ইন্দিরা গান্ধীর সাথে খুবই সন্তোষজনক আলোচনা- ভুট্টোর প্রতি বঙ্গবন্ধু
নয়াদিল্লি। বাংলাদেশকে পাকিস্তান স্বীকৃতি না দিলে পাকিস্তানের সাথে কোনো আলোচনা হবে না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ এখানে পুনরায় দৃঢ়তার সাথে এ কথা বলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনার পরই বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে জনাব ভুট্টো বা অপর কোনো পাকিস্তানি কর্মচারীর সাথে কথা বলতে বাংলাদেশের কোনোই আপত্তি নেই। প্রধানমন্ত্রী একজন প্রশ্নকারীকে বলেন, চীন-মার্কিন আলোচনা এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার আলোচনায় কোনো সাদৃশ্য টানা যায় না। বঙ্গবন্ধু বলেন, আপনার স্মরণ আছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এক দেশ ছিল। অতঃপর বাঙালিরা যুদ্ধ করে পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদীদের কবল থেকে নিজেদের মুক্ত করে। তাই কোনো আলোচনা অনুষ্ঠানের আগে বাংলাদেশকে অবশ্যই পাকিস্তানের স্বীকৃতি দেওয়া দরকার।’
যুদ্ধবন্দি প্রশ্ন : যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে বাংলাদেশের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না জিজ্ঞাসা করা হলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আরো একটি নীতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “যুদ্ধবন্দি প্রশ্নে আমাদের নীতি খুবই স্পষ্ট। তারা ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে, তারা গণহত্যা চালিয়েছে এটাতো সর্বজনবিদিত, তারা দেশকে বিধ্বস্ত করে দেয় আর ১ কোটি বাঙালিকে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়, এরপরও আপনারা আমাকে এ প্রশ্ন করছেন। দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দু’ঘণ্টা ব্যাপী আলোচনার পর পরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নীতি নির্ধারণী বিষয় ব্যক্ত করেন।
আলোচনা বৈঠক : দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচিত বিষয়বস্তুর বিষয় সম্পর্কে অবিলম্বে বিশেষ কিছুই জানা যায় নি। তবে মনে হয়, দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন বিষয় ছাড়া উভয় নেতাই পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিষয়, যুদ্ধবন্দি প্রশ্ন ও জাতিসংঘের বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আলোচনায় খুবই আগ্রহী ছিলেন। প্রথম এক ঘণ্টাকাল দুই প্রধানমন্ত্রী কোনো সাহায্যকারী ছাড়াই আলোচনা করেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আব্দুস সামাদ, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার স্মরণ সিং, বাংলাদেশের হাইকমিশনার ড. এ আর মল্লিক, ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পি এন হাকসার ও ভারতের পররাষ্ট্রদফতরের সেক্রেটারি শ্রী এসকে ব্যানার্জী পরে আলোচনায় যোগদান করেন। স্বদেশ যাত্রার প্রাক্কালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন যে, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তার আলোচনা হয়েছে। তার আলোচনায় তিনি খুবই সন্তোষ্ট হয়েছেন। সহযোগীতা এবং পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনার সুযোগের জন্য তিনি শ্রীমতি গান্ধীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
চীনা তেটো : সাংবাদিক সম্মেলনেও বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে চীনের ভেটোদানের প্রশ্নে সংক্ষেপে আলোচনা করেন। বাংলাদেশকে জাতিসংঘের বাইরে রাখার জন্য কতিপয় শক্তির ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য তার সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। বাংলাদেশ বাস্তব সত্য। আর এ সত্যকে এক সময়ে না এক সময়ে সকল শক্তিকেই স্বীকার করতে হবে। আর কেউ যদি বাংলাদেশকে জাতিসংঘের বাইরে রাখতে চায়, তো সেটা তাদের ব্যাপার। সে সম্পর্কে আমার কিছুই বলার নাই।’ বাংলাদেশে এখনও ভারতীয় সৈন্য রয়েছে- নিরাপত্তা পরিষদে চীনের কথিত অভিযোগ সম্পর্কে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলে শেখ মুজিব চড়া গলায় বলেন, বাংলাদেশের মাটিতে এখন একজনও ভারতীয় সৈন্য নেই। যদি কেউ একথা বলে থাকে, তারা মিথুক, মিথুক। ভারত ও বাংলাদেশের মুখে কালি লেপনের জন্যই তারা একথা বলছে। শেখ মুজিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ২৫ মার্চ নাগাদ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ওয়াদা করেছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ১৫ মার্চের মধ্যেই শ্রীমতি গান্ধী ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করে নেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশের এটা সৌভাগ্য আর আমরা শ্রীমতি গান্ধী, ভারতের সরকার ও জনগণের নিকট কৃতজ্ঞ। কারণ তারাই আমার জনগণকে দেখাশোনা করেছিলেন। তা না হলে, আমাদের লোকদের ভাগ্যে যে কি ঘটতো, তা বলা মুশকিল।
আলোচনা সন্তোষজনক হয়েছে : ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার আলোচনা প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বলেন, আমরা সহযোগিতা ও পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছি। আমাদের আলোচনা খুবই সন্তোষজনক হয়েছে। আমাদের মধ্যে আলোচনায় পূর্ণ সমঝোতা হয়েছে।’
স্বদেশ যাত্রা : ভারতের রাজধানীতে ৩ ঘণ্টা অবস্থানের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী স্বদেশ যাত্রা করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরকার শরণ সিং, দেশরক্ষামন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম ও মন্ত্রীসভার অপরাপর সদস্যরা পালাম বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বিদায় সম্বর্ধনা জ্ঞাপন
পালাম বিমান বন্দরে আন্তরিক অভ্যর্থনা জ্ঞাপন : পূর্বাহ্নের খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ১১.১৫ মিনিটে নয়াদিল্লি আগমন করেন। এ সময় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। বঙ্গবন্ধুকে পালাম বিমান বন্দরে এক অনাড়ম্বর ও আন্তরিক সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী হাতে ছাতা ধরে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। হাসতে হাসতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নেমে আসেন। এ সময় তাকে উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল।৫৩
রেফারেন্স: ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭২, দৈনিক বাংলা
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ