You dont have javascript enabled! Please enable it!

৭ মার্চের নির্বাচন হবে অবাধ ও নিরপেক্ষ – বঙ্গবন্ধু

মানুষ শান্তি চায়। আমার নিকট তারা ভাত চায় না, চায় শান্তিতে ঘুমাতে। কিন্তু এক শ্রেণির দুষ্কৃতকারী ও সমাজ-বিরোধীদের জন্য মানুষের শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে। তারা শান্তিতে ঘুমাতে পারছে না।” জাতির জনক প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ কথার উল্লেখ করে শনিবার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিজয় দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত জনসমাবেশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত বাংলার পবিত্র মাটিতে চোর-গুন্ডা, ডাকাত-দুষ্কৃতকারী, সমাজবিরোধীদের কোনো ঠাই থাকবে না। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, “আগামি ৭ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এবং এই নির্বাচন হবে অবাধ ও নিরপেক্ষ। এই জন্য নির্বাচন কমিশনকে ইতোমধ্যেই যথার্থ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। যারা ক্ষমতা চান তারা এই নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় আসতে পারেন।” শান্তি ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতির পুনরুল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু,বলেন, দুষ্কৃতকারী ও সমাজবিরোধী দের নির্মূল করার জন্য এই মাসের মধ্যেই প্রতি মহকুমায় রক্ষিবাহিনী প্রেরণ করা হবে। তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে চোর-ডাকাত, গুন্ডা-বদমায়েশ, দুষ্কৃতকারী ও সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করবে। বঙ্গবন্ধু আরো বলেন যে, প্রয়োজন হলে সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতকারীদের দমনের জন্য গ্রামে গ্রামে সেনাবাহিনী প্রেরণ করা হবে। এই ব্যাপারে তিনি সরকার এবং রক্ষীবাহিনীর সাথে সহযোগিতা করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আকুল আহ্বান জানান। বাংলাদেশের প্রথম বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে শনিবার অপরাহ্নে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়োজিত এক বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিচ্ছিলেন। উল্লেখযোগ্য যে, এই জনসমাবেশে বাংলাদেশের দূরবর্তী জেলাসমূহ হতে হাজার হাজার কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আগমনের পূর্বে বিদ্রোহী কবির পুত্র কাজী সব্যসাচী ‘বিদ্রোহী কবিতা আবৃতি করেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার পূর্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পৌছলে আওয়ামী সেচ্ছাসেবকবাহিনী। তাকে অভিবাদন জানায়। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী সেচ্ছাসেবকবাহিনীর একটি টুপি পরিধান করে এই অভিবাদন গ্রহণ করেন। আওয়ামী সেচ্ছাসেবকবাহিনীর প্রধান জনাব আব্দুর রাজ্জাক প্রধানমন্ত্রীকে এই টুপিটি পরিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, গ্রামের মানুষ চোর, গুন্ডা, বদমায়েশদের জন্য রাতে ঘুমাতে পারে না। মানুষ ভাত চায় না রাতে শান্তিতে ঘুমাতে চায়। এই পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী তেজোদৃপ্ত কণ্ঠে বিশাল জনসমুদ্রের উদ্যেশ্যে জিজ্ঞাসা করেন, “আমি জানতে চাই, এইসব সমাজবিরোধী ব্যক্তিকে যদি কঠোর হস্তে দমন করা হয়। তাহলে আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন কিনা।” প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠ হতে এই উক্তি নিঃসৃত হতে না হতেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসমুদ্র গর্জে ওঠে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন।
বাংলার মাটিতেই বিচার হবে : প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসমাবেশে বিভিন্ন মহল কর্তৃক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কীত জল্পনা-কল্পনা ও সন্দেহের নিরসন করে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের মাটিতেই হবে। তিনি আগামি নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে জনসমাবেশের ম্যান্ডেট গ্রহণ করেন। বিশাল জনসমুদ্র বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবিচল ও ইস্পাত দৃঢ় আস্থা ঘোষণা করে আগামি নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে রায় দেন।
কালাকানুন বাতিল-বঙ্গবন্ধু জনসমাবেশের গগণবিদারী স্লোগান ও করতালীর মধ্যে ঘোষণা করেন যে, আজ হতেই বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্সসহ সকল কালাকানুন বাতিল হলো। বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পুনরায় ঘোষণা করেন যে, কলকারখানা জাতীয়করণ কোনো ক্রমেই বাতিল করা হবে না। জণগণের সম্পত্তি ব্যক্তি মালিকানায় অর্পণের ক্ষমতা তার নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সন্দেহ পোষণকারীদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। এবং কেউ তা ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। তিনি শ্রমিক ও কৃষকগণকে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আকুল আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু দুর্নীতিবাজ ও সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, এরা আমার গরিব মানুষের হক লুটে খায়। আমি বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র হতে ভিক্ষা করে গরিব মানুষদের জন্য জিনিসপত্র জোগার করে আনি; আর দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিরা তা লুটে খায়। এরা জিনিসপত্র, চাউল, কাপড়, ঔষধপত্র গুম করে ফেলে। তিনি এসব সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের রুখে দাঁড়াবার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, জনগণের সহযোগিতা ছাড়া কোনো সরকারের পক্ষে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়। যারা আওয়ামী লীগ কর্মীদের দুর্নীতির সমালোচনা করেন, তাদেরকে তিনি আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখবার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন যে, দুর্নীতির দায়ে আওয়ামী লীগের এম, সি, এ ও কর্মীকে দল হতে বহিষ্কার করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ হতে বহিষ্কার করার পর অন্য দল এইসব বহিস্কৃত ব্যক্তিকে ‘হিরো’ সাজিয়ে দলভুক্ত করে নেন। এসব দল হাজার হাজার টাকা ব্যয়ে সম্মেলন করার অর্থ কোথায় পায় তা তিনি জিজ্ঞাসা করেন। তিনি বলেন, এসব দলই বিপ্লবের বড় বড় কথা বলে। আগামি নির্বাচনের পর এইসব ‘লাল ঘোড়াকে দাবিয়ে দেয়া হবে। তিনি বলেন, এই লম্বা চুল ও দাড়িওয়ালা অতি বিপ্লবীরা গাড়ী হাইজ্যাক ও লুটপাট করে বেড়ায় আর অতি-বিপ্লবী স্লোগান দিয়ে বেড়ায়। তিনি বলেন, জনগণ আমাকে জাতির পিতা বলেন, যদি প্রধানমন্ত্রী হতে পারতাম তাহলে এদের দমন করতে কষ্ট হতো না। তিনি আরো বলেন, জনগণকে ভালবেসে আমি রাজনীতি করি, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতি করি নাই। যেদিন দেখবো জনগণ আমাকে ভালবাসে না, সেদিন ক্ষমতা লাথি মেরে জনগণের কাছে ফিরে যাব। তিনি বলেন, জুলুম করি নাই। জুলুম কাকে বলে দেখেন নাই। আমরা সকল অকথ্য জুলুম নির্যাতন ভোগ করেছি। আজ যারা বড় বড় কথা বলেন তাদের অনেকেরই তখন জন্ম হয় নাই। আমার শত শত কর্মীকে খুন করা হয়েছে। খুনের জবাব কীভাবে দিতে হয় তা দেখিয়ে দিতে পারে। গত ২৪ বছর আমার কোনো কর্মীর গায়ে কেউ হাত দিতে পারে নাই। আমি ক্ষমতায় আছি বলেই আজ আমার কর্মীদের খুন করা সম্ভব হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, এখনো বাংলাদেশে পাকিস্তানি দালালদের খেলা চলছে। এরা পাটের গুদামে আগুন লাগিয়ে থাকে বলে তিনি অভিযোগ করেন। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সমস্যার প্রতি আলোকপাত প্রসঙ্গে গত এক বছরে কপর্দকহীন অবস্থায় সরকারের বিভিন্ন পুনর্গঠনমূলক কাজের বিবরণ দান করেন। তিনি জানান যে, আগামি জুন মাসে ভৈরব সেতু চালু হবে। জাতিসংঘের উদ্যোগে চালনা বন্দর বিপদমুক্ত এবং এর উন্নয়ন কার্য করা হচ্ছে।
পররাষ্ট্র নীতি প্রসঙ্গে : পররাষ্ট্র নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, বাংলাদেশ সকল দেশের সাথে বন্ধুত্ব চায়। আমরা ছোট রাষ্ট্র হতে পারি কিন্তু আমাদের ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ সহ্য করা হবে না। আমরা কোনো রাষ্ট্রের ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করতে চাই না। তিনি অস্ত্র প্রস্তুতের প্রতিযোগিতা বন্ধ করে প্রস্তুতের অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের মধ্যে ব্যয় করার জন্য বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি আহ্বান জানান।
বিরোধী দলের প্রতি : প্রধানমন্ত্রী সরকারের সমালোচনায় কেবল মত্ত না থেকে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সেবা করার জন্য বিরোধী দলসমূহের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন যে, আওয়ামী লীগ আইয়ুব-ইয়াহিয়ার শাসনামলে সরকারের বিরোধীতা করা সত্ত্বেও জনগণের দুর্দিনে চাদা উঠিয়ে জনগণকে সাহায্য করেছে। তিনি এই প্রসঙ্গে ১৯৭০ সালের বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড়ের সময় আওয়ামী লীগের সাহায্যের কথা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধু তার সরকারের বিভিন্ন অবদানের কথা উল্লেখ প্রসঙ্গে বলেন যে, বিপ্লবের পর কোনো দেশে মাত্র এগারো মাসের মধ্যে সংবিধান দেয়ার দৃষ্টান্ত নাই। তিনি জানান এ পর্যন্ত সরকার বিভিন্ন দেশ হতে ৩ শত ৯ কোটি টাকা সাহায্য এবং ১ শত ৭৫ কোটি টাকা ঋণ লাভ করেছে। বঙ্গবন্ধু সরকারি কর্মচারী গণকে মানসিকতার পরিবর্তন করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এটা আইয়ুব-ইয়াহিয়ার সরকার নয়, তাই জনগণকে ফাকি না দিয়ে আন্তরিকতার সাথে কাজ করুন। আপনাদের অসুবিধা আমরা দেখব।৬১

রেফারেন্স: ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২, দৈনিক বাংলা
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!