You dont have javascript enabled! Please enable it!

1981.10.31 | নির্বাচনী লড়াই | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৩১ অক্টোবর ১৯৮১

সম্ভবতঃ এই প্রথম বাংলাদেশে একটি নির্বাচনের ফলাফল অনিশ্চিত। এই অনিশ্চিতির ভেতর দিয়ে প্রবল উত্তেজনা ও বাকবিতন্ডাকে সঙ্গী করে ভােটাররা ভােট দেবেন ১৫ নভেম্বর। এবং এমন একটি সিদ্ধান্ত দেবেন, যা নিয়ে হয়ত তাদের পরবর্তী পাঁচ বছর বেঁচে থাকতে হবে। কয়েকজন প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থীর পরিবর্তিত অবস্থান, মতান্তর এবং নির্বাচনী প্রচারণায় হতাশা : জনগণের উদাসীনতা সব কিছু সত্ত্বেও তিনজন মূল প্রার্থী সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী পছন্দের প্রতীক। এরা এমন এক লড়াইয়ে অবতীর্ণ, যার ফলাফল প্রভাবান্বিত করবে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিমালা; জাতীয় অর্থনীতি; সংকট; বিভেদ সবকিছু।
১৯৭৮-এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সঙ্গে এবারের নির্বাচনের সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য ব্যাপক। তখন ক্ষমতাসীন প্রার্থী ছিলেন ফ্রন্টের প্রার্থী, এবার দলীয় প্রার্থী। তখন মূল বিরােধী দুজন ছিলেন একই প্লাটফরমে; উচ্চারিত হয়েছিল পার্লামেন্টারী ব্যবস্থার শ্লোগান। এবার দুজন দুই প্লাটফরমে শ্লোগানও ভিন্ন।
বিচারপতি সাত্তার, জেনারেল (অবঃ) ওসমানী ও ডক্টর কামাল হােসেন—এই তিনজন তিনমুখী লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচনে নেমেছেন। এবং এই তিনজনই কোন না কোন ভাবে রাষ্ট্র পরিচলনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং আছেন। কিন্তু এদের ব্যক্তিত্ব বহমূখী। তাই তাঁরা নির্বাচনী অভিযানে সারা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। লক্ষ লক্ষ টাকার নির্বাচনী উপকরণ ব্যবহার করছেন। বিরতিহীনভাবে একে অন্যের দক্ষতা ও কর্মসম্পাদনের সমালােচনা করছেন। তাঁদের সমর্থক ও অনুসারীরাও এর সঙ্গে যােগ দিয়েছেন। কিন্তু এত কিছুর পরেও, নির্বাচনী উত্তেজনা যেখানে শুরু সেখানেই থেমে আছে। নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জনগণ অংশগ্রহণ করছেন নির্বাচনে। এখনাে তারা পুরােপুরি নির্বাচনী লড়াইয়ে সম্পৃক্ত হতে পারেন নি। এর কারণ কি ? এটা কি প্রার্থীদের সম্পর্কে হতাশা ? না অর্থনৈতিক সমস্যা ? না, এই ধারণা যে কোন প্রেসিডেন্টই রাষ্ট্রীয় আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় কোন ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারবেন না। জনগণ পরিবর্তনে বিশ্বাসী, কিন্তু হঠকারী সিদ্ধান্তে নয়।
বিভিন্ন প্রার্থীর জনসমর্থনের পেছনে মূল কারণ, বিরােধী দের বিরােধিতা ; কোন একজনের জন্যে আন্তরিক উৎসাহ নয়। ভােটারদের ভােটের ফলাফল সম্পর্কে সন্দেহ আছে, পরিবর্তন সম্পর্কে সন্দেহ আছে। এবং প্রার্থীদের দক্ষতা সম্পর্কেও সন্দেহ আছে। এখনাে চূড়ান্তভাবে অঙ্গীকৃত সমর্থকের সংখ্যা সীমাবদ্ধ। তাই নির্বাচনকে নিয়ে জনজোয়ারের সৃষ্টি হয়নি। এত কিছুর পরেও, আশা-নিরাশার মাঝেই জনগণ মনস্থির করবেন আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে। এবং তাই ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে নির্বাচনী প্রেক্ষাপট। এবং সে সময়সীমার আগেই প্রার্থীরা প্রভাবান্বিত করার চেষ্টা করছেন ভােটারদের।
এদেশে অতীতে যতবার নির্বাচন হয়েছে, একটি শ্লোগান মূল শ্লোগানে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এবারের নির্বাচনে তা অনুপস্থিত। সম্ভবতঃ দুটি কারণেঃ যেহেতু এ নির্বাচন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত নির্বাচন, এবং একটি একক প্রশ্ন গােটা জাতিকে আন্দোলিত করছে না। এবং এজন্যে প্রয়ােজন অতীতের নির্বাচনগুলোর পুনরুল্লেখ ।
নির্বাচনের ইতিহাস/১৯৫৪
পাকিস্তান সৃষ্টির আগে তৎকালীন পূর্ব বাঙলায় প্রাদেশিক আইন পরিষদের সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালে। এতে নির্বাচিত সদস্যরা ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ শেষ বারের মতো ঢাকায় অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের সংসদীয় অধিবেশনে যােগ দেন। অতঃপর সর্বসম্মতিক্রমে ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে প্রদেশব্যাপী স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম প্রাদেশিক আইনসভার সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৫৪ নির্বাচনের কেন বিস্তৃত প্রতিবেদন তৎকালীন পাকিস্তানী প্রশাসকেরা প্রকাশ করেননি। তবে অতিকষ্টে এবং বিভিন্ন স্থান হতে পাওয়া তথ্য অনুসন্ধান করে জানা যায়, এ নির্বাচনে সর্বমােট আসন সংখ্যা ছিল ৩০৯। এদের মধ্যে মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত আসনের সংখ্যা ছিল ২২৮টি। তফসিল সম্প্রদায়ভুক্ত হিন্দুদের জন্য সংরক্ষিত ছিল ৩৬ টি, তফসিলী হিন্দু ছাড়া বর্ণহিন্দুদের ছিল ৩০টি, বৌদ্ধদের জন্য ২টি, স্থানীয় খৃষ্টানদের জন্য ১টি, মুসলমান মহিলাদের জন্য ৯টি, তফসিলী হিন্দু মহিলাদের জন্য ২টি এবং বর্ণহিন্দু মহিলাদের জন্য ১টি আসন।
নির্বাচনে প্রধান প্রতিযােগিতা হয় তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লীগ এবং যুক্তফ্রন্টের মধ্যে। শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি, সােহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ, মওলানা আতাহার আলীর নেজামে ইসলাম এবং গণতন্ত্রী দলের সমন্বয়ে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে এই নির্বাচনী যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। অমুসলিম অসিনগুলাের জন্য প্রধান প্রধান প্রতিদ্বন্দী ছিল পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস, সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্ট এবং তফসিলী সম্প্রদায় ফেডারেশন।
নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৯টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অন্যান্যদের মধ্যে মুসলিম লীগ ৯টি আসনে, খিলাফত-ই-রব্বানী পার্টি ১টি আসনে এবং ১২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করেন। অমুসলিম আসনগুলোতে বিজয়ী হন পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসের ১৫ জন, সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্টের ১০ জন এবং ৫ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
তফসিলী সম্প্রদায় ভুক্ত দের আসনগুলোতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ফেডারেশনের ১৮ জন, পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসের ১০ জন, সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্টের ২ জন এবং ৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করেন। এছাড়া পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসের ১ জন স্থানীয় খ্রীষ্টান ও ১ জন মহিলা প্রার্থী, যুক্তফ্রন্টের ৯ জন মহিলা প্রার্থী, এবং তফসিলী সম্প্রদায় ফেডারেশনের ২ জন মহিলা প্রার্থীও নির্বাচিত হন।
নির্বাচনের সামগ্রিক পরিচালনায় ছিলেন পূর্ববঙ্গের নির্বাচন কমিশনার এম, অজিফার সি, এস , পি , এবং তাঁকে সর্বাত্মক সহযােগিতা দেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র বিভাগের বিশেষ কর্মকর্তা এমদাদ আলী এবং একই বিভাগের উপসচিব আলতাফ গওহর। সংবিধান ও নির্বাচনী শাখার সহকারী সচিব এস, এ. খান এবং স্বরাষ্ট্র বিভাগের আরেকজন সহকারী সচিব এম, এফ, বারীও নির্বাচন পরিচালনায় সহযােগিতা করেন।
প্রাথমিকভাবে নির্বাচনের জন্য প্রায় ১ লক্ষ ৫৩ হাজার ব্যালট বাক্সের প্রয়ােজন বলে অনুমান করা হয়। এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যবহৃত মাত্র ৪৫ হাজার পুরনাে ব্যালট বাক্স ছিল। ফলে অন্ততঃপক্ষে আরাে ১ লক্ষ ব্যালট বাক্স যথা সময়ে সংগ্রহের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু স্থানীয় কারিগরেরা দেয় সময়ে ৭০ হাজারের বেশি বাক্স সরবরাহে অক্ষম ছিল। এ অবস্থায় কলিকাতার একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বাকী ৩০ হাজার ব্যালট বাক্স নির্মাণের আদেশ দেয়া হয় ও ১৯৫৪ সালের জানুয়ারীর দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্য সেগুলো পেছানাের চুক্তি হয়। কিন্তু ১৩ জানুয়ারী উক্ত প্রতিষ্ঠান ব্যালট বাক্স সরবরাহে অপারগতা প্রদর্শন করে। এমতাবস্থায় স্থানীয় একটি ক্ষুদ্রশিল্প প্রতিষ্ঠান দিনরাত ২৪ ঘন্টা কাজ করে জানুয়ারী মাস শেষ হওয়ার আগেই ৩০ হাজার বাক্স সরবরাহ করে এই সংকট হতে নির্বাচনকে রক্ষা করে। এই ১ লক্ষ ব্যালট বাক্সের খরচ পড়ে প্রায় ১১ লক্ষ ৭ হাজার ৪ শত ২৭ টাকা।
প্রাথমিক হিসাবে দেখা যায়, নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রায় ২০ হাজার প্রিসাইডিং অফিসার এবং প্রায় ৪০ হাজার পােলিং অফিসার প্রয়ােজন। কিন্তু তৎকালীন প্রাদেশিক সরকারের হাতে নির্বাচন পরিচালনায় সক্ষম মাত্র ৫ হাজার প্রিসাইডিং অফিসার এবং ১০ হাজার পােলিং অফিসারের বেশি লোক না থাকায় ক্রমাগত ৪ দিন ভােট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ভােট কেন্দ্রের স্থান সংকুলানের জন্য স্কুল-কলেজ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দখল করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৭ দিনের জরুরী ছুটি ঘোষণা করা হয়।
১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারী নির্বাচনের নােটিশ জারী করা হয়। মনােনয়নপত্র পেশের শেষ সময়সীমা ছিলাে ১১ জানুয়ারী। ১৬ হতে ১৮ জানুয়ারী মনােনয়নপত্র বাছাই করা হয়। মনােনয়ন প্রত্যাহারের শেষ সময়সীমা ছিল ২১ জানুয়ারী। প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয় ২৫ জানয়ারী। ১৬ ফেব্রুয়ারী থেকে ভোট গ্রহণের কথা থাকলেও প্রার্থীদের বিশেষ অনুরোধে তা পিছিয়ে করা হয় ৮ মার্চ। মার্চ ৮ থেকে ১২ পর্যন্ত ভােট গ্রহণ করা হয়। ১১ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত অনবরত নির্বচিনী ফলাফল ঘােষণা করা হতে থাকে ও ২৫ মার্চ থেকে নির্বাচনী গেজেট প্রকাশ শুরু করে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল গেজেট আকারে সরকারীভাবে প্রকাশ করা হয় ৭ এপ্রিল তারিখে।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ১ হাজার ৭ শত ৮৬ জন প্রার্থী মনােনয়নপত্র দাখিল করেন। মােট ১০০টি মনােনয়নপত্র বাতিল বলে ঘােষণা করা হয় এবং তিনশত ৯৬ জন প্রার্থী মনােনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন। মােট ৩০৪টি আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দীতা করেন ১ হাজার ২ শত ৮৫ জন প্রার্থী। পাঁচজন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হন। নির্বাচনে জয়লাভ করেন যুক্তফ্রন্টের ২১৮ জন, মুসলিম লীগের ৯ জন, খিলাফত-ই-রব্বানী পার্টির ১ জন, পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসের ২৭ জন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যুক্তফ্রন্টের ১২ জন, তফসিলী ফেডারেশনের ১৪ জন, এবং ২৩ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। নির্বাচনে সর্বমােট ব্যয় হয় ১ কোটি ৩ লক্ষ ৫৫ হাজার ৯২ টাকা।
এই নির্বাচনে সর্বমােট ভােটারের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৯৯ লক্ষ ৪১ হাজার ৫ শত ৬৩ জন। এদের মধ্যে মহিলা ভােটারের সংখ্যা ছিল ৯২ লক্ষ ৩৯ হাজার ৭শত ২০ জন। পাঁচজন প্রার্থী বিনা প্রতিন্দ্বদ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় চূড়ান্ত ভােটারের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৯৭ লক্ষ ৪৮ হাজার ৫শত ৬৮ জন। এদের মধ্যে ভােট দেন মাত্র ৭৩ লক্ষ ৪৪ হাজার ২ শত ১৬ জন। অর্থাৎ ভােটকেন্দ্রে উপস্থিত ভােটারের সংখ্যার হার ছিল শতকরা ৩৭ দশমিক ১৯ জন। নির্বাচনে শতকরা ৩৭·৬০ জন মুসলিম, শতকরা ৩৯·১০ জন বর্ণহিন্দু, শতকরা ৩৩·২৬ জন তফসিলী হিন্দু, শতকরা ৩৭·৫১ জন মুসলিম মহিলা, শতকরা ৩৫·৪৮ জন তফসিলী হিন্দু মহিলা এবং শতকরা ২৮·৮০ জন স্থানীয় খ্রীষ্টান মহিলা তাদের মূল্যবান ভােট দিতে ভােটকেন্দ্রে যান। নির্বাচনে সর্বোঙ্গ ভোট পান নারায়ণগঞ্জ দক্ষিণ কেন্দ্রের যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী আলমাস আলী ৩০ হাজার ৮শত ৮৭টি এবং সর্বনিম্ন ভােট পান সিরাজগঞ্জ উত্তর-পশ্চিম আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আলহাজ মৌলবী আবেদ আলী মােট ১৯টি।
এই নির্বাচনের পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ মোটামটি সকলের জানা। ৯২ (ক) ধারা জারী করে এই গণ রায়কে বানচালের চেষ্টা হয়েছিল। সেই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী, ১৯৫৮ সালে।
১৯৬৯ পর্যন্ত আয়ুবী শাসনামলে দেশে কোন প্রত্যক্ষ ভােট হয়নি, রাষ্ট্র পরিচালনার পর্যায়ে। তাই ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশব্যাপী গণজোয়ার সৃষ্টি হলেও মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভােটে তা বানচাল হয়ে যায়। মাত্র আশি হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী নির্ধারণ করে দেয় দেশের ভাগ্য।
পূর্ব পাকিস্তানের শেষ নির্বাচনঃ ১৯৭০-৭১
১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদ ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচন এতদঞ্চলের দক্ষিণাংশে একই বছরের নবেম্বর-ডিসেম্বর মাসের সামুদ্রিক জলােচ্ছাস ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে পিছিয়ে যায় ও ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রধানতম সােপান উন্মুক্ত করে দেয়। নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের জন্য সংরক্ষিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৮৯টি আসনে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
সত্তরের নির্বাচনে সারা পূর্ব পাকিস্তানে ভােটারের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৬০ লক্ষ ৩৪ হাজার ৫শত ৩০ জন পুরুষ এবং ১ কোটি ৫১ লক্ষ ৭৬ হাজার ৬ শত ৯০ মহিলা সহ মােট ৩ কোটি ১২ লক্ষ ১১ হাজার ২শত ২০জন। এদের মধ্যে মােট ১ কোটি ৭৭ লক্ষ ৬৯ হাজার ৪ শত ৬৭টি ভোট গৃহীত হয় এবং ৫ লক্ষ ৭৬ হাজার ১ শত ৪৬টি ভােট বিভিন্ন কারণে বাতিল বলে ঘােষণা করা হয়। গ্রাহ্য মােট ভােটের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৭১ লক্ষ ৯৩ হাজার তিনশত ৫১টি। ভােট প্রদানকারীর উপস্থিতির হার ছিলাে শতকরা ৫৩·৮৮।
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ছিলাে আওয়ামী লীগ, জামাতে ইসলামী, পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন), মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), মুসলিম লীগ (কাইউম), ওয়ালী ন্যাপ এবং বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র ও অন্যান্য ছােট ছােট রাজনৈতিক দলের প্রার্থী। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের আসনগুলােতে শতকরা ৭৫·১১ ভাগ, জামাতে ইসলামী শতকরা ৬·০৭ ভাগ, পাকিস্তান ডেমােক্র্যাটিক পার্টি ২·৮১ ভাগ, কনভেনশন মুসলিম লীগ শতকরা ২·৮১ ভাগ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ ১·৬০ ভাগ, কাইয়ুম মুসলিম লীগ ১·০৭ ভাগ, ওয়ালী ন্যাপ ২·০৫ ভাগ, অন্যান্য ছােটখাটো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা ৫ ভাগ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা শতকরা ৩·৪ ভাগ ভােট লাভ করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬টি আসনে, পিডিপি ১টি আসনে এবং একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হন এবং মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত সাতটি আসনেই আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে।
নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে মােট ৮ শত ৭৩টি মনােনয়নপত্র দাখিল করা হয় এবং ৫টি মনােনয়নপত্র বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়। ৮৭ জন প্রার্থী তাঁদের মনােনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন এবং ৭ শত ৮১ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেন। অন্যদিকে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মােট ২ হাজার ১ শত ৩ জন প্রার্থী মনােনয়নপত্র দাখিল করেন, ১৪টি মনােনয়নপত্র বাতিল করা হয়, ২ শত ৪১ জন প্রার্থী তাদের মনােনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন এবং সর্বমােট ১ হাজার ৮শত ৫০ জন প্রার্থীর মধ্যে ভােটযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়।
সত্তর-একাত্তরের নির্বাচনের জন্য দেশে ছিলাে মােট ১ লক্ষ ৫১ হাজার ব্যালট বাক্স। কিন্তু দীর্ঘদিন অযত্নে পড়ে থাকার দরুন অধিকাংশ বাক্স নষ্ট হয়ে যায়। প্রায় ৪৯ হাজার ১ শত ৮৭টি বাক্স পুনঃসংস্কার এবং মেরামত করার প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। যদিও হিসেব অনুযায়ী ব্যালট বাক্সের প্রয়ােজনীয়তা ছিলো প্রায় ১ লক্ষ ৫৬ হাজার শেষ পর্যন্ত মাত্র ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ১শত ২২টি ব্যালট বাক্স ব্যবহার করা যায়। কেবলমাত্র ভােটকেন্দ্রে ব্যালট বাক্সগুলাে বহন করে নিয়ে যাবার জন্যই নির্বাচন কমিশনের খরচ হয় প্রায় ৪ লক্ষ ১০ হাজার টাকা।
মােট ১৫ হাজার ৩ শত ৩১টি পােলিং স্টেশন ব্যবহারের জন্য কমিশনকে ৮১ হাজার ৬ শত রাবার স্ট্যাম্প; ১ লক্ষ ৭৬ হাজার রাবারের সীলমােহর, ৮১ হাজার ৬শত স্ট্যাপ-প্যাড ১৬ হাজার ৮শত ২০টি পিতলের সীলমােহর, ৩২ হাজার মােটা কাপড়ের ব্যাগ এবং ১৬ হাজার পাউণ্ড মােমজাতীয় পদার্থ অতিরিক্ত হিসেবে সংগ্রহ করতে হয়। মেরামতের জন্য প্রতি বাক্সে গড়পড়তা খরচ পড়ে ২২ টাকা।
মােট ১৫ হাজার ৩ শত ৩১ জন প্রিসাইডিং অফিসার, ৫৫ হাজার ৫ শত ৬৮ জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং ১ লক্ষ ১১ হাজার ১ শত ৩৬ জন পােলিং এজেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করেন। এদের সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন ৭৯ জন রিটার্নিং অফিসার এবং ৪৮০ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসার। ভােট গণনার জন্য ছিলেন ২২ হাজার ৭ শত ৬৫ জন গণনাকারী এদের তত্ত্বাধানে ছিলেন, ৬ হাজার তিনশত ২১ জন সুপারভাইজার।
এই নির্বাচনের দুটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিলঃ পাকিস্তানের দুই প্রদেশে দুটি ভিন্নমূখী রাজনৈতিক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং মরহুম মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বামপন্থীদের নির্বাচন বর্জন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, এই ফলাফলের কারণেই এত দ্রুত দেশের রাজনৈতিক চেহারা বদলে যায়।
এই নির্বাচন বর্জনের ফলে বামপন্থীরা যে নৈরাজ্যে পতিত হয়, পরবর্তী পর্যায়ে তারা তা আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি। অপরদিকে দুই শ(অস্পষ্ট) সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দুটি দল শুধু প্রদেশেই সীমাবদ্ধ থাকায় কোন রাজনৈতিক সমাধানে আসিতে পারেনি। এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনৈতিক দল হিসেবে সেনাবাহিনীর ভূমিকা, যা পাকিস্তানের রাজনীতিতে ছিল অনুপেক্ষনীয়।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনঃ ১৯৭৮
বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য সর্বপ্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৮ সালের ৩ জুন। এই নির্বাচনে ভােটারের মােট সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৮৪ লক্ষ ৮৬ হাজার ২ শত ৪৭ জন। এদের মধ্যে ২ কোটি ৫৫ লক্ষ ৩১ হাজার ৫ শত ৬১ জন ভােট প্রদান করেন। প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দী ছিলেন ক্ষমতাসীন তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীরউত্তম, পি, এস ; সি এবং বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাের সম্মিলিত প্রার্থী অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী।
মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সর্বমােট ১ কোটি ৫৭ লক্ষ ৩৩ হাজার ৮ শত ৭ ভােট পেয়ে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন। অন্যদিকে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জেনারেল (অবঃ) আতাউল গনি ওসমানী ৪৪ লক্ষ ৫৫ হাজার ২ শত ভােট লাভ করেন।
এই দু’জন প্রধান প্রার্থী ছাড়াও আরাে ৮ জন প্রার্থী নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নামের তালিকা এবং তাদের প্রাপ্ত ভােটসংখ্যা নিম্নে দেয়া গেলােঃ
নাম
১। জনাব আজিজুল ইসলামঃ
২। আবুল বাশারঃ
৩। অধ্যক্ষ এ. হামিদ এম, এস, সিঃ
৪। হাকিম মওলানা খবিরুদ্দীন আহমেদঃ
৫।জনাব মােঃ আবদুস সামাদঃ
৬।গোলাম মাের্শেদঃ
৭। শেখ মোঃ আবু বকর সিদ্দিকঃ
৮। সৈয়দ সিরাজল হুদাঃ
ভােটসংখ্যা
৪৯,০৬৪
৫১,৯৩৬
২৩,৯৬৮
৮১,৪২৫
৩৭,২৭৩
৩৮,১৯৩
২৫,০৭৭
৩৫,৬১৮
আসন্ন নির্বাচনঃ১৯৮১
বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির কার্যকালের স্বাভাবিক মেয়াদ হচ্ছে ৫ বৎসর। কিন্তু ৩০মে ৮১ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে নিহত হলে তার শূন্য পদ পূরণার্থে নির্ধারিত সময় অর্থাৎ ১৯৮৩ সালের আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন প্রথমে ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়। এই তফসীল অনুযায়ী মনােনয়নপত্র গ্রহণের শেষ সময়সীমা ছিল ১০ আগস্ট। মনােনয়নপত্র বাছাই আগস্ট ১১ এবং তা প্রত্যাহারের সময়সীমা ১৭ আগস্ট কিন্তু দেশের রাজনৈতিক দলসমূহ ক্রমাগত নির্বাচন পেছানোর দাবী জানাতে থাকলে এই তফসীল বদল করে মনােনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ৭ সেপ্টেম্বর, বাছাই ৮ সেপ্টেম্বর এবং প্রত্যাহার ১২ সেপ্টেম্বর এবং নির্বাচন ১৫ অক্টোবর নির্ধারিত হয়। এর পরেও বেশীরভাগ বিরােধী রাজনৈতিক দল নবেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে নির্বাচন পেছানোর দাবী জানাতে থাকলে চড়ান্ত ফয়সালায় মনােনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ২১ সেপ্টেম্বর; বাছাই ২২ সেপ্টেম্বর প্রত্যাহার ১৪ অক্টোবর এবং ভােটগ্রহণ ১৫ নবেম্বর স্থির করা হয়।
নির্বাচন পরিচালনার জন্য দেশের ৭১ জন মহকুমা অফিসারকে সহকারী রিটার্নিং অফিসার এবং থানা পর্যায়ের মােট ৯৬১ জন অফিসারকে তাদের সহয়তা করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয। এই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন ১ জন
রিটার্নিং অফিসার ; ৭১ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসার; ২১ হাজার ৮ শত ৫৯ জন প্রিজাইডিং অফিসার; ৬৬ হাজার ২ শত, ২৩ জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং ১ লক্ষ ৩২ হাজার ৪ গত ৪৬ জন পােলিং অফিসার। মােট ২১ হাজার ৮ শত ৫৯টি –ভোট কেন্দ্রের ৬৬ হাজার ২ শত ২৩টি ভোট কক্ষে ভোট গ্রহণ করা হবে। অর্থাৎ এর জন্য মােট ২ লক্ষ ২০ হাজার ৫ শত ২৮ জন বিভিন্ন রকমের ব্যক্তির দরকার রয়েছে। বিভিন্ন সরকারী আধা-সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা থেকে এদের নিয়ােগ করা হয়েছে।
আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সর্বমােট ৩ কোটি ৮৯ লক্ষ ৩৪ হাজার ৪ শত ৯০ জন ভোটার তাদের ভােটাধিকার প্রয়ােগ করবেন। এদের মধ্যে ২ কোটি ৩ লক্ষ ৩৯ হাজার ৭ শত ৩৯ জন পুরুষ এবং ১ কোটি ৮৬ লক্ষ ৯৪ হাজার ৭ শত ৫৯ জন মহিলা ভােটার।
নির্বাচনে ব্যয়
আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন এবং প্রার্থীদের তরফ থেকে প্রচার কাজ চালাবার জন্য কি পরিমাণে টাকা ব্যয় হবে তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে জল্পনা-কল্পনা। গত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ব্যয় হয়েছিল সাড়ে তিন কোটি টাকা । এ বছর কমিশনেরই ১০ কোটি টাকার বেশী খরচ হবে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
এবার ব্যালেট পেপার ছাপাতে প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা খরচ হবে। কাগজের জন্য খরচ হবে আরাে দেড় কোটি টাকা। গত নির্বাচনে ১ লক্ষ ৫৭ হাজার ব্যালেট বাক্স ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ৪০ হাজার বর্তমানে ব্যবহারের যােগ্য নয়। সেগুলাে মেরামত করা ছাড়াও তৈরী হচেছ কাঠের ১৬ হাজার এবং লোহার ১৭ হাজার নতুন ব্যালট বাক্স। প্রতিটি কাঠের বাক্সের দাম পড়ছে ১৫ টাকা এবং প্রতিটি লোহার বাক্সের দাম পড়ছে ১৯৭ টাকা। এছাড়া ইতিমধ্যেই ৫২ হাজার বৃহদাকার বাক্স তৈরী করা হয়েছে। ৮৬ হাজার নতুন বাক্স তৈরী করতে খরচ পড়ছে প্রায় তিন কোটি ৮২ লক্ষ টাকা। প্রধান ৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বী যদি তাদের পােস্টারের জন্য গড়ে ২০ টন করে কাগজ কিনেন তাহলে ব্যয় হবে প্রায় ১ কোটি টাকা । এ দিয়ে পােস্টার ছাপানের ব্যয় পড়বে প্রায় তিন কোটি টাকা। প্রধান প্রতিদন্ধীদের ২২ হাজার ভােটকেন্দ্রের ৬৬ হাজার বুথের অধিকাংশটিতে একাধিক সংখ্যার পােলিং এজেন্ট লাগবে। একেকজন পােলিং এজেন্টকে ৫০ টাকা করে দিলেও প্রধান ৫ জন প্রার্থীকে এবাবদ খরচ করতে হবে প্রায় দু কোটি টাকা। প্রধান নির্বাচনী প্রার্থীরা প্রত্যেকে অন্ততঃপক্ষে গড়ে ১০০টি করে জনসভা করলেও প্রায় ২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা খরচ হবে। এগুলাে সবই হলাে প্রধান প্রধান খাত। এছাড়াও নির্বাচনে কত রকমের ব্যয় রয়েছে তা হিসেব করে বলা কঠিন হয়ে পড়বে।
এবার যারা প্রার্থী
এবারের নির্বাচনে মােট ৭২ জন প্রার্থী তাদের মনােনয়নপত্র পেশ করেন। এদের মধ্যে যাঁরা প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে অবস্থান করছেন তারা হলেন বিএনপি প্রার্থী বিচারপতি জনাব আবদুস সত্তার, আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডঃ কামাল হােসেন, জাতীয় নাগরিক কমিটির মনােনীত প্রার্থী জেনারেল (অবঃ) এম, এ, জি ওসমানী, তিনদলের মেজর (অবঃ) এম, এ, জলিল; পিপলস লীগের ডঃ আলীম আল-রাজী, ন্যাপের (মাে) অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, দেশপ্রেমিক ফ্রন্টের জনাব মােহাম্মদ তােয়াহা, আই ডি এল মাওলানা আবদুর রহিম; স্বতন্ত্র প্রার্থী মওলানা মুহম্মদুল্লাহ (হাফেজ্জী হজুর) এবং সেলিনা মজুমদার। যাঁরা প্রতিদ্ধন্ধীবতা করছেন তাঁরা হচেছন মওলানা গােলাম মােস্তফা খান; শাহজাহান চৌধুরী ; সৈয়দ শামসুর রহমান;
আফতাব উদ্দীন, শেখ মােহাম্মদ রওশন আলী; মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান, খঃ নূরুল ইসলাম সালেহউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, মোঃআকরাম হােসেন মােল্লা জাকির হােসেন, আলহাজ্ব মওলানা খায়রুল ইসলাম যশোরী, নূরুল হক, ছয়ফর রহমান, মােঃ আবদুল জব্বার ; সিদ্দিকুর রহমান ; আলহাজ মাওলানা শেখ মোঃ উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী; হারুনার রশিদ :: আবদুর রহমান খান, মাঃ মােঃ আবদুর রহিম, সাদেক মিয়া ; আলী হােসেন আকতার : মােঃ শফিক; নূর মােহাম্মদ ; এম ; এ মজিদ, এ, বি, এ মছিউদৌল্লা, মনােরঞ্জন দাস ; কাজি মোঃ শাহজাহান; সিরাজুল ইসলাম ; কে; এম, আবুল কালাম আজাদ, আলহাজ গােলাম মোরশেদ ; মােঃ খলিলুর রহমান মজুমদার। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত মােট ৩০ জন প্রার্থী নিবাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করলে সর্বমোট প্রার্থী সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৯ জনে। যারা মনােনয়নপত্র প্রত্যাহার করে ছেন তারা হলেনঃ
১। আজিজুল ইসলাম; ২। অাবদুল হামিদ খান, ৩। মিন্নত আলী, ৪। কাজী ছায়দুল হক, ৫। উমর বিন কসূমুদ্দিন, ৬। গােলাম মোস্তফা মজুমদার, ৭। লুৎফর রহমান জাহাঙ্গীর, ৮। খান এ সবুর, ৯। খ ফয়জুল কবীর ; ১০। আ স ম আবদুল্লা ; ১১। মােহাম্মদ আবুশফী; ১২। আবদুল গফুর ১৩। ছলেমান মিয়া ১৪। ডাঃ মোস্তফা আফাজউদ্দিন আহমদ ১৫। আজিজুল হক ভূয়া ১৬। দেওয়ান মােহাম্মদ আবদুস সেলিম; ১৭। এম;: এ; সােবাহান ১৮। মাহবুবুল আলম ; ১৯। খন্দকার এ ; কে : মােহাম্মদ আলী, ২০। এস, এম, শামসুল হক সিরাজী ২১। মাধব গােবিন্দ সাহা; ২২। আফাজ উদ্দিন চৌধুরী, ২৩। নুরুজ্জামান ২৪। মঈনুল আলম, ২৫। সরাফাত হােসেন চৌধুরী, ২৬। আঃ খায়ের মােঃ শামসুল হুদা; ২৭। মিয়া মােঃ লুৎফর রহমান আনসারী ওরফে কাঞ্চন মিয়া ; ২৮। রাশেদ খান মেনন ২৯। মােঃ আনােয়ার হােসেন; ৩০। নির্মল সেন; ৩১। আঃ সাত্তার; ৩২। আবদুর রাজ্জাক (মােঃ সেলিম চৌধুরী) ৩৩। মােঃ নিজাম উদ্দিন মাস্টার।
নির্বাচনী প্রতীক
এবারের নির্বাচনে প্রার্থীদের জন্য মােট ৭০টি প্রতীক বরাদ্দ করা হয়। প্রতীক পছন্দের জন্য ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দিয়ে দরখাস্ত করতে বলা হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় একাধিক প্রার্থী একই প্রতীক চাইলে পারস্পরিক সমঝােতায় এবং তা সম্ভব না হলে লটারীর ভিত্তিতে প্রতীক নির্ধারণ করা হবে। যে সমস্ত প্রতীক বরাদ্দ করা হয়; সেগুলাে হলাে উড়ােজাহাজ; কুড়াল ; বদনা; বটগাছ, বইসাইকেল, নৌকা, বই, বােতল ; তীর ও ধনুক, পুল, বালতি, গরুর গাড়ী; বাস; উট, মােমবাতি, চেয়ার ; ঘড়ি; মােরগ, নারিকেল ; গরু, চায়ের পেয়ালা, খেজুর গাছ, হরিণ ঢেকি, ঢোলক, হাঁস; হাতী; হাত পাখা; জলন্ত মশাল, মাছ, ফুটবল ; হুক্কা ; ঘােড়া; কুড়েঘর, দোয়াত-কলম, কাঁঠাল ; চাবি, ঘড়ি; কুলা, মই, প্রদীপ, হারিকেন, তালা, আম ; তাল ; তোতা পাখী; পেপে ; আনারস ; কলসী; লাঙ্গল, রেডিও (ট্রানজিস্টার) রেলওয়ে ইঞ্জিন, রিক্সা, গােলাপ ফুল, কাঁচি; ধানের শীষ ; কাস্তে কোদাল, চশমা, তারা, বকপাখী; তলােয়ার; টেবিল ; বাঘ, টাংগা, টিউবওয়েল ; ছাতা; বেহালা; ছড়ি এবং চাকা।
কার ভাগ্য কোন প্রতীক?
১৫ অক্টোবর হাল্কা বাকবিতন্ডা ও মৃদু, দর-কষাকষির মধ্য দিয়ে ৩১ জন প্রার্থীর মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ করা হয়। লাঙ্গল প্রতীকের ব্যাপারে মােট ১২ জন প্রার্থীর প্রথম পছন্দ ছিল। এর মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এম এ জি ওসমানী এবং দেশ প্রেমিক ফ্রন্ট মনোনীত জনাব মােহাম্মদ তোয়াহা ব্যতীত অবশিষ্ট সকলেই স্বতন্ত্র প্রার্থী। এর মধ্যে মােহাম্মদ তোয়াহার লাঙ্গল প্রতীক ছিল একমাত্র পছন্দ। কিন্তু ১২ জন প্রার্থীর কেউই লাঙ্গল প্রতীকের দাবী ছাড়তে চাননি। ওসমানীর পক্ষ থেকে যুক্তি প্রদর্শন করা হয় যে ; তার দল জাতীয় জনতা পার্টির প্রতীক লাঙ্গল এবং আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারলে তিনি কৃষির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেবেন বলে কর্মসূচী ঘােষণা করেছেন। সেজন্য লাঙ্গল প্রতীক তারই পাওয়া উচিত। পক্ষান্তরে তােয়াহা সাহেব বলেন যে, তিনি আজীবন কৃষক-শ্রমিকের সাথে রাজনীতি করেছেন। সেজন্য প্রতীক তারই প্রাপ্য। তাকে লাঙ্গল প্রতীক না দিলে তিনি প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করবেন বলে হুমকি দেন।
অবশেষে লটারীর আশ্রয় গ্রহণ করা হলে স্বতন্ত্র প্রার্থী জনাব নূরুল হক লাঙ্গল প্রতীকের অধিকারী হন। মােহাম্মদ তোয়াহা এ ব্যবস্থা মেনে নিতে পারেন নি। তিনি সদলবলে নির্বাচন কমিশন অফিস পরিত্যাগ করেন। তাঁর অনুপস্থিতিতেই তাকে প্রদীপ প্রতীক দেয়া হয়।
ধানের শীষ প্রতীকের দাবী ছিল তিনজন প্রার্থীর। এরা হলেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি জনাব আবদুস সাত্তার, পিপলস লীগ মনােনীত প্রার্থী ও অলীম আল-রাজী এবং ভাসানী ন্যাপ (সেলিনা) মনােনীত একজন মহিলা প্রার্থী মিসেস সেলিনা মজুমদার। জনাব সাত্তারের পক্ষে এই মর্মে যতি প্রদর্শন করা হয় যে, গত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মরহুম জিয়াউর রহমান ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দিতা করেছিলেন। এবারের নির্বাচনে সেই একই দলের প্রার্থী সাত্তার সাহেব প্রতিদ্বন্দিতা করছেন এবং ধানের শীষ প্রতীক চেয়ে ছেন। এই প্রতীকটি তাঁরই প্রাপ্য। _ এ ব্যাপারে ডক্টর আলীম আল-রাজীর পক্ষ থেকে বলা হয় তিনি ১৯৭৩ সালে ‘ধানের শীষ’ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দিতা করেছিলেন। এই প্রতীকটি তারই প্রাপ্য। মিসেস সেলিনা মজুমদারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, তিনি আজীবন ভাসানী ন্যাপ করেছেন এবং ধানের শীষ ভাসানী ন্যাপেরই প্রতীক। আইনতঃ এই প্রতীকটি তিনিই পাবেন। কিন্তু শেষ অবধি বিএনপি মনােনীত প্রার্থী – মই ‘ধানের শীষ’ প্রতীক বরাদ্দ করা হয়। ছাতা প্রতীক নিয়ে হাফেজজী হুজুর ও অাবুল কালাম আজাদের মধ্যে লটারী অনুষ্ঠিত হয়। লটারীতে জর হয় অবুল কালাম আজ হুজুরের দ্বিতীয় পছন্দ ছিল খেজুর গাছ প্রতীক। কিন্তু এই প্রতীকটি মওলানা যশােরীর প্রথম পছন্দ থাকায় তাকেই বন্দি করা হয়। মওলানা জালালাবাদী, সাইফুর রহমান ও শামসুর রহমানের প্রথম পছন্দ ছিল তলােয়ার প্রতীক। এজন্য লটারী অনুষ্ঠিত হয়। লটারীতে জয়লাভ করেন মওলানা জালালাবাদী। অন্য কোন প্রার্থী নৌকা ও কুড়ে ঘর প্রতীক না চাওয়ায় কোন রকম বিতর্ক ছাড়াই যথাক্রমে আওয়ামী লীগ মনােনীত প্রার্থী ডক্টর কামাল হােসেন ও ন্যাপ (মােঃ) মনােনীত প্রার্থী অধ্যাপক মােজাফফর আহমদের নামে তা বরাদ্দ করা হয়। অবশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যেভাবে বিভিন্ন প্রার্থীর মধ্যে প্রতীক বন্টন করা হয়, তা হলো বিচারপতি জনাব সাত্তার ধানের শীষ ; অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এম এ জি ওসমানী মই; ডঃ কামাল হােসেন নৌকা, মেজর (অবঃ) এম এ জলিল। মশাল, মওলানা মুহম্মদুল্লাহ (হাফেজ্জী হুজুর) বটগাছ, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ কুড়ে ঘর, ডক্টর আলীম আল রাজী রিক্সা, আফতাবউদ্দিন শেখ টেবিল, আবদুর রহমান খান কলসী, আলহাজ গােলাম মাের্শেদ গরুর গাড়ী, আলহাজ মাওলানা খায়রুল ইসলাম যশােরী খেজুর গাছ, আলহাজ মাওলানা খায়রুল ইসলাম যশোরী খেজুর গাছ; আলহাজ মওলানা শেখ মােঃ ওবায়দুল্লাহ বিন সাইদ জালালাবাদী তলােয়ার, আলী হােসেন আক্তার গােলাপ ফুল, এবিএ মছিউদ্দৌলা আনারস; এম এ মজিদ ঘড়ি; কাজী মোঃ শাহজাহান তারা, কে এম আবুল কালাম আজাদ ছাতা, খঃ নূরুল ইসলাম কোদাল, ছায়ফুর রহমান চায়ের পেয়ালা, ছাদেক মিয়া মোরগ, জাকির হােসেন বাস, নূরুল হক লাঙ্গল; মনােরঞ্জন দাশ বাইসাইকেল, মাওলানা গােলাম মোস্তফা খান চেয়ার, মাঃ মােঃ আবদুর রহিম হারিকেন, মােঃ আকরাম হােসেন মোল্লা অাম, মােঃ আবদুল জব্বার কাস্তে; মােঃ খলিলুর রহমান মজুমদার তালা; মােঃ জিল্লুর রহমান হাতি ; মােঃ তােয়াহা প্রদীপ; মােঃ শরিফ নুর মোহাম্মদ গাভী, মােঃ রওশন আলী মাছ, শাহজাহান চৌধুরী হাতপাখা; সালেহউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী উড়ােজাহাজ, সিদ্দিকুর রহমান ভূইয়া বাঘ ; সিরাজুল ইসলাম মােমবাতি ; সেলিনা মজুমদার ফুল, সৈয়দ শামসুর রহমনি বই এবং হারুনার রশিদ দোয়াত-কলম।
ভোটযুদ্ধে রাজনৈতিক দল
উনচল্লিশ জন রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর মধ্যে দলীয় এবং সাংগঠনিক পরিচয় নিয়ে যাঁরা ভােটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন তারা হলেন বিএনপি প্রার্থী বিচারপতি জনাব আবদুস সাত্তার, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (হাসিনা) মনােনীত প্রার্থী ডঃ কামাল হােসেন, নাগরিক কমিটি মনােনীত জাতীয় প্রার্থী অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মুহম্মদ আতাউল গনী ওসমানী, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল; বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টি (গণতান্ত্রিক আন্দোলন) ও শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দলের যুগ্মপ্রার্থী মেজর (অবঃ) এম এ জলিল, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের দুইটি অংশ দুইজন তিনদলীয় রাজনীতিবিদ কামরুন্নাহার লাইলী ও এডভােকেট লুৎফে আলম, পিপলস লীগ (নেওয়াজ) ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি সমন্বয়ে গঠিত দেশপ্রেমিক ফ্রন্টের জনাব মােঃ তোয়াহা, ন্যাপের (মাে) অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ; পিপলস লীগের ডঃ আলীম আল রাজী; আই ডি এল এর মওলানা আবদুর রহিম এবং ভাসানী ন্যাপের সেলিনা মজুমদার। এছাড়াও রাজনৈতিক দলের প্রার্থী না হয়েও সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে প্রতিদ্বন্দিতা করছেন মওলানা মুহাম্মদুল্লাহ (হাফেজজী হুজুর)
বি এন পি
১৯৭৫ সনের অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর আরােপিত নিষেধাজ্ঞা ১৯৭৬ সনে প্রত্যাহার করা হলে মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল গঠন করেন। ১৯৭৮ সালে এই দল ভেঙে দেয়া হয় ও দলের পক্ষ থেকে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট নামে একটি সংগঠন সৃষ্টি করে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার পর জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের গোড়াপত্তন করেন। রাষ্ট্রপ্রধান দলের চেয়ারম্যান হওয়ায় অচিরেই দেশব্যাপী এর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়ে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী দলের অফিস খােলা হয়। রাষ্ট্রপতি মরহুম জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে দেশের অর্থনৈতিক পশ্চাদগামীতা রোধ ও সর্বক্ষেত্রে সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে তাঁর ১৯-দফা অর্থ-সামাজিক কর্মসূচী ঘোষণা করেন। এই দফাগুলাের মধ্যে প্রধান ছিলো বাংলাদেশের প্রতিটি জনসাধারণকে নিরক্ষরতা থেকে মুক্তি, (শিক্ষা বিপ্লব), প্রতিটি ফসলের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা দ্বিগুনীকরণ ও বাস্তবায়ন (কৃষি বিপ্লব), খালকাটা কর্মসূচী নিয়ে স্বেচছাশ্রমের ভিত্তিতে প্রতি ইন্চি অনাবাদী ভূমিকে কৃষি উপযােগী করে তােলা; সমাজের সর্বস্তর হতে দুর্নীতি ঘুষ ; জুয়া ; ইত্যাদি নির্মল করা ; কুটির শিল্প ও ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসারের মাধ্যমে আমদানীনির্ভর অর্থনীতির অবসান ঘটিয়ে দেশকে উৎপাদনের দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তােলা, সমাজ থেকে বেকারত্বজনিত হতাশার অবসান ঘটিয়ে প্রত্যেকটি মানুষের হাতকে কর্মী ও উৎপাদনমুখী হাঁতে পরিণত করা ইত্যাদি।
চলতি বছরের ৩০ মে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান নিহত হলে উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি জনাব আবদুস সত্তার সাংবিধানিক ক্ষমতায় তার স্থলাভিষিক্ত হন ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ক্ষমতার শীর্ষে আরােহন করেই বিচারপতি জনাব আবদুস সাত্তার মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অনুসৃত রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক সকল পরিকল্পনার অর্ধসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার কথা ঘােষণা করেন।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতারােহনের পর প্রচলিত সংবিধানের বিধি অনুসারে বিচারপতি জনাব আবদুস সাত্তার ১৮০ দিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন ও জাতীয়তাবাদী দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দিতা করার জন্য দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনােনয়ন লাভ করেন।
দলীয় মনােনয়ন লাভের পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নতুন কোন নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ না করে মরহুম প্রেসি-ডেন্ট জিয়াউর রহমানের অসমাপ্ত ১৯-দফা কর্মসূচীকেই নিব। চনী ম্যানিফেস্টো হিসেবে গ্রহণ করে ও নির্বাচনে জয়ী হলে এই ১৯-দফা কর্মসূচীর পূর্ণ বাস্তবায়নের আশ্বাস দেয়া হয়।
নাগরিক কমিটি
দক্ষিণ তালপট্টিতে ভারতীয় আগ্রাসন ও তাকে উপলক্ষ্য করে দেশের সর্বত্র সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ চক্রান্তের প্রতিবাদী সংগঠন হিসেবে চলতি বছর মে মাসে প্রগতিশীল চিন্তাবিদ ডঃ আহমদ শরীফ ও রাজনীতিবিদ সাংবাদিক এ জেড এনায়েতল্লাহ খানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বধীনে ঢাকায় নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়। প্রতিষ্ঠার পরবর্তী মুহূর্ত থেকে দেশের অসংখ্য প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবি এই সংগঠনের প্রতি নিজেদের একাত্নতা ঘােষণা করেন ও সমাজ থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প মুছে ফেলায় কৃতসংকল্প হয়ে এক দুরূহ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন।
ঢাকার প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে নাগরিক কমিটি তার প্রস্তাবিত কর্মসূচী পেশ করে। এই কর্মসূচীর অন্তত ছিলাে দেশের স্বাধীনতা ও সর্বভৌমত্বের ওপর সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদী হামলা প্রতিহত করণ, জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী সকল অসমচুক্তি বাতিলকরণ; জোটনিরপেক্ষ স্বাধীন, পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ; সার্বভৌম জাতীয় পরিষদ গঠন, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, পশ্চাৎপদ ও গ্রামাঞ্চলের রুদ্রশিল্প উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় সহায়তা দান, চোরাচালান ও পুজি পাচার রহিতকরণ বেকারদের চাকুরীর সংস্থান করা ; কৃষির
সমবায়করণ ; বর্গাস্বত্ব রেজিষ্ট্রীকরণ ও সময়ভিত্তিক বর্গাচুক্তি প্রথার প্রণয়ন বর্গাচাষী ও গরীব চাষীদের জন্য বিশেষ ব্যাংকঋণ প্রবর্তন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সনদের ভিত্তিতে শ্রমনীতি প্রণয়ন, প্রাথমিক শিক্ষা সার্বজনীন ও বাধ্যতামূলককরণ ; প্রশাসনের সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালুকরণ প্রাথমিক স্বাস্থ্যরক্ষা, শিশু– স্বাস্থ্য মাতৃসদন ও পুষ্টির ওপর গুরত্ব আরাে সর্বজনীন বাস্থ্য বীমার মাধ্যমে চিকিৎস্য ও ন্যায্যমূলে। ঔষুধ সরবরাহ, নারী নির্যাতনমূলক সামাজিক প্রথা ও আইনরহিত করণ সকলের জন্য বাসস্থান এই লক্ষে শহর ও গ্রামে স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নাগরিক কর্মসংস্থান ও যাতায়াত সমস্যার সমাধানকরণ ইত্যাদি।
অাসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সব সাধারণের সমষ্টিগত ইচছার বাহক ও সাধারণ মানুষের কাছাকাছি অবস্থানকারী একজন ব্যক্তিত্বকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করার জন্য নাগরিক কমিটি এমন একজন লোকের সন্ধান করতে থাকে, যিনি সারা দেশে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব; অনমনীয় ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক ধীশক্তির দিক দিয়ে সপরিচিত ও জনপ্রিয় হবেন। বস্তুতঃ বাংলাদেশের বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে সর্বসম্মতভাবে গ্রহণযােগ্য ও সকলের কাছে সমান আদৃত একজন ব্যক্তিত্বের অভাববােধই নাগরিক কমিটিকে এহেন অনুসন্ধানে ব্যাপৃত করে। অবশেষে একক চরিত্রে উপরােক্ত সবগুলো গুণের একত্রীভূত সমাবেশ উপলব্ধি করে নাগরিক কমিটি তাদের পক্ষে নির্বাচনযুদ্ধে অবতীর্ণ হবার জন্য জেনারেল (অবঃ) ওসমানীকে মনােনয়ন দেয়।
রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে ওসমানীকে মনােনয়ন দানের পরপরই নাগরিক কমিটি দেশের অন্যান্য বিরােধী দলগুলাের সমন্বয়ে একটি নির্বাচনী ঐক্যজোট গঠনের অভিলাষ ব্যক্ত করে। এ পর্যায়ে প্রথমেই তারা বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সমর্থন লাভ করে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদও একে সমর্থন জানায়।
পরবর্তী পর্যায়ে এদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন বাংলাদেশের মজদুর পার্টি, জাতীয় জনতা পার্টি, বাংলাদেশ আওয়মী লীগ (মিজান) ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (নাসের) কৃষক তাঁতি পার্টি, প্রগতিশীল পার্টি ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে জেনারেল (অবঃ) ওসমানীর নাম দেশে-বিদেশে বিপুলভাবে আলােচিত এবং সমাদত। অন্যদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে সফলতার অগ্রণায়ক হিসেবে তিনি দেশের প্রতিটি মুক্তিযােদ্ধার অতি আপনজন। প্রকারণেই বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতিটি ইউনিট তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধা স্থাপন করে ও ওসমানীর নির্বাচনী যুদ্ধে সহযােদ্ধা হবার ইচছা প্রকাশ করে। এর ফলে দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নাগরিক কমিটি এক বিরাট সাংগঠনিক শক্তির পৃষ্ঠপােষকতা অর্জন করে।
কিন্তু অন্যান্য বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাের অধিকাংশ অভ্যন্তরীণ বিশৃংখলা ও সংঘাতে জর্জরিত হওয়ায় নির্বাচনী ঐকাজোট গঠনের পরিকল্পনা কার্যকর হতে পারেনি। একই দলের মধ্যে বিভিন্নমুখী রাজনৈতিক আদর্শের বিস্তার ও ব্যক্তিস্বার্থের কারণে কোন বিরােধী দলই সম্পূর্ণভাবে সমর্থন নিয়ে জেনারেল – (অব) ওসমানীর সঙ্গে সমঝােতায় আসতে পারেনি। এদের মধ্যে কেবলমাত্র মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের অংশ নিজেদের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার ওপর বিরাট ঝুকি নিয়েও ওসমানীর সঙ্গে এক একাত্নতা ঘােষণা করে। নির্বাচনী ঐক্যজোট গঠনের প্রশ্নে জেনারেল (অবঃ) ওসমানীর সঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (হাসিনা) দশদলীয় – ঐক্যজোট; ১৮-দলীয় ঐক্যজোট বা ন্যাশনাল ফ্রন্ট ; ত্রিদলীয় ঐক্যজোট এবং অন্যান্য বিরােধী দলগুলাের সঙ্গে বেশ কয়েক পায়ে মতবিনিময় হয়। কিন্তু পারষ্পরিক মত্যনৈক্য ও সমঝোতাহীনতার- কারণে এসমস্ত আলােচনা সফল হয়নি। জেনারেল (অবঃ) ওসমানী নিজে জনতা পার্টির সভাপতি হলেও দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে নামেন নি, তবে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি তাঁর নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তাব সর্বসম্মত ভাবে অনুমােদন করেছে।
নির্বাচনে তিনি জনতা পার্টির কর্মসূচী অবলম্বন না করে জনসাধারণের সাধারণ ইচছার প্রতিফলন হিসেবে আলাদা একটি নির্বাচনী ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। নির্বাচনে জয়ী হলে তিনি যেসমস্ত অথনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক কর্মসূচী , বাস্তবায়নের অাশা রাখেন, সেগুলো হলাে : ১৯৭৫ সনের ২৫ জানুয়ারীর চতুর্থ সংশোধনীর পূর্বেকার পূর্ণ গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারের ভিত্তিতে ১৯৭২ সনের সংবিধানে ব্যক্ত সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃ প্রতিষ্ঠা, প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান; সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, সকল নাগরিককে নিজ নিজ ধর্মে বিশ্বাস স্থাপনের, তা প্রচারের এবং পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান; বিচার বিভাগকে প্রশাসন থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথকীকরণ, সকল প্রকার নিবর্তনমূলক কালাকানুন বাতিল। কারারুদ্ধ রাজবন্দীদের মুক্তি এবং সামরিক আইনে দন্ডিতদের সর্বোচচ আদালত পর্যন্ত আপীলের সুযোগ দান, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও কল্যাণ ট্রাস্ট শক্তিশালী করে প্রকৃত মক্তিযােদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন, আর্মড সার্ভিসের বাের্ডের পুর্নগঠন; সর্বক্ষেত্রে সম্ভাব্য উৎপাদন শক্তির পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, কৃষির ব্যাপক সমবায় ও অাধুনিকীকরণ ; ভূমিহীন, ক্ষেত মজুরদের রেজিষ্ট্রেশন ও সময়ভিত্তিক বর্গাচুক্তি প্রণয়ন, ফসলের উৎপাদন ব্যয় ও কৃষক পরিবারের জীবিকা নির্বাহের ব্যয় বিবেচনা করে কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ, চোরাচালন ও পুজি পাচার রহিতকরণ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সনদের ভিত্তিতে শ্রমনীতি প্রণয়ন, শিক্ষাব্যবস্থাকে বৃত্তিমূলক ও উৎপাদনমুখীকরণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতকরণ, অভিন্ন পাঠ্যসূচীর প্রবর্তন ; সকল প্রকার অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ রােধ, প্রাথমিক স্বাস্থ্যরক্ষা শিশুস্বাস্থ্য, মাতৃমঙ্গল ; পুষ্টির ওপর গুরত্ব আরােপ ও সার্বজনীন স্বাস্থ্যবীমার মাধ্যমে চিকিৎসা ও বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ; সকলের জন্য বাসস্থান—এই লক্ষ্যে শহর ও গ্রামে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ, নারী নিবর্তনমূলক সামাজিক প্রথা ও আইন নিষিদ্ধকরণ, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিভিত্তিক জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির প্রবর্তন, বিদেশের সঙ্গে সংস্থাপিত চুক্তিসমূহের পুর্নমূল্যায়ন, সকল বিরােধের শান্তিপূর্ণ মীমংসায় পদক্ষেপ গ্রহণ, প্রশিক্ষণে ক্ষতি সৃষ্টি না করে দেশরক্ষা বাহিনীকে উৎপাদনক্ষম জাতিগঠনমূলক প্রকল্পের কাজে নিয়ােগ পুলিশ ব্যবস্থায় এবং পুলিশ প্রশাসনের আধুনিকীকরণ ইত্যাদি।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (হাসিনা)
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (হাসিনা) বহু চড়াই উৎরাই অতিক্রম করে ১৯৮১ এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পর্যন্ত আসতে পেরেছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর স্থানীয় রাজ-নীতিবিদদের নেতৃস্থানীয় অংশ ও পাকিস্তান আন্দোলনের অগ্রদূত ও সমমনা ব্যক্তিদের নিয়ে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে মরহুম মওলানা ভাসানী ও মরহুম হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বাধীনে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের গোড়াপত্তন ঘটে।
১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ, শেরে বাংলার কৃষক-শ্রমিক পার্টি; নেজামে ইসলাম এবং গণতন্ত্রী দলের সমন্বয়ে একটি নির্বাচনী যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয় এবং নির্বাচনে এই সম্মিলিত দল ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ৩০৯টি অসনের ২০৯টি আসন লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী মুসলিম লীগ কয়েকটি সমসাময়িক ইস্যু ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের কারণে দ্বিখণ্ডিত কয়েকটি সমসাময়িক ইস্যু ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায় ও এর বড় অংশটি আওয়ামী লীগ নামে নতুন ব্যানারের নিচে সংগঠিত হয়।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হলে সমস্ত রাজনৈতিক ক্রিয়াকান্ড নিষিদ্ধ হয়ে যায় ও আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা জেল বরণ করেন। কিন্তু কয়েকজন নেতা আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে গােপনে সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকেন ও ধীরে ধীরে পরবর্তী রাজনৈতিক সংগ্রামের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে থাকেন।
১৯৬৪ সাল হতে আওয়ামী লীগ তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এসময় এই দল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য দূরীকরনের লক্ষ্যমাত্রই স্থির করে। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় শক্তির ওপর পাশ্ববর্তী একটি দেশের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে সশস্ত্র অভ্যুত্থান সংঘটনের দায়ে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকে গ্রেফতার করা হয় ও দলের কেন্দ্রীয় নেতা শেখ মুজিবর রহমান সহ বেশ কয়েকজনের বিরদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সূত্রপাত ঘটানাে হয়। কিন্তু গণ-আন্দোলনের তাপে শেষপর্যন্ত এই মামলা প্রত্যাহার করে গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তি দেয়া হয়।
১৯৬৬ সাল থেকে আওয়ামী লীগ প্রত্যক্ষ গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত করতে থাকে ও পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও কয়েকটি অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়ে ৬-দফা প্রস্তাব পেশ করে। ছয়-দফার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রদেশের জনগণ সম্মিলিত একাত্মতা প্রদর্শন করতে থাকায় ১৯৭০ সালে দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন দেয়া হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক ও জাতীয় উভয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
কিন্তু আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মক্তি যুদ্ধ শুরু হয়। এসময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ভারতে অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়।
একই বছর স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠন করা হয়। এসময় থেকে আওয়ামী লীগের ভাগ্যাকাশে দুর্যোগ দেখা দিতে থাকে। ১৯৭৪ সালে সারাদেশে বিরাট দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় যার জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করা হয়। এসময় নিপীড়িত জনতার বিক্ষোভ এত স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সরকারের পতন আসন্ন হয়ে ওঠে। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারী মাসে দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে দিয়ে একদলীয় প্রথার ভিত্তিতে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু রাজ নৈতিকভাবে সকলকে কোনঠাসা করেও সরকার তার পতন এড়াতে পারেন নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কয়েকজন সামরিক অফিসার ও জওয়ানদের অভ্যুত্থানে দলের চেয়ারম্যান ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান সপরিবারে নিহত হন।
১৯৭৮ সালে পুনরায় দেশে রাজনৈতিক তৎপরতা আরম্ভ হলে আওয়ামী লীগ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায় ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি সমান্তরাল আওয়ামী লীগের জন্ম হয়।
এরপর থেকে আওয়ামী লীগ আবার নতুনভাবে সংগঠিত হতে থাকে ও আবদুল মালেক উকিলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ৪০টি আসন অর্জন করে সংসদে বৃহত্তম বিরােধী দলের আসন গ্রহণ করে।
চলতি বছর ১৭ মার্চ শেখ মুজিবের কন্যা মিসেস হাসিনা ওয়াজেদ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন ও ব্যাপক সাংগঠনিক তৎপরতা আরম্ভ করেন। আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এককালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ডঃ কামাল হােসেনকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে মনােনয়ন দিয়েছে।
ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ তার ১৭-দফা নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে। এই ১৭-দফা কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ১৯৭২ সালের শাসনতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন, সকল কালাকানুন বাতিল; রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে শৃংখলা আনয়ন ; কৃষিসমবায় ও ভূমি সংস্কার; বেকারত্ব দূরীকরণ; বৈদেশিক ঋণের পূর্ণস্ব্যবহার, আমদানী রফতানীতে ভারসাম্য আনয়ন: ব্যক্তি মালিকানায় শিল্প প্রতিষ্ঠা কৃষি ও শিল্পের সকল ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্ব বিলােপ, শক্তিশালী ও সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা ; আইন শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ইত্যাদি।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল
১৯৭২ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার দলীয় সংগঠন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখা দেয়। দলীয় কিছু সংখ্যক নেতার খামখেয়ালীপনা ও প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্রের স্বার্থে বাংলাদেশের স্বার্থকে নষ্ট করার মতান্তরজনিত প্রশ্নে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন যুবককর্মী ও নেতা হয়ে ওঠেন প্রতিবাদমুখর। স্বার্থগত এই কোন্দল পরবর্তীকালে আদর্শগত কোন্দলে রূপ নেয় ও তার অনিবার্য ফল হিসেবে একই বছর ১৮ অক্টোবর দলের সমমনা বিশিষ্ট কয়েকজন যুবকের প্রকাশ্য বিদ্রোহ, আওয়ামী লীগে ভাঙ্গনের সূচনা ঘটায়। একই দিনে মেজর (অবঃ) এম এ জলিল ও আ স ম আবদুর রবের যৌথ আহ্বানে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের উন্মেষ ঘটে।
১৯৭৩ সালের জানুয়ারী মাসে এর প্রথম কনভেনশনে এবং একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে এর প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে দলের স্থায়ী কমিটি গঠন করে পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচী প্রকাশ করা হয়।
১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জাসদ একটি আসনে জয়লাভ করে। কিছুদিন পরে অনুষ্ঠিত একটি উপ-নির্বাচনে জাসদ আরাে একটি আসনে জয়লাভ করে ও পরবর্তীকালে আরেকটি উপ-নির্বাচনে যুগ্মভাবে জয়ী হয়ে জাতীয় সংসদে যৌথ সদস্যপদ লাভ করে।
১৯৭৩ সাল থেকেই একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে জাসদ আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। ১ মার্চ থেকে সারাদেশে জাসদের নেতৃত্বে ফ্যাসীবাদ বিরােধী আন্দোলন শুরু হয়। দেশের সর্বত্র ঘন ঘন হরতাল জঙ্গী সমাবেশ ও বিক্ষোভের আয়োজন করা হতে থাকে। ১৭ মার্চ জাসদ তার দাবী আদায়ের লক্ষ্যে ও সামাজিক দুর্নীতি রােধের আহ্বান জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও করলে পুলিশ গুলী চালিয়ে প্রায় ৫০ জনকে হত্যা করে। জলিল এবং রব সহ প্রায় ১০০ জন জাসদ কর্মীকে বিশৃংখলা সৃষ্টির অভিযােগে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৭৪ সালে বহুদলীয় প্রথা ভেঙ্গে দিয়ে বাকশাল গঠন করা হলে জাসদ বাকশাল-বিরােধী আন্দোলনে তৎপর হয়ে ওঠে। একই সময়ে সমস্ত রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক কার্যকলাপের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী হলে জাসদ আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায় । এসময় গোপন রাজনৈতিক তৎপরতা হিসেবে তারা নিজেদের সংগঠন শক্তিশালী করতে থাকে।
৭৫ এর আগস্টে শেখ মুজিব নিহত হলে জাসদ বেসামরিক রাজনীতির পাশাপাশি সামরিক বাহিনীতেও একটি শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলার কাজে হাত দেয় ও সেনাবাহিনীতে বিপ্লবী পরিষদ নামের প্রগতিশীল একটি গ্রুপের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করতে থাকে। এদেরই মাধ্যমে জাসদের নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সেনাবাহিনীতে একটি অভ্যুত্থান সূচিত হয়। এতে তৎকলীন লেঃ কর্নেল জিয়াউর রহমানের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রশক্তির পতন ঘটানাে হয়। ৮ নভেম্বর তারিখে জাসদ নেতা মেজর (অব) এম এ জলিল ও আ স ম আবদুর রব কারাগার হতে বিনাশর্তে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৭৫ সালের ১২ নভেম্বর জাসদ নেতা রব জলিল এবং কর্নেল তাহেরকে সেনাবাহিনীতে বিশৃংখলা সৃষ্টির দায়ে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়।
অতঃপর কারাগারের অভ্যন্তরে সামরিক আইনের আওতায় একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে অভিযুক্ত জাসদ নেতাদের বিচার করা হয়। বিচারে কর্নেল তাহের ও মেজর (অব) জলিলের মুত্যুদন্ড হয়। পরে কর্নেল তাহেরের মত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় এবং মেজর (অবঃ) জলিলের দন্ড হ্রাস করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়।
১৯৭৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাতীয় সংসদে ৯টি আসন লাভ করে। নির্বাচনের পরে সাধারণ ক্ষমার আওতায় রব, জলিল ও সিরাজুল আলম খান সহ বেশ কয়েকজন জাসদ নেতাকে মুক্তি দেয়া হয়।
১৯৮০ সালে জাসদ কর্মসূচীবিহীন ইস্যুভিত্তিক প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সহ নয়টি বিরোধী দলের সমন্বয়ে দশ-দলীয় ঐক্যজোট ও ওয়ার্কার্স পার্টি এবং শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের সঙ্গে ত্ৰি-দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। কিন্তু আদর্শগত ঐক্য সম্ভব না হওয়ায় এবং পূর্ণাঙ্গ কোন কর্মসূচী দিতে ব্যর্থ হওয়ায় এসমস্ত ঐক্যজোট বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশেষ কোন সুবিধা করতে পারেনি।
আওয়ামী লীগ (হাসিনা) এবং ওসমানীর সঙ্গে মতানৈক্যের কারনে কোন নির্বাচনী ঐক্যফ্রন্ট গঠনে ব্যর্থ হওয়ায় আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জাসদ ত্ৰি-দলীয় ঐক্যজোটের পক্ষ থেকে মেজর (অবঃ) জলিলকে মনােনয়ন দান করে নিম্নোক্ত প্রস্তাবগুলাে সামনে রেখে নির্বাচনী ইশতেহর প্রকাশ করেছেঃ
চতুর্থ ও পঞ্চম সংশােধনী বাতিল করে সংসদীয় ব্যবহার পুনঃপ্রবর্তন; সংসদে সংখ্যানুপাতিক হারে পেশাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ ও বিভিন্ন পেশার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে স্বশাসিত সংস্থা প্রতিষ্ঠা বিচার বিভাগ থেকে প্রশাসনকে পৃথকীকরণ; বাক স্বাধীনতা; সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ; ট্রেড ইউনিয়ন ; ধর্মঘট ও ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিতকরণ, প্রশাসন গণতন্ত্রীকরণ সংখ্যালঘু জাতিসত্তা সমূহের স্ব স্ব জাতিসত্তায় স্বীকৃতি প্রদান; প্রতিরক্ষা ও শৃংখলা ও রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক কাঠামাে গঠন, শিক্ষা ব্যবহার রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, জনসাধারণের চিকিৎসার নিরাপত্তা ; ভূমিহীন ক্ষেত মজুরদের নিয়ে কর্মী শিবির গঠন বর্গা চাষীদের বর্গাস্বত্ব প্রদান; জমির সিলিং কমিয়ে যৌথ চাষাবাদের প্রবর্তন পাটশিল্প পাট ব্যবসার জাতীয়করণ, রাষ্ট্রীয় ব্যবসাকেন্দ্র চালুকরণ ; যুদ্ধ নয় শান্তি ভিত্তিতে সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সকল অসম ও অমর্যাদাকর চুক্তি বাতিল ইত্যাদি।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর)
১৯৫৭ সালের কাগমারী আওয়ামী মুসলিম লীগের ভিতরকার প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক গ্রুপ স্বায়ত্বশাসন এবং স্বাধীন, নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে ডানপন্থী মাের্চার সঙ্গে মতানৈক্যের সম্মুখীন হয়। এর ফলে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ও সভাপতিত্বে এবং মাহমদুল হক ওসমানীকে সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে নতুন এক রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয় ঘটে।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসক জারী হলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো এ দলটিও আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায় ও গােপনে রাজনৈতিক তৎপরতা ও প্রশিক্ষণ চালাতে থাকে । ১৯৬২ সালে নতুন শাসনতন্ত্র জারী করার পর রাজনৈতিক দল গঠনের অনুমতি পাবার পর ন্যাপ আবার নতুনভাবে সংগঠিত হয়।
১৯৬৪ সালে ন্যাপ এর দলীয় কাঠামােতে এক অনিবার্য ভাঙ্গনের সুত্রপাত ঘটে। এসময়ে আইউব খানের পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বমূলক সহাবস্থানের ইস্যুতে ন্যাপের একটি অংশ প্রতিবাদ জানায় এবং এই অংশটি প্রত্যক্ষভাবে রাশিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক আঁতাত স্থাপনের জন্য দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা চালায়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৬-দফা উত্থাপিত হলে মাওলানা সাহেবের নেতৃত্বে এই কর্মসূচীর ওপর অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করা হয়। কিন্তু ন্যাপের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মােজাফফর আহমেদ তার দলের বিতর্কিত অংশটি নিয়ে ৬-দফা প্রশ্নে নীতিগত সমর্থন দেয়ার জন্য পার্টির ওপর চাপ প্রয়ােগ করেন। এদের যুক্তি ছিলাে যদিও ৬-দফা একটি সর্বাঙ্গসুন্দর কর্মসূচী নয়, তথাপি মজলুম কৃষক শ্রমিকের স্বার্থে এর ওপর আপাতঃ সমর্থন দেয়া যায়।
দলের সঙ্গে নীতিগত মনােমালিন্যের কারণে ১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে ন্যাপ একটি আলাদা সংগঠন দাঁড় করায় ও সৈয়দ আলতাফ হােসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে অধ্যাপক মােজাফফরের সভাপতিত্বে একটি তলবী কমিটি গঠন করা হয়। এরপর কিছুদিন পর্যন্ত মােজাফফর ন্যাপের এই অংশটি তলবী ন্যাপ নামে পরিচিত ছিল।
১৯৬৮ সালে পেশােয়ার কনফারেন্সে খান মােহাম্মদ ওয়ালী খানের নেতৃত্বে পাকিস্তান ন্যাপ গঠন করা হলে মােজাফফর ন্যাপ তাতে যােগ দেয় ও ওয়ালী খানের সভাপতিত্বে পাকিস্তান ন্যাপের নতুন কমিটি গঠিত হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান ন্যাপ পশ্চিম পাকিস্তান হতে ৩৯টি এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে ১টি। আসিন লাভ করে। স্বাধীনতার পরে মােজাফফর ন্যাপ নতুনভাবে সংগঠিত হয় ও ১৯৭৩ সালের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে একটি আসন লাভ করে।
আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ ন্যাপ এর পক্ষ থেকে ভােটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন।
দেশপ্রেমিক ফ্রন্ট
বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের দু’টি অংশ, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি, পিপলস লীগ (নেওয়াজ) এবং দু’জন ব্যক্তি কামরুন্নাহার লাইলী ও এডভােকেট লুৎফে আলমের সমন্বয়ে ২৬ আগস্ট ৮১ দেশপ্রেমিক ফ্রন্ট নামের নির্বাচনী ঐক্যজোট গঠন করা হয়। বৃটিশ আমল থেকে বামপন্থী-চরমপন্থী রাজনীতির সঙ্গে …(অস্পষ্ট)ত সাম্যবাদী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলাের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু বৃটিশ এবং পাকিস্তানী আমলে কমিউনিস্ট ভাবধারাশ্রিত এই দলটি প্রকাশ্য রাজনীতির তেমন সুযােগ পায়নি। পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার সাম্যবাদী দল নামে সংগঠনটি আপন রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতাে। ১৯৬৭ সালে আদর্শগত স্বম্বের কারণে দলটি দ্বিখন্ডিত হয়ে পড়ে ও মনিসিং-এর নেতৃত্বে দলের একটি অংশ নতুন সংগঠন দাঁড় করায়। মূল অংশটি পূর্ব বাংলার সাম্যবাদী দল নামেই কাজ করতে থাকে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাতি-বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বে সর্বহারার বিপ্লব সম্ভব কিনা এই প্রশ্নে মতানৈক্য হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও স্বাধীন বাংলাদেশ বিপ্লব মূল্যায়ন এই দুই ইস্যুতে দলের মােহাম্মদ তোয়াহা ও আবদুল হকের মধ্যে বিরােধ দেখা দেয় এবং আবদুল হকের নেতৃত্বে একটি অংশ দল ছেড়ে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন চালাতে থাকে। বাকী অংশটি বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল নামে পরিচিত হয়।
১৯৭৭ সালে দলের কেন্দ্রীয় নেতা মােঃ তােয়াহা ও নগেন সরকারের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়ায় এই দুই নেতার নেতৃত্বে দলটি আবার দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে। আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নগেন সরকারের দলটি প্রথমে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পরে পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ডঃ আলীম আল রাজীর পিপলস লীগ থেকে বের হয়ে আসা গরীব নেওয়াজের অংশ, মতিউর রহমান ও অধ্যক্ষ সিরাজুল হকের নেতৃত্বাধীন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি এবং বাংলাদেশ-চীন সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট কামরুন্নাহার লাইলী ও সাধারণ সম্পাদক এডভােকেট লুৎফে আলমের সমন্বয়ে গঠিত দেশপ্রেমিক ফ্রন্টে যােগ দিয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়।
বলাবাহুল্য, বিগত ১৩ অক্টোবর নগেন সরকারের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (নগেন) অস্থায়ীভাবে খােন্দকার। আলী আব্বাস ও দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীনে পরিচালিত হচ্ছে।
ইতিমধ্যে এক নির্বাচনী ইশতেহারে দেশপ্রেমিক ফ্রন্ট ২১ দফা কর্মসূচী পেশ করেছে যার মধ্যে রয়েছে ভারতের সঙ্গে ২৫ বৎসর মেয়াদী চুক্তি বাতিল; রুশ-ভারতের আগ্রাসী চক্ৰান্ত প্রতিহতকরণ; সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন, ভারতীয় পণ্য আমদানী নিষিদ্ধকরণ, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা সমূহের অধিকার নিশ্চিত করণ, শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিতকরণ, ভূমির আমল সংস্কার সাধন, ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন, ও ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের নায়কদের পুনর্বাসন।
এগুলাে ছাড়া রাজনৈতিক দল হিসেবে অনুল্লেখযোগ্য সংগঠন থেকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন জামাতে ইসলাম থেকে বেরিয়ে আসা ইসলামিক ডেমােক্রেটিক লীগের মওলানা আবদুর রহিম এবং ইসলামী সাম্যবাদী দল, বাংলাদেশ লেবার পার্টি এবং পিপলস লীগের চেয়ারম্যান ডঃ আলীম আল রাজী। তবে এদের পক্ষে কোন নির্বাচনী তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছেনা।
মাওলানা মােহাম্মদুল্লাহ্
(হাফেজজী হুজুর)
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ৩৯ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩০ জনই স্বতন্ত্র বা নির্দলীয় পদপ্রার্থী। অনুলেখযােগ্য রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের অধিকারী এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠার দিক দিয়ে বৈশিষ্ট্যবর্জিত বলে সংগঠনবিহীন এসমস্ত প্রার্থীর সম্ভাবনা একেবারেই অনুজ্জ্বল একথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়। তবুও এক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রমী ধারার সৃষ্টি করে নির্বাচনী প্রাঙ্গণে যে স্বতন্ত্র প্রার্থী রীতিমতাে আলােচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছেন, তিনি বাংলার শােষিত বঞ্চিত মজলুম জনগণের বর্ষীয়ান মুরুব্বী ও পথপ্রদর্শক মাওলানা মােহাম্মদুল্লাহ্ যিনি হাফেজজী হুজুর নামেই বেশি পরিচিত।
বস্তুতঃ কেবলমাত্র ধর্মভিত্তিক প্রেরণকে সম্বল করে এদেশে কোন নির্দলীয় ব্যক্তিকে সরাসরি রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হয়ে জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য এর আগে এতােটা সরব হতে দেখা যায়নি। ঢাকার লালবাগ জামে মসজিদের হাফেজ মাওলানা মােহাম্মদুল্লাহ্ আলেম সমাজে একটি সপরিচিত নাম। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে ; আমলা; ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবী মহলে, সর্বত্র তার বেশ ভক্ত ছড়িয়ে আছে; যাঁরা রাজনীতির চাইতে ধর্মকে রাষ্ট্র পরিচালনায় অধিক কার্যকর বলে মনে করেন, এমন লােকের সংখ্যাও আমাদের দেশে কম নয়। কাজেই ধর্মীয় প্রেরণাকে সামনে রেখে রাষ্ট্র পরিচালনাকে ধর্মের আরাে কাছাকাছি টেনে এনে এখনাে লােকের আস্থা অর্জন করা যায়—এসত্যটি হাফেজজী হুজুর সম্পর্কে আলোচনার ঝড়ই অনেকটা সপ্রমাণিত করে তােলে।
এপ্রসঙ্গে আমাদের দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার একটি বিশেষ প্রবণতার কথা উল্লেখ করা যায়। মূলতঃ এতদঞ্চলের মাদ্রাসা শিক্ষা দুটি প্রধান স্রোতােধারায় বিভক্ত। একটি আলীগড়ী, যাঁরা ইসলাম ধর্মকে আধুনিক ছাঁচে ঢেলে সমসাময়িক যুগের উপযােগী করতে অধিকমাত্রায় আগ্রহী। ইসলামভাবাপন্ন হলেও এরা অনেকটা সংস্কারধর্মী এবং পাশ্চাত্য শিক্ষাকে বা ইসলামে আধুনিকতার সংস্পর্শকে এরা শুদ্ধবাদী নীতি বলে মনে করেন। অন্যটি হলাে দেওবন্দ পন্থী–যারা আদি ও অকৃত্রিম কোরান ও সুন্নাকে জীবনধর্মের প্রধান মূলমন্ত্র বলে মনে করেন এবং নির্ভেজাল ইসলামী আদর্শের মূল ধারা থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হতে চান না। হজরত মাওলানা মােহাম্মদুল্লাহ বা হাফেজজী হুজুর এদের মধ্যে দেওবন্দপন্থী ধারার অনুসারী। এর ফলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের সরলপ্রাণ মুসলমানেরা, যারা ইসলামের সংস্কারের চাইতে মূল ধারাকেই অনুসরণ করতে বেশিমাত্রায় আগ্রহী, হাফেজজী হুজুরের প্রতি হবেন কার্যগতভাবেই দুর্বল। এতে করে আলীগড়পন্থী আধুনিক মুসলমানদের আস্থা অর্জন না করায় হাফেজজী হুজুরের সাময়িক ক্ষতি হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলাম পছন্দ লােকের ভােট তিনি পাবেন, তা অনুমান করে নেয়া যায়।
ইতিমধ্যেই হাফেজজী হুজুরের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে ১৮-দফা নির্বাচনী কর্মসূচীও প্রকাশ করা হয়েছে। কর্মসূচীতে বলা হয়েছে, আমি কোন দল বা সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নির্বাচনে প্রার্থী হইনি। আমি আল্লাহ এবং রসুলের (দঃ) পক্ষ থেকে এদেশের শােষিত নির্যাতিত আপামর জনসাধারণের মধ্য থেকে তাদেরই একজন হয়ে তাদের আশা আকাংক্ষার বাস্তবায়ন ও মৌল মানবিক অধিকার সংরক্ষণের দাবী নিয়ে অগ্রসর হয়েছি। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জনগণের ঈমাণ ও বাঁচার অধিকার নিয়ে যে অপশক্তি এতদিন রাষ্ট্র পরিচালনার নামে, একটি নির্মম পরিহাসের সৃষ্টি করে রেখেছে, সেই অপশক্তির বিরুদ্ধেই আমার এই আপােষহীন জ্বেহাদ।
তাঁর ১৮-দফা কর্মসূচীতে রয়েছে রাষ্ট্র এবং সমাজ জীবনের সর্বত্র কোরআন ও সুন্নাহর প্রবর্তন ও প্রতিষ্ঠা খােলাফার রাশেদার আলোকে সার্বজনীন প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে মজলিসে সুরা বা জাতীয় সংসদ গঠন, সুদভিত্তিক শােষণমূলক অর্থব্যবস্থার উচ্ছেদসাধন করে সকল পেশাজীবী মেহনতী মানুষের অংশীদারীত্বের মাধ্যমে শােষণহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, সংস্কারের মাধ্যমে প্রশাসনিক ব্যবস্থার সুষ্ঠু বিন্যাস ও ব্যয়সংকোচ, কোরআন ও সুন্নাহর আলােকে সকলের জন্য ইনসাফ নিশ্চয়তার জন্য বিচার ব্যবস্থাকে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা, জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ রেখে মুসলিম জাহানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নততর করার পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন, জাকাত ও উশরভিত্তিক বাইতুলমা.(অস্পষ্ট) প্রতিষ্ঠা ; কোরান ও সুন্নাহর আলােকে কর ব্যবস্থার পুনবিন্যাস, মাতৃজাতির পরিপূর্ণ মর্যাদা এবং শরীয়ত কর্তৃক প্রদত্ত তাদের সর্বপ্রকার অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান ইত্যাদি।
ন্যাপ (মােঃ)
বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি ন্যাপ (মাে)কে সমর্থন জানানোর পর এই দুই সংগঠনের সময়ে গঠন করা হয়েছে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শিবির নামের নির্বাচনী ঐক্যজোট। এই জোটের প্রার্থী হিসাবে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ তার নির্বাচনী ইশতেহারে যেসমস্ত কর্মসূচী ঘােষণা করেছেন সেগুলাে হলাে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সাফল্য পুনরুদ্ধার করা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, হত্যার রাজনীতি বন্ধ করা সমস্ত কালাকানুন বাতিল; রাজবন্দীদের মুক্তি ; রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার; কৃষিফসলের দাম নিশ্চিত করা, জমির সর্বোচ্চ সীমা পরিবার পিছু দো-ফসলী ৩০ বিঘা ও একফসলী ৫০ বিঘায় ধার্য করা, শ্রমিক কর্মচারীদের ছাটাই; হয়রানী ও নির্যাতন বন্ধ করা ; সকল স্তরের বৃত্তিজীবী মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা, শহরে জমির সর্বোচ্চ সীমা ৫ কাঠায় ধর্য; মুদ্রাস্ফীতি কমানাে, ঘুষখােরদুর্নীতিবাজদের উৎখাতের লক্ষ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডের ব্যবস্থা করা, পাচার বন্ধের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া : শিক্ষাকে গণমুখী করে তেলা; বর্তমানের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মসূচীকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারণ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পখাতকে দুর্নীতিমুক্ত করে লাভজনক খাতে পরিণত করে তােলা, সর্বপ্রকার বিলাসদ্রব্যের আমদানী বন্ধ করা; শহরের ছিন্নমূল বস্তীবাসীদের পুনর্বাসন : উপজাতী গোষ্ঠিদের নিজ নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতি অনুযায়ী জীবনযাপনের সুযােগ দেয়া, প্রতিরক্ষাবাহিনী সুদৃঢ়করণ, পঙ্গমুক্তিযােদ্ধাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা; জোট-নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন, ইত্যাদি।
বৃহত্তম প্রার্থীতালিকা নিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। ইতিমধ্যে কয়েকজন অরাজনৈতিক প্রার্থী তাদের নাম প্রত্যাহার করলেও, ব্যালট পেপারে এদের প্রত্যেকের নাম থাকবে। ভােটারদের প্রথম প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হবে ব্যালট পেপারের আয়তন নিয়ে।
বিভিন্ম প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আশা করা যায় নির্বাচন যথারীতি অনুষ্ঠিত হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন তাঁদের সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত হয়ত জনগণের উৎসাহ থাকবে না। এবং নির্বাচনের বহুমুখী স্রোত ভােটকেন্দ্রে উপস্থিতির সংখ্যাও প্রভাবান্বিত করবে।
যে নির্বাচনী প্রচার অভিযান চলেছে তাতে একক প্রার্থীর দক্ষতা ও গুণাগুণ যাচাই করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু বাস্তবে ভােটারদের কাছে এর আবেদন খুবই সীমিত। বঙ্গভবনে সাফল্য নির্ভর করবে ভুলের স্বীকৃতির ওপর, তা সংশােধন ও জনমনে আস্থা সৃষ্টির ওপর। প্রার্থীদের যােগ্যতা আমাদের সম্পূর্ণ অজানা নয়। তাই উদ্দেশ্যের একটা পরিচ্ছন্ন বহিঃপ্রকাশ প্রয়োজন। আজকের দিনে জনসভায় লক্ষ লােকের উপস্থিতি জয় পরাজয় নির্ধারণ করে না, আততৃপ্তি দেয় মাত্র। কেননা রাষ্ট্র পরিচালনা অভিনয় নয়; আরাে অনেক কিছু।
এই নির্বাচন আমাদের একজন প্রেসিডেন্ট এবং দেশকে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যবার জন্য নবতর প্রেক্ষিত দান করতে পারবে কি?

কেন সাত্তারকে ভােট দেবেন
* তাঁকে নতুনভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা নিতে হবে না।
* তিনি মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়ার ১৯ দফা বাস্তবায়িত
করবেন।
* তিনি দক্ষ প্রশাসক, কর্মক্ষম এবং নিয়মানুবর্তী লােক।
* তিনি বাকশালীদের মােকাবিলা করবেন।
* তিনি ওসমানী অথবা কামাল হােসেন নন।

কেন ওসমানীকে ভোট দেবেন
* তিনি সৎ, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এবং সংহত ব্যক্তিত্ব।
* তিনি পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র চালু করবেন।
* তিনি জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ সাধন করবেন।
*তিনি ধোঁকাবাজির রাজনীতি করবেন না।
*তিনি সাত্তার অথবা কামাল হোসেন নন।

কেন কামালহােসেনকে ভােট দেবেন।
* তিনি উচচশিক্ষিত এবং প্রবীণ প্রার্থীদের পাশে বয়সে
নবীণ।
* তিনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা ‘বাকশাল’ কায়েম করবেন।
* তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়িত করবেন।
* তিনি “অথর্ব” সরকারের হাত থেকে জনগণকে মুক্তি দেবেন।
* তিনি সাত্তার অথবা ওসমানী নন।

কেন হাফেজ্জী হুজুরকে ভােট দেবেন
* তিনি ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি এবং ইসলামী শাসন কায়েম করবেন ।
*তিনি সিনেমা বন্ধ করে দেবেন এবং মেয়েদের জন্য বােরখা চালু করবেন।।
* তিনি জাকাত ও উশরভিত্তিক বাইতুল-মাল গড়ে তুলবেন।
* তিনি কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী নন।
* তিনি সাত্তার, ওসমানী বা কামাল হােসেন নন।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!