You dont have javascript enabled! Please enable it!

মানুষকে বাঁচানোর জন্যে সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠনের দাবি- মওলানা ভাসানী

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সর্বগ্রাসী দুর্ভিক্ষের কবল থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্যে অবিলম্বে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ এবং জাতীয় কনভেনশন ডেকে একটি সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠনের দাবি করেছেন। রোববার পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতাকালে মওলানা ভাসানী বলেন, গ্রাম বাংলার মানুষ আজ ভুখা। না খেয়ে মানুষ মরছে। চাল ডাল তেল লবণের দাম বেড়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। তাই সরকারের প্রতি জনগণের কোনো আস্থা নেই। সর্বদলীয় একটি জাতীয় সরকার গঠন করে দুর্ভিক্ষের মোকাবেলা করা সম্ভব বলে মওলানা ভাসানী মন্তব্য করেন। দেশব্যাপী ভুখা মিছিল দিবসে ন্যাপের উদ্যেগে অনুষ্ঠিত পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানীই বক্তৃতা করেন এবং কাজী জাফর আহমদ সরকারের নিকট পেশ করার জন্যে লিখিত একটি দাবিনামা পাঠ করে শুনান। প্রতিকূল আবহাওয়া এবং বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে জনসভায় উপস্থিত শ্রমিক জনতা হাত তুলে দাবি মানার প্রতি সমর্থন জানান।
একটানা হালকা বৃষ্টিপাতের মধ্যে বক্তৃতাকালে মওলানা ভাসানী বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের রায়ই চূড়ান্ত। বাংলাদেশের সরকারকেও সাড়ে ৭ কোটি মানুষের কথা মতো চলতে হবে। নইলে গদি ছাড়তে হবে। তিনি বলেন, বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করে জনতার দাবির কাছে মাথা নত করে পদত্যাগ করেছিলেন। সুয়েজ সংকটের সময় বৃটেনবাসী দাবি করলে ইডেন সরকার পদত্যাগ করেছিলেন। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বলে জনতার দাবি অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ করা উচিত। ভুখা মিছিলের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও সরকারের বক্তব্যের জবাব দিয়ে মওলানা ভাসানী বলেনঃ ভুখা মিছিল যারা করেন তারা নাকি দেশ ও স্বাধীনতার শত্রু ? চীন মার্কিনের দালাল। কিন্তু ভুখা মিছিল আমরা অতীতেও অনেকবার করেছি। আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে ১৯৫৬ সালে আবু হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে আমরা ভুখা মিছিল করি। জিঞ্জিরা থেকে আগত ভুখা মিছিলের ওপর সেদিন পুলিশ গুলি চালালে তিনজন নিহত হয়েছিল, এর আগে লিয়াকত আলীর আমলে মুজিবকে নিয়েই আমি ঢাকায় ভুখা মিছিল করি। এছাড়া ইস্কান্দার মির্জার শাসনামলে খাদ্যের দাবিতে আমি ১৭ দিন এক নাগাড়ে অনশন ধর্মঘট করেছি। কিন্তু সেদিন তো আওয়ামী লীগের কেউ আমাকে বলে নাই ভুখা মিছিল করলে স্বাধীনতা ধ্বংস হবে। তবে আজ কেন ভুখা মিছিলের সাথে দেশের স্বাধীনতা নস্যাৎ হবার প্রশ্ন আসে। স্বাধীনতাকে বরবাদ করার জন্যে ৩০ লক্ষ লোক শহীদ হয় নাই। মজলুম জননেতা বলেন, গদি দখল বা পরিষদের সদস্য হবার জন্যে আমরা ভুখা মিছিল করি না। আমাদের মিছিল হলো দেশের হিন্দু, মুসলমান, বোদ্ধ, খ্রিষ্টান সকল মানুষের অন্ন বস্ত্রের দাবি নিয়ে। তা না হলে জনগণের দাবি পুরণ হবে না।
লালবাহিনীর সম্পর্কে : লালবাহিনীর নেতাদের সতর্ক করে দিয়ে মওলানা ভাসানী বলেন, সাপুড়ে শেষ পর্যন্ত সাপের কামড়েই মরে। লালবাহিনীকে নিয়ে যারা খেলছে, পরিণামে লালবাহিনীর হাতেই তারা জব্দ হবে। কারণ লালবাহিনীতে যারা সদস্য তারা মন্ত্রী, আমলা বা অফিসারের ছেলে নয়। এদেশের গরিব জনগণের সন্তান তারা। তাদেরকে দিয়ে গরিব জনগণের আন্দোলন দমন করা যাবে না।
মোজাফফর আহমদের সমালোচনা : অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের সমালোচনা করে মওলানা ভাসানী বলেন, মোজাফফর আমাকে বাংলাদেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু দেশ কারো পৈত্রিক সম্পত্তি নয়। বৃটিশ গভর্নমেন্ট ১৯২৪ সালে আমাকে ২৪ ঘণ্টার নোটিশ দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করার হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু আমি বাংলা ছাড়ি নাই। বৃটিশের অর্ডার অমান্য করেছি। আমাকে যদি মারতে হয়, গুলি কর, ফাঁসি দাও। জনগণের জন্য শহীদ হবার অধিকার আমার আছে। ভারতের বাঙালিদের উদ্দেশ্যে মওলানা ভাসানী বলেন, মাড়োয়ারীরা ভারতের বাঙালিদের গোলাম করে রেখেছে। বাংলা ভাষার স্বীকৃতি তাদের নাই। আমরা লড়াই করে বাংলাভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছি। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ভারতের বাঙালিরাও ইচ্ছে করলে আমাদের সাথে বৃহত্তর বাংলায় আসতে পারে। এই প্রসঙ্গে অখণ্ড বৃহত্তর বাংলার দাবির কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, কোলকাতাতে অবিভক্ত বাংলার হিন্দু মুসলমান নেতারা একত্রে বসে বৃহত্তর বাংলা নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র করার পরিকল্পনা করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আমরা ভারত বা পাকিস্তান কারো সাথে যেতে চাইনি। আরো ভারতের বাঙালিরা চাইলে বাংলা ভাষাভাষি জনগণকে নিয়ে স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা করতে পারি। তিনি বলেন, বাঙালি মোঘল পাঠানের গোলামী করে নাই। অশোকের নিকটও স্বাধীনতা স্বীকার করে নাই। ভবিষ্যতেও তারা কারো গোলামী করবে না। রক্তের টানে বাঙালি একদিন বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠা করবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
চীনের ভেটো প্রসঙ্গে : চীনের ভেটোর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মওলানা ভাসানী বলেন, গনচীন আমার আত্মীয় নয়। আমার আগে চীন সফর করেছে সোহরাওয়ার্দী, মুজিব ও মানিক মিয়া। চীনের স্বীকৃতি আদায়ের জন্যে মুজিবকে সঙ্গে নিয়ে আমি গণচীনে যেতে রাজি আছি। মুসলিম জাহানের স্বীকৃতির জন্যেও আমার যেতে আপত্তি নেই। কিন্তু সরকার হিন্দুস্তানের ওপর নির্ভর করে থাকলে ২২ বছরেও চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে না। তিনি বলেন, হিন্দুস্তানের জনগণের বন্ধুত্ব আমরা চাই। কিন্তু ভারত, রাশিয়া, চীন বা আমেরিকার কারো গোলামী আমরা করবো না।
ভুট্টোর আপার চেম্বার খালি : পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের ছেড়ে দেবার আহ্বান জানিয়ে মওলানা ভাসানী বলেন, ভুট্টোকে বলেছি বাঙালিদের ছেড়ে দিতে। কিন্তু তার আপার চেম্বার খালি নইলে সে বাঙালিদের ছেড়ে দিত। বাঙালিদের ফেরত ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য তিনি ভুট্টোর প্রতি আবার আহ্বান জানান।৯

রেফারেন্স: ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭২, দৈনিক বাংলা
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!