You dont have javascript enabled! Please enable it! 1980.12.26 | রাজনৈতিক দলগুলাের প্রতি বিচিত্রার ১টি প্রশ্ন ১৯৮০ সালে আপনাদের সাফল্য ও ব্যর্থতা কতটুকু? | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৬ ডিসেম্বর ১৯৮০ - সংগ্রামের নোটবুক

রাজনৈতিক দলগুলাের প্রতি বিচিত্রার ১টি প্রশ্ন – ১৯৮০ সালে আপনাদের সাফল্য ও ব্যর্থতা কতটুকু?

সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৬ ডিসেম্বর ১৯৮০

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আত্মমূল্যায়ণের কোন প্রচলন বা ঐতিহ্য নেই। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের যে সর্বগ্রাসী বন্ধনে আমরা আবদ্ধ, তা আমাদের রাজনীতিকেও বেধে রেখেছে। তাই অন্যত্র কতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ যেমনি সীমিত– তা পরিবারে আর সমাজেই হোক না কেন–রাজনীতি ক্ষেত্রেও তা সমানভাবে প্রযােজ্য।
রাজনৈতিক দলগুলাে জন্মলগ্ন থেকেই একটা কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেয় ব্যাপক নীরব জনগােষ্ঠীর ওপর। এই জনগােষ্ঠী তাদের কতৃত্ব মেনে নেয়ার জন্যই সেখানে প্রশ্ন তেলার বা প্রশ্ন করার সুযােগ নেই। রাজনৈতিক দল গঠনের সঙ্গে সঙ্গে তার নামের সঙ্গে জড়িত হয় আভিজাত্য। সেই আভিজাত্যে কাদা ছিটানাের অধিকার নেই কারাে। এ অধিকার সংবাদপত্রগুলােরও নেই।
ক্ষমতার ভেতরে এবং বাইরে সর্বত্র একই অবস্থা। সমাজের মূল কাঠামাে-গ্রামে যেমনি আমরা গােষ্ঠীবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাইনি, তেমনি মুক্তি পাইনি রাজনৈতিক অঙ্গনে। রাজনৈতিক দলগুলাে তাই গােষ্ঠী স্বাথেই সীমাবদ্ধ। এখানে কেউ নৈর্ব্যক্তিক নয়।
রাজনীতিকে গণমানুষের কাছে, অর্থাৎ যারা সময়ের ব্যবধানে কখনাে কখনাে ভােটদানের অধিকারী, তাদের কাছে নিয়ে যাবার কথা প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ঘােষণাপত্রেই সগৌরবে উচ্চারিত। জনগণই ক্ষমতার উৎস—এ ধরনের বাণী শুনতে হয় সেই নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠকেই। কিন্তু জবাবদিহি কেউ করে না।
রাজনৈতিক দলগুলােকে নিয়ে এখানে আলােচনারও কোন ব্যবস্থা নেই। ব্যবস্থা থাকলেও সহনশীলতার অভাবে তা হয়ত সম্ভব হতাে না। কেননা হননের ভয়ে, কেউ মত কণ্ঠে কোন সমালোচনা করতে চাননা।
বায়তুল মােকাররম চত্বরে বা লালদীঘি ময়দানে যে মানুষ নীরব শ্রোতা, বিভিন্ন সময়ে তার বহু প্রশ্ন থাকলেও প্রশ্ন রাখার সে মাধ্যম কোথায়? মত ও পথের দিক দিয়ে আমরা যাদের অনুসরণ করি, কর্মে তা মেনে চলি না।
আত্মমল্যায়ন, আত্ম সমালােচনা, অগৌরবের নয়। রাজনীতিতে জয় যেমনি আছে, তেমনি আছে পরাজয়। ভবিষ্যত যেমনি জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে, তেমনি অতীত তৈরি করে ভবিষ্যতের ভিত্তি। আমরা ভবিষ্যতকে নিয়ে যতটা আন্দোলিত হই, অতীতকে নিয়ে ততটা হই না। বরং অতীতকে মুছে ফেলার এক বিরামহীন প্রচেষ্টায় আমরা লিপ্ত। বাংলাদেশের রাজনীতি এই সীমাবদ্ধ থেকে মুক্ত নয়।
রাজনীতিকে রাজনীতিতে রুপান্তরিত করতে হলে উল্লেখিত সীমাবদ্ধতা থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করতে হবে। রাজনীতিবিদদের আত্মমূল্যায়নের মাপকাঠিতে দাঁড়াতে হবে জনগণের সামনে। তবে এ যেন আয়নায় দেখা প্রতিবিম্ব না হয়—যা দেখা যায়, অথচ থাকে যায় ধরা-ছোয়ার বাইরে।
সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আমরা দেশের রাজনৈতিক দলগুলাের কাছে একটিমাত্র প্রশ্ন রেখেছিঃ ১৯৮০ সালে আপনাদের দলের সাফল্য ও ব্যর্থতা কতটুকু? রাজনীতিবিদেরা যে আত্মমূল্যায়ন করেছেন তার মূল্যায়ন করবেন দেশবাসী। ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারী থেকে তারাই এই রাজনৈতিক মূল্যায়নের প্রত্যক্ষ অংশীদার। গণমাধ্যম হিসেবে আমরা মনে করি জনগণের একটা দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা এতে আংশিক পূর্ণ হবে।
সময়ের স্বল্পতা এবং রাজনৈতিক দলগুলাের একটির কর্মসূচীর কারণে এ কাহিনী সম্পূর্ণ হয়নি। এই নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত অসম্পূর্ণতার জন্য আমরা দুঃখিত।
এখানে উল্লেখ্য, জাতীয় জনতাপার্টি প্রধান জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম, এ, জি, ওসমানী এ প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করেছেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মােজাফফর) প্রধান অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ অঙ্গীকার সত্ত্বেও জবাব দিতে পারেননি। তিনি বলেছেন, “আমি রাজনীতি করতে আসিনি। রাজনীতিবিদদের শিক্ষা দিতে এসেছি।”
প্রতিটি সাক্ষাৎকারের সঙ্গে আলাদাভাবে প্রশ্নটি জুড়ে দেয়া হয়নি। প্রতিটি জবাবকে শিরােনামে উল্লেখিত একটি মাত্র প্রশ্নের জবাব হিসেবে গণ্য করতে হবে।
এছাড়া ভুল বােঝাবুঝি এড়ানাের জন্য বর্ণনাক্রমিকভাবে দলগুলাে সাজানাে হয়েছে। কেননা জনপ্রিয়তা বা শক্তি যাচাই আমাদের লক্ষ্য নয়।
মাহফুজউল্লাহ / কাজী জাওয়াদ / জগলুল আলম / হাসান হাফিজ।

আমরা জনগণের আশা আকাঙক্ষা পূরণ করতে পারিনি
আমি প্রথমে আমাদের ব্যর্থতার কথাই বলবাে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অন্যান্য সব বিরােধী দলের মত নয়। কারণ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং স্বাধীনতার পর প্রথম সরকার গঠন করে। রাজনৈতিক দলের দুটো ভূমিকা থাকে। বিরােধীদলে তার ভূমিকা একরকম এবং ক্ষমতাসীন দল হিসেবে ভূমিকা অন্যরকম। স্বাধীনতার পর ক্ষমতা গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সংবিধান রচনার কাজে হাত দেয়। জাতীয় চার মূলনীতির-গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ এবং জাতীয় তাবাদের ভিত্তিতে আমরা সংবিধান রচনা করি। বিশ্বের সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে এ সংবিধান ছিল সবকটি কমনওয়েলথ দেশের সংবিধানের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সংবিধান। এখন সে মূলনীতি পরিবর্তীত হয়েছে। গণতন্ত্র হয়েছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, সমাজতন্ত্র হয়েছে সামাজিক ন্যায় বিচার, ধর্মনিরপেক্ষতা হয়েছে বিসমিল্লাহের রহমানের রহিম এবং জাতীয়তাবাদ হয়েছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ।
৭৫ সালে আওয়ামী লীগের হাত থেকে ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর এখন দ্রব্যমূল্য শত শত গুণ বেড়েছে। বিভিন্ন সরকারী পরিসংখ্যানেই তা পাওয়া যাচ্ছে। কোন কোন দ্রব্যমূল্য ৬০০ থেকে ৮০০ গুণ বেড়েছে। পাটের উৎপাদন ৪০ লাখ বেল কম হয়েছে, পাটের মূল্য সর্বকালের নিম্নতম। চায়ের উৎপাদন কমেছে কম করে হলেও ১ কোটি পাউন্ড। কাগজের দাম এবং অন্যান্য পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। শতকরা ৬০ ভাগ কৃষক ভূমিহীন হয়েছে। শতকরা ১৩ ভাগ অর্থাং ১ কোটি ১৩ লাখ সর্বহারা যাদের একখন্ড জমি বা একটু মাথা গােজার স্থান নেই একথা সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী ডঃ ফসিহউদ্দিন মাহতাবও স্বীকার করেন। তার উপরে দেশের ১৫/১৬ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণের বােঝা রয়েছে।
রাজনৈতিক কর্মীদের হয়রানী বেড়েছে। বিভিন্ন জেলে বন্দীদের দুর্ভোগ বেড়েছে। বিভিন্ন জেলে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, গুলি চলেছে, নির্যাতন চলেছে। বিরােধীদলের বিভিন্ন কর্মসূচী বানচাল করে দেয়ার জন্য সশস্ত্র হামলা চলেছে। আমরা এসব প্রতিহত করতে পারিনি। জনগণ আশা করেছে আওয়ামী লীগ হয়তাে কিছু করবে। কিন্তু আমরা জনগণের সে আশা আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ পূরণ করতে পারিনি। এ হলাে আমাদের ব্যর্থতার দিক।
আমাদের সফলতার দুটো দিক আছে। রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক। রাজনৈতিকভাবে আমরা বাকশাল কর্মসূচীকে জনপ্রিয় করতে পেরেছি। বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল কর্মসূচী গ্রহণ করেন তখন তা আমরা জনগণের মধ্যে সফলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারিনি। সত্যি বলতে কি আমাদের অনেক কর্মীদের মধ্যেও বাকশাল সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। আমরা চেয়েছিলাম গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় উন্নয়ন করায়ত্ত করতে। কিন্তু তখন সময়াভাবে তা জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করা যায়নি। যার সুযােগ গ্রহণ করে এমনকি বিরােধীদলগুলােও আমাদের দেশদ্রোহী বলতে থাকে। এখন বিভ্রান্তির অবসান ঘটেছে।
এছাড়া জাতীয় ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করি। জেলে বন্দীদের ওপর নির্যাতন ও হত্যার প্রতিবাদে আমরা প্রতিবাদ দিবস পালন করি। জেল হত্যার প্রতিবাদে আমরা দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেই। আমাদের সেই কর্মসূচীর পক্ষে সবগুলাে বিরােধী দলও হরতালের ডাক দেয়। ৩ নবেম্বর জেলে চার জাতীয় নেতার হত্যার বিচার দাবী করে এবং সেই কালাে দিনটির প্রতিবাদে আমরা হরতালের ডাক দেই। দেশব্যাপী স্বতস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয়। হরতাল বানচাল করার জন্য সরকারের লেলানাে বাহিনী সশস্ত্রভাবে নিরীহ জনসাধারণের উপর হামলা চালায়। সরকারের সে আক্রমণের মুখেও হরতাল পালিত হয়। এছাড়াও আওয়ামী লীগ এবছর যতগুলাে কর্মসূচী ঘোষণা করেছে জনগণের স্বতঃফুর্ত সহযােগীতায় তা সফল হয়েছে।
দেশব্যাপী জনসভা এবং বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে জনগণের কাছে একথাই প্রমাণিত হয়েছে যে আওয়ামী লীগ বাকশালের কর্মসূচী গ্রহণ করে দেশদ্রোহী হয়ে যায়নি এবং আওয়ামী লীগ অস্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। বাকশাল কর্মসূচী হচ্ছে রাজনৈতিক ও আর সামাজিক একটি কর্মসূচী। জনগণ আমদের এ কর্মসূচীকে গ্রহণ করেছে।
সরকার স্বাধীনতা দিবসকে পরিবর্তন করে জাতীয় দিবস করতে চাইলে আমরা তার প্রতিবাদ করি। ফলে সরকার ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস হিসেবে রাখতে বাধ্য হয়েছে।
আমরা থাই-বাংলাদেশ মৎস্য চুক্তির বিরােধীতা করি। এবার সে চুক্তি আর স্বাক্ষরিত হয়নি।
আমরাই প্রথম সরকারের মার্কিন শান্তি বাহিনী চুক্তি স্বাক্ষরের বিরােধিতা করি। সরকার এটা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন।
ক্ষমতাসীন থাকাকালে যে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিলাম আমরা এখনও সেই পররাষ্ট্রনীতির কথা বলছি। আমরা সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই—কারও সঙ্গে আমাদের শত্রুতা নেই। আমরা যখন একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার তথা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনে পদক্ষেপ নিচ্ছিলাম তখন স্বভাবতই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো আমাদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে। তার মানে এই নয় আমরা সমাজতান্ত্রিক দেশ ছাড়া অন্যান্য দেশকে শত্রু শিবিরে ঠেলে দিচ্ছি।
জোট নিরপেক্ষতা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম অঙ্গ। এর ফলে আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমাদের সম্মান বেড়েছে। যার ফলে বাংলাদেশ জাতিসংঘে সদস্যপদ লাভ করেছে এবং বাংলাদেশ এখন নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ ইরাক-ইরান যুদ্ধের আমরা অবসান চাই। আমরা ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির নিন্দা করেছি। আমরা ইসরাইল কর্তৃক জেরুজালেম দখলের নিন্দা করেছি। আমরা চাই বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধত্ব সুদৃঢ় হােক এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দলোন আরও সাফল্য অর্জন করুক। আমরা মনে করি বর্তমান সরকার মুখে জোট নিরপেক্ষতার কথা বললেও আসলে জোট নিরপেক্ষতার নীতি মেনে চলছে না।
আমাদের সংগঠন বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর, চার জাতীয় নেতার মৃত্যুর পর, সামরিক শাসনের পর, কয়েক হাজার কর্মী এবং বর্তমান নেতৃবন্দের উপর কারাগার ও নির্যাতন নেমে আসে। আমাদের অফিস ছিলনা, একটা কাগজ পর্যন্ত ছিলনা। ১৯৭৫ সালের আগে আমরা যেহেতু ক্ষমতায় ছিলাম সেহেতু আমাদের কার্যক্রম কমে যায়। ৭৫ সালের পর দুই বছর আমরা কোন কাজ করতে পারিনি। পিপিআর হওয়ার পর আমরা খুব সীমিতভাবে কাজ করতে থাকি। তখন আবার, অপ্রিয় হলেও সত্য আমাদের দল চারটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। পাঁচজন নিয়ে হলেও খােন্দকার মোশতাক আহমেদ চলে যান। দশজন নিয়ে হলেও মিজানুর রহমান চৌধুরী চলে যান। তার কয়েকজন স্বার্থান্বেষী লােক বিএনপিতে যােগদান করে। তারপরও আমরা যারা ছিলাম তারা বাংলাদেশে ৪৫০টি থানায় ৫ হাজার ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক রূপ দিতে সক্ষম হই। বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের যে কোন জায়গায় খুজলে অন্ততঃ একজন লােক পাওয়া যাবে যে আওয়ামী লীগের কথা বলে। এই হচ্ছে আমাদের সাংগঠনিক সফলতা।
সর্বশেষে একটি কথা আমি উল্লেখ করতে চাই। তাহলাে সরকারের নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলাে একপেশেভাবে ক্ষমতাসীন দলের খবর ফলাও করে প্রচার করছে। যেমন ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে রমনা গ্রীনে জাতীয়তাবাদী দলের আলােচনা সভা হয়েছে। আরও অনেক দল সভা আলােচনা সভা করেছে সে সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। গণমাধ্যমগুলো এভাবে সত্যকে বিকৃত করতে থাকলে তার উপর জনগণের আস্থা একদম কমে যাবে। ফলে দেখা যাবে কোন উন্নয়ন কর্মসূচীও এর মাধ্যমে প্রচার করে জনগণের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা এ সম্পর্কে সচেতন হওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
আবদুল মালেক উকিল
সভাপতি
আওয়ামী লীগ (মালেক)

বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাের অবস্থা টবে গােলাপের চারার মতো
আমাদের দল ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। জাতীয় সংসদের অধিবেশনগুলােতে বিরােধী ও গঠনমূলক বক্তব্য রেখে এবং বিরোধী দলগুলাের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন বিলের ওপর সমালোচনা করে দলের পক্ষ থেকে সংসদীয় সিদ্ধান্তগুলােকে ত্রুটিমুক্ত করতে ব্যাপক কর্মতৎপরতা চালাতে সক্ষম হয়েছেন।
সংসদের বাইরে সাংগঠনিকক্ষেত্রে জনসাধারণের মধ্যে দলীয় প্রভাব বিস্তার করতে গিয়েও ব্যাপকভাবে সাফল্য অর্জন করেছে। ১৯৮০ সালে আমার দল বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে ব্যাপক সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়েছে ও সর্বত্রই তা জনগণের করে তাদের কাছ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ও অনূকুল সাড়া পেয়েছে। এমনকি যারা আমার দলের কর্মী নয় এদের মধ্যেও এ বছর আমার দলের কর্মতৎপরতা বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে, যা আমার দলের সম্প্রসারণকার্যে বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছে।
দলীয় সাংগঠনিক কাজকর্ম চালাতে গিয়ে এবছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আবহমন্ডলে অবক্ষয়ের যে করুন নমুনা দেখেছি তা নিদারুণভাবে আমাকে হতাশ করেছে। সরকারী পত্র পত্রিকাগুলাে আজকাল জনসাধারণের কথা না বলে কাজ করছে সরকারী বুলেটিন হিসেবে। যার ফলে জনসাধারণের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্য বােধ সৃষ্টি হচ্ছে না। অথচ গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের অস্তিত্ব না থাকলে গণতান্ত্রিক বিকাশের সমস্ত পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়তে বাধ্য।
গণতন্ত্র কেবলমাত্র পুঁথিপত্রের আইনেই সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বিবেচনা করতে হবে এ আইন প্রয়ােগ করা হচ্ছে কার হাত দিয়ে ? যাদের হাত দিয়ে আইন কার্যকর করা হচ্ছে তাদের মধ্যে যদি গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবােধ না থাকে তাহলে দেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক কোন পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। বর্তমানে বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাের অবস্থা টবে গােলাপের চারার মতাে বৃদ্ধি ও বিকাশের পথ যেখানে অত্যন্ত সীমিত পরিসরে অবরুদ্ধ হয়ে আছে।
শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও এবছরে আমরা দলের ছয় দফা কর্মসূচী প্রকাশ করেছি। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অত্যন্ত গুরত্বপর্ণ সবগুলাে বিষয় এই কর্মসূচীর অন্তভুক্ত করা হয়েছে এবং এই কর্মসূচীর ওপরে দলের প্রত্যেকটি সদস্য নিরংকুশ ও স্বতঃস্ফূর্ত সহযােগিতা ও সম্মানবােধ প্রদর্শন করেছেন। চলতি বছরে দলের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠানের প্রাথমিক কাজ কর্মগুলাে সম্পন্ন করার ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
পার্লামেন্টের চলতি অধিবেশনে কতকগুলাে বিল উত্থাপন করে সরকার পক্ষান্তরে তার দুর্বলতাই প্রকাশ করেছেন। উপদ্রুত এলাকা বিল সরকারের দুর্বলতার এক প্রত্যক্ষ পরিচয় বহন করে। এই বিলে যে সুপারিশ রয়েছে, তার জন্য আইননের কোন প্রয়ােজন হয়না—জরুরী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের যে কোন স্থানেই এই আইন প্রয়ােগ করা যায়। অথচ সরকার নিজেদের শক্তির ওপর আস্থা ও রাখতে পারছেন না বলেই এর চারদিকে নতুন বর্ম পুরানাের অপচেষ্টা চালাচ্ছেন।
‘জাতীয় নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর হুমকী এলে শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই তার মীমাংসা করা যায়। অথচ ক্ষমতাসীন দলের লােকেরা নিজেদের দুর্বল সাংগঠনিক এলাকাগুলােতে অরাজকতা কায়েমের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। এ উদ্দেশ্যে সরকার যে কালাকানুন প্রণয়ন করতে যাচ্ছেন তা উদ্দেশ্যমূলক এবং এ উদ্দেশ্য জনগণের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট।’ সরকারের আত্মরক্ষা ও সাবধানতার প্রাচীর যত উচু হবে, প্রতিপক্ষের আক্রমণ হবে ততই জোরালাে, এটা ক্ষমতাসীন দলের মনে রাখা দরকার। এবং বিশেষ সময়ে প্রতিরক্ষার প্রাচীর যত সুদৃঢ়ই হােক না কেন, সংগঠিত আক্রমণের মুখে তার পতন ঘটবেই।
প্রেসিডেন্টের ব্যাপক গণসংযােগ কর্মসূচী দেখে মনে হয়, শেষ পর্যন্ত তিনি মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য আহ্বান জানাবেন। কিন্তু দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় এককভাবে কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নামা সম্ভব নয়। তার জন্য দরকার হবে সরাসরি বাইরের সাহায্য এবং এর অর্থই হলো দলীয় ভিত্তিব্যবস্থার ওপর সর্বনাশ ডেকে আনা।
সরকার রাষ্ট্রীয় প্রচার যন্ত্রগুলােকে উদ্দেশ্যমূলক ও অবৈধভাবে ব্যবহার করে চলেছেন, যাতে মনে হয় দেশে কোন বিরােধী রাজনৈতিক সংগঠনের অস্তিত্বই নেই। প্রচারযন্ত্রগুলােতে বিরােধী রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কোন তথ্য পরিবেশন করা হয় না। সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যু বার্ষিকীতে সরকারের প্রচারযন্ত্র যেভাবে ক্ষমতাসীন দলের কথা প্রচার করেছে তাতে মনে হয়েছে প্রচারযন্ত্রগুলাে যেন সরকারের নিজস্ব সম্পত্তি।
অর্থনৈতিক প্রতিকুলতার কারণে এ বছর বহু ক্ষেত্রে আমরা আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারিনি। বর্তমান অবস্থায় যেখানে সাধারণ একজন মানুষ নিজের দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রেই প্রতিনিয়ত পর্যুদস্ত হচ্ছেন, সেখানে সাংগঠনিক পর্যায়ে উৎসাহের সঙ্গে কাজ করা তাদের পক্ষে হয়ে পড়ছে এককথায় অসম্ভব। তিনি বলেন, রাজনীতি আজকাল হয়ে পড়েছে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এই অর্থনীতিক প্রতিযােগিতায় আমরা ক্ষমতাসীন দল সহ কতিপয় বিরােধী দলের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। আমাদের দলের বর্ধিত সভাগুলােতে অনেক সময় মহকুমা পর্যায়ের অনেক কর্মী কেবলমাত্র পথ খরচার অভাবে সময়মতাে যােগ দিতে পারেননি। দলের লােকদের প্রয়ােজন মতাে টাকা পয়সা সরবরাহ করতে না পারাই আমার দলের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতা চিরন্তন—যতদিন সংগঠন থাকবে ততদিন পর্যন্ত এ বাস্তব সমস্যার সমাধান ঘটবেনা।
বিরােধী দলগুলাে টাকার অভাবে, তাদের সাংগঠনিক কাজকর্ম চালাতে পারছেন না অথচ সরকারের হেলিকপ্টার, গাড়ি, কেবলমাত্র ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেগুলাে আবার ব্যবহার করা হচ্ছে নানা রকম অনুৎপাদনশীল কাজে যার ফলে জনগণের অর্থের অপচয় ঘটছে। টাকা ছড়িয়ে জনসাধারণের মধ্যে মবিলিটি সৃষ্টি করা যায় না। মবিলিটি হলাে একটি স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার। প্রতিপক্ষকে সমান সুযােগ সুবিধা দিয়েই জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ততা যাচাই করা উচিত। বিরােধী দলগুলােকে আপাত দৃষ্টিতে কর্মক্ষমতাহীন বলে মনে হলেও আসলে তা নয়। কাজেই সাদা চোখে যা বিরােধী দলের ব্যর্থতা বলে মনে হয় তা ব্যর্থতা নয়।
মিজানুর রহমান চৌধুরী
সভাপতি
আওয়ামী লীগ (মিজান)

সংগঠনের রক্তক্ষরণ ১৯৮০ সালেও বন্ধ হয়নি
ইউনাইটেড পিপলস পার্টির বিগত ছয় বছরের কার্যকালের মধ্যে ১৯৮০ সালকে ‘উদ্যোগ’ ও ‘আন্দোলনের’ গুরত্বপূর্ণ বছর হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণের প্রশ্নেই বলুন, সাংগঠনিক প্রশ্নেই বলুন আর সংগ্রামের প্রশ্নেই বলন—এই বছরটিতে এসে ইউপিপি সর্বক্ষেত্রেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করার প্রয়াস পেয়েছে এবং জোর কদমে দৃঢ়তার সঙ্গে সামনে এগিয়ে গেছে। অবশ্য, এর সােপান রচিত হয়েছিল ‘৭৯ এর শেষ লগ্নে।
বাকশালী পুনরুত্থানকে প্রতিহত করে দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম কর ১৯৮৯-এর ২৯ ও ৩০শে ডিসেম্বর ইউপিপি-র তৃতীয় জাতীয় কাউন্সিলে যখন মূল রণধ্বনি হিসেবে এই লােগান উচ্চারণ করা হয়—তখন অনেকেই ভ্রু বাঁকিয়েছিলেন। কারণ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে অঙ্গীকারবদ্ধ অনেক দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তিই তখনও পর্যন্ত বাকশালী জুজুর ভয়কেই রাজনীতির প্রধান নিয়ামক উপাদান মনে করতেন। এবং সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরােধী সংগ্রামে জিয়া সরকারকে সহায়ক শক্তি মনে করতেন। জিয়া সরকারও এই সুযােগটি ষােল আনা গ্রহণ করতেন জুজুর ভয় দেখিয়ে। এই প্রেক্ষাপটে ইউপিপি-র ঐতিহাসিক কাউন্সিল সম্মেলনে ‘নব্য বাকশাল’ হিসাবে জিয়া সরকারের মূল্যায়ন করার মধ্য দিয়ে রাজনীতির গােটা আবেদনে পরিবর্তন সূচিত হয়ে যায়।
যাই হােক, সেই সম্মেলনের পর মাত্র এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে সরকার তার আসল চেহারায় আত্মপ্রকাশ করেছে। গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যার প্রশ্নে সরকারের দোদুল্যমানতা, মুহুরীর চরে উপযুর্পরি ভারতীয় হামলার মুখে দুর্বোধ্য নীরবতা, বিদ্রোহ কবলিত উত্তর-পূর্ব ভারতে ভারতীয় সৈন্য ও রসদ প্রেরণের সুবিধার্থে বাংলাদেশের নৌ ও আকাশ পথ গােপনে উম্মুক্ত করে দেয়া, লাঠিটিলা ও তামাবিলে অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে উচ্চবাচ্য না করা, দক্ষিণ তালপট্টী দ্বীপের ভারতীয় জবর দখলের বিরুদ্ধে টু শব্দটি উচচারণ না করা, ভারতীয় সামরিক স্বার্থে বাংলাদেশ-ভারত রেল যােগাযােগ আলােচনায় সম্মত হওয়া, আসামের তেল অবরােধের মুখে ভারতের এনার্জী সংকট মােচনের উদ্দেশ্যে পাইপযােগ্য জ্বালানী গ্যাস সরবাহের প্রস্তাব দেয়া—প্রভৃতি ঘটনা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে এই সরকার আধিপত্যবাদ সম্প্রসারণবাদ বিরােধী নয়। বরং তাদের সঙ্গে ঢলাঢলি করেই এই সরকার ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে থাকিতে চায়। আবার রাজশাহীর আখচাষী মিছিলে গলী বর্ষণ, রাজশাহী ও খুলনা কারাগারে নাৎসী কায়দায় বন্দী হত্যা, দলীয় পান্ডাদের মধ্যে অস্ত্র বিতরণের মাধ্যমে প্রাইভেট ঘাতক বাহিনী তৈরির চেষ্টা এবং সর্বোপরি ‘উপদ্রুত এলাকা বিল’ পেশ প্রভৃতি অজস্র ঘটনাবলী প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এই সরকার প্রকৃত পক্ষে বাকশাল অপেক্ষাও বেশী বাকশালী। বলা বাহুল্য, এই সব ঘটনা ইউপিপি-র মূল্যায়নকেই সঠিক প্রমাণিত করেছে। ফলে, ‘৭৯ এর ডিসেম্বরে আমাদের শ্লােগান শুনে যারা ভ্রু বাকিয়েছিলেন—আজ তাদের অনেকেই সরাসরি কিংবা কিছুটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই শ্লোগানকেই গ্রহণ করেছেন।
আজ তাই বলতে পারি ঐ শ্লােগানটি রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে ইউপিপি-র উদ্যোগী ভূমিকার পরিচয়ই বহন করে।
তবে, কেবল চিন্তা-চেতনায় নয়, সংগ্রামের ময়দানেও ইউপিপি প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার প্রয়াস পেয়েছে। রাজশাহীর ও খুলনার বন্দী হত্যার বিরুদ্ধে, থাই-বাংলাদেশ মৎস্য চুক্তির বিরুদ্ধে, নিউজ প্রিন্ট ও কাগজের মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে, পেট্রোল-ডিজেল-কেরােসিন-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে, সার-কীট নাশকের মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ইউপিপি কখনও এককভাবে কখনো মিলিতভাবে সংগ্রাম চালিয়েছে।
ভারতে গ্যাস রপ্তানীর প্রশ্নে ইউপিপি-র ভূমিকা ব্যাখ্যা করার বড় একটা প্রয়ােজন পড়ে না। সরাসরি পাইপযােগে ভারতে গ্যাস রপ্তানীর সরকারী উদ্যোগ আয়ােজনের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেশে বিদেশে তার প্রতিরােধ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হই। ১৬ই জুলাই এ প্রতিবাদ দিবস, ২৪শে জুলাই জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠান এবং ১৬ই আগস্ট সচিবালয়ের সম্মুখে অবস্থান ধর্মঘট পালন ও চরমপত্র প্রদানের মাধ্যমে আমরা ক্ষমতাসীন গােষ্ঠীকে এই জাতীয় স্বার্থবিরােধী উদ্যোগ পরিহার করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকি। বিদেশে ইউপিপি-র যুক্তরাজ্য শাখাও পশ্চিম জার্মানী শাখা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করে। লন্ডনের হাইড পার্কে ইউপিপি-র যুক্তরাজ্য শাখা জনসভা করে ও পরে বাংলাদেশ মিশনে স্মারক লিপি প্রদান করে।
উল্লেখ নিষ্প্রয়ােজন এ আন্দোলনেও আমাদের সম্পূর্ণ না হলেও আংশিক বিজয় অর্জিত হয়েছে। ইতিমধ্যে সরকার তাদের পূর্বেকার অবস্থান থেকে পিছু হটে এসেছেন।
সর্বশেষ, ‘উপদ্রুত এলাকা’ বিল-এর বিরুদ্ধে আমাদের সক্রিয়তা। দেশের অধিকাংশ বিরােধী দল যখন বিবৃতি-প্রতিবাদ দিতে দায়সারা গােছের প্রতিরােধ রচনা করে যাচ্ছিল—ইউপিপি সেখানে বঙ্গভবন ঘেরাও করে আন্দোলনের নতুন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ইউপিপি ঘােষণা করেছেঃ এই জংলী আইনের বিরুদ্ধে হরতাল, ঘেরাও ও আইন অমান্য আন্দোলনসহ যে কোন চরমপন্থা গ্রহণে ইউপিপি পিছুপা হবে না। আত্মপ্রশংসা বা আত্মপ্রচারের জন্য নয়, আমি বলতে পারি ইউপিপি-র এ ঘোষণার পরােক্ষ প্রতিক্রিয়া বিরােধী দলগুলাের মধ্যে ঘটতে বাধ্য।
আপনারা লক্ষ্য করেছেন—দিনে বিপ্লব করে রাতে যারা বঙ্গভবনের গােপন কক্ষে অভিসার করে বেড়াতেন—তাদের অনেকেই এখন রাজপথে নেমেছেন। কারণ, ইউপিপি-র ঘেরাও কর্মসূচীর পর অনেকেরই কিছুটা টনক নড়েছে। এই উপলব্ধি সবার মধ্যে সঞ্চারিত হতে সহায়ক হয়েছে যে সংগ্রামের ময়দানে না থাকলে নীলামে উঠতে পারে। অর্থাৎ বিরােধী দলের স্থবিরতা কাটিয়ে তােলার ক্ষেত্রেও আমরা ‘বরফ গলাবার’ দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছি।
আমরা মনে করি সরকার ফ্যাসীবাদী শক্তির জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাচ্ছে। সুতরাং শান্তিপূর্ণ পন্থায় এরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে বলে মনে হয় না। বরং এই সরকারের কাজে কর্মে প্রতীয়মান হচ্ছে—এরা দেশকে এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে চায়।
জাতিকে এই সংকট থেকে এককভাবে কোন দল মুক্ত করতে পারবে বলে আমরা মনে করি না। আমাদের শক্তি সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ সচেতন। সুতরাং আমরা বারবার দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে আসছি। এক্ষেত্রে আমাদের অনেক বন্ধুকে এখনও শুধু মাত্র বামপন্থী শক্তির ঐক্য ফ্রন্টের সংকীর্ণতায় ভুগতে দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ইউপিপি লাগাতার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এবং আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ইতিহাসের অনিবার্য দাবী পূরনের জন্য দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির বৃহত্তর ঐক্য গড়ে উঠবেই উঠবে।
উপসংহারে আমি বলতে চাই, ১৯৮০ সালের এই বছরে আমাদের মােটামটি সাফল্য অর্জিত হলেও ব্যর্থতাও কম নয়। ব্যর্থতাকেও আমরা খাটো করে দেখতে চাই না। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছেঃ আমরা আমাদের মূল রণধ্বনিকে কার্যকরী করার জন্য নব্য বাকশাল ও পুরাতন বাকশাল বিরােধী একটি বৃত্তের জাতীয় গণতান্ত্রিক মাের্চা এখনও দাঁড় করাতে পারিনি। পারিনি গণতান্ত্রিক ফ্রন্টকে ইতিহাসের চ্যালেঞ্জ পূরণ করার উপযােগী একটি সংগ্রামী মাের্চা হিসেবে রূপ দিতে। আমাদের এই ব্যর্থতার ফলশ্রুতি স্বরূপ বর্তমান স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভকে সংগঠিত রূপ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কারণ জনগণ জিয়ার বিপরীতে বাকশাল নয় একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান কামনা করে। এটা সম্ভব হচ্ছে না বলেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক উপাদান সঞ্চারিত হচ্ছে না। জনগণ এক হতাশা ও নৈরাশ্যের গভীর সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে এবং জাতীয় রাজনীতি লক্ষ্যহীনতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমাদের আর একটি দুর্বলতা হচ্ছে সংগঠনের রক্তক্ষরণ ১৯৮০ সালেও বন্ধ হয়নি। যদিও এর পেছনে সরকারের চক্রান্ত ক্রিয়াশীল রয়েছে তবুও আমাদের অক্ষমতা ও ব্যর্থতা অস্বীকার করা যাবে। আমরা যদি আমাদের কর্মী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের আরও রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে গড়ে তুলতে ও সঠিক ভাবে নির্বাচিত করতে পারতাম তাহলে তারা এত সহজে লােভ-লালসা ও প্রাসাদ চক্রান্তের শিকারে পরিণত হতে পারতো না । কিন্তু বলিষ্ঠ আত্মপ্রতায়ের সঙ্গে আমরা এই কথাটকু বলতে চাই, সংগঠনের এই রক্তক্ষরণ হয়েছে দূষিত রক্ত ক্ষরণ এবং তাতে আমাদের পার্টি উত্তরােত্তর শক্তিশক্তিশালী হচেছ, আগামী দিনের ইতিহাসই তা প্রমাণ করবে।
কাজী জাফর আহমদ
সভাপতি
ইউনাইটেড পিপলস পার্টি
৮০ সালের কাজকে সুচনা বলে মনে করি ।
দেশের অবস্থা থেকে আমাদের পার্টির অবস্হা বিচিছন্ন নয়। আবার দেশের অবস্থাও দুনিয়ার অবস্থা থেকে আলাদাভাবে বিচার করা যায় না। ১৯৮০ সালে তামাদের মাটির সাফল্য বা ব্যর্থতার প্রশ্নটি ঐ আলােকেই দেখতে হবে। সারা দুনিয়ার পরিস্হিতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে বলতে হয়, এ বছরটি ছিল অশান্ত। বিশ্বের শান্তিকামী ও সমাজতান্ত্রিক শক্তিগুলোর একটানা প্রচেষ্টার ফলে গত এক দশকে অত্স্এ সীমিত করণ, দাঁতাত ও বিশ্ব শান্তির পথে যে সাফল্য অর্জিত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি তা বানচাল করার জন্য বছরের গােড়া থেকেই প্রচেষ্টা তীব্রতর করে ভুলতে শুরু করে। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার ক্রমাগত সাফল্য, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের তীব্রতা ও ব্যাপকতা বৃদ্ধি নতুন নতুন সাফল্য অর্জন ও একচেটিয়া করা পুজিবাদের বিরুদ্ধে উন্নততর জীবনযাত্রার জন্য পুজিবাদী দেশগুলির শ্রমজীবী জনগণের ক্রমবর্ধমান আন্দোলন—বিশ্ব বিপ্লবী প্রতিক্রিয়ার এই তিন ধারার ক্রমবর্ধমান মৈত্রীর ফলে তাতেকিন্তু সাম্রাজ্যবাদ নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের মােকাবিলা করার উদ্দেশ্যে নতুন করে বিশ্বকে অস্ত্র প্রতিযোগিতাও স্নায়ুযুদ্ধের যুগে ঠেলে দেবার জন্য চেষ্টা শুরু করে। তারা দাঁতাদের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করে সারা বিশ্বে নতুন নতুন উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু, সৃষ্টির প্রয়াস পায়। উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের এই নব উদ্যমে সহায়তা করে চীনের মাওবাদী সরকার। জাপানকে এই প্রক্রিয়ায় টেনে এনে তারা দূর প্রাচ্যে ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় নতুন উত্তেজনার ক্ষেত্র সৃষ্টির প্রয়াস, পায়। ইরানে তথাকথিত জিম্মী উদ্ধারের নামে তারা হস্তক্ষেপের চেষ্টা চালায়। আফগানিস্তানের বিপ্লবী অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তানকে ভিত্তি করে তারা সে দেশের অভ্যন্তরে নাশকতামূলক তৎপরতা চালায়। ভিয়েতনাম ও কাম্পুচিয়ার বিরুদ্ধে হামলা চালানাের জন্য নতুন করে পাঁয়তারা চালায় চীন। ফিলিস্তিনী ভাইদের মুক্তি আন্দোলনের বিরুদ্ধে ইসরাইলকে নতুন করে অস্ত্র সজ্জিত করে। ইরান-ইরাক যুদ্ধকে অবলম্বন করে সাম্রাজ্যবাদ আরব ঐক্য নষ্ট করা ও মধ্যপ্রাচ্যে পুনরায় আধিপত বিস্তারে তৎপর হয় ।
এই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য হিসেবে আমাদের সরকার আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থের সাম্রাজ্যবাদ ও তার সহযােগী মাওবাদী চীনা সরকারের পূর্বোক্ত হীন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বিশ্ব শান্তি, দাঁতাত ও উত্তেজনা প্রশ্নমনের সপক্ষে ভূমিকা গ্রহণ না করে বরং বাস্তবে অনেক গুরত্বপূর্ণ প্রশ্নে তার বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করে চলেছেন। জাতীয় ক্ষেত্রে সরকারের নীতি ক্রমাগতই জাতীয় স্বার্থ ও জনগণের স্বাথের বিরদ্ধে পরিচালিত হচেছ। মূখে স্বনির্ভরতার কথা বললেও আমাদের দেশ ক্রমাগতই সাম্রাজ্যবাদী সাহায্যের উপর আরও বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এই সাহায্য নির্ভরশীলতা কমা নাের পরিবর্তে তা বাড়িয়ে তুলছে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বললেও সার ও কীটনাশকের দাম, পাওয়ার পাম্প-এর ভাড়া বৃদ্ধির ফলে এ ক্ষেত্রে সমস্যাই সৃষ্টি হয়েছে। সবক্ষেত্রেই সরকারী নীতি ধনিক শ্রেণীর অনুকূলে। সরকারী নীতির ফলে লাভবান হচেছন বিত্তবান ব্যবসায়ী ও ধনিকেরা। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের কোন প্রচেষ্টা নেই। নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বৃন্ধি পাচেছ। সরকার ব্যক্তিখাতে ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দিয়েছেন। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকালে যত নতুন কাপড়ের কল স্থাপিত হবে সেগুলি স্হাপিত হবে। ব্যক্তিগত খাতে শতকরা ৪৯ ভাগ শেয়ার ব্যক্তি খাতে হস্তান্তর করে কসকরকে রপান্তরিত করা হয়েছে লিমিটেড কোম্পানীতে। বিদেশী পুজিকে অবাধ আমন্ত্রণ জানানাে হচেছ নানা সুযােগ সুবিধা দিয়ে এককথায় দেশে সাম্রাজ্যবাদের আওতাধীন ধন্যবাদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই সরকারী নীতি পরিচালিত হচেছ। গােটা সমাজ, ব্যাপক জনগণ ও মুষ্টিমেয় ধনিক এই দুইভাগে ভাগ হয়েছে। স্বাধীনতা বিরােধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন এবং স্বাধীনতার সুফলগুলির উপর, ক্রমাগত আঘাত হানার নীতি সরকার গােড়া থেকেই অনুসরণ করে আসছেন। স্বাধীনতা দিবসকে নতুন করে জাতীয় দিবস হিসাবে ঘোষণা করে স্বাধীনতার প্রশ্নে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চলেছে। সরকারের গণবিরােধী প্রতিক্রিয়াশীল নীতি সমূহের বিরদ্ধে জনমনে বিক্ষোভ দানা বাঁধছে সরকার ততই স্বৈরাচারী নীতির নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
জনগণের মাথার উপর উপদ্রত এলাকা বিলের খড়গ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আমাদের পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড মােহাম্মদ ফরহাদকে এখনাে আটক করে রাখা হয়েছে। রাজবন্দীদের এখনাে মুক্তিদেয়া হয়নি। দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক দলগুলির বিরদ্ধে স্বয়ং রাষ্ট্রপতির অনর্গল দায়িত্বহীন উক্তি সমূহ উত্তেজনাকর পরিস্থি চিন্থিত সৃষ্টি করছে। বর্তমান সরকার দেশকে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দিক থেকে বিদেশের উপর শঙ্কাজনকভাবে যতই নির্ভরশীল করে তুলছেন ততই সরকারের ও সরকার দলীয় নেতৃবর্গ বিদেশী বাদের বিরােধিতার নাম করে মুখে ফেনা তুলছেন। শত্রু, সম্পত্তি আইন চালু রেখে সাম্প্রদায়িক ও কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তিগুলিকেই খুশি করা হচেছ। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, দেশী সামন্তবাদ ও প্রতিক্রিবার বিরুদ্ধে আফগান জনগণের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি পরিপূর্ণ সমর্থন জানানোর জন্য বছরের শুরু থেকেই সরকারী মহল থেকে শুরু করে সকল প্রতিক্রিয়াশীল মহগুলি একযােগে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। একাধিকবার আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসে হামলা চালানাে ও আগুন লাগানাে হয়। এই তাবস্থায় আমরা আমাদের পার্টির তৃতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করতে সক্ষম হই। দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শিবিরের সকল নেতৃবৃন্দ আমাদের কংগ্রেসে উপস্থিত থেকে কংগ্রেসকে স্বাগত জানান। আমাদের পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসকে আমরা আমাদের এক বড় সাফল্য মনে করি। কংগ্রেসের পর পরই মার্চ মাসে আমাদের পার্টির উপর ব্যাপক হামলা চালানাে হয়। সাধারণ সম্পাদক মােহাম্মদ ফরহাদসহ অন্যন্য নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়। মােহাম্মদ ফরহাদের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ-এর অভিযােগে মামলা রুজু করা হয়। আমাদের পার্টি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সরকারী কর্মচারীদের হরতালের সমর্থনের সঙ্গে জড়িত এই অজুহাতে প্রায় ৫০ জন পার্টি নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল আমাদের পার্টির উপর সুপরিকল্পিত হামলা। নামে বেআইনী না করে কার্যত পার্টিকে অচল করে দেয়াই সরকারের উদ্দেশ্য ছিল। দেশপ্রেমিক গণতন্ত্রিক মহল সমূহ হতে এরুপ হামলার প্রতিবাদ জানানাে হয়। কমিউনিস্ট পার্টির উপর হামলাকে সকলেই গণতান্ত্রিক শক্তির উপর আক্রমণ বলে অভিহিত করেন।
তৃতীয় কংগ্রেসের পর থেকে আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে জনজীবনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে স্থানে স্থানে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচিছ। শ্রমিক কর্মচারীদের বাঁচার মত মজুরী ও ন্যায্য অধিকার, পাটের, তামাকের ন্যায্য দাম, ক্ষেতমজুরদের কর্মসংস্হান ভূমিহীনদের মধ্যে খাস জমি বন্টন, বর্গা জমির উপর বর্গা চাষীদের অধিকার প্রভৃতি দাবি, হাট বাজারে যুব কংগ্রেসের জুলমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন গড়ে তােলা হচেছ। বাংলাদেশের সামাজিক অর্থনৈতিক রূপান্তর তথা সমাজ প্রগতির জন্য প্রয়ােজন দেশবাসীকে সমাজ সচেতন ও সংগঠিত করা। এ জন্য দেশে আজ যে বুর্জোয়া, পেটিবুর্জোয়া ধারার রাজনীতি চলছে তার পরিবর্তে সমাজ কাঠামাে পরিবর্তনের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে এ জাতীয় ছােট ছােট আন্দোলন এবং এই আন্দোলন সমূহের ভিত্তিতে স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে ঐক্য গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কমিউনিস্ট পার্টি সমাজ প্রগতির লক্ষ্যে কাজ করে যাচেছ। স্বাধীনতার সুফলগুলাের উপর অাক্রমণ প্রতিহত করা এবং সরকারের ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী প্রবণতার বিরদ্ধেও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কর্মসূচীর ভিত্তিতে দশদলের ঐক্য রক্ষা ও শক্তিশালী করা অামরা গুরত্বপূর্ণ বলে মনে করি। বস্তুতঃ দশদলীয় ঐক্য জনগণের আকাঙ্ক্ষাও গনচেতনারই এক অভিব্যক্তি।
দেশের নাজক পরিস্হিতিতে সমস্ত দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং জনগণের অতি জরুরী অাশ সমস্যাসমূহ সমাধানের জন্য তাদের সংগঠিত করা ও আন্দোলন পরিচালনা করা
১৯৮০ সালে মূলতঃ এই ধারায় আমরা কাজ চালিয়ে গেছি। সবাই মিলে এভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার ভেতর দিয়ে জনগণের আস্থাভাজন দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল বিকল্প শক্তি সমাবেশ গড়ে উঠতে পারে। আশি সালের কাজকে আমরা সূচনা বলেই মনে করি। এ কাজে সাফল্য ভবিষ্যৎ ঘটনাবলীর বিকাশের উপর নির্ভর করবে। আর ভবিষ্যতের উপর ” আমরা নিঃসন্দেহে আস্হাবান। বর্তমান যুগ সাম্রাজ্যবাদ আর প্রতিক্রিয়ার পিছ, হঠার যুগ। বাংলাদেশে তার ব্যতিক্রম হতে পারে না।
সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক,
ভারপ্রতি সম্পাদক,
কমিউনিষ্ট পার্টি
ত্রিশ বছরে বর্তমানে জাতীয় সংসদে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী বিরােধীদল রয়েছে শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হকের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত কৃষক শ্রমিক পার্টি বাংলাদেশে মেহনতী মানুষের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ১৯১৪ সালের নবেম্বর মাসে বর্তমান জামালপুর জেলার কামারিয়ার চরে শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কৃষক সম্মেলনে নিখিল বঙ্গ প্রজাসমিতির প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠানটি কালক্রমে নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজাসমিতি এবং বিভাগােত্তরকালে কৃষক শ্রমিক পার্টি নামে রপান্তরিত হয়। এই সংগঠনই প্রথম বাংলাদেশ হতে জমিদারী প্রথার উচেছদ এবং কুখ্যাত মহাজনী প্রথার অবসান দাবী করে। ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত বাংলায় শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হকের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত কৃষক প্রজা-মুসলিম লীগ কোয়ালিশন সরকার দেশব্যাপী ঋণ সালিশী বোর্ড গঠনের মাধ্যমে মহাজনের শােষণ থেকে বাংলায় কৃষকদের মুক্ত করেন। এই সময়ে প্রজা আইনের মাধ্যমে জমির ওপর কৃষকের অধিকার স্বীকৃত হয়। ১৯৫৬ সালে জনাব আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে গঠিত কৃষক শ্রমিক–যুক্তফ্রন্ট সরকার জমিদারী প্রথার উচেছদ করেন। কৃষক শ্রমিক পার্টি বিভাগােত্তরকালে শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হকের ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভারতের পূর্বে এবং পশ্চিমাঞ্চলে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী জানিয়ে আসে। ১৯৭০ সালের নির্বাচন বয়কটের কালে মরহুম জননেতা মাওলা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও জনাব আতাউর রহমান খানের সঙ্গে কৃষক ৪ শ্রমিক পার্টিও লাহাের প্রস্তাবের বাস্তবায়নের দাবী করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা প্রকৃত পক্ষে ঐতি-হাসিক লাহোর প্রস্তাবেরই বাস্তবায়ন। কৃষক শ্রমিক পার্টি জন্ম লগ্ন থেকেই দেশে সকল অর্থনৈতিক বৈষাম্যের অবসান ও কৃষক শ্রমিক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মেহনতী জনতার রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। – কৃষক শ্রমিক পার্টির অতীত (অসপষ্ট) এবং পার্টির মূল লক্ষ্য গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন, ধর্ম ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তন, শােষণ মুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন, জাতীয় স্বাধীনত ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ ও সকল প্রকার আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের বিরােধিতা করিয়া বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা করণ। সামনে রেখেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ৮০ সালের ভূমিকার প্রকৃত মুল্যায়ন করা যেতে পারে।
কৃষক শ্রমিক পার্টির অন্যতম মূল লক্ষ্য, দেশে পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম। এজন্য দেশে নির্বাচিত সংসদ প্রতিষ্ঠা এবং এর সার্বিক সফলতার জন্য সর্বদা প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে। ১৯৭৯ সালে দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করলে কৃষক শ্রমিক পার্টি নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। এর মূল কারণ ছিল, একমাত্র নির্বাচিত সংসদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই দেশ থেকে সামরিক শাসনের অবসান সম্ভব ছিল। এবং কার্যতঃ তাই ঘটেছে। কৃষক-শ্রমিক পার্টির এ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের পর দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে অংশ নেয়। বিগত ত্রিশ বছরে বর্তমানে জাতীয় সংসদে সর্বাপেক্ষা শক্তি শালী বিরােধী দল রয়েছে। দেশে গণ তান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য এটি এক গুরত্বপূর্ণ অধ্যায়।
বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারী দল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি তাদের সমর্থন ঘোষণা করলেও কার্যতঃ তাদের নীতি দেখে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে বাধার সৃষ্টি করেছে। সরকার দীর্ঘকাল সংসদের আধিবেশন না ডাকার ফলে রাজনৈতিক মহলে চরম অসন্তষ্টির সৃষ্টি হয় এবং বিরােধী দলীয় সংসদ সদস্যগণ সরকারী নীতির প্রতিবাদে সংসদ অধিবেশন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা সরকারের কাছে তেইশ দফা দাবী পেশ করেন। সরকার ষােলটি দাবী মেনে নেন। এ সত্তেও কয়েকটি বিরােধী দলের সংসদ ন সদস্যগণ তাঁদের সংসদ বর্জন চালিয়ে র যাবার সিদ্ধান্ত নেন। এতে সংসদ পরি চালনায় অচলাবস্থার সষ্টি হয়। এই ক সরকার কর্তৃক মলদাবীসহ অধিকাংশ দাবী মেনে নেয়ার প্রেক্ষিতে কৃষক-শ্রমিক পার্টি সংসদে যােগদানের সিদ্ধান্ত নেয়। এবং সংসদ অধিবেশনে অচলাবস্থার অবসান ঘটে।
১৯৮০ সালে ফারাক্কা সমস্যা ভারতে গ্যাস রফতানীর প্রস্তাব, ভারত কতৃক পূর্বাশা দ্বীপ দখল, বাংলাদেশ থাই মৎস্য চুক্তি এবং সাম্প্রতিক সরকার কর্তৃক জাতীয় সংসদে উত্থাপিত উপদ্রুত অঞ্চল বিল দেশব্যাপী রাজনৈতিক তৎপর তার সৃষ্টি করে। কৃষক শ্রমিক পার্টি ফারাক্কা বাঁধ বিরােধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেয়। ভারতে গ্যাস রফতানীর ব্যাপারেও কৃষক শ্রমিক পার্টির পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদে প্রথম মূলতবী প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় এবং ভারতে গ্যাস রফতানীর বিরােধিতা করে দেশব্যাপী আন্দোলন চালায়। অন্যান্য রাজনৈতিকদলও ভারতে গ্যাস রফতানী র বিরােধিতা করে। ফলে সরকার জনগণের ইচছার বিরদ্ধে ভারতে গ্যাস রফতানী করা হবে না বলে ঘােষণা করতে বাধ্য হন। ভারত কর্তৃক পূৰ্ব্বাশা দ্বীপ দখলের বিরুদ্ধেও কৃষক-শ্রমিক পাটি সংসদের ভিতরে এবং বাইরে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। বাংলাদেশ-থাই মৎস্য চুক্তির বিরুদ্ধেও কৃষক-শ্রমিক পার্টি সংসদের ভিতরে এবং বাইরে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ফলে – সরকার এই ক্ষতিকর মৎস্য চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হন। সরকার সম্প্রতি জাতীয় সংসদে উপদ্রুত এলাকা বিল উত্থাপন করেন। এই কালা আইন সল্পকেও কৃষক শ্রমিক পার্টি সংসদের ভিতরে এবং বাইরে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অন্তবর্তীকালীন নির্বাচন দাবী করেছে। বর্তমান অবস্থায় অন্তবর্তীকালীন নির্বাচনে একমাত্র সরকারী দলই লাভবান হবে। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে কৃষক-শ্রমিক পার্টি সর্ব প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে অন্তবর্তীকালীন নির্বাচনের বিরােধিতা করে। অন্তবর্তীকালীন নির্বাচনের বিরদ্ধে দেশে প্রবল জনমত গড়ে ওঠে এবং সরকারও অন্তবর্তীকালীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা নেই বলে ঘােষণা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ১৯৮০ সালে কৃষক-শ্রমিক পার্টি কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবাবলী ও কর্মসূচী জাতির জন্য কল্যাণকর বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
এ, এস, এম সােলায়মান
সভাপতি, কৃষক-শ্রমিক পার্টি
১৯৮০ মেহনতি জনতার সার্বিক মুক্তির জয়যাত্রা শুরুর বছর
১৯৮০ হচেছ আমার দলের জন্য সবচাইতে সফল বছর। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালে আমাদের দলের জন্ম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল মেহনতি জনতার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করা। আমার জানা মতে এখন পর্যন্ত এদেশে কেউ সমাজতন্ত্রের কথা বলে নি।
৮০-র দশকের যে আন্দোলন সেটা হচেছ প্রকৃত পক্ষে জনতার আন্দোলন। ১৯৬৯ সালে মেহনতি জনতার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের জন্য ‘অবজেকটিভ কন্ডিশন’ অনুকূলে ছিল না। যার জন্য তখন আন্দোলন চলে যায় উঠতি মুৎসুদ্দী বুর্জোয়াদের হাতে। মূলতঃ যা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। ১৯৮০ দশকে এই দশ বছরে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে মেহনতি জনতা বিশেষ করে শ্রমিক, ভূমিহীন কৃষক শ্রেণী আন্দোলনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে মেহনতি জনতার মুক্তির আন্দোলনের নেতৃত্বে আসছে। তারই ছাপ পড়েছে ৪০ দশকের ৮০ সালে। তারই প্রমাণ হচেছ বিভিন্ন আন্দোলনে যেমন হাজার হাজার কৃষক পটুয়াখালীর চর নিঝুমে লড়াই করছে, ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর সরকারী কর্মচারীরা, সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। ৮০ সালেই আমাদের দল বাংলাদেশের যে সংবিধান আছে সে সংবিধান ও গণপরিষদ যে জনগণের নয় তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। অর্থাৎ ৭২ সালের সংবিধান এদেশের জনগণকে মুক্তি দিতে পারে না। অন্যান্য দল যখন তার ভিত্তিতে কার্যক্রম গ্রহণ করে আমরা তখন ৭২ সালের সংবিধানকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করি। আমরাই প্রথম কথা তুলেছি যে গণপরিষদ সার্বভৌম নয়। ৮০ সালেই বিভিন্ন রাজনৈতিক স্রোতধারা সে লক্ষ্যেই যাচেছ। অাজ উপলব্দি আসছে ৭২ সালের ‘কন্সটিটিউশন ইজ নট এডিকোয়েট এনাফ টু এসটাবলিশ দি রাইটস অব দি টয়লিং মাসেস’।
১৯৮০ সালে আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জনের একটি পথ হিসেবে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রচেষ্টা করি। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন বলতে আমরা কতগুলাে দলের ঐক্য বুঝিনা। আমরা বুঝি মূল লক্ষ্যে যাওয়ার পথে যে প্রধান শত্রু, আছে তার বিরুদ্ধে যে সব শ্রেণী শক্তি হিসাবে কাজ করছে তাদের ঐক্য। একটি নিম্নতম কর্মসুচীর মাধ্যমে তাদের ঐক্যবদ্ধ করে মূল শত্রুর বিরুদ্ধে আন্দোলন তৈরী করা। সেই লক্ষ্যেই আমরা ১০ দলীয় ঐক্য সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চালাই। কিন্তু এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করার ক্ষেত্রে একটি ব্যাপারে আমরা সচেতন ছিলাম যেন এর সুযােগ কোন একটি বিশেষ দল বা গােষ্ঠী, যাদের স্বার্থের সঙ্গে মেহনতি জনতার স্বার্থের মিল নেই, তারা নিতে না পারে। অর্থাৎ সমস্ত আন্দোলনের ওপর মেহনতি জনতার একটা ছাপ থাকে। আমি মনে করি সেই ব্যাপারে আমরা অনেকাংশে সার্থক হয়েছি। বিভিন্ন রাজনৈতিক কার্যক্রম, বিভিন্ন আন্দোলন, হরতালের মাধ্যমে ধীরে ধীরে দেশের মূল আন্দোলনের নেতৃত্বে মেহনতি জনতাই এগিয়ে আসছে। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই দেশের আধা প্রতিষ্ঠিত শােষণ- বাদী ধনবাদী অর্থনৈতিক কাঠামাে ভেঙ্গে পড়ছে এবং ধনবাদী অর্থনীতির নিজস্ব ধর্মই হচেছ অন্তর্দ্বন্দ। সেই অন্তদ্বন্দর এবং আন্তর্জাতিক ক্ষয়িষ্ণু ধনবাদী অন্তদ্বন্দ এ দুটো মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থ নীতি একেবারেই ভেঙে পড়ছে। প্রকৃতপক্ষে অর্থনীতি বলতে বাংলাদেশে কিছু নেই। তার প্রমাণ হচেছ ৭৪ সালে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা শতকরা ৪০ থেকে শতকরা ৬৫ ভাগে দাঁড়িয়েছে। দেশের জমি ও সম্পদ শতকরা ১০ জনের হাতে জমা হচেছ। ফলে শ্রেণীদ্বন্দর বাংলাদেশে তীব্র থেকে তীব্রতর হচেছ। শ্রমিকশ্রেণী ভূমিহীন কৃষক নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী, শ্রেণী সচেতন হয়ে উঠছেন। তাদের প্রকৃত শত্রু কে চিহ্নিত করতে পারছেন। ৮০-র দশক হচেছ এই শ্রেণী-মেরুকরণের একটি উল্লেখযােগ্য বছর। কাজেই আমার মতে এ দশ কের ৮০ সাল হচেছ মেহনতি জনতার সার্বিক মুক্তির জয়যাত্রার শুরুর বছর। আমার বিশ্বাস যদি এই রাজনৈতিক ধারাকে তার নিজস্ব লক্ষ্যের পথে শক্তিমান নেতৃত্ব দেয়া যায় তবে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে মেহনতি জনতার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের সাংগঠনিক ব্যর্থতা আছে। সাংগঠনিক ব্যর্থতা বলতে যতখানি সংগঠিত করতে পারতাম ততখানি করতে পারিনি। কিন্তু বিভিন্ন একমনা দল ও গোষ্ঠি আজকে আমরা এক জায়গায় এসেছি এবং যৌথভাবে সে কাজ শুরু করার একটা ব্যাপক পরিকল্পনা নিচিছ। যাতে যে মেহনতি জনগণ প্রকৃতপক্ষে মূলশক্তি তাদের সংগঠিত এবং সচেতন করা যায়। যার মাধ্যমে তারা রাষ্ট্র পত্র দখল করতে পারে।
সিদ্দিকুর রহমান
ফাষ্ট সেক্রেটারী
কৃষক শ্রমিক সমাজবাদী দল
আমাদের তেমন কোন সাফল্য নেই রাজনৈতিক দল হিসেবে। সাফল্যের অর্থ যদি হয় যে, জনগণের পক্ষ হতে উত্থাপিত দাবী সমূহের কোন কোনটি ক্ষমতাসীন সরকার মেনে নিয়েছে তা হলে বলতে হয় যে, সে ক্ষেত্রে আমাদের তেমন কোন সাফল্য নেই। তবে বিগত দিন গুলির ঘটনাবলী সাক্ষ্য দেবে আমাদের দল আর্দশ ও নীতির প্রশ্নে, অবিচলিত ও অাপােষহীন রয়েছে। এবং সকল প্রকার প্রলােভন চক্রান্ত ও হুমকি উপেক্ষা করে আমাদের দল এদেশের মানুষের বাঁচার দাবী ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অবিচল নিষ্ঠার সঙ্গে সােচছার রয়েছে। আমি মনে করি এটাই আমাদের সাফল্য। আমরা মনে করি ঐক্যবদ্ধ ব্যাপক গণ আন্দোলন ছাড়া দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। বিগত দিনগুলাে সাক্ষ্য দেবে আমি ও আমার দল সকল গণতান্ত্রিক ও স্বাধীনতা কামী রাজনৈতিক দল সমূহের নূন্যতম কর্মসূচী ও ইস্যুভিত্তিক ঐক্য গড়ে তোলার জন্য নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচিছ। এদেশের সমস্যাভারে ভারাক্রান্ত মানুষের প্রতিটি সমস্যা ও ন্যায়সংগত দাবী আমরা আমাদের ক্ষুদ্র শক্তি অনুযায়ী তুলে ধরেছি। যদিও ক্ষমতামদেমত্ত সরকার সেই সব ন্যায় সঙ্গত দাবী মেনে নেয় নি। তথাপি আমি মনে করি বিলম্ব হলেও আমরাই জয়যুক্ত হবাে। ইতিহাস এর সাক্ষী দেয়।
রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের ভুল এুটি থাকতে পারে কিন্তু ব্যর্থ বলে মনে করি না। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও জাতীয় প্রশ্নে, নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে সকল প্রকার চক্রান্ত, হুমকী ও প্রলােভন উপেক্ষা করে রাজনৈতিক দল হিসেবে আমারে দলের ভূমিকা-অবিচল নিষ্ঠা ও সততার প্রমাণ বহন করে। ছােট দল হিসেবে আমাদের দলের ভূমিকা অন্যের কাছে ছােট বলে মনে হতে পারে তবে আমি মনে করি আমাদের দল কখনই জনগণের স্বার্থকে ব্যক্তিস্বার্থের নিকট (অস্পষ্ট) করেনি। সেই দিক থেকে আমরা আমাদের দলের ভূমিকা ক্ষুদ্র হলেও ব্যর্থ মনে করি না।
মাওলানা আঃ রশিদ তর্কবাগীশ সভাপতি
গণ আজাদী লীগ
গণতান্ত্রিক আন্দোলন জনগণকে এখনও জমায়েত করতে পারেনি
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৮০ সালে সংগঠন হিসাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাফল্য ও ব্যর্থতার কথা বলতে হলে একটু পিছিয়ে শুরু করতো হয়।
সংগঠন হিসাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন জন্ম নেয় ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় জিয়াউর রহমানের তথাকথিত ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে’ যােগদানকে কেন্দ্র করে ইউপিপি-তে যে ভাঙ্গনের সূত্রপাত ঘটে তার পরিপ্রেক্ষিতেই গণতান্ত্রিক আন্দোলরে জন্ম। ইউপিপি-র তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর আহম্মদ সংগঠনের রাজনৈতক ও সাংগঠনিক লাইনের প্রতি বিশ্বাস ঘাতকতা করে সবার অগােচরে রাতের আধারে ক্যান্টনমেন্টে সমস্ত সংগঠনকে যখন জিয়ার হাতে তুলে দিয়ে আসেন, তখন আমাদের পক্ষে সেখানে থাকা সম্ভব হয়নি। আমরা সেদিন অতি সস্পষ্টভাবে এই উপলব্দিতে পৌছেছিলাম সংগঠন হিসাবে ইউপিপি-র অবলুপ্তি ঘটল। এবং হয়েছে ও তাই। বিচিত্রার রিপাের্টেই প্রকাশ পেয়েছে এরপর কতবার ইউপিপি-র ভাঙন হয়েছে, এবং আগে বা পরে ঐ ভগাংশগুলো জিয়ার দলের সঙ্গে মিলিত হয়েছে বা দল ছুট হয়ে অন্য কোথাও মিশেছে।
অবশ্য ঐ ঘটনাটি ছিল আশু কারণ। এর পর থেকে ইউপিপি-র অভ্যন্তরে সংগঠনের প্রথম গৃহীত রাজনৈতিক লাইনকে অক্ষুন্ন রাখার যে সংগ্রাম চলছিল তার পরিণতি লাভ করে ঐ ঘটনার মধ্য দিয়ে।
একটি কথা আজ সুষ্পষ্টভাবে বলা প্রয়ােজন একটি সাধারণ রাজনৈতিক দল হিসাবে নয়, বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের মোর্চা হিসাবেই ইউপিপি-র জন্ম হয় —যে কারণে সেদিন ‘বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী)’ তার সকল গণকার্যক্রম ইউপিপি-র মধ্য দিয়ে করার জন্য উক্ত সংগঠনে নিজেকে সংশ্লিষ্ট করে। (দ্রষ্টব্য : প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত ইউপিপি-র প্রথম সাংবাদিক সম্মেলন)। ইউপিপি-র ঘোষণা ছিল বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের বিকল্প শক্তি গড়ে তােলা। আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে কোন দেশের অন্ধ অনুসরণ না করাও ছিল ইউপিপি-র অন্যতম রাজনৈতিক মতামত। এসবই বিধৃত ছিল ইউপিপি-র ঘােষণা কর্মসূচী এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডে। পচাত্তরের পরবর্তীতে তাই ইউপিপি দক্ষিণপন্থী ও বাকশালী রাজনীতির বিপরীতে তৃতীয় স্রোত গড়ে তােলার কাজে হাত দেয়।
সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে—
(ক) শ্রেণী সংগ্রামই হচ্ছে বর্তমান সময়ের প্রধান ধারা। সুতরাং রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে বুর্জোয়া-পেটি বুর্জোয়া ধরনের সংগঠনের কোন ভবিষ্যত নেই। সাময়িকভাবে এ ধরনের সংগঠন জনগণের উপর প্রভাব রাখতে পারলেও, শ্রেণী ও পেশাগত আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান ধারায় সেগুলাে অপাংতেয় হয়ে যাবে অথবা নিত্য সংকটে ঘুরপাক খাবে। এ অবস্থায় প্রয়ােজন শ্রেণী সংগ্রামের পরিচালনায় উপযুক্ত সংগঠন—যা একমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর আদর্শে গঠিত পাটিই পারে। এবং এ পার্টিকে অবশ্যই নিজ দেশের বাস্তবতার উপর তার নীতি ও কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। ‘পান্থ’ রাজনীতির ধারার বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম করতে হবে। তুলে ধরতে হবে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐক্যের লাইন।
(খ) রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল বিষয়বস্তু হবে সমাজ পরিবর্তন। বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের সংগ্রামকে বিকশিত করে ‘জনগণের বিকল্প রাজনৈতিক’ শক্তি গড়ে তােলার লক্ষ্যে আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে। এর জন্য ক্ষমতাসীন স্বৈরশক্তির বিরদ্ধে সাধারণ ঐক্যের ছত্রছায়া নিতে হবে—যার অর্থ হচ্ছে প্রচলিত ছুৎমার্গের উব্ধে সেই লক্ষ্যে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে আগ্রহী শক্তিগুলাের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রচেষ্টা।
এরই ভিত্তিতে সংগ্রাম পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক প্লাটফরম হিসাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আত্মপ্রকাশ। বহুজন দ্বারা বহুভাবে নিন্দিত এবং বিক্রিত হলেও ১৯৮০ সালে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐ সংগ্রামের বিজয় ঘটেছে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক আন্দোলনের বিস্তার, আন্দোলনের ধারায় এবং সংগঠনে। সেগুলােকে সংক্ষেপে এভাবে বলা যায়ঃ-
(ক) শ্রেণী ও পেশাগত আন্দোলন আজ আর মুখের কথা নয়। বিভিন্ন দলগুলােকে এটা যেমন প্রভাবিত করছে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কর্মসূচীতেও তার প্রতিফলন ঘটছে। সমাজ পরিবর্তন এখন সাধারণ শ্লোগান। গত এক বছরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে বর্গাচাষী, ভূমিহীন ও ক্ষেতমজুরদের আন্দোলন নির্দিষ্ট রূপ নিয়ে বরিশাল, দিনাজপুর, খুলনা ও যশোরে বিকাশ লাভ করছে। এরই পাশাপাশি আখ চাষীদের নিজস্ব সংগঠন, আখচাষী ইউনিয়ন, কৃষি ফার্ম শ্রমিকদের কৃষি ফার্ম শ্রমিক ফেডারেশন ইত্যাদি নিজেদের সংগঠন গড়ে উঠেছে। কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সূচনা ঘটেছে সম্মিলিত কৃষক সংগ্রাম কমিটির মাধ্যমে। এছাড়াও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলাে এই ক্ষেত্রে আরও বেশী মনােযােগ দিচ্ছে।
(খ) পেটি বুর্জোয়া পার্টির অসারতা সম্পর্কে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মহলে মতামত ক্ৰমে দৃঢ় হচ্ছে। ইতিমধ্যে শ্রমিকশ্রেণীর পার্টি হিসাবে ‘ওয়ার্কার্স পার্টি’-র অভ্যুদয় ঘটেছে। অন্যান্যদের ক্ষেত্রেও মেরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
(গ) গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্র সাধারণ ঐক্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অগ্রগতি সর্বাধিক। বছরের প্রথম থেকেই বিভিন্ন ইস্যুতে দশদলীয় ঐক্য ঐক্যবদ্ধ কাজ করেছে। পার্লামেন্টের মাঝে এই সাধারণ ঐক্য ছিল আরও ব্যাপক। উপদ্রুত বিলকে নিয়ে সর্বশেষ ঐক্য (যদিও এখন পালামেন্টে সীমাবদ্ধ) একে আরও বিস্তৃতি দিয়েছে। ছ্যুতমার্গের রাজনীতির ক্রমে অপসারিত হচ্ছে।
(ঘ) আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে পন্থী রাজনীতির বিপরীতে স্বাধীন ও সার্বভৌম লাইন গ্রহণ এবং সমাজতান্ত্রিক শিবিরের ঐক্যের সংগ্রামও রাজনৈতিকভাবে বিজয় অর্জন করেছে ৮০ সালে।
তবে ব্যর্থতাও রয়েছে প্রচুর। এই ব্যর্থতা বাস্তবতার কারণেই। বাম রাজনীতির ক্ষেত্রে অনৈক্য, সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনের কর্মসূচীর সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক রূপের অনুপস্থিতি।
কিন্তু প্রথম থেকেই কাজী জাফরের নেতৃত্বে একটি অংশ ইউপিপি-কে আর দশটি পেটি বুর্জোয়া দলের ধারায় তৈরী করতে সচেষ্ট থাকে এবং পচাত্তর পরবর্তীতে যে রাজনৈতিক শুন্যতা সৃষ্টি হয় সেখানে ঐ রকম একটি দল হিসাবে ক্ষমতার শূন্যতায় নিজেদের অবস্থান গ্রহণ করতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। জিয়াশাহীর কাছে আত্মসমর্পন তারই পরিণাম। এর জন্য ‘রুশ-ভারত বিরােধীতা’ ‘বাকশাল বিরােধীতা’ যে সমস্ত শ্লোগান তোলা হয় তা ঐ আত্মসমর্পনের আড়াল সৃষ্টির জন্য।
ইউপিপি-র এই অতিজ্ঞতা, পূর্বতন ন্যাপ ও অন্যান্য দলের মাঝে কাজ করার অভিজ্ঞতা, শ্রেণী ও পেশাগত সংগ্রামের নবতর বিকাশের বাস্তব অবস্থা ও সাধারণ ও সাধারণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা এখনও বিদ্যমান। ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলন’ বর্তমান রাজনৈতিক আন্দোলনে দক্ষ কর্মী ও সংগঠক উপহার দিলেও তার কর্মসূচীতে জনগণকে এখনও ব্যাপকভাবে জমায়েত করতে পারেনি। কিন্তু জনগণের প্রতি অগাধ বিশ্বাস থেকে তুমি বলতে পারি যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের রাজনৈতিক লক্ষ্য। সফল হবেই।
রাশেদ খান মেনন
আহবায়ক
গণতান্ত্রিক আন্দোলন

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি শাণিত সংগঠনের প্রয়ােজন আছে
১৯৮০ সালে রাজনীতির ক্ষেত্রে আমাদের এক বাস্তব সাফল্য এসেছে। এ সাফল্যের ফল আমরা দেখেছি গত গণতাত্রিক কনভেনশনে। যেখানে পুরোন চিন্তা এবং কাঠামাের বৃত্ত থেকে রাজনৈতিক শক্তি বিশেষ করে সংগ্রামী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি যারা বিভিন্ন সময়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরােধিতা করেছেন, সামন্তবাদ উচ্ছেদের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন তাঁরা সেই পুরােন বৃত্তগুলাে ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। এই চিন্তা বহুদিন থেকে রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে বিশেষ করে যারা সক্রিয়ভাবে আন্দোলনের সঙ্গে বা কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে প্রচন্ড আলােড়ন সৃষ্টি করে। প্রথমতঃ আমরা ব্যক্তি, গ্রুপ বা সমষ্টিগতভাবে গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করব। যদিও আমরা তখনও এই রাজনীতিকে সাংগঠনিক বা বলা যায় পূর্ণাঙ্গ সাংগঠনিক রূপ দিতে পারিনি তবুও এই কনভেনশনের বিপুল সাফল্য ও সাড়া নিশ্চিতভাবে বর্তমান নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের সংগঠন তৈরী এবং রাজনীতি প্রচারের ব্যাপারে প্রচন্ড এক চাপ সৃষ্টি করেছে। আমরা মনে করি এই চাপের মুখে এবং আকাঙ্খার পরিপ্রেক্ষিতে এই সংগঠন বিকাশের জন্যে প্রথম পদক্ষেপে যে সাফল্য অর্জন করেছি সে সাফল্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবাে।
আমাদের এই গণতান্ত্রিক শক্তির অতীতের বিভাজন ও ব্যর্থতার মূল কারণ হলাে রাজনীতি ভুল ছিলাে। দ্বিতীয় কারণ হলাে যখন রাজনীতি সঠিক ছিলাে তখন সাংগঠনিক দৌর্বল্য, একদিকে গণতান্ত্রিকতা এবং অন্যদিকে কেন্দ্রিকতার সময়ের অভাবের দরুণ সেই সঠিক রাজনীতিকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি। এটা অতীতে বহুবার প্রমানিত হয়েছে। যার জন্যে সবার মধ্যে একটা আকাঙ্খার বিকাশ ঘটে যে আজকের বর্তমান বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই মুৎসুদ্দী রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভাঙ্গবার জন্যে এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি শাণিত সংগঠন তৈরি করার প্রয়ােজন আছে। যে সংগঠন তার রাজনীতিকে নতুনভাবে ব্যক্ত করবে, সুস্পষ্টভাবে সাম্রাজ্যবাদের বিরােধীতা করবে, সামন্তবাদ কর্মসূচী গ্রহণ করবে।
১৯৮০ সালে আমরা একেকজন বা দলগতভাবে বিভিন্ন দলে ছিলাম। সত্যিকথা বলতে গেলে, যে সমস্ত দলে আমরা ছিলাম ঐতিহাসিক কারণে এ দলগুলাে অনুপযােগী হয়ে যায়। এবং অনুপযােগী সংগঠন কখনােই একটি উপযােগী রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনা। অতএব সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডে আমরা বিচ্ছিন্নভাবে আদৌ এগিয়ে যেতে পারিনি। বরন্চ বলবাে, ১৯৮০ সালে আমাদের চিন্তার বিকাশ এবং কর্মকান্ডের সময় যেটুকু সাধিত হয়েছে তা মূলতঃ কেবল ৮০ সালের ব্যর্থতাই নয়, তার আগেকার ব্যর্থতার নিরিখে আমাদের কর্মকান্ডকে একটি স্তরে উন্নীত করতে সমর্থ হয়েছি।
৮০ সাল অন্যান্য সালের মত জাতীয় গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পরিস্থিতিতে আমরা দেশের রাজনৈতিক সংগঠন, আন্দোলন ও কাজের ধারার পুনরায় মূল্যায়ন করে এই গণতান্ত্রিক শক্তির বিভক্তি ও বিভাজন আরও বেড়েছে। নতুন দল গড়তে গিয়ে আমরা আরও ভাগাভাগি করেছি। আমি ও মনে করি এই বিভক্তি আগামী দিনের কর্মকান্ডকে আদৌ প্রভাবিত করবে না। কেননা মূলতঃ এই সংগঠনগুলাে ছিল একটি ঐ বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত। কতগুলাে দল এবং সে দলগুলােকে ভাঙ্গা খুবই সহজ ব্যাপার। যে কেউ যে কোন একটি প্যাডের ওপর বিবৃতি দিলে পরই দল ভাঙ্গাভাঙ্গি হয়ে যায়। সত্যি কথা বলতে গেলে পর যে সমস্ত দল ভেঙ্গেছে তারা দলগতভাবে কতখানি ভেঙ্গেছে এটা বলা মুশকিল। কেননা সে দলগুলাে আদৌ ছিল কিনা সে প্রমাণ পাওয়াও কঠিন। ভেঙ্গেছে ওপরের দিকে, চিন্তার বিভিন্নতার দরুন। অথবা আমার মনে হয় রাজনৈতিক বিবাদ ছাড়াও ব্যক্তি আকাঙ্খা বা ব্যক্তির দরুণ দল ভেঙ্গেছে। এবং তার ফলে জনমনে কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। আমরা আশা করছি ৭ ও ৮ ডিসেম্বরের কনভেনশনের মধ্য দিয়ে যে সাফল্য অর্জন করেছি, নতুন রাজনৈতিক হাতিয়ার নির্মাণের যে সংকল্প গ্রহণ করেছি তাতে ৮০ সালে আমাদের যে আপেক্ষিক কর্মহীনতা ছিল সেটা কাটিয়ে উঠে এটাকে এগিয়ে নিতে পারবাে। নতুন সংগঠনের দুটো সমস্যা আছে। একটা নির্মাণগত একটা ভাবগত। নির্মাণগত দিকের প্রাথমিক বাঁধা বিপত্তি আমরা কাটিয়ে এসেছি। তা হলাে পুরনাে কাঠামোগলাে ভাঙ্গবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আমরা কনভেনশন করতে পেরেছি এবং এ কনভেনশনে অগনিত অগ্রণী রাজনৈতিক কর্মী উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে প্রধান দাবী এসেছে, আন্দোলনের এবং সঠিক কর্মসূচী প্রণয়নের মধ্য দিয়ে এ সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যদিও রজনীতি নির্ধারণের প্রশ্নে এখনও আমাদের দৌর্বল্য আছে কিংবা অপূর্ণতা আছে তবু কর্মীবৃন্দ বা সচেতন ব্যক্তিবর্গ যারা এখানে সমবেত হয়েছেন তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস এ অপূর্ণতাকে আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবাে এবং আরও সুস্পষ্ট, উপযােগী কর্মসূচী জনগণের সামনে উত্থাপন করতে সক্ষম হবাে।
এনায়েতুলাহ খান
সদস্য, স্ট্যান্ডিং কমিটি
গণতান্ত্রিক পার্টি
আমাদের পার্টিতে শক্তিশালী নেতৃত্ব এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি
আমাদের পার্টির সাফল্য বা ব্যর্থতা সম্পর্কে বলতে হলে পাটির লক্ষ্য সম্পর্কে প্রথমে কিছু বলা দরকার। আমাদের পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রায় দু’বছর। ১৯৭৯ সালের ১লা জানুয়ারী আমরা কিছু সংখ্যক ব্যক্তি যারা এক সময়ে বিভিন্ন মাকর্সবাদী-লেনিনবাদী সংগঠন সমূহের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তারা বাংলাদেশ জনমুক্তি পার্টি গঠনের সিদ্ধান্ত নেই। পুরানাে লাইন যখন ভুল প্রমাণিত হল এবং আমাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল তখন ওই সব মাকর্সবাদীলেনিনবাদী সংগঠনে আমরা নতুন লাইন তুলে ধরার চেষ্টা করি। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা সম্ভব হয়নি বলে আমরা নতুন অর্থনৈতিক-সামাজিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এই পার্টিতে ঐক্যবদ্ধ হই। প্রথম থেকেই পার্টির ঘােষিত লক্ষ্য ছিল সমাজতন্ত্র কায়েমের মধ্যে দিয়ে শ্রমজীবী জনগণকে সকল প্রকার শােষণ থেকে মুক্ত করা। আমাদের লক্ষ্য সমাজতন্ত্র হলেও আমরা এ বিষয়ে সচেতন ছিলাম যে আমাদের মত একটি পশ্চাৎপদ দেশে সরাসরি সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব নয়। যে শ্রেণী দ্বন্দ সমাজতন্ত্রে উত্তরণ অপরিহার্য করে তুলে সেই দ্বন্দ উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের নির্দিষ্ট স্তরের সঙ্গে জড়িত। তাই, প্রথম স্তরে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের পথে আজকে যে সামাজিক সম্পর্ক সমূহ বাধা তা দূর করাই হবে পার্টির কাজ।
আমরা লক্ষ্য না করে পারি না যে এদেশর শ্রমজীবী জনগণ—কৃষক, শ্রমিক,মজুর, কারিগর প্রমুখ–সকল সম্পদ উৎপাদন করলেও তারা নিজেরা অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে দিয়ে জীবন যাপন করছেন। অথচ, যারা প্রত্যক্ষ শ্রমের সঙ্গে জড়িত নন তারা মােটামােটি ভালভাবে জীবন যাপন করছেন। শ্রমজীবী জনগণকে দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে রেখে এসব অশ্রমজীবী শ্রেণী সমূহের অবস্থান অর্থহীন ও অপ্রয়ােজনীয়। এই অবস্থার পরিবর্তনই আমাদের পার্টির লক্ষ্য। যে সামাজিক সম্পর্কের কারণে শ্রমজীবী জনগণের সঙ্গে অশ্রমজীবী শ্রেণী সমূহের এই পার্থক্য তা অব্যাহত থাকলে বর্তমান অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না। এই সামাজিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখছে উৎপাদন ও বিনিময়ের উপর অশ্রমজীবী শ্রেণী সমূহের নিয়ন্ত্রণ। এই নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রাখার উদ্দেশ্যেই পরজীবী শ্রেণী সমূহ এখানকার ব্যাংক, পার্লামেন্ট, পুলিশ, আমলাতন্ত্র, বিচার-ব্যবস্থা, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
যারা প্রকৃতই বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন কামনা করেন তারা সবাই এসব প্রতিষ্ঠানের আমল পরিবর্তনের প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেন। কিন্তু, এখানে যে প্রশ্নটি বড় করে দেখা দেয় সেটা হল কোন শ্রেণী উৎপাদন ও বিনিময় নিয়ন্ত্রণ করছে এবং কারা তাদের সামাজিক সমর্থক। আমাদের দেশের বর্তমান অর্থনীতি বিশ্বপূজিবাদী অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্ব পূজিবাদী অর্থনীতির সঙ্গে এখান কার অর্থনীতির আদান প্রদান একেবারে অপরিহার্য। এই অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এখানকার বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থা বিরাজ করছে। বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন সামন্ত রাজা-রাজন্যদের শাসিত। স্থানীয় ফিউডাল এস্টেট অথবা স্থানীয় অর্থনীতি, যা আধা-সামন্তবাদী ব্যবস্থার , বৈশিষ্ট্য, তার স্থান দখল করে নিয়েছে কেন্দ্রীয় শাসন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এসবই বিশ্ব পূজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িত এবং এই ব্যবস্থার স্বার্থেই গড়ে উঠেছে। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আমরা নয়া-উপনিবেশিক বলে আখ্যায়িত করি। এই অর্থনীতির প্রতিনিধি হিসাবে আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণী, পূজিপতি, কলকারখানার পরিচালক, আমলা, বড় ব্যবসায়ী, ইনডেনটার, কনট্রাকটর যারা অন্তভক্ত তারাই এখানকার উৎপাদন ও বিনিময় নিয়ন্ত্রণ করছে। এই শ্রেণী উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের পথে প্রধান বাধা এবং এই শ্রেণীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ উৎপাদকদের দ্বন্দর সমাজ পরিবর্তনকে অপরিহার্য করে তুলেছে। অতীতের কোন রাজনৈতিক আন্দোলনই এই শ্রেণীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়নি। এদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক পরিবর্তন এই শ্রেণীর স্বার্থেই হয়েছে। এই শ্রেণীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আক্রমণ পরিচালনা করে স্বল্প সময়ের মধ্যে আমাদের পার্টি উৎসাহব্যঞ্জক সাফল্য অর্জন করেছে। কল্পিত সামন্তবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করে এক যুগ ধরে আমরা যে সাফল্য অর্জন করতে পারিনি, বরং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি, আজকে আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণী ও তার সামাজিক সমর্থকদের রাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করে আমরা আমাদের পার্টিকে শ্রমজীবী জনগণের অনেক নিকটে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। তবে, একথা অস্বীকার করা যাবে না যে কাজের পদ্ধতি আরও উন্নত হলে আমরা অনেক বেশী পরিমাণে সাফল্য অর্জন করতে পারতাম। কাজের পদ্ধতি নিয়ে আমরা অনেকদিন পর্যন্ত জমিলতায় ভুগেছি। প্রচলিত পদ্ধতিতে কাজ করার পরিবর্তে কোন পদ্ধতিতে কাজ করলে শ্রমজীবী জনগণের চিন্তা চেতনাকে গভীরভাবে নাড়া দেওয়া সম্ভব হবে সে নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দেয়। যে কাজের পদ্ধতি আমরা দীর্ঘ দিন অনুসরণ করেছি তা নতুন পদ্ধতি অবলম্বনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এখন পর্যন্ত এসব প্ৰশ্নের পুরােপুরি মীমাংসা হয়েছে বলা ভুল হবে। ক্রমাগত নতুন নতুন প্রশ্ন আমাদের সামনে আসছে। এছাড়া, আমাদের পার্টিতে শক্তিশালী নেতৃত্ব এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। পার্টিতে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের আগমন এবং রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে সক্রিয় অংশ গ্রহণ ব্যতীত এই অভাব দূর হবে না। যে কর্মকান্ড শুরু করলে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা পার্টিতে যােগ দেবেন সেই কর্মকাণ্ড আমরা এখন পর্যন্ত শুরু করতে পারিনি। তবে আমরা বিশ্বাস করি আমাদের লাইন যেহেতু সঠিক এবং প্রচলিত রাজনীতি ও পার্টি সমূহের প্রতি শ্রমজীবী জনগণ বীতশ্রদ্ধ তাই, আমরা এমন রাজনৈতিক কর্মকান্ড অচিরেই শুরু করতে পারব যা অনেককেই পার্টিতে যােগ দিতে উৎসাহিত করবে।
মাহফুজ ভূঁইয়া
সভাপতি, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি
জনমুক্তি পার্টি।

বৃহত্তম পার্টি হওয়া সত্বেও জাতীয়তাবাদী দলকে পরিপূর্ণ মনােলিথিক চরিত্র দিতে পারিনি।
(১) এ বছর আমরা দশ বছরের বেশি সময়ের উপনিবেশিক প্রশাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটিয়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও নিম্নতম স্তরে জনগণের নিজেদের হাতে নিজেদের শাসনভার অর্জনের প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এই প্রক্রিয়া হলো স্বনির্ভর গ্রাম সরকারের প্রক্রিয়া। চলতি বছরের মধ্যেই দেশের অধিকাংশ গ্রামে স্বনির্ভর গ্রাম সরকার গঠন করা হয়েছে এবং এ বছরই সর্বপ্রথম ভূমিহীন ও পেশাদার মানুষ প্রশাসনে অংশ নিতে সমর্থ হয়েছে।
(২) ১৯৮০ ইং সালের জুন মাসের মধ্যে আমরা ১৮২টি নতুন খাল খনন করেছি। ১৯৮০ ইং সালে আমাদের ৭০০ (সাতশত) খাল খননের পরিকল্পনা রয়েছে। এই খাল খনন ও কৃষিতে আনুসঙ্গিক ম্যাচিং সাপাের্ট দেয়ার ফলে এ বছর আমরা আশ্চর্যজনক ফললাভ করেছি। ভয়াবহ বন্যায় ১৪টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও এবারের খাদ্য উৎপাদন হয়েছে ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ৫ বছরে খাদ্যোৎপাদন দ্বিগুণ করার প্রাথমিক লক্ষ্য আমরা পুরােপুরি অর্জন করেছি।
(৩) ১৯৫১-৭১ইং পর্যন্ত ২৮ বছরে এদেশের স্বাক্ষরতার হার বেড়েছিল মাত্র ১২%। আমরা ৫ বছরে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এবং এ বছরই এই লক্ষ্যে ১ কোটি প্রাইমারী প্রকাশ ও বন্টন করেছি, নিয়েছি আনুসঙ্গিক অন্যান্য ব্যবস্থা। অনেক ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এ বছর আমরা স্বাক্ষরতার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের একটা অচলায়তন ভাংতে সমর্থ হয়েছি।
(৪) জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল জনগণের মিলিশিয়া গঠন করা। আমরা এ বছর এ ব্যাপারে উল্লেখযােগ্য সাফল্য অর্জন করেছি। আমাদের গ্রাম প্রতিরক্ষা দল ও পৌর প্রতিরক্ষা দলের সদস্য সংখ্যা ইতিমধ্যেই এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে এবং এদের মধ্যে ৩৫ লক্ষই হচ্ছে মহিলা। এই দলের সদস্যরা শুধু অস্ত্রের প্রশিক্ষণই নিচ্ছেনা, গ্রামােন্নয়ন ও সমাজ উন্নয়নের যাবতীয় প্রশিক্ষণও গ্রহণ করছে এবং হাতে-কলমে সে প্রশিক্ষণকে বাস্তবে প্রয়ােগ করে চলেছে। আনসারদেরও আমরা অনুরূপভাবে প্রশিক্ষিত করতে সমর্থ হয়েছি।
(৫) ১৯৭১-এর বিজয়ের পরবর্তীতে শিল্পক্ষেত্রে যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করা হয় তার ফলে শিল্পায়নের ধারা দীর্ঘদিন ধরে স্তব্ধ হয়েছিল। ১৯৭৭ ইং সালে পুনরায় সম্ভাব্য বিনিয়ােগকারীদের মধ্যে আস্থা ও বিনিয়ােগের ইচ্ছা দেখা দিতে থাকে। ১৯৮০ইং সালে সে আস্থা ব্যাপকভাবে বাস্তবে রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং দিকে দিকে ডি শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। এ বছর থেকেই আমরা শুরু করেছি শিল্প ক্ষেত্রে বৈপ্লবের প্রক্রিয়া।
(৬) এ বছর আমরা ভূমিহীন ও সহায়সম্বলহীন মানুষদের জন্য কোলেটারেল মুক্ত ঋণ তথা গ্রামীণ ব্যাঙ্ক প্রকল্পের সম্প্রসারণ, মৎস্য চাষ, গ্রামীণ বনায়ন, নগ্নপদ চিকিৎসক ইত্যাদি তৈরির মাধ্যমে এমন একটি প্রক্রিয়া শুরু করতে সমর্থ হয়েছি, যা সমাজের সবচেয়ে নিপীড়িত মানুষগুলােকে মুক্তির দিশা দিতে পেরেছে।
(৭) গণতন্ত্রের ভিত্তিকে আমরা এ বছর আরও মজবুত করতে পেরেছি। বর্তমানে দেশে রাজবন্দীর সংখ্যা সর্বনিম্ন।
বিভিন্ন দল-উপদল, নেতা-উপনেতা ও কতিপয় পত্র-পত্রিকায় চূড়ান্ত মিথ্যাচার, রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক বক্তব্য, অশালীনতা ও ধৃষ্টতার পরাকাষ্ঠা দেখানাে সত্ত্বেও আমরা সহনশীলতার যে অদৃশ্য -পূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এসেছি, এ বছরও সে ঐতিহ্য পূর্ণমাত্রায় বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছি।
(৮) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গত কয়েক বছর ধরে আমরা যে ক্রমবর্ধমান সম্মান অর্জন করে আসছিলাম এবছর তা আরাে বেড়েছে। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি জাতিসংঘে প্রদত্ত তাঁর ভাষনে অনুন্নত বিশ্বের স্বপক্ষে যে দশ দফা প্রস্তাব প্রদান করেন তা নীতিগতভাবে গৃহীত হয়েছে। এবং বাংলাদেশ কার্যত অনুন্নত বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে নিজের স্থানকে মজবুত করতে সমর্থ হয়েছে। (৯) সবচেয়ে বড় কথা এ বছর আমরা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সুস্পষ্ট বিজয়ের সূচন করতে সমর্থ হয়েছি। আমাদের দেশ, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মাটি, মানুষ, সমস্যা ও সমাধানকে কেন্দ্র করে রাজনীতির ব্যর্থহীন রুপরেখা প্রদান করেছি, এ রাজনীতি আপামর জনগণ ব্যাপক ভাবে গ্রহণ করেছে এবং ডান বাম মধ্যম নির্বিশেষে অন্যান্য ঘরানার সচেতন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা ব্যাপকভাবে ও স্বতস্ফূর্তভাবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যােগদান করছে।
(১) আমাদের পার্টি আজ দেশের বৃহত্তম পার্টি হওয়া সত্ত্বেও আমরা একে একটি পরিপূর্ণ মনােলিথিক চরিত্র প্রদান করতে পারিনি। যদিও তা প্রদান করার কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে।
(২) প্রচারের ক্ষেত্রেও আমরা কিছু, দুর্বলতার শিকার হয়েছি। অনেকগুলাে বিষয় ও ঘটনাকে আমরা যথাসময়ে ও যথাযথভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারিনি। এই দুর্বলতা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারলে বিভিন্ন বিরোধী দলের গলাবাজী আরও অনেকখানি কমে যাবে।
(৩) দুর্নীতি এখনও বিদ্যমান আছে। বেঅাইনী অস্ত্রও আমরা পুরােপুরি উদ্ধার করতে পারিনি যার ফলে এখানে সেখানে মাঝে মাঝেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবণতি ঘটে যাচেছ।
জুলমত আলী খান,
যুগ্ম-মহাসচিব,
জাতীয়তাবাদী দল।
জাতীয় লীগ সঠিক কোন অবদান রাখতে পারেনি
বর্তমান অবস্থায় অন্যান্য বিরােধী দলের মতাে আমার দলের পক্ষেও সঠিক অর্থে রাজনৈতিক কার্যধারা পরিচালনা তা করা সম্ভব নয়। ১৯৮০ সালে রাজনীতি _ কেবলমাত্র শ্লোগানের রাজনীতিতে পরি শত হয়েছে। প্রত্যেকটি দল মিছিল, মিটিং করছে কিন্তু বাস্তব অর্থ গঠনমূলক কোন কাজ করছেনা। গণতান্ত্রিক প্রয়ােজনে যে ধরনের সুস্থ রাজনীতির প্রয়ােজন, এমতাবস্থায় তার বিকাশ সাধন সম্ভবপর হচেছ না। আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ ও সে ব্যাপারে সরকারের মনােভাব, তালপট্টি, ফারাক্কার মতাে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সরকারের নির্লিপ্ত ও নেতিবাচক মনাে ভাব অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক। দেশের অর্থ নৈতিক ভিত্তিও দিনে দিনে হয়ে পড়ছে দুর্বল থেকে দুর্বলতর। কৃষি বিপ্লব, দ্বিগুণ ফসল উৎপাদন ইত্যাদি নিয়ে বিপ্লবী বুলি আওড়ানাে হচেছ, অথচ দৃশ্যতঃ ইতিবাচক কোন ফলাফল পাওয়া যাচেছ না। এক দিকে ফসলের উৎপাদন বাড়ানাের জন্য উৎসাহিত করে অন্যদিকে সারের দাম বাড়িয়ে কৃষি উৎপাদনে নিয়ে আসা হয়েছে স্থবিরতা। ১৯৮০ সালে রাজশাহী, রংপুর, খুলনা জেলে বন্দীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে মানুষের মােলিক দাবীগুলাের ওপর আঘাত হানা হয়েছে। দু-র্নীতি আগেকার সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। প্রশাসনের এমন কোনো পর্যায় নেই। যেখানে কোনো দুর্নীতির অবস্থান নেই।
এমন অবস্থায় কোন দলের পক্ষে সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। কাজেই ব্যর্থ তার অংশই বেশী হওয়া বাঞ্ছনীয় দলের সাংগঠনিক সফলতা বা ব্যর্থতা কোন বড় কথা নয়, সংগঠন দেশের সামগ্রিক অবস্থার ওপর কিভাবে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারলাে তার ওপরেই একটি দলের সফলতা বা ব্যর্থতা নির্ভর করে। অথচ বর্তমান অবস্থায় কোন দলের পক্ষে প্রকৃত অর্থে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা সম্ভব হচেছ না। এ হিসেবে আমার দল নিজস্ব সাংগঠনিক ক্ষেত্রে যেমন সফলতার পরিবর্তে ব্যর্থতা অর্জন করেছে বেশী সার্বিক প্রেক্ষাপটেও তেমনি সঠিক কোন অবদান রাখতে পারে নি।
তবে অন্ততঃপক্ষে সংগঠনগত পর্যায়ে জাতীয় লীগ এবছরের শেষের দিকে আবার একটি ব্যস্ত রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠবে। দলের কয়েকজন সদস্যের মধ্যে আপাতঃ বিভ্রান্তি, এলেও অধিকাংশ কম এবং নেতা এখন পর্যন্ত আমার ওপরই আস্থাভাজন। দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভাগুলােতে কার্যনির্বাহী কমিটির অধিকাংশ সদস্যই উপস্থিত থাকছেন এবং কোরাম সংখ্যক সদস্যের উপস্থিতিতে দলীয় নীতি , ও সিদ্ধান্ত সঠিকভাবেই প্রণীত ও কার্যে রূপায়িত হয়ে চলেছে। দেশী ও বিদেশী কয়েকটি অশুভ চক্রের লােভ ও মােহের হাতছানি থেকে দলীয় কর্মী ও নেতাদের রক্ষা করে এখন পর্যন্ত যে জাতীয় লীগ সঠিক দলীয় নীতিগুলাে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সমষ্টিগতভাবে কাজ করে যেতে পারছে, তা জাতীয় দলের সাংগঠনিক পর্যায়ে একটি চূড়ান্ত সাফল্য।
আতাউর রহমান খান
সভাপতি জাতীয় লীগ।
আমরা লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করিনা
ভারত কর্তৃক তৈরী ফারাক্কা এবং সীমান্তে সৃষ্টি হাঙ্গামা এবং দক্ষিণ তালসভা, বিবৃতি ও সাংবাদিক সম্মেলনের পট্টি দখল এ সকল কাজকে তামরা দেশের সব চাইতে বড় সমস্যা বলে মনে করি। বাংলাদেশ জাতীয় দল মনে করে ভারতের এ সমস্ত ঘৃণ্য কাজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম একান্তই প্রয়ােজন। তাছাড়া যে সমস্ত রাজনৈতিক দল দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে, এদেশের বাসিন্দা হয়ে বিদেশের লেজুড় বৃত্তি করছে তাদের বিরদ্ধে এবং যে সমস্ত রাষ্ট্র আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নষ্ট করার জন্য তৎপর, তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা এবং দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে নিষ্কন্টক করা ও ফারাক্কার প্রকোপ থেকে রক্ষা করা প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের লক্ষ্যে দেশের ৫টি রাজনৈতিক দলের সমবায়ে ও সীমান্ত হামলা প্রতিরােধ কমিটি গঠন করেছি। এই কমিটি গত এক বৎসর ধরে সক্রিয় ভাবে বহাল রয়েছে।
১৯৮০ সালের প্রাক্কালে ২৭শে ডিসেম্বর রাশিয়া কর্তৃক আফগানিস্তান । দখলের পর বিশ্ব রাজনীতিতে এর প্রতি ক্রিয়া দেখা দেয়। বাংলাদেশের মুসলিম জনতা এই হামলার বিরুদ্ধে সােচচার হয়ে ওঠে। আমরা ফারাক্কা ও সীমান্ত হামলা প্রতিরােধ কমিটির পক্ষ থেকে জনসভা, বিবৃতি ও সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে এর তীব্র প্রতিবাদ করি। ইসলামী সম্মেলনের মতে আফগানিস্তানে রাশিয়ার পুতুল বারবক কারমাল সরকারের সঙ্গে সকল প্রকার সম্পর্কচেছদ করার জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবী জানিয়েছি।
৮০ সালের প্রথম দিকে রাজশাহী জেলে বন্দী হত্যার প্রতিবাদে আমরা ঢাকা শহরে হরতাল পালন করি। ১৬ মে ছিল ফারাক্কা দিবস। ১৯৭৬ সালের এই দিনে মওলানা ভাসানী ফারাক্কার বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিল সংগঠিত করেছিলেন।
ফারাক্কা ও সীমান্ত হামলা প্রতিরােধ কমিটি ১৬ মে ফারাক্কা দিবস পালন করে। দেশব্যাপী এই দিবস উদযাপিত হয়। এই উপলক্ষ ঈশ্বরদিতে অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয় সমাবেশ। ঈশ্বরদিতে আম বাগানে বিশাল সমাবেশ ও সমাবেশ শেষে কমিটির আহ্বায়িকা, জাতীয় দল প্রধান মিসেস আমেনা বেগমের নেতৃত্বে বিরাট মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট-এর বিপ্লবকে স্মরণে রেখে ৮০ সালের ১৫ আগষ্ট অন্যান্য দলের সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় দলও এককভাবে এই দিবস পালন করে। খুলনা জেলখানায় বন্দী হত্যা কাণ্ডের প্রতিবাদে, আমরা ফারাক্কা ও সীমান্ত হামলা প্রতিরােধ কমিটি ৫ দলীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সহ ১৫ দলের উদ্যোগে ২৮ অক্টোবর দেশব্যাপী হরতাল পালন করি। এবং জনসভার মাধ্যমে প্রতিবাদ জনসভার মাধ্যমে প্রতিবাদ করি।
উপদ্রুত এলাকা বিলের নামে সরকার মানুষ হত্যার যে লাইসেন্স সংসদের নিকট চেয়েছে এর বিরুদ্ধেও আমরা, প্রতিবাদ জানিয়ে যাচিছ। ফারাক্কা প্রতিরােধ কমিটিকে সম্প্রসারণ করে ফারাক্কা বাঁধের বিরদ্ধে এবং সীমান্তে বার বার ভারতীয়দের হামলা ও পূর্বাশা দ্বীপ ভারতীয়দের দখল থেকে পুনরুদ্ধার করার উদ্দেশ্যে একটা ব্যাপক ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তােলার জন্যও গত এক বছর ধরে আমরা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছি। এছাড়া এ বছর বন্যার সময়ও আমরা দলীয় পর্যায়ে রিলিফের ব্যবস্থা করি। এই উপলক্ষে খন্দকার মােশতাক আহমদের ডেমােক্র্যাটিক লীগ সহ আমরা ১৩টি দলের নেতৃবৃন্দ একটি রিলিফ টিম নিয়ে উত্তরবঙ্গ সফর করে স্বহস্তে রিলিফ বিতরণ করি। এক কথায় সংক্ষেপে এই হল গত এক বছরে আমাদের সাংগঠনিক তৎপরতার খতিয়ান।
অবশেষে বলতে হয় আমরা বিদেশের লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করি না। বিদেশে বৃষ্টি হলে ঢাকায় বসে ছাতা ধরার রাজনীতিকে আমরা ঘৃণা করি। আমরা ট্রাক ভাড়া, মানুষ ভাড়া করে জনসভার কলেবর বৃদ্ধি করে জৌলুস প্রদর্শনের রাজনীতিকে ঘৃণা করি।
এই জৌলুস প্রদর্শন না করা যদি ব্যর্থতা হয় তাহলে এ ব্যাপারে আমরা সত্যি ব্যর্থ।
আমেনা বেগম
আহ্বায়িকা
জাতীয় দল।
অর্থাভাবে সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিতে পারছিনা।
কোন একটি বিশেষ সময়ে একটি রাজনৈতিক দলের সাফল্য ও ব্যর্থতার মূল্যায়নের ভিত্তি হলাে সেই বিশেষ সময়ে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে উক্ত – দলের গৃহীত পদক্ষেপসমূহের যথার্থতা বিবেচনা করা। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের জনগণ সরকারের ফ্যাসিবাদী ক্রিয়াকলাপের প্রত্যক্ষ শিকারে পরিণত হয়েছে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়নি। জাতীয় সংসদকে এড়িয়ে রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন ধরনের আদেশ ও অধ্যাদেশ জারি করে একনায়কত্বকে সুদৃঢ় করার প্রয়াস চালাচেছ।
সারের দাম, কীটনাশক ওষুধের দাম, পাওয়ার পাম্পের ভাড়া বৃদ্ধি করে কৃষি উৎপাদন হ্রাস করা হয়েছে। ফসলের ন্যায্য দাম থেকে কৃষকদের বঞ্চিত করা হয়েছে। অসংখ্যবার লােডশেডিং-এ ফলে এবং বিদ্যুতের চার্জ বৃদ্ধি করার কারণে শিল্প উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। চামড়া শিল্পকে ধবংস করা হয়েছে। পাট ও পাটশিল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এভাবে দেশের অর্থনীতির আমদানী নির্ভরতা এবং সাম্রাজ্যবাদী ঋণের উপর নির্ভরশীলতা আরও বেড়ে গেছে। অর্থনীতিতে ব্যক্তিমালিকানার শােষপ পাকাপােক্ত ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সরকারীভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এককথায়, ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি চরম দেউলিয়াত্বে পর্যবসিত হয়েছে, শােষণ-নিপীড়ন এবং ঘুষ দুর্নীতির যাঁতাকলে জনজীবন মারাত্মক ভাবে নিষ্পেষিত হচেছ।
১৯৮০ সালে আমরা দেখছি, দেশের কোন কোন অংশে বিদেশী আধিপত্যবাদীদের পতাকা উড়ছে। স্বীয় ভূ-খণ্ডের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিচেছ। এমন কি, সামান্যতম উদ্যোগ পর্যন্ত গ্রহণ করছে না। বিভিন্ন অসমচুক্তির কারণে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিঘিত হচেছ। ফারাক্কা সমস্যার সমাধানে সরকার দৃডঢ় ভূমিকা গ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সরকারের গৃহীত পররাষ্ট্রনীতি দেশের, স্বার্থরক্ষা ও সম্মান বৃদ্ধির সহায়ক হয়নি।
বিভিন্ন কালাকানুন এবং সন্ত্রাস, বহাল রেখে জনগণের গণতান্ত্রিক ও সামাজিক অধিকার হরণ করা হচেছ। ৪র্থ ও ৫ম সংশােধনী, প্রেস এন্ড পাবলিকেশনস অর্ডিনলি, পাকিস্তানী আমলে প্রণীত শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি আইন, সরকারী কর্মচারী অধ্যাদেশ ইত্যাদি বাতিল করার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। উপরন্তু নতুন করে মানুষ মারার জংলী লাইসেন্স নেয়ার উদ্দেশ্যে জাতীয় সংসদে উপদ্রত এলাকা বিল পেশ করা হয়েছে। এই বিলের বিরদ্ধে আন্দোলনরত নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের উপর প্রকাশ্যে পুলিশী হামলা চালানাে হয়েছে। সংসদে তাদের কথা বলার সুযােগ দেয়া হচেছ না। দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরকারী পৃষ্ঠপােষকতায় সন্ত্রাসবাদীরা বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যা করছে। রাজশাহী ও খুলনা কারাগারে নিরীহ বন্দীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বন্দীদের হত্যা করা হয়েছে। এভাবে ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকারকে নির্লজ্জভাবে ভূলুন্ঠিত করা হয়েছে। ১৯৮০ সালে বিরাজমান এই পরিস্থিতিতে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন করে দেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে জাসদ অঙ্গীকারাবদ্ধ। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করতে হলে বিরাজমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার আলােকে রচিত একটি সুনির্দিষ্ট কর্ম– সূচীর ভিত্তিতেই জনগণকে সংগঠিত, – ঐক্যবদ্ধ এবং আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের একটি বাস্তব কর্মসূচীর অভাব ছিল।
১৯২০ সাল থেকে এ উপমহাদেশে বাম পন্থী রাজনীতির উন্মেষ ঘটা সত্তেও কোন দল সমাজ পরিবর্তন সাধনের উপযুক্ত কর্মসূচী হাজির করতে সক্ষম হয়নি। উপমহাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের মূল্যায়ন এবং জাসদের গত ৮ বছরের আন্দোলন ও সংগঠনের অভিজ্ঞতার ফসল স্বরুপ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, ১৯৮০ সনে জনগণের সামনে বিরাজমান বাস্তব পরিস্থিতির আলােকে একটি যথাযােগ্য কর্মসূচী হাজির করতে সক্ষম হয়েছে। বিপ্লবী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর্যায়ে জাসদের ঘােষিত এই ১৮ দফা কর্মসূচীতে পার্লামেন্টে সকল পেশার প্রতিনিধিত্ব অর্জন, প্রশাসনের গণতন্ত্রায়ন, সর্বস্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সর্বক্ষেত্রে শতকরা ৪০ ভাগ ভােটারের অনাস্থার প্রেক্ষিতে প্রতিনিধি প্রত্যাহার শােষিত জনতার স্বার্থরক্ষাকল্পে বিভিন্ন স্তরে জনগণের স্বশাসিত সংস্থাসমূহের প্রতিনিধিদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সংস্থা গঠন, শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, ক্ষেতমজুরদের ট্রেড ইউনিয়ন গড়ার আইনগত অধিকার ও লেবারওয়ার্ক ব্রিগেড গঠনের দাবি রয়েছে। সকল সক্ষম নাগরিকদের সামরিক প্রশিক্ষণ দানসহ সামরিকবাহিনীকে উৎপাদনমুখী ও আধুনিকীকরণের দাবিও রয়েছে। এ ধরনের একটি কর্মসূচীর ভিত্তিতে সংগঠন ও আন্দোলন রচনার মাধ্যমেই কেবল ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও পুজিবাদকে কার্যকরভাবে রাখা যেতে পারে। শােষিত শ্রমজীবী শ্রেণীসমূহের রাজনৈতিক শক্তিকে বিকশিত করা যেতে পারে, সমাজ জীবনের সকল কে সঠিক ও সার্থকভাবে পরিচালনা করে। সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের রাজনীতির অগ্রগতিকে নিশ্চিত করা যেতে পারে। তাই, ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও পুজিবাদকে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে আরও গণতন্ত্র অর্জন, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুদৃঢ়করণ এবং গণমুখী অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার নীতির ভিত্তিতে প্রণীত ১৮ দফা কর্মসূচী গ্রহণকে আমরা একটি ঐতিহাসিক সাফল্য বলে মনে করছি। জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব অর্জ নের জন্য জাসদ সংসদের ভিতরে ও বাইরে আন্দোলন পরিচালনা করছে। সংসদের ভিতরে আমাদের দলীয় সদস্যগণের উদ্যোগে বিরোধী দলের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। এখানেও জাসদ সাফল্যের দাবিদার। ফ্যাসিবাদকে রোখার জন্য জাস ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন রচনায় বিশ্বাসী এবং এ জন্য বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি ইতিমধ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে কয়েকটি ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন রচনা করা হয়েছে, এই ঐক্যকে কর্মসূচী ভিত্তিক ঐক্য ও আন্দোলনে রূপান্তরিত করার জন্য আমাদের আন্তরিক ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সরকারের গণতন্ত্র বিরােধী ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলার লক্ষ্যে জনগণের এই ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায়ও জাসদ সাফল্যের দাবিদার ক্রমাগত আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৮০ সালে বহু, রাজবন্দীকে আমরা মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। এককভাবে জাসদ বেশ কয়েক টি আন্দোলন পরিচালনা করেছে। বিভিন্ন পেশাজীবী জনগােষ্ঠীর আন্দোলন সংগঠিত করতে জাসদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৮০ সালে বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী জনগণ তাদের স্ব স্ব পেশার দাবির ভিত্তিতে আন্দোলনে এগিয়ে এ আসছিল। এই সকল আন্দোলনে আমাদের সক্রিয়তা ও সম্পৃক্তি আমাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও কর্ম পদ্ধতির সাফল্যকে তুলে ধরে। দেশব্যাপী গণসংযােগের মাধ্যমে সরকারের গণবিরােধী ও ফ্যাসিবাদী চরিত্রকে জনগণের সামনে উন্মােচিত করতে অামরা অনেকটা সফল হয়েছি।
১৯৭২ সনের ৩১ অক্টোবর (জাসদের) জন্মের পর থেকেই জাসদ তৎকালীন সরকারের একনায়কত্বসুলভ ও স্বৈরাচারী ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন করেছে। ৭৪-এর একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে এবং তৎপরবর্তী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সর্বাতন্ত্রক প্রতিরােধ রচনা করতে গিয়ে জাসদের নেতৃত্ব ও সংগঠক ও অসংখ্য কর্মীকে কারাগারে যেতে হয়। অসংখ্য সাথী আন্দোলনের মুখে শহীদ হয়েছেন। জাসদকে প্রতিটি সরকারের রােষানলে পতিত হতে হয়েছে। প্রতিটি সরকারই জাসদকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু কর্মীদের বলিষ্ঠত, আদর্শের প্রতি অনুরাগ ও সক্রিয়তার কারণে জাসদের সংহতি রক্ষিত হয়েছে। নেতৃবৃন্দ কারাগারে থাকা সত্ত্বেও জাসদের এই সাফল্যের কারণ হলাে জাসদের কর্মীবাহিনী যৌথ নেতৃত্বে বিশ্বাসী। যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সংগঠনগতভাবে জাসদ সাফল্যের দাবি রাখে। ১৯৮০ সালে কাউন্সিল অধিবেশন ও জাতীয় সম্মেলন। অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা সাংগঠনিক কেন্দ্রীকতা, আদর্শগত কেন্দ্রীকতা এবং গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা অনুশীলনের লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় নীতিমালা ও নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করতে সফল হয়েছি। নেতিবাচক রাজনীতির বদলে আমরা ইতিবাচক রাজনীতি অনুশীলনে সক্ষম হয়েছি। সংগঠনের মূল আদর্শ ও কর্মসূচীর পরিপন্থীদেরকে আমরা সংগঠন থেকে বাদ দিতে সক্ষম হয়েছি। এভাবে : সংগঠনের অভ্যন্তরে চিন্তার ঐক্য, কর্মপদ্ধতির ঐক্য এবং দৃষ্টিভঙ্গীর ঐক্য অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণে আমরা আপেক্ষিক অর্থে সফল হয়েছি, যার ফলে বর্তমানে। জাসদ সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের মত অনুন্নত পশ্চাদ-পদ পুজিবাদী সমাজে সমাজ বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য বিপ্লবী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর্যায়ে একটি সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন হিসেবে জাসদের যে সব সাংগঠ-নিক কাঠামাে গড়ে তােলা প্রয়ােজন, সেগুলাে গড়ে তােলার কাজে আমরা মােটামুটিভাবে সফলতা অর্জন করছি। বিপ্লবের লক্ষ্যে সংগঠন রচনার আন্দোলনে জাসদ আজ দ্বিতীয় পর্যায়ে উপনীত হতে সক্ষম হয়েছে।
এতসব সাফল্য সত্ত্বেও আমরা কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যর্থতাকে এড়িয়ে যেতে পারিনি। শত চেষ্টা সত্ত্বেও আমরা এখন পর্যন্ত কর্মসূচী ভিত্তিক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন রচনা করতে সক্ষম হইনি। যে গতিতে ১৯৮০ সালে রাজনৈতিক আন্দোলন রচনা করা প্রয়ােজন ছিল, রাজনীতিতে আমরা সেই গতির সল্চার করতে পারিনি। বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রমজীবী জনতার আন্দোলনসমূহকে আমরা সমন্ধিত করে প্রচণ্ড গণ-আন্দোলনের জন্ম দিতে পারিনি, যদিও আন্তরিকতার সঙ্গে বিভিন্ন শােষিত শ্রেণী ও পেশাজীবী জনগণকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা আমরা অব্যাহত রেখেছি।
বিভিন্ন পরাশক্তির লেজুড়বৃত্তিতা থেকে বিরত ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুশীলনরত একটি সংগঠনের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ যেভারে গড়ে তােলা প্রয়ােজন, আমরা সেই অর্থনৈতিক বুনিয়াদ রচনার কাজে পুরােপুরি সফল হইনি। ফলে অর্থনৈতিক অসুবিধার কারণে আমরা প্রয়ােজনীয় সকল সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হচিছ না। আমাদের নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচী প্রচারের জন্য প্রয়ােজনীয় বুকলেট, প্রচারপত্র ও সাহিত্য প্রকাশ এবং দেশব্যাপী তা প্রচার করতে আমরা অতটা সক্ষম হইনি। জাতীয় জীবনের বিভিন্ন সমস্যা ও গুরত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সামগ্রিক তথ্য সংগ্রহ করা এবং তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ দানের কার্যকর পদ ক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছি। কর্মীবাহিনীকে ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দানেও আমরা পুরােপুরী সফল হইনি। জন্মলগ্ন থেকে আন্দোলনরত একটি সংগঠনের কাছে শােষিত নিষ্পেষিত মুক্তিকামী জনতার প্রত্যাশা অনেক। জাসদের কাছ থেকে আন্দোলন রচনার ব্যাপারে জনগণের যে প্রত্যাশা, আমরা বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে ১৯৮০ সালে সেই প্রত্যাশা পূরণের জন্য প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে পুরােপুরি সফল হইনি। একটি রাজনৈতিক সংগঠনের একটি নির্দিষ্ট বছরের কার্যকলাপে সাফল্য পরি মাপ করার মাপকাঠী হওয়া উচিত—ঘোষিত রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য উক্ত সংগঠন বাস্তব পরিস্থিতির আলােকে যথার্থ কর্মসূচী এবং প্রয়োজনীয় সংগঠনিক ও আন্দোলনের পদক্ষেপ গ্রহণে -সচেষ্ট কিনা তার ওপর। এই বিবেচনায় ১৯৮০ সালটি জাসদের নিকট-কর্মসূচী, সংগঠন ও আন্দোলন রচনার ক্ষেত্রে একটি অগ্রগতির বছরই বটে।
এম, এ, জলিল _ সভাপতি
আ, স, ম, আবদুর রব
সাধারণ সম্পাদক
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল
উত্তেজনা সৃষ্টি করে ক্ষমতা দখলের কাজ জামায়াতে ইসলামী করেনা
জামায়াতে ইসলামী শুধু মাত্র একটা রাজনৈতিক দল নয়। এটা একটা আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন, একটা পূর্ণাঙ্গ ইসলামী আন্দোলন। রাজনৈতিক হৈ হাঙ্গামা সৃষ্টি করে, সস্তা শ্লোগান তুলে সরকারকে গালি দিয়ে বক্তৃতার মাধ্যমে উত্তেজনা সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করার মত কাজ জামায়াতে ইসলামী করে না। শালীনতা বজায় রেখে গঠনমূলক সমালােচনার দ্বারা শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে অগ্রসর হওয়াই জামায়াতে ইসলামী পছন্দ করে।
ফলে রাজনৈতিক ময়দানে আমাদের সাফল্যের মাপকাঠি ভিন্ন। দীর্ঘ আট বৎসর অনুপস্থিত থেকে পি, পি, আর উঠে যাওয়ার ও জরুরী অবস্থা অবসানের পর অনেক বিলম্বে মাত্র ৭ মাস আগে প্রতিষ্ঠিত হয়ে জামায়াতে ইসলামী সাবলীলভাবে কাজ করে যাচেছ।
জামায়াতের এ্যাচিভমেন্ট-এর ব্যাপারে আমাদের হিসেবে আমরা ফেব্রুয়ারী মাস হতে বর্ষার পূর্ব পর্যন্ত ঢাকা মহানগর থেকে শুরু করে সকল জেলা, মহকুমা, গুরত্বপূর্ণ থানা সদর ও অন্যান্য গুরত্বপূর্ণস্থানে জনসভা করে জনগণের কাছে জামায়াতে ইসলামীর দাওয়াত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী ও পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে আমাদের কর্মসূচী পেশ করতে পেরেছি। বর্ষার মৌসুমে সাংগঠনিক শৃংখলা বিধান কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও একটা পক্ষ পালনের মাধ্যমে আমরা লক্ষাধিক লােককে সহযােগী সদস্য হিসাবে পেয়েছি।
শুধু ক্ষমতা দখলের চিন্তা না করে দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা – সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে দেশ যে এক নায়কত্বের দিকে অগ্রসর হচেছ- তা বুঝতে পেরে আমরা এ বৎসরের শেষ প্রান্তে-৭ ডিসেম্বর দেশের জন্য একটা সুষ্ঠ রাজনৈতিক পদ্ধতি জাতির সামনে পেশ করেছি।
হঠাৎ ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে ভাঝবেগে আমরা কোন কাজ করছি না। সুষ্ঠ চিন্তাভাবনার মাধ্যমে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এদেশে গণতন্ত্রমনা অাদর্শানুরাগী লােকেরা আমাদের ডাকে সাড়া দিচেছ। কতটুক সাফল্য আমরা এ সময়ে লাভ করতে পেরেছি তা আমাদের বিচার্য নয়। বরং তা বিচারের ভার সচেতন জনগণের উপর।
বছরের গােড়া থেকে একটা সুষ্ঠ পরিকল্পনা ভিত্তিক টারগেট নিয়ে আমরা কাজ শুরু করলেও উক্ত পরিকল্পনার টারগেট পূরণ হয় নি কারণঃ
যেহেতু তার দশটা দলের মত জামায়াতে ইসলামী শুধু মাত্র রাজনৈতিক দল নয়। আবার অন্যান্য ধর্মীয় দলের মতও নয় একটা পূর্ণাঙ্গ ইসলামী আদর্শ বাদী দল হিসাবে জামায়াতকে গ্রহণ করতে উভয় মহলকে যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করতে হয়।
যারা রাজনীতিকে পেশা বা নেশা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং রাজনীতির মাধ্যম নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চিন্তা করেন তারা এতে অাসার উৎসাহ পান না। এ ধরনের আদর্শবাদী প্রতিষ্ঠানে আসতে পারেন যারা নিজেক প্রতিষ্ঠিত করার (অস্পষ্ট) নয় বরং ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেকে বিলীন করতেও প্রস্তুত হন তারাই।
যারা দ্বীন ইসলামকে ধর্মমাত্র মনে করেন এবং ধর্মীয় জীবনের বাইরে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনকে ইসলামী আদর্শের ছাঁচে ঢালাই করতে সাহস পায় না তারাও এতে আসা কঠিন মনে করেন। সুতরাং এতে দলে দলে ভর্তি হওয়া স্বাভাবিক নয়। এর পরেও যারা ঢােকেন ও প্রাথমিক সদস্য হন ট্রেনিং পদ্ধতির কারণে পূর্ণাঙ্গ সদস্য হওয়া অনেকের পক্ষেই আবার সম্ভব হয় না। একটা অ-ইসলামী সমাজে ইসলাম কায়েম করার যােগ্য হওয়ার জন্য যে কয়টি অপরিহার্য গুণাবলী দরকার এই সমাজে তা অর্জন করা বেশ কঠিন।
ব্যর্থতার দ্বিতীয় কারণ, যেহেতু জামায়াতে ইসলামী বর্তমান আর্থ-সামাজিক ব্যবহার অমিল পরিবর্তন চায় সে কারণে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কায়েমী স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লােকেরা এতে সামিল হয় না। তাই সাধারণভাবে নিন্ম মধ্যবিত্ত এবং তার চেয়েও দুর্বল ব্যক্তিরাই বেশি সংখায় সমবেত হয়। যদিও জামায়া- তের প্রতিটি কর্মীকে মাসিক নিয়মিত সাধ্যমত দান করতে হয় তবু সংগঠনের আর্থিক দুর্বলতা থেকেই যায়। সুতরাং, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা জামায়াতের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এই দুর্বলতা আমাদের নিরাশ করতে পারে না।
শামসুর রহমান
সেক্রেটারী জেনারেল
জামায়াতে ইসলামী
আর্থিক কারণে সারা দেশে ন্যাপ (নাসের) সংগঠিত হতে পারেনি
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (নাসের) পূর্ণ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। এই দল মওলানা ভাসানীর আন্তর্জাতিকতা, সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরােধী। শােষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে। বাংলাদেশের রাজনীতি আজ দুই পরা শক্তির প্রভাব অনেকটা কাটিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও অর্থনৈতিক মুক্তির পথে এগিয়ে যাচেছ। ভাসানী ন্যাপ রাজ নৈতিকভাবে ১৯৮০ সালে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনকে বিভিন্ন দল, ব্যক্তি ও জনগণের মধ্যে বিচার করতে সমর্থ হয়েছে। এ দল ঐক্যবদ্ধভাবে ফারাক্কা ও সীমান্ত হামলা প্রতিরােধ কমিটি গঠনের মাধ্যমে সমমনাদের ঐক্য গড়ে তােলা ও সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পথ উন্মুক্ত করতে সমর্থ হয়েছে। সাংগঠনিকভাবে এই দল আর্থিক কারণে সারা দেশে সহস্র সহস্র ত্যাগীকর্মী থাকা সত্ত্বে সুসংগঠিত হতে পারেনি। তবে, শীঘ্রই এই সমস্যা কাটিয়ে সংগঠনিকভাবে এই দল রাজনীতি ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা নিতে পারবে সে বিশ্বা আমরা করি। আবদুস সােবহান
সেক্রেটারী জেনারেল
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (নাসের) বাসদ গড়ে তােলাই সাফল্য।
জাসদের অভ্যন্তরে মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করে ব্যাপক সংখ্যক কর্মী বাহিনীকে শােধনবাদী, সংস্কারবাদী রাজনীতির ধারা থেকে যুক্ত করে সর্বহারা শ্রেণীর বৈপ্লবিক সংগ্রাম ও সংগঠন গড়ে তােলার ক্ষেত্রে আগ্রহ সৃষ্টি ও পদক্ষেপ হিসাবে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল গড়ে তােলাকে আমাদের সাফল্য মনে করি। গত ৭ নবেম্বর ৮০ সালে দল ঘােষণার দশদিন পর আমাদের সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ডাকসু নির্বাচনে জয় লাভ করে। গােটা সমাজব্যাপী যে ব্যক্তি কেন্দ্রীকতা, নীতিহীনতা ও নৈতিকতার অবক্ষয় চলেছে, বিশেষ করে শিক্ষিত যুবসমাজ ব্যাপক হারে যার শিকার হচেছ, সে ক্ষেত্রে ডাকসু সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের বিজয় সাফল্যের আর একটি সংযােজন। কিন্তু সার্বিকভাবে সারাদেশের শ্রমজীবী মেহনতী মানুষের মধ্যে বৈপ্লবিক চেতনা গড়ে তােলা ও পুজিবাদ, ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ বিরােধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সার্বিক অর্থে গড়ে তুলতে না পারা এবং সকল দলের নিষ্ঠাবান, বিপ্লবীমনা কর্মীদের কাছে আমাদের বক্তব্য পৌছাতে না পারাকে আমাদের ব্যর্থতা বলে মনে করি। খালেকুজ্জামান ভুইয়া
আহ্বায়ক
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল
আমরা নীরব ছিলাম
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৮০, সাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় সমৃদ্ধ এ বছরটি। প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলেই নতুন ভাবনা চিন্তা সংযােজিত হয়েছে—সচেতনতার উন্মেষ ঘঠেছে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে। মত বিরােধে ভঙা গড়া সম্পন্ন হয়েছে কিছু দলে–কিছু দলে এর প্রস্তুতি চলছে। বলা যায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জন্য চলতি বছরটি একটি প্রস্তুতির বছর।
১৯৮০ সাল মুসলিম লীগের পূর্নজীবন ও নবজাগরণের বছর। দলের অভ্যন্তরে পরিবর্তনের একটি হাওয়া—সচেতনতার একটি ঢেউ প্রবাহিত হয়েছে। চলতি বছরের শেষার্ধে মুসলিম লীগ তার দীর্ঘ দিনের সীমাবদ্ধতা পরিহার করে এগিয়ে এসেছে। এগিয়ে এসেছে পুরনাে ধ্যান ধারণা অতিক্রম করে। ২৭ নভেম্বর 80 তারিখ বায়তুল মােকাররমের জনসভা ঘােষিত দলের নয় দফা কর্মসূচি এক উজ্জল প্রমাণ। এই কর্মসূচী দেশ ও জনগণের সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তির সনদ বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। উপমহাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে মুসলিম লীগ একটি বহুল আলােচিত ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল। দীর্ঘদিন মুসলিম লীগ ক্ষমতায় ছিলাে। কিন্তু ১৯৪০ সালের পর এবছরই মুসলিম লীগ দলের একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী জাতির সামনে ঘােষণা করেছে। কর্মসূচীতে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে জনগণকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সামাজিক স্বাধীনতা আর নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। উন্নয়নের স্বার্থে এবং প্রশাসন ও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়ােজনে চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ ঘােষণা অন্য তম। এক দলীয় বা স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অঙ্গীকার এবং সকল প্রকার সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল মুক্তিকামী জনগণের মত সংগ্রামকে সমর্থন করা হয়েছে কর্মসূচীতে। এই কর্মসূচীর প্রতিটি দফায় প্রতিটি লাইনে মুসলিম লীগের পরিবর্তিত মানসিকতা আর দৃষ্টিভঙ্গীর স্বাক্ষর বহন করছে। ১৯৮০ সালে জাতীয় রাজনীতিতে আমাদের দলের সফলতা আর ব্যর্থতা সম্পর্কে বলতে গেলে বলা যায় যে, বছর হিসেবে কোন রাজনৈতিক দলের সফলতা আর ব্যর্থতা নিরুপণ করা দুষ্কর। তবে চলতি বছর জাতীয় রাজনীতির অংগন গনগনে ছিলাে । দক্ষিণ তালপট্টিতে ভারতীয় বেআইনী দখল, ভারতে গ্যাস বিক্রির চক্রান্ত, বাংলাদেশের উপর দিয়ে ভারতকে রেল সুবিধা দানের চুক্তি, খুলনা জেলে নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং সর্বশেষ মানুষ হত্যার অবাধ লাইসেন্স উপদ্রুত এলাকা বিল উত্থাপন উল্লেখযােগ্য। মুসলিম লীগ এগুলির গুরত্ব এবং সুদূরপ্রসারী ফলাফল সম্পর্কে উদাসীন ছিলাে না। পত্র পত্রিকায় বিবৃতি সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভা করে আমরা অন্যান্য সচেতন দলগুলির মতাে প্রতিবাদ করেছি। জনমত গঠনে উদ্যোগ নিয়েছি। এ সময় আমরা সর্বাত্মক কোন আন্দোলনে যেতে পারিনি কারণ তখন প্রক্রিয়া পর্ব নিয়ে ছিলাম ব্যস্ত। তবে জাতীয় রাজনীতিতে আমরা বিচিছন্ন ছিলাম না। সংসদে আমাদের দুজন সদস্য জনাব সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জনাব ইব্রাহীম খলিল জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন ইস্যুতে মুসলিম লীগের দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরেছেন। উপদ্রুত এলাকা বিল সম্পর্কে অমুসলিম লীগের সিদ্ধান্ত সংসদে তাঁর নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন।
১৯৮০ সালের প্রথম ছয় মাস আমাদের যুদ্ধে কেটেছে। এই যুদ্ধ ছিলাে পশ্চাদপদ মানসিকতা, মূল্যহীন মূল্যবোধ ব্যক্তি ও স্বার্থকেন্দ্রিক অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে অদম্য স্পৃহা ছিলাে দুর্গন্ধময় ঘর থেকে বেরিয়ে ভােরের নরম সূর্যালােকে অবগাহন করার। আমরা অবগাহন করেছি। এর পরই শুরু হয় বর্তমান রাজনীতির যথাযথ মূল্যায়ন এবং দেশ ও জনগণের মৌলিক সমস্যা অনুধাবনের প্রচেষ্টা। আমরা সফল হয়েছি। সঠিকভাবে আত্মস্থ করতে পেরেছি। এবং পেরেছি বলেই সমাধানের একটি সুপষ্ট চিত্র অংকন করতে পেরেছে মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগ আজ আর কোন ব্যক্তি বিশেষের বা গোষ্ঠীর নয় জনগণের।
এ সময় আমরা তুলনামূলকভাবে নীরব ছিলাম। সাময়িক নীরবতা যদি জাতীয় রাজনীতির বৃহত্তর পরিসরে কোন রাজনৈতিক দলকে ব্যর্থ হিসাবে চিহ্নিত করা হয় তাহলে সে চিহ্ন আমরা গৌরবের সাথেই বহন করবো। আর জাতীয় রাজনীতির অংগনে শুধু মাত্র ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন এবং উদ্দেশ্যহীন পদচারণার পরিবর্তে সুস্পষ্ট কর্মসূচীর ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছার পথ তৈরী করতে পারাটা যদি কোন রাজনৈতিক দলের সাফল্য হিসাবে আখ্যায়িত করা হয় তাহলে মুসলিম লীগ সে গৌরবময় সফলতার দাবীদার। মুসলিম লীগ জনগণকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাে। জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা আর মুক্তির প্রতীক ছিলাে মুসলিম লীগ। দীর্ঘ সংগ্রামের পথ অতিক্রম করে পুনরায় এ দলটি জনগণের কাছে ফিরে এসেছে। বিলুপ্তির পথ থেকে, অন্ধকার বিবর থেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিকে আলাের পথে উত্তরণ করেছে মুসলিম লীগ এ বছর। আগামী দিনে জাতীয় রাজনীতিতে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাবার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে মুসলিম লীগ। তাই চলতি বছরের রাজনীতিতে মুসলিম লীগ উল্লেখযােগ্যভাবে সাফল্যলাভ করেছে।
বি, এ, সিদ্দিকী
সভাপতি
মুসলীম লীগ
যা পারিনি তাই ব্যর্থতা
রাজনৈতিক দলের কর্মই তার স্থান নির্ধারণ করে। একটি রাজনৈতিক সংগঠনের সাফল্য বা ব্যর্থতা বিচার করার ভার দেশের জনসাধারণের। ১৯৮০ সালে আমাদের দল ডেমােক্র্যাটিক লীগের ভূমিকা দেশবাসীর চোখের সামনেই রয়েছে, সংবেদনশীল দৃষ্টিভংগী নিয়ে জনতার অব্যক্ত মনােভাব বুঝবার চেষ্টা করলেই দলের সাফল্য সম্পর্কে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে। একটি রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমকে তখনই সফল বলা যায় যখন সে দল জনতার প্রত্যাশাকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে পারে এবং শত বৈরিতা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও জনতার কাছে যেতে পারে। সে মাপকাঠির দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে আমি নির্দ্ধিধায় বলতে পারি যে একটি সফল বছর অতিক্রম করছি আমরা। ১৯৮০ সালের ঘটনা প্রবাহকে বিচার করার জন্য খানিকটা পেছন ফিরে তাকান দরকার। ১৯৭৬ সালে এদেশবাসীর স্নেহধন্য হয়ে এদল জন্মলাভ করেছিল। জন্মের মূহুর্তেই এদল নিকট অতীতের এক ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতির উত্তরাধিকারী ছিল। সে প্রতিশ্রুতি, সার্ব ভৌম পার্লামেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ভেজাল সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ১৯৭৫ এর ৩রা অক্টোবর লায়লাতুল কদরে জাতিকে যে অঙ্গীকার আমি করেছিলাম। ১৯৭৫ এর ৭ই নবেম্বরে সিপাহী-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত, আহ্বান সত্ত্বেও আমি রাষ্ট্রপতির পদে পুর্নবার অধিষ্ঠিত হইনি, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পবিত্র ইচছা ও জনতার অপাপবিদ্ধ প্রত্যাশা পরিপূরণের বৃহত্তর স্বার্থে ‘বুলেটের চেয়ে ব্যালটের’ পথকে গনতান্ত্রিক পথ হিসেবে গ্রহণ করে যথাসময়ে পার্লামেন্ট নির্বাচনকে অনুষ্ঠান করার লক্ষ্যে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নিকট রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার অর্পণ করে ছিলাম। রাষ্ট্রপতি থাকাকালে জনতার মহান প্রত্যাশা আর যুগ যুগের লালিত মূল্যবােধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে যে অঙ্গীকার আমি করেছিলাম, ক্ষমতা থেকে বহু, যােজন দূরে জনতার কাতারে দাঁড়িয়েও সে অঙ্গীকার পরিপূরণের লক্ষ্যে ডেমােক্রেটিক লীগ ও আমি আমাদের সীমিত ভূমিকা পালন করেছি।
এই ঐতিহাসিক পটভূমিকাতেই ১৯৮০ সালে ডেমােক্র্যাটিক লীগের কার্যক্রমকে বিশ্লেষণ করতে হবে। না হয় সেটা হবে খন্ডিত ও অপূর্ণ বিশ্লেষণ। জন্মের পর মূহুর্তে থেকেই যে প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে ডেমােক্রেটিক লীগকে অগ্রসর হতে হয়েছিল, যে নির্যাতন বরণ করতে হয়েছে তা আর কোন সংগঠনের বেলায় কখনও ঘটেছে কিনা আমার জানা নেই। ২ মাস ৬ দিন যখন ডেমোক্রেটিক লীগের বয়স তখন আমি কারান্তরালে নিক্ষিপ্ত হই প্রায় ১৪ মাস আমাদের দলকে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়, হুমকি আর প্রলােভনের জাল বিস্তার করে দলকে করা হয় বিপর্যস্ত। প্রলােভন দেখিয়ে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি আমাদের দলের অনেক কেই নিজের দলে ভিড়িয়েছে, ভয়ভীতির দরুন অনেকেই নিশ্চুপ হয়ে গেছে। আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ শাহ মুয়াজ্জেম হোসেনকেও একবার আমার সাথে গ্রেফতার করে। দল নিষিদ্ধ করার পূর্বে আবারও তিনি কারারুদ্ধ হন। ১৪ মাস আমাদের দল নিষিদ্ধ ছিল। এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আমরা হাইকোর্টে রীট আবেদন করি। শেষ শুনানীর পূর্বমূহুর্তেই এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। কিন্তু প্রায় দেড় বৎসর ডেমােক্র্যাটিক লীগ অফিসে সরকারী তালা লাগান ছিল। এত প্রতিবন্ধকতা, বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও ডেমােক্র্যাটিক লীগের নেতা ও কর্মীরা হতােদ্যম হয়নি। আমার কারারান্তরালে থাকাকালীন প্রায় চার বছর ডেমােক্রেটিক লীগের নেতা ও কর্মীরা হৃদয়ের গহীনে যে বেদনার উত্তাপ অনুভব করেছেন সে উত্তাপের নিঃসরণ তাদের সম্মুখযাত্রায় তীব্রভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে, জনগণের আরও কাছাকাছি যাবার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছে। সে পথেই ১৯৮০ সালে ২৬শে মার্চ আমার কারামুক্তি ঘটে। ১৯৮০ সালেও আমরা নতুন কথা বলিনি। ১৯৭৫ সালের ৩রা অক্টোবর রাষ্ট্রপতি হিসেবে যে অঙ্গীকার আমি করেছি, ১৯৭৬ সালে যে অঙ্গীকার পরিপূরণের লক্ষ্যে ডেমােক্রেটিক লীগ দৃপ্ত শপথ নিয়েছিল, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ প্রায় চার বছর পাড়ি দিয়ে একই লক্ষ্য অর্জনের পথ আপােষহীনভাবে আমরা এগিয়েছি। এটাই আমাদের সাফল্য। এপ্রিলের শেষে চার দিন ব্যাপী ডেমােক্রেটিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভায় আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ঘটমান বাস্তবতার নিরিখে সপষ্ট প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।
আপনাদের মনে আছে, গত ২৩শে মে বায়তুল মােকাররমের বিশাল জনসভায় ঘাতকের মরণ ছােবলকে উপেক্ষা করেও আমরা লিখিত বক্তব্য দেশবাসীর সামনে পেশ করেছিলাম। ১৯৮১ সালের ২৮শে ফেরুয়ারীর মধ্যে সার্বভৌম পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী জানিয়েছি। কোটি কোটি জনতার ইচছার প্রতিধবনি করেই এ দাবী আমি করেছি। আমার এই দাবির পর পরই প্রায় সব কয়টি বিরােধী রাজনৈতিক দল অনরুপ দাবী করেছেন। পথসভা ও কর্মীসভা বাদ দিয়ে আমি এ যাবৎ দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা সদরে ২৫টি জনসভায় বক্তব্য পেশ করেছি। প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির স্বৈরশাসন অথবা শাসনতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র (Constitutionalised-Dictatorship) থেকে মুক্ত হয়ে সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্য জনতার উদ্বেল আকাঙ্ক্ষা আন্দোলনের রুপে পরিগ্রহ করছে অত্যন্ত তীব্র গতিতে। আর কোন সাফল্যের দাবীদার আমরা নই। একটি উন্নয়নশীল দেশে সিস্টেমের প্রতি জনসাধারণের আন্দোলনমূখী সচেতনতা সৃষ্টিতে আমরা যতটুকু সফলতা অর্জন করতে পেরেছি—সেটাই আমাদের সাফল্য। পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে আমরা সুষ্ঠ বক্তব্য রেখেছি। তৃতীয় বিশ্ব ও মুসলিম বিশ্ব থেকে বর্তমান সরকার যে বিচিছন্ন হয়ে বন্ধহীন হয়ে পড়েছে তার মারাত্নক পরিণতি সম্পর্কে হুশিয়ার করে দিয়ে করণীয় কর্তব্যও দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছি। আফগানিস্তানে পরাশক্তি রাশিয়ার আগ্রাসনকে ভূমন্ডলীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে প্রতিরােধ করা এবং মুসলমানদের প্রথম কাবা পবিত্র জেরুজালেমকে ইহুদী কবলমুক্ত করা যে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির অবিচেছদ্য বিষয় হওয়া উচিত সে বক্তব্য আমরা রেখেছি। ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ ইরান-ইরাকের আত্নঘাতী -যুদ্ধের অবসান কামনা করে আমরা যুদ্ধরত দেশ ও ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশ ও বিশ্ববিবেকের কাছে আবেদন জানিয়েছি। ফারাক্কা, দক্ষিণ তালপট্টি ও পূর্ব ভারতের বিদ্রোহ সম্পর্কিত আমাদের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। দীর্ঘদিন ধরে উপমহাদেশীয় ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে আমরা সচেতন দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। সাবধানবাণী উচচারণ করেছি সরকারের উদ্দেশ্য। ভারতীয় রাজ্যসভায় ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন
‘বাংলাদেশ তার মাটির উপর দিয়ে ভারতের উত্তর পূর্ব রাজ্যে সরাসরি যােগাযােগ প্রতিষ্ঠায় নীতিগতভাবে রাজী হয়েছে’। আজ আমাদের আশংকা ও সাবধানবাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত। সরকারের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে জাতীয়করণের সর্বনাশা নীতি প্রত্যাহার করে পুজি বিনিয়ােগ ও দ্রুত শিল্প বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি তথা মুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করার নীতি আমরা ঘােষণা করেছি। সবচেয়ে বড় কথা হচেছ পররাষ্ট্রনীতি থেকে অর্থনীতি পর্যন্ত সর্ববিষয়ে সচেতন জনসাধারণের নিকট আমরা গুণাগুণ বিচারের বিতর্ক সৃষ্টি করতে পেরেছি। আমাদের বক্তব্যের স্বপক্ষে জনতার সমর্থন অর্জন করতে পেরেছি। জনতার সুর আর ডেমােক্রেটিক লীগের কথা আজ এক ও অভিন্ন। এর চাইতে বেশী পাওয়া কি হতে পারে ?
নিঃসংকোচে একথাও স্বীকার করব আমাদের জনগণের অধিকার আদায়ের অভিযাত্রায় আমাদের ব্যর্থতার তালিকাও হয়ত কম নয়। গবেষক আর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা যথাসময়ে তা নিরুপণ করবেন। যা পারিনি তাই আমাদের ব্যর্থতা– একথা স্বীকার করতে কোন অগৌরব নেই। কিন্তু আমরা সচেতন, ব্যর্থতার গ্লানি আমাদেরকে আচছন্ন করতে পারে না। ক্ষমতাসীনের ভ্রুকূটি, প্রচার মাধ্যমের অভাব, অর্থসংকট সহ নানা প্রতিকূলতার প্রেক্ষিতেই আমাদের ব্যর্থতাকে বিচার করতে হবে। সঙ্গীনের মুখে থরে থরাে গণতান্ত্রিক মূল্যবােধকে প্রতিষ্ঠিত করার মহান ব্রতে আমরা অকুতােভয়—নববর্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ডেমােক্রেটিক লীগের যে কোন কর্মী এ নির্ভীক উচচারণ করার সাহস রাখে।
খন্দকার মােশতাক আহমাদ
সভাপতি
ডেমােক্রেটিক লীগ
বাকশাল বিরােধী আন্দোলন তীব্র করে তােলা যায়নি
১৯৮০ সালে কৃষকদের সংগঠিত করার ব্যাপারে আমরা অধিকতর সফল হয়েছি। পুরনাে এলাকা আরও সংগঠিত হয়েছে। নতুন এলাকায় নতুন সংগঠন হচছে। ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লা ও বরিশাল হচেছ পুরনাে এলাকা। বগুড়ার জয়পুরহাট এবং কুষ্টিয়াতে কৃষকদের নতুনভাবে সংগঠিত করা হয়েছে। কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানায় শঙ্খ নদীর চরে প্রায় ২০০ বিঘা খাস জমি দখল করা হয়েছে। চকরিয়া থানায় ১৬ বিঘা খাস জমি কৃষকরা নিজেরা চাষ করে। কিন্তু জোতদাররা সে সব জমি দখল করে। পরে কৃষকরা সংগ্রাম করে সেগুলাে পুনর্দখল করে। রাজশাহীতে নওগাঁ পত্নিতলা এলাকায় প্রায় ৬০ বিঘা খাস জমি দখল করা হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ দফা দাবীর সংগ্রাম _ ব্যাপক ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ হয়। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের ন্যায্য সংগ্রাম সাফল্য অর্জন করে। এসব ক্ষেত্রে ছাত্র সংগঠনের মধ্যে পার্টির কর্মীরাই চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। নােয়াখালী জেলায় অস্ত্র উদ্ধারের নামে আমাদের কর্মীদের হুমকি দেয়া হয়। এই হয়রানীর বিরদ্ধে কয়েক হাজার লোকের গণমিছিল মহকুমা প্রশাসকের অফিস। ঘেরাও প্রভাত সরকারের উক্ত প্রচেষ্টাকে সাময়িকভাবে তুলে নিতে এবং ব্যাহত করতে সমর্থ হয়েছে।
রাজশাহী জেলে রাজবন্দীদের সংগ্রামে আমাদের কমরেডদের ভূমিকা ছিল। উল্লেখযােগ্য। তা বর্তমান সরকারের চরিত্র তুলে ধরতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। খুলনা জেলহত্যার প্রতিবাদে খুলনায় আঞ্চলিকভাবে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে আমরা সফল হয়েছি।
পার্টি থেকে বিভিন্ন সময়ে বিচিছন্ন প্রকৃত মার্কসবাদী লেনিনবাদীদের একটি কেন্দ্রে ঐক্যবদ্ধ করার ব্যাপারে এগিয়ে যেতে আমরা অনেকখানি সফল হয়েছি। আমাদের দলের সঙ্গে আরও দুটো, মার্কসবাদী লেনিনবাদী সংগঠন (বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (মাঃ লে) এবং কমিউনিস্ট লীগ (মাঃ লে) কে নিয়ে ঐক্য কংগ্রেস করার জন্য একটি প্রস্তুতি গঠনে আমরা সফল হয়েছি। বামপন্থী ছাত্র সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী নামে একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে তােলার ব্যাপারে আমাদের চিন্তা বাস্তবরুপ লাভ করেছে জাতীয় ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় ছাত্রদল (ঢালী), বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন, জাতীয় ছাত্রদল (কামাল), ছাত্রলীগ (তাজুল) এই মৈত্রীতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
চারটি কৃষক সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি কৃষক সংগঠনে পরিণত করার প্রাথমিক প্রতি এর মধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। এগুলাে হলাে বাংলাদেশ চাষী সামিতি, বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন এবং কৃষক মৈত্রী সমিতি। মার্চ মাসের মধ্যেই জাতীয় কৃষক সম্মেলনের মাধ্যমে এই প্রয়াস পরিপূর্ণতা লাভ করবে আশা করি।
রুশ সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের প্রতিক্রিয়াশীল আগ্রাসী চরিত্র উন্মােচন করার ক্ষেত্রে আমাদের প্রচার আন্দোলন গুরত্বের দাবী রাখে। গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবী কৃষক আন্দোলন তােলার ক্ষেত্রে আমাদের রণনৈতিক পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও আমরা প্রয়ােজনীয় অগ্রগতি সাধনে ব্যর্থ হয়েছি। গড়ে তোলার পরিকল্পনা থাকা সরকারের গণবিরােধী ও জাতীয় স্বার্থবিরােধী নীতি ও কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সময়মত ও উপযুক্তভাবে শক্তিশালী গণসংগ্রাম সংগঠিত করতে পারিনি। রুশ-ভারতের বিরদ্ধে সংগ্রামের উপর জোর থেকে যাওয়ার দরুন বাকশাল বিরােধী আন্দোলন তীব্র করে তোলা যায় নি। ফলে বর্তমান মার্কিন ঘেষা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনও তেমন তীব্র করা যায় নি।
১৯৮০ সালের পূর্বেই আমরা জাতীয় পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে সামন্তবাদের সঙ্গে কৃষক জনতা তথা সমগ্র জনগণের দ্বন্দ্বকে মুখ্য দ্বন্দ্ব হিসাবে মূল্যায়ন করেছি। এই মূল্যায়নে সম্রাজ্য বাদ, সম্প্রসারণবাদ, সামন্তবাদ, আমলামুৎসুদ্দী পুজির স্বার্থ রক্ষক ক্ষমতাসীন সরকারই প্রধান লক্ষ্যবস্তু এবং সামন্তবাদ বিরােধী সংগ্রামকে প্রধান ভিত্তি করেই এ সংগ্রাম অগ্রসর হবে। কিন্তু আমাদের প্রচার আন্দোলনে ক্ষমতার প্রত্যাশী বাকশালীরাই প্রধান লক্ষ্যবস্তু হিসাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তার একে কাজে লাগিয়ে জিয়া সাহেবের বাকশাল বিরােধীতার ভাওনবাজী জনগণকে বিভ্রতি করতে সাহায্য করেছে। বেশ কিছু দোদুল্যচিত্ত সুবিধাবাদী চরিত্রের বামপন্থীরা বাকশাল বিরােধীতার নামে বিএনপিতে ঢোকার পথ করে নিতে সমর্থ হয়েছে। রুশ সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী প্রচার আন্দোলনের জোয়ারে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী প্রচার আন্দোলন শক্তিশালী করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। শ্রমিকদের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন গড়ে তােলার ব্যাপারে আমরা এখনও সফল হইনি। যদিও এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জোর প্রচেষ্টা আমরা চালিয়ে যাচিছ।
নগেন সরকার
সভাপতি
সাম্যবাদী দল (মাঃ লেঃ )

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1980.12.26-bichitra.pdf” title=”1980.12.26 bichitra”]