হোয়াইট হাউসের বছরগুলো | হেনরী কিসিঞ্জার | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৬ নভেম্বর ১৯৭৯
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন নোবল বিজয়ী পররাষ্ট্র সচিব হেনরী কিসিঞ্জার তার স্মৃতিকথা লিখেছেন।
এতে কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি এ্যাফেয়ার্স’ সহকারী এবং পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে আট বছরের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন।
এ গ্রন্থে ১৯৬৮ সালের নবেম্বর থেকে ১৯৭৩ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ঘটনা এবং সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বর্ণিত হয়েছে।
কিসিঞ্জার লিপিবদ্ধ করেছেন কূটনীতির অনূদ্ঘাটিত তথ্য। এতে রয়েছে গণচীনের প্রতিষ্ঠার ২২ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বরফ গলার কাহিনী ২৯ বছর দীর্ঘ ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তির ঘটনা।
শাটল কূটনীতির জনক-কিসিঞ্জার মূল্যায়ন করেছেন তার সময়ের বিশ্বের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নেতাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলােচিত প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মূল্যায়নও তিনি কলেছেন।
বিশ্বের কূটনীতির ইতিহাসে পিকিং-ওয়াশিংটন যৌথ ইশতেহার এবং ভিয়েতনাম-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি উল্লেখযােগ্য ঘটনা বলে চিহ্নিত হবে। পিকিং-ওয়াশিংটন যৌথ ইশতেহারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এতে অন্যান্য যৌথ ইশতেহারের মত মতৈক্য লিপিবদ্ধ হয়নি। লিপিবদ্ধ হয়েছে মতানৈক্যের বিষয়গুলাে। আর এ যৌথ ইশতেহারের খসড়া প্রণয়ন করেন পঞ্চশীলা নীতির অন্যতম প্রণেতা চৌ এন লই। কূটনীতির অনুদ্ঘাটিত এসব তথ্য এমন বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত এবং ঘটনার অভিনবত্ব এমন ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর যে কিসিঞ্জারের স্মৃতিকথা রহস্যোপন্যাস বলে ভ্রম হয়। আসলেই ঘটনা গল্পের চেয়েও আশ্চর্যজনক।
কিসিঞ্জারের এই গ্রন্থটি সাপ্তাহিক ‘টাইম’ তিনটি সংখ্যায় (ভলিউম ১১৪ নং ১৪, ১৫, ১৬) সংক্ষিপ্তাকারে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছে। টাইমের জন্য এর সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন সহকারী ব্যবস্থাপক সম্পাদক রেনাল্ড প্রি ক্রিস। তাঁকে সহায়তা করেছেন টাইমের প্রধান প্রতিবেদক-গবেষক বেটি স্যাটারহােয়াইট সাটার। তিনি টাইমের চৌদ্দজন রিসার্চ লাইব্রেরিয়ানের সহায়তা নেন একাজে।
ক্রিস বলেছেন, “কি বাদ দেয়া যায় তা বের করাই ছিল কঠিন সমস্যা। প্রত্যেকটি ঘটনাই এমনভাবে ঢােকানাে হয়েছে যে তা পুরো বইটি জুড়ে জালের মত ছড়িয়ে আছে। তার এই কঠিন কজে সহায়তা করেন একজন অতি যােগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি-স্বয়ং কিসিঞ্জার।
আমাদের বিশ্বাস এর অনুবাদ অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের কৌতূহল নিবৃত্ত করবে। ইনার কলামে টাইমের (এবং বিচিএারও) সম্পাদকদের মন্তব্য লিপিবদ্ধ হয়েছে। কিসিঞ্জারের এ বইটি প্রকাশ করেছে লিটল, ব্রাউন প্রকাশনা সংস্থা। মুল্য ২২.৫০ ডুলায়।–অনুবাদক ।
ক্ষমতার আহবান
অভিষেক হলাে এক ঠান্ডা দিনে। অনুষ্ঠানে নতুন মন্ত্রিসভার ঠিক পিছনে বসে আমি দেখছিলাম ‘হেইল টু দি চীফ’ গানের সুরে সুরে লিণ্ডন বি জনসন লম্বা লম্বা পা ফেলে মেনে আসছেন। জনসনকে লাগছিল খাঁচায় আবদ্ধ ঈগলের মত গর্বিত ও অভিজাত। চোখ তাঁর এমন এক স্থানে নিবদ্ধ যেখানে তিনি আর পৌঁছতে পারবেন না।
একটু পরে নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এলেন। তাঁর চোয়াল দুটি দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ, বিজয়ের উল্লাস তখনও চোখে-মুখে লেগে। মনে হচ্ছে ক্লান্ত ও বিজয়ী এক ম্যারাথন প্রতিযােগী। বােঝা যাচ্ছিল না নিক্সন কি উপভােগ করছিলেন অনুষ্ঠানটি, না অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে আগের(অস্পষ্ট) কল্পনা।
আমি কেন ঐ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম তা ভেবে আমি নিজেই অবাক। কারণ আমার রাজনৈতিক বন্ধুরা ছিল নিক্সনের ঘােরতর বিরােধী। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি দশ বছর ধরে শিক্ষকতা করেছি। সেখানে নিক্সন বিরােধিতাই ছিল দস্তুর। এবং আমার জীবনে একমত যে লােকটি আমাকে প্রভাবান্বিত করেছেন তাকে দু বার নিক্সন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার প্রতিযােগিতায় পারাজিত করেন।নাম তার নিক্সন রকফেলার।
একই পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া ব্যক্তিগত ঈর্ষাও রকফেলার এবং নিক্সনের শত্রুতার কারণ ছিল ।নিক্সন মনে করতেন রকফেলার প্রেসিডেন্ট হলে এসব কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে পারবে না এবং তখন এমেচারদের মত সবকিছু নষ্ট করে ফেলবে। আর রকফেলার মনে করতেন নিক্সন দূরদৃষ্টিহীম এবং আদর্শবিহীন সুবিধাবাদী।
নিক্সন এর বিরুদ্ধে আমার হাতে কোন যুক্তি প্রমাণ না থাকলেও ১৯৬৮ সালে তাঁর সম্পর্কে আমিও তাই ভাবছিলাম। রকফেলার যে সাংবাদিক সম্মেলনে নিক্সনকে কিছু সুবিধা দিয়েছিলেন আমি তাতে উপস্থিত ছিলাম। রকফেলার এর কাজে আমি মর্মাহত হয়েছিলাম ।
কয়েক মাস পর নিক্সন তখন সবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। নিউ ইয়র্কে আমি গভর্নর রকফেলার এবং তার কয়েক জন উপদেষ্টার সঙ্গে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম। নিক্সন রকফেলারকে মন্ত্রণা পরিষদের কোন পদ দিতে চাইলে তা কিভাবে নেওয়া হবে সে বিষয়ে আমরা আলোচনা করছিলাম। এমন সময় নিক্সন এর এ্যাপোয়েন্টমেন্ট সেক্রেটারি ভোয়াইট চ্যাপিপ টেলিফোন করে আমাকে নিক্সন এর সঙ্গে দেখা করার কথা বলেন।জাতীয় রাজনীতিতে রকফেলার এর পরাজয়ের পর সবচেয়ে মর্মান্তিক স্মরণীয় ঘটনা ছিল এটি।
হােয়াইট হাউসে যাওয়ার আগে নিক্সন পিয়ারে হোটেলে উঠেছিলেন। আমি ২৫ নবেম্বর সকাল দশটায় তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমি ভেবেছিলাম ফোন সমস্যার ব্যাপারে আমার মতামত জানতে চাইবেন। চ্যাপিন আমাকে বড় শোবার ঘরে নিয়ে বসিয়ে জানালেন একটু পরেই প্রসিডেন্ট আসবেন। আমি জানতাম না নিক্সন এমন লাজুক এবং নতুন লোক দেখলে ভীত হয়ে পরেন। তার ওপর সে লোক যদি তার বিরোধী হয় তাহলে তো কথাই নেই। তিনি তাই অভ্যাসমত পাশের ঘরে বসে মাথা ঠান্ডা করে এবং আলাপ এর পয়েন্ট গুলো মনে মনে ঝালায় করে একটা চিরকুটে লিখে নিচ্ছিলেন।
নিক্সন খুব ভদ্রভাবে ঘরে ঢুকলেন। অবশ্য তার আচরণ অতিরিক্ত স্নায়নিক দুর্বলতা কে চেপে রাখতে পারেনি। নিক্সন বলেছিলেন তার অসুবিধার কথা।পররাষ্ট্র বিভাগের ওপর তার একটু আস্থা নেই। কারণ তিনি ভাইস প্রসিডেন্ট থাকাকালে এ বিভাগের কর্মচারীর বিরোধিতা করতেন। তিনি অফিস ছেড়ে বের হলেই সবাই বেপরোয়া হয়ে যেতেন—এই সব। কথায় কথায় নিক্সন বললেন যে, তিনি নিজেই বৈদেশিক নীতি নিয়ন্ত্রন করতে চান। তিনি বলছিলেন যে, তিনি নীতিনির্ধারণ থেকে সিইএকে সরিয়ে দিতে চান। কারণ সিআইএ-তে আইভী লীগের লোকজন বোঝাই।তারা বিশ্লেষণাত্মক উদ্দেশ্য বাদ দিয়ে নিজেদের খেয়ালখুশী মত কাজ করেন৷ নিক্সন এসব বিষয়ে আমার মতামত চেয়ে বসলেন।
আমি বললাম যে, ভাইস-প্রেসিডেন্ট বা প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে পররাষ্ট্র বিভাগকে দেখা তার উচিত নয়। প্রেসিডেন্ট হিসেবেই তার দেখা উচিত আর প্রেসিডেন্ট ইচ্ছা করলেই পররাষ্ট্র নীতি নিয়ন্ত্রন করতে পারেন। সিআইএ সম্পর্কে আমার ধারণা কম সে কথা—তারপর আইসেন হাওয়ারের সময়ে যে নিয়ম তৈরি হয়েছিল তা বদলে আরও সময়ানুযায়ী নিয়ম পাল্টানাে দরকার একথা আমি তাকে বললাম।
তারপর নিক্সন প্রায় সম্ভাব্য বৈদেশিক নীতি সম্পর্কে কিছু কথা আমাকে বললেন। এতে নিক্সনের বােধক্ষমতা এবং জ্ঞান সম্পর্কে আমার ধারনা পাল্টে গেল। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কূটনীতির উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত। আমি বললাম, অতীতে আমাদের নীতিনির্ধারকদের বোকামির ফলে আমরা যে অস্থিরতা দেখিয়েছি তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের কীটনীতি হওয়া উচিত স্বাধীন। কূটনীতি বৃহৎ জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে মিলিত হওয়া উচিত, যাতে প্রেসিডেন্ট বদলালেও বৈদেশিক নীতি না বলায়।
নিক্সনের কথা থেকে আমি বুঝলাম যে, সে চায় আমি তার সঙ্গে কাজ করি। এতে আমি বললাম সে রকফোলারকে কোন পদ দিলে আমি তার (র) অধীনে কাজ করতে পারি? এত রকফেলারের শেষ সম্ভাবনাও নষ্ট হয়ে গেল।
পরদিন জন মিচেল আমাকে টেলিফোনে জানালেন যে, তিনি নতুন সরকারে আমার অবস্থান সম্পর্ক কিছু কথা বলতে চায়। আমি মিচেলের অফিসে গেলাম। মিচেল জিজ্ঞেস করলেন আমি ন্যাশনাল সিকিউরিটির কাজটি নেব কি-না। শুনে আমি থ । বললাম আমাকে তো সে কাজ দেয়াই হয়নি। মিচেল বললো-“হায় যীশু, সে এটারও বারেটো বাজিয়েছে”। একথা বলে মিচেল বাইরে চলে গেলেন। মিনিট পাঁচেক পর ফিয়ে এসে বললেন, প্রেসিডেন্ট আপনাকে কে ডেকেছেন। এবার নিক্সন খোলাখুলি প্রস্তাব দিলেন।
অন্তবিরোধ
কয়েকদিন পর নিক্সম জানালেন,উইলিয়াম পিয়ার্স রজার্স হবেন তার পররাষ্ট্র সচিব। রজার্স আইসেন হাওয়ারের সময় এটর্নি জেনারেল ছিলেন এবং তার পুরনো বন্ধু ।
নিক্সন বলেন কূটনীতিতে তার (রাজর্সের) জ্ঞান কম বলে সে তার প্রতি বিশ্বস্ত হবে। তাছাড়া রাজার্সের মতো আত্ম কেন্দ্রিক এবং উচ্চাভিলাষী লোক তিনি আর দেখেননি। এতে রাশানদের সঙ্গে রজার্স যথাযথ ব্যবহার করতে পারবেন এবং অধীনস্থ কর্মচারীরা তাকে সমীহ করে চলবে। কারন সে আজেবাজে কাজ পছন্দ করে না।
৫০ সালের দিকে রজার্স উভয়ের মধ্যে বেশি প্রাধান্য নিয়ে থাকতেন। তাই তিনি নিক্সন এর অধীনে নতুন পদ খুব একটা পছন্দ করেননি। এবং রজার্সের সম্পর্ক এমন হওয়ার ফলে আমার গুরুত্ব একটু বেড়ে যায়। অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা নিক্সন নিজে করতেন। কোন বিদেশি অতিথি একজনের সঙ্গে অফিসে দেখা করতে এলে মার্কিন কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে কেবল আমি সেখানে উপস্থিত থাকতাম।
ধীরে ধীরে অবস্থা এমন হল যে প্রেসিডেন্ট বা আমি বিশিষ্ট বিদেশি নেতাদের সঙ্গে হোয়াইট হাউস সিচুয়েশন রুম থেকে সরাসরি যোগাযোগ করতাম। পররাষ্ট্র বিভাগের মাধ্যমে আালাপ হতো না। নিজে নিয়ন্ত্রন করার এবং সাফল্যের পুরো অংশীদার হওয়ার জন্য নিক্সন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হোয়াইট হাউসে সরিয়ে আনতেন। এতে আমলাতান্ত্রিক স্থবিরতা কাটিতো যা নিক্সন মোটেই পছন্দ করতেন না। ১৯৭১- এর মে মাসে পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আলোচনার কিছুই জানতেন না। সল্ট আলোচনার স্থিতাবস্থা থেকে সাফল্য লাভের ৭২ ঘণ্টা আগে পর্যন্ত তিনি জানতেন না। জুলাই মাসে আমার গোপন পিকিং সফর সম্পর্কে তিনি খবর পেয়েছেন আমি পিকিংয়ের পথে রওয়ানা হবার পর। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে আমার মস্কো যাওয়ার কথা। যাত্রার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তাকে জানালে তিনি তাতে বাধা দেন।
ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এর জন্যই আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। রজার্স তার ওকালতি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ঘটনার গুরুত্ব যাচাই করতেন। আর আমি গুরুত্ব দিতাম রণনীতি এবং ভৌগলিক অবস্থানের ওপর। আমাদের দুজনের এক করলে হয়তো জাতি অধিক লাভবান হতো, কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত কারণে নিক্সনের পক্ষে তা করা সম্ভব হয়নি।
সােভিয়েত সংকট
বিশ্বযুদ্ধের পর অন্যান্য বৃহৎ আণবিক শক্তি দেশগুলাের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতির অন্যতম সঙ্কট। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা ছিল একটি কঠিন কাজ। নয়া প্রশাসন এ জন্য শীর্ষ বৈঠককে একমাএ পথ বলে ধরে নেয়।
পরাশক্তিগুলো প্রায়ই একটি কক্ষে অস্রধারী দুজন অন্ধ লােকের পথ খোঁজার মত ব্যবহার শুর করে। একে অন্যকে মনে করে মরণকামী শত্রু। তাই তাঁরা অন্যের আচরণ বােঝার জন্য চেষ্টা করে। এসব শক্তির মনে রাখা উচিত যে, অনিশ্চয়তা ও সমঝোতা বৈদেশিক নীতির মৌলিক বিষয় এবং রদ্ধকক্ষের কোন ক্ষতি না হলেও অস্ত্রধারী অন্ধের একে অন্যের যথেষ্ট ক্ষতি করতে পারে।
রুশ-মাকিন সম্পর্কের ব্যাপারে দু দেশে আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা এবং আলোচনার টেবিলে নীতি-পার্থক্য ছিলো অন্যতম সমস্যা। মার্কিনীরা মনে করে প্রতিটি আলােচনায় দরকষাকষি এবং যুক্তি বিশেষ ফল দিতে পারে। অন্যেরা মনে করেন এ বিষয়ে আরও উদার হওয়া উচিত। যাই হোক, কোন অবস্থারই শেষ নেই। প্রতিপক্ষ নিশ্চয়ই আমাদের শেষ দেখার জন্য কোন বিষয়ে কঠোর মনােভাব দেখাতে পারে। মার্কিন আলােচনাকারীদের এ মনোভাবের জন্য ১৯৬১ সালে আমাদের সকল প্রচেষ্টা জটিল হয়ে যায়। প্রশাসনের মধ্যেই যাঁরা শুভেচ্ছা দেখাতে অধিক সুবিধা দিতে চায় তাঁদের সঙ্গেই আমাদের প্রায় বিরামহীনভাবে লড়তে হয়েছে। কেউ এমন কথা বলেনি যে, এবিএম এবং এমআইআরভি নিয়ে আমাদের কর্মসূচী অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়া উচিত, তা না হলে আমরা সল্ট আলোচনার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে ফেলব। আসলে এবিএম এবং এমআইআরভি ছিল সল্ট আলোচনায় আমাদের একমাত্র তুরুপের তাস। অনেকে বলেছেন যে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক হলে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু আসলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ায় রাশিয়ার সঙ্গে কোন কোম বিষয়ে বরফ গলতে শুরু করেছিল।
আমাদের আভ্যন্তরীণ বিভাগগুলো আমাদের চামকে দেয়ার মত হাতিয়ার সােভিয়েত নেতাদের হাতে তুলে দিয়েছিল। যেমন একসময় সােভিয়েত নেতারা সল্ট আলােচনায় বসতে আগ্রহ দেখান। তখন হোয়াইট হাউস চাইছিল রাশিয়ায় সামগ্ৰিক আচরণ নিয়ে আলােচনা করতে। কিন্তু আভন্তরীণ বিভাগগুলাে খবরের কাগজ বা সাধারণ কথা বার্তায় যুক্তরাষ্ট্রের সল্ট আলোচনার জন্য তৈরি থাকার কথা প্রকাশ করে দেয়। এতে আমাদের একই সঙ্গে রাশিয়া এবং আমাদের আমলাদের বােঝাতে হয়েছিল যে শুধু শ্লোগান নির্ভর আলােচনা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষিতে আমরা আমাদের বৈদেশিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
‘৬৭ সালের শেষের দিকে আমরা কিছুটা সফল হলাম। সােভিয়েতের আগ্রহেই সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত আনাতােলি দক্লিনিনের(অস্পষ্ট) সঙ্গে আমার আলােচনা সফল হতে থাকল। আরো কিছুদিন পর আমরা আমলাদের বােঝাতে সক্ষম হলাম যে, আমরা আলােচনার স্বার্থে আলােচনা করেই ক্ষান্ত হতে চাই না। প্রেসিডেন্ট চান কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে।
মুখােমুখি
প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সময় থেকে সব প্রেসিডেন্টই আগে বা পরে বিশ্বাস করেছেন এবং রাশিয়ার সঙ্গে নিজেই সামনাসামনি আলাপ করে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ দেখিয়েছেন। তাদের এ ধারণায় ইন্ধন যুগিয়েছে সেই সব মার্কিনীরা যারা মনে করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ব্যক্তি-সম্পর্ক বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
নিক্সন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন। কারণ তিনি মনে করতেন একবার আলাপ করলেই আন্তর্জাতিক আলােচনার ধারা পাল্টায় না। তাছাড়া দু’দেশের মধ্যে কয়েক দশকের শত্রুতা শুধু ব্যক্তিগত কারণেই নয়। নিক্সন তাই সামনাসামনি রাষ্ট্রপ্রধানদের আলোচনা বেশি পছন্দ করতেন না।
তা সত্ত্বেও নিক্সন যুদ্ধবিরােধী মিছিলকারীদের হঠাৎ চমকে দেয়ার জন্য নাটকীয়ভাবে শান্তি আলোচনা করতে আগ্রহী হয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন এতে হ্যানয় মনে করতে পারে যে, বৃহৎ শক্তির খেলায় সে খরচের খাতায় পড়ে যাবে। বেশ ক’বারের মধ্যে এটা একবার যখন নিক্সনের সঙ্গে আমার পুরো মতপার্থক্য হয়েছিল।
মস্কোর পথে
১৯৭০ সালে নিক্সন মস্কো যাওয়ার ইচ্ছা করেন। কিন্তু আমন্ত্রন এলো সােভিয়েতের কাছ থেকে ১৯৭২ সালের বসন্তে যাওয়ার জন্য। কারণ ১৯৭১-এ নিক্সন পিকিং যাওয়ার কথা ঘােষণা করেন এবং পোল্যান্ড এ খাদ্যাভাবের জন্য দাঙ্গা বেধে যায়।
আমি পিকিংয়ে গোপনে গিয়েছিল বলে তাদের সমান হওয়ার জন্য মস্কোও চাইছিল আমি গােপনে একবার রাশিয়া যাই। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে আমি প্রেসিডেন্টের একটি বিমানে গােপনে মস্কো যাই।
আমার যাত্রার শুরুতে উত্তর ভিয়েতনাম বাহিনী এক বিরাট আক্রমণ চালায়। এতে আমাদের সন্দেহ জাগে যে সোভিয়েতের আশ্রিত দেশ ভিয়েতনামকে সােভিয়েত ইউনিয়ন কথা মানাতে পারবে? নাকি এ আমাদেরই দূর্বল ভেবে সে সোভিয়েত ইউনিয়ন উত্তর ভিয়েতনামের পাল্টা জবাব দেয়া থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করবে ?
কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান লিওনিল ব্রেজনেভের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ করার কথা ছিল ২১ এপ্রিল সাল ১১টায়। আমরা যে অতিথি ভবনে থাকতাম তার বিরাট একটিতে তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
আমায় মনে হয় অফিসের নির্দেশে ব্রেজনেভ গম্ভীর মুখে আমাকে ক্ষেপিয়ে তুলতে চাইছিলেন। একবার তিনি বললেন যে, তাঁরা চান আমাকে আরও উষ্ণ করতে। আমি বললাম, এতে কি আমাকে ভয় দেখানাে হচ্ছে ? ব্রেজনেভ বললেন সােভিয়েত কাউকে ভয় দেখায় না। কথাটি আমার কাছে নতুন মনে হলো।
আমার মনে হয় প্রথম সাক্ষাতে একজন মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে তিনি খুব স্নায়বিক দুর্বলতায় ভুগছিলেন। এর কারণ সম্ভবতঃ তার প্রচুর সিগারেট ও মদপান, হার্টের অসুখ এবং কাজের চাপ। তার হাত দুটো সবসময়ই কিছু না কিছু কাজ করে। একটি হতে তো সর্বক্ষণ সিগারেটের ছাই ঝাড়ইে ব্যস্ত। দোভাষী তার কথা অনুবাদ করতে থাকলে তিনি অস্থির ভাবে উঠে দাঁড়াতেন, সহকর্মীদের সঙ্গে জোরে জোরে কথা বলতেন, এমনকি ঘরে বাইরে চলে যেতেন। ব্রেজনেভের সঙ্গে কথা বলা তাই মুশকিল ছিল। কারণ তিনি হঠাৎ উঠে বাইরে চলে যান বা কেউ যখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছে তিনি তখন হয়তো কথার দিকে খেয়াল না করে খাবার সাধছেন। ব্রেজনেভ এবং কিঞ্চিত সল্ট এবং অন্যান্য ব্যাপারে নিক্সনের সফরের মূল কাজগুলো সম্পন্ন করেন। এর প্রায় এক মাস পর নিক্সন মস্কো যান।
ক্রেমলিনে নিক্সন
গত কয়েক মাসে আমাদের কাছে পর্যবেক্ষকদের চমক লেগে গিয়েছিল। হ্যানয় বা আমাদের বিরোধীদের সমালোচনা না সত্ত্বেও আমরা মোটামুটি দাঁড়াবার জায়গা পেয়েছিলাম কিন্তু উদার রক্ষণশীলদের চেয়ে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। প্রেসিডেন্টের যাএার শুরুতে আমি তাকে এক স্মারকপত্রে লিখলাম, “সোভিয়েট আদর্শবান ও অভ্রান্তরীণ রাজনীতির জন্যই পশ্চিমা দেশ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সোভিয়েট ইউনিয়ন শত্রুতামূলক সম্পর্ক রাখবে। সােভিয়েট নেতা এবং উঠতি নেতাদের বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী হওয়ার ইচ্ছা এবং সোভিয়েটের সম্পদের উপর দৃঢ় আত্মবিশ্বাস থেকে মনে হয় সোভিয়েট ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তাদের চিন্তাভাবনা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে। এতে তারা বিপজ্জনক ঝুঁকি নিতেও পিছুপা হবে না।” সোভিয়েট নেতাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনার কোনো লক্ষ্য ছিল না আলোচনা শুরু করতে আমাদের অনেক সময় ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। কারণ তারা হয়তো পলিটব্যুরোর সভায় থাকতেন বা তাদের খুঁজে পাওয়া যেতনা। এটা তাদের কাজেরই ধারণা বা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের ব্যাপার তা আমি বুঝতে পারিনি। ব্রেজনেভ ১৯৭৩ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রে আসেন তখন তিনি ক্যাম্প ডেভিডে নিক্সনকে দেখা যায় এমন ভাবে বারান্দায় বসে তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলাপ করেন। এ জন্য তিনি প্রেসিডেন্টকে প্রায় দু’ঘন্টা বসিয়ে রাখেন। কিন্তু সমান্য ও দুঃখও প্রকাশ করেননি।
মস্কো নদীর তীরে এক ঘন গাছপালা ঘেরা রাশিইয়ান বাড়িতে আলােচনার স্থান ছিল। এটা ছিল ক্রেমলিন থেকে মােটরে ৪o মিনিটের পথ। এই দেতলা বাড়ির নিচতলায় একটি ডিম্বাকৃতি টেবিলে নিক্সন ব্রেজনেভ আলােচনা শুরু হল কোন বাকবিতন্ডা ছাড়াই। কিছুক্ষণ পর নিক্সন ভিয়েতনাম নিয়ে ঝগড়া করতে শুরু করলেন। নিক্সন না করলেও সোভিয়েট নেতারা করতেন। কারণ এ বিষয়ে তাদের পােট ছিল ভর্তি।
নিক্সন আশা করছিলেন ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক ব্যাপারে সােভিয়েট নাক গলাবেনা । বরং সোভিয়েট ভিয়েতনামকে আলােচনায় নমনীয় হতে একটু খোঁচা দিতে পারে কারণ মস্কোই ভিয়েতনামকে অস্ত্র সরবারাহ করে এবং তাদের মধ্যে আদর্শের মিল রয়েছে।
আর যায় কোথায়? সোভিয়েটের তিন নেতা নিক্সনকে একদম জেকে ধরলেন। ব্রেজনেভ বলতে শুরু করলেন ভিয়েতনামে আমার কি নির্মমভাবে বােমা ফেলছি। নিক্সনের বক্তব্যই শুধু নয় কথায় সূরও খুব ভালো না। তিনি বলছিলেন ভিয়েতনাম আলােচনার জন্য খুব আগ্রহ দেখিয়েছে। আমরা শুধু নগুয়েন ভ্যান থিউকে ছেড়ে আসতে পারছিনা। এসব কারনে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করাই দরকার। আমরা বর্তমান যুগে হিটলার বনে গেছি। নিক্সনকে এভাবে গালাগালি শুরু করলে নিক্সন মাত্র দু’বার একটি করে কথা বলে তাদের জবাব দেন।
ব্রেজনেভ খুব চটে গিয়েছিলেন। কোসিগিন কিন্তু জিনিসটা ব্যাখ্যা করতে চাইছিলেন। ব্রেজনেভ লিন্ডন জনসনের সঙ্গে তার অলোচনার কথা তুলে বলেন যে তিনি যেমন জয়ের আশা করে হেরে গেছেন নিক্সনের অবস্থাও সেই রকমই হবে। তারা বললেন যে এরপর হ্যানয় হয়তো বিদেশী সৈন্য নিয়েই যুদ্ধ করবে। এতে নিক্সন জবাব দেন যে আমরা তাতে ভীত নই। তিন নেতার মধ্যে পদগণীই কিছুটা নয়ভাবে কথা বলছিলেন। আসলে নেতাদের উদ্দেশ্য ছিল আলোচনার রেকর্ড রেখে চান ভিয়েতনামেক দেখানাে যাতে তারা খুশি হতে পারে।
যাইহোক শীর্ষ বৈঠককে বিপথ থেকে টেনে আবার পথে আনা হয় এবং মূল আলোচনায় নিষ্পত্তি হয়। এতে এবিএম এবং অন্যানা আক্রমণাত্মক মিসাইল তৈরি বন্ধ করে দেয়া হয়। এ চুক্তি দেশে ভাষণ বিরোধী সমালোচনার সম্মুখীন হয়। সমালোচকরা বলেন যে এতে সোভিয়েট ইউনিয়ন বেশি সুবিধা পেয়েছে। তারা ইতিমধ্যেই কয়েক ধরনের মিসাইল তৈরি করে ফেলেছে।
নিক্সনের জীবনে এটা সবচেয়ে বড় ট্রেজেডি যে সােভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে বা কোন নতুন চুক্তি হলেই তা ভীষণ সমালোচনার সম্মুখীন হয়। এবং তাঁকে পূর্বসূরীদের চেয়ে দুর্বল বলে আখ্যা দেয়া হয়। কিন্তু কেউ বলেনি যে পিকিং ঘুরে আমার তিন মাস পর আমরা কতগুলো ব্যাপারে মীমাংসায় পৌছুতে পেরেছিলাম। হ্যানয়ের ব্যাপারে আমরা এখন ঠকে গেলেও আমাদের সামনে ভবিষ্যৎ এর পথ খােলা ছিল। ব্রেজনেভের ‘মৌলিক নীতিতে’ একমত হওয়ার অন্তত মৌখিক ভাবে ভালো রাজনৈতিক ব্যবহারের স্বীকৃতি রয়েছে। এতে গণতন্ত্র এবং সোভিয়েট ব্যবস্থার সহ-অবস্থানের পথ খুজে পাওয়া গেছে। অন্তত এটুকু একমত হওয়া গেছে যে অস্ত্র পরীক্ষা করে উত্তেজনা বা শংকা দূর করা যায়ন। এ জন্য আন্তর্জাতিক আচরণ চাই।
দেশের অভ্যন্তরে নিক্সনের অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় আমরা আমাদের কৌশলকে বাস্তবায়িত করতে পারছিলাম না। উদার এবং রক্ষণশীলদের আক্রমণের ফলে সােভিয়েটের সঙ্গে সম্পর্ক সংঘাতময় হতে থাকে। উদারনীতিকরা এতদিন নিক্সনকে অনমনীয় বলে সমালােচনা করছিলেন। এখন তারা বলতে শুরু করেন যে নিক্সন আমেরিককে বিকিয়ে দিচ্ছে। রক্ষণশীলরা মনে করছিলেন আমেরিকা সোভিয়েটের সঙ্গে স্বন্দ এবং সহযােগিতার নীতি বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারবে না ।
তাদের পক্ষে অবশ্য যুক্তি ছিল। কারণ এর আগে সােভিয়েট ইউনিয়ন আমাদের সঙ্গে সকল চুক্তিকে তার পরবর্তী হামলার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করেছে। তবু আমেরিকা শুধু শক্তি বৃদ্ধির পথ ধরতে পারেনা। কারণ এতে আমাদের বিরোধী বিশ্বশান্তির এজেন্ট হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের উদ্দেশ্য সোভিয়েটের আগ্রাসী মনোভাব বন্ধ করা হলে আমাদের নীতি এমন হওয়া উচিত যাতে ভবিষ্যৎতে আমরা কিছু আশা করতে পারি। অবশ্য ইতিহাস ও অতীত থেকে আমরা সোভিয়েটের দৃষ্টিভঙ্গি বিচার করলে এই সংকীর্ণ পথে আমরা এগিয়ে যেতে পারবাে কিনা সে সম্ভাব্যতা যাচাই করা প্রয়োজন হয়ে পরে।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক
আলােচনার টেবিলে সােভিয়েট কূটনীতিকরা অভদ্র এবং মােটা-বুদ্ধি, চীনারা ধীর এবং সুন্দর। রাশান পরাশক্তি বলে সব সময় বিশেষ সবিধা আদায় করতে চায়। চীনারা চায় ধ্রুব নীতি এবং আত্মবিশ্বাস প্রদর্শন করে কোন যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে যাতে শক্তি সম্পর্ক অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাড়ায়। রাশানরা উন্মাদের মত দ্বিচারিণী রুপ প্রকাশ করে। আর চীনা চাপের মুখে থাকে রহস্যময় আবরণে আবৃত। আসলে “নীতির” ব্যাপারে কেন আলোচনা না করে তারা আগেই চাপ সৃষ্টি করে রাখে।আমাদের সঙ্গে আলোচনায় চীনা কূটনীতিকরা সবসময়ই নিজেদের বিশ্বস্ত বলে প্রমাণ করেছেন। ছােটখাট দাবী তুলে তারা নিজেদের ছোটলােক বলে জাহির করেননি, দরাদরি করেননি, কতখানি নামবেন তা দ্রুত তুলে ফেলেছেন, বক্তব্য যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন এবং দৃঢ়ভাবে তা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। উদ্দেশ্য ব্যাখ্যায় এবং রক্ষায় তারা অনড়। যেমন চৌ প্রায়ই বলতেন, আমাদের কথার দাম আছে।”
চীনের সঙ্গে আকস্মিকভাবে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হওয়ায় কিসিণ্জার সোভিয়েট এবং চীনা কূটনীতিকদের আলোচনার ঢং যাচাই করতে সুযোগ পেয়েছেন। কিসিঞ্জার লিখেছেন, “উদ্দেশ্য সাধনের সুযােগ এলেই কৌশল বের হয়ে আসে।”
নিক্সন বেশ বুঝতে পেরেছিলেন যে ১৯৬৯ সালে চীন-রুশ সীমান্ত সংঘর্ষ ছিল অপূর্ব সুযোগ। রাশিয়ায় সঙ্গে সম্ভাব্য সর্বাত্মক যিদ্ধের ভয়ে চীন এখন উদ্গিব্ন। । তাই সােভিয়েট চাপের পাল্টা শক্তি তারা খুঁজছিল। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দু দেশের সম্পর্কের মৌলিক পরিবর্তন আনা জন্য অত্যন্ত সূক্ষভাবে সংকেত দেয়। এ প্রসঙ্গে কিসিঞ্জার লিখেছেন, “বিশেষ নাচটি এমন জটিল ছিল যে এই দুই পক্ষের কাউকেই শুরু করার দায় বইতে হয়নি, কোন পক্ষরই পুরনো মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক জটিল হয়ে যায়নি।” ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এখন পিকিং যাচ্ছিলেন তখন নিক্সন তাকে অনুরোধ করছেন তিনি যেন চীনাদের জানান যে মার্কিনীরা সম্পর্ক উন্নত করতে আগ্রহী।
শীর্ষ থেকে শীর্ষ
ডিসেম্বরে ৮ তারিখে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা হিলালী আমাকে জানালেন যে ইয়াহিয়ার সফর সম্পর্কে তার কিছু কথা আছে। আমি তাকে পরদিন হােয়াইট হাউসে আসতে বললাম। সন্ধ্যা ৬টার কয়েক মিনিট পর হোয়াইট হাউসে আমার অফিসে হিলালী আমাকে একটা খাম দেখালেন। খামে ছিল নীল বর্ডারের সাদা কাগজে হাতে লেখা একটা চিঠি। ইয়াহিয়া তার যেগাযােগের নিরাপওায় সন্দিহান ছিলেন বলে এটা তার কাছে লোক মারফত পাঠান। (পাকিস্তানি সূএে যত যােগাযােগ তা এভাবেই হয়েছিল)। হিলালী আমাকে বললেন যে চিঠিটি আমাকে দেয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই। তাই তিনি ওটি পড়ে শােনালেন, আমি তা লিখে নিলাম। একটি পুরোন ধর্মভিত্তিক দেশের অভিজাত শ্রেণীর একজন অভিজাত প্রতিনিধি এশিয়ার একটি বিপ্লবী দেশের নেতার একটি বার্তা পশ্চিম পুজিবাদী বিশ্বের একজন প্রতিনিধিকে মুক্তি লিখন দিচ্ছেন—এ অসামঞ্জস্য আমরা তখন খেয়াল করিনি। আমাদের মনেও ওঠেনি যে যােগাযোগ উন্নত একটি বিশ্বে বাস করে প্রাচীনকালের দূতদের মত রাজ দরবারে হাতে লেখা বার্তা পড়ে শােনানাের আমরা ফিরে গিয়েছিলাম।
বার্তাটি সূক্ষ্ম বা পরোক্ষ ছিল না। নিক্সনের কাছে চৌ এন লাই লিখেছিলেন, ‘সব সময় চাইছিলাম এবং সবসময়ই চেষ্টা করছি শান্তিপূর্ণ উপায়ে আলোচনা করতে … প্রেসিডেন্ট নিক্সনে এক বিশেষ দূতকে পিকিংয়ে স্বাগত জানানো হবে।” এ শুধু চৌ-এর নিজের কথাই ছিল না। চেয়ারম্যান মাও এবং ভাইস চেয়ারম্যান লিন পিয়াও তাই চাইছিলেন। চৌ এন লাই লিখেছিলেন “এই প্রথম একজন রাষ্ট্রপ্রধান আরেকজন একজন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। আমরা একে গুরুত্ব দিচ্ছি।” যদিও এর আগে বিভিন্ন সূত্রে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন সংকেত আমরা পেয়েছি।
মোটকথা প্রসিডেন্টর একজন প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমি হল ঘর পার হয়ে ওভাল অফিসে গেলাম । নিক্সন এবং আমি আমন্ত্রণ গ্রহন করার জন্য তৈরি ছিলাম। তাই ১৬ ডিসেম্বর হিলালীর দেয়া চৌয়ের চিঠির একটি জবাব আমরা হিলালীর মাধ্যমেই পৌছে দিলাম। চীনা চিঠিটি ছিল হাতে লেখা—আমরা জবাব জেরক্স কাগজে টাইপ করে। একটা প্যাডেও না– এটা সরকারী জলছাপ বা স্বাক্ষরও এতে ছিল না। আমাদের আমলারা এটা জানতেনও না। যাই হোক, উভয় পক্ষই পিকিংয়ে আলােচনায় বসতে রাজী হলাম।
কঠিন নাচটি চলছিলই, সূক্ষ্ম সংকেতের আদান-প্রদানও ইতিমধ্যে হয়েছিল– যুক্তরাষ্ট্রের একটি পিংপং দল চীন সফরের আমন্ত্রণও পেয়েছিল। ১৯৭৯ সালে ২৭ এপ্রিল ঘটলাে আসল ঘটনা। পাকিস্তানী সূত্রে চৌ এর আরেকটি চিঠি পাওয়া গেল। চৌ লিখেছেন, “চীন সরকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের একজন বিশেষ দূতকে (যেমন কিসিঞ্জার) অথবা স্বয়ং প্রেসিডেন্টকেই সরাসরি আলোচনার জন্য স্বাগত জনানোর দৃঢ় ইচ্ছা পুনরায় জানাচ্ছে। পরদিন সকালে নিক্সন কিসিঞ্জারকে গােপনে পিকিং যাওয়ার জন্য তৈরি হতে বললেন। কিন্তু যাএা শুরুর কিছুদিন আগে একাটি প্রত্যাশিত সংকট দেখা দিল।
আমলাতান্ত্রিক এবং পদ্ধতিগত সংকট দূর হয়ে যাওয়ার পরপরই এমন একটা ঘটনা ঘটল যে আমার যাত্রা শুরুর পূর্বে পর্যন্ত সে ঘটনায় আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখল। ঘটনাটি ছিল পেন্টাগনের দলিল ফাঁস হয়ে যাওয়া। আমরা যখন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য ক’মাস ধরে চেষ্টা চালাচ্ছি তখন ভিয়েতনাম সম্পর্কিত পেন্টাগনের দলিলের ৭ হাজার পৃষ্ঠা ফাঁস হয়ে যাওয়াটা আমাদের প্রতি ছিল মারাত্মক আঘাত। দলিলগুলো অবশ্য নিক্সনের আমলের নয়। কিন্তু হোয়াইট হাউসের রাজনৈতিক কর্মচারীরা পুরনো আমলের দুর্নীতি প্রকাশ করে ফায়দা লুটতে চাইছিলেন। এধরনের ঘটনা জনস্বার্থ বিরােধী বলে আমি মনে করি। এতে সরকারের প্রতি সকলেই আস্থা হারিয়ে ফেলে।
আমাদের ভয় ছিল পিকিং মনে করতে পরে যে তা সম্ভাব্য বন্ধু অস্থির, লান্ছিত এবং নিরাপদ নয়। এসব দলিল ফাঁস হয়ে যাওয়ায় আমাদের রাজনৈতিক স্থিতাবস্থার ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। এসব দলিল প্রকাশ করার বিরুদ্ধে নিক্সনের সকল কাজে আমি শুধু সহযােগী ছিলাম না উৎসাহও দিয়েছি। তবে অনর্থক চোখ রাঙ্গিয়ে যে ছেলেমানুষী করা হয়েছে আমি অবশ্য তার কিছুই জানতাম না। এগুলোই পরে নিক্সন প্রশাসনের পতন ঘটায়। এসব পথ গ্রহণ ক্ষমার অযোগ্য। সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলবাে যে এসব দলিল চুরি করে প্রকাশ করাও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। সৌভাগ্য এই যে এসব কোন ঘটনাই আমাদের পিকিং যাত্রায় বিঘ্ন সৃষ্টি করেনি।
জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে এশিয়ায় তথ্য সংগ্রহের নামে পিকিং যাওয়ার তারিখ ঠিক হয়েছিলো ৯ জুলাই। কথা ছিলো কিসিঞ্জার ইসলামাবাদ থেকে সটকে পড়ার জন্য ভোর হওয়ার আগেই কালো চশমা এবং হ্যাট পরে চাকলালা বিমান বন্দরে যাবেন। করণ কিসিঞ্জার নামটি ছিলো পিন্ডির ঘরে ঘরে পরিচিত। আর তাঁরা চাইছিলেন যাতে কোন পথচারী কিসিঞ্জারকে দেখে না ফেলে। বিমানে বসে কিসিঞ্জারের মনে পড়ছিল ১৯৫৪ সালে ইন্দো-চীন প্রশ্নে জেনেভা সম্মেলনে জন ফুস্টার ডালেস চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে হাত মেলাননি। ঘটনাটি কেউ ভুলে যায়নি। তা আমাকে বিভিন্ন সফরের সময় মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে। কিসিঞ্জার চাইছিলেন ঘটনাটি সংশোধন করতে। পশ্চিম পিকিং-এর একটি দেয়াল ঘেরা মনোরম বাড়িতে তার ওঠার ব্যবস্থা হয়েছিলাে। সেখানে পৌছে তিনি প্রধানমন্ত্রীর আগমনের অপেক্ষা করছিলেন।
সাড়ে চারটায় চৌ-এন-লাই এলেন। তার পাতলা ভাববুহল চেহারার মধ্যে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল তাঁর তীক্ষ্ম চোখ দুটো। মনে হচ্ছিলো শান্ত, গভীর এবং আত্মবিশ্বাসী। আভিজাত্য ছিলো চলাফেরায়। ঘরের মধ্যে তা উপস্থিতি শুধু উপস্থিতিতেই সীমিত ছিল না। পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ইস্পাত কঠিন শৃংখলা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ (মাও এবং দ্য গালের মতই) থেকে তাঁকে মনে হচ্ছিল যেন একটি প্যাচানাে স্প্রিং।
তাঁর স্মিত হাসি দেখে বােঝা যাচ্ছিল বিনা অনুবাদেই তিনি ইংরেজী বোঝেন। তাঁর মাপা ক্ষিপ্রতা একথাই মনে করিয়ে, দিচ্ছিল যে অর্থ শতব্দী ধরে তার পদমর্যাদা তাঁকে পুড়ে পুড়ে তৈরি করেছে। আমি অতিথি ভবনের দরজা থেকে তাঁকে স্বাগত জানালাম যন্ত্রের মতাে ডান হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে। চৌ মৃদু হেসে হাতটি গ্রহণ করলেন। এটাই ছিল আমাদের অতীতকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার প্রথম পদক্ষেপ।
আমি খুব শীগগীরই বুঝতে পেরেছিলাম একটি পরিচ্ছন্ন রুচিবােধ আছে বলে চৌ ছোটখাট দরকষাকষির পান্ডি পার হচ্ছিলেন অবলীলায়।
অথচ এ ধরনের দরকষাকষি অন্যান্য কমিউনিস্ট দেশের সঙ্গে আলোচনার বৈশিষ্ট্য। সেবার এবং প্রতিবারই এর সঙ্গে আমার আলোচনা ৫/৭ ঘন্টা স্থায়ী হয়েছে। কিন্তু, তার আচরণে কখনও অধৈর্য প্রকাশ পায়নি। এমন কি কোন টেলিফোন এসেও আমাদের বিরক্ত করেনি। যা কিনা আমলারা করতে পারতেন সহজে। আমি বুঝতে পারিনি তিনি কেমন করে এটা ম্যানেজ করতেন। তাই আমি প্রায়ই ঠাট্রা করে বলতাম, ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা দ্বিতীয় বার আসার সময়ও করতে পারবেন না।
আমি বুঝতে পেরেছিলাম কোন কথা সূক্ষ্ম যুক্তিতে দাঁড় করিয়ে তাতে অনড় থাকাই চৌ-এর সঙ্গে আলোচনার সবচেয়ে সহজ উপায়। তাই আমি তার সঙ্গে খোলা খুলি কথা বলতাম- তিনিও তাই করতেন। ৯ জুলাইয়ের প্রথম আলোচনায় কোন আলােচনা না করেই আমরা সম্মত ছিলাম যে আমাদের বিরোধের বিষয়গুলোর শেষ রক্ষা করার জন্য আমারা চাপ দেব না। তাইওয়ান সম্পর্কে খুব সংক্ষিত আলোচনা হল। কিন্তু পরের দিন চৌ কোন ভুমিকা না করেই আলোচনার শুরুতে একটি কঠিন প্রবাদ জুড়ে দিয়ে বললেন, “আমাদের য়(অস্পষ্ট) এতসব বিরোধ থেকে যাওয়ার পরও প্রেসিডেন্টের সফরের কোন মনে আছে কি?
আমিও শক্ত করেই বললাম, পিকিং-ই আমন্ত্রণ জানিয়েছে প্রেসিডেন্টকে, তাই কোন পূর্বশত আমরা মানবো না। তারপর আমি চৌ-এর সমস্ত যুক্তি একের পর এক ইচ্ছাকৃত ভাবে খন্ডন করতে শুরু করলাম।
আমি প্রথম কথাটি বলতেই চৌ আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,আমরা যদি এখনই না খাই তবে চীনা হাঁস ঠান্ডা হয়ে যাবে। খেতে খেতে চৌ নরম হয়ে আসছিলেন। খাওয়ার পর আমি আবার গোঁয়ারের মত তর্ক শুরু করলাম। হঠাৎ চৌ প্রস্তাব করলেন ১৯৭২ সালের গ্রীষ্মেই প্রেসিডেন্ট যেন সফরে আসেন। ভাবখানা এই যে তারিখ নির্ধারনটাই আমাদের একমাত্র সমস্যা ছিল। তিনি আরো বলেছিলেন যে আমরা আগে যেন সােভিয়েট নেতাদের সঙ্গে আলােচনা করে হাসি। আমি বললাম–না নির্ধারিত প্রোগ্রাম অনুসারে প্রেসিডেন্ট আগে পিকিং আসবেন তারপর যাবেন মস্কো। চৌ এতে অসন্তুষ্ট হননি।
আমার শার্টের গল্প এখানে বললে এই গোপন সফরের কাহিনী অসমাপ্ত থেকে যাবে। এশিয়ায় ১২ দিন প্রচন্ড খাটুনি যাবে বলে আমি আমার সহকারী ডেভ হ্যালপারিনকে বলেছিলাম দুটো ধোয়া শার্ট জোগাড় করে রাখতে। আমার বিমান চাকলালা ছাড়ার পর হ্যালপারিন টের পায় যে আমার জিনিসপত্রের সঙ্গে সে শার্ট দুটো দিয়ে দেয়নি। আর আমি চাইছিলাম প্লেনেই শার্ট বদলাতে। শেষে জন হোলরিজের দুটো শার্ট আমি নিলাম। হোলরিজ ৬ ফুটেরও বেশি লম্বা। আমার মােটাসোটা শরীরে তার শার্ট মোটেই ফিট করেনি। আমার ছবিতে তাই অস্বস্তির ভাব ফুটে উঠেছিল। কারণ আমার মনে হচ্ছিল যেন আমার ঘাড় নেই। তার উপরে শার্টগুলােতে প্রকাশ্যে বড় করে লেখা ছিল তাইওয়ানে তৈরি। তাই আমি আক্ষরিক অর্থেই বলে ছিলাম ‘তাইওয়ান আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
ইউরেকা
কিসিঞ্জার নিক্সনকে সংকেত-তার পাঠালো ‘ইউরেকা’ । যার অর্থ ছিল সফর সফল। পিকিং থেকে ফিরে কিসিঞ্জার এবং উইন্সটন লর্ড নিক্সনের কাছে দেয়া রিপাের্টে লেখেন যে “মাও এবং আপনি যাতে ইতিহাসে একটি দিক উদ্মাটন করতে পারেন সেজন্য মূল কাজগুলো আমরা করে এসেছি।”
১৫ জুলাই টেলিভিশনে নিক্সন ঘােষণা করেন, ৭২ সালের মে মাসে তিনি চীন যাবেন। ১৯৭১-এর অক্টোবরে কিসিঞ্জার একটি অগ্রগামী দল নিয়ে পিকিং ঘন।
চীনারা এর আগে কখনও অগ্রগামী দল দেখেননি। অমি চৌ-এন-লাইকে ঠাট্রা করে বলতাম, “চীন অনেক আক্রমণ ঠেকিয়েছে। কিন্তু কখনও অগ্রগামী দলের সম্মুখীন হয়নি। কিন্তু এ ঠাট্রা শেষ পর্যন্ত আর ঠাট্টা ছিল না।
নিক্সনের সফরের সবকিছু খুব দ্রুত শেষ করা হয়। আমরা প্রস্তাব করেছিলাম ২১ ফেব্রুয়ারী বা ১৬ মার্চ তিনি পিকিং আসবেন। চৌ বলেছিলেন তারও আগে। যাইহােক আমাদের দলের কথা অনুযায়ী সবকিছু সম্পন্ন হচ্ছিলাে। নিরাপত্তা প্রধান তাঁর গুরত্ব জাহির করার জন্য নিক্সন যে সমস্ত এলাকায় যেতে পারেন সে সমস্ত এলাকার রাষ্ট্রবিরােধীদের তালিকা চেয়ে বসলেন। এতে মজার এক সমস্যার সৃষ্টি হল। চীনে অবশ্য অগ্রগামী দলটিই ছিল একমাত্র রাষ্ট্রবিরোধী আর কমিউনিস্টদের তালিকায় পাওয়া যেত ৮০ কোটি লােকের নাম।
চৌ ও আমি ৪০ ঘন্টা বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করি। এর মধ্যে ১৫ ঘন্টা কাটে যৌথ ইশতেহার নিয়ে। আমি একটি গৎবাঁধা খসড়া তৈরি করে এনেছিলাম। চৌ বললেন, এটা মােটেই গ্রহণযােগ্য নয় কারণ এটা দেখতেই ‘অসত্য’। এমন ইস্তেহার সােভিয়েটরা স্বাক্ষর করতে পারে কিন্তু বিশ্বাসও করে না, পালনও করে না।
চৌ প্রস্তাব করলেন, তিনি একটি খসড়া বানাবেন। এবং যা বানালেন তা ছিলাে দৃষ্টান্তহীন। তাতে চীনের মূল্যায়ন আপােষহীনভাবে লেখা ছিল। আমাদের জন্য ছিল কয়েক পাতা সাদা কাগজ। এতে তাইওয়ান সম্পর্কে চীনের অনমনীয় মনােভাব দেখানাে হয়েছিল। ওটা দেখে আমি ভড়কে গিয়েছিলাম। প্রেসিডেন্টের একটি সফর শেষে ভিন্নমতের একটি লিস্ট তৈরি করে ফিরতে হবে। কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখলাম ভিন্নমতই আমাদের একমত হতে সহায়ক হবে এবং তাতে আমাদের কোন মিত্রই অখুশী হবে না। কারণ তা জানবে যে তাদের বন্ধুরা তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সদা সচেষ্ট। উপরন্তু ঐকমত্যের কোন বিষয় খুজে পেলেই বন্ধুত্ব স্থায়ী হতে পারে।
আমরা উভয় পক্ষই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একমত হলাম। আমাদের দ্বিমতের প্রধান কারণ ছিল তাইওয়ান। আমরা তাইওয়ান ও চীনকে এক করার একটি পদ্ধতি খুঁজ ছিলাম। এতে পিকিং ও তাইপের সম্মতি ছিল এবং আমাদের বর্তমান সম্পর্কও এর ফলে বিঘ্নিত হত না। চৌ ও আমি প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা খেটে ইস্তেহারের খসড়া তৈরি করলাম। এটা শেষ হল সকাল আটটা দশে। ন’টায় আমাদের ফিরে যাবার কথা। চৌ আমাকে অতিথি ভবনের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এই প্রথম ইংরেজীতে বললেন, শিল্পী আবার আসুন, আরামসে গল্প করা যাবে।”
বিশাল ব্যক্তিত্বের মুখােমুখি
২১ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২। বেলা ১১-৩০ মিনিটে প্রেসিডেন্ট নিক্সন বিরাট একদল নিয়ে পিকিং পৌছালেন। নিক্সন এবং কিসিঞ্জার উঠলেন। রাজকীয় ফিশিং লেকের পাশে এক বিরাট অতিথি ভবনে। পররাষ্ট্র সচিব রজার্স উঠলেন কয়েক শ গজ দূরে আরেকটি অতিথি ভবনে তাঁর দলবল নিয়ে।
বেলা আড়াইটায় আমাকে খবর দেয়া৷ হল, চৌ-এন-লাই রিসেপশন রুমে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি সেখানে যেতেই তিনি বললেন চেয়ারম্যান মাও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে চান। প্রেসিডেন্ট এবং আমি তাই বর্তমান যুগের বিরাট এক ব্যক্তিত্বের সামনে হাজির হওয়ার জন্য তৈরি হলাম ।
মাও যে রাজাদের জীবনযাত্রার সমালােচনাও ঘৃণা করতেন, তাঁদের মতই তিনি পশ্চিম পিকিংয়ের রাজকীয় অংশে রহস্যময় ভাবে থাকতেন। যদিও পুরনাে মূল্যবােধ, সমাজ কাঠামো এবং ট্রাডিশন পাল্টাতে তার জীবন ছিল উৎসর্গীত । কিন্তু কেউ মাওয়ের সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেখা করতে পারেননি। আমি পাঁচবার তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করি। প্রতিবারই আমাকে হঠাৎ করে ডাকা হয়েছিল। একবার তিনি আমার স্ত্রী ন্যান্সির সঙ্গে দেখা করতে চান। ন্যান্সি তখন কিছু কেনাকাটা করছিল। সে মুহুর্তে তাকে খুজে বের করে তাঁর সামনে আনা হল।
ন্যান্সি ঘরে ঢুকতেই মাও এক অন্তর্ভেদী হাসিতে বুঝিয়ে দিলেন যে, তাঁকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব নয়। সম্ভবতঃ একমাত্র চার্লস দ্য গলই এমন আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। একজন পরিচারিকা তার দেখাশােনা করতেন। কিন্তু সে ঘরে সবকিছু ছাপিয়ে ছিল মাওয়ের উপস্থিতি। তাকে মহিমান্বিত করে তােলার কোন প্রচেষ্টাই ছিল না।
কোন কোন সময় চৌকেও তাঁর সামনে দ্বিতীয় কাতারের লোক বলে মনে হত। আমার বিশ্বাস কোন কোন সময় তা ছিল সাজানো ঘটনা। চৌ অবশ্যই বুঝেছিলেন চীনের দুই নম্বর বাক্তি হওয়া ভীষণ কঠিন এবং আত্মঘাতী। তার আগের কেউ বেচে নেই। (আমার বিশ্বাস তিনিও ছিলেন না।) অসুস্থ হয়ে না পড়লে তাকেও ‘চার কুচক্রীর’ পাল্লায় পড়তে হতো।
মাওয়ের সঙ্গে আলােচনার চেয়ে সাক্ষাতে যাওয়াটাই ছিল বড় কথা। কারণ তিনি মোটেই নড়াচড়া করতে পারতেন না, আমাদের সঙ্গে দেখা করার আগে তিনি বেশ ক’বার অসুস্থ হয়ে পড়েন। খুব কষ্ট করে দম নিয়ে নিয়ে তিনি কথা বলতেন। ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে আমি যখন আবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই তখন তিনি শুধু ঘড় ঘড় আওয়াজ করতেন। তার সহকারীরা তার কথা লিখে আবার তাকে দেখাতো—যাতে ভুল না হয়ে যায়। মাও সেগুলাে দেখে বললে, তাঁরা তা বলতেন। মৃত্যুর দ্বার-প্রান্তেও মাওয়ের চিন্তা ছিল স্বচ্ছ এবং কথা ছিল রসে ভুরপর। মাও কখনাে স্বগতোক্তি করেননি। অন্যান্য রাজনীতিকের মত বাছাই করা শব্দ তিনি ব্যবহার করতেন না। প্রশ্নের জবাব দিতেন পাল্টা প্রশ্ন করে। মাও সমস্যাকে আঘাত করতেন নির্মমভাবে।
আমি একদিন দেং জিয়াও পিংকে বললাম, “আমরা প্রতিপক্ষের কাছে কোন কিছু চাইনি বলেই আমাদের বন্ধুত্ব দৃঢ় ভিত্তিতে স্থাপিত”। পরদিন মাও আমার এ বক্তব্য খণ্ডন করলেন নির্মমভাবে। বললেন, “প্রতি পক্ষের কাছে আমাদের কারও কোন প্রত্যাশা না থাকলে আপনার পিকিংয়ে কেন এসেছেন—কেনই বা আমরা প্রেসিডেন্টকে এবং আপনাকে স্বাগত জানালাম ?”
এমন এক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমরা দেখা করতে গেলাম। নিক্সনের হাত হাতে নিয়ে স্বভাবসুলভ ফোড়ন কেটে মাও বললেন, “আমাদের উভয়েরই পুরনো বন্ধু জেনারেলিসিম্যে চিয়াং কাইশেক নিশ্চয়ই এটা পছন্দ করছে না।” নিক্সন কমিউনিস্ট বিরােধী দেশ থেকে তার পিকিং ভ্রমণের বর্ণনা দিয়ে বললেন, দেশেরই পররাষ্ট্র নীতি অপরের জন গ্রহণযোগা এবং উভয়ের কারও প্রতি হুমকওস্বরূপ নয়। মাও বলেন, আমরা ফ্রান্স এবং দক্ষিণ কোরিয়ার জন্যও হুমকি হয়ে দাড়াচ্ছি না।
মাওয়ের কথা এত বেশ গূঢ় ছিল যে, তাকে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা যায়। আমি বুঝতে পেরেছিলাম অনেক চিন্তার পরই তার কথা বুঝতে পারা যায়। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ব্যাপারে মাও কোন স্পষ্ট কথা দেননি। তিনি এজন্য চীনের আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রীতাকে দায়ী করেন। তিনি বললেন, যে ব্যবসাবাণিজ্য বা অন্য কোন ছোটখাটো বিষয়ে নিষ্পত্তির আগে বড় বড় বিষয়ের মীমাংসা হওয়া দরকার। “আমরা বুঝেছি যে তোমরা সঠিক। তাই আমরা টেবিল টেনিস খেললাম ।” এতেই আমি বুঝতে পারলাম যে, ব্যবসা-বাণিজ্যের আলোচনা পরে করা চলবে। মােট কথা মাও চান শীর্ষ বৈঠক সফল হোক।
মাও তাইওয়ানের চেয়ে সােভিয়েত সম্পর্কের আলােচনায় বেশি গরম দিয়েছিলেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন যে, প্রথমটি অভ্যন্তরীণ এবং দ্বিতীয়টি আন্তর্জাতিক সমস্যা। সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র এই দুই পরাশক্তির মধ্যে কোনটিকে নিয়ে ভয় বেশি—নিক্সন প্রশ্ন করলে মাও জবাব দেন “বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের আগ্রাসী হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ কোন কোন দেশ থেকে তোমরা সৈন্য প্রত্যাহার করছো এবং আমাদের সৈন্য বাইরে যায় না।”
এর পরের চার দিন কিসিঞ্জার যৌথ ইস্তেহারের খসড়া তৈরি করার জন্য চীনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রায় বাইশ ঘণ্টা বৈঠক করেন।
হ্যাংচৌ-এ বিস্ফোরণ
টেলিভিশন কমেন্টেটর এবং সাংবাদিকরা শীর্ষ বৈঠকের নেতাদের এই ছােটখাটো কথা বা ঘটনার গূঢ় অর্থ খুজছিলেন। চীনের প্রচীরে গিয়ে নিক্সন সাদামাটা অর্থেই বললেন, এটা “গ্রেট ওয়াল।”
ইতিমধ্যে বিভিন্ন ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল। রিশালকায় গ্রেট হল অব দি পিপলে ব্যাংকোয়েটও দেয়া হল। প্রতিটি টেবিলে চীনাদের বােধহয় একটিই করণীয় ছিল। তা হলো প্রতিটি মার্কিনীর থালায় খাবারের টিবি বানিয়ে রাখা। এরপর এলাে অশেষ টোস্টের পালা। আমরা মাওতাই খেলাম। আমার বিশ্বাস এই বিপজ্জনক পানীয়টি অতিদাহ্য বলেই হয়তাে উড়ােজাহাজের জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। একথার প্রমাণও আমি পেয়েছিলাম ওয়াশিংটনে ফিরে নিক্সন যখন স্ট্রিসিয়াকে এ পানীয়টির মাহাত্ম্য বোঝাচ্ছিলেন তখন। নিক্সন এক বােতল মাওতাই একটি গামলায় ঢেলে তাতে আগুন জ্বালালে আগুন বের হওয়ার আগেই গামলাটি ফেটে যায়। টেবিলের উপর তখন মাওতাই জ্বলছিল। অবশ্য কোন জাতীয় দুর্ঘটনা ঘটার আগেই নিক্সন পরিবার আগুন নিভিয়ে ফেলেন।
প্রত্যেকটি চৈনিক পান করার আগে অবশ্যই একজন মার্কিনের সঙ্গে উচ্ছলভাবে ‘গান-বেই’ বলে টোস্ট করে নিচ্ছিল। যার অর্থ উপুর করে খাও। এমন কয়েকটা সন্ধ্যা কাটানোর পর সবাই খুব খুশী ছিল। সৌভাগ্য এই যে, টোস্ট সম্পর্কে আগেভাগেই জানিয়ে দেয়া হত। তবু সাংহাইয়ে ঘটলাে এক ঘটনা। নিক্সন উপস্থিত বুদ্ধিতে টোস্ট করতে গিয়ে এমন কথা বলে বসলেন যাতে মনে হয় দু দেশের মধ্যে কোন সামরিক চুক্তি হতে যাচ্ছে। (নিক্সন বলেছিলেন, “উই জয়েন দি চাইনিজ পিপল, উই দি আমেরিকান পিপল ইন আওয়ার ডেভিকেশন টু দিস প্রিন্সিপাল; দ্যাট নেভার এগেন শ্যাল ফরেন ডমিনেশন, ফরেন অকুপেশন বি ভিজিটেড ডাইনেশন, ফরেন অকুপেশন, বি ভিজিটেড অন(অস্পষ্ট) দিস সিটি অর এ্যানি পার্ট অব চায়না কী(অস্পষ্ট) এ্যানি ইন্ডিপেন্ডেন্ট কান্ট্রি ইন দিস ওয়াল্ড”।) সৌভগ্যক্রমে তখন সেখানে কোন সাংবাদিক ছিল না।
হ্যাংচৌ ইয়াংসি নদীর ভাটিমুখে একটি সুন্দরতম শহর। প্যারিসে চীনা রাষ্ট্রদূত হুয়াং জেন আমাদের মিলিটারী এটা সকে একটা চীনা প্রবাদ বুলেছিলেন। প্রবাদটি হলাে- দুটো শহর দেখার উপযােগী–উপরে স্বর্গ নীচে হ্যাংচৌ। নিক্সন সাদামাটা গদ্যে ভিউকার্ডের মত সুন্দর।
মাকিনী দলের স্ফুর্তি এ শহরের প্রশান্ত নীরবতার সঙ্গে বেখাপ্পা লাগছিল। হ্যাংচৌ ইশতেহরের খসড়া পররাষ্ট্র দফতরের বিশেষজ্ঞদের কাছে দিয়ে সব রজার্স সংশোধনীর এক বিরাট তালিকা পেশ করে।
নিক্সন এতে ভিষন ভড়কে যান। তিনি ভাবছিলেন, ডানপন্থীরা ইশতেহারের দারুণ বিরোধিতা করবে। পররাষ্ট্র বিভাগে ইশতেহরে আমেরিকা যে সুবিধা দিয়েছে রটে গেলে আগুন জ্বলে উঠবে। তিনি এও জানতেন যে, আবার ইশতেহার তৈরির কথা চীনাদের বললে তাঁর পুরাে সফরটাই বিফল হয়ে যাবে। উত্তেজনায় তিনি একটি জাঙ্গিয়া পরে হ্যাংচৌ সুন্দর বাংলোয় অস্থিরভাবে পায়চারী করছিলেন আর বলছিলেন যে, পররাষ্ট্র দফতরকে তিনি দেশ ছাড়াবেন। বহু বছর আগে পিয়ারে হােটেলে আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হওয়ার পর তিনি বহুবার একথা বলেছেন কিন্তু একবারও কার্যকর করেননি। আমি তাকে বােঝালাম যে, খাওয়ার পর আমি খসড়াটি আবার পড়ে দেখি। কিন্তু চীনারা এর কোন সংশোধন করতে না চাইলে আমাদের এটা মেনে নিতেই হবে।
চীনরা খুব খুশী না হলেও মতপার্থক্যগুলো লেখা হয়েছিল। দেশে ফিরে কিসিঞ্জার এ সফরের গুরুত্ব যাচাই করেছেন।
আমি এ যাবত যতনের দেখা পেয়েছি। তদের মধ্যে আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও চীনা নেতারাই শুধু আবেগতাড়িত হয়ে শক্তি ভারসাম্যের রাজনীতি অনুশীলন করতে পেরেছেন। যেখানে আদর্শ ইতিহাস এবং কৃষ্টিকে করেছে এমন রাষ্ট্র চালাতে গিয়ে মাও এবং চৌ দুজনেই নিক্সনকে পেয়েছিলেন একজন স্বাভাবিক বন্ধুরূপে। তা সত্ত্বেও চীনাদের এই আমাদের স্বার্থ অভয় একথা চিন্তা করাও ভয়াবহ। নয়া সম্পর্কের ব্যাপারে আমাদের কোন স্বপ্ন ছিল না। আমরা জানতাম চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেবল একটি সুবিধাজনক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। চীন একাই শক্তিশালী হয়ে দাড়ালে মার্কিন তাকে ছেড়ে যাবে। একঘরে হয়ে যাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে চীন আক্রমণ না করেও সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের সঙ্গে উত্তেজনা পরিহার করে চলতে পারে। চীনের দূরভিসন্ধি যাই হোক না কেন আমাদের অনতিদূর স্বার্থ ছিল সাহায্য করা এবং বিদেশী চাপের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা প্রদান করা।
আগামী সংখ্যায় সমাপ্য।
মধ্যপ্রাচ্যে প্রচেষ্টা
১৯৭০-এর শুরুতে যুদ্ধ দেবতারা তাদের অস্ত্রগুলোর পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। বােঝা গিয়েছিল খুব শিগগিরই এগুলো লাগবে। ইসরাইলী বোমারু বিমান কায়রাে এবং নীল নদের বম্বীপের আকাশ সীমা ভেদ করে অনেক অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ছিল। নীল নদ এবং সুয়েজ খালের তীরে মস্কো সারফেস টু এয়ার মিসাইল বসিয়ে যাচ্ছিল। এই মিসাইল চালাতে এবং রক্ষা করতে মিসরে প্রায় ১৫,০০০ সােভিয়েট কমব্যাট ফোর্স উপস্থিত ছিল। মিসর এবং ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধের বিপদ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলেও ১৯৭০ সালে বিস্ফোরণ ঘটলাে জর্দানে। প্যালেস্টাইনীর তিন মাসে দুই বার জর্দানের বাদশাহ হােসেনকে হত্যার পরিকল্পনা করে। বাদশাহ’র সৈন্যরা ফেদাইনদের উপর এর প্রতিশোধ নিতে শুরু করলে মনে হয় যে ইরাক ও সিরিয়ার সোভিয়েট সমর্থিত সরকার গুলো হস্তক্ষেপ করবে। সেপ্টেম্বরের গােড়ার দিকে অবস্থা আরও জটিল করতে গেরিলারা চারটি বিদেশী বিমান হাইজ্যাক করে আম্মানের ৩০ দূরে একটি এয়ারস্ট্রিপে নিয়ে যায়। সেখানে শত শত যাত্রীকে জিম্মি হিসাবে আটকে রাখা হয়। তারা আটক ফেদাইনদের মুক্তি দাবী করছিল। গেরিলাদের ‘ব্লাক সেপ্টেম্বর’ অভিযান ধীরে ধীরে শুরু হয়ে গিয়েছিল। এতে বাদশাহ হোসেনের ক্ষমতায় থাকাই বিপজ্জনক হয়ে পড়েছিল। অবস্থার গুরত্ব বিবেচনার জন্য কিসিঞ্জার তার ওয়াশিংটন স্পেশাল এ্যাকশন গ্রুপ (ওসাগ ) কাজে লাগালেন। গ্রপের সুপারিশে বিমানবাহিত ইনফ্যান্ট্রি ইউনিটগুলোকে সতর্ক করে দেয়া হল এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগর এলাকায় বিমান এবং জাহাজ ঘোরাফেরা শুরু করল যাতে সােভিয়েট বা তাদের মক্কেল কেন দেশ হস্তক্ষেপ করতে নিরুৎসাহিত হয়।
সােভিয়েট ইউনিয়ন ১০ই সেপ্টেম্বরের দিকে যুদ্ধবিরতি বা জিম্মিদের মুক্তির জন্য চাপ দিলে ফেদাইনদের জন্য তা হলো চরম লাভ। বাদশাহ’র কর্তৃত্ব তাতে অনেক খর্ব হতো। জর্দানে অস্থিতিশীলতা সোভিয়েটের জন্য অধিক সম্মান এবং সুয়েজ খাল এলাকায় নিরপত্তাহীনতা বাড়িয়ে দিতে পরিতাে। কিন্তু অধিক লোভের জন্য তাদের মক্কেলদের লাগামবদ্ধ না করে সোভিয়েট ইউনিয়ন শক্তির ভারসাম্যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটার আগেই আমাদের শক্তি সমান করার সুযােগ করে দেয়।
সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে চারটি বিমানই ধ্বংস করে দিয়েও ফেদাইনরা যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরাইলের কাছ থেকে কোন রকম সুবিধা আদায় করতে ব্যর্থ হয়। আমাদের স্বর ধীরে ধীরে কঠিন হচ্ছিল এবং আমরা প্রায় প্রতি ঘন্টায় আমাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকি। এ অবস্থায় আমাদের শক্তি বৃদ্ধিতে মানসিকভাবে বলিয়ান হয়েই হোক বা ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌছেই হােক— হোসেন ফেদাইনদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করলেন। ১৫ সেপ্টেম্বর আমাদের রাষ্ট্রদূত ডীন ব্রাউন এক জরুরী তারবার্তায় জানালেন বাদশাহ হোসেন রাজধানী আম্মানে আইন-শৃংখলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিশ্বস্ত সৈন্যদের দিয়ে সমগ্র শহর অবরোধ করে হােসেন ১৭ সেপ্টেম্বর তার সৈন্যদের আম্মানে প্রবেশ করার আদেশ দিলেন। এতে জর্দানের উত্তরে আইরবিড পর্যন্ত বিরাট যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লাে।
জর্দানে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ায় লোভীদের নিরৎসাহিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য মোতায়েনের ব্যাপারটি জরুরী হয়ে পড়লাে। নিক্সনের সঙ্গে এই নিয়ে আমি দীর্ঘ আলোচনা করলাম। তিনি উৎসাহভরে সৈন্য মোতায়েনের ব্যাপারটি অনুমোদন করলেন।
সিরিয়ার আক্রমণ
যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য মোতায়েন করায় সোভিয়েটরা খুব ভীত হয়ে পড়লাে। ১৮ সেপ্টেম্বর তারা পুনঃনিশ্চয়তা দিয়ে একটি নোট পাঠালাে । কিসিঞ্জার এতে উৎসাহিত হলেন কিন্তু নিক্সন হলেন না।
নিক্সন সন্দেহ প্রকাশ করে বললেন, সোভিয়েটের এমন নােট পাঠানোর অর্থ হলো এর পিছনে খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তিনি পরে সঠিক বলে প্রমাণিত হন।
২০ সেপ্টেম্বর সকালে সিরিয়ার ট্যাঙ্ক জর্দানে প্রবেশ করলাে। ওয়াশিংটন সময় সকাল ৬টায় বাদশাহ এবং তার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা জায়েদ রিফাই রাষ্ট্রদূত ব্রাউনকে সিরিয়ার ট্যাংক আক্রমণের দুটো বড় ঘটনা জানান। বাদশাহ হোসেন মার্কিন সাহায্য চাইলেন। বেলা সাড়ে বারােটায় বাদশাহের পক্ষে জায়েদ রিফাই সিরিয়ার আক্রমণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে কিনা তা জানার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে জরিপ করতে অনুরোধ করলেন। ঠিক সেই সময়ে সিরিয়ার দুটো আমার্ড ব্রিগেড জর্দান সীমান্ত অতিক্রম করে এবং বৃহওর যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু করে।
আমার কোন সন্দেহ ছিল না যে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। প্রেসিডেন্টকে একটি প্রস্তাব দেয়ার জন্য ঐ দিন সন্ধ্যা সাতটায় আমি ওসাগের সভা ডাকলাম। তখন থেকে পরদিন সকলে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সভা পর্যন্ত আমরা অবিরাম সভা করলাম এবং ফোনের জবাব দিতে থাকলাম।
রাত ৮-২০ মিনিটে আমরা বৃটেনের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে বাদশাহ বিমান আক্রমণ করে সাহায্য করার অনুরােধ করেছেন। বৃটেনের এই খবরে আমরা আমাদের পূর্ব ধারণামত ইসরাইলের অংশগ্রহণ পর্যন্ত নিশ্চুপ থাকতে স্থির করলাম। লক্ষ্য সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট গোয়েন্দাতথ্য ছিল না যাতে তড়িঘড়ি করে আমাদের সৈন্য দিয়ে আক্রমণ করতে পারি। আবার সঙ্গে সঙ্গে সােভিয়েট ইউনিয়নকে নিষ্পৃহ রাখতে আমাদের দ্রুত কাজ করা প্রয়োজন ছিল।
রাত ৯-২৭ মিনিটে সহকারী পররাষ্ট্র সচিব জো সিসকোকে আমাদের প্রস্তাব প্রেসিডেন্টকে জানাতে বললাম। সিসকো সমস্ত তার যােগাযােগ রক্ষা করছিল বলে হােয়াইট হাউসের বিভিন্ন মত ধর সম্পর্কে কম বুঝতো। প্রথমেই আমাদের কাজ ছিল নিক্সনকে খুঁজে বের করা। সিক্রেট সার্ভিসের সহায়তায় আমরা তাকে এক্সিকিউটিভ অফিস বিল্ডিংয়ের বেসমেন্টে স্কিটল বে লিং এলিতে ছিলেন। নিক্সন এক হাতে একটি বল ধরে অত্যন্ত শান্তভাবে অামাদের প্রস্তাব অনুমােদন করলেন। এটা এমন একটা সময় যখন অমি নিক্সনকে কোট এবং টাই ছাড়া দেখি। তিনি বললেন যাই করা হােক না কেন আমরা যেন সফল হই। তিনি সিরিয়ান আক্রমন বন্ধ করতে চাইছিলেন।
জর্দানের শহর আইরবিডের পতন হলো। কিসিঞ্জার ইসরাইলের রাষ্ট্রদ্রুত আইজাক রাবিনকে অনুরােধ করলেন তথ্য প্রদান করতে এবং বিমান ও সেনাবাহিনীর আক্রমণের সম্ভাব্যতা বৃদ্ধি করতে।
২১ সেপ্টেম্বর রাত দুটোয় অামি ঘুমােতে গেলাম, ভাের সােয়া পাঁচটায় অলি হেগা (এনএসসিতে কিসিঞ্জারের অধীনে দ্বিতীয় প্রধান) আমাকে জাগিয়ে বললেন যে রাবিন তাকে তখনি ফোনে জানিয়েছে যে রাবিন তাকে এখনি ইসরাইলীরা মনে করে গ্রাউণ্ড এ্যাকশন প্রয়োজন হয়ে পড়বে। দু তিন ঘন্টার মধ্যে আমেরিকার মতামত পেলে ভালো হয়। ৫-৩৫ মিনিটে আমি প্রেসিডেন্টকে জাগিয়ে রাবিনের সম্মতির কথা বললাম। আমি অনুরোধ করলাম তিনি যেন সকাল ৭-৩০টায় প্রধান উপদেষ্টাদের সভা করে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তার আগে নয়। কিন্তু, নিক্সন আবার ফোন করে বললেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করো না। তাকে (রাবিনকে) বলো শুরু করতে। আমি চাইছিলাম না প্রধান উপদেষ্টাদের পরামর্শ ছাড়াই সােভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে যুদ্ধের ঝুকিঁ নেন। ইসরাইলী সৈন্য বাহিনীর আক্রমণে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বেধে যেতে পারতাে। আমি সিসকোর সঙ্গে পরামর্শ করলাম—সিসকো বলেন, প্রেসিডেন্ট ঠিকই করেছেন, রজার্সের সঙ্গে আলাপ করলাম ৷ তিনি বললেন জর্দানের লিখিত অনুরােধ ছাড়া এটি করা উচিত নয়। প্রতিরক্ষা সচিব মেলভিন লেয়ার্ডের সঙ্গে আলাপ করলাম। তিনি গোয়েন্দা বিভাগের পরামর্শ মত চলার কথা বললেন। সকাল ৭-১০-টায় আমি প্রেসিডেন্টকে সভা ডাকার জন্য আবার অনুরোধ জানালাম মত পার্থক্যের কথা বলে। এবার তিনি নিমরাজী হলেন। অামরা ইসরাইলের বিমান হামলায় এক মত ছিলাম—সৈন্য বাহিনীর অাক্রমণ নিয়ে অামাদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। আমার মনে হয়নি যে এ নিয়ে আমাদের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত জরুরী ছিল। কারণ সৈনা সমাবেশ করতে ইসরাইলের অন্তত দুদিন সময় লাগতাে। আর সৈন্য সমাবেশ না করে তার কোন উপায় ছিল না তাতে আমরা যাই মনে করি না কেন। কারণ সিরিয়াকে সে জয়ী হতে দিতে পারে না। বাদশাহ হে সেন দু’দিন টিকে থাকতে পারলে আমরা এক শ্বাস ফেলতে পারতম-এর মধ্যে সিরিয়ার উপর যে চাপ সৃষ্টি হতো তাতে আপনা আপনি সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো।
ঝুঁকির অংক
২১ সেপ্টেম্বর সকাল ৮-৪৫টায় এনএনসি র বৈঠক শুরু হল। আমাদের আলোচনার সূত্রপাত হলো গ্রাউন্ড অপারেশনের ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী কি হবে এ নিয়ে। কিন্তু, শীঘ্রই তা সমস্যা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে এই বিতর্কে পরিণত হলাে। যারা খুব ধীরে অগ্রসর হওয়ার পথ পছন্দ করছিলেন তাদের মনে ভয় ছিল সােভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। আমি এবং নিক্সন মনে করতাম যে এতে সমস্যা আরও জটিল হয়ে যেতে পারে। সোভিয়েটের সঙ্গে এক হাত লড়াই যদি এড়িয়ে যেতেই হয় তবে অামাদের উচিত দ্রুত এমন একটি ঝুঁকির অংক সৃষ্টি করা যাতে সোভিয়েট ইউনিয়ন অমাদের ধীর পদক্ষেপের সঙ্গে তাল রেখে অগ্রসর হতে আগ্রহী না হয়। রজার্স চাইছিলেন সিরিয়া আরও দক্ষিণে অগ্রসর হলেই আমাদের কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত, আমি মনে করতাম তথাকথিত মুক্ত এলাকা থেকে সব সিরিয়া সৈন্যের অপসারণের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হতে পারে। নিক্সন সিদ্ধান্ত নিলেন যে সিসকোর ইসরাইলকে জানিয়ে দেবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আরেকবার আলােচনা করে ইসরাইল গ্রাউন্ড অপারেশন চালাতে পারে। অামাদের পদক্ষেপে এবং সিরীয়া বিমান বাহিনীর বিমানগুলাে বন্ধ না করায় জর্দানী বাহিনী আইরবিডের চারদিকে সিরীয় ট্যাংকের উপর আক্রমণ চালাতে শান্ত করে এতে সিরিয়া ১২০টি ট্যাংক হারায়। ছ’দিনের যুদ্ধের তিন বছর পরও যে ১৭,০০০ ইরাকী সৈন্য পূর্ব সিরিয়ায় অবস্থান করছিল তারা একদম নিষ্ক্রিয় থাকে। মিসর আমাদের জানায় যে সােভিয়েট ইউনিয়ন জর্দানে সিরিয়ার ভূমিকা পুনঃবিবেচনার জন্য সিরিয়ার প্রতি অনুরােধ জানিয়েছে। গােলান মালভূমিতে ইসরাইলী সৈন্য বাড়ানাে চলতেই থাকলাে এবং চাপ অব্যাহত রাখার জন্য আমরা আমাদের কাজও বাড়িয়ে দিলাম। সংকটকালে যখন বিপক্ষ দল সমাঝোতা করতে চায় বলে মনে হয় তখন সব কাজে ঢিলে দেয়ার প্রবণতা সংকট উদ্ধারের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। এটা সবচেয়ে বিরাট ভুল। সংকট উওরন করেই বা কিভাবে তা সমাধান করা হবে আলোচনা করেই কেবল সমঝোতায় পেীছানো সম্ভব। তা না হলে শেষ মুহূর্তের সন্দেহে সমাধান নাও মিলতে পারে। ১৯৫১ সালে কোরিয়ার যুদ্ধে যুদ্ধবিরতি -আলোচনা দীর্ঘায়িত হয়েছিল আক্রমণ বন্ধ করে দেয়ার জন্য। ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনামে বোমাবর্ষণ বন্ধ করার সময়েও একই যুক্তি দিতে পারতাম।
সিরিয়ার সৈন্য প্রত্যাহারের প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্তেও আমি ভূমধ্যসাগরে অামাদের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য চাপ দিচ্ছিলাম। ২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সিরিয়ার সৈন্য প্রত্যাহার করে না নিলে আমরা সর্বাধিক চাপ প্রয়ােগ করতাম। ইসরাইল হয়তাে আক্রমন করে বসতে বা আমরা ধোঁকা দিতে শুরু করতাম। এতে যুদ্ধ আবার বেধে যেত কিংবা সিরিয়া বাদশাহর অস্তিত্ব বন্ধক রেখে মুক্ত এলাকা দখল করে থাকতো। তাই চারটি ডেস্ট্রয়ার ভূমধ্যসাগর অভিমুখে রওয়ানা হলাে দুটো আক্রমণকরী সাবমেরিন জিব্রাল্টার প্রণালী পার হয়ে গেল। সম্ভাব্য সোভিয়েন্ট হস্তক্ষেপের পাল্টা পরিকল্পনা হতে থাকলো। ২৩ সেপ্টেম্বর দুপুর ২-৫০টায় আমরা খবর পেলাম সিরীয় ট্যাংক প্রত্যহারী করা হচ্ছে। সংকটের উত্তরণ এভাবেই হলো।
পাক-ভারত যুদ্ধ
১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাচিছল। পূর্বাঞ্চল পুরো স্বাধীনতা না হলেও স্বায়ত্তশাসন অর্জন করতে যাচিছল। এতে গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। পূর্বাঞ্চলের সাড়ে সাত কোটি লোক ১৯৬১ সাল থেকে সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। এবার ইয়াহিয়ার পাঞ্জাবী সৈন্যরা পূর্বাঞ্চলের স্বাধীকার দাবীতে ক্রুদ্ধ হয়ে খুনে উম্মত্ত হয়ে উঠলাে। এতে প্রায় ৮০ লাখ বাঙালী শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থীরা তার দেশে নানা সমস্যার সৃষ্টি করছে এই দাবী করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কিছু করার ইঙ্গিত দিচিছল। কিসিঞ্জারের মতে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ঘৃণীত প্রতিবেশীকে ভেঙ্গে ফেলার জন্য শরণার্থী সমস্যাকে কাজে লাগাচিছলেন। (এখানে কিসিঞ্জার উল্লেখ করেন যুক্তরাষ্ট্র শরণার্থীদের জন্য ৯২ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয় যা অন্য কোন দেশ এককভাবে দেয়নি।) কিসিঞ্জার চাইছিলেন পূর্বাঞ্চল ধীরে ধীরে স্বাধীন হােক। কিন্তু, ভারত ধীরে ধীরে সমাধানের ব্যাপারে অধৈর্য হয়ে পড়ে। আগস্ট মাসে জোটনিরেপক্ষ ভারত সোভিয়েট-ভারত বন্ধুত্ব চুক্তি করে মস্কোর সঙ্গে জোট বাধে। কিসিঞ্জার লিখেছেনঃ চুক্তি স্বক্ষর করে মস্কো বারুদে জলন্ত দেশলাই ছুড়ে দেয়। নবেম্বরে ইন্দিরা যখন নিক্সনের সঙ্গে দেখা করেন তখন পাক-ভারত যুদ্ধের গুজব ছড়িয়ে পড়ে।
পূর্বাঞ্চলে আক্রমণ
নেহেরু তনয় ইন্দিরা গান্ধী এবং নিক্সন দুভাগ্যজনকভাবে একে অন্যের প্রতি গ্রহণযোগ্য ছিলেন না। নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের উত্তরাধিকারী বলে ইন্দিরার ধারণা এবং তার রহস্যময় নীরবতা নিক্সনের ভেতর নিরাপত্তাহীনতা জাগিয়ে তােলে। উন্নয়নশীল দেশগুলাের পু’জিবাদকে ঘৃণা করার ফ্যাশন এবং তাঁর বুদ্ধিজীবী বন্ধুদের কাছ থেকে শোনা নিক্সনের গল্প পুরোটাই মিথ্যা নয় এমন একটি ভাব তার আচরণে ফুটে উঠেছিল। নিক্সন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের উপর, যে মন্তব্য করেন তা ছাপার অক্ষরে লেখা যায় না। নিক্সন ওভাল অফিসে বিদেশীদের সঙ্গে যে দুটো ব্যর্থ সাক্ষাৎ দিয়েছেন তা হলাে ৪ ও ৫ নবেম্বর ইন্দিরার সঙ্গে। ইন্দিরা ভিয়েতনাম এবং চীনের ব্যাপারে নিক্সনকে এমনভাবে প্রশংসা করলেন যেন একজন অধ্যাপক একজন পিছিয়ে পড়া ছাএকে পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দিচেছন। তাঁর প্রশংসার সমস্ত ঔজ্জ্বল্য নিষ্প্রভ হলাে যখন তিনি বলেন যে নিক্সন চীনের সঙ্গে যা করেছেন তা গত দশকেই করার জন্য ভারত সুপারিশ করেছিল।
ইন্দিয়ার জ্যাঠামো দেখার পর্যাপ্ত সময় নিক্সনের ছিল না। তিনি চিন্তা করছিলেন ইন্দিরা নিশ্চয়ই তাঁর উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তার চেয়ে বেশ নীতি মেনে চলে তিনি ইন্দিরাকে ক্ষমতা অাঁকড়ে থাকার জন্য স্থির বুদ্ধি রাজনীতিক বলে ধরে নিলেন। ১১ আগস্ট নিক্সন সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের সভায় অবশ্য বলেছিলেন ইন্দিরার বদলে তিনি হলেও হয়তো একই ব্যবহার করতেন। তিনি এবং আমি মুখােমুখি হতে চাইনি। একটি যুদ্ধ আমাদের ভৌগােলিক-রাজনৈতিক অবস্থান পাল্টে দিতে পারতো। অামরা ও নিয়েছিলাম পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ছিল অবশ্যাম্ভাবী এতে হয়তো সময় কিছু বেশি লাগতে পারে। মিসেস গান্ধী ঠিকই বুঝেছিলেন নিক্সন কি করতে চান। তিনি নিজেও সংকট সৃষ্টিতে যথেষ্ট কাজ করেছেন। এখন তা ঠিকঠাক মত গুছিয়ে তুলতে না পরলে তার নিজেরই ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। নিক্সনের প্রতি তাঁর যে তাচিল্য প্রকাশ পেয়েছিল তার কারণ হয়তো এই ছিল যে লােকটির আন্তর্জাতিক বিষয়ে ধারণা তাঁর (গান্ধীর ) ধারণার সঙ্গে অস্বস্তিকর সাদৃশ্যজনক ছিল।
মিসেস গান্ধী সম্পর্কে আমার ধারণা নিক্সনের অনুরূপই ছিল। তবে আমি তার মাতব্বরী ব্যক্তিগতভাবে নেইনি। কারণ ভারতীয়দের আচরণে এমন কিছু নেই যাতে জননণ বা প্রতিবেশীর প্রতি নৈতিক সদা চরণের কোন বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ভারতীয় নেতাদের নীতিবাগিশত আমার কাছে মনে হয়েছে উদার ও সামান্য সমাজতন্ত্রী পাশ্যত্যের অপরাধবোধকে ব্যবহার করার জন্য প্রণােদিত।
নিক্সন যে জন্য সময় চাইছিলেন ইন্দিরা সে কারণেই বিয়টি শিগগীর শেষ করতে চাইছিলেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ভারতের বো-দ্রাদিগতকে জোরদার করতো। এটা ভারত বিভক্ত করে আরও মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতো। তাই নয়দিল্লী চাইছিল বাংলাদেশের জন্ম এমনভাবে হােক যাতে উপমহাদেশে ভারতের প্রাধান্য বজায় থাকে।
ইয়াহিয়া পুর্বান্চলে ১৯৭১ সালের মধ্যেই বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কথা মেনে নিয়েছিল। এতে অবশ্য পূর্বান্চলের স্বায়ত্তশাসন দেয়া হতো। উত্তেজনা কমিয়ে আনার জন্য তিনি ভারত সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে আনার কথাও মেনে নিয়েছিলেন। তবু, নয়াদিল্লী পাকিস্তানের বাবস্থায় খুশী হয়নি। ইন্দিরার ওয়াশিংটন ত্যাগের ঠিক ১৭ দিন পর পাকিস্তানী বেতারে বলা হয় যে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়েছে।
আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমাদের পাক-ভারত যুদ্ধ দেখতে হবে এবং ভারত _ তা শুরু করেছে। এবং আইনের অাবরণের কোন তােয়াক্কাই সে করেনি। আমি মনে করতাম—নিক্সন আরও দূঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন সমাধানের পথ বন্ধ করার জন্য ভারত ধীরে ধীরে তার দাবীনামা বাড়িয়েছে। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানিদের অত্যাচার পাশবিক ছিল ঠিকই এবং শরণার্থীরা ভারতের অর্থনীতির উপর এক বিরাট বােঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু, যুদ্ধের অন্যতম কারণ উপমহাদেশে ভারতের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা।
সােভিয়েট ইউনিয়ন ভারতকে নিবৃত্ত করতে পারতো—সে তা করতে চায়নি। বরং সক্রিয়ভাবে উৎসাহ দিয়েছে। পাকিস্তানের দূরবস্থায় সুযােগ নিতে যাতে আমাদের মৈত্রীতে একটা ঘুষি মারা যায় এবং চীনের অসারতা প্রমাণ করা যায়। এই বিষয়ে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ একই ছিল বলে যুক্তরাষ্ট্রের নিস্ক্রিয়তায় চীনের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক জটিল হতে পারতো। আমরা আন্তজার্তিক রীতি রক্ষা ব্যাপারটিও দেখেছিলাম না। ঘটনার শিকার হয়েছিল আমাদের এমন এক মিত্র যার সঙ্গে আমরা ওয়াদাবদ্ধ ছিলাম। ১৯৫১ সাল থেকেই উভয়ের মধ্যে পরিষ্কার চুক্তি ছিল এবং তা অন্যান্য সমঝােতার মধ্য দিয়ে দৃড়বদ্ধ ছিল। এসব চুক্তির সারবস্তু নিয়ে কেউ কেউ বিতর্ক করতে পারেন কিন্তু, আমাদের তা অস্বীকার করার উপায় ছিল না । এমন কি পাকিস্তান যখন ১৯৫৯ সালের চুক্তি অনুযায়ী আমাদের কাছে সাহায্য চাইলো তখন পররাষ্ট্র বিভাগ খােলা খুলি বলে বসলো যে আমরা কোন রকম ভাবে দায়বদ্ধ নই। একটি বিরাট জাতির এভাবে আইনের ফাঁক খুজে বেড়ানোয় অন্যন্য মিত্ররা বিশ্বস্ত হতে পারে না। বিষয়টি আমাদের উপর ফেটে পড়লাে যখন আমরা চীনের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষার জন্য পাকিস্তান ছাড়া অন্য কোন সূত্ৰ খুজে পাইনি। আর যদি চীনের বন্ধু, এবং আমাদের মিত্রের হেনস্থা বন্ধ করার জন্য সোভিয়েটের সঙ্গে সংঘর্ষে নিমজ্জিত হতাম। তবে সারা বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য ভেঙে পড়তাে। সােভিয়েটের অস্ত্রধারী একজন মিত্রের শক্তিমদমত্ততা সমগ্র আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতিই হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল এমন এক সময় যখন যা মধ্যপ্রাচ্যের নীতি দিয়ে প্রমাণ করতে চাইছে শক্তি ব্যবহারের অসারত্ব। এবং সেই সময় ইন্দোচীনের পর একটি ফ্যাক্টর হিসাবে আমাদের গুরুত্বও অনেকখানি কমে গেছে। পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করার কোন প্রয়ােজন ছিল না। আমি এবং নিক্সন উভয়েই মনে করতাম পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা এমন অবশ্যম্ভাবী ছিল যে এজন্য যুদ্ধের কোন প্রয়োজন ছিল না। আমরা চইছিলাম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পশ্চিমপাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে কারণ ভারত চাইছিল তাকেও টুকরো টুকরাে করে ফেলতে। আমরা চাইছিলাম যে সােভিয়েট অস্ত্র এবং কূটনীতি সংকট মােকাবিলায় অপরিহার্য বলে গৃহীত না হোক। এ কৌশল কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব ছিল কারণ আমাদের বিভিন্ন বিভাগ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করতো। তারা ভারতকে চটাতে ভয় পেতো ; মনে করতো আমরা যাই করি না কেন পাকিস্তান হারবেই, তা জানতাে আমাদের পথ কংগ্রেস এবং গণমাধ্যমের কাছে অপ্রিয় ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের ভেতর কোন বিচ্যুতি দেখা দিলে তা ভারতের পক্ষেই যাবে।
এ পরিস্থিতিতে ওসাগ একটি পথ খুজে বের করার জন্য ৩ ডিসেম্বর মিলিত হলাে। এ সভার খবর কলামিস্ট জ্যাক এড়াঙ্গনের কাছে ফাঁস করে দেয়া হয়। বিচিছন্নভাবে দেখলে এতে মনে হবে হোয়াইট হাউস নিজের ইচ্ছামত কাজ করতে চাচ্ছে কিন্তু গত কয়েক মাসে ব্যুরোক্রেসি প্রেসিডেন্টের চরম নির্দেশের পথে যেমন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা বিবেচনা করলেই সব কিছু অনুধাবন করা যাবে। সিচুয়েশন রুমে আমি বলেছিলাম প্রায় আধা ঘণ্টা পর পরই প্রেসিডেন্ট আমাকে ধমকাচেছন যে আমরা শক্ত নই। কিন্তু, তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করছিলেন না যে আমরা তার ইচছা মতই কাজ করছিলাম। তিনি চান পাকিস্তনের দিকে ঝুঁক্তে এবং মনে করছেন যে প্রত্যেকটি ব্রিফিং বা স্টেটমেন্ট তার উল্টো দেয়া হচ্ছে।”
অমি যত বাঁকা কথাই বলতাম না কেন। বিভাগগুলাের দূর্বলতা তাতে একটুও কমেনি। আমি যখন প্রেসিডেন্টের ইচছানুযায়ী ভারতকে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করে দিতে বললাম, পররাষ্ট্র বিভাগ পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও একই পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করে—যদিও প্রেসিডেন্ট মনে করতেন ভারতই অপরাধী। এ সবের ফলে আমি আরেকটি উল্টো কথা বললাম, “প্রেসিডেন্টের ইচছামত পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতি দেখানাে অসম্ভব। প্রত্যেকবারই যদি ভারতকে কেন্দ্র করে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় তবে পাকিস্তনের ব্যাপারেও আমাদের একই কাজ করতে হবে।”
পশ্চিমাঞ্চল বিভক্তি
ডিসেম্বরের ৭ তারিখে ইয়াহিয়া অমাদের জানালেন যে পাকিস্তানি খণ্ড বিখন্ড হয়ে যাচেছ এবং ব্যাপারটি পূর্ব পাকিস্তনের স্বায়ত্তশাসন ছাড়িয়ে অনেক দূরে গিয়েছে। আমরা কিন্তু সূত্রে খবর পেলাম যে ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানকে পঙ্গু করে ফেলতে চান, বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত জাতিসংঘের কোন যুদ্ধ বিরতিও তিনি মানবেন না এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কাশ্মিরের পাকিস্তানী অংশ মুক্ত করার জন্য তার সৈন্যরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে এবং পাকিস্থানে সেনাবাহিনী এবং বিমান বাহিনীকে নিঃশেষ করে দেবে। যার অর্থ পশ্চিম পাকিস্তনকে খণ্ড খন্ড করে প্রতিরক্ষাহীন করে রাখা। মিসেস গান্ধী তার সহকারীদের একথাও বলেছেন যে চীন কিছু করতে এলে সোভিয়েট ইউনিয়ন প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অন্যান্য গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায় এর অর্থ -সিন কিয়াং এ সােভিয়েট আক্রমণ। পাকিস্তানের চীন-রুশ যুদ্ধসহ এমন চাপ সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না।
এই প্রেক্ষিতে আমি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলি যে আমরা ১৯৭১-এর মার্চে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের অত্যাচার ক্ষমা করে দেইনি, পাকিস্তানের সামরিক সহায্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং কলকাতায় পাকিস্তান সরকার এবং বাংলাদেশের কর্ম কর্তারা যাতে রাজনৈতিক বিষয়ে আলােচনা করতে পারেন সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা জাতিসংঘে এবং এতে পক্ষে ১০৪ এ বিপক্ষে ১১ যুদ্ধবিরতি এবং সৈন্যাপসারন প্রস্তাব তুলি ভােট পেয়ে জয়ী হই। বিগত এক দশকে আমরা এই একটি বিষয়েই আন্তর্জাতিক সমাজে এত অধিক সমর্থন লাভ করি। কিন্তু আমাদের ব্রিফিং বা এ সমর্থন কে নটাই গণমাধ্যম এবং কংগ্রেসের সমালোচনাকে নরম করতে পারেনি।
১২ ডিসেম্বর সকালে অামি এবং নিক্সন ফরাসী প্রেসিডেন্ট পম্পিডুর সঙ্গে আজোরে দেখা করতে যাওয়ার আগে আমি নিক্সন এবং আল হেগ ওভাল অফিসে এক সভায় বসলাম। নিক্সন প্রশাসনের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিরক্ষা সচিব বা তাদের বিভাগের কোন প্রতিনিধির পরামর্শ না নিয়েই রুশ-চীন-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুদ্ধ বাধানোর যুক্তি এ সভায় নেয়া হয়েছিল।
বেলা ১১-৩০টায় আমরা হট লাইনে নিক্সনের নামে ব্রেজনেভের কাছে একটি তার বার্তা পাঠালাম। (নিক্সন প্রশাসন এই প্রথম হট লাইন ব্যবহার করেন এবং ১৯৭০ সালে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের সময় ব্রেজনেভ তা ব্যবহার করেন।) আসলে এই লাইনের চাইতে সােভিয়েট দূতাবাসের মাধ্যমে মস্কো-ওয়াশিংটন যােগাযোগ দ্রুততর হতো। কিন্তু এই লাইন জরুরী বলে মনে করা হতাে এবং এতে সোভিয়েট সিদ্ধান্ত দ্রুত হতে পারতো। এক পৃষ্ঠার এই বার্তায় বলা হয় যে জাতি সংঘের নিরাপওা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র একটি বিশেষ কাজ শুরু করে দিয়েছে। এবং এটা পাল্টানাে সম্ভব নয়। এতে শেষ লাইনটি ছিল “আমি দৃঢ় ভাবে বলতে পারি না যে আমরা উভয়েই যে ফলশ্রুতি কামনা করি না তা আমরা এড়িয়ে যেতে পারবাে।”
ঠিক আমরা যখন বার্তাটি পাঠানো শেষ করলাম সে সময় জাতিসংঘে চীনের দূত হুয়ং, হুয়া পিকিং থেকে একটি জরুরী বার্তা নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। চীনের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম কারণ তারা যে কোন বার্তায় প্রতিপক্ষ সাক্ষাৎপ্রার্থী না হওয়া পর্যন্ত রেখে দেয়। বিবেচনা করেই তারা রীতি ভঙ্গ করেছে। আমাদের অনুমান ছিল যে চীন পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দিতে আসছে। তাই যদি হয় তাহলে আমরা শক্তি পরীক্ষার দ্বারে এসে দাঁড়িয়েছি। কারণ আমরা জানতাম যে চীন যদি সামরিক সাহায্য দেয় তবে সােভিয়েত ইউনিয়ন চীনের বিরুদ্ধে বিশ্ব শক্তি ব্যবহার করবে।
নিক্সন তৎক্ষণাৎ বুঝেছিলেন যে সোভিয়েট চীনকে হেনস্থ করতে পারলে বিশেষ শক্তি ভারসার্মের সকল ধারণাই উবে যাবে। তিনি সিন্ধান্ত নিলেন যে, সোভিয়েত চীনের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করলে আমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবাে না। আমি এ সিন্ধান্ত সমর্থন করি। যে দেশটিকে আমরা স্বীকৃতি দেইনি এবং যে দেশের সঙ্গে দুই দশক ধরে আমাদের কোন যোগাযােগই নেই সেও আমাদের কাছ থেকে বিশেষ সাহায্য পেতে যাচিছল যার পরিমাণ প্রয়ােজন অনুযায়ী নির্ধারণ করা হতো। মস্কোর প্রেরিত বার্তা এবং আমাদের রণকৌশলের জন্য সামান্য সাময়িক কাজ করা প্রয়োজন ছিল। মালাক্কা প্রণালী দিয়ে যে বিমানবহী জাহাজ আসছিল তাকে বঙ্গোপসাগরে প্রস্তুত থাকতে বলা হলাে।
অসলে আমরা যা মনে করেছিলাম চীন তা চায়নি। বরং তারা জাতিসংঘের ব্যবস্থাই মেনে নিতে চাইছিল। প্রায় ৪৮ ঘন্টা আগে নিউইয়র্কে এক গোপন সফরে গিয়ে আমি হুয়াং হুয়াকে বলেছিলাম, সৈন্যপসারণ এবং যুদ্ধবিরতি চেয়ে শুধু, যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে। নিক্সন যখন তার সাহসী আদেশটি প্রদান করেন তখন এটা জানতেন না। অামরা যা ভেবেছিলাম তাই যদি ঘটতাে তাহলে সরকার, গণমাধ্যম এবং কংগ্রেসের সম্ভাব্য বিরোধিতা সত্ত্বেও আমাদের চীনকে সাহায্য করতে হতো।
অনিশ্চয়তার সীমারেখা
আমাদের নৌবহর বঙ্গোপসাগরে পৌছলে পত্রিকাগুলাের দৃষ্টি সেদিক যেয়ে পড়ে। আমরা কি ভরতকে ভয় দেখাচ্ছি ? আমরা পূর্ব পাকিস্তান রক্ষা করতে চাইছি? আমরা কি পাগল হয়ে গেছি? এগুলো, সবই ছিল সাধারণ কথা। পশ্চিম পাকিস্তান এক ঘূর্নিঝরে পরার আগ পর্যন্ত যুদ্ধ শেষ করতে আমরা ৭২ ঘন্টা সময় পেয়েছিলাম। ভারতের সৈন্য প্রত্যাহার করতে এমন সময়ই লাগতাে। সােভিয়েতকে সতর্ক করে দেয়া আমাদের প্রয়োজন ছিল এবং চীনকে সাহায্য করার জন্যও তৈরি থাকা উচিত ছিল। এই টাস্ক ফোর্স বঙ্গোপসাগরে নিয়ে যাওয়ায় নয়াদিল্লী এবং মস্কোকে সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য চাপ দেয়া যাচ্ছিল।
অজোর থেকে ফিরে আসার পথে বিমানবাহিনীর সাংবাদিক পুলে আমি বলেছিলাম যে, উপমহাদেশে সােভিয়েতের আচরণ পারষ্পরিক সহাবস্থান এর ক্ষেত্র সৃষ্টি করছে না । এটা চলতে থাকে উভয় দেশের সম্পর্ক পূর্নমূল্যায়ন করতে হবে।
এ খবরটি মস্কো পৌছেছিল এবং ১৬ ডিসেম্বর সকালে আমরা খবর পেয়েছিলাম যে, মস্কো দিল্লীকে চাপ দিচ্ছে কাশ্মীরসহ সবখানে তাৎক্ষণিক অবস্থা মেনে নিতে। সেদিনই মিসেস গান্ধী যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব দেন। আমার কোন সন্দেহ নেই যু্ক্তরাষ্ট্রের জন্যই সোভিয়েত ইউনিয়ন চাপ দিয়ে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়েছে। সঙ্কট শেষ হল। আমরা সবচেয়ে খারাপ দিকটি এড়িয়ে যেতে পারলাম যা কোন কোন সময়ে অনেক রাষ্ট্র নেতারাই পারেন না।
নিক্সন আমলের প্রথম পর্বে পাক-ভারত যুদ্ধ ছিল একটি অত্যন্ত জটিল ব্যাপার, যে ঝুকি ছিল অত্যন্ত বেশি। এখনও আমার বিশ্বাস যে, মিসেস গান্ধী পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থায় যুদ্ধ করতে উৎসাহী হননি। আমরা ইয়াহিয়াকে যে সময় সামরিক আইন তুলে বেসামরিক সরকার চালু করতে রাজী করেছিলাম তিনি সেই সময় আক্রমণ করেন। এতে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যেতো কিন্তু পাশবিকতা এত চরমে উঠতো না।
এ বিষয়ে আমাদের ব্যবহারের কারণ বলা হয়েছে ব্যক্তিগত শত্রুতা ভারত-বিরােধী পক্ষ পাতিত্ব, দুঃখভােগের প্রতি নিস্পৃহতা এবং অনৈতিকতা কে আমরা যদি অন্য (অস্পষ্ট) করতাম তাহলে পূর্ব অংশ হারানোর পরও পাকিস্তান কাশ্মীর, বালুচিস্তান এবং আরো অনেক অংশই হারাতো যা (অস্পষ্ট) পাকিস্তান ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যেত। এই সঙ্কটের ফলে প্রমাণিত হয়েছে যে, নিক্সন এবং আমি সরকারের উপর অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে আছি বলে কোন খবর বের হতে পারছে না সে ধারণা ভুল। সত্য জনশ্রুতির ঠিক উল্টো। হোয়াইট হাউস প্রাধান্য বিস্তার করে ছিল না—বিভাগগুলােই বাধা সৃষ্টি করতো। পরিষ্কার কোন নির্দেশ না দিয়ে আস্ফুট চেষ্টা চালানো হতো। যাতে পছন্দমাফিক পথ প্রহণ করা যায়, বিভিন্ন সংস্থা মতামত ব্যক্ত করতে ব্যর্থ হয়নি বরং চীফ এক্সিকিউটিভ তার মতামত কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছেন। নিক্সন প্রশাসন যে পথে চলছিল তা ছিল মূর্খের এবং বেশিদিন চলার অনুপযােগী একথা স্বীকার করতে হয় যে, এগুলো শুন্যের উপর ভর করে চলেনি। নিক্সনকে প্রশংসা করতে হয় প্রচন্ড জনমতের বিপক্ষে দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহন সমস্ত বিষয়ে অধিকার এবং সাহসের জন্য।
তার প্রশাসন ছিল ধুর্ত এবং মানবতাকে এজন্য মূল্য দিতে হয়েছে। তবু সাধারন রীতিতে যে সাফল্য লাভ সম্ভব নয় তেমন সাফল্য অর্জনকারী ঘটনার কথা ইতিহাসে অবশ্যই লেখা থাকবে।
রাষ্ট্র যন্ত্র
কিসিঞ্জার এ্যাপ্রেন্টিস স্টেটম্যান হিসেবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যোগদান করেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় একজন অভিজ্ঞ হিসেবে সে পদত্যাগ করেন। এখানে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কে তার কিছু মন্তব্য দেওয়া হল।
সিদ্ধান্ত গ্রহন
মানুষ ক্ষমতায় গেলে শিকড় গজায় বলে যে প্রবাদ রয়েছে আমার ক্ষেএে তা মিথ্যা প্রমানিত হয়েছে। আসলে উচ্চপদ মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে শেখায় সে বিষয় নয়। এটা বুদ্ধিবৃত্তিকে ব্যবহার করে সৃষ্টি করে না। উচ্চপদস্ত ব্যাক্তিরা যে জ্ঞানও অন্তদৃষ্টি নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেন তা নিয়েই তারা ক্ষমতা ত্যাগ করেন; কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত গ্রহন করা উচিত তা শেখেন না। মন্ত্রনা পরিষদের সবগুলো বিভাগের (অস্পষ্ট) হলাে প্রেসিডেন্টের সিন্ধান্ত গ্রহনের পথ সংকুচিত করে দেয়া প্রশস্ত করা নয়। এগুলো একটি পছন্দসই নীতিতে চলার জন্য সংঘবদ্ধ এরা অনেক পথ বেছে নেয় না। যদি এদের বিভিন্ন মতামত দিতে বলা হয় তবে এর দুটো প্রায় অবাস্তব পরামর্শ এবং তার মধ্যে (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দ্বিতীয়টি) আর একটি পছন্দমত মন্তব্য জুড়ে বসে থাকবে। যে কোন অজ্ঞ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী চোখ বুজে দুই নম্বর সিদ্ধান্ত বেছে নিয়ে তার বিভাগীয় সহকর্মীদের তুষ্ট রাখতে পারেন।
একজন প্রেসিডেন্ট বির্তকিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ বিলম্বিত রেখে তার এুটিটাকে এরিয়ে যেতে পারেন না। সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে বিসমার্কের বিখ্যাত উক্তি আগেই ভেবে দেখতে হবে। “যে রাষ্ট্রনায়কের কাছে যুদ্ধ করার পক্ষের যুক্তিগুলো যুদ্ধের পরও সমান ভাবে আদৃত না হয় তার কপালে দুঃখ। শক্তি ব্যবহার করবেন কিনা এটা হচ্ছে একজন নেতার মৌলিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে অবশ্যই জয়লাভ করতে হবে। মধ্যপন্থা অবলম্বন করে যে হেরে যায় তার জন্য কোন পুরষ্কারই নেই। কোন জাতিরও উচিত নয় সেসব যুদ্ধের বা কূটনৈতিক আলোচনা বা কাজ শুরু করা যার শেষ সে দেখতে চায় না।
গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত অপ্রস্তুত অবস্থায় সাধারন সভায় গ্রহন করলে কোন সঠিক সিদ্ধান্তের প্রেসিডেন্ট বা সহকারীদের তুষ্ট করার কারণে; মূল জোর এুটিপূর্ন হতে পারে। কেনেডি এবং জনসন প্রশাসনে এ এুটিটি ছিল বলে আমার মনে হয়। আবার সভাগুলো খুব বেশি ফর্মাল হলে এবং প্রেসিডেন্ট ব্যুরোক্রেসির সিদ্ধান্তের কাছে তার বিচারশক্তিকে নত করে ফেললে যেমন অ ই-সেনহাওয়ার করতেন। তিনি শুধু, একটি গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুমাদন বা প্রত্যাখ্যান করার কাজ করতে শুরু করেন। এট প্রেসিডেন্ট মাঝে-মধ্যে নিজের ইচছা খাটিয়ে দূর করতে পারেন, কিন্তু এ ধরনের সাময়িক সিন্ধান্ত পুরােপুরি সাময়িক হিসেবেই থেকে যায়। কারণ পূর্বের অনুসৃত পথ তার সামনে বিকল্প সিধান্ত গ্রহণের পথ খােলা রাখে না।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, প্রতেকটি সমাজই অবক্ষয় এবং ধ্বংস প্রত্যক্ষ করেছে। তবু প্রয়ােজন এবং আকস্মিকতার নিশ্চয়ই একটি সীমা আছে-যা রাষ্ট্রনায়করা বেছে নেবেন। রাষ্ট্রনেতার কাজ হচেছ ধংস হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। কিন্তু তিনি চিরন্তনতার পুরস্কার আশা করতে পারবেন না। তিনি হয়তাে জানেন যে, ইতিহাস স্থিতির শএু তবুও কোন নেতার আত্নসমর্পণের উপায় নেই। ধ্বংসের যে প্রক্রিয়া মানব-জাতি-সংস্থাকে প্রতিষ্ঠিত রেখেছে তার বিরুদ্ধে লড়তে, সৃষ্টি করতে এবং অবক্ষয় প্রতিরোধ করতে সে তার জনগণের কাছে ঋণী।
একটি বৃহৎ আমলাতন্ত্র—তা যত সংঘ বদ্ধই হােক না কেন-সৃষ্টিশীলতাকে ধ্বংস করে। বিজ্ঞ সিদ্ধান্ত এবং নিরবচিছন্ন প্রশাসনকে তা গুলিয়ে ফেলে। আধুনিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের উদ্দেশ্য রক্ষার চেয়ে তা পরিচালনা করতেই বেশি সময় ব্যয় হয়। বিতর্কহীন কোন চরম সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না বলে জটিল আমলাতন্র বর্তমান অবস্থাই পছন্দ করে। এর কারণ হলাে, বর্তমান অবস্থা কে চেনা চেনা লাগে এবং অন্য পথটি কোন শ্রেষ্ঠতর ফল দিত একথা কখনও প্রমাণ করা যায় না। বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়কদের তাই বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে অবিরাম লড়াইয়ে আবদ্ধ থাকতে দেখা কোন দৈবাৎ ঘটনা নয়। কারণ রাষ্ট্রনায়কদের চিন্তার পরিধি বিশেষজ্ঞদের কম ঝুঁকি নেয়ার প্রতি দুর্বলতাকে চ্যালেঞ্জ করে বসে।
মুখের কথা ছাড়াও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তারবার্তার প্রেক্ষিতে এবং তারবার্তার আকৃতিতে পরিকল্পনা করার প্রতি পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। নতুন পররাষ্ট্র সচিব তার টেবিলে নীতি বিশ্লেষণ বা বিভিন্ন পরামর্শ দেখতে পান না। যা পান তা একগাদা চিঠি এবং তাকে তা দয়া করে যতশীঘ্র সম্ভব স্বাক্ষর করতে বলা হয়। যদি তিনি কোন খসড়া অগ্রাহা করেন তবে তা এত সামান্য পরিবর্তিত হয়ে ফেরত আসে যে, দুয়ের মধ্যে পার্থক্য বের করতে আইন বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমি পররাষ্ট্র সচিব হওয়ার পর বুঝতে পেরেছিলাম যে, সারা জীবন ধরে পররাষ্ট্র নীতি রচনা করেছে তার পক্ষেও দফতরের তার যন্ত্রটির উপর প্রাধান্য বিস্তার করা এক বিরাট, বিশাল কাজ।
পররাষ্ট্র বিভাগ আমলাতন্ত্রের কোন আদেশ মেনে নিলে এটা হচেছ চমৎকার যােগ সংস্থা। কিন্তু বিভাগটি কোন উদ্ধত কমকর্তার আদেশ বিশ্লেষণ করতে চায় তখন রক্ত চলাচলের শিরার মত পথে বহু, নােট সপ্তাহমাস ধরে চলতে থাকে। কিন্তু এটা কোন সঠিক সিদ্ধান্ত মানতে চাইলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কাগজপত্র তৈরি হয়ে আসে।
ব্যাক চ্যানেল এবং ব্যাক বাইটিং।
ব্যাক চ্যানেল এমন যোগাযােগ ব্যবস্থা যাতে সাধারণ প্রক্রিয়া এড়িয়ে যাওয়া হয়। এটা করা হয় কারও বিশেষ সুবিধার জন্য । ব্যাক চ্যানেলে পররাষ্ট্র, বিভাগকে এড়িয়ে যাওয়া হত কারণ এটা নিজেই নিজেকে প্রযুক্তি এবং অভ্যাসের শিকার করে ফেলেছিল। প্রযুক্তির শিকার এইভাবে যে এর কম্পিউটারগুলাে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও পূর্বনির্ধারিত মাপকাঠিতে সাধারণভাবে বিচার করে। কূটনীতিকরা তথ্য উপজীব্য করে বেচে থাকেন এবং তাদের অভ্যাস হলো রীতিগত বাধা পুংখানুপুংখ মেনে চলা। এই কারণে পররাষ্ট্র বিভাগ নিজস্ব আভ্যন্তরীণ ব্যাক চ্যানেল সৃষ্টি করেছিল এবং অধুনা প্রত্যেক প্রেসিডেন্টই এ বিভাগের সাধারণ যােগাযােগ ব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে চাইতেন। কোন সাময়িক সমস্যার ব্যাপারে সরকার পরিচালনায় নিক্সনের ব্যবস্থা খুব ভালাে এবং সরাসরি চলতাে এবং একটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েই চলতে পারতাে যেমন কম্বােডিয়ার ক্ষেত্রে হয়েছিল। বিশেষ উদ্দেশে একক কূটনীতির ক্ষেত্রেও এটা বেশ ভালো চলছিল যেমন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক, ভিয়েতনাম আলােচনা এবং সােভিয়েত ইউনিয়মের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে সম্পর্কের ক্ষেত্রে। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ বা জটিল কূটনীতির ক্ষেত্রে যখন নিরাপত্তা উপদেষ্টার পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব হত না তখনই সঙ্কট দেখা দিত যেমন পাক-ভারত যুদ্ধের সময়। বিবেক বা বুদ্ধি অভাবে অসামঞ্জস্য এবং সিদ্ধান্তহীনতা দেখা দিত। কখনও প্রেসিডেন্টের মনােভাব একটি গ্রুপ বুঝলে এবং গ্রুপের মাত্র কয়েকজন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একমত হলে বিতর্ক বিচ্ছেদ এবং শৃঙ্খলা আনয়নের জন্য আদেশ (যা প্রায়ই ব্যর্থ হতাে) প্রদান করে প্রচুর সময় নষ্ট করা হতো।
প্রেসিডেন্টক উপদেশ দান
আমি বিশ্বাস করি প্রেসিডেন্টের উচিত পররাষ্ট্র সচিবকে প্রধান উপদেষ্টা এবং জাতীয় নিরাপওা উপদেষ্টাকে প্রাথমিকভাবে প্রশাসক এবং সমন্ধয়কারী হিসাবে রাখা। নিরাপত্তা উপদেষ্টা উন্নয়ন এবং নীতি নির্ধারনে সক্রিয় হলে সে নিশ্চয়ই পররাষ্ট্র সচিবকে খাটো করে ফেলে। এতে বিদেশী সরকারগুলো দ্বন্দ্বে, ভোগে এবং সরকারের মধ্যে বিভক্তিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে শুরু করে। পররাষ্ট্র বিভাগ এতে নৈতিকতা হারায় এবং বিভেদমূলক আচরন শুরু করে। পররাষ্ট্র সচিবকে প্রেসিডেন্ট পছন্দ না করলে তাকে – অব্যাহতি দেয়া উচিত, ব্যক্তিগত সহকারীর মাধ্যমে নজর রাখা উচিত নয়। নিক্সন প্রশাসনে পররাষ্ট্র সচিবের গুরুত্ব বেড়েছিল বিভাগের আমলাদের উপর নিক্সনের অবিশ্বাস সম্বন্ধে রজারসের অজ্ঞতা এবং আমার দৃঢ়তার জন্য। রজার্সের তার পদের গুরুত্ব হারানোর অন্যতম কারন তার পদের কারনে বিশেষ সুবিধা ভোগ। আমলাতান্ত্রিক ঝগড়ার উচ্চতর পদাসীনের যুক্তির চেয়ে জোরালো যুক্তি না থাকলে পরাজয়ই হয়।
উচ্চপদে আসীন সামরিক অফিসাররা তাদের জ্ঞান এবং আনুগতের মধ্যে সমন্বয় ঘটাবেন এমনভাবে যাতে যোগ্যতা প্রমানের জন্যই পরবর্তী যুদ্ধের জন্য তারা টিকে থাকতে পারেন। তাদের কম্যান্ডার ইন-চীফকে চ্যালেন্জ করেন এবং তাকে সমর্থন করার জন্য পথ খুজে বেড়ান, বিরোধিতার জন্য নয়।
সমালোচকদের ধারনা সিআইএ ঈগলের মত এ্যাডভেন্চারবাদী আসলে সিআইএ তা ছিল না তারা ওয়াশিংটনের ফ্যাশন অনুযায়ী বিষয় বিশ্লেষনের কাজে লেগেছিল। আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সিআইএ সাহস করে পদক্ষেপ নেয়ার চাইতে নিস্ক্রিয় থাকতে বেশি বুদ্ধি বের করেছে। এর বিশ্লেষকরা জানতেন যে, কোন নতুন পথ খুজে না পাওয়ার জন্য কেউ কখনও শাস্তিভোগ করেনি কিন্তু কোন ঝুঁকি সম্পর্কে বলতে না পারার জন্য অনেকের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে গেছে। সেজন্য গয়েন্দারা সব সময় কোন কাজের খারাপ কি প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে এ সম্বন্ধে বলেছে এটা স্থবিরতাকেই উৎসাহ দেয়।
সঙ্কট মোকাবেলা
কোন আলােচনায় আমি সব সময়ই চেষ্টা করেছি যুক্তিসঙ্গত ফল খুজে বের করতে এবং লক্ষে পৌছতে। যা একটু একটু করে এগুলো এবং তাও শেষ মুহূর্তে করার নীতিতে বিশ্বাসী তারা একে প্রি-এম্পটিভ কনসেশন বলে ঠাট্টা করেছেন। আমি এটা করতাম আমলাতন্ত্রকে ক্ষমা করার এবং যুক্তি গুলাকে শানিয়ে নেয়ার জন্য। পাকা লােক মনে করে নবীশরা এতে খুব আগ্রহী হয়। সাধারণতঃ এতে মনে হয় লোকটা বােধহয় নিজেই ঠকে গেল। এতে আরও বেশি সুবিধা পাওয়ায় জন্য প্রতিপক্ষ আশা করে বসে থাকে, কিন্তু বুঝতে পারে না যে অপর পক্ষ শেষ সীমায় নেমে গেছে। অনেক আলােচনায়ই আমি অনেক সুবিধা নিজেই দিয়েছি, বা প্রতিপক্ষ খুব কমই আশা করেছেন, যখন সামান্যতম চাপ ছিল এবং বুঝিয়ে দিয়েছি যে এর নীচে অামরা নামবো না। আমি সব সময় চাপের মুখে আমাদের আলোচনার, অবস্থান পরিবর্তনের বিরোধিতা করেছি।
অনেকে মনে করতে পারেন যে সঙ্কট মোকাবিলা এমন উত্তেজক ব্যাপার যে, আসল কর্তারা লিমােজিনে করে হোয়াইট হাউসে জমায়েত হন এবং উত্তেজিত সহকারীরা শেষ তারবার্তাটি হাতে নিয়ে বিব্রত কর্মকর্তাদের ধমকে শেষ করেন। আমি এমন অবস্থা কখনও দেখিনি। তবে হ্যা সঙ্কটকালে উত্তেজনা থাকলেও এক অদ্ভূত নীরবতা থাকে। দৈনন্দিন ছােটখাট কাজ অধস্তন ব্যক্তিরা চালান। ব্যাক্তিত্বের সংঘর্ষ প্রায় থাকেই না। সবচেয়ে ক্ষমতাবান দায়িত্বের জন্য লড়াই করেন এবং অন্যেরা ভয়ে ভয়ে থাকেন যে ব্যর্থ হলে একজনকে বলির পাঠা হতে হবে। আমাদের কিছু করার নেই বলে অনেকে গা ঢিলে দেন। অনেকে আবার বিরুদ্ধ মত লিখে রাখেন যাতে পরে দোষ চাপানাে যায়। যারা সত্যি সংকটের মোকাবেলা করেন তারা ঝড় দেখে অবিচলিত থাকেন। তাদের চারদিকে সবকিছুই সচল, কিন্তু তারা স্থিরভাবে কাজ করেন পরিশ্রান্ত হওয়া পর্যন্ত যতক্ষণ না সাফল্য বা ব্যর্থতা আসে।
দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে যারা- তারা ভবিষ্যদ্বানী, জ্ঞান, অাশা এবং সন্দেহের বন্যায় আপ্লুত হন। খুব কমই ঐকতানের ছবি পাওয়া যায়। সিদ্ধান্ত গ্রহনকারী নিজের সৃষ্টিশীলতা এবং অবস্থা কি করে ঐকতানের সৃষ্টি করেন। এ গতিময়তা শুধু ক্রীড়াবিদদের মধ্যেই দেখা যায়। সিদ্ধান্ত খুব দ্রুত নিতে হয় এতে আবার মেধা এবং শাররিক যোগ্যতা উভয়েরই যাচাই হয়ে যায় কারণ অনেক সময় এটা নিশ্চিত করতেই নষ্ট হয় যে আদত কর্তারা একই তথ্যের উপর নির্ভর করে।একই উদ্দেশে কাজ করছেন। প্রতিদ্বন্দিতার চাপে পড়ে কেউ বিশ্বাস করতে চান, যে কোন বিষয় এড়িয়ে গেলেই সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া যায়; এটাই সঙ্কট আমন্ত্রণ করে ।
ভিন্ন দুনিয়ার মুখােমুখি
কিসিঞ্জার লিখেছেন যে, “১৯২০ দশকে আমরা মনে করেছি এই দুনিয়ায় আমাদের থাকা উচিত নয়, কারণ আমরা এই দুনিয়ার তুলনায় ভালো মানুষ। আর ১৯৬০ দশকে আমরা মনে করতাম এ দুনিয়ায় আমাদের থাকা উচিত নয়, কারন আমরা অত্যন্ত খারাপ।”
নিক্সন এমন সময়ে প্রেসিডেন্ট ছিলেন যখন সাধারণ ভাবে শক্তি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে বলা হতাে। সমালােচকরা বলতেন আমেরিকা টিকে থাকলে থাকবে শুধু, তার নৈতিকতার শুদ্ধতার জন্য। কিন্তু এর কোন নিশ্চয়তা ছিলনা এবং এধরনের ধারণার ভিত্তিতে রচিত পলিসি উত্তরনের প্রয়ােজন ছিল। জাতীয় সার্থের নামে প্রদত্ত শ্লোগানের ফলে আমাদের ঘনঘন পথ পরিবর্তন করতে হয়েছে। নয়া নৈতিকতা আমাদের কাছ থেকে অধিক ওয়াদা আদায় করতে চেয়েছে। বুদ্ধিজীবিদের নিক্সন-ঘৃণা তাদের এটা বুঝতে বাধার সৃষ্টি করেছে যে অামরা তাদের সঙ্গে একমত হয়েই লক্ষ্য ও পথ এবং ওয়াদা ও সাধ্যের মধ্যে সমন্বয় রক্ষার চেষ্টা করছি। একটি আবেগের জন্য অন্য কিছুর বিসর্জনের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলাম না বলে তাদের সঙ্গে আমাদের বিচেছদ ঘটে। (অস্পষ্ট) ভিয়েতনাম বির্তক এত তিক্ত হওয়ার কারন হলো এই যে সমর্থক এবং বিরোধী উভয় পক্ষই ঐতিহ্যবাহী বিশ্ব নৈতিকতর সমর্থক।
নিক্সন প্রশাসন এতটা আন-আমেরিকান হয়ে পড়েছিল এই জন্য যে আমরা বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা সম্পর্কে ভিন্নতর বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে চাইছিলাম। একা থাকা বা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার প্রবনতা সারানোর পথ ছিল অধিক স্থায়ী জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে নীতি প্রণয়ন করা। উত্তেজিত হয়ে দৌড়াদৌড়ি বা ব্যর্থ হলে ঘরকুনো হয়ে থাকার কোন অর্থই হয় না। বেঠিক পথ অপূর্ণ কাজ এবং ভারসাম্য ও প্রচেষ্টার অসন্তোষজনক কাজের সঙ্গে আমাদের আপোষ করা দরকার।
যে জনগণ শক্তি ভরসাম্য সম্পর্কে পড়তে গিয়ে ‘পুরান’ কথাটি না পড়ে পারে না তাদের শক্তি-ভারসাম্য সম্পর্কে কিছু, বলতে যাওয়া ভীষণ কষ্টসাধ্য। সে সময়ের উপহাসগুলোর মধ্যে এটি একটি নয় যে, – একজন এুটিপূর্ণ মানুষ, যে তার জাগতিক সুবিধার প্রতি সজাগ, পারমাণবিক যুগের বিপদ থেকে নতুন বাস্তব অবস্থানুযায়ী শান্তির পথে আমেরিকাকে নিয়ে যেতে অগ্রণী হয়েছিল। দু জন বিদেশী নেতা মও এবং চৌ এটা বুঝেছিলেন বলেই আমেরিকার উদারনৈতিকতার চঞ্চল নেতাদের মধ্যে নিক্সনকেই বেছে নিয়েছিলেন। দর্শন এবং ইতিহাসকে অতিক্রমকারী ভৌগােলিক রাজনৈতিক স্বার্থের ক্ষেত্রেই লাল-নীতির সমালোচক এবং বিশ্ব বিপ্লবেরো অগ্রণীরা একে অন্যকে খুজে পান।
দিগন্ত প্রসারণ
১৯৭১ সালের জানুয়ারীতে কিসিন্জার কেপ কেনেডী ভ্রমণ করেন। চন্দ্রাভিযান দেখে তিনি মানুষের বিশ্বাস এবং চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে লিখেছেন-
আমাদের মহাশূন্য কর্মসূচী থাকা দরকার কারণ যে সমাজ তার দিগন্ত প্রসারিত করে না তা সংকুচিত হয়ে পড়ে। আগে বিশ্ব সমস্যার সমাধান করার যুক্তি আমাদের চিরদিনের জন্য গৃহবন্দী করে রাখবে। মানব- জাতি তার দৃষ্টিভঙ্গি অবিরাম প্রসারিত না করতে থাকলে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যাবে না, কারণ বিশ্ব কোনোদিনই সমস্যা মুক্ত হবে না। ১৫শ শতকে ইউরােপের সমস্যা সমাধানের কথা উঠলে কলম্বাস কেনদিনই আমেরিকা অাবিষ্কার করতেন না। ইউরোপের সমস্যাতে সমাধানহীন থাকতোই বরং সমস্যার জটিলতায় ইউরোপ দমবন্ধ হয়ে যেতো। বিশ্বাসই মানুষের বর্ণাঢ্য বৈচিত্রময় যাএার একমাএ প্রেরনাদাএী। কিন্তু বর্তমান প্রযুক্তির যুগে একজন মানুষ কি করে স্বপ্ন দেখবে? যে বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষক সমাজ ক্যাথিড্রাল নির্মাণ করেছে স্বর্গের কাছে পৌছানোর জন্য শত শত বছর ধরে ইমারত নির্মান করেছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং স্থায়িত্ব পাওয়ার আশায় পাথর কুদেছে সে বিশ্বাস মানুষ আবার কেমন করে ফিরে পাবে?
কেপ কেনেডীতে আমার ১১ বছরের কন্যা এলিজাবেথ এবং ৮ বছরের পুত্র ডেভিডকে (তখনকর বয়স) সঙ্গে নিয়ে দাড়িয়ে আমার মনে হয়েছে আমি যে বিশ্বে ছিলাম এরা তার চেয়ে ভিন্ন এক পৃথিবীতে থাকবে। বালক বয়সে চিনেছি শুধু, জাতীয় সীমারেখা—মহাশুন্যযান ছিল কল্পনার বাইরে। টেলিভিশনের কথা চিন্তাও করতে পারতাম না। অথচ এরা যেসব বস্তু দেখছে তা তাদের কল্পনাকেও হার মানায়। অামার সময়ে আমরা বই পরে মানুষ হয়েছি। যার ফলে এই জেনারেশনকে সবসময় তাদের পরিবেশকে কল্পনার মধ্যে রাখতে হয়েছে। আমার সন্তানদের সামনে তা এনে দিচেছ টেলিশিনের পর্দা তবু তাদের সামনে দশ সেকেন্ড শক্তি প্রদান করেই শত শত লক্ষ মাইলের যাত্রা শুরু করা গেছে যা কিন অধিকাংশ সময়েই থাকছে অপরিবর্তিত।
ভালো হোক অার মন্দ হােক, আমি মনে করছি আমি এমন একজন লোক যে তার পরবর্তী পুরুষকে তাদের অনির্ধারিত একটি যাত্রায় রওয়ানা করিয়ে দিতে শক্তি প্রয়োগ করেছে। আমাদের লক্ষ্য ভুল হলে সবচেয়ে কুশলী নাবিকও শোধরাতে পারবে না আমরা এমন এক বিশ্বের প্রতি লক্ষ্য স্থির করেছি যেখানে কেউ কোনদিন ছিল না আমাদের বিপদ রয়েছে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আমাদের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ বিষয় হলো যাত্রা শুরু করার সিধান্ত নেয়া ; এজন্য যে জটিল যােগ্যতা আমাদের প্রয়োজন ছিল তা হলাে ভবিষ্যতে বিশ্বাস যা আংশিকভকে অঙ্গীকারের ফসল।
লিওনিদ ব্রেঝনেভ
মাও সে তুং এবং চৌ-এন লাই এমন এক জাতির নেতা, যাদের সভ্যতা সে অঞ্চলে অনেক আগে থেকেই বিখ্যাত। তাই চীন নেতারা চোস্ত এবং আত্মবিশ্বাসী। ব্রেজনেভ এমন এক জাতির প্রতিনিধি যে জাতি তর ওপর আগ্রাসী শক্তির অবক্ষয়ের পর টিকে রয়েছে। এ জাতি হলাে ইউরােপ ও এশিয়ার মধ্যে ঝুলন্ত জনগোষ্ঠী। ব্রেজনেভ তার আত্মবিশ্বাসের অভাব পুষিয়ে নেন গালভর বুলি দিয়ে। ব্রেজনেভ রুক্ষ, নির্মম এবং ধুর্ত। তিনি যখন রাশিয়ার শক্তি নিয়ে বড়াই করেন, তখন সহজেই বােঝা যায় যে তিনি নিজেই শক্তি সম্পর্কে সচেতন নন। নাৎসী হামলায় পরাজিত বলে নিজের দুর্বলতা নিয়ে বোধ হয় তিনি বেশী কমপ্লেক্সে ভােগেন। আমার বিশ্বাস পশ্চিমা মতে শান্তি না হলেও তিনি জীবনের সব ভয় ঝুকি এবং সংগ্রাম থেকে রেহাই পেতে চান। আমি যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করি তখন তিনি স্টালিনের শুদ্ধি অভিযান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আরেক দফা শুদ্ধি অভিযান, স্টালিনের মত্যুর পর ক্ষমতার দ্বন্দ পার হয়ে এুশ্চেভকে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। তাঁকে দেখে মনে হচিছল সবচেয়ে কম ঝুকি নিয়ে ক্ষমতায় থাকতে আগ্রহী একজন ব্যক্তি অথচ নিঃশেষিত। এতে অবশ্য সােভিয়েট-শক্তি-বৃদ্ধির-নীতির কোন পবিবর্তন হয়নি। ব্রেঝনেভ যাই ভাবুন না কেন আমাদের শক্তি তাদের শক্তিরই ভারসাম্য রক্ষা করছিল।(অস্পষ্ট) শক্তি-ভারসাম্যের স্থান দখল করতে পারেনা।
আলেক্সি কোসিগিন
আমাদের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন কেসিগিন ব্রেঝনেভের চেয়ে বেশি উদার। আমার কাছে তা মনে হয়নি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কাজ ছিল প্রাত্যহিক কাজ নিয়ন্ত্রণ করা।অবশ্যই এতে তার প্রজ্ঞা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যের সুবিধা সম্পর্কে এক লম্বা চওড়া বক্তৃতা দিয়ে ফেলতে পারতেন। এতে তিনি আমাদের সােভিয়েত বাজার খুলে দিয়ে এক মহা উপকার সাধন করেছেন। একথা বলতে ভুল করবেন না। অর্থনীতি ছাড়া অন্য সব বিষয়ে কোসিগিনকে আমর মনে হয়েছে গােয়ার না হলেও গোড়া। কোসিগিন তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত এবং মার্জিত । সোভিয়েত রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রায় ৩০ বছর ধরে রয়েছেন তিনি। তিনি যখন প্রথম বিশজন নেতার একজন তখন ব্রেজনেভ ছিলেন মধ্যম স্তরের নেতা। কোসিগিনের ক্ষমতায় থাকার অন্যতম কারণ হয়তাে তাঁর উচ্চকাংখার অভাব এবং স্টালিন থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীনরা কেউ তাকে শত্রু বলে মনে করতেন না। তার কর্তব্যপরায়নতা এমন যে স্ত্রী যখন গুরুতর অসুস্থ তখনও তিনি প্রাত্যহিক কাজ করতে গিয়েছেন এবং স্ত্রীর মৃত্যুর খবর পেয়েও লেনিনের সমাধি পর্যন্ত রেড স্কোয়ার প্যারেড পরিদর্শন করেছেন। আমাদের অনেকেই তাকে দারুন রসিক বলে মনে করতেন। আমি একদিন তা যাচাই করতে গিয়ে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে ছিলাম। এমনও হতে পারে যে তাঁর রসিকতা আমি ধরতে পারিনি। শীর্ষ বৈঠকের পর আমরা একটি রাশন বিমানে চড়ি। কিন্তু বিমানটি কিছুতেই স্টার্ট নিচিছলনা। তিনি তখন বললেন, “এজন্য যদি আমাদের ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রীকে টারমাকে শাস্তি দিতে দেখতে চান তবে আমি তাই করতে পারি। আমি তাকে যান্ত্রিক ত্রুটির কথা বুঝিয়ে বললাম” একটা পয়সা পড়ে গেলে তা মালিকের কাছে ফিরে আসে না।” জবাবে তিনি ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার পয়সা ফিরে আসে।
মাও সে-তুং
নিক্সনের সঙ্গে অল্প সময়ের সাক্ষাতেও মাও তার স্বপ্ন ছাপিয়ে রাখতে পারেননি যে তাঁর অতীতের সমস্ত কাজ, কষ্টভােগ, লংমার্চ, নির্মম নেতৃত্বের লড়াই সহস্র বছরের পুরনাে সভ্যতার মধ্যে অতীতের সব জাগরণের মতই মাত্র একটি বিশেষ ঘটনা বলেই চিহ্নিত হবে। নিক্সন যখন বলেছিলেন যে, “মাওয়ের লেখা জাতিকে গতি দিয়েছে— পাল্টেছে এ বিশ্বকে তখন জবাবে স্বভাবসুলভ রহস্য করেই তিনি বলেছিলেন, কিন্তু আমি ত পাল্টাতে পারিনি। আমি পাল্টেছি পিকিং থেকে দেখা যায় এমন কিছু জায়গা। মাওয়ের কাছে কমিউনিজম ছিল সত্য। ২০ শতকের কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে কেবল তিনিই কমিউনিজমের গভীর সত্য উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। ইতিহাসের বেঙ্গাত্মক শিক্ষা এই যে চীন বিপ্লবের বিশাল নেতাই কমিউনিজমের (অস্পষ্ট) সঠিক বুঝতে পেরেছিলেন কমিউনিজমের আসল লক্ষ্য অভিজাত্য এবং জাতীয়তাবাদ।তার সমালোচক সােভিয়েট রাশিয়াই রাশিয়ানদের জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মত্যুর আগে পর্যন্ত মাও অধুনিকীকরণের বিরােধীতা করেছিলেন। কারণ তা চীনের বৈশিষ্ট্য নষ্ট করবে। প্রতিষ্ঠানিকতা সমর্থন করেন,কারণ তাতে বিপ্লবী উৎসাহ থাকবে। কথিত আছে বিপ্লব বিপ্লবের নেতাকেই ধবংস করে। মাওয়ের ক্ষেত্রে হয়েছে তার বিপরীত। মাও বিপ্লবকে ধংস করেছেন একের পর এক বিপ্লব করে। জীবনের শেষ ক মাসে দিনে মাত্র কয়েক ঘন্টা কাজ করতে পারতেন, কথা বলতে পারতেন না। তবু স্বাতন্ত্র্যবাদীদের সঙ্গে আরেকবার লড়াইয়ের ধৈর্য তার ছিল। এরপর মহান দেবতুল্য বিশাল এই ব্যাক্তিত্ব তিরােহিত হন। তার এই তিরোধান ছিল সম্রাট চিন হুয়াং তি-র মৃত্যুর মত। তিনি মত্যুর পর তার অবস্থা সম্পর্কে আগেই জানতে পেরেছিলেন।
চৌ এন-লাই
১৯৭১ সালে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে চৌ-এর জড়িত থাকার ৫০ বৎসরপূর্ণ হয়। এর মধ্যে ২২ বছর তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দর্শন, ইতিহাস কৌশল এবং হাস্যরসে তার ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ঘটনার—এমনকি আমার ব্যক্তিগত জীবনের ওপর তার জ্ঞান মানুষকে অবাক করে দেয়ার মত। ৮০ কোটি লােকের প্রাত্যহিক সমস্যার দায় মাথায় নিয়েও তাঁর কথাবার্তা চাল চলন ছিল (অস্পষ্ট)
ব্যক্তিগতভাবে চৌ ভীষণ দয়ালু। আমাদের দলের কেউ অসস্থ হয়ে পড়লেও সে প্রটোকল না মেনেই তাকে দেখতে যেতেন। তাঁর মানবিক গুনাবলীর জন্য চীনারা তাকে নেতাদের মধ্যে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখতেন। ১৯৭৫ সালে আমি যখন একজন দোভাষীকে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম তখন সে কেদে ফেলে জানালো যে সে গুরুতর অসুস্থ। তাঁর মৃত্যুর পর চীনে গভীর শোকের ছায়া এমনিই নেমে আসেনি বা তাঁকে ৭০ দশকের শেষাশেষি অনর্থক গুরুত্ব দেয়া হচেছনা। আমাকে যারা প্রভাবান্বিত করতে পেরেছেন এমন একজন লােকের মধ্যে তিনি একজন।। চৌ-এর মত্যুর পর সারা বিশ্ব শ্লথ হয়ে গেছে। বিশ্বকে এখন কেউ আশার বাণী শােনাতে পারছেনা। আমরা দুজনেই জানতাম যে আমাদের দু দেশের সম্পর্ক খুব গভীর নয়-কোন সময়ে তা নাও টিকে থাকতে পারে। তবু সরকারী ক্ষমতা পেয়ে আমি যে পুরস্কার পেয়েছি তার একটি হলাে এই যে আদর্শের দন্দ থাকা সত্বেও একজন মহান মানবের সঙ্গে আমার একটা কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। একাজটি ছিল মানুষের ভবিষ্যত সম্পর্কে দূরদৃষ্টির অভাবের হাত থেকে কিছু রক্ষা করা।
জন কোনালী
নিক্সন কোনালীকে অনান্য কেবিনেট সদস্যদের মত বিপদজনক প্রতিযােগী মনে করতেন না। রজারস এবং লেয়াডের মত কোনালী নিক্সনের পূর্ববর্তী সংকট গুলোতে নিক্সনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন না। তাই নিক্সন কখনও তার অনুপস্থিতিতে সমালােচনা করতেন না। কেবিনেট সদস্যদের মধ্যে কোনালীকে নিক্সন ভয় করে চলতেন। তিনি ছিলেন দারুণ বুদ্ধিমান,সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং চলতেন জাত নেতার মত। তিনি ছিলেন সহসী। আমাকে একবার বলে ছিলেন, আপনাকে সবাই বিচার করবে কতজন শত্রুকে আপনি ধংস করলেন তা দিয়ে। সেই সংখ্যা যত বেশি হবে আপনাকে সবাই তত বড় মনে করবে। কোনালী লড়তে ভালবাসতেন। অধিকাংশ নিজ ভাগ্য নির্মাতার মত তিনি কোন কিছুর মুখােমুখি হতে পছন্দ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ভিয়েতনাম নিয়ে আমাদের নেতাদের সংকট উদ্ধারের একমাত্র পথ অমারোর স্বার্থ রক্ষার জন্য দৃঢ় থাকা। নিক্সনের প্যালেস গার্ড রেখে তার কেবিনেট সদস্যদের হোয়াইট হাউস এসিসট্যান্টদের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা তিনি চূর্ণ করে দেন। বৈদেশিক অর্থনৈতিক ব্যাপারে সবাই তার কাছে হার মানতো। হোয়াইট হাউসের পরামর্শ প্রয়ােজন হলে তিনি রাস্তা পার হয়ে সোজা ওভাল অফিসে চলে যেতেন। বিদেশীদের সঙ্গে ভাল ব্যাবহারের তিনি কোন যুক্তি খুজে পেতেন না। কারণ তার মতে কোন দেশ কেবল চাপের মুখেই নতি – স্বীকার করে। শক্তির উচ্চাসনে না বসে আলোচনার কোন অর্থ তার কাছে ছিল না। তার উপস্থিতিতে বােঝা গিয়েছিল যে ইউরােপের সঙ্গে অর্থনৈতিক আলোচনা অনুকূল হবে না: ইউরােপ শুভেচছা বিনিময়ের চেয়ে একটু বেশি এগিয়ে আসবে।
ধােয়ার চুড়ায় ১৯৭০ সালে প্রেসিডেন্টের ভাটিকান সফরের সময় এমন একটি ঘটনা ঘটে যা মনে করলে হাসির উদ্রেক হয় কিন্তু আসলে তা মারা যাওয়ার মত। আমাদের অগ্রগামী দল প্রেসিডেন্ট সেন্ট পিটার্স স্কোয়ার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি হেলিকপ্টারে করে ষষ্ঠ বহরে যাবেন। এ জন্য কুরিয়া সুপারিশ করে যে প্রতিরক্ষা সচিবের হলি ফাদারের বক্তৃতার সময় উপস্থিত থাকা উচিত হবে না। কিন্তু সফরকারী দল যখন পােপের দরবারে প্রার্থনা শােনার জন্য যায় তখন লেয়াডও সেখানে সিগার চিবুতে চিবুতে হাজির হন। লেয়াড কেন এসেছেন জিজ্ঞেস করলে আমতা আমতা করে হেলিকপ্টার খুজতে এসেছেন এমন একটা জবাব দেন।যাই হােক আমি তাকে সিগার নিবিয়ে ফেলতে বললাম। হলি ফাদার এবং নিক্সন পাশাপাশি বসলেন এবং পুরাে দলকে তাদের সামনে দুই সারিতে জায়গা দেয়া হল। পােপ যখন তার ছােট্ট ভাষণ দিচিছলেন তখন লেয়াডের পকেট থেকে ধোঁয়া বের হতে শুরু করল। তার পকেটের আগুন নেভাতে লেয়াড তার পাশে চাপড়াতে শুরু করলেন। নিজেকে পুড়িয়ে পােপের সামনে নিবেদন করার লেয়াডের এই নাটকীয় ঘটনা যারা দেখতে পাচিছলেন না তারা হাতলি দেয়া শুরু করলেন পররাষ্ট্র সচিবের শব্দ শুনে। দুই হাজার বছর ধরে অর্জিত প্রজ্ঞাই ভাটিকানের কর্মকর্তাদের এটা অস্বাভাবিক নয় বলে ভান করতে সক্ষম করেছিল।
চার্লস দ্যগল
১৯৬৯ সালে আইসেন হাওয়ারের অত্যেষ্টি ক্রিয়ায় যোগ দিতে তিনি ওয়াশিংটন আসেন। তখন তিনি ছিলেন আকর্ষণের এক কেন্দ্রবিন্দু। নিক্সন তখন যে সংবর্ধনা দেন তাতে সব সরকার প্রধান এবং সিনেটররা তার চারপাশে ভিড় করেন। দেখে মনে হচিছল যে তিনি যদি কোন জানালার কাছে যান তবে ঘরের ভরকেন্দ্র সরে যাবে এবং জানালা দিয়ে সবাই বাগানে পড়ে যাবে। ওভাল অফিসে নিক্সন-দ্যগল সাক্ষাৎকার ঘটে। তার মধ্যে তখন একাকীত্ব এবং নিজের কীর্তির দর্শক হওয়ার ভাব এসে গেছে। মনে হচিছল তিনি নিজেই তার আসন্ন অবসরের প্রতিক। পশ্চিম জার্মানীর চ্যান্সেলর কুট জর্জ কিসিঞ্জার যে গল্পের ভিত্তিতে বলেছিলেন যে দ্য-গল বেশিদিন বাঁচবেন না তিনি তা স্মরণ করলেন। কিসিঞ্জার বলেন যে দ্যগল বলেছিলেন, “আমরা এবং জার্মানরা অনেক পথ একসঙ্গে অতিক্রম করেছি। “আমরা বন্য প্রাণীতে ভরা জঙ্গল এবং রৌদ্রে পোড়া মরুভূমি অতিক্রম করেছি। তুষারাচছাদিত পাহাড় চূড়া অতিক্রম করেছি গুপ্তধনের সন্ধানে সাধারণতঃ প্রতিদ্বন্দীর মত, সাম্প্রতিককালে সহযোগী হিসাবে। এখন আমরা বুঝেছি কোথাও কোন গুপ্তধন নেই এবং আমাদের জন্য বন্ধুত্বই অবশিষ্ট আছে।
গােল্ডমায়ার
তিনি খাঁটি লােক। শৈশবে রাশিয়ার ইহুদীদের প্রতি অত্যাচার এবং যৌবনে প্যালেস্টাইনের রুক্ষ ব্যবহার তাঁকে এ শিক্ষাই দিয়েছে যে যাদের সংগ্রাম করার ইচছা আছে তারা টিকে থাকার সুযোগ পায় এবং সংগ্রাম করলেই সফল হওয়া যায়। তার পাথরের ভাস্কর্যের মত চেহারা মানুষের অমানবিকতা কতদূর যেতে পারে তা জানে এমন একটি জনগােষ্ঠীর লক্ষ্যের সাক্ষ্য দেয়। মাঝে মধ্যে তাকে বিদ্রুপ করতে দেখা গেলেও তিনি যে প্রতিটি ইসরায়েলী সৈন্যের মৃত্যুকে তার পরিবারের একজন সদস্য হারানাের সমান বলে মনে করতেন এটা কখনও তার চেহারা থেকে অপসৃত হয়নি। যুদ্ধে দখল করা প্রতি ইঞ্চি জমিকে তিনি মনে করতেন সাফল্যের পুরস্কার যা দৃঢ়ভাবে রক্ষা করতে হবে এবং নিরাপত্তার সুনিশ্চিত বাস্তব আশ্বাসের সঙ্গেই কেবল তা বিনিময়যােগ্য। তাঁর মন ছিল বাস্তববাদী, একাগ্র। আজে-বাজে কথায় বা দর কষাকষির সূক্ষতায় তিনি পটতেন না। বিষয়ের গভীরে তিনি চলে যেতেন।আনুষ্ঠানিক কথাকে উপহাস করে জবাব দিতেন এবং আলােচনাকে নিয়ন্ত্রণ করতেন নিজের ব্যক্তিত্ব এবং ধূর্ত মনস্তত্ব দিয়ে। আমার সঙ্গে তিনি ভাগ্নেকে বিশেষ আদর করে এমন খালার মত ব্যবহার করতেন যাতে ভিন্ন মতের সম্ভাবনা চিন্তা করাও মুরুব্বীদের সঙ্গে বেয়াদবী করার সামিল হয়ে দাঁড়ায়। এ ছিল আগে থেকেই হিসাব করা। মিসেস মায়ার মনে করনে, পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম রজারসের মনােভাব সম্পর্কে রিপাের্টগুলাে সত্য নয়।তিনি মনে করতেন রজার্স নিজে তার মনােভাব ব্যাখ্যা করার সুযােগ পেলে অসম্পূর্ণ তারবার্তার সৃষ্ট ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটবে এবং তিনি ক্ষমা করতে পারবেন। তিনি নিক্সনকে মনে করতেন ইহুদীদের বন্ধু—এটা নিক্সনকে যারা ইহুদীদের শত্রু বলে মনে করেন তাদের চমকে দেয়ার মত। কিন্তু এতে নিক্সনের সুনাম বেড়েছে। নিক্সন ইসরাইলের জন্য তেন ইহুদীদের বন্ধু—এটা নিক্সনকে যারা অনেক কিছু করেছেন— হৃদয়বৃত্তির জন্য নয়, ভাবাবেগহীনভাবে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য হিসাব কষে।
ইরানের শাহ
ইতিহাস বিজয়ীরা লেখেন, এবং শাহ এখন জনপ্রিয় নন। একজন নেতাকে আমাদের দৃঢ় সমর্থন দিয়ে যাওয়ার সুনাম বর্তমনে তার বিরদ্ধে হৈ চৈ শুরু হয়ে যাওয়ায় একটুও বাড়ছেনা। আমাদের উভয় দলের আটজন প্রেসিডেন্ট তাকে আমাদের দেশের একজন বন্ধু এবং এক গুরত্বপূর্ণ এবং উত্তপ্ত এলাকায় স্থিতিশীলতার স্তম্ভ বলে মনে করতেন। তার ব্যক্তিত্ব প্রভূত্ব দেখানাের মত নয়—বরং লাজুক এবং আত্মঅপসরণকারীর মত। তাঁর সম্পর্কে আমার ধারণা তিনি একজন ভদ্র এবং স্পর্শকাতর লােক যিনি বিশ্বাস করেন প্রশাসককে কঠিন এবং নিরপেক্ষ হতে হবে। তিনি তা হতে চেষ্টা করে কখনও সফল হননি । তার রাজকীয়তা বছরের পর বছর অনুশীলন থেকে প্রাপ্ত। আমি মনে করি রাষ্ট্রের প্রয়ােজনের কাছে তিনি ছিলেন বন্দী যেমন শেষ পর্যন্ত তিনি তারই সাফল্যের শিকারে পরিণত হন। শাহ সম্পর্কে যত কথাই বলা হােক তিনি ছিলেন আত্মোৎসর্গীকৃত সংস্কারক। শিল্পায়ন করার ক্ষেত্রে তিনি প্রগতিবাদী। তার দুর্ভাগ্যের অন্যতম কারণ তিনি যত দ্রুত আধুনিকীকরণ করেছিলেন তার দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠন তত বিকাশ লাভ করেনি। তিনি পাশ্চাত্যের শিক্ষানুযায়ী “আধুনিক” সূত্র কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। অনেক পশ্চিমা অর্থনীতিবিদ মনে করেন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক প্রগতির উপর নির্ভরশীল—শাহ বিশ্বাস করতেন যে সরকার লােকের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে তা নিশ্চয়ই জনসমর্থন পাবে। এ সুত্র মারাত্মকভাবে ভুল প্রমানিত হয়েছে। যে শাসক জানেন অর্থনৈতিক উন্নয়ন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত সামাজিক জটিলতা সহনক্ষম নতুন রাজনীতির ক্ষেত্র সৃষ্টি করেন তিনিই জ্ঞানী। শাহ, তার বন্ধুরা এমন কি শত্রূরাও এ জ্ঞান রাখেনা।
আই ঝাক রাবিন
বূদ্ধি এবং ধৈর্য্য ছাড়া তার কোনকিছুই রাষ্ট্রদূতদের মত নয়। ইসরাইলের স্বাধীনতা যুদ্ধের তিনি একজন বীর এবং নিরাপত্তা বাহিনীসমূহের চীফ-অব-স্টাফ হিসাবে ছয়দিনের যুদ্ধে বিজয়ের স্থপতি। স্বল্পভাষী এবং লাজুক রাবিনের মধ্যে কুটনীতিক হওয়ার সাধারণ গুণাবলী ছিল। মুখস্ত করার মতাে কথা বলে এমন লোকেরা তার অপছন্দ এবং সাধারণ কথা আলােচনায় বিরক্ত হতেন। কিন্তু রাবিনের দুর্ভাগ্য ওয়াশিংটনে এমন লােকের অভাব নেই। দুই রকম কথা তিনি পছন্দ করেন না তা আবার কুটনীতির জন্য প্রয়োজন। আমি তাকে অত্যন্ত পছন্দ করতাম—তিনি কিন্তু এজন্য কোন কিছুই করেন নি। রাবিনের অনেক গুণ কিন্তু মানবিক সম্পর্কের দান তার মধ্যে নেই। তাকে যদি যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্রাটেজিক এয়ার কমান্ডের পুরােটাই উপহার হিসাবে দেয়া হয় তাহলে তিনি মনে করবেন ক) শেষ পর্যন্ত ইসরাইল তার অংশ পেলাে এবং খ) বিমানগুলােতে কিছু ত্রুটি আছে এবং ওগুলো গ্রহণ করে তিনি আমাদের জন্য কিছু সুবিধা করে দিয়েছেন।
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1979.11.26-kissinger.pdf” title=”1979.11.26 kissinger”]