জনগণের কল্যাণে মত ও পথ বদলাও- বঙ্গবন্ধু
ধ্বংসস্তুপের ওপর সুখী ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে কাজ করার জন্যে জাতির পিতা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশবাসীর প্রতি পুনরায় আহ্বান জানিয়েছেন। জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, শুকুনেরা এখনো উড়ছে, শত্রুরা ঘুমিয়ে নেই। তিনি বলেন যে, স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্যে চেষ্টা চলছে; সাম্প্রদায়িকতাকে খড়াবার অপচেষ্টা চলছে। পুঁজিপতি শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাচ্ছে। দুস্কৃতিকারীরা শান্তিকামী জনগণকে শান্তিতে ঘুমতে দিতে চাচ্ছে না। চক্রান্তকারী দুস্কৃতিকারীদের এই খেলাকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্যে বঙ্গবন্ধু জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমিও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করব; বাংলার মানুষ আমার পাশে আছে। বাংলার মানুষকে আমি যতটা জানি আর কেউ তা জানে না। রবিবার সকালে গণভবনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কর্মীদের আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিচ্ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলোতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারিত অনুষ্ঠানসমূহের ওপর ভিত্তি করে একটি বিশেষ অধিবেশন বঙ্গবন্ধু ও সুধী মন্ডলীর উপস্থিতিতে গণভবন থেকে বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্র সরাসরি প্রচার করে। বাংলাদেশ বেতারের অন্যান্য কেন্দ্র থেকে তা রিলে করা হয়। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন। এত রক্তপাত ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের পরও কেউ কেউ এখনও তাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে পারে নি। বঙ্গবন্ধু বলেন, তিনি কারও ক্ষতি করতে চান না। তিনি শুধু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছেন এবং আশা করছেন যে বাংলাদেশের সুখী মানুষের কল্যাণের জন্যে এদের মনোভাবের পরিবর্তন হবে। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি তাদেরকে তার সরকার সুযোগ দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, এইসব লোক দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য যদি তাদের মত ও পথ পরিবর্তন না করে তবে জনগণ তাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তা প্রয়োগ করবেন। বাংলার মানুষ তাদেরকে চরম আঘাত আনবে। বঙ্গবন্ধু বলেন, তিনি চিরদিন বাংলার সুখী মানুষের পাশে রয়েছেন এবং থাকবেন। গভর্নরগিরি ও মন্ত্রীত্বের পদ গ্রহণের প্রস্তাব অতীতে তাকে বহুবার দেয়া হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীত্বও তার জন্য কিছু নয়, যে কোনো মুহূর্তে প্রয়োজন হলে ছেড়ে দিতে পারেন। তার কাছে বড় জিনিস হলো বাংলার সুখী মানুষ। মনোভাব এখনও যারা পরিত্যাগ করেনি তাদেরকে এই দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য জাতির পিতা হিসাবে, বঙ্গবন্ধু হিসাবে, প্রধানমন্ত্রী মত ও পথ পরিবর্তনের জন্যে আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে যে লক্ষ লক্ষ লোক প্রাণ দিয়েছে তারা আর ফিরে আসবে না। কিন্তু যারা বেঁচে রইল তারা সবাই যেন স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে পারে তার জন্যে বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মকভাবে সবাইকে কাজ করার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, বর্বর পাকিস্তানি দসূরা নানাভাবে নানান কৌশলে দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ শোষণ করেছে। এর আগে ২০০ বছর শোষণ করেছে বৃটিশ শাসক গোষ্ঠী। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, বাংলাদেশের সম্পদ নিয়ে বহু দেশ সম্পদশালী হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশ চিরদিন ছিল দুর্দশাগ্রস্ত। ছিল খাদ্যের অভাব। জনগণ ছিল পদানত। বঙ্গবন্ধু বলেন, শত্রুরা দেশকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে তাকে এখন নতুন করে গড়তে হবে। জনগণ যাতে ভাত কাপড় পায় তার জন্যে জাতি গঠনের মহান ব্রত নিয়ে কাজ করে যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, সোনার বাংলা সত্যিই সোনার বাংলা। সোনার মতো মন অন্তর জনগণের আর কোথাও নাই। তাই বঙ্গবন্ধু দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলেন যে, একদিন সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। স্বাধীনতার সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসকে পাশাপাশি রেখে ভবিষ্যৎ বংশধরেরা যাতে প্রেরণা লাভ করতে পারে; তারা যেন সঠিক ইতিহাস জানতে পারে সে ব্যাপারে কাজ করে যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, স্বাধীনতার সংগ্রাম এক দিনে জন্ম লাভ করেনি। ২৫ বছরে নানা কৌশলে জাতীয়তাবাদ আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের এই ইতিহাসের সঠিক তথ্য যাতে ভবিষ্যৎ বংশধরেরা জানতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ২৫ মার্চ পূর্ববর্তী অসহযোগ আন্দোলনকালীন একটি তথ্য জানান। তিনি বলেন যে, জনগণের প্রতি শেষ ডাক যেন তিনি দিয়ে যেতে পারেন। এই জন্যে প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. নূরুল্লাকে একটি রেডিও ট্রান্সমিটার বানিয়ে দেয়ার জন্যে বলেছিলেন, কিন্তু হানাদারেরা সেই ট্রান্সমিটার ব্যবহার করার সুযোগ বঙ্গবন্ধুকে দেয়নি। এরপর ২৫ মার্চ রাতে তিনি। স্বাধীনতার ঘোষণা সম্মলিত শেষ বাণী চট্টগ্রামে পাঠান। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। তার শব্দ সৈনিকদের ইতিহাস সৃষ্টিকারী সংগ্রামী প্রশংসার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন যে, তারা যখন এগিয়ে এসেছিলেন তারা অনেকেই ভাবতে পারেনি এতো শীঘ্র স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হবে। যে প্রাণ ও প্রেরণা এবং আত্মত্যাগ নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মীরা কাজ করে গেছেন তেমনি প্রেরণা ও অধিকতর কর্তব্যবোধ নিয়ে রাষ্ট্রীয় চার নীতির ভিত্তিতে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগের জন্যে তিনি শব্দ সৈনিকদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, কেউ তাদের কণ্ঠরোধ করতে পারবে না।৯০
রেফারেন্স: ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭২, দৈনিক ইত্তেফাক
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ