You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিশেষ ট্রাইব্যুনালের রায়, জল্লাদ বাহিনীর দোসর ডা. মালিকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

সেশন জজ জনাব আবদুল হান্নান চৌধুরী বাংলাদেশে পেনাল কোডের ১২১ নং ধারা মোতাবেক কুখ্যাত ইয়াহিয়া আমলের সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডাঃ আবদুল মোত্তালিব মালিককে যাবৎ জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। রাষ্ট্র প্রধানের আদেশ অনুযায়ী সেসন জজ জনাব আবদুল হান্নানকে নিয়ে গঠিত এক বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এই বিচার কার্য সম্পূর্ণ করেন। ডাঃ আবদুল মালিকের বিচারের ফলাফল শুনার জন্য দুপুরের দিকে সেসন জজ-এর প্রাঙ্গণে অভূতপূর্ব জনসমাবেশ ঘটে। হাজার হাজার কৌতুহলেী মানুষ আদালতের কক্ষে ভিড় জমায়। বিকেল ৩টার দিকে বিচারপতি যখন ফল স্কেপ সাইজের দীর্ঘ ২৭ পৃষ্ঠা ব্যাপী বিচারের রায় পাঠ করে শুনান তখন আদালত কক্ষে তিল ধারণের ঠাই ছিল না। বিচারের রায় পড়ে শুনানোর সময় ডাঃ মালিকের মুখমণ্ডলে কঠিন হাসি-কান্নার এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। মুহূর্তের জন্য তার চোখ দুটো অশ্রু সজল হয়ে উঠে। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আসামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় কর্তৃক পেনাল কোডের ১২১ ও ১২৪ (ক) ধারা মোতাবেক আনীত অভিযোগ সমূহের সাক্ষ্য প্রমাণাধি গ্রহণের পর আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করেন। এই সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল ১৯৭২ সালের রাষ্ট্র প্রধান কর্তৃক জারীকৃত বিশেষ দালাল আইনের ১ ও ৪ (খ) ধারা পাঠ করে শোনান। অতপর আসামী বৃদ্ধ বয়স এবং অতীতের সময় রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যকলাপের কথা বিবেচনা করে তাকে কেবল মাত্র বাংলাদেশ পেনাল কোডের ১২১ ধারা মোতাবেক দণ্ডিত করা হয়। সেসন জজ কর্তৃক বিচারাদেশ পাঠ করে শুনানোর পর পরই আসামী স্বয়ং ও তার আইন উপদেষ্টা উঠে দাঁড়ান। এবং এই মামলা হাইকোর্টে আপিলযোগ্য কিনা তা অনুমোদন করার অনুরোধ জ্ঞাপন করেন। অতপর ট্রাইব্যুনাল সার্টিফিকেট দানের আশ্বাস প্রদান করেন। বিচার আদেশ পাঠের প্রারম্ভে বিবাদী পক্ষের কৌসুলী কোর্টকে বলেন যে, যেহেতু ডা. মালিক একজন বিদেশি নাগরিক সেহেতু তাকে জেনেভা কনভেনশনের নীতি অনুযায়ী আটক করা হয়েছে, সেহেতু তার বিচার করার অধিকার এই কোর্টে নাই। সেশন জজ বিবাদী পক্ষের এই বক্তব্যকে প্রত্যাখান করেন। কোর্ট এসব যুক্তি নাকচ প্রসঙ্গে বলেন যে, বিবাদী কোর্টে প্রদত্ত দরখাস্তে নিজেকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তান হানাদারবাহিনীর সঙ্গে সহযোগীতা ও প্রশাসনের মাধ্যমে জল্লাদবাহিনীর হাতকে শক্তিশালী করা পরবর্তী পর্যায়ে হানাদারবাহিনীর গভর্নর হিসাবে বিভিন্ন বক্তৃতা ও লিখিত বিবৃতির মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও বিরোধীতা করার অভিযোগে ডাঃ মালিককে অভিযুক্ত করা হয়। বিবাদীপক্ষে জনাব আতাউর রহমান খান ও খান বাহাদুর নাজির উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি শক্তিশালী আইনজ্ঞ দল মামলা পরিচালনা করেন। বিবাদী পক্ষে মামলা পরিচালোনার জন্য কুইনস কাইন্সের স্যার ডিঙ্গল ফুটের ঢাকা আগমনের কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি এসে পৌঁছান নাই। প্রখ্যাত এডভোকেট জনাব সিরাজুল হক, সরকারি কৌসুলী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও জনাব আবদুল রাজ্জাক খান সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। সরকার পক্ষে এই মামলার মোট ২৮ জন সাক্ষীকে হাজির করেন। বিবাদী পক্ষ এদের জেরা করেন। সরকার পক্ষে এডভোকেট জনাব সিরাজুল হক গত শনিবারের শুনানীতে আসামীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেন। তিনি বলেন যে, আসামী পাকিস্তান হানাদার আমলে বাংলাদেশে সীমাহীন অপরাধের কার্যের জন্য দায়ী। অপরপক্ষে বিবাদী পক্ষের কৌসুলী ও আসামীর লিখিত জবানবন্দিতে দাবি করা হয় যে, শুধুমাত্র মানবতার স্বার্থে ডাঃ মালিক হানাদার কবলিত বাংলাদেশের গভর্নর ও প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন যে, দুর্গত জনগণের সেবা ও সাহায্য করার জন্যই তিনি এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তিনি কখনই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা বা হানাদারবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেননি। জবাবে সেসন জজ আবদুল হান্নান বলেন, আসামী যে হানাদার কবলীত বাংলাদেশ দুর্গত মানবতার সেবা করেছেন তার কোনো প্রমাণদানে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। বরং তার শাসনামলেই পাকিস্তান হানাদারবাহিনীর পাইকারী হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ, গৃহদাহ, লুণ্ঠন ইত্যাদি থেকে শুরু করে সব রকমের অপরাধ সংঘঠিত হয়েছে। বিচারপতি জনৈক সাক্ষীর জবানবন্দির উদ্ধৃতি দিয়ে আরও বলেন যে, আসামী কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। তার অন্যতম উপদেষ্টা মেজর জেঃ রাও ফরমান আলী সাধারণত শান্তি কমিটির সভায় উপস্থিত থাকতেন। ১৯৭১ সালে নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির এক সভায় রাজাকারের সংখ্যা ১০ লক্ষে উন্নীত করার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরিশেষে বিচারপতি বলেন যে, পাকিস্তান হানাদারবাহিনীর বিজয়ের আর কোনো সম্ভাবনা নেই। তা বুঝতে পেরেই আসামী ও তার মন্ত্রীপরিষদের অন্যান্য সদস্য ১৪ ডিসেম্বর তারিখে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের পিছনে যদি তার মহৎ উদ্দেশ্যে থাকত, তাহলে অনেক আগেই তিনি হানাদারবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা আকড়ে থেকেছেন। এটাই তার অপরাধ প্রমাণ।৬৬

রেফারেন্স: ২০ নভেম্বর ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!