You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.10 | মুক্তিরদ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ শত্রু সর্বত্র রণে ভঙ্গ দিয়া পালাইতেছে : ঢাকার উদ্দেশে ত্রিমুখী অভিযান - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিরদ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ শত্রু সর্বত্র রণে ভঙ্গ দিয়া পালাইতেছে : ঢাকার উদ্দেশে ত্রিমুখী অভিযান

(নিজস্ব প্রতিনিধি)। যে-আশা নিয়া ইয়াহিয়া চক্র পাক ভারত যুদ্ধ বাধাইয়াছিল উহাতে ছাই পড়িয়াছে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্র ভারতীয় বাহিনীর প্রবল ও ঐক্যবদ্ধ আঘাতে এবং বাঙলাদেশের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অ্যুত্থানে ইয়াহিয়ার দস্যুবাহিনী নাস্তানাবুদ। যুদ্ধ করা দূরে থাক, উহারা পালাইবার পথ পাইতেছে না। দুর্ধর্ষ যশাের ক্যান্টনমেন্ট মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর পদানত, কুমিল্লা ও রংপুর ক্যান্টনমেন্ট যে কোন মুহুর্তে আত্মসমর্পণ করিতে পারে। দখলদার বাহিনীর শেষ ভরসাস্থল ঢাকা তিন দিক হইতে অবরুদ্ধ।  ঢাকার পতন অবশ্যম্ভাবী ও আসন্ন। স্বাধীন বাংলাদেশ সত্যই এবার সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হইতে চলিয়াছে। এদিকে ইয়াহিয়া চক্রের সাম্রাজ্যবাদী মুরব্বীরা চীনের মাওবাদী নেতৃত্বের সহযােগিতায় শান্তি ও ‘যুদ্ধ’ বিরতির নামে জাতিসংঘের পতাকা লইয়া বাংলাদেশে ও এই উপমহাদেশে হস্তক্ষেপের যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র আঁটিয়াছিল সমাজতান্ত্রিক শিবিরের নেতা মহান সােভিয়েতের দৃঢ় ভূমিকার দরুণ উহা ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। সাম্রাজ্যবাদীরা অবশ্য এখনও আশা ছাড়ে নাই। কিন্তু নিপীড়িত জাতিসমূহের শ্রেষ্ঠ বন্ধু সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব উহাদের সকল ষড়যন্ত্র বানচাল করিয়া দিতে কৃতসংকল্প। যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের একতরফা হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধেও সােভিয়েতের কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হইয়াছে। পাকদস্যরা নিশ্চিহ্ন হইবার পথে গত এক সপ্তাহের যুদ্ধে পাক দস্যুরা বাঙলাদেশে, চরম মার খাইয়া এখন সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হইবার পথে। যুদ্ধ করিবার মত মনােবলও উহাদের নাই। বাঙলাদেশে পাকবাহিনীর সৈন্যধ্যক্ষ লেঃ জেনারেল নিয়াজি। নাকি ইতিমধ্যে চম্পট দিয়াছে। অন্যান্যরাও আত্মসমর্পণ করিয়া প্রাণরক্ষার কথা চিন্তা করিতেছে।  যশাের ক্যান্টনমেন্ট পাক দস্যুরা একপ্রকার বিনা যুদ্ধেই ছাড়িয়া গিয়াছে। রংপুরে যুদ্ধ চলিতেছে তবে উহার ফলাফল উভয় পক্ষেরই জানা। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট অবরুদ্ধ। চালনা বন্দর ভারতীয় নৌবাহিনীর দখলে। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর যে-কয়টি জঙ্গী বা বােমারু বিমান বাঙলাদেশে ছিল সবগুলি খতম। নােয়াখালি ও ফেনীর পতনের ফলে বিচ্ছিন্ন চট্টগ্রামের পথে অগ্রসর হইতেছে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী । চট্টগ্রাম বন্দর আগেই বিধ্বস্ত করিয়া দেওয়া হয়েছিল।

‘ঢাকা চল। ঢাকা ছাড়া এখন বলিতে গেলে প্রায় সারা বাংলাদেশই মুক্ত। ঢাকার দিকেও মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী তিনদিক হইতে অগ্রসর হইতেছে। পাকবাহিনী ঢাকায় মরিয়া হইয়া লড়াইয়ের শেষ চেষ্টা করিবে, না আত্মসমর্পন করিয়া প্রাণ বাঁচাইবে তা এখনও পরিষ্কার নয়। কিন্তু বাঙলাদেশের সকল রণাঙ্গনে পাকবাহিনীর মধ্যে যে “পালাও পালাও” রব উঠিয়াছে উহার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় বড় রকমের যুদ্ধ করা সম্ভব বলিয়া মনে হয় না। | ঢাকায় মিত্রবাহিনীর বিমান আক্রমণে পাকদস্যদের মধ্যে ত্রাসের ছায়া নামিয়া আসিয়াছে। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র স্তব্ধ, ট্রান্সমিটার ভবনটি বিমান আক্রমণে বিধ্বস্ত। মিত্রবাহিনী একদিকে ভৈরববাজারও অন্যদিকে দাউদকান্দি হইতে দ্রুত ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হইতেছে। যেকোন দিন ঢাকা শত্রুমুক্ত হইবে। পাকিস্তানের চার ডিভিশন সৈন্য মৃত্যুর জালে জড়াইয়া পড়িয়াছে। ইহাদের যুদ্ধ করিবার শক্তি নাই, পালাইবার পথ নাই। আত্মসমর্পণ ভিন্ন প্রাণ বাঁচাইবার উপায় নাই।  পশ্চিম পাকিস্তানের রণাঙ্গনে ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের রণাঙ্গনেও পাকজঙ্গী শাসকদের হিসাবে গােলমাল হইয়া গিয়াছে। এই রণাঙ্গনেও ভারত প্রাধান্য বিস্তার করিয়া রহিয়াছে। কাশ্মীরের চার এলাকায় প্রাথমিক বিপর্যয়ের পর এখন কাশ্মীর সীমান্তও সুরক্ষিত। সিন্ধু ও পাঞ্জাব এলাকায় ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের সীমান্তের গভীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়াছে।

পাকিস্তানের নৌবাহিনীকেও ভারতীয় নৌবাহিনী অকেজো করিয়া দিয়াছে। দুইটি সাবমেরিন, কয়েকটি ডেস্ট্রয়ার ও বহু গানবােট ধ্বংস করিয়াছে। পশ্চিম রণাঙ্গনে সাফল্যের পরিমাণ বাঙলাদেশ অপেক্ষা কম হইলেও ভারতীয় বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত। উদ্বাস্তুরা ফিরিয়া আসিতেছে। সীমান্ত এলাকা হইতে পাওয়া খবরে জানা যায়, বাঙলাদেশের মুক্ত এলাকাগুলিতে উদ্বাস্তুরা দলে দলে ফিরিয়া আসিতে শুরু করিয়াছে। তবে এক কোটি উদ্বাস্তুর প্রত্যাবর্তন ও পূনর্বাসন কিছুটা সময়সাপেক্ষ এবং একটি সুসমন্বিত পরিকল্পনা মােতাবেক ইহা করিতে হইবে। শত্রুমুক্ত এলাকাগুলিতে অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থাও গড়িয়া উঠিতে শুরু করিয়াছে।

মুক্তিযুদ্ধ ১: ২৩।

১০ ডিসেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯