You dont have javascript enabled! Please enable it!

শত্রু পরিত্যাক্ত ভালুকা

বাংকার, বাংকার, শুধুই বাংকার। যেদিকে তাকানাে যায়, চোখে একটা না একটা বাংকার পড়বেই। ভালুকার কুলাঙ্গার চান মিয়ার বাড়ীর উঠোনে তেমনি একটা বাংকার চোখে পড়লাে। এতাে চমত্তার ভাবে তৈরী এ বিবরটি যে, দিনের পর দিন এতে আশ্রয় নিয়ে থাকলেও বিপদের এতােটুকু সম্ভাবনা নেই। বাড়ীটির পশ্চিমদিকেও চার খানা বড় বড় বাংকার। এ সবের মধ্যে থাকা খাওয়া সবকিছুই চলতে পারে। এ থেকে বেরিয়ে নিরাপদে পালাবার পথও তৈরী রয়েছে। এক কথায় বাড়ীটি এতাে সুরক্ষিত যে, একে একটা দুর্গ বলা চলে; ছাদের উপরও বাংকারের অস্তিত্ব তারই প্রমাণ। বাড়ীটি থেকে বেরুলেই সামনে নদী। খেয়াঘাটের উপর রাস্তার মুখে বাংকার। দূর থেকে বুঝা যায় ওখানে কোন শত্রু ঘাঁটি আছে কিনা। আর একটু পেরিয়েই কিছু বেড়ার ঘর, যেখানে রেজাকাররা থাকতাে তাদের পরিবার নিয়ে। পরিবার পরিকল্পনা দপ্তর, সাব-রেজিষ্টার অফিস এ সমস্ত ঘরগুলােও একই কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে ওখানে পড়ে রয়েছে চাল, ডাল, মরিচ। কোন জায়গায় পড়ে আছে রান্না করা খাবার খেয়ে নেবার সময় টুকুও পায়নি—পালাতে হয়েছে পাক সেনাদের পা-চাটা পােষা কুকুরের মত।  বাজারের পশ্চিম অংশে বহু বাংকার আর শেলটার। দক্ষিণে ঈদগাহ মাঠটিও বিরাট বিরাট বাংকারে পরিপূর্ণ। মসজিদের দক্ষিণ পাশে দুখানা বাংকার জোড়া লাগানাে; এক একটাতে গােটা পরিবার নিয়ে বাস করা যেতে পারে। বাজারের পর থানা। থানার পশ্চিম দিকে সুউচ্চ মাটির বাঁধ, বাঁধের আড়ালে বাংকার। মাত্র কদিন পূর্বেই একটি দালান তৈরী হয়েছে দশ ইঞ্চি পুরু দেয়ালে; পশ্চিমের দেয়ালটায় গুলি করার জন্যে ফোকর রাখা হয়েছে। শুধু থানাটিকে ঘিরেই পশ্চিমে বড় বড় ১০ খানা, দক্ষিণে ৭টা পূর্বেও ১০ খানা ও উত্তরে ৪টি বাংকার। থানা এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে মাটির নীচে একটি ঘর। ঘরটিতে চেয়ার, টেবিল, তক্তপােষ সবই পাতা রয়েছে। শােনা গেল পাক হানাদারেরা ওখান থেকে ওয়ারলেসে খবর পাঠাত। একটা ব্যাপার খুব অবাক হবার মত–পালিয়ে যাবার পূর্ব মুহূর্তে ওরা প্রতিটি অফিসের কাগজপত্রগুলাে নষ্ট করে দিয়ে গেছে। থানার অফিস কক্ষেও একই কাণ্ড, কাগজপত্র নষ্ট অবস্থায় ইতস্ততঃ ছড়ানাে।

থানার পূর্ব পাশ দিয়ে হাইওয়ে। গােটা হাইওয়েটাই বাংকার ও ট্রেন্সে একাকার। এসব দেখে। স্বভাবতঃই মনে ভয় জাগে, নিরাপত্তার এতাে সুন্দর বন্দোবস্ত থাকা সত্বেও শত্রুরা পালিয়ে গেলাে কেন? মেজর অফিসারের কাছে এ প্রশ্নের জবাব মিললাে। তিনি বললেন, এক মাস যাবৎ আমরা তাদের | এমনভাবে অবরােধ করেছিলাম যে, তাদের খাদ্য, পানীয় এবং সকলরকম সরবরাহের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সামরিক পট পরিবর্তনের। সামনে ওরা দিশেহারা হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। | শত্রুর তৈরী একটা বাংকারে বসে বসে বিষয়টি লেখা চলছিলাে। ভালুকা থানার রেভিনিউ সার্কেল অফিসার বললেন, পাক সেনারা ভালুকায় আসার দু’দিন পর আমাকে জোর করে ধরে এখানে আনা হয়। এরপর এখানে যা দেখেছি তা প্রকাশ করতে সংকোচ লাগে। চান মিয়ার সুযােগ্য পুত্র ধনু মিয়া এখানে না থাকলে এ অঞ্চল এতােটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতাে না। ধনু ও তার সঙ্গীরা একদিন ১৯ জন নারীর ওপর পাশবিক উৎপীড়ন চালায়।  

চান মিয়া যাকে লােকে একসময় সমীহ করে কথা বলতাে, পাক জঙ্গী চক্রের সেই বিশ্বস্ত কর্তা আজ নেই। তার বিশাল বাড়ীটা সমস্ত কুকীর্তির সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক ঐশ্বর্য আর আসবাবপত্র গড়ে উঠেছিলাে বাড়ীটাতে, যে ঐশ্বর্যের পরতে পরতে মানুষের রক্ত, ভারী ভারী গদিজোড়া আসন, যাতে গা রাখিলে আবেশে চোখ আপনি বুজে আসে—আলমারী ভর্তি পােষাক পরিচ্ছদ—অগণিত ট্রাঙ্ক, সুটক্যাশ—প্রতিটি কক্ষের একই সাজ। সবগুলাে টেবিলের ওপর বিদেশী ম্যাগাজিন, অবসর বিনােদনের জন্যে বই, যেন সবাই একটুখানি বাইরে গেছে এখুনি এসে পড়বে। কিন্তু তারা আর আসবে না। মুক্তিবাহিনীর ক’জন বীর জোয়ান সদর্পে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে বাড়ীটাতে।। কিছু রাত হতেই শােনা গেলাে দূর থেকে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান। একজন শাস্ত্রী মেজরের সামনে এসে স্যালুট জানিয়ে বলবে, একদল রেজাকার এসেছে। জানা গেলাে, ওরা ধীতপুরে সকালের দিকে আত্মসমর্পণ করেছে। মেজর তাদেরকে নিরস্ত্র করে আনতে বললেন। ৮০টা রাইফেল, ১টা ষ্টেনগান,  একখানা এল, এম, জিসহ বিপুল পরিমাণ গােলাবারুদ পাওয়া গেলাে ওদের কাছে। মেজর অফিসারের  কাছে অবশ্য এ ঘটনা খুবই স্বাভাবিক। মাত্র কদিন আগে তিনি জাগ্রত বাংলার প্রতিনিধির কাছে ব্যক্ত করেছিলেন, আর তিন দিন পর আপনারা মুক্ত ভালুকায় বসে রিপাের্ট লিখবেন।  মেজর অফিসারের এ-দুরদর্শিতাই তার যথার্থ পরিচয়। তাঁর প্রতিটি কথার পিছনে থাকে অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞতার পিছনে কর্মের একটা প্রয়াস। সামরিক পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণে ভুলভ্রান্তি হয়তাে তার কখনও হয়েছে কিন্তু অদম্য নিষ্ঠা তাকে একের পর এক এনে দিয়েছে সাফল্যের বিজয় গৌরব। চারিত্রিক দৃঢ়তায় মেজর আফিসার প্রকৃত সৈনিকের ন্যায়ই অনাড়ম্বর।

জাগ্রত বাংলা ১: ৮ !

১১ ডিসেম্বর ১৯৭১ 

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯