You dont have javascript enabled! Please enable it!

অষ্টম প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তার | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২০ নভেম্বর ১৯৮১ 

বিচারপতি আবদুস সাত্তার ১৯০৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতায় পড়াশোনা করেন। এম, এ ও বি, এল ডিগ্রী লাভের পরে তিনি ১৯২৯ সালে কলকাতায় আইন ব্যবসায় শুরু করেন। তিনি ১৯৩৯ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ও ১০৪০-৪২ সালে কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাইবুনালের এ্যাসেসর- মেম্বার ছিলেন। ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা হাইকোর্টের এডভোকেট হন এবং ১৯৪৫ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিযুক্ত হন।

১৯৫০ সালে বিচারপতি সাত্তার এ্যাডভোকেট হিসেবে ঢাকা হাইকোর্টে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে তিনি পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে বিচারপতি সাত্তার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ও শিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৭ সালে তাকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের ও ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের বিচারক নিযুক্ত করা হয়। ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত হন।

বিচারপতি সাত্তার ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জীবনবীমা কর্পোরেশনের পরিচালকমন্ডলীর চেয়ারম্যান ও ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সাংবাদিক বেতন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশ জাতীয় গ্রুপের মনোনীত সদস্যের আহবায়ক ও বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ল এ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল এ্যাফেয়ার্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

১৯৭৫ সালের পর তিনি রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী হন। ১৯৭৭ সালের ৩ জুন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাইস-প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। তিনি আইন ও পার্লামেন্টারী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হবার পরে দেশের সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতি সাত্তার ১৯৮১ সালের ৩০ মে অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে কতিপয় বিপথগামী সশস্ত্র দুষ্কৃতকারীর ৪৮ ঘন্টার বিদ্রোহ সাফল্যের সঙ্গে দমন করা হয় ও দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা হয়।

বিচারপতি সাত্তার রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক ও এইচ, এস সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। পরলোকগত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দেশে পূর্ণ গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৮ সালের গোড়ার দিকে বিচারপতি সাত্তার জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থানের পরে এটিই হচ্ছে প্রথম জাতীয়তাবাদী দল। এই নয়া পার্টি জাগদলই পরে দেশের বৃহত্তম গণমুখী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রেরণা যোগায়। বিএনপি প্রতিষ্ঠায় বিচারপতি সাত্তারের সুযোগ্য নেতৃত্ব ও সুক্ষ্ম রাজনৈতিক বিচারশক্তির যথেষ্ট অবদান রয়েছে। বিএনপি ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করে। বিএনপি চেয়ারম্যান শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী বিচারপতি সাত্তারকে পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মনোনীত করেন। জিয়াউর রহমান নিহত হবার পরে বিচারপতি সাত্তার বিএনপি’ র অস্থায়ী চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

১০৮১ সালের ১৫ নবেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিচারপতি সাত্তার বিপুল ভোটে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মনোনীত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বিচারপতি আবদুস সাত্তার বেসরকারীভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ৮ম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।

৩০ মে ‘৮১ তারিখে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মর্মান্তিক মৃত্যুতে প্রেসিডেন্ট পদ শুন্য হলে সংবিধান মোতাবেক এই নির্বাচন ঘোষণা করা হয়। নির্বাচনে সর্বপ্রথম প্রার্থী হিসেবে মন্চে আসেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বিচারপতি আবদুস সাত্তার। তখন থেকেই বিএনপি তাদের নির্বাচনী বক্তব্য জনগণের কাছে উপস্থিত করতে শুরু করে। অন্যান্য দল তখনো দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাঠিয়ে উঠতে পারে নি। বি এন পি’র বাইরে প্রার্থী মনোনয়নের ব্যাপারে প্রথম সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে জাতীয় নাগরিক পার্টি। জেনারেল ওসমানীকে জাতীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হলেও নির্বাচনের তারিখ পেছানোর ব্যাপারে নাগরিক কমিটি দাবী জানায়৷

প্রার্থীর নাম ঘোষণা না করেই আওয়ামী লীগ তারিখ পিছানোর দাবী জানান। অন্যান্য প্রার্থী ও দলের পক্ষ থেকেও তারিখ পেছানোর দাবী করা হয়। বিভিন্ন দলের দাবীর প্রেক্ষিতে নির্বাচনের তারিখ পেছানো হলে প্রতিদ্বন্দ্বীরা তা মেনে নেন।

প্রার্থী মনোনয়ন ও নির্বাচনী প্রচারণায় প্রায় সবশেষে অবতীর্ণ হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডঃ কামাল হোসেন। প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত বিরোধী দলের একজন একক প্রার্থী মনোনয়নের ব্যাপারে অনেক আলাপ আলোচনা হলেও, শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয় নি। বিভিন্ন পার্টি ও জনমনে একক প্রার্থী হিসেবে জেনারেল ওসমানী গ্রাহ্য হয়ে উঠতে না উঠতেই অন্যান্য প্রার্থীরা প্রার্থীপদের ব্যাপারে অনমনীয় হয়ে ওঠেন।

ওসমানীর নির্বাচনী মঞ্চে আগমন আওয়ামী লীগের (হাসিনা) নেতিবাচক ভূমিকায় বাধা হয়ে ওঠে৷ ডঃ কামাল হোসেন নির্বাচনী প্রচারে আসার পর নির্বাচনী প্রচারণায় নতুন ধারা দেখা দেয়। বিএনপি, ত্রিদলীয় ঐক্যজোট, দেশ প্রেমিক ফ্রন্ট এবং নাগরিক কমিটি নিজ নিজ কর্মসূচী প্রচারের পাশাপাশি আওয়ামী – বাকশাল আমলের দূর্নীতি আর বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা প্রধান করে তোলে। নির্বাচনী প্রচারে নেগেটিভ দিকটাও প্রধান হয়ে ওঠে।

প্রত্যক্ষ ভোটে এবার ছিল দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। স্বাধীনতার আগে এবং পরে এখানে বেশ কয়েকবার পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ এইসব নির্বাচনেও নেগেটিভ প্রচারণা ছিল প্রধান। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের প্রধান কারণ ছিল মুসলিম লীগ ও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের বিরোধিতা। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের বিজয়- ও ছিল পিন্ডিয় বিরোধিতা ভিত্তিক। সেই প্রচারণায় আওয়ামী লীগের কোনো গঠনমূলক ইতিবাচক বক্তব্য ছিল না। ১৯৭৩ সালে যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাকে নির্বাচন না বলে তৎকালীন সরকারের চরম ভাঁওতা বলাই সঙ্গত। কারণ সেবার নির্বাচনে এত ব্যাপক কারচুপি হয়েছে যে, জনগণ আসলে কি রায় দিয়েছিলেন তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু সেই সময় উপযুক্ত বিকল্প যেমন ছিল না তেমনি কোন শক্তিশালী বিরোধী দলও ছিল না কারচুপির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টিতে আন্দোলনের কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে যেতে৷

১৯৭৫ সালের পর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতিবাচক বক্তব্য নিয়ে জনগণের সামনে আসেন। গণভোট এবং প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জিয়া তার কর্মসূচী নিয়েই জনগণের কাছে ভোটের আবেদন জানান। বস্তুতঃ প্রেসিডেন্ট জিয়ার মূল কর্মসূচী- ই ছিলো এবার বিএনপি’ র প্রধান নির্বাচনী কর্মসূচী।  প্রেসিডেন্ট জিয়া যে ১৯ দফা কর্মসূচী নিয়ে ১৯৭৮ সালে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন, সেই ১৯ দফা – ই ছিল এবার বিচারপতি সাত্তারের প্রধান নির্বাচনী ইশতেহার। প্রেসিডেন্ট জিয়া নির্বাচিত হওয়ার তিন বছরে মর্মান্তিক ভাবে মৃত্যুবরণ করায় ১৯ দফার কর্মসূচী বাস্তবায়ন সম্পন্ন করতে পারেন নি। এ কারণেই বিএনপি ১৯ দফাকে তাদের মূল কর্মসূচী ঘোষণা করে। তারা জনগণের কাছে ভোট চেয়েছে প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য। বিচারপতি সাত্তারকে উপস্থিত করা হয়েছে প্রেসিডেন্ট জিয়ার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে। ১৯৮১ সালে বিএনপি’ র এই বিজয়ের মূল কারণ প্রথমত প্রেসিডেন্ট জিয়ার ভাবমূর্তি এবং দ্বিতীয়ত আওয়ামী – বাকশালী আমলের দূর্দিনে ফিরে না যাওয়া।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া রাজনৈতিক অঙ্গনে যে ইতিবাচক ভূমিকার অবতারণা করেন এবার বিএনপি সেই ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রেখেই তাদের নির্বাচনী প্রচার শুরু করে। প্রথম থেকেই তাদের প্রচার জিয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন। প্রার্থীদের মনোনয়ন পত্র জমা দেয়ার আগে নির্বাচনী মঞ্চে ছিল বিএনপি ও নাগরিক কমিটি। নাগরিক কমিটিকে প্রার্থী ও নির্বাচনী ইশতেহারের কথা বলার পাশাপাশি রাজনৈতিক মেরুকরণে ব্যস্ত থাকতে হয়। তারা সম্মিলিত বিরোধী দলের একক প্রার্থীর মাধ্যমে বিএনপি’ র মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন। তাদের প্রধান নির্বাচনী ইস্যু ছিল সংসদীয় পদ্ধতির সরকার কায়েম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একাধিক বিরোধী দলীয় প্রার্থী মঞ্চে আসেন। মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন পার হওয়ার পরই শুরু হয় ব্যাপক নির্বাচনী প্রচারাভিযান। জেনারেল (অবঃ) ওসমানীর পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য প্রার্থী হিসেবে এলেন আওয়ামী লীগের (হা) ডঃ কামাল হোসেন, ত্রিদলীয় ঐক্য জোটের মেজর (অবঃ)এম এ জলিল, দেশপ্রেমিক ফ্রন্টের মোহাম্মদ তোয়াহা, ন্যাপ (মোঃ) – এর অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মওলানা মোহাম্মদউল্লাহ। বলতে গেলে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন থেকে নির্বাচন পর্যন্ত প্রায় এক মাস ছিল সত্যিকারের নির্বাচনী প্রচারাভিযান। জনসভা, পোস্টার, ফেস্টুন আর তোরণ নির্মাণের মাধ্যমে প্রচারাভিযান তুঙ্গে ওঠে এই সময়। বিএনপি প্রথমে ১৯ দফা কর্মসূচী এবং তাদের আমলে যে উন্নয়নমুখী কাজ হয়েছে তা তুলে ধরে। আওয়ামী লীগ (হা) মঞ্চে আসার পর বিএনপি স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী – বাকশালীদের বিরুদ্ধে বলতে শুরু করে। স্বতন্ত্র প্রার্থী মওলানা মোহাম্মদউল্লাহ ছাড়া অন্য সব বিরোধী প্রার্থীও আওয়ামী লীগকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেন এবং জনগণকে আওয়ামী – বাকশালী আমলের বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সেইসব দিনে ফিরে না যাওয়ার আহবান জানান। এরা অবশ্য বিএনপিকেও নানাভাবে আক্রমণ করে বক্তব্য দেন। মওলানা মোহাম্মদউল্লাহ পরোক্ষভাবে বিএনপি’ র সমালোচনা করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের ব্যাপারে তার সম্পূর্ণ নিরবতা রহস্যজনক মনে হওয়ায় ভোটাররা তার ভূমিকা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠেন।

আওয়ামী লীগ (হাঃ) মঞ্চে এসেই চারদিক থেকে আক্রমণের সম্মুখীন হওয়ায় আত্মরক্ষামূলক প্রচারণায় যেতে হয়। এ কারণে প্রায় প্রত্যেকটি সভায় তাদের অতীত কর্মের ব্যাখ্যাই মূল বক্তব্য হয়ে দাড়ায়৷ বাকশালী আদর্শ ও ব্যবস্থা কায়েম করার কথা আবার সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা একই সঙ্গে নির্বাচনী কর্মসূচী হিসেবে ঘোষণা করায় জনসাধারণ তাদের স্ববিরোধিতা সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে ডিফেনসিভে (আত্মরক্ষামূলক) থাকলে স্বাভাবিকভাবেই নিজের দূর্বলতা প্রকাশ পায়। বিচারপতি সাত্তার সঠিক পদক্ষেপ হিসেবেই নির্বাচনী প্রচারের শেষ তিন সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন জনসভায় প্রধান বক্তব্য হিসেবে বাকশাল বিরোধী বক্তব্য তুলে ধরেছেন। বাকশাল বিরোধী বক্তব্যে বিএনপি বাড়তি সুবিধা পেয়েছে অন্যান্য বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের বাকশাল বিরোধিতা থেকে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে এসেছে, বাকশাল বিরোধী প্রবল বক্তব্যে জনমত নতুন করে আরো ব্যাপকহারে বিএনপি এবং বিচারপতি সাত্তারের পক্ষে আসে। প্রেসিডেন্ট জিয়ার ভাবমূর্তি ও ১৯ দফার পাশাপাশি ‘বাকশাল’ প্রতিহত করার কারণে বহু ভোটার বিচারপতি সাত্তারকে ভোট দেয়ার জন্য নতুনভাবে সিদ্ধান্ত নেন। এই সংখ্যা-ও যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য বলে অনুমান করা যায়।

বিএনপি তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার হিসেবে ১৯ দফার পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং স্থিতিশীল প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসনের কথা বলে। স্বাধীনতা – সার্বভৌমত্ব রক্ষা, আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, গ্রামীণ ও কৃষি উন্নয়ন, খাদ্যে স্বনির্ভরতা, সকলের জন্য কাপড়, যথাসম্ভব সবার জন্য বাসগৃহ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, ন্যুনতম চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা, নারীর মর্যাদা ও যুবকদের সংগঠিত করা, বেসরকারী খাতকে উৎসাহ দান, শ্রমিক-মালিক সুস্থ সম্পর্ক রক্ষা, সরকারী চাকুরীজীবিদের মধ্যে জনসেবার মনোভাব সৃষ্টি, জনসংখ্যার বিস্ফোরণ রোধ, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা, দূর্নীতিমুক্ত ন্যায়নীতি ভিত্তিক সমাজ কায়েম, ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সকলের অধিকার রক্ষা ও জাতীয় ঐক্য  সুদৃঢ় করা ১৯ দফার মূল লক্ষ্য। এছাড়া নির্বাচনী প্রচারে খালকাটা কর্মসূচীর মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, নিরক্ষরতা দূরীকরণে সাফল্য ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এটা ছিল প্রচারের ইতিবাচক দিক। এর পাশাপাশি প্রতিপক্ষ হিসেবে আওয়ামী লীগের (হাঁ) বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়া হয়। এটা ছিল প্রচারের নেতিবাচক দিক। আওয়ামী শাসনামলে কল-কারখানায় লুটপাট, রাজনৈতিক কর্মী হত্যা, চুরি ডাকাতি হাইজ্যাক, জনজীবনে ভীতি ও পীড়নের মাধ্যমে সন্ত্রাসের অবস্থা সৃষ্টি, ১৯৭৪ – এ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি ইত্যাদি ব্যাপারে জনগণকে অবহিত করেন বিএনপি প্রার্থী।

দেশের মোট প্রায় ৪ কোটি ভোটারের প্রায় ৯৩% হলেন গ্রামীণ ভোটার। মূলত গ্রামের ভোটই নির্ধারণ করে নির্বাচনের ফলাফল কি হবে৷ এবারেও এ কথা সত্য। গ্রামের মানুষের ভোটই নির্বাচনে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। তাদের অধিকাংশ যাকে ভোট দিয়েছেন তিনিই নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৭০ সালের গণআন্দোলনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি হয়৷ কিন্তু স্বাধীনতার পর ১৯৭২ -৭৫ পর্যন্ত গ্রামের মানুষের সকল আশা আকাঙ্ক্ষাই নিস্ফল কান্নায় রূপ নেয়৷ উপরন্তু বাড়তি পাওনা হিসেবে আসে আওয়ামী সন্ত্রাস ও রক্ষী বাহিনীর অকথ্য নির্যাতন। গ্রামের মানুষ এবং শহরেও জনগণ আওয়ামী-বাকশালী নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। ১৯৭৫ সালের পর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিশেষ করে গ্রামের মানুষকে নতুন আশার বাণী শোনালেন এবং তাদের দেশ গঠনে প্রত্যক্ষভাবে অংশীদার করলেন৷ সারা দেশের গ্রামে গ্রামে তিনি সৃষ্টি করলেন নতুন উদ্দীপনা,  নতুন জাগরণ। প্রতিদিনের বিভীষিকাময় মুহূর্তে কাটাবার দুঃসহ যাতনা থেকে গ্রামের মানুষকে মুক্তি দিতে এগিয়ে আসেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। দলে দলে মানুষ তার ডাকে সাড়া দেয়। গ্রামে গ্রামে শুরু হয় রূপান্তরের পালা। গ্রামের এই মানুষেরা এখনও প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রতি অনুগত। তারা জিয়ার উত্তরসূরীকে নতুন করে সুযোগ দিয়েছেন তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে অগ্রণী হতে। তাছাড়া স্বাভাবিকভাবেই গ্রামের মানুষ বাকশালী সন্ত্রাসের দিনে ফিরে যেতে চায় নি। আওয়ামী লীগ তাদের কাছে এখনও মূর্তিমান এক বিভীষিকা। বিচারপতি আবদুস সাত্তারের বিজয় তাই ঘটনার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

বিচারপতি সাত্তারের কাছে প্রত্যাশা

জনগণ বিপুল ভোটে বিচারপতি সাত্তারের কাঁধে নতুন দায়িত্ব তুলে দিয়েছে। জনগণের বিরাট এবং ব্যাপক প্রত্যাশা এখন তার কাছে। জিয়ার অসমাপ্ত কাজের সূত্র ধরেই বিচারপতি সাত্তারকে এগিয়ে যেতে হবে গ্রাম বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য। এ দেশের  

                                             ছক ১: প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ১৯৮১, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিদের প্রাপ্ত ভোট
জেলা  বিচারপতি আবদুস সাত্তার ডঃ কামাল হোসেন মাওলানা মোহাম্মদউল্লাহ অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী মেজর (অবঃ) এম. এ জলিল অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ
ঢাকা ১৭,৪৭,০৩১ ৫,৪৪,৩৪৯ ৬০,২৫৮ ১১,৮২৮ ২৩,০২৬ ১৪,৭৯০
টাঙ্গাইল ৩,৮০,২৪৪ ১,২৪,৮৬২ ৪,৪২৩ ২,২৯২ ১১,৫১৭ ২,৭৮৮
জামালপুর ২,৮৯,৩৫১ ১,৪৯,৮৭৪ ৪,৮০৩ ২,১৩৭ ৯১,৪৮৪ ৪,১৩৭
ফরিদপুর ৬,০১,৮২৪ ৫,০০,৮৫৪ ৩৩,৮০৭ ৪,৬৬৬ ১৮,৬৫৬ ১৫,৭৮৮
ময়মনসিংহ ৮,৮২,৫১৬ ৪,৭৪,৯৬৫ ৩৫,৫৭২ ৬,৮০১ ১২,৫২২ ১৩,৪৮৯
চট্টগ্রাম ১১,১৪,৪১৮ ২,৮৪,৮১৬ ১১,৬৪৭ ৭,২৬৩ ১৮,৮০৮ ৬,২৮৬
পা: চট্টগ্রাম ৫৪,১৪৩ ২৫,৬৯৮ ৬৮৬ ৩৮১ ১,৫০৫ ১,৩২৯
বান্দরবান ১৯,৭৩১ ৭,৭৮২ ৩৪৫ ১৩২ ১৩৪ ৬৯২
নোয়াখালী ৫৬,৪৮৮৯ ১,৪১,৫৯১ ১৯,৫২৩ ৬,৫২৩ ৩০,০৩৩ ২,১৯৯
কুমিল্লা ১২,৭৩,৫৮২ ৩,২০,৭০০ ৩০,৯২৩ ১০,৫৭০ ৭,৪৩০ ১২,৭৩৩
সিলেট ৭,১৬,৫৬৮ ৪,৫৬,৭৯৮ ৭০,৩১৫ ২,০০,২৯০ ৭,৫০২ ২৪,৫৫৮
রংপুর ১০,৫৩,০৯৫ ৪,২৪,৭১৯ ১৩,৩৮৬ ৯,৪১৯ ১৩,৩০৫ ১৮,৯৩৭
দিনাজপুর ৪,৫৯,৬১৫ ৩,৩১,৭৭৬ ৬,৫৭২ ৪,২৭৯ ৭,৭৮৪ ২৬,১৫৪
বগুড়া ৫,৬৫,৫৮৭ ১,২৯,৯৯০ ৫,২৩৯ ৪,৫৫২ ৭,২০০ ৫,৭৪৬
রাজশাহী ৯,২৯,৭৯৮ ৩,৩১,৭৭৬ ৭,২০৫ ১১,১৫০ ১০,৫৭৩ ২১,৯১২
পাবনা ৫,২৬,৫৬৪ ১,৭৬,৫৮৮ ৫,৬৮৯ ৩,১৪৩ ১২,৬৭১ ৩,৯৭৮
কুষ্টিয়া ৪,১৬,৩২৪ ৯,২০,৩২১ ৪,০৩৭ ৩,১১১ ১৭,২২৪ ৬,১৪৬
যশোর ৬,৮৯,১৪৪ ৩,৪১,৯৯৯ ২৬,৬০২ ৩,১৫৪ ৮,২৭৮ ১৫,৩২১
খুলনা ৭,৪৩,৭৭১ ৩,৯৪,২২৯ ২৫,২৫১ ৫,৮১২ ৮,৬০৩ ১৮,১৮০
পটুয়াখালী ২,১৪,৩৩৭ ১,৪২,৭২৩ ৯,৪৯২ ৮৪৮ ৪,০৮৬ ৩,৫২৭
বরিশাল ৯,৭৪,২৬৯ ২,২৭,৩৬৪ ১০,৪৩৯ ৩,৬৪৭ ২৬,৯৯৬ ৫,০০১
সর্বোমোট ১,৪২,১৭,৬০১ ৫৬,৯৪,৮৮৪ ৩,৮৭,২১৫ ৩,৩২,০০৩ ২,৪৯,৩৪০ ২,২৪,৭৬৬

দরিদ্র মানুষের চাহিদা খুব বেশী নয়। অধিকাংশ জনগণ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন৷ প্রেসিডেন্ট জিয়া মানুষকে এই অমানবিক পরিস্থিতির হাত থেকে মুক্ত করে তাকে দিতে চেয়েছিলেন যোগ্য সামাজিক মর্যাদা আর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। কদিন আগে ১৫ নবেম্বর বিচারপতি সাত্তারকে বিপুল ভোটে জয়ী করেছেন জনগণ এই সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য। তারা মানবেতর জীবন থেকে মুক্তি চান। বিচারপতি সাত্তার তার দীর্ঘ প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতায় নিশ্চয়ই এটা জানেন এবং বোঝেন। সবাই এখন আশা করছেন বিচারপতি সাত্তার সঠিক পথেই এগোবেন।

দেশের সংবিধানে সামাজিক ন্যায় বিচারের কথা বলা আছে। ১৯ দফার মধ্যেও আছে মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা। কিন্তু আমরা জানি এই পথে এগোতে হলে প্রতিবন্ধকতা কম নয়। তবে এটাও বুঝতে হবে নয় কোটি মানুষের এই দেশে শতাধিক মানুষ কোটিপতি হলে দেশের সুদিন এসেছে বলা যায় না। সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন যদি না হয় তবে মানুষের মর্যাদা বা নিরাপত্তা কোনটাই পাওয়া সম্ভব নয়। এ কথা এখন আর অস্বীকার করা যায় না যে এমন অনেকেই আছেন যারা অসাধু উপায়ে সম্পদের পাহাড় তৈরী করেছে৷ অনেকের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পদ গড়েছেন। দেশের যে বিপুল সংখ্যক মানুষ বিচারপতি সাত্তারকে ভোট দিয়েছেন তারা চান তিনি দূর্নীতি দমনে কঠোর হবেন। বিএনপি কর্মী, নেতা এমন কি কোন মন্ত্রীও যদি অন্যায়ভাবে সম্পদ গড়ে তোলেন তবে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে এই আশা সবার। কারণ দূর্নীতি দমন করা না গেলে উৎপাদনের সুফল কখনোই গ্রামের মানুষের কাছে যাবে না, যাবে না সেই সব মানুষের কাছে যারা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত।

অবশ্য জিয়ার মতোই বিচারপতি সাত্তারকে মানুষ বিশ্বাস করেছেন। তার উপর আস্থা স্থাপন করেছেন। তারা এই আশা করেন যে, বিচারপতি সাত্তার এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে মুক্তির পথ দেখাবেন। বিচারপতি সাত্তার নিজেও বহুবার এই অঙ্গীকার করেছেন। এই অঙ্গীকার থেকে তিনি কখনোই দূরে সরবেন না এটাই সকলের বিশ্বাস। বিএনপি’ র একজন বিশিষ্ট নেতা বলেছেন, “বিচারপতি সাত্তার প্রয়োজনে জিয়ার চাইতেও কঠোন হবেন। দূর্নীতি তিনি কঠোর হাতেই দমন করবেন। তিনি নিজেই বলেছেন, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জাতির কর্ণধার হিসেবে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সঙ্গেই থাকবেন। “

– চিন্ময় মুৎসুদ্দী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!