You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.04.20 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান | আবার কালবৈশাখীর ছোবলে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২০ এপ্রিল শুক্রবার, ৭ই বৈশাখ, ১৩৮০

অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান

মওজুদদার ও কালোবাজারি গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে সরকার ঢাকা শহরে একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু করে। গত পরশুদিন চব্বিশজনকে গ্রেফতার করেছে। জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ, একজন ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের সাহায্যে এ অভিযান পরিচালনা করেছেন। চব্বিশজন কালোবাজারি গ্রেফতারের সংবাদে ঢাকা শহরের মানুষের মনে হলেও একটি উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেকে মনে করেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এই অভিযান সার্থকভাবে পরিচালনা করতে পারলে উল্লেখযোগ্য সুফল পাওয়া সম্ভব। সমাজদেহ থেকে কালোবাজারি ও চোরাকারবারীদের উৎখাত করতে হলে যে একটি ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা আবশ্যক একথা পূর্বেহেই আমরা উল্লেখ করেছিলাম। দেশের সাধারণ মানুষের ভোগ পণ্য নিয়ে যারা স্বার্থ হাসিলের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের আজ নৈতিক দায়িত্ব। সরকারের দায়িত্ব পালনে পদক্ষেপের সঙ্গে দেশের জনগণের সহযোগিতাও আজ একান্ত প্রয়োজন। ইতিপূর্বে সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন কালোবাজারি মওজুদদারদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সে সকল অভিযানের তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো সাড়া আমরা লক্ষ্য করিনি। অথচ এদের বিরুদ্ধে যতদূর সম্ভব কঠোর হওয়ার জন্য সরকারের প্রতি জনগণ তাদের রায় জানিয়ে দিয়েছিল পূর্বেহেই। কিন্তু জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী সরকার এই সকল সামাজিক শত্রুদের বিরুদ্ধে যথার্থ কোন ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম হননি।
শুধু কালোবাজারি মওজুদদারদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করলেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসতে পারেনা। এ ব্যাপারে একটি সুস্পষ্ট নীতি অনুসরণ করতে হবে সরকারকে। অনেক সময় লক্ষ্য করা গেছে যে সরকারি নীতি অস্পষ্টতার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই অসৎ ব্যবসায়ীরা সুযোগ গ্রহণ করছে। সরকার তার বিভিন্ন ঘোষণায় অসাধু ব্যবসায়ীদের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাদেরকে শাস্তি দেবার কথা ব্যক্ত করেছেন। আমরা মনে করি, সরকার অসাধু ব্যবসায়ীদের পরিচয় অনেক ক্ষেত্রেই জানেন অথচ তাদের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। বিভিন্ন স্থানে এমন কতকগুলো ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যার দরুন অসাধু ব্যবসায়ীরা মুনাফার সুযোগ পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তাই আমাদের বক্তব্য, দেশের মওজুদদার ও মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে সর্বাগ্রে। আর সে নীতিমালা হতে হবে অবশ্যই সমাজতান্ত্রিক উপাদানে পরিপুষ্ট।

ঝানু দুই মার্কিন কূটনীতিকের ঢাকা সফর

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের উপসচিব মিঃ কেনেথ রাশ এবং পররাষ্ট্র দফতরের নিকটপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী সচিব মিঃ জোসেফ সিসকো ঢাকায় এসেছিলেন। আকস্মিকভাবে তাদের এই ঢাকা সফর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে হচ্ছে। বিশেষ করে উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যখন বাংলাদেশ এবং ভারত একটা যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ মাত্রেই যখন এই শান্তি উদ্যোগের দিকে গভীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী বাংলাদেশে আগমন বিশেষ অর্থবহ। কেনেথ এবং জোসেফ সিসকো আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব কামাল হোসেনের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছেন। অনুমান করা হচ্ছে উপমহাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যাবলী নিয়েই এই সমস্ত আলোচনা হয়েছে।
মার্কিন কূটনৈতিকদ্বয় হংকং থেকে মার্কিন বিমানবাহিনীর একটি বিমানে করে ঢাকায় অতঃপর নেপাল ভ্রমণ করেন। তাদের আসবার একদিন আগে উপমহাদেশের শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ-ভারতের যুদ্ধ ঘোষণা প্রকাশ করা হয়। ঢাকায় সাংবাদিক সম্মেলন করে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বিচার করা হবে এমন যুদ্ধাপরাধীদের সংখ্যা প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে বাংলাদেশের বক্তব্য স্পষ্ট এবং স্বার্থহীন ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে। মার্কিন কূটনীতিকদ্বয় অবশ্যই যে সকল বক্তব্য সম্বন্ধে ওয়াকেবহাল হয়েই ঢাকা সফরে এসেছিলেন।
আমরা উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী সকলকে অভিনন্দন জানাব। কিন্তু রাজনীতির খেলা এত নোংরা যে সহজ-সরল জিনিসটাকে ঘোলা করে দেবার জন্য লোকের অভাব এখানে কোন সময়ই হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উপমহাদেশে উত্তেজনা অব্যাহত রাখা তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজ খবরদারি বজায় রাখার জন্য এমন কোন পথ নেই যারা এতদিন গ্রহণ করেনি। হঠাৎ করে তাদের নীতির কোন আকাশ পাতাল প্রবেশ ঘটবে এমনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোন আশাবাদী মহল মনে করেন না। এখন বাংলাদেশ ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটা সৎসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য যখন কার্যকরী উদ্যোগ গৃহীত হতে যাচ্ছে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই ঝানু কূটনীতিকের বাংলাদেশ সফর কোনো অশুভ প্রভাব ফেলতে পারে কিনা এই নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে ঢাকার বিভিন্ন মহলে। পেঁচা অলক্ষুণে; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অশুভ ষড়যন্ত্রে প্রতীক। তাদের এ বদনাম ঘুচাতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন শক্তি তা করবেন কি? অন্তত আমাদের এই উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাদের কি ভূমিকা হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে কি তারা সচেতন?

আবার কালবৈশাখীর ছোবলে

আবার ঝড় বয়ে গেল। কালবৈশাখীর তাণ্ডব আবারও আঘাত হেনেছে মানিকগঞ্জ মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকায়। এই প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে বহু ঘরবাড়ি সম্পদ বিধ্বস্ত হয়েছে। ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১২৭ জন আহতকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আনা হয়েছে হয়তো আরও আনতে হবে। এই আহতদের সঠিক সংখ্যা শেষ পর্যন্ত কততে দাঁড়াবে তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। মৃতের সংখ্যাও এখনো নিরূপিত হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও রাষ্ট্রপতি বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী প্রকৃতির রুদ্ররোষে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার অধিবাসীদের জন্য শোক জ্ঞাপন করেছেন এবং সেখানে আহার, আশ্রয়, ঔষধপত্র, চিকিৎসা ইত্যাদি সাহায্য দ্রুত প্রেরণের জন্য ইতিমধ্যে নির্দেশ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করে এসেছেন।
মাত্র কয়েক দিন আগেই ফরিদপুরের ৩টি মহাকুমার ২৬ টি গ্রামের উপর দিয়ে কালবৈশাখীর তাণ্ডবলীলা বয়ে গেছে। সেখানকার মানুষের আত্মীয়-পরিজন, ঘর-সংসার অর্থ বিনষ্টের এতোটুকু প্রশমিত হতে না হতেই আবারো দুর্যোগ নেমে এলো মানিকগঞ্জের অধিবাসীদের উপরে। বাংলাদেশের ষড়ঋতুর প্রথম ঋতু গ্রীস্মের কেবল শুরু। আরো দের দুই মাস আবহাওয়ার এই বেখেয়ালি পাগলামি অব্যাহত থাকবে। জানিনা সামনের দিনগুলোতে এমনিতর দুর্যোগ আরো কবার আসবে। তবু প্রকৃতির সে বেখেয়ালিপনার জন্য আমাদেরকে বুঝি প্রস্তুত থাকতেই হবে।
বিংশশতাব্দীর চরম বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন ও প্রকৃতিকে বশ করানো মতো কোনো পন্থা আবিষ্কৃত হয়নি। তাই বোধকরি এই গতিবাদের যুগেও প্রকৃতির হাতে ক্রীড়নক হয়েই থাকতে হচ্ছে মানুষকে। ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত এলাকার লোকদের বিভিন্ন প্রকার সাহায্য প্রদানের জন্য সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা নিবেন সত্য কিন্তু সেইসব সাহায্য সময়মতো যথা স্থানে পৌঁছালে কিনা সে বিষয়ে বিশেষ সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কেননা, অতীতের ঘটনাগুলো থেকে আমরা দেখেছি রিলিফ এবং দুর্গত এলাকার সাহায্য দ্রব্য কালোবাজারি হয়। সুতরাং সেই সমস্ত বিবেকবর্জিত ব্যক্তিরা যে এখন সুযোগ গ্রহণ করবে না, তার নয়।
দুর্গত এলাকার মানুষের সাহায্য করা শুধু একা সরকারের দায়িত্ব নয়, সে দায়িত্ব আপামর জনসাধারণের, সারা দেশবাসীর। সুতরাং গোটা দেশবাসীকে সাহায্যসামগ্রী নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারকে সাহায্য এবং সহযোগিতার দান করতে হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন