রাজাকাররা তাদের ভূমিকা অনুযায়ীই ইতিহাসে চিত্রিত হবে
হাসান হাফিজুর রহমান | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৬ নভেম্বর ১৯৭৯
সাক্ষাৎকার
হাসান হাফিজুর রহমান কবি সাংবাদিক ও প্রবন্ধকার এ পর্যন্ত তাঁর ২০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
তার সাংবাদিকতার শুরু দৈনিক ইত্তেহাদের সহকারি সম্পাদক হিসেবে, ১৯৫৭ সালে। ৫৭ থেকে ৬৩ পযর্ন্ত তিনি ঢাকা জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। ৬৪ সালে তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানের সহকারী সম্পাদক হিসেবে আবার সাংবাদিকতা পেশায় ফিরে আসেন। বাংলাদেশ স্বাধীন …হওয়ার পর ৭২ সালে দৈনিক বাংলার সম্পাদক নিযুক্ত হন। এই পদে তিনি ৭৩ সাল পযর্ন্ত ছিলেন। এরপর ৭৩ থেকে ৭৪ সাল পর্যাপ্ত মস্কো দূতাবাসে প্রেস কাউন্সিলার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ৭৬-৭৭ সালে তিনি ‘সমকালের’ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঐ বছরই তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পে প্রকল্প কর্মাধ্যক্ষ হিসেবে যােগ দান করেন। আজ পর্যন্ত তিনি এই পদেই অধিষ্ঠিত রয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে আধুনিক কবি ও কবিতা (প্রবন্ধ, ৬৭), অন্তিম স্বরের মতো (কাব্য; ৬৮) অন্তিম শব্দাবলী (কাব্য, ৬৮), যখন উদ্ধত সঙ্গীন (কাব্য ; ৭২); বিমুখ প্রান্তর (কাব্য, ৭৪), আলােকিত গহবর (প্রবন্ধ; ৭৭) বজ্রেচেরা আঁধার (কাব্য, ৭৬), আরাে দুটি বৃত্ত (গল্প; ৭০) ইত্যাদি।
সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতি স্বরুপ তিনি ৬৭ সালে লেখক সংঘ পুরষ্কার, ৬৮ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, ৭২ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার ও ৭৭ সালে সুফী মােতাহার হােসেন সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
প্রশ্নঃ ইতিহাস রচনা প্রসঙ্গে ডঃ নিহার রঞ্জন রায় ঢাকাতেই বলেছিলেন—একটি জাতির ইতিহাস রচনা করার জন্য সমসাময়িক কাল থেকে চল্লিশ বছরের ব্যবধন প্রয়ােজন। এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
উত্তরঃ ডঃ নিহার রঞ্জন রায়ের এটি একক বক্তব্য নয়। এটি একটি সাধারণ বক্তব্য। সমসাময়িক ঘটনার নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ প্রায় অসম্ভব! কারণ এই ঘটনার সঙ্গে প্রত্যেকেই কোন না কোন ভাবে জড়িত। ইতিহাস যিনি রচনা করবেন, তার মনেও এ ধরণের একটি প্রভাব থেকে যেতে পারে। তাই ঘটনা থিতিয়ে যাওয়ার পরই ইতিহাস রচিত হওয়া উচিত। তবে সমসাময়িক কালেই নথি-পত্র রক্ষিত হওয়া উচিত। তা না হলে ঐতিহাসিককে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হয়। যেমন ধরুন কার্ল সেন্ড বার্গ ৬ খন্ডে আব্রাম লিংকনের জীবনী রচনা করেছেন। তিনি তার জীবনের অনেক নথি-পত্রই পাননি। যদি পেতেন, তা হলে তার জীবনী রচনা করা সেন্ডবার্গের পক্ষে আরাে সহজ হতো। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে নথি-পত্রের যে কত বেশি প্রয়োজন তা আগের তুলনায় অনেক বেশি স্পষ্ট। তাই ঐতিহাসিক প্রয়ােজনেই বৃটিশ মিউজিয়াম, কমনওয়েলথ সেন্টার আরাে পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় লাইব্রেরীতে অত্যন্ত যত্ন সহকারে এই সমস্ত নথি-পত্র রক্ষিত হচেছ। ইতিহাস কখন রচিত হবে, সমসাময়িক কালে এটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচেছ ইতিহসের উপাদান সংগ্রহ করা। আমরা তাই করছি। অথচ এ সমস্ত উপাদান সংগ্রহের প্রতি আমরা আগে লক্ষ্য রাখিনি। ফলে অনেক প্রয়োজনীয় তথ্যই অবলুপ্তির পথে। যেমন তাজউদ্দীন, মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ; কামরুজ্জামান আরাে অনেকের বস্তুব্য ধরে রাখা হয়নি। খুজলেও হয়ত এখন আর তাদের বক্তব্য পাওয়া যাবে না। তাদের বক্তব্য তৎক্ষণাৎ রক্ষিত হওয়া উচিত ছিল।
প্রশ্নঃ কি ধরনের অঙ্গীকার নিয়ে আপনারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা শুরু করেছেন? তা কত দূর এগিয়েছে ? উত্তরঃ আমাদের মূল উদ্দেশ্য তথ্য সংগ্রহ, তা যতই বিচিত্র কৌণিক হোকনা কেন। আমাদের ধারণা, কিছু, বিরোধী লােক ছাড়া প্রায় সকলেই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ ভূমিকা সম্পর্কে আমরা জানতে চাই। আমাদের অঙ্গীকার বস্তু নিষ্ঠ ও তথ্য নির্ভর ইতিহাস রচনা। এজন্য এ বিরুদ্ধবাদীদের ভূমিকা সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করছি। গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে দলিল-পত্র, বক্তৃব্য সত্যায়নের মাধ্যমে সংগ্রহ করছি।
এ পর্যন্ত ৩ লাখ পৃষ্ঠারও অধিক দলিল পত্র সংগ্রহ করেছি। আমরা এ নিয়ে ১৫টি ভ্যলুম প্রকাশ করবো, প্রতিটির গড় পৃষ্ঠা সংখ্যা হবে ৬০০। ১৪টি হবে খসড়া প্রামান্য দলিল পত্র নিয়ে প্রকশিত গ্রন্থ আর ১৫তমটি হবে ইতিহাস। প্রামান্য দলিল পত্র নিয়ে ১৪টি ভ্যলুম ছাপা হওয়ার পর আলােচনা-সমালােচনা হবে। বিতর্ক হবে। আরাে তথ্য আমরা পাবাে। জনসাধারণের কাছ থেকে আমরা এ খসড়া ইতিহাসের উপাদানের সংযোজন ও সংশোধন আশা করি। এর পরবর্তী অবস্থায় সে সমস্ত তথ্য নিয়ে প্রতিটি খসড়া ভাল্যুমের এক বা একাধিক পরিশিষ্ট গ্রন্থ প্রকাশিত হবে। এর পরই অামরা ইতিহাস রচনায় হাত দেবাে। কাজটি সময় সাপেক্ষ। ইতিহাসকে বস্তুনিষ্ঠ, তথ্যনির্ভর ও নিরপেক্ষ হতে হলে সময়ের দুরত্ব দরকার। আমাদের কাজ শেষ হওয়ার পরও আমরা একে সাময়িক বলবাে। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পরও থেকে যাবে তিন লক্ষাধিক ডকুমেন্ট। সেগুলাের পরও নতুন তথ্য আসবে। এরপরও আরো ইতিহাস আলোকপাত করার সম্ভাবনা থাকবে।
প্রশ্নঃ একজন লেখক, কবি ও সাংবাদিক হিসেবে আপনি কি ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে কোন বৈপরীত্যের সম্মুখীন হয়েছেন?
উত্তর : প্রায় প্রত্যেক লেখকেরই দেশের বাস্তবতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মানসিক যোগ থাকে। ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সেই বাস্তবতারই একটি সাংগঠনিক দায়িত্ব এসে পড়েছে আমার ওপর। এখানে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সংগ্রহের কাজটি অনেকাংশে কর্মীর কাজ। দেশের প্রতি যে ভালােবাসা, তা-ই কর্মপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে। যদিও এব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা না থাকারই কথা। কবি হিসেবে আমার যে নিজস্ব মনােভঙ্গি বা আবেগ, এ কাজের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা থাকার কোন প্রশ্ন ওঠে না। কারণ কাজটি অবেগের নয়। এখানে তথ্য আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। তথ্য আমরা নিয়ন্ত্রণ করছিনা। এখানে নায়ক আমি বা আমার সহকর্মীরা নন। নায়ক মুক্তিযুদ্ধ স্বয়ং। তবে সাংবাদিক হিসেবে অামার যে পূর্বাভিজ্ঞতা , তা এখানে কিছুটা কাজে লেগেছে। কাজে লেগেছে এজন্য যে সাংবাদিকদেরও তথ্যের অধীনে কাজ করতে হয়। তারা নিজেরা তথ্য নির্মাতা নন। বিশেষ ভাবে একাজে, আমাকে একটি মূল্যবােধ সব সময় জাগ্রত রাখতে হয়, তা হচেছ নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতার মূল্যবােধ। এটা মুক্তি যুদ্ধের প্রকৃত স্বরুপের কাছে আনুগত্য ছাড়া কিছু নয়।
প্রশ্নঃ মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাসে রাজাকার-আলবদর আরাে অন্যান্য বিরুদ্ধবাদীদের ভূমিকা কি রুপ হবে ?
উত্তর : সে সময়ে রাজাকার, আলবদররা যে ভূমিকা পালন করেছে, সে ভাবেই ইতিহাসে তারা আসবে। আমরা সে ভাবেই তথ্য সংগ্রহ করছি।
প্রশ্নঃ বর্তমানে যারা রাজনৈতিকভাবে অবাঞ্ছিত অথচ মুক্তি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন, তাদের স্থান কিভাবে নির্ধারিত হবে?
উত্তরঃ আমরা যে সময় পর্যন্ত ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করছি, তার সময় কাল ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত। বর্তমানে কার কি অবস্থা, তা দেখার সুযোেগ আমাদের নেই। তা আমরা দেখছিও না।
১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত যার যে ভূমিকা থাকুক না কেন পক্ষে-বিপক্ষে দেশে বিদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে বা ব্যক্তিগত ভাবে, সাংগঠনিক বা দলীয়, রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক; মানবিক বা অমানবিক, যে ধরনের তথ্যই আমরা পাইনা কেন, তা সংগ্রহ করছি। প্রাথমিক অবস্থায় ইতিহাস রচনার প্রকল্পটির সময় সীমা তিন বছরের। প্রয়ােজন হলে আরাে দু বছর বাড়ানাে হবে। পরে এই প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধের দলিল পত্রের আর্কাইভ হিসেবে থেকে যেতে পারে।