গণপরিষদে খসড়া সংবিধান পেশ
দীর্ঘ ২৫ বছরের নিপীড়িত, নির্যাতিত সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কাছে বৃহস্পতিবার ছিল এক ঐতিহাসিক দিন। গতকালই স্বাধীন দেশের গণপরিষদে আপামর জনসাধারণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক সুখী ও সমৃদ্ধিশালী জীবনের নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতিবহ খসড়া সংবিধান অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়। আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন এই ঐতিহাসিক সংবিধান বিল পেশ করেন। পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত ও গীতা পাঠের পর অধিবেশন শুরু হলে কতিপয় সদস্যদের মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। অতঃপর শিল্পমন্ত্রীর প্রস্তাবক্রমে ডেপুটি স্পীকার জনাব মুহম্মদুল্লাহ সর্বসম্মিতক্রমে স্পীকার নির্বাচিত হন। অতঃপর অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদের প্রস্তাবক্রমে রাজশাহীর জনাব বয়তুল্লাহ সর্বসম্মতিক্রমে ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত হন। আইন মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন কর্তৃক পেশকৃত সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপ্রধান রূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির উর্ধ্বে স্থান লাভ করবেন এবং এই সংবিধান ও অন্য কোনো আইনের দ্বারা তাঁকে প্রদত্ত ও তার ওপর অর্পিত সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন করবেন।
পক্ষান্তরে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তার কর্তৃত্বে কিংবা প্রধানমন্ত্রীর যেকোনো নির্দেশ সাপেক্ষে অন্য যে কোনো মন্ত্রী বা তার কর্তৃত্বে এই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হবে। অপরদিকে মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকবেন।
১৫৩টি ধারা সম্বলিত ৭২ পৃষ্ঠার খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় চারটি মৌল আর্দশ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের আদর্শের প্রতিফলন রয়েছে। পরিষদে খসড়া শাসনতন্ত্রের সাথে খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টও পেশ করা হয়। এই শাসনতন্ত্র মানুষের ওপর মানুষের শোষণ হতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা রয়েছে। পরিষদের নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, রক্ত দিয়ে লেখা এই শাসনতন্ত্র রাষ্ট্রীয় চারটি মৌল আদর্শের ওপর ভিত্তি করে প্রণাত হয়েছে। তিনি বলেন যে, দেশ একটি শাসনতন্ত্র এবং সাধারণ নির্বাচন লাভ করতে যাচ্ছে। নিবাচনে যে দলই জয় লাভ করবে স্বভাবতঃ তারা জাতীয় দায়িত্ব পালন করবেন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে খসড়া শাসতন্ত্রের যে কোনো সংশোধনীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, যদি জাতির জন্য আরো উন্নত সংবিধানের স্বার্থে এই খসড়া শাসনতন্ত্রে কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের প্রয়োজন হয় তাহলে তা নিশ্চয়ই গ্রহণ করা হবে। খসড়া শাসনতন্ত্র বিল পেশকালে আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেন যে, শাসনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক পন্থায় সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে এবং তা সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচারের নিশ্চয়তা রয়েছে। অধিবেশনে শিল্পমন্ত্রী ও বিশেষ অধিকার সম্পর্কীয় বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭২ সালে ১১ এপ্রিল তারিখে গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাব অনুসারে গণপরিষদের সদস্যদের বিশেষ অধিকার সম্পর্কে গঠিত বিশেষ কমিটির রিপোর্ট পেশ করেন। চারঘণ্টা কাল স্থায়ী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুই বার বক্তৃতা করেন।৪৭
রেফারেন্স: ১২ অক্টোবর ১৯৭২, দৈনিক ইত্তেফাক
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ