সমাজ বিরোধীদের উৎখাত করতে জনগণের সহযোগিতা কামনা-বঙ্গবন্ধু
ফরিদপুর। বন্দুকের নল নয়, জনগণই আমার ক্ষমতার উৎস। আমি শুধু জনগণের ওপর নির্ভর করি। দেশের সমগ্র জনগণের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টনই আমার সরকারের লক্ষ্য। এভাবেই গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী লাখো লাখো মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন করা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ এখানে কলেজ ময়দানে এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রীত্বের গদী তার কাছে বড় কিছুই নয়। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে এলাম। দেখলাম, ইয়াহিয়ার বর্বর সেনারা আমার বাংলাকে ধ্বংস করে ভেঙে তছনছ করে গেছে। এই ধ্বংস স্তুপ থেকে দেশকে পুনর্গঠন করার ইচ্ছা নিয়ে দেশ শাসণের দায়িত্ব গ্রহণ করি। জনগণ যদি আমাকে সমর্থন না করে আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেব। আমি কি নির্বাচনে দাঁড়াব। আপনারা কি আগামি নির্বাচনে আমাকে সমর্থন করবেন। বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নের জবাবে বিপুল জনসমুদ্র তুমুল হর্ষধ্বনি আর গগনবিদারী কণ্ঠে ‘জয় বাংলা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ প্রভৃতি ধ্বনি দিয়ে হাত তুলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সমর্থন জানায় এবং তাকে নির্বাচনে দাঁড়াতে অভিনন্দন জানায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, উৎপাদন বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চাষের জমিতে পানি সেঁচ করার জন্য এই বছর ১১ হাজার পাম্প বণ্টন করা হয়েছে। খাদ্য ঘাটতি দূর করতে হলে উৎপাদন আপনাদের বাড়াতে হবে। এ বছর খাদ্য শস্যের পরিমাণ ৮ কোটি মণ। এ রকম ঘাটতি ভয়াবহ। আমাদের অর্থনীতি এতে গুরুতর ক্ষগ্রিস্ত হবে।
যারা চেটেপুটে খায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে : যারা সবকিছু চেটেপুটে খায় তাদের। বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। দেশ থেকে সমাজবিরোধীদের উৎখাত করতে হলে জনসাধারণের সাহায্য দরকার। চোর ডাকাত দুস্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব কি না। বঙ্গবন্ধুর এই প্রশ্নে উত্তরে জনগণ হাত তুলে তাকে সমর্থন করে। বঙ্গবন্ধু বলেন, মত ও পথ বদলিয়ে ফেলুন জনগণের সেবা করুন। এই জনগণই আপনাদের বাবা চাচা ভাই। সাবধান। দুর্নীতি করবেন না। আলসেমী ছাড়েন। জনতাকে বলেন, শান্তিতে জীবন যাপন করতে হলে দুস্কৃতিকারী আর ডাকাতদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করেন। বিশেষ করে ফরিদপুর বাসীকে লক্ষ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেন, এই জেলাতে জন্মেছি, এখন আমি সারা বাংলাদেশের নাগরিক। সব এলাকার মানুষ এখন আমার কাছে সমান। এর আগে এখানে আসতে পারি নি। আশা করি আবার ফরিদপুরে আসব।
বিদেশী সাহয্যপুষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের সম্পর্কে : কতিপয় রাজনৈতিক দলকে লক্ষ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেন, কতিপয় দেশের গোপন তহবিলের সাহায্যপুষ্ট কতগুলো রাজনৈতিক দল হীন প্রচার চালাচ্ছে, কাণ্ডজ্ঞান বিবর্জিত কথাবার্তা বলছে। আপনারা আগামি নির্বাচনে সমুচিত শিক্ষা দিয়ে দিন।
ভুট্টোর প্রতি : পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের প্রশ্নে তিনি বলেন, ভুট্টো সাহেব আপনার নেতা গোলাম মোহাম্মদ, চৌধুরী মুহাম্মদ আলী, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের সাথে লড়েছি। আপনি তো নাবালক, আপনাকে আমি থোড়াই পরোয়া করি। সেখানে ৫ লাখ বাঙালিকে আপনি আটকে রেখেছেন। আপনার সাথে কথা বলার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ আর যারা প্রাণ দিল, যাদের সম্মান হানি হলো আমরা তাদের ভুলব না। সরকার তাদের ভুলতে পারে না। তারা আমার সন্তান। তারা আমার বোন। আমাকে তাদের দেখতেই হবে। যে মুক্তিযোদ্ধারা পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছেন সরকার তাদের কল্যাণের জন্য ৪ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে।
কেন রাজনীতি করি : এনার খবরে প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশবাসীকে সুখী করা, তাদের জীবনে স্বস্তি আনা এবং তাদের মুখে হাসি ফোটানোই তার জীবনের আকাক্সক্ষা। লাখো লাখো ক্ষুধার্ত মানুষ আহার পাবে, রোগের চিকিৎসা পাবে, শিক্ষার আলো পাবে, এজন্যই রাজনীতি করি। আজ দেশে চরিত্রবান মানুষই দরকার। যারা সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারে।
সংবিধান পেয়েছেন : শাসনতন্ত্রের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ২৫ বছর ধরে যে অধিকারের জন্য আপনারা লড়েছেন সংবিধানে সেসব অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এখন কেউ আপনাদের অধিকার কেড়ে নিতে পারবে না।
বাংলার মাটিতেই ওদের বিচার হবে : বর্বর পাকিস্তান হানাদাররা আমার দেশের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, সেতু ধ্বংস করেছে, ধানক্ষেত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, মান-বোনদের সম্মানহানি করেছে। ওরা অপরাধী, বাংলার মাটিতেই ওদের বিচার হবে। কোনো রকম চাপে এই সিদ্ধান্ত পাল্টোনোর প্রশ্ন ওঠে না। এই সময় বজ্রগম্ভীর কন্ঠে তিনি বলেন পাকিস্তান বাংলাদেশের প্রতিবেশি রাষ্ট্র হলে দেখতাম, ভুট্টো সাহেব কি করে বাঙালিদের আটকে রাখেন। আফসোস। পাকিস্তানি দেড় হাজার মাইল দূরে। সাড়ে সাত কোটি মানুষ আমাকে জাতির পিতা করেছে। জাতির পিতার কাছে প্রধানমন্ত্রীত্ব অতি তুচ্ছ বস্তু। তবুও ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশকে গড়ে তোলার জন্যই প্রধানমন্ত্রীত্বের দায়িত্ব নিয়েছি। তিনি বলেন, আমার অস্ত্র জমা দেয়ার ডাকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা সাড়া দিয়েছে। এখন ডাকাত, গুন্ডা, বদমাস,আর সমাজবিরোধীর হাতেই অস্ত্র আছে। কিন্তু কি করে এসব অস্ত্র আদায় করতে হয় তা আমি জানি। দেশের প্রতিটি আনাচে কানাচে দিয়ে এসব অপরাধীকে খুঁজে বের করার জন্য তিনি পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীকে আদেশ প্রদান করেন।
স্বাধীনতা নস্যাৎ করতে দেব না : কাউকে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা নস্যাৎ করতে দেব না। জনতার সাথ বেইমানি করতে পারব না। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের টোপ দেয়া হয়েছিল, আমি জনতার স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে তা নেই নি। আজ বাংলাদেশের মাটিতে পতপত করে স্বাধীন পতাকা উড়ছে। ৯৭টি দেশ একে স্বীকৃতি দিয়েছে। আর ইয়াহিয়ার সৈন্যরা আজ আমার হাতে বন্দি। পাকিস্তান এবং আরও কতিপয় দেশের এজেন্টরা জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কাজ করছে। এদের প্রতিরোধ করা হবে। যেমন প্রতিরোধ করেছি ইয়াহিয়ার সামরিক একনায়কত্বকে।
সামর্থ অনুযায়ী চেষ্টা করছি : প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৩ বছর কিছু দিতে পারব না বলেও সামর্থ অনুযায়ী কিছু দেয়ার চেষ্টা করেছি। খাদ্য শস্য বিদেশ থেকে এনেছি। দুর্নীতিবাজরা তা চেটে খেয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগ প্রধান জনাব সামসুদ্দীন মোল্লা সভায় সভাপতিত্ব করেন। আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান সভায় বক্তৃতা দেন।৯৮
রেফারেন্স: ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭২, দৈনিক ইত্তেফাক
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ