You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভাঙ ভাঙ কারা  আঘাতে আঘাতে কর

বাংলাদেশের দিকে দিকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনা বাহিনী বীরদর্পে এগিয়ে চলেছে। এই সম্মিলিত আক্রমণের সামনে পাক হানাদারেরা হয়েছে দিশাহারা হয়েছে বিভ্রান্ত-বিপর্যন্ত। একের পর এক ঘাঁটি ছেড়ে তারা পালাচ্ছে। মাত্র নয় মাস আগে বাংলাদেশ ছিল বাঙালীর রক্তে লাল; বাঙালীর মৃতদেহের পাহাড়ের আড়ালে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য পড়েছিল ঢাকা। আজ তার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা। যশাের-ঝিকরগাছা-মাগুরা  নারায়ণগঞ্জ-কুমিল্লা ইত্যাদি বহুস্থানে, পথে-প্রান্তরে ছড়ানাে রয়েছে পাঞ্জাবী পাকসেনার মৃতদেহ-ভীতসন্ত্রস্ত পাকসেনা গাড়ী করে পালাতে গিয়ে দিগ্বিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে রাস্তার ধারের গাছে মেরেছে ধাক্কা। লেঃ জেঃ নিয়াজী পালিয়েছেন ঢাকা ছেড়ে পিণ্ডিতে। পাক ঘাতকেরা কপাল চাপড়ে বলছে, ‘হায় আল্লা, নসীবে এ-ও ছিল। সামান্য বাঙালী, তার হাতে খেতে হলে মােক্ষম মার!’ অপরদিকে মুক্তিবাহিনী করে চলেছে চরম আঘাত। তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছে ভারতীয় স্থল-নৌ-বিমানবাহিনী, জলে-স্থলে অন্তরীক্ষে একযােগে আক্রান্ত হয়েছে পাক হানাদারেরা।  ফলত; যা অনিবার্য তাই ঘটছে। প্রত্যহ পতন হচ্ছে বহু পাক ঘাঁটির। এত দ্রুতগতিতে এতাে বেশি জয়লাভ করেছে মুক্তি বাহিনী ও মিত্রবাহিনী, যে তার সুসম্বন্ধ সম্পূর্ণ বিবরণ দেওয়া অসম্ভব। বিগত সপ্তাহে দিনের পর দিন যা ঘটেছে, তার সামান্য মাত্র আভাস এখানে দেওয়া হলাে। রণাঙ্গন অনুসারে সাজানাে সম্ভবপর হলাে না :

৬ই ডিসেম্বর ৬ই ডিসেম্বর, সমস্ত বাংলাদেশ জুড়ে এখন মুক্তিবাহিনীর অবাধ গতিবিধি  গত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমাদের মুক্তিবাহিনী লালমনিরহাট থেকে খানসেনাদের রক্তে মাটি ভিজিয়ে সৈয়দ পুরের দিকে বীর বিক্রমে আক্রমণ করেন। এদিকে অন্য আরেক দল মুক্তি বাহিনী আমাদের মিত্র শক্তির সাহায্যে সিলেট জেলা কুলাউড়া কে শত্রু মুক্ত করেন এবং মৌলভী বাজারের দিকে বিনা বাধায় এগিয়ে যান। গত ৫ই ডিসেম্বর আমাদের বীর মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা জেলার চাঁদপুরের দিকে এগিয়ে যান, এবং ঐ একই জেলায় অবস্থিত ব্রাহ্মণবেড়িয়া উপ শহরটিকে তিন দিক দিয়ে আক্রমণ করেন। এই আক্রমণে। মিত্র শক্তি আমাদের মুক্তিবাহিনীকে যথেষ্ট সাহায্য করেন।  এদিকে নােয়াখালি জেলার ফেণী শহরে খান সেনারা তাদের অতি আবশ্যকীয় জিনিষপত্রাদিও সঙ্গে নেবার ফুরসৎ পায় নাই। এখানে মুক্তিবাহিনীর হঠাৎ আক্রমণে খান সেনাদের বেশিরভাগ অংশকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয়।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের উত্তর পূর্ব-সীমান্তে ময়মনসিংহ জেলায় কমলপুর, বক্সীগঞ্জ এবং রাজেন্দ্রগঞ্জ প্রায় বিনা বাধায় আমাদের মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এই জেলায় অবস্থিত অধিকাংশ খান সেনারা জামালপুরে আসে। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আঘাতে খান সেনারা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এদিকে কুষ্টিয়া জেলায় বীর মুক্তিবাহিনী মিত্রশক্তির সাথে কাঁধ মিলিয়ে চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া শহর মুক্ত করার জন্য দুর্বার জলস্রোতের মত আঘাত হেনেছে। এখানে মুক্তিবাহিনীর বিচ্ছু ফৌজেরা অতি চমকপ্রদ ঘটনার অবদান করেন। এই জেলায় অবস্থিত দর্শনা গত ৫ ডিসেম্বর খান সেনা মুক্ত হয়। এখানে প্রচুর রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। এইমাত্র খবর পাওয়া গেল যে রাজশাহী জেলার শারদা, মীরগঞ্জ এবং এলাইপুর থেকে পাক জঙ্গী বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে আমাদের মুক্তিবাহিনী সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ৭ই ডিসেম্বর। মিত্র শক্তির সাহায্য এবং অবদানে আমাদের মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের শত্রু সেনার সব চেয়ে বড় ঘাঁটি যশাের ক্যান্টনমেন্ট অবরুদ্ধ করে রাখেন। ৮ই ডিসেম্বর ৮ই ডিসেম্বর আমাদের বীর মুক্তিবাহিনী মিত্রবাহিনীর সাথে এক জোট হয়ে ঢাকা শহরকে চারপাশ থেকে। 

নাগপাশে অবরুদ্ধ করে ফেলেছেন। এবং কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সাতক্ষিরা এবং মাগুরায় স্বাধীন। পতাকা উত্তোলন করেছেন। ৯ই ডিসেম্বর। ৯ই ডিসেম্বর, ঢাকা শহরে অধিষ্ঠিত বাংলাদেশ নরমেধ যজ্ঞের নায়ক জেনারেল নিয়াজী ও তাকে সাহায্যকারী কয়েকজন খুনী প্রধান তাদের অনুচরদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়ে প্রাণ বাঁচানাের চেষ্টায় একটি পশ্চিম পাকিস্তানী বুয়িং বিমানে চড়ে চম্পট দেয়। এই দিনের সুখের খবর কুমিল্লা শহর আমাদের দখলে। ময়নামতী সেনানিবাস প্রায় শত্রুমুক্ত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত। যশােরের মাগুরা এবং খুলনার সাতক্ষীরা স্বাধীন। উত্তর পূর্ব রণাঙ্গনে সৈয়দপুরের উত্তর ভাগ শক্র কবল মুক্ত এবং অন্য অংশও মুক্ত হতে চলেছে। পূর্ব খণ্ডে আমাদের বীর মুক্তি বাহিনী চট্টগ্রামের রামগড় এলাকায় শেষ শত্ৰুটিকে পর্যন্ত যমালয়ে পাঠিয়ে সেখানে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। এদিন যে যে স্থানগুলি শত্রু কবলমুক্ত হয় সেগুলি হল, যশাের খুলনা এলাকায় রূপদিয়া ও লেবুতলা। কুমিল্লা এলাকায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া। শ্রীহট্টে শ্রীমঙ্গল ও রংপুর, দিনাজপুর এলাকায় দুর্গাপুর ও বাহড়িয়া অঞ্চল। এখানে সর্বত্রই মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে শত্রুসেনা সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত হয়। ১০ই ডিসেম্বর। ১০ই ডিসেম্বর মুক্তির আলােয় উদ্ভাসিত চুয়াডাঙ্গা, বিজয়ী মুক্তিবাহিনীর পতাকা উড়ছে চাদপুরে। কুষ্টিয়ার উপকণ্ঠও মুক্ত। রংপুর এবং দিনাজপুর প্রায় মুক্ত। উত্তর পূর্ব আশুগঞ্জ ফেরিঘাট এখন মুক্তিবাহিনীর দখলে। ময়মনসিংহ অঞ্চলে আমাদের বীর মুক্তিবাহিনী জামালপুর ঘিরে ফেলেছেন এবং প্রায় পতনের মুখে ঠেলে এনেছেন। এদিকে পদ্মা মেঘনা ও যমুনার তীর ধরে আমাদের বীর যােদ্ধারা ঢাকার সমগ্র অঞ্চল ঘিরে ফেলেন। এদিন মিত্র-নৌ-সেনারা বঙ্গোপসাগরের সন্নিকটে পাক সৈন্য ভর্তি। দুখানা জাহাজ আটক করেন। কিছু খান সেনা ইদুরের মত পদ্ম এবং মেঘনার তীরে বীর যােদ্ধাদের অস্ত্রের ঘায়ে পিষ্ট হয়ে মরছে। এদিকে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট এবং ময়নামতী দুর্গেও খান সেনাদের অবস্থা একই রকম। ১১ই ডিসেম্বর। ১১ই ডিসেম্বর আমাদের বীর মুক্তিবাহিনী খুলনা জেলার চালনা ও মঙ্গলা বন্দর বীর বিক্রমে দখল করে নেয়। মুক্তিবাহিনী অপূর্ব কৃতিত্বের সাথে এদিন নােয়াখালি মুক্ত করেন। নােয়াখালি জয়ের খবর খুবই উল্লেখযােগ্য। যশাের খণ্ডে রূপদিয়া, চেঙ্গুটিয়া, হরিশঙ্করা, ও ডাঙ্গামারা এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। এবং ফুলতলাও মুক্ত হতে চলেছে। ঢাকা বেতার কেন্দ্র নিস্তব্ধ রকেট আক্রমণে ঢাকাতে পাক বাহিনীর মিথ্যা সংবাদ প্রচারের বেতার কেন্দ্রটি স্তব্ধ হয়ে গেছে। খবরে জানা গেছে, বেতার কেন্দ্রের তিনটি ট্রান্সমিটারই সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত।

 বিপ্লবী বাংলাদেশ | ১: ১৭।

১২ ডিসেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!