You dont have javascript enabled! Please enable it!

পরাজয়ের সাক্ষ্য | সিদ্দিক সালিক | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৭ ডিসেম্বর ১৯৮২

[লেখক ’৭১ সালে ছিলেন পাক-বাহিনীর জনসংযোগ মূখ্য ব্যক্তি। পুরো একাত্তর সাল প্রত্যেকটি প্রধান সংবাদপত্র অফিসে তারা ভারী বুটের শব্দ আতংকের সৃষ্টি করেছে—প্রতিদিনই তিনি সংবাদপত্রের সম্পাদককে টেলিফোনে নির্দেশ দিয়েছেন। যুদ্ধের ওপর ভারতীয় ও পাকিস্তানের সমর নেতাদের বই বেরিয়েছে অনেকগুলো—এটি তারই একটি। উইটনেস টু সারেন্ডার নামের এই বইতে পাকিস্তানী পক্ষের অনেক কথা পাওয়া যায়—যা একান্তভাবেই পাকিস্তানী প্রেক্ষিত—তা সত্ত্বেও ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে চারটি অধ্যায়ের বঙ্গানুবাদ এখানে প্রকাশ করা হলো।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য : ভারতীয় সময় নায়করা ’৭১ সাল নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন, পাকিস্তানীরা লিখেছেন কয়েকটি—দু’পক্ষই আত্মপক্ষের কথা বলেছেন। একজন লিপিবদ্ধ করেছেন বিজয়গাঁথা, একজন দিয়েছেন পরাজয়ের সাক্ষ্য।
দু’পক্ষের লেখা থেকে তৃতীয়পক্ষের কথা কিছু জানা যায়। এই তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ মুক্তিবাহিনীর কোন প্রধান ব্যক্তি আত্মপক্ষের কথা লেখেননি। লেখেননি বলেই দু’পক্ষের লেখা থেকে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান নিরূপণের চেষ্টা হয়।
লেখক এখনো পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে কর্মরত কর্নেল।–সম্পাদক]

বিদ্রোহ
ভারত কেন মার্চের শেষাশেষি বা এপ্রিলের গোড়ার দিকে আমাদের চরম অরক্ষিত অবস্থায় আমাদের ওপর সামরিক হস্তক্ষেপের সুযোগ গ্রহণ করেনি? ১৯৭১-এর যুদ্ধের ভারতীয় সরকারী ইতিহাসকর মেজর জেনারেল ডি কে পালিত বলেছেন, ভারতের সেনাবাহিনীপ্রধান সে দায়িত্ব গ্রহণ করতে এই কারণে অস্বীকৃতি জানান যে, সশস্ত্র বাহিনী তখনও সুসজ্জিত ও সুসংগঠিত হবার প্রক্রিয়ায় আত্মনিয়োজিত ছিল। জেনারেল পালিত জানান, ৫০০০ কোটি রোপিয়া ব্যয়সাপেক্ষ পঞ্চবার্ষিক প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা তখন বাস্তবায়িত হচ্ছিল এবং ভারতের সামরিক শক্তিকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তুলবার প্রয়োজনে আরও অনেক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের অন্যপক্ষীয় ছিল। তিনি বলেন :
সেনাবাহিনীতে জনশক্তির যোগান তখনও পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি এবং অনেক ইউনিট তখনও ছিল দুর্বল। কয়েকটি সাঁজোয়া রেজিমেন্ট পুরোপুরি গড়ে তোলা ও সুসজ্জিত করার কাজ তখনও শেষ হয়নি। সুষ্ঠু তৎপরতা চালাবার জন্যে আবশ্যিক প্রশাসনিক ও লজিস্টিক ইউনিটের নানান সীমাবদ্ধতা দূর করা হয়নি। বিমান বাহিনীতে জঙ্গী বিমান মিগ-২১-এর উৎপাদন কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়নি এবং খুচরো যন্ত্রপাতির অভাবে বিমান বহরের কর্মক্ষমতা ছিল নিম্নপর্যায়ের। নৌবাহিনীর ক্ষেত্রেও পুনঃসজ্জার কর্মসূচী তখনও শেষ হয়নি। সশস্ত্রবাহিনীকে যুদ্ধের জন্যে পূর্ণভাবে প্রস্তুত করবার উদ্দেশ্যে জরুরী কার্যক্রম গ্রহণের জন্যে আরও কয়েক মাস সময়ের প্রয়োজন ছিল।….তার চাইতে বড় গুরুতর ব্যাপার হল যে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার চাহিদার কারণে সেনাবাহিনীর মধ্যে শক্তির ভারসাম্য বিপর্যস্ত ছিল। পশ্চিমবঙ্গে দুই ডিভিশন সৈন্য (ভারী অস্ত্র ছাড়া) এবং নাগাল্যান্ড ও মিজো পার্বত্য এলাকায় এক ডিভিশন করে সৈন্য মোতায়েন করা হয়। বাংলাদেশে হামলা চালাবার উদ্দেশ্যে কোন ঘাঁটি নির্মাণ না করায় এই পর্যায়ে আকাশ যুদ্ধের অস্ত্র ব্যবহার অসম্ভব হয়ে ওঠে। শীলচরে কুড়িগ্রাম বিমান ক্ষেত্রকে কুমিল্লা রণাঙ্গনে আক্রমণ চালাবার জন্যে ব্যবহার করতে হত, কিন্তু তা আক্রমণ চালাবার জন্যে পর্যাপ্ত ছিল না।’
পরে ‘দি লিবারেশন ওয়ার’-এর সহ-গ্রন্থকার হিসাবে শ্রী কে, সুব্রাহ্মনিয়াম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্যে কমপক্ষে নয় মাসের সময়ের প্রয়োজন বলে নির্ধারণ করেন। তিনি বলেন,‘…..এ ধরনের সফল আক্রমণ পরিচালনার আগে সব ধরনের প্রস্তুতি চালানো, বিশ্বজন মতামত গড়ে তোলা, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ ইত্যাদির জন্যে আমাদের নয় মাস সময় দরকার।’
সামরিক প্রস্তুতি ছাড়াও চীনা হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা কূটনৈতিকভাবে বন্ধ করা এবং অনুকূলে বিশ্বমত তৈরি করার জন্যেও ভারতের সময়ের প্রয়োজন ছিল। ভারতকে একই সঙ্গে এইসব ক্ষেত্রে তৎপরতা শুরু করতে হয়। ভারতের বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানরা যখন তাঁদের সশস্ত্র বাহিনীর পুনর্বিন্যাস ও পুনঃসজ্জার কাজ দ্রুতগতিতে করে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারত-সোভিয়েত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি সম্পর্কিত পুরনো একটা প্রস্তাবকে চাঙ্গা করে তোলেন এবং ১৯৭১-এর ৯ আগস্ট চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। ভারত নিজের অনুকূলে বিশ্বমতকে প্রভাবিত করবার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অনিশ্চিত পরিস্থিতির জন্যে ভারতে পালিয়ে শরণার্থীদের উপস্থিতির বিষয়কে কাজে লাগায় এবং গুণান্বিত করে।
এদিকে বিদ্রোহ দমনের ব্যাপারে ভারত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অবাধ সুযোগ নিতে দেয়নি। সে সাধারণভাবে ‘মুক্তিবাহিনী’ নামে পরিচিত বিদ্রোহী বাহিনী গড়ে তোলে। পূর্ব পাকিস্তানের দলত্যাগী ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের লোকরা এই বিদ্রোহী বাহিনীর মূলশক্তি হিসেবে কাজ করে। এই বাহিনীতে এসে যোগ দেয় ছাত্র, আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবী ও সক্ষম শরণার্থীরা। কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম,এ,জি, ওসমানী এদের সর্বাধিনায়ক হন।
এই বিদ্রোহী বাহিনীর জন্যে রাজনৈতিক ছত্রছায়া যোগাবার উদ্দেশ্যে ২৫ মার্চ সেনাবাহিনীর তৎপরতার মুখে কলকাতায় পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিকে ভারত কাজে লাগায়। এদের মধ্যে বিশিষ্ট হচ্ছেন তাজউদ্দিন, কামরুজ্জামান, মনসুর আলী, খন্দকার মুশতাক আহমেদ। তাঁরা ভারতের পৃষ্ঠপোষকতা এবং মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় ‘বাংলাদেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে একটি প্রবাসী সরকার গঠনের জন্য সংগঠিত হন।
ভারতের সমরনায়কেরা মুক্তিবাহিনীর জন্য নিম্নরূপ ব্যবস্থাবিধি নির্ধারণ করেন :
‘নিজেদের মাটিতে তাঁদের মোতায়েন করা; উদ্দেশ্য : প্রথমত বঙ্গে সংরক্ষণাত্মক দায়িত্বপালনের জন্যে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সমূহকে উদ্ভিন্ন করা ও ব্যতিব্যস্ত রাখা, দ্বিতীয়তঃ ক্রমাগতভাবে গেরিলা তৎপরতার বিস্তার ঘটিয়ে পূর্ব সেক্টরে পাকিস্তানী বাহিনীসমূহের মনোবলের ক্ষয়সাধন; এবং শেষতঃ পাকিস্তান আমাদের উপরা বৈরিতার সূচনা করলে সে ক্ষেত্রে পূর্বাঞ্চলীয় পদাতিক বাহিনীর সহায়ক হিসেবে ক্যাডারদেরকে কাজে লাগানো।’ (প্রাণ চোপরা, ‘ইন্ডিয়ান সেকেন্ড লিবারেশন দিল্লী, পৃষ্ঠা ১৫৫)।
এই দায়িত্বভার পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সেই মতো মুক্তিবাহিনীকে প্রস্তুত করা হয়। প্রথম পর্যায়ে তাঁদেরকে অন্তর্ঘাতী কর্ম তৎপরতা, চোরাগুপ্তা হামলা, গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলি চালানোর ব্যাপারে চার সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পরবর্তীকালে এই প্রশিক্ষণ আট সপ্তাহ পর্যন্ত চলে এবং এতে সব ধরনের ছোট অস্ত্র চালনাসহ আরও কিছু সমরকৌশল শেখানো হয়।
পরিশেষে, এদের মধ্যে ৩০ হাজার সদস্যকে ভারতের নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি চিরাচরিত পদ্ধতির লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্যে অস্ত্র সজ্জিত ও সংগঠিত করা হয় এবং অবশিষ্ট ৭০ হাজার লোক গেরিলাযুদ্ধ চালাবে বলে স্থির হয়।
পূর্ব-পাকিস্তানের বিদ্রোহ তৎপরতাকে তিনটি পর্যায় ফেলা যায় :
প্রথম পর্যায় (জুন-জুলাই) : তারা সীমান্ত এলাকায় তৎপরতা চালায়, যেখানে ভারতীয় সৈন্যরা তাদের নৈতিক ও বস্তুগত সমর্থন দানের জন্যে সঙ্গে সঙ্গে থাকত। এই পর্যায়ে বিদ্রোহীরা খুবই ভীরু আচরণ প্রদর্শন করে এবং চিহ্নিত হওয়া বা পাল্টা-আক্রমণের সামান্যতম আভাস পেলে তারা নিজেদের আস্তানায় দ্রুত পালিয়ে যেত। এ সময় তাদের প্রধান কয়েকটি সাফল্যের মধ্যে ছিল : ছোটখাট কালভার্ট উড়িয়ে দেয়া, পরিত্যক্ত রেলপথ মাইন দিয়ে উড়িয়ে দেয়া, গ্রেনেড নিক্ষেপ কিংবা কম গুরুত্বপূর্ণ কোন রাজনৈতিক নেতাকে লাঞ্ছিত করা।
দ্বিতীয় পর্যায় (আগস্ট-সেপ্টেম্বর) : তারা নিজেদের প্রশিক্ষণ ও তৎপরতা পদ্ধতির ব্যাপারে উন্নতি দেখায়। তাদের মধ্যে আরও আস্থা, প্রেরণা ও নেতৃত্ব গড়ে ওঠে বলে অনুমিত হয়। এ সময় তারা সামরিক কনভয়ের উপর অতর্কিত হামলা চালায়, থানার উপর আঘাত হানে, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানসমূহ উড়িয়ে দেয়, নৌযান ডুবিয়ে দেয় এবং বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করে। তাদের এ তৎপরতা ঢাকা পর্যন্ত প্রসারিত হয়।
তৃতীয় পর্যায় (অক্টোবর-নবেম্বর) : তারা সীমান্তে ও অভ্যন্তরে মোটামুটি ভালভাবে তৎপর হয়ে ওঠে। ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট এই বাহিনী সীমান্ত ফাঁড়িগুলোতে প্রচন্ড হামলা চালায় এবং গুরুত্বপূর্ণ নগর ও শহরে গোলযোগ উসকিয়ে দেয়। এই দ্বৈত হামলা আমাদের সম্পদের হানি ঘটায় এবং মনস্তাত্ত্বিক চাপের সৃষ্টি করে।
এদের তৎপরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ শিবিরের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এই সংখ্যা ছিল মে মাসে ৩০টি, আগস্ট ৪০টি এবং সেপ্টেম্বরে ৮৪টি। প্রত্যেক শিবিরে এক প্রশিক্ষণ-চক্রে ৫০০ থেকে ২০০০ বিদ্রোহীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার ক্ষমতা ছিল। যুদ্ধের আগে পর্যন্ত এদের সংখ্যা মোট ১ লাখে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রথম প্রথম, বিদ্রোহীদের জন্যে অস্ত্র ও সরঞ্জাম পাওয়ার ব্যাপারে ভারতের কিছু সমস্যা ছিল, তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পর এতবড় একটা পরাশক্তির কাছ থেকে তার সম্পদ পাবার সুযোগ হয়ে যায়। ‘ভারত বিদ্রোহীদের যেসব আস্ত্র দিচ্ছে, তার স্থলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ করবে, এই মর্মে সোভিয়েত নিশ্চয়তার পরই কেবল গেরিলাদের কাছে ভারতের অস্ত্র সরবরাহ বৃদ্ধি পায়।’ (‘নিউজ রিভিউ অন পাকিস্তান’, নিউ দিল্লী, নব্ম্বের ১৯৭১) ঢাকায় একজন বৃটিশ সাংবাদিক আমাকে জানান, তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত সেকেলে সোভিয়েত অস্ত্রসহ বিদ্রোহীদের দেখেছেন। এইসব অস্ত্র ইতোপূর্বে পূর্ব ইউরোপে স্তূপীকৃত ছিল। এছাড়া ভারতের সহায়তায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বিদেশসহ বাংলাদেশের দূতদের মাধ্যমে সংগৃহীত চাঁদার টাকা দিয়ে কিছু অত্যাধুনিক অস্ত্র কেনেন।
পাকিস্তান এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে কীভাবে?
এই বিদ্রোহের ক্রমবর্ধমান উপদ্রব মোকাবিলার জন্যে তার ছিল ১ হাজার ২শ ৬০ জন অফিসার ও ৪১ হাজার ৬০ জন অন্যান্য পদের লোক। এই জনশক্তি নিয়ে তাকে ৫৫ হাজার ১শ ২৬ বর্গমাইল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে হত।
কিংবদন্তীর গেরিলা নায়ক টি, ই, লরেন্স এই পরিস্থিতির অনুপাত দেখিয়েছেন প্রতি চার বর্গমাইলে ২০ জন সৈন্য। তাঁর এই সংখ্যানুপাত দেয়া হয়েছে মরু অঞ্চলের যুদ্ধবিগ্রহের প্রকরণে, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের মত প্রচুর উদ্ভিদরাজির প্রতিবন্ধকতা নেই। সেই মরু-অঞ্চলের সংখ্যানুপাত ধরলেও পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে পাকিস্তানের দরকার ছিল প্রাপ্ত সৈন্য সংখ্যার প্রায় সাতগুণ। বিদেশী সংবাদদাতা ডেভিড লোশকের মতে, ২ লাখ ৫০ হাজার সৈন্য প্রয়োজন। তা সত্বেও পাকিস্তান এই ব্যাপক বিদ্রোহ পূর্ণ নয় মাস অর্থাৎ যুদ্ধ বেধে যাওয়ার আগে পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রাখে।
পাকিস্তান, গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত ফাঁড়ি, জেলা ও মহকুমা সদরের দখল রক্ষার মাধ্যমে তার উপস্থিতি অব্যাহত রাখে। সে ৩৭০টি সীমান্ত ফাঁড়ির মধ্যে ৯০টি এবং প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ শহর নিজের দখলে রাখে। শহরগুলোয় নিজেদের ঘাঁটি স্থাপন করে সেনাবাহিনী সংলগ্ন এলাকায়, বিশেষ করে বিদ্রোহীদের তৎপরতা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করত। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে যা ঘটত, তা হচ্ছে, শায়েস্তাকারী বাহিনী তাদের (মুক্তিবাহিনী) উপর চড়াও হবার আগেই তারা সটকে পড়ত।
অবশ্য বিদ্রোহের পরবর্তী পর্যায়ে বিদ্রোহীরা প্রায়শঃ এই বাহিনীকে প্রতিরোধ করেছে এবং সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হবার আশঙ্কা থাকলে তবেই তারা নিজেদের গুপ্তস্থানে আত্মগোপন করেছে।
আমাদের বাহিনী এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়ব্যাপী বেশ তৎপর ছিল। ঐ সময় বিদ্রোহেরও ছিল শৈশবদশা। তারপর উপদ্রব যত বাড়তে থাকে, আমাদের অধিনায়করা তত উদাসীন হয়ে পড়েন এবং যে ক্ষেত্রে তৎপর না হলেই নয়, কেবল সেই ক্ষেত্রে তৎপর হন। শেষ পর্যায়ে (অক্টোবর-নবেম্বর) তাঁরা সাধারণতঃ নিজেদের ঘাঁটিতে অবস্থান করাকেই শ্রেয় বলে মনে করেন এবং অধিনায়কত্বের ঝুঁকি নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে, যার মধ্যে প্রধান হচ্ছে, কোন রকম ক্ষয়পূরণের সুযোগ ছাড়া দীর্ঘ অনিয়মিত যুদ্ধ। বাঙালীরা তাদের আচরণের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের পরিণতির উত্থান-পতন অনুসরণ করতে থাকে। তারা স্বভাবতঃ বিজয়ীদলের পক্ষ নেয়। আমাদের সেনাবাহিনী যখন যে এলাকায় থাকত, তারা তখনকার মত আমাদের সঙ্গে থাকত; কিন্তু সেই বাহিনী সরিয়ে নেওয়া হলে তারাও তখন নিজেদের নতুন প্রভুদেরকে (মুক্তিবাহিনীকে) স্বাগত জানাত। বুদ্ধিমান লোকরা নিজেদের কাছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পতাকা রাখত এবং সুযোগমত যখন যেটা দরকার ব্যবহার করত। তবে পতাকা উড্ডীন করার ব্যাপারটা অত সহজ ছিল না। অবস্থা না বুঝে ভুল পক্ষ নিলে সে জন্যে তাদেরকে প্রচুর মাশুল দিতে হত। এ ধরনের একটি ঘটনার উল্লেখ করছি।
ঘটনাটি ঘটে আগস্ট মাসে নোয়াখালী জেলায়। ৭ জন সৈন্যসহ একজন নিম্নপদ্স্থ অফিসারকে বিদ্রোহী অধ্যূষিত একটি এলাকা বিদ্রোহীমুক্ত করার জন্যে নিয়োগ করা হয়। নির্দেশ মোতাবেক এই তরুণ অফিসার ‘কৌশল ও নমনীয়তা’ নীতি গ্রহণ করেন। তার ৫ জন সৈন্য বিদ্রোহীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। এরপর একজন ক্যাপ্টেনের নিয়ন্ত্রণে সেখানে নতুন করে সৈন্য পাঠানো হয়। বিদ্রোহীরাও নতুন শক্তিতে পাল্টা আক্রমণ করে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। ক্যাপ্টেন আগের দলের কয়েকটি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন এবং বুঝতে পারেন কঠোরভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা না করলে ভাগ্যের এমনি নির্মম পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তিনি বিদ্রোহীদেরকে কয়েকদফা জোর হুঁশিয়ারী দেন। কিন্তু এতে কোন ফল হয় না। এরপর তিনি পুরো এলাকা ঘেরাও করে ফেলেন এবং তার সমস্ত অস্ত্র দিয়ে এলাকাটির উপর চরম আঘাত হানেন। চীৎকার, আর্তনাদ আর ঘন কালো ধোঁয়ায় আকাশ-বাতাস আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে।
কিছু সময় পর সাদা পতাকা হাতে একজন বৃদ্ধ লোক যুদ্ধবিরতির অনুরোধ জানিয়ে উপস্থিত হন। এই অনুরোধ মেনে নেওয়া হয়, তবে এই প্রক্রিয়ায় অনেক জীবনের অবসান ঘটে।
এইভাবে কখনও কখনও বিদ্রোহীরাও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে ‘যোগসাজশকারীদের’কে আরও বেশি প্রবলভাবে শাস্তি দিতে সক্ষম হয়।
মূল সমস্যা ছিল নিরীহ সাধারণ লোকদের কাছ থেকে বিদ্রোহীদেরকে পৃথক করে রাখা। মাছ যেমন পানিতে মিশে যায়, তারাও সেভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যেত। জেনারেল টিক্কা খানকে পরামর্শ দেয়া হয় যে, ৩ কিলোমিটার সীমান্ত বেষ্টনী জনশূন্য করা হোক, যেন সেনাবাহিনী ঐ এলাকার সন্দেহজনক প্রত্যেককে গুলি করতে পারে। কিন্তু টিক্কা খান এই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করেন। তার মতে, এ ব্যবস্থা শরণার্থীদের পুনর্বাসন সমস্যাকে আরও সংকটজনক করে তুলবে এবং তখন তিনি ৪ সেপ্টেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের পুনবার্সনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন।
সুতরাং, বিদ্রোহী এবং তাদের আশ্রয়দাতারা বেশ মিলেমিশে অবস্থান করতে থাকে। এদের সবার বাহ্যিক চেহারা একই রকম হওয়ায় একজন থেকে অন্যজনকে পৃথক করা খুব মুশকিল ছিল। যখন-তখন একজন বিদ্রোহী হাতে করে স্টেনগান নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারত, আবার জরুরী অবস্থায় দরকার হলে সেই অস্ত্র ক্ষেতের ভেতর ফেলে দিয়ে একজন নিরীহ চাষীর মত কাজ করে যেতে পারত। অন্যদিকে আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ একজন জেলে নিজের কাজ ফেলে রেখে অগ্রসরমান কোন কনভয়ের সামনে মাইন পুঁতে রেখে সটকে পড়তে পারত। বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে মনে করে এখানে এরকম একটি সত্য ঘটনার উল্লেখ করছি।
রাজশাহী থেকে খবর পাওয়া গেল যে, বিদ্রোহীরা রোহনপুর এলাকায় প্রবেশ করে জনসাধারণের উপর খাদ্য, অর্থ ও আশ্রয়ের জন্যে চাপ দিচ্ছে। একদল সৈন্য ঐ এলাকায় অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে তিনজন লোককে কর্মরত অবস্থায় দেখা ছাড়া আর কিছুই পেল না। এই অবস্থায় তারা ফিরে আসছিল, এমন সময় একজন দাঁড়িওয়ালা লোককে দেখতে পেয়ে তারা সঙ্গীনের মুখে বিদ্রোহীদের অবস্থান জানার জন্যে চাপ দেয়। তারই ইঙ্গিতে সৈন্যরা ঐ তিনজন কৃষককে পাকড়াও করে ক্ষেত থেকে বেশ কয়েকটি গ্রেনেড, যথেষ্ট পরিমাণে বিস্ফোরক ও প্রচারপত্র উদ্ধার করে। এরা তিনজনই মুক্তিবাহিনীর খাঁটি সদস্য বলে প্রমাণিত হয়।
এরা সেনাবাহিনীর চোখে ধুলো দেওয়ার জন্যে আরও বিভিন্ন রকম কৌশল অবলম্বন করত। উদহারণস্বরূপ, জুলাই মাসে বেনাপোল ও রঘুনাথের মধ্যবর্তী স্থলে (যশোর সেক্টরে) দুজন সৈন্য তাদের নিয়মিত টহলের সময় দেখতে পায় যে, একজন অসহায় চেহারার লোক ঝোলা ভর্তি শাকসব্জি নিয়ে যাচ্ছে। তারা কোন বিদ্রোহী দেখতে না পাওয়ায় তাদের সময়ের সদ্ব্যবহার হল না এবং তাই তারা লোকটিকে দেখে লক্ষ্যহীনভাবে বলতে লাগল,‘ঝোলায় করে কী নিয়ে যাচ্ছ, বাবা?’ বৃদ্ধ লোকটি ভয়ে কাঁপতে লাগল। তারা যখন লোকটির ঝোলা খুলল, দেখা গেল, তাতে রয়েছে শাক-সব্জি দিয়ে ঢাকা প্রচুর টাইম-ফিউজ (অন্তর্ঘাতী তৎপরতার জন্যে)।
অনুরূপভাবে লেফটেন্যান্ট ফাররাখ ব্রহ্মপুত্রের চর এলাকায় অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন। তখন মৌসুমী ফলভর্তি একটি নৌকো তিনি আটক করেন। নৌকোর খোল ভর্তি ছিল মাইন ও গ্রেনেড।
বিদ্রোহীরা চিহ্নিত হবার হাত থেকে বাঁচবার জন্যে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করত। আমরা যখন প্রধান পথে যাতায়াত করতাম, তখন তারা সাধারণতঃ গ্রামের পথ ধরে চলাচল করত। রংপুরের একজন বিদ্রোহী, সীমান্তের ওপারে তার এক সশস্ত্র কমরেডের কাছে এক পত্রে লিখল : ‘পাকিস্তানী সেনারা কখনই আমাদের সনাক্ত করতে পারবে না। কারণ, তারা প্রধান প্রধান সড়ক, সর্বাধিক ব্যবহৃত ফেরী এবং প্রধান প্রধান ঘাট পাহারা দেয়; অন্যদিকে আমরা অলিগলি, পার্শ্বপথ এবং অব্যবহৃত রাস্তাঘাটই ব্যবহার করি। এছাড়া তারা নৌকোর খোলের মধ্যে কী আছে, তা লক্ষ্য না করে নৌকোর উপর ভাগই কেবল তল্লাশী করে। আমাদের আশ্রয়স্থল হচ্ছে মসজিদের ইমাম কিংবা শান্তি কমিটির বিশিষ্ট কোন সদস্যের বাড়ি, স্বভাবতঃ সেনাবাহিনী যাদেরকে অননুগত বলে সন্দেহ করছে না। আমাদের উপায়গুলো সূক্ষ্ম, আমাদের উদ্দেশ্য উচ্চ। আমরা জিতবই।’
আরও সময় পেরিযে যাবার পর, অন্তর্ঘাতী কাজে তারা বেশকিছু আধুনিক কলাকৌশল প্রয়োগ করে। যেমন, শুরুতে তারা বুবিট্রাপ ও নিরাপত্তা ভাল্ব ব্যবহার করত, কিন্তু যখন আমরা একটি শূন্য গাড়ি বা মূল গাড়ির অগ্রভাগে রেলবগী জুড়ে দেওয়ার মাধ্যমে এর কার্যকারিতা নষ্ট করার পদ্ধতি শিখে ফেলি, তখন তারা দূর নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মাধ্যমে বৈদ্যুতিক বিস্ফোরক ব্যবহারের কৌশল অবলম্বন করে। এর ফলে তারা চলন্ত লক্ষ্যবস্তু ইচ্ছেমত উড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। যখন তাদের ডাইনামো চিহ্নিত হয়ে পড়ে, তখন তারা ড্রাই ব্যাটারী সেল ব্যবহার করতে শুরু করে, যা সাধারণ টর্চে বা বাঁশের চোঙ্গায় করে অনায়াসে চালান করে দেয়া যায়।
নদীর মোহনায় পরিচালিত অভিযানের ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটত। তারা জাহাজ, বার্জ বা কোস্টারের সঙ্গে নিরেট ধরনের কোন বিস্ফোরক বেঁধে দিত। কিন্তু আগস্ট নাগাদ তারা শম্বুক মাইনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু করে দেয়। এই মাইনের মুখ চুম্বকের হওয়ায় লক্ষ্যবস্তুর যেকোন অংশে একে সহজেই সেটে দেয়া যায়। কিন্তু এক পর্যায়ে এই মাইন তাদের নিজেদের জন্যে বিপজ্জনক হয়ে উঠলে তারা এমন সব ডুবুরী নিয়োগ করতে আরম্ভ করে দেয়, যারা লুকিয়ে ডুবে ডুবে জাহাজের কাছ পর্যন্ত গিয়ে তাতে মাইন গেঁথে দিয়ে আসতে পারত। এই উদ্দেশ্যে ভারতীয় নৌবাহিনী ৩০০ ফ্রগম্যানকে প্রশিক্ষণ দেয়। কখনও কখনও ডুব সাঁতারুর শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্যে তারা নল ব্যবহার করত। পরে তারা বাঁশের টুকরো বা কলাগাছ ভাসিয়ে তার উপর শম্বুক মাইন বহন করে লক্ষ্যবস্তুর দিকে নিয়ে যেত এবং ইস্পাতের সেই লক্ষ্যবস্তুর গায়ে সহজেই তা সেটে যেত।
তাদের অন্তর্ঘাতের তালিকা অনুযায়ী ২৩১টি সেতু, ১২২টি রেললাইন এবং ৯০টি বিদ্যুৎ-কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অতি উচ্চমাত্রার সচেতনতা ছাড়া এত বিপুল পরিমাণে ক্ষতিসাধন তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এখন তাদের তেজস্বিতার একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি।
একটি বাঙালী বালককে অন্তর্ঘাতী প্রচেষ্টা চালাবার অপরাধে ১৯৭১-এর জুন মাসে রাজশাহী জেলার রোহনপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে কোম্পানী সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু সে কোন তথ্য প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানায়। সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে মেজর ‘আর’ তার বুকের দিকে স্টেন-গান তাক করে বলেন,‘এই তোমার শেষ সুযোগ। স্বীকার না করলে, বুলেট দিয়ে তোমার শরীর এফোড় ওফোড় করে দেওয়া হবে।’ এই কথায় সে নতজানু হয়ে বসল, মাটিতে মাথা ঠেকাল, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি এখন মরতে চাই। আমার দেশের পবিত্র মাটির ছোঁয়া পেয়ে আমার রক্ত ধন্য হোক। তবেই তো আমার দেশ তাড়াতাড়ি স্বাধীন হবে।’
আধুনিক কৌশলে সমৃদ্ধ ও উচ্চ প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ এরকম বিদ্রোহীদের সম্পূর্ণ মুছে ফেলা সেনাবাহিনীর জন্যে সহজ কাজ ছিল না, যদিও আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। প্রথম প্রথম সেনাবাহিনী সড়কপথে সৈন্য পাঠাত, কিন্তু কয়েকদফা বিস্ফোরণের পর তাদেরকে গ্রামাঞ্চলে তৎপরতা চালাতে হয়। এর ফলে তাদেরকে চোরাগুপ্তা আক্রমণের শিকার হতে হয়। বর্ষাকালে তারা বিদ্রোহীদের খুঁজে বের করার জন্যে দেশী নৌকো ব্যবহার করত কিন্তু জলপথে চলাচলের প্রশিক্ষণ দেওয়া সত্ত্বেও এক্ষেত্রে পারঙ্গমতা দেখাতে তারা ব্যর্থ হয়। কখনও কখনও হয় তাদের নিজেদের ভুলে নিজেরাই নৌকো ডুবিয়ে বসে, না হয় বিদ্রোহীদের তৎপরতার জন্যে নৌকোডুবি ঘটে। এরপর আমরা কাঁদা ও পাঁকের মধ্যদিয়ে পায়ে হেঁটে অভিযান চালাবার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু আগাছা আর জোঁকের জন্যে আমাদের পক্ষে এই অভিযান আরও পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। সমতল ভূমির লোকদের হয়রানির জন্যে জোঁকই যথেষ্ট। আমি শহীদ নামে একজন লেফটেন্যান্টকে দেখেছি যার পায়ে জোঁকের অসংখ্য কামড় ছিল। যুদ্ধের পরও দীর্ঘদিন তার ক্ষত শুকোয়নি।
খুবই লজ্জার সঙ্গে বলতে হয়, এইসব অভিযান কালে কিছু সৈন্য লুটতরাজ, হত্যা ও ধর্ষণের মত খারাপ কাজ করেছে। সরকারীভাবে ৯টি ধর্ষকের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে এবং দোষীদের গুরুতর শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু শাস্তি দিলেও এতে যা ক্ষতি হবার তা তো হয়েছেই। সব মিলিয়ে এই ধরনের কয়টা ঘটনা ঘটেছে, জানি না, তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একজন সৈন্যও যদি নারী ধর্ষণ করে থাকে তবে তা পুরো সেনাবাহিনীর সততার উপর কালিমা লেপনের জন্যে যথেষ্ট। এই ধরনের বর্বর ঘটনা স্বাভাবিকভাবে বাঙালীদেরকে শত্রুভাবাপন্ন করে তোলে। তারা আগেই আমাদের খুব একটা পছন্দ করত না, এরপর তারা আমাদের আরও প্রচন্ডভাবে ঘৃণা করতে থাকে। এই প্রবণতাকে আয়ত্ত্বে আনবার বা এই ঘৃণার ছাপ মুছে ফেলবার জন্যে গুরুত্বসহকারে কোন প্রচেষ্টাও চালানো হয়নি। এক্ষেত্রে বাঙালীদের কাছ থেকে ব্যাপক সহযোগিতার প্রশ্নই ওঠে না। যারা ইসলাম ও পাকিস্তানের নামে আমাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিলেন তারাই কেবল ঝু্ঁকি নিতে প্রস্তুত ছিলেন।
এসব দেশপ্রেমিক নাগরিক দুই দলে সংগঠিত হন। প্রবীণ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা শান্তি কমিটি গঠন করেন এবং যুবক ও সক্ষম ব্যক্তিদেরকে রাজাকার হিসেবে বাছাই করা হয়। কমিটিসমূহ ঢাকায়, সেই সঙ্গে বিভিন্ন পল্লী এলাকায় গঠন করা হয় এবং তারা স্থানীয় জনগণ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে উপযোগী যোগসূত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। একইসঙ্গে তারা বিদ্রোহীদের কোপানলে পড়ে এবং এদের মধ্যে ২৫০ জন হতাহত বা গুম হয়ে যায়।
পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলা হয় এবং তাদের মধ্যে স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে অংশীদারিত্ব বোধ জাগ্রত করা হয়। রাজাকারদের সংখ্যা ৫০ হাজারে উন্নীত করা হয়—লক্ষ্য ছিল এক লাখের।
সেপ্টেম্বরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত একটি রাজনৈতিক প্রতিনিধিদল জেনারেল নিয়াজীর কাছে অভিযোগ করেন যে, তিনি জামাতে ইসলাম মনোনীত একটি সেনাবাহিনী গঠন করেছেন। জেনারেল আমাকে তার কার্যালয়ে ডেকে বললেন, ‘এখন থেকে তুমি রাজাকারদের ‘আল-বদল’ ও ‘আল-শামস’ নামে পরিচিত করবে। এতে করে কারো ধারণা হবে না যে, এরা একই দলের সদস্য।’ আমি তার আদেশ মান্য করলাম।
আলবদর ও আল-শামসের উৎসর্গিত স্পৃহা ছিল এবং তারা সাগ্রহে সেনাবাহিনীকে সাহায্য করেছে। তারা যেমন কঠোর পরিশ্রম করেছে, তেমনি যথেষ্ট দুর্ভোগও পুইয়েছে। দালালীর অভিযোগে তাদের বা তাদের উপর নির্ভরশীল লোকদের মধ্যে ৫ হাজার জন মুক্তিবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়। তাদের মধ্যে কয়েকজন আত্মত্যাগের এমন মহান নজির স্থাপন করেন, যা বিশ্বের সেরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে তুল্য। উদাহরণস্বরূপ, নওয়াবগঞ্জ থানার গালিমপুরের একজন রাজাকার বিদ্রোহীদের একটি গোপন অবস্থানের খোঁজ করার জন্যে সৈন্যদের সঙ্গে পথপ্রদর্শক হিসেবে যায়। সে ঘরে ফিরে এসে দেখে, তার তিনটি পুত্রকে হত্যা এবং একটি মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে। এই ক্ষতি সেনাবাহিনী ও পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের জন্যই তাকে মেনে নিতে হয়। আর একজন রাজাকার গোমস্তাপুরে একটি সড়ক সেতু পাহারা দেবার সময় বিদ্রোহীদের হাতে পড়ে। বিদ্রোহীরা তাকে ‘জয়বাংলা’ বলাবার জন্যে বলপ্রয়োগ করে, কিন্তু অবিরামভাবে সে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সঙ্গীনের খোঁচায় তাকে প্রাণ দিতে হয়।
অবশ্য প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের ব্যাপারে রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর সমকক্ষ ছিল না। তাদের প্রশিক্ষণ ছিল দুসপ্তাহ থেকে চার সপ্তাহের। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীকে ৮ সপ্তাহের নিবিড় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। রাজাকারদের অস্ত্র ছিল সেকেলে ধরনের ৩০৩ রাইফেল, অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর ছিল স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রসহ অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। তাই সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত থেকে রাজাকাররা ছিল একটা সম্পদ মাত্র, কিন্তু স্বাধীন কোন দায়িত্ব দিয়ে তাদের উপর নির্ভর করা যায়নি। সুতরাং বিদ্রোহের আসল ধাক্কাটা খেতে হয়েছে নিয়মিত বাহিনীকেই এবং তারা নির্ভীকচিত্তে সব দুর্ভোগ মাথা পেতে নিয়েছে। তাদের দুর্ভোগের মাত্রা কেবল হতাহতের সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। গভীরতর আঘাত এসেছিল মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে। সেনাবাহিনীর মনোবল যে জিনিসটার কারণে সবচেয়ে বেশি ভেঙে যায়, তা হচ্ছে, চিকিৎসার জন্যে আহতদের সব সময় সামরিক হাসপাতালে নেওয়া বা নিহতদের পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো সম্ভব হয়নি। আহতরা অনেক সময় হেলিকপ্টারের জন্যে সীমান্ত ফাঁড়িতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছে। কারণ, সড়কপথে সাধারণতঃ মাইন পোঁতা থাকত এবং আচমকা গুলি খাওয়ার ভয় থাকত। অন্যদিকে হেলিকপ্টারই বা আসবে কীভাবে! ‘আঘাত খুবই মারাত্মক এবং আহতকে আকাশ পথে নিয়ে আসা দরকার’, এই মর্মে রেজিমেন্টাল মেডিক্যাল অফিসার (আর-এম-ও) সার্টিফিকেট না দেওয়া পর্যন্ত হেলিকপ্টার পাঠাবার বিধান ছিল না। তাছাড়া, কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ব্যাটেলিয়ন সদর থেকে তিনি আহতের কাছে যেতেও পারেন না। আহতকে যদি অতর্কিত হামলা বা মাইনের কারণে সড়কপথে সরানো সম্ভব না হয়, তাহলে একই কারণে চিকিৎসকই বা কেমন করে সড়কপথে ঐ এলাকায় যাবেন?
অবশ্য আহতদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু ভাগ্যবান ঢাকায় সমন্বিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসিত হবার সুযোগ লাভ করেন। কিন্তু সে দৃশ্য চোখে দেখার মত নয়। কারও বা কয়েকটি প্রত্যঙ্গ কর্তিত, কারও মুখ পুড়ে ঝলসে গেছে, কেউ কেউ চিরতরে অন্ধ বা বধির হয়ে গেছে। এদের অধিকাংশ এমনকি আরোগ্যলাভের পরও পঙ্গু জীবন যাপন করতে বাধ্য হবে। অনেকে ছোটখাট আঘাত, বিক্ষত পা, ছত্রাক ও জোঁকের কামড়ের ক্ষত নিয়েই মাঠে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছে। বহুমাস ধরে তারা বিশ্রাম, অবসর বা বিনোদন কাকে বলে জানে না। আর যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, প্রথম প্রথম তাদের লাশ আমরা পশ্চিম পাকিস্তান পাঠাতাম। কিন্তু জুলাই-আগস্টের দিকে যখন এদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, অনাবশ্যক ভীতি সঞ্চারিত হবে, এই আশঙ্কায় আমরা তখন তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে লাশ পাঠানো বন্ধ করে দেই। এই অপ্রিয় সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সফররত জেনারেল স্টাফ প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি নাকি অবজ্ঞার সঙ্গে মন্তব্য করেন,‘যে মরে গেছে, তার জন্যে পশ্চিম পাকিস্তানই কী আর পূর্ব পাকিস্তানই কী—দুই জায়গায়ই অপ্রয়োজনীয়।’
কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে নিহতদের আত্মীয়রা সব সময়ই চেয়েছেন, লাশ যেন তাদের কাছে পাঠানো হয়। ৩১ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কম্যান্ডিং অফিসারের কাছে পাঠানো একজন অফিসারের বোনের একটি চিঠির কথা মনে পড়ছে। তিনি চিঠিতে এক পর্যায়ে লিখেছেন,‘আমি আমার সুদর্শন ভাইকে করাচী ছাড়ার সময় আপনাদের হাওয়ালা করেছিলাম। যদি তাকে আপনারা ঠিক সেইভাবে আবার ফিরিয়ে আনতে না পারেন, তাহলে অন্তত তার লাশ নিয়ে আসতে যেন ভুল করবেন না।’ কিন্তু তার ভাইকে জীবিত দূরে থাক মৃত অবস্থায়ও তিনি দেখতে পারেননি কোনদিনও।
০০০

বিপর্যয়ের মুখোমুখি
পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি কি অভ্যন্তরীণ, কি আন্তর্জাতিক—কোনখানের রাজনীতি দিয়েই প্রভাবিত করা সম্ভব হয়নি। এই পরিস্থিতি অব্যাহতভাবে খারাপ হতে থাকে। যেন নিয়তির টানে সে আপনাআপনি ধাবিত হচ্ছে। ডাঃ মালিকের অসামরিক মন্ত্রিসভা কায়েম কিংবা দেশের বাইরে পাকিস্তানের কাকুতি মিনতি কোন কিছু দিয়েই পরিস্থিতির মধ্যে ইতরবিশেষ ঘটানো যায়নি।
খোদ ঢাকার জীবনও বেশ সংকটজনক হয়ে ওঠে। এমন কোনদিন যায়নি, যেদিন লুটতরাজ, অগ্নিকান্ড, রাজনৈতিক হত্যাকান্ড বা বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেনি। এখানে কয়েকটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করছি। সাবেক গভর্নর আবদুল মোনেম খান ২৩ অক্টোবর প্রকাশ্য দিবালোকে তার বাসভবনে গুলিতে নিহত হন। এর মাত্র কয়েকদিন পর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একজন প্রাদেশিক মন্ত্রির গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে উড়ে যায়। এতে ৫ জন নিহত এবং ১৩ জন আহত হয়। পরেরদিন বিপুল-আয়তন স্টেট ব্যাংক ভবনে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। এরপর গভর্নর হাউসের পাশেই ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট ভবনে আগুন ধরে। টেলিভিশন স্টেশন এই ভবনে অবস্থিত ছিল।
এই ধরনের বহু ঘটনা নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়াবার ফলে জনসাধারণ ক্রমেই এতে যেন অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। একারণে বিদ্রোহীরা দেশ-বিদেশের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিশেষ ধরনের কিছু একটা করার প্রয়োজন বোধ করে। এই লক্ষ্যে তারা হোটেলে ইন্টার কন্টিনেন্টালের টয়লেট সেকশন উড়িয়ে দেয়। এই ভবনের একটা বিরাট অংশ ধ্বংস হয় যা মেরামত করতে বেশ কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যায়।
১১ অক্টোবর বিদ্রোহীরা তৎপরতার সঙ্গে নতুন এক ধরনের কৌশল যুক্ত করে। তারা ঢাকায় এই প্রথমবারের মত মর্টার ব্যবহার করে। আমি নিজেই বিমান বন্দর সংলগ্ন পি-আই-আই-এর রন্ধনশালার কাছে ভোর রাত ১টা ৪০ মিনিটে প্রচন্ড শব্দ শুনতে পাই, তাক না করে দুটি গোলা বিমান বন্দরের দিকে ছোঁড়া হয় এবং তা লক্ষ্যভ্রষ্টভাবে বিস্ফোরিত হয়। তা সত্ত্বেও ঘটনাটা স্থানীয় প্রশাসনকে বিচলিত করে। কারণ আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে, পরেরবার গোলাবর্ষণ ক্রুটিপূর্ণ নাও হতে পারে।
ঢাকার বিভিন্ন শহরতলীতে বিদ্রোহীরা আধিপত্য বিস্তার করে বলে অনুমান করা হয়। বস্তুতঃ শহরের বাইরের এলাকা তাদের জন্যে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ছিল। কারণ, আমরা সাধারণত আমাদের তল্লাশী অভিযান নগরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতাম। এ প্রসঙ্গে সিদ্ধিরগঞ্জে ঘটনা উল্লেখযোগ্য। বিদ্রোহীরা সেখানকার প্রধান বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী তার কেটে দেয়। কোন বাঙালী কর্মী এই কেন্দ্রের মেরামতে সম্মত হয়নি। কাজেই পশ্চিম-পাকিস্তানের দুজন সহকারী প্রকৌশলী, একজন লাইন তত্ত্বাবধায়ক, একজন সহকারী ফোরম্যান এবং একজন লাইনম্যান সমন্বয়ে গঠিত পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একটি দলকে এই কাজে পাঠানো হয়। তারা যখন সেখানে কাজ করছিলেন, বিদ্রোহীরা তখন ৩০ অক্টোবরের প্রকাশ্য দিবালোকে তাদের উপর আক্রমণ চালায় এতে দলের পাঁচজনের সবাই নিহত হন। বিদ্রোহীরা যুদ্ধ শেষের এনাম হিসেবে সহকারী ফোরম্যান বদর-ই-ইসলামের লাশ নিয়ে যায়। অন্য চারজন লাশ উদ্ধার করা হয় এবং ৩১ অক্টোবর বিকেল পাঁচটায় পাকিস্তানে পাঠানো হয়।
ঢাকা কিংবা এর যে কোন শহরতলী থেকে দেশের অভ্যন্তরে যাতায়াতকালে মনের মধ্যে স্বাভাবিক অনুভূতি জাগে যে, আমরা যেন শত্রু এলাকার ভেতর দিয়ে যাতায়াত করছি। ব্যক্তিগত রক্ষী ছাড়া চলাচল করা ছিল অসম্ভব। অথচ, এইভাবে রক্ষীপরিবেষ্টিত হয়ে যাওয়া মানেই বিদ্রোহীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং তাদের মনে লোভ জাগিয়ে তোলা। তারা দলের উপর অতর্কিত হামলা চালাত কিংবা চলার পথে মাইন পুঁতে রাখত। কেউ কখনও নিরাপদে নিজের গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারলেই বিরাট একটা বাস্তব সাফল্য বলে মনে করা হত।
মফস্বল এলাকার স্থানীয় অধিনায়কদের কখনও কোন স্বস্তি ছিল না। ছিল না সন্ত্রস্ত অবস্থা থেকে হাঁপ ফেলবার একটুখানি অবকাশ। স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে তাদেরকে অসংখ্য সমস্যার সমাধান করতে হত। তাদের দায়িত্বের মধ্যে ছিল : আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, সরকারী সম্পত্তি রক্ষা করা, কল-কারখানায় কাজ চালু রাখা এবং সন্দেহজনক এলাকাকে বিদ্রোহীমুক্ত করা। ঐসব এলাকায় একটা করে প্লাটুন বা কোম্পানীর চেয়ে বেশি সৈন্য মোতায়েন করা হত না। অথচ তাদের দায়িত্ব-এলাকা ছিল এত বেশি বড় যে, ঐ স্বল্পসংখ্যক সৈন্যকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে বিভক্ত করে দিতে হত। এইসব ভাল যত ক্ষুদ্র হত, বিদ্রোহীদের দিক থেকে বিপদের আশঙ্কা তত তীব্র হত। এই সৈন্যদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য কিছু রাজাকার, ইস্ট-পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের কিছু ওয়েস্ট পাকিস্তান রেঞ্জ’র বা পুলিশ তাদের সঙ্গে নিয়োগ করা হত। এই জগাখিচুড়ি সংমিশ্রণ লড়াকু শক্তিকে পঙ্গু করে তোলে। তবে সংখ্যাধিক্য সব সময় ৩০ জনকে নিয়োগ করা হয়, তখন সেটা অনেকখানি নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য বলে ধারণা জন্মায়।
প্রকৃত অর্থে কোন অবস্থানই পুরোপুরি নিরাপদ বা সুরক্ষিত ছিল না। এর মধ্যে বিশেষ করে যেসব অবস্থানে আধা-সামরিক বাহিনীর লোকেরা থাকে, সেগুলো হচ্ছে বিদ্রোহীদের বিশেষ লোভনীয় লক্ষ্যক্ষেত্র। বিদ্রোহীরা প্রায়ই এদের উপর হামলা চালায় এবং এদেরকে নির্মূল করে দেয়। এর ফলে ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি হয় এবং এদের মধ্যে যারা বেশি ভীরু ও অননুগত তারা বিদ্রোহীদের কোন হামলার মোকাবিলা ছাড়াই নিজেদের অবস্থান ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। উদাহরণ্স্বরূপ নওয়াবগঞ্জ থানার ৩৯ জন রাজাকারের মধ্যে ৩২ জন ২৯ অক্টোবর নিজেদের অবস্থান ত্যাগ করে। অবশিষ্ট ৭ জনকে পরের দিন বিদ্রোহীরা কাবু করে ফেলে এবং থানাটা শত্রুকবলিত হয়ে পড়ে। এই ধরনের আরও একটা ঘটনা। লোহগঞ্জ থানায় আমাদের ৫৭ জন বাঙালী ছিল, যাদেরকে সাধারণ ক্ষমতার অধীন আন্তঃসার্ভিস বাছাই কমিটি ক্ষমা করে দেয়। তাদের সঙ্গে ঐ থানায় পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশ ও রেঞ্জারের ৩০ জন রাইফেলধারী মোতায়েন করা হয়। ২৮ অক্টোবর এই ৫৭ জন বাঙালীর সবাই পালিয়ে যায়। পরের রাতে আরও লোকজন নিয়ে এবং অস্ত্রসজ্জিত হয়ে তারা ফিরে আসে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ঐ ৩০ জনের সবাইকে হত্যা করে। এইভাবে এই থানাও বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বিশেষ করে নোয়াখালী, ফরিদপুর ও টাঙ্গাইল জেলার আরও কয়েকটি থানার ভাগ্যেও একই পরিণতি ঘটে।
সীমান্তের দিকে যে কেউ এগুলো যখন-তখন শুনতে পাবেন ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাগুলির শব্দ। তারা সীমান্ত ফাঁড়ি এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় অব্যাহত গোলাবর্ষণ করে চলেছে। জুনের শেষের দিকে তারা এই তৎপরতা শুরু করে এবং সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে বিদ্রোহীদের তৎপরতা বৃদ্ধির সঙ্গে তাদের এই তৎপরতাও তীব্রতা লাভ করে। আমাদের ভূখন্ডের অভ্যন্তরে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ২০০০ রাউন্ড করে গোলা বর্ষিত হয়। এই গোলাবর্ষণের ত্রিবিধ উদ্দেশ্য।
প্রথমতঃ এ হচ্ছে শত্রুতার ‘নিয়ন্ত্রিত বিস্তার’ সম্পর্কিত ভারতীয় নীতির অংশ। ভারত চায় সীমান্ত এলাকাকে সব সময় উত্তপ্ত রাখতে।
দ্বিতীয়তঃ এর দ্বারা সীমান্তা এলাকায় তৎপর বিদ্রোহীদের চাঙ্গা রাখা যায়।
তৃতীয়তঃ এর মাধ্যমে রণকৌশলগত লক্ষ অর্জিত হয়। এতে করে বিদ্রোহী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদেরকে কোন কোন অরক্ষিত অঞ্চল ও ছিটমহল দখল করতে সাহায্য করা হয়। দখলদারদের উচ্ছেদ করতে গিয়ে আমরা আবার নিশ্চিত গোলন্দাজ হামলার বা চোরাগুপ্তা আক্রমণের সম্মুখীন হই এবং এতে আমাদের প্রচুর হতাহত হয়ে যায়। এইভাবে একের পর এক তারা আমাদের অনেক ছোট ছোট অঞ্চল ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
এই অবস্থা সত্ত্বেও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ১২ অক্টোবরের বেতার ভাষণে জাতিকে জানান,‘আপনাদের বীর সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানের পবিত্র ভূমির প্রতি ইঞ্চি জমি রক্ষা ও হেফাজতের জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।’ অথচ, এই সময় নাগাদ সীমান্ত-এলাকার তিন হাজার বর্গমাইল অঞ্চল ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
জেনারেল নিয়াজী অতিরঞ্জিত বিজয়ের দাবী সহকারে প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণাকে সমর্থন করে যাওয়াই কর্তব্য বলে মনে করেন। তিনি কয়েকবার ঘোষণা করেন যে, যুদ্ধ যদি বেঁধেই যায়, তাহলে আমরা ভারতের ভূখন্ডে গিয়ে লড়ব। গালভরা বড়াই জাহির করে কখনও তিনি কলকাতা দখল করে বসেন এবং কখনওবা আসাম তার করায়ত্ত হয়ে যায়।
আমি তার জনসংযোগ কর্মীর দায়িত্ব পালনকালে একবার তাকে বললাম, এত বেশি অসম্ভব আশার বাণী শোনাবেন না।
উত্তরে তিনি বললেন,‘তুমি কি জানো না যে, ঠকবাজী আর কূটকৌশলই হচ্ছে লড়াই জেতার শ্রেষ্ঠ শয়তানী বুদ্ধি?’
অর্থাৎ তিনি শত্রুর সঙ্গে ঠকবাজী করছেন না—করছেন নিজেরিই সঙ্গে।
১৯৭১-এর ২৪ অক্টোবর তার সঙ্গে কার্যালয়ে আমার একান্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণের ঘটনার কথা এই উপলক্ষে আমার মনে পড়ছে।
তিনি বললেন, ‘তোমার বন্ধুরা (বিদেশী সাংবাদিকরা) কী বলছে?’ জানালাম, ‘তারা বলছে, যুদ্ধ এখন দোরগোড়ায় এসে গেছে।’ ‘বেশ তো, আমিও প্রস্তুত। আমার প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আমার ৭০ হাজার সশস্ত্র জোয়ান রয়েছে। স্থলভাগে আমি খুবই শক্তিশালী।’ ‘কিন্তু আপনার কোন বিমান বা নৌশক্তি তো নেই বললেই চলে।’ ‘বিমান বাহিনী আর নৌবাহিনী ছাড়াই আমি লড়ব বলে ঠিক করেছি।’
‘তবু, বিদ্রোহী ও বাইরের আগ্রাসীদের সঙ্গে লড়বার মত যথেষ্ট শক্তি আপনার নেই বলেই আমার মনে হচ্ছে। আমার ভয় হচ্ছে…..।’
‘তোমার কিসের ভয়?’
‘গোটা সীমান্তজুড়ে আমরা অবস্থান করছি। কিন্তু শত্রুর অবস্থান ঘরে, বাইরে সর্বত্র। আমরা যেন স্যান্ডউইচ। শত্রুদেরকে তো কিছুই করতে হবে না—কেবল তাদের সুবিধা মতো কোন ফাঁক দিয়ে আমাদের প্রতিরক্ষা ভেদ করে কেবল ঢুকে পড়তে পারলেই হল। তারপর তারা নিজেদের মধ্যে জুড়ে যাবে। আমাদের ধ্বংসের জন্য এটুকুই তো যথেষ্ট!’
‘তোমার আশঙ্কা একেবারেই ভিত্তিহীন। তুমি সম্ভবতঃ সংখ্যা দিয়ে সবকিছু বিচার করছ। যুদ্ধে জিতবার জন্য সংখ্যা বড় কথা নয়—বড় কথা হচ্ছে অধিনায়কত্ব। তুমি তো জানো না, অধিনায়কত্ব কাকে বলে। অধিনায়কত্ব হচ্ছে সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে সঠিক সংখ্যায় সৈন্য মোতায়েন করা।’
ঠকবাজীর রাজত্বে কেবল যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আর তার সমর অধিনায়ক নিয়াজী বাস করছিলেন, তা নয়। অধঃস্তনরাও সেই একই পীড়ায় ভুগছিলেন।
আমি সব সময় জেনারেল নিয়াজীর ডিভিশনাল ও ব্রিগেড সদরে তার সফর সঙ্গী হয়েছি এবং সামরিক শলা-পরামর্শের প্রায় প্রত্যেকটিতে আমি যোগ দিয়েছি। একজন মেজর জেনারেল এবং একজ ব্রিগেডিয়ার ছাড়া প্রত্যেক ডিভিশনাল এবং ব্রিগেড কম্যান্ডার জেনারেল নিয়াজীকে বার বার এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে, অত্যন্ত সীমিত সম্পদ এবং প্রচন্ড প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব তারা সম্পূর্ণ পালন করতে সক্ষম হবেন। যেমন : ‘স্যার, আমার সেক্টরের ব্যাপারে আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না। আমরা সময় এলেই শত্রুকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেব।’ সব শলা-পরামর্শেরই এই হল মোদ্দা কথা। ভিন্নতর কোন মন্তব্য এলেই আস্থাহীনতা আর পেশাদারী অযোগ্যতার দায়ে ধরা পড়বার ভয়। কেউ চায় না নিজের ভবিষ্যৎ পদোন্নতির সম্ভাবনা নষ্ট করে ফেলতে।
অধিনায়কদের এই রকমের খাম-খেয়ালী অতি-আশাবাদ একদিকে, অন্যদিকে সৈনিকদের প্রশিক্ষণ, সাজ-সরঞ্জাম আর মনোবলের মান তেমনি নিম্নস্তরের। দীর্ঘ আট মাস তারা অবস্থার উন্নতির কোন লক্ষণ দেখেনি। চিরাচরিত যুদ্ধে লড়বার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় তারা পায় না। বহু মাস ধরে বিশ্রাম বা অবকাশ কাকে বলে, তা তারা জানে না। অনেকেরই বুট, মোজা চারপায় নেই। সবচেয়ে দুঃসহ তাদের অনেকেরই নেই লড়বার মতো অন্তঃকরণ। কারণ, তারা মনে করে, যে বাঙালীরা হিন্দুদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুসলির জ্ঞাতিভাইদের বধ করাকে পূণ্যর কাজ বলে মনে করে, সেই বাঙালীদের জন্য জীবন দেওয়ার কোন অর্থ হয় না।
যুদ্ধশাস্ত্র বলে, তোমার সৈনিকের মনের মধ্যে কোন চিন্তা আলোড়ন তুলছে, সেইটা জানতে পাবার মধ্যে নিহিত আছে তোমার অধিনায়কত্বের বারোআনা সাফল্য। তবু আমাদের অধিনায়করা এই গুরুত্বপূর্ণ মনস্তত্ত্বটা সাধারণভাবে উপেক্ষা করে গেছেন। তারা গুনে গেছেন কেবল মাথা আর রাইফেলের কুঁদোর সংখ্যা। যখন তাদেরকে জানানো হল যে, বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে আমরা ২৩৭ জন অফিসার, ১৩৬ জন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার এবং অন্যান্য র‌্যাংকের ৩৫৫৯ জন লোক হারিয়েছি, তখন তারা হিসাব করতে বসে গেলেন, আর কতজন বেঁচে থাকল। তাদের মনে একটিবারের জন্যেও এই উপলব্ধি জাগল না যে, মাথা গুনতি হতাহতের ক্ষতির চাইতে মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতির মাত্রা ইতোমধ্যেই অনেক বেশি হয়ে গেছে।
এহেন অধোগামী মনোবলের ফলস্বরূপ সৈনিকরা টহলদারী উচ্ছ্বাস এবং লড়াকু দৃঢ়তা হারিয়ে বসে। পরিণতিস্বরূপ সীমান্ত এলাকার প্রহরা ঢিলা হয়ে যায়। মাঝে মাঝে সপ্তাহে একবার কি দুবার সৈন্যদের একটা দল নিজেদের দায়িত্ব এলাকা যাচাই করতে যায় এবং রাতে ঘুমোবার জন্য ঘাঁটিতে ফিরে আসে। ১২ নবেম্বর এমনি একটি দল ধর্মদেহ এলাকায় (যশোর সেক্টরের সীমান্ত এলাকা থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে) যায় নিয়মিত টহল দেওয়ার জন্যে। তারা দেখতে পায়, ঐ এলাকা ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর ১ নাগা ব্যাটেলিয়নের একটি প্লাটুনের দখলে রয়েছে। অনুপ্রবেশকারীরা ৫ নবেম্বর চুপিসারে সীমান্ত পার হয়েছে এবং এক সপ্তাহ ধরে নির্বিঘ্নে সেখানে অবস্থান করছে। ১৩ নবেম্বর তাদেরকে উচ্ছেদ করা হয়। তাদের চারজন ধরা পড়ে এবং যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের হাতে বন্দী থাকে।
কুমিল্লার দক্ষিণে বেলুনিয়া এলাকায় ঠিক একইরকমের একটি বিস্ময় লক্ষ্যগোচর হয়। সেখানে দেখতে পাই যে, ১০ নবেম্বর নাগাদ বিদ্রোহী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকরা এই অঞ্চলের অর্ধেক গ্রাস করেছে এর কয়েকদিন পর তাদের প্রতিরক্ষা ভেঙে দেওয়ার জন্য আমরা নৈশ্য অভিযান চালাই এবং এতে সফল হই। একই সপ্তাহে, ১৩ নবেম্বর অন্য একটি শত্রুবাহিনী যশোর সেক্টরের বয়রার কাছে সীমান্ত অতিক্রম করে। সেখানে ৭ দিন যাবত তাদের এই অবস্থান টের পাওয়া যায়নি এবং এই সময়ের মধ্যে ভারতীয়রা সেখানে দুটি পূর্ণ ব্যাটেলিয়নশক্তি (জম্মু-কাশ্মীর ব্যাটেলিয়ন এবং শিখ-লাইট ব্যাটেলিয়ন) সংগঠিত করে। বহু দেরী করে, ১৯ নবেম্বর আমরা তাদের এই উপস্থিতি টের পাই। যশোরের স্থানীয় ব্রিগেডকে অনুপ্রবেশকারীদের উচ্ছেদের দায়িত্ব দেয়া হয়। ২২ ও ৩৮ ফ্রন্টিয়ার কোর্সের দুটি কোম্পানীকে আক্রমণের নির্দেশ দেওয়া হয়। আক্রমণ ব্যর্থ হয়ে যায় এবং এতে আমাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। পরে শত্রুরা আমাদের ৩৮ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সৈন্যদের উপর হামলা চালায় এবং আমাদের সৈন্যরা সব সরঞ্জাম ফেলে রেখে নিজেদের প্রতিরক্ষা ছেড়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
এই ঘটনা থেকে প্রমাণ হয় যে, একদিকে আমাদের সৈন্যরা নিজেদের অবস্থান-ক্ষমতা হারিয়েছে, অন্যদিকে শত্রুরা অত্যন্ত দৃঢ়চিত্ত। এখান থেকে শত্রুকে উচ্ছেদ করতে হলে সত্যি সত্যি জবরদস্ত উদ্যোগের প্রয়োজন। সেই অনুযায়ী নতুন করে আক্রমণের জন্য বিদ্যমান ডিভিশনের সঙ্গে আমরা ২১ পাঞ্জাব (আর, এ্যান্ড এম) এবং ৬ পাঞ্জাবের ডিভিশনাল সৈন্য যোগ করি। ‘আলফা’ ও ‘ব্রেভো’ নামের দুই টাস্ক বাহিনী সংগঠিত করে যথাক্রমে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমতিয়াজ ওয়ারাইচ এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরীফের অধিনায়কত্বে এদের ন্যস্ত করা হয়। এছাড়াও দেওয়া হয় এক স্কোয়াড্রন ট্যাংক এবং এক রেজিমেন্ট গোলন্দাজ শক্তি।
২১ নবেম্বর ভোর ৬টায় আক্রমণ চালানো হয়। শুরুতে আমরা বেশ সাফল্য লাভ করি। কিন্তু আমরা যখন আক্রমণ করতে করতে বৃক্ষরাজীর মধ্যে দিয়ে শত্রুদের অবস্থানের দিকে আরও অগ্রসর হতে থাকি তখন গুপ্তঅবস্থান থেকে শত্রুট্যাংকের গোলা আসতে আরম্ভ করে। এটা আমাদের জন্যে ছিল বড় রকমের একটা বিস্ময়। কারণ, ঐ এলাকাকে আমরা ট্যাংক মোতায়েনের অনুপযুক্ত বলে ধরে নিয়েছিলাম। শত্রুপক্ষের গোলন্দাজ বাহিনীও সীমান্তের ওপার থেকে এ যুদ্ধে যোগ দেয়। আমরা পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সাহায্য চেয়ে পাঠাই। অচিরে তিনটি স্যাবার জেট আমাদের মাথার উপর এসে পৌঁছায়। সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় মিগের আগমন ঘটে এবং এই মোকাবিলায় আমরা দুটি বিমান এবং সব কয়টি ট্যাংক হারাই। ফলে আমাদের অভিযান প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তবে শত্রুরা এই স্থান থেকে চলে না যাওয়ায় তাদেরকে আরও বিস্তার লাভ থেকে বিরত রাখবার জন্য আমরা তিন দিক থেকে তাদের ঘিরে রাখি। ৩ ডিসেম্বর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এই ঘেরাও অব্যাহত থাকে। কৌশলগতভাবে আমরা শত্রুর হাতে মার খাওয়া সত্ত্বেও এটাকে চূড়ান্ত সফল অভিযান বলে ঢালঢোল পেটানো হয়। বরঞ্চ এইভাবে বড় একটা শক্তি এই একটিমাত্র ক্ষত এলাকায় আটকা পড়ে থাকবার কারণে আমাদের অপেক্ষাকৃত কম সুরক্ষিত এলাকাগুলোতে ভারতের দিক থেকে জোরালো আঘাত আসবার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তবে সৌভাগ্যবশতঃ শত্রুদের লক্ষ্য তখনও ছিল সীমিত।
বাইরে আমরা প্রচার করতে থাকি যে, ২১ নবেম্বরের যুদ্ধটা ছিল আমাদের উপর মিগ, সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট হয়ে ভারতের হামলা। কিন্তু আসলে এটা ছিল ১৩ নবেম্বর থেকে দখলকৃত আমাদের এলাকা থেকে শত্রুদেরকে সরিয়ে দেবার জন্য আমাদেরই একটা প্রচেষ্টা।
একই সপ্তাহে (২০-২৫ নবেম্বর) ভারত, সিলেটের জকিগঞ্জ ও আটগ্রাম, দিনাজপুরের হিলি এবং রংপুর জেলার পঞ্চগড়ে হামলা চালায়। শত্রুরা চেয়েছিল ভবিষ্যৎ অভিযানে বিচরণক্ষেত্র হিসাবে ব্যবহারের জন্য সীমান্তের কয়েকটি সুবিধাজনক স্থান দখল করে নিতে। কিন্তু আমরা হেঁড়ে গলায় চীৎকার জুড়ে দিলাম যে, পূর্ব পাকিস্তানের উপর সার্বিক সামরিক অভিযান শুরু হয়েছে।
সিলেট ও রংপুর সেক্টর থেকে আমাদের কিছু প্রতিরক্ষা সৈন্য বিতাড়িত হয়। যশোর সেক্টরে যে ৩৮ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স অবস্থান নিয়েছিল তারা অবস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়, এমনকি সাজ-সরঞ্জাম, হাঁড়ি-পাতিল পর্যন্ত ফেলে আসতে হয়।
এই তিন ঘটনা জেনারেল নিয়াজীকে অগ্নিশর্মা করে তোলে। আমারই সামনে তিনি ‘দোষী’দের ভৎর্সনা করেন এবং নিম্নরূপ আদেশ দেন।
‘শতকরা সত্তর ভাগ হতাহত না হওয়া পর্যন্ত পিছু হটা চলবে না—তা-ও জি-ও-সি স্বয়ং অনুমতি দিলে তবে।’ এই মৌখিক আদেশ পরে লিখিতভাবে নিশ্চিত করা হয়।
জেনারেল নিয়াজী ২২ নবেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেকদিন সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনে যান। আমি সব সময়ই তার সফরসঙ্গী। ২৭ নবেম্বর হিলি এলাকা পরিদর্শনকালে জেনারেল নিয়াজী একদল সাংবাদিকের সঙ্গে মিলিত হন। তাদেরকে হিলিতে ভারতীয় হামলা এলাকা দেখাবার জন্যে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে, আমাদের সীমানায়, ভারতের একটি বিকল ট্যাংক পড়েছিল। সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান ঘরোয়াভাবে প্রায় আধ ঘন্টা ধরে চলতে থাকে। শেষে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন,‘সর্বাত্মকযুদ্ধ কখন শুরু হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?’
মুরগীর মাংসের প্লেট থেকে মাথা তুলে তিনি বললেন,‘আমার মতে সর্বাত্মক যুদ্ধ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।’
এই জবাব কারও কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি, কারণ আমরা সবাই জানতাম যে, ভারত যদি বিমান, সাঁজোয়া আর গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে সত্যি সত্যি তার সর্বাত্মক সামরিক শক্তি নিয়োজিত করত, তাহলে জেনারেল নিয়াজী এই সময় মুরগীর মাংসের প্লেটের মধ্যে মুখ গুঁজে সাংবাদিকদের সঙ্গে এইভাবে রসিকতা করতে পারতেন না।
সাংবাদিকরা যখন হিলি রওয়ানা হয়ে গেলেন, জেনারেল নিয়াজী তখন শত্রু বিমানের হামলার সামান্যতম ভয় না করে ঢাকার পথে উড্ডয়ন করলেন। যাবার সময় তিনি একজন যুবতী মহিলা সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়ে গেলেন ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসে ফিরে গিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকার দেবার জন্যে।

ঢাকা : শেষ তৎপরতা
ঢাকার মানসিক সুরক্ষা এবং সীমান্তের ভীত প্রতিরক্ষা যেন পরস্পর নির্ভরশীল। এর একটাতে বাড়তি কমতি হলে অন্যটার ভাগ্য প্রভাবিত হয়ে যায়। এছাড়া অন্যকোন বিষয়কে প্রভাব বিস্তারের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতে হলে সে হবে পশ্চিম পাকিস্তান রণাঙ্গনে যুদ্ধের অবস্থা। জেনারেল নিয়াজী যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে লাহোর রণাঙ্গনে আমাদের সাফল্যের ভিত্তিহীন সংবাদে যথার্থ একজন কুস্তিগীরের মত আচরণ করতে লাগলেন এবং ৭ ডিসেম্বর নাগাদ ক্রমে ক্রমে বিভ্রান্তির অতলতায় তলিয়ে যেতে লাগলেন। প্রায় ঐ সময় ৯ ডিভিশনকে পরাস্ত করে ভারতীয়রা যশোর ও ঝিনাইদা দখল করে নেয়, ১৬ ডিভিশনের প্রধান যোগাযোগ-রেখার উপর হামলা চালায় এবং কুমিল্লা ও ফেনীর মধ্যবর্তী স্থানে ৩৯ অস্থায়ী ভিডিশনের নরম পেটে ছুরি বসিয়ে দেয়। ঐদিন সন্ধ্যায় জেনারেল নিয়াজীকে গভর্নর হাউসে ডেকে পাঠানো হয় যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্বন্ধে ডাঃ এ, এম মালিককে অবহিত করার জন্যে, কারণ তিনি নানা রকমের পরস্পরবিরোধী সব খবর পাচ্ছিলেন। জেনারেল নিয়াজীর স্টাফ প্রধান, ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকী যখন সব রণাঙ্গনে বীরোচিত প্রতিরোধের খবর দিচ্ছিলেন, সেই সময় বিভাগীয় ও জেলা সদর থেকে সন্ত্রস্ত বেসামরিক কর্মকর্তারা সৈন্য প্রত্যাহারের পর বেসামরিক জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সম্পর্কে গভর্নরকে ফোন করছিলেন। গভর্নর তাই মনে করলেন যে, জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হওয়াই হবে সত্য উদঘাটনের শ্রেষ্ঠ উপায়।
৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গভর্নর মালিকের সঙ্গে বৈঠকটা ছিল জেনারেল নিয়াজীর জন্যে অত্যন্ত অস্বস্তিকর। সরকারীভাবে ও প্রকাশ্যে নিয়াজী এমন সব বড়াই করেছেন, যা প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যুদ্ধের তো মাত্র চারদিন কেটেছে—এত সকালেই নিজেদের লজ্জার বিষয়গুলো একজন বেসামরিক গভর্নরের কাছে স্বীকার করা কি উচিত হবে? নাকি এখনও বীরত্ব আর বিজয়ের কাহিনী শুনিয়ে যাবেন? কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন : আরও কতকাল এইভাবে গভর্নর, সরকার ও জনগণকে বোকা বানিয়ে রাখা যাবে?
গভর্নর মালিক, জেনারেল নিয়াজী ও আরও দুইজন সিনিয়র অফিসার গভর্নমেন্ট হাউসের একটি আরামপ্রদ কক্ষে আলোচনা বসলেন। তারা বেশি কথা বললেন না। কথার চাইতে নীরবতাই বেশি লক্ষ্য করা গেল। সেই কথাটুকুর বেশির ভাগ আবার বললেন গভর্নর নিজে এবং তাও নির্বিশেষভাবে। আলোচনার মূল বিষয় ছিল : অবস্থা সব সময় এক থাকে না। অবস্থা ভালো থেকে খারাপ হয়, আবার খারাপ থেকে ভালোও হয়। অনুরূপভাবে, একজন জেনারেলের কর্ম-জীবনেও উত্থান-পতন থাকে। একসময় সাফল্য তাকে মহিমান্বিত করে, আবার অন্য সময় হয়তো পরাজয় তার মর্যাদাকে খাটো করে দেয়। ডাঃ মালিক এই শেষের বাক্যটি যখন উচ্চারণ করলেন, তখন সঙ্গে সঙ্গে বিশালদেহী জেনারেল নিয়াজী কেঁপে উঠলেন এবং কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি দুহাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে শিশুর মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। গভর্নর ঠিক বড় ভাইয়ের মত করে জেনারেল নিয়াজীর গায়ে হাত রেখে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,‘আমি জানি, জেনারেল সাহেব একজন কম্যান্ডারের জীবনে এমনি কঠিন দিন আসে। কিন্তু সেজন্যে মন খারাপ করবেন না। আল্লাহ মহান।’
জেনারেল নিয়াজী যখন কাঁদছিলেন, তখন একজন বাঙালী ওয়েটার ট্রেতে করে কফি ও স্ন্যাক নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। তাকে সঙ্গে সঙ্গে কক্ষ থেকে চীৎকার করে এমনভাবে বের করে দেওয়া হয়, যেন সে কক্ষের পবিত্রতা হানি করেছে। বেরিয়ে গিয়ে সে তার বাঙালী সঙ্গীদের কাছে জানায়,‘সাহেবরা ভেতরে কাঁদছেন।’ এই মন্তব্য গভর্নরের পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক সচিবের কানে যায় এবং তিনি বাঙালীদের এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করতে নিষেধ করেন।
গভর্নর মালিক এইভাবেই পূর্ব পাকিস্তান যুদ্ধের সর্বাধিক সত্য ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য লাভ করলেন। কান্নাকাটির জন্যে সমবেদনা জানাবার পালা শেষ হলে তিনি জেনারেল নিয়াজীকে বললেন, ‘পরিস্থিতিটা খারাপ যখন, তখন আমি ভাবছি; যুদ্ধ বিরতির ব্যবস্থা করার জন্যে প্রেসিডেন্টের কাছে আমার তার পাঠানো উচিত।’ জেনারেল নিয়াজী মুহূর্তের জন্যে স্তম্ভিত থেকে মাথাটা নিচু করলেন, তারপর ক্ষীণকন্ঠে বললেন, ‘আমি মান্য করব।’ তদনুযায়ী ইয়াহিয়া খানের কাছে গভর্নর একটি বার্তা পাঠালেন। কিন্তু তার এই প্রস্তাবের ওপর কোনই ব্যবস্থা গৃহীত হল না।
জেনারেল নিয়াজী তার সদর দফতরে ফিরে এসে নিজের ঘরে স্বেচ্ছা-বন্দীত্ব গ্রহণ করলেন। তিনি এরপর তিনরাত বস্তুতঃ আত্মগোপন করে থাকলেন। এইসময়, ৮-৯ ডিসেম্বরের রাতে আমি তার কক্ষে যাই। তখন পর্যন্ত আমি গভর্নমেন্ট হাউস বৈঠকের কথা জানতে পারিনি। দেখলাম, তিনি হাতের উপর মাথা রেখে আছেন এবং মুখ সম্পূর্ণ ঢাকা। আমি বলতে পারব না তিনি কাঁদছিলেন কিনা। আমাদের সংক্ষিপ্ত আলাপের মধ্যে তার কথাটুকু শুধু আমার এখনও মনে আাছে। বললেন, ‘সালিক, তোমার ভাগ্যকে ধন্যবাদ যে, আজ তুমি জেনারেল নও।’ একথা থেকে তার প্রচন্ড যন্ত্রণাই প্রকাশ পেল। আমি সেখান থেকে চলে গেলাম, কিন্তু সারারাত ঘরে তার জন্যে আমার করুণা হল।
৭, ৮ ও ৯ ডিসেম্বর এই তিন দিন ছিল জেনারেল নিয়াজীর জন্যে বড়ই দুঃসময়। ঐ সময় সব ডিভিশনই তাদের সঙ্গতি হারিয়ে ফেলে। এদের অধিকাংশই নিজেদের ‘দুর্ভেদ্য এলাকা’ ছেড়ে আরও অনেক পেছনে সরে আসতে বাধ্য হয়। আরও দুঃখের কথা যে, পূর্ব পাকিস্তানের এতসব ক্ষয়ক্ষতি পূরণ হওয়ার মত লাভজনক কোন কিছুই পশ্চিম পাকিস্তান রণাঙ্গণে সংঘটিত হয়নি। এখন জেনারেল নিয়াজীর সব উচ্ছ্বলতার অবসান ঘটেছে এবং যে রসিকতার জন্যে তিনি এত বিখ্যাত, তাও আর নেই। তিনি কারও সঙ্গে দেখা করেন না এবং সব সময় বিমর্ষ থাকেন। তার চোখে অনিদ্রার স্পষ্ট ছাপ। স্পষ্টতঃই দায়িত্বের বোঝা তিনি যেন আর বইতে পারছেন না।
এদিকে বিশেষভাবে অল-ইন্ডিয়া রেডিও এবং সাধারণভাবে অন্যান্য বিদেশী সম্প্রচারকেন্দ্র আমাদের বিড়ম্বনার কাহিনী অতিরঞ্জিত করে প্রচার করতে লাগল। তেমনি আবার আমাদের রেডিও পাকিস্তান, আমাদের সাফল্য সম্পর্কে অতিরঞ্জিত খবর প্রচার করে তাদেরকে হারিয়ে দিতে চাইল। দুর্ভাগ্যবশতঃ শ্রোতাদের বিশেষ করে বাঙালী শ্রোতাদের অল-ইন্ডিয়া রেডিও ও অন্যান্য কেন্দ্রের সম্প্রচারের উপর রেডিও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি আস্থা।
এই একই সময় বিবিসি ঘোষণা করল যে, জেনারেল নিয়াজী তার সৈন্যদের বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে পশ্চিম পাকিস্তান পালিয়ে গেছেন। এই খবর তার ভাবমূর্তিকে প্রভাবিত করে এবং এতে তিনি খুবই তিক্ত অনুভূতি লাভ করেন। ১০ ডিসেম্বর তিনি হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে গিয়ে আকস্মিকভাবে উপস্থিত হন এবং লাউঞ্জে প্রথম যে লোকটির সঙ্গে দেখা হয়, তাকে তিনি বলেন, ‘কই বিবিসির লোক কোথায়? আমি তাকে দেখতে চাই যে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কৃপায় আমি এখনও পূর্ব পাকিস্তানে আছি। আমি কখনই আমার বাহিনীকে ছেড়ে যাব না।’ এই ঘোষণার পর তিনি তার সদর দফতরে ফিরে আসেন।
অবশ্য জেনারেল নিয়াজীর ঢাকায় উপস্থিতি সত্ত্বেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে তার যোগ্যতা সম্বন্ধে বিদেশীদের মনে কোন আস্থা জাগল না। ডুবন্ত জাহাজ থেকে বেরিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার মত তাদের অবস্থা। তারা পালিয়ে বাঁচতে চায়। জাতিসংঘ ৮ ডিসেম্বর তাদের জন্যে বিমানযাত্রার ব্যবস্থা করে। কিন্তু তখনও রানওয়ের বিশ্রী অবস্থা এবং ভারতীয় বিমান বাহিনী দিনে কমপক্ষে তিনবার করে বিমানক্ষেত্রের উপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত ও পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ব্যবস্থা করার পর কিছুদিনের মধ্যে তারা পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে।
অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার মনোভাব কেবল যে পলায়নের পর বিদেশী বা শত্রুভাবাপন্ন বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে সীমিত ছিল, তা নয়—বরং কিছু সেনা অফিসারের মধ্যেও আতঙ্ক বাসা বাঁধল। এদের মধ্যে থেকে বেশ কয়েকটা তকমা-আঁটা দুজন অফিসার আমার কাছে এসে বললেন, ‘জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে তো আপনার বেশ খাতির। আপনি তার কাছে গিয়ে একটু বলুন না কেন বাস্তববাদী হতে। নইলে আমরা যে সবাই কুকুরের মত মরে পড়ে থাকব।’ আমি বললাম যে, যুদ্ধের মত একটা সেনসেটিভ বিষয়ের উপর সিদ্ধান্তের ব্যাপারে একজন কোর-কম্যান্ডারকে প্রভাবিত করাটা আমার মত সামান্য একজন জনসংযোগ অফিসারের পক্ষে খুব বেশি বাড়াবাড়ি বলে মনে হবে। আমি জেনারেল নিয়াজীকে কিছুই বলিনি।
তবে ৮-৯ ডিসেম্বর রাতে জেনারেল নিয়াজীর ট্যাকটিক্যাল সদর দফতরের সীমানা-প্রাচীরের কাছে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আমার দেখা হলে তখন এসব অফিসারের মনোভাব তার কাছে আমি ব্যক্ত করি। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ সরকারও উদ্বিগ্ন। তবে পূর্ব কম্যান্ডের অধিনায়কের কিছু বিশেষ বিবেচ্য বিষয় আছে। তবু এ ব্যাপারে কিছু করব।’
পরের দিন গভর্নর প্রেসিডেন্টের কাছে একটি বার্তা সংকেত পাঠান। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে এতে বলা হয়, ‘আরও একবার আমি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং রাজনৈতিক নিষ্পত্তির বিষয় বিবেচনার জন্যে আপনাকে অনুরোধ করছি।’ ইয়াহিয়া খান বিষয়টিকে আবার উপেক্ষা করলেন, কারণ ঘটনার উপর নির্ভরযোগ্য সামরিক রিপোর্টের জন্যে প্রকৃত ব্যক্তি হলেন জেনারেল নিয়াজী। তিনি যতদিন আস্থাবান, ততদিন রাজনৈতিক কোন খুঁটি ধরবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ৯ ডিসেম্বর সকালে ব্যাপারটা ঘটল, যখন পুর্ব কম্যান্ডের সদর দফতর এই প্রথমবারের মত স্বীকার করল যে, পরিস্থিতি খুবই সংকটজনক বটে। তখন নিম্নরূপ বার্তা-সংকেত পাঠানো হল :
এক । আকাশ যুদ্ধে শত্রুর প্রবল আধিপত্যের জন্যে এখন আর পুনর্বিন্যাস সম্ভব নয়। জনতা প্রবলভাবে বৈরী হয়ে উঠেছে এবং শত্রুবাহিনীকে সর্বাত্মক সাহায্য করছে। বিদ্রোহীদের ব্যাপক অতর্কিত হামলার জন্যে নৈশ অভিযান আর সম্ভব নয়। ফাঁক বুঝে ও পেছন থেকে বিদ্রোহীরা শত্রুকে পরিচালিত করছে। বিমানক্ষেত্র দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। গত তিনদিন কোন অভিযান চালানো যায়নি এবং ভবিষ্যতেও যাবে না। এমনকি অব্যাহতি লাভও খুবই কঠিন।
দুই । শত্রুর বিমান হামলায় অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জামাদির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সৈন্যরা বীরবিক্রমে লড়াই করে যাচ্ছে কিন্তু চাপ এবং যন্ত্রণাও খুব বেশি হচ্ছে। কুড়ি দিন যাবত নিদ্রা নেই। বিমান, গোলন্দাজ ও ট্যাংকের অবিরাম হামলার মুখে আছি।
তিন । পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটজনক। আমরা যুদ্ধ ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।
চার । অনুরোধ, এই অঞ্চলে শত্রুর সমস্ত বিমান ঘাঁটির উদ্বেগকে পুষ্ট করল। কাজেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পরিস্থিতি বিমানযোগে সৈন্য পাঠান।
জেনারেল নিয়াজীর তারবার্তা এই প্রথম গভর্নর মালিকের উদ্বেগকে পুষ্ট করল। কাজেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পরিস্থিতি অনুধাবন করলেন এবং তার পক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে তিনি প্রাদেশিক গভর্নরকে ক্ষমতা দিলেন। ঐ রাতেই গভর্নর এবং পূর্ব কম্যান্ডের অধিনায়কের কাছে প্রেসিডেন্ট যে তার পাঠালেন, তার প্রধান অংশ নিম্নরূপ :
প্রেরক প্রেসিডেন্ট, প্রাপক গভর্নর, প্রতিলিপি পূর্ব কম্যান্ড। আপনার জরুরী বার্তা পেয়েছি এবং পূর্ণ উপলব্ধি লাভ করেছি। আমাকে দেওয়া আপনার প্রস্তাবের উপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে আমি আপনাকে অনুমতি দিলাম। আমি আন্তর্জাতিকভাবে সর্বাধিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি এবং করে যাচ্ছি, কিন্তু আমরা পরস্পর সমপূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকায় পূর্ব পাকিস্তানের উপর সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমি আপনার শুভবুদ্ধি ও বিচার ক্ষমতার উপর সবকিছু ছেড়ে দিচ্ছি। আপনার যে কোন সিদ্ধান্ত আমি অনুমোদন করব আপনার সিদ্ধান্ত মেনে নেবার জন্যে এই সেই মত সবকিছু আয়োজন করার জন্যে আমি জেনারেল নিয়াজীকে উপদেশ দিচ্ছি।
এই বার্তার পর আর একটি বার্তা আসে সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান জেনারেল আবুল হামিদ খানের কাছ থেকে জেনারেল নিয়াজীর কাছে। এতে প্রেসিডেন্টের বার্তার প্রধান বিষয়গুলো পুনরুল্লেখ করা হয় এবং সঠিক স্দ্ধিান্ত নেওয়ার সাহায্যের জন্যে যুদ্ধ পরিস্থিতির সঠিক হিসেব গভর্নরের কাছে পেশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। হামিদ তাকে সর্বাধিক পরিমাণ অস্ত্র ও সরঞ্জাম ধ্বংস করে ফেলার পরামর্শ দেন, যেন তা শত্রুর হাতে না পড়তে পারে। এর আগে ১০ ডিসেম্বরে পাঠানো জেনারেল হামিদের তারবার্তা :
প্রেরক সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান, প্রাপক অধিনায়ক। সূত্র : গভর্নরের কাছে প্রেসিডেন্টের সংকেত বার্তা ও আপনার কাছে তার প্রতিলিপি। আপনার সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরামর্শক্রমে গভর্নর কর্তৃক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা প্রদত্ত হয়েছে। পরিস্থিতির গুরুত্বের মাত্রা সঠিকভাবে বোঝাবার মত উপযুক্ত কোন সংকেত না থাকায় সরেজমিনে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার আমি আপনার হাতে ছেড়ে দিচ্ছি। স্পষ্ট যে, সংখ্যা ও সরঞ্জামের দিক থেকে বিপুল শ্রেষ্ঠত্ব এবং বিদ্রোহীদের সক্রিয় সহযোগিতা নিয়ে শত্রু যে পূর্ব পাকিস্তানের উপর সম্পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করবে, এখন সেটা কেবল সময়ের ব্যাপার। ইতোমধ্যে বেসামরিক নাগরিকদের যথেষ্ট ক্ষতি হচ্ছে এবং লোক যথেষ্ট হতাহত হচ্ছে। লড়তে পারবেন কিনা, সে মূল্যায়ন আপনাকে করতে হবে। এর ভিত্তিতে আপনি আপনার সুস্পষ্ট পরামর্শ গভর্নরকে প্রদান করবেন এবং গভর্নর তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন প্রেসিডেন্ট কর্তৃক অর্পিত ক্ষমতাবলে। যখনই আপনি সে রকম করার প্রয়োজন বোধ করবেন, সর্বাধিক পরিমাণে সামরিক সরঞ্জামাদি ধ্বংস করে ফেলতে চেষ্টা করবেন, যেন তা শত্রুর হাতে গিয়ে না পড়ে। আমাকে অবহিত রাখুন। আল্লাহ আপনার সহায় হোন।
এখন যেহেতু গভর্নর এ, এম, মালিকের উপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের কর্তৃত্ব অর্পিত হয়েছে, তাই প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, কূল রক্ষার জন্যে কী ব্যবস্থা তিনি গ্রহণ করবেন। যে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ তার নেই। জেনারেল নিয়াজীর যদি লড়াই চালিয়ে যাবার সাধ্য থাকত, তাহলে তো উপরে বর্ণিত বার্তা বিনিময়ের কোন প্রয়োজন ছিল না। আর, নিয়াজী যদি মনোবল হারিয়ে থাকেন, তাহলে সেই মনোবল চাঙ্গা করতে গভর্নরের আর কী-ই বা করণীয় থাকতে পারে! সুতরাং, ডাঃ এ, এম, মালিক এমনে একটা যুদ্ধ বিরতির কথা ভাবলেন, যার মাধ্যমে রাজনৈতিক নিষ্পত্তি আনা যায়, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে সরকার চালানো যায় এবং পূর্ব পাকিস্তানের মাটি থেকে ভারতীয় ও পাকিস্তানী বাহিনী সরিয়ে নেওয়া যায়। এজন্যে মধ্যস্থতাকারী মনোনীত করা হল জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব পল মার্ক হেনরীকে, যিনি তখন ঢাকায় ছিলেন।
মিস্টার হেনরীর হাতে যখন চিঠি দেওয়া হয়, তখন গভর্নরের সঙ্গে ছিলেন তার উপদেষ্টা মেজর জেনারেল ফরমান আলী এবং মুখ্য সচিব মুজাফফর হোসেন। ১০ ডিসেম্বর ডাঃ মালিকের পাঠানো বার্তায় প্রেসিডেন্টকে পরিস্থিতি সম্বন্ধে অবহিত করা হয়।
‘প্রাপক : পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। যেহেতু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার আমার উপর অর্পিত হয়েছে সেহেতু আমি আপনার অনুমোদনের পর সহকারী মহাপরিচালক মিস্টার পল মার্ক হেনরীকে নিম্নরূপ চিঠি প্রদান করছি। চিঠি আরম্ভ : পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে সর্বাত্মক যুদ্ধের মধ্যে পাকিস্তানের পরিস্থিতির উদ্ভব হল, যাতে সশস্ত্র বাহিনীসমূহকে আত্মপরিস্থিতির উদ্ভব হল, যাতে সশস্ত্র বাহিনীসমূহকে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হতে হল। পাকিস্তান সরকার সর্বদাই রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাসমূহ নিষ্পন্ন করতে চেয়েছেন, যার জন্যে আলাপ আলোচনাও হয়েছে। প্রচন্ড প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সশস্ত্রবাহিনীসমূহ বীরোচিত যুদ্ধ লড়েছেন এবং তারা এখনও লড়ে যেতে সক্ষম, কিন্তু আরও রক্তপাত ও নিরীহ লোকদের প্রাণহানি এড়াবার উদ্দেশ্যে আমি নিম্নরূপ প্রস্তাব করছি। যেহেতু রাজনৈতিক প্রশ্নের দরুণ বিরোধ দেখা দিয়েছে সেহেতু তার সমাধানও অবশ্যই রাজনৈতিক হতে হবে। সুতরাং, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে এতদ্বারা ঢাকায় শান্তিপূর্ণভাবে সরকার প্রতিনিধিদের আহ্বান জানাচ্ছি। এই প্রস্তাব করতে গিয়ে আমি একথা জানানো কর্তব্য বলে মনে করছি যে, পুর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের মাটি থেকে ভারতীয় বাহিনীসমূহেরও আশু প্রত্যাহার দাবী করবেন। সুতরাং, আমি জাতিসংঘকে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা করার আহ্বান জানাচ্ছি এবং অনুরোধ করছি, এক : অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতি। দুই : পাকিস্তানের সশস্ত্রবাহিনীসমূহের সসম্মানে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন। তিন : যেসব পশ্চিম পাকিস্তানী পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যেতে আগ্রহী তাদের প্রত্যাবর্তন। চার : ১৯৪৭ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসতিগ্রহণকারী সব ব্যক্তির নিরাপত্তা। পাঁচ : পূব পাকিস্তানে যে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করার নিশ্চয়তা। এই প্রস্তাব করতে গিয়ে আমি স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই যে, এ হচ্ছে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা সুনিশ্চিত প্রস্তাব। সশস্ত্রবাহিনীসমূহের আত্মসমর্পণের প্রশ্ন বিবেচ্য নয় এবং সে প্রশ্ন ওঠে না, এবং এই প্রস্তাব গৃহীত না হলে সশস্ত্রবাহিনীসমূহ শেষ লোক ক্ষয় না হওয়া পর্যন্ত লড়ে যাবে। চিঠি সমাপ্ত। জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করা হয়েছে এবং আপনার অধিনায়কত্বে নিজেকে সমর্পণ করেছেন।
যুদ্ধবিরতির এই প্রস্তাব একবার যখন জাতিসংঘের কাছে চলে গেল, তখন সে প্রস্তাবকে অবশিষ্ট বিশ্ব থেকে আর গোপন রাখার প্রশ্ন ওঠে না। কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক বেতারকেন্দ্র থেকে এর বিষয়বস্তু সম্প্রচারিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে জাতিসংঘে পাকিস্তানের বক্তব্যের গুরুত্ব খাটো হয়ে যায়। যেখানে নবনিযুক্ত উপ-প্রধানমন্ত্রী জনাব জেড, এ, ভুট্টে আমাদের পক্ষে সন্তোষজনক একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের পক্ষে ওকালতি করছিলেন। এর পরিণামস্বরূপ রাওয়ালপিন্ডিতে একজন সরকারী মুখপাত্র যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব সরাসরি অস্বীকার করে বসেন। ১৩ ডিসেম্বর সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি, যে-কেউ এমন কোন দলিল বা বিবৃত পেশ করুন, যাতে আত্মসমর্পণের ধারণা ব্যক্ত করা হয়েছে।’ ঢাকাকে অবহিত করা হয় যে, ‘তোমাদের প্রস্তাব খুব বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে’ এবং ‘তোমরা সংযুক্ত পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে একটা সিদ্ধান্ত নেবে, এই রকমই আশা করা হয়েছিল।’
মেজর জেনারেল ফরমান আলী (সাধারণভাবে যাকে এই প্রস্তাবের প্রণেতা বলে বিবেচনা করা হয়) পরে আমাকের বলেছিলেন যে, এর উদ্দেশ্য একমাত্র এই ছল যে, যুদ্ধবিরতির সুযোগে ‘আমাদের অধিনায়কেরা নিজেদের বাহিনীসমূহকে পুনর্গঠিত করে নেবেন এবং নিজেদের ক্ষমতা পুনরুজ্জীবিত করবেন। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা সরকার গঠন বলতে আমরা যা বুঝিয়েছি তা হচ্ছে, এই যে, সভ্য পাকিস্তানীমনা সকল বাঙালী এম এন এ ও এম পি এ যাঁরা ১৯৭০ এর ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছেন বা ভবিষ্যতে কখনও নির্বাচিত হবেন, তাঁরাই ক্ষমতায় বসবেন। ভারত যদি এটাকে বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করে এবং আবার বৈরিতা শুরু করে, তাহলে আমরা নতুন উদ্যম নিয়ে আবার তার মোকাবিলা করব।’
প্রস্তাবের আসল উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, রাওয়ালপিন্ডিতে সরকারী মুখপাত্র তার নিন্দা করায় যুদ্ধবিরতির প্রশ্নটা আপাততঃ শিকেয় উঠল। ইয়াহিয়া খান সম্ভবতঃ জনাব ভুট্টোকে আরও কিছু সময় দিতে চেয়েছিলেন, যেন তিনি বিশ্ব প্রতিষ্ঠানে তার কূটনৈতিক নৈপূণ্য দেখানোর সুযোগ লাভ করেন। তাকে জানানো হয় যে, বাইরে থেকে নৈতিক ও বস্তুগত সমর্থন সংগ্রহ করা হচ্ছে—বিশেষতঃ ‘উত্তর থেকে হরিদ্রাবর্ন এবং দক্ষিণ থেকে শ্বেতকায়’ পাকিস্তানের পক্ষে হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছে। ঢাকা এই বক্তব্যের পরিষ্কার অর্থ করল যে, চীন ও আমেরিকা সাহায্য দেবে, যেন ভারতের পক্ষে সোভিয়েত সমর্থনকে কাটিয়ে ওঠা যায়। এই চমৎকার খবরটা শেষ পর্যন্ত সৈন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তখন তখন সব সেক্টরে চরম চাপের তলায় নিষ্পেষিত। তাদের পর্যুদস্ত মনোবলকে চাঙ্গা করবার লক্ষ্য নিয়েই এই খবর ছড়ানো হয়। টাঙ্গাইলের কাছে ভারতীয় ছত্রীসৈন্য নামতে দেখে ব্রিগেডিয়ার কাদিরের অধীন পরিচালিত পলায়নরত ৯৩ ব্রিগেড সেই ছত্রীসৈন্যকে আকাঙ্ক্ষিত সাহায্য মনে করে বিভ্রান্তির বেড়াজালে জড়িয়ে পড়ে। প্রায় একই সময় ঢাকার ট্যাকটিক্যাল সদর দফতরে আমি একজন সেনাপতির পরিচালককে দেখলাম তার দুই ব্যান্ডের ট্রানজিস্টর রেডিও মেরামত করতে। তার পাশ দিয়ে আমি যখন এগিয়ে যাচ্ছিলাম, সে উঠে দাঁড়াল এবং এলিয়ে পড়া টুপিটাকে ঠিক করে নিয়ে আমাকে অভিবাদন জানাল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘খবর কী?’ সে উদাসভাবে বলল, ‘চীন বা আমেরিকার সাহায্যের কই কোন খবরতো দেখছি না!’
রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রচারিত ধোঁকাবাজীর খবরটায় কিছু সাময়িক ফল হয়েছে। সৈনিকরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকছে (অর্থাৎ চীনারা বিমান পাঠাল কিনা) এবং সমুদ্রের দিকে লক্ষ্য করছে (অর্থাৎ মার্কিন রণতরী ভিড়ল কিনা)। এইভাবে তারা সময় কাটাতে লাগল, কখন বন্ধুদের সাহায্য এসে পৌঁছায়। কিন্তু হা-হতস্মি-কোন সাহায্যই এল না।
পূর্ব কম্যান্ডের সদর দফতর থেকে রাওয়ালপিন্ডিতে নির্ভরযোগ্য মহলের কাছে অধীর আগ্রহে টেলিফোন করা হচ্ছে জানবার জন্যে বন্ধুদের হস্তক্ষেপের শেষ খবরটা কী। উত্তরে সবাই জানাচ্ছে শীঘ্রই আসছে। প্রত্যক্ষ কোন ফল ছাড়া এইভাবে পূর্ণ ৪৮ ঘন্টা যখন কেটে গেল, তখন রাওয়ালপিন্ডির জেনারেল হেড কোয়ার্টারে আবার টেলিফোন করা হল। আবার উত্তর এল, শীঘ্রই আসছে। ক্রোধান্বিত একজন স্টাফ অফিসার এই আলাপ শুনতে পেয়ে বললেন, ‘জিজ্ঞেস করো, এই ‘শীঘ্রই কখন আসবে।’
ঢাকায় চীন ও আমেরিকায় কূটনৈতিক প্রধানদের সঙ্গেও পৃথক পৃথকভাবে যোগাযোগ করা হয়। তারা তাদের সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ গ্রহণ সম্বন্ধে অজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এই গুজব নিয়ে জেনারেল নিয়াজী নিজে জেনারেল ইয়াহিয়া কিংবা জেনারেল হামিদের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী ছিলেন না। শেষে পূর্বাঞ্চল কম্যান্ড থেকে রাওয়ালপিন্ডিতে প্রশ্ন করা হল, ‘সুনির্দিষ্টভাবে বলুন, আরও কতকাল বন্ধুদের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে?’
উত্তর এল, ‘আরও ছত্রিশ ঘন্টা।’
এই নতুন সময়-সীমা তাহলে দাঁড়াচ্ছে ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যা।
এদিকে সামরিক তৎপরতাজনিত অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে লাগল। ৯ ডিভিশনের ৫৭ ব্রিগেড হার্ডিঞ্জ সেতু অতিক্রম করেছিল তো করেছিল। ১৬ ডিভিশন সিলেট ও ভৈরব বাজারে আটকা পড়ে যায়। ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশনাল সদর দফতরের আর কোন অস্তিত্ব ছিল না। ৩৬ অস্থায়ী ডিভিশনের একমাত্র ব্রিগেডটি ঢাকা ফিরবার পথে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সমস্ত ডিভিশনাল সেক্টর বহুধাবিভক্ত হয়ে যায়, যার ফলে ঢাকা দখলের জন্য শত্রুর পক্ষে যথেষ্ট ফাঁক ও ফাটল সৃষ্টি হয়ে যায়।
যাই হোক, বাস্তব দৃষ্টি দিয়ে দেখতে গেলে, শত্রু তখনও ঢাকার নাগালের বাইরে। তারা কেবল নরসিংদীতে একটা হেলিকপ্টারবাহী কোম্পানী এবং টাঙ্গাইল এলাকায় একটি ছত্রী ব্যাটেলিয়ন রয়েছে। মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র (যমুনা) কিংবা গঙ্গা (পদ্মা)-এর ওপার থেকে স্থলবাহিনী এসে যোগ না দেওয়া পর্যন্ত এই দুই বিচ্ছিন্ন বাহিনী প্রাদেশিক রাজধানীর জন্য আদৌ কোন হুমকি হতে পারে না। ঢাকা দখল করতে হলে ভারতকে নিজ দেশ থেকে আরও অনেক সৈন্য আনতে হবে। বিভিন্ন নদীর উপর সেতু তৈরী করতে হবে কিংবা ট্যাংক, সাঁজোয়া ও অন্যান্য ভারী সরঞ্জাম বইবার জন্য বহু নৌযানের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া, তাকে নদ-নদীর বাঁধা আয়ত্ত্বে আনতে হবে, এবং আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক শক্তিকে পরাস্ত করতে হবে। সুতরাং, সংরক্ষণশীল হিসাব কষে দেখলেও বোঝা যায়, এইসব শক্তি সংগ্রহ করে চূড়ান্ত আঘাত হানতে হলে ভারতের অন্ততঃপক্ষে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে।
ঢাকার চারপাশে শত্রুর বিপুল সমাবেশ ঘটেছে বলেই যে পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ড দিশেহারা হয়ে পড়েছে, তা নয়। তার দিশেহারা হবার কারণ হচ্ছে, সে জানে, হামলা হবেই এবং ঢাকাকে রক্ষা করবার মত নিয়মিত বাহিনী তাদের নেই। আমি লক্ষ্য করলাম, ব্রিগেডিয়ার বকর কী মরিয়া হয়েই না আকুতি জানাচ্ছেন, ঢাকাকে রক্ষার জন্য আমাকে একটা ব্রিগেড দাও, কিংবা নিদেনপক্ষে একটা ব্যাটেলিয়ন দাও, দোহাই তোমাদের। তিনি ব্রিগেডিয়ার আতিফকে বললেন, কুমিল্লা দুর্গ ছেড়ে দাও এবং তোমার বাহিনীকে ঢাকার পূর্ব পাশে মোতায়েন করো। কিন্তু আতিফ তার নিজ হাতে গড়া নিরাপদ একটা প্রতিরক্ষার আশ্রয় ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করলেন না। তেমনি মেজর জেনারেল কাজীকে যখন ভৈরব বাজার থেকে চলে আসতে বলা হল, তখন তিনি তা মান্য করতে পারলেন না, কারণ যাবার জন্য ‘নৌ-পরিবহণের বড়ই অভাব’। মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহকে ৫৭ ব্রিগেড (মূলতঃ ৯ ডিভিশন থেকে গঠিত) পাঠিয়ে দেবার অনুরোধ জানানো হল, কিন্তু তিনি তা পাঠালেন না। তিনি পাঠালেন মাত্র একটা ব্যাটেলিয়ন এবং ব্যাটেলিয়নও যমুনা পার হতে ব্যর্থ হয়।
ঠিক এমনি অসহায় অবস্থায় মেজর জেনারেল জামশেদ জামালপুর-ময়মনসিংহ এলাকা থেকে ৩৯ ব্রিগেডকে প্রত্যাহার করে ঢাকার উত্তরাঞ্চলে মোতায়েনের আদেশ দিলেন। তিনি টেলিফোনে ব্রিগেডিয়ার কাদিরের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন না, পাছে তিনিও এই আদেশ অমান্য করবার জন্যে কোন ছল-ছুতোর আশ্রয় গ্রহণ করেন। ব্রিগেডিয়ার কাদিরই হলেন একমাত্র অধিনায়ক, যিনি ঊর্ধ্বতন অফিসারের ইচ্ছা পূরণ করলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আসবার পথে তার বাহিনী বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
পরিস্থিতি ক্রমাগতভাবে অতিদ্রুত খারাপ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও জেনারেল নিয়াজী তখনও বিশ্বাস করছেন যে, বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি রক্ষিত হবে এবং সেই অনুযায়ী তিনি বলিষ্ঠ আচরণ প্রদর্শন করে যাচ্ছেন। ১১ ডিসেম্বর তিনি মোটরযোগে স্থানীয় সমন্বিত সামরিক হাসপাতাল এবং ঢাকা বিমান বন্দরে বিমান বিধ্বংসী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরিদর্শনে যান। আমি তার সঙ্গে ছিলাম। হাসপাতালে জনাকয়েক পশ্চিম পাকিস্তানী সেবিকা তার সামনে এসে দাঁড়ায় এবং ‘বর্বর মুক্তিবাহিনীর’ হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করবার অনুরোধ জানায়। তিনি তাদেরকে উদ্বিগ্ন হতে নিষেধ করেন, কারণ বৃহৎ সাহায্য এসে গেল বলে। তিনি জানান, আর সাহায্য যদি না-ই আসে, তাহলে ‘মুক্তিবাহিনীর হাতে পড়বার আগে আমরাই তোমাদেরকে মেরে ফেলব।’
সেখান থেকে তিনি চলে যান বিমানবন্দরে এবং কয়েকটি কামানের অবস্থান পরিদর্শন করেন। সেখানকার জওয়ানদের তিনি উৎসাহসূচক কথা বলেন, তবে জানান, ‘তোমাদের অবস্থানের সামনের মাটির দিকে নজর রেখো। তোমাদের ব্যক্তিগত অস্ত্র যেন সব সময় প্রস্তুত থাকে।’ এরপর সেনানিবাস ফিরবার সময় বেশ বড়সড় একদল বিদেশী সাংবাদিককে তিনি ঢাকা বিমান বন্দরের বাইরে অপেক্ষমান দেখতে পান, যারা ব্যাংকক যেতে চায়। তার বিরুদ্ধে স্বপক্ষ ত্যাগের যে গুজব ছিল, সেটাকে খন্ডন করবার এটা একটা চমৎকার সুযোগ বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু সাংবাদিকরাই একের পর এক অজস্র প্রশ্নবানে তাকে বিদ্ধ করতে থাকে। তিনি ঝাঁপসা, তিক্ত ও এড়িয়ে যাওয়া উত্তর দিয়ে দায় সারেন। এর মধ্যে কয়েকটি প্রশ্ন ও উত্তর ছিল নিম্নরূপ :
প্রশ্ন : ভারত দাবী করছে যে, তার বাহিনী ঢাকার দ্বারপ্রান্তে উপনীত। সত্যি সত্যি তারা কতদূর পর্যন্ত এসেছে?
উত্তর : আপনি নিজে গিয়ে সেটা দেখে আসুন।
প্রশ্ন : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
উত্তর : আমি শেষ লোকটি, শেষ গুলিটি পর্যন্ত লড়ব।
প্রশ্ন : ভারতীয়দেরকে ঢাকার বাইরে ঠেকিয়ে রাখবার মত যথেষ্ট সৈন্যশক্তি আপনার আছে কি?
উত্তর : একমাত্র আমার মৃতদেহের উপরই ঢাকার পতন ঘটবে। এটার (নিজের বুক দেখিয়ে) উপর দিয়ে তাদেরকে ট্যাংক চালিয়ে যেতে হবে।
এইভাবে প্রশ্নের পর প্রশ্ন চলতেই থাকল। কোনটার উত্তর দিলেন, কোনটা এড়িয়ে গেলেন। তারপর অতিদ্রুত ফিরে গেলেন তার ভূগর্ভ সদর দফতরে।
১০ থেকে ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজীর মেজাজে সামান্যকিছু আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। তখনও তিনি উত্তেজিত কিন্তু সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েননি। তার হাস্যরস নিভে গেছে, কিন্তু কান্না নেই। তিনি পুরুষোচিতভাবে সংযম দেখান এবং নিজের উপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করেন। বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি ভুয়া হলেও তার প্রভাব তখনও তার মন থেকে কেটে যায়নি।
নিয়াজীর মেজাজের এই পরিবর্তন অবশ্য সামরিক তৎপরতার পরিস্থিতির উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। এই পরিস্থিতির প্রমাবনতি ঘটতে থাকে। ১০ ডিসেম্বর নাগাদ দেওয়ালের লিখন এত বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মেজর জেনারেল জামশেদ ঢাকার রক্ষক হিসেবে কর্তব্য পালন করতে শুরু করে দেন। এতে জেনারেল নিয়াজীর অবস্থান আরও অনেক পেছন দিকে সরে যায়।
ঢাকা ও তার উপকন্ঠের একটি নির্বাহন মানচিত্র অভিযান কক্ষের পশ্চিম দেওয়ালে গাঁথা ছিল। ঢাকার দুই-স্তরবিশিষ্ট প্রতিরক্ষা সংগঠনের জন্যে জামশেদ সেই কক্ষে সম্মেলন চালাচ্ছেন। তার ডেপুটি, ব্রিগেডিয়ার বশীর আহমদ, নতুন নতুন প্রতিরক্ষা চিহ্নিত করবার জন্যে মানচিত্রে ঢাকার চারপাশে গোল গোল আঁচড় কাটতে থাকেন। মানচিত্রের উপর এইসব আঁচড় দেখতে বেশ ভালই লাগে—যেন মোচড় খাওয়া কোবরা সাপ, যেন এখনই শত্রুর গায়ে ছোবল মারবে যদি শত্রু তাকে স্পর্শ করবার সাহস রাখে।
কাগুজেব্যবস্থা অনুযায়ী ঢাকার প্রতিরক্ষার জন্যে থাকবে বহির্সীমানা আর অভ্যন্তরীণ সীমানা। বাইরের পর্যায়ে সৈন্যরা শত্রুকে ঠেকিয়ে রাখবে। এই কাজ তারা করবে উত্তর-পশ্চিমে মানিকগঞ্জের রেখা বরাবর, উত্তরে কালিয়াকৈরে, উত্তর-পূর্বে নারায়ণগঞ্জে, পূর্বে দাউদকান্দিতে এবং দক্ষিণ-পূর্বে মুন্সিগঞ্জে। আশা করা হয় যে, ৯৩ ব্রিগেড (ময়মনসিংহ), ২৭ ব্রিগেড (ভৈরব বাজার), ১১৭ ব্রিগেড (কুমিল্লা) এবং ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশন (চাঁদপুর) যথাক্রমে কালিয়াকৈর, নরসিংদী, দাউদকান্দি ও মুন্সিগঞ্জে অবস্থান গ্রহণ করবে। কিন্তু এই আশা কখনও আলোর মুখ দেখতে পায়নি। আর, অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষাটা থাকবে মীরপুর সেতু, টঙ্গী, ডেমরা ও নারায়ণগঞ্জ বরাবর। ঢাকাগামী এই পশ্চিম, উত্তর ও পূর্বমুখী পথগুলোর দায়িত্বে থাকবেন কর্নেল ফজলে হামিদ, ব্রিগেডিয়ার কাসিম ও ব্রিগেডিয়ার মনসুর এবং মূল নগরী ঢাকার দায়িত্বে থাকবেন ব্রিগেডিয়ার বশীর।
কিন্তু ঢাকায় কোন সংগঠিত বাহিনী না থাকায় মানচিত্রে প্রদর্শিত শূন্যস্থান ভরাট করার জন্যে নানাবিক্ষিপ্ত উপাদান সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়। আরও একটা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে অস্ত্র বিভাগ, সেবা বিভাগ ও আধা-সামরিক বাহিনীসমূহের প্রতিনিধিদেরকে তাদের লভ্য সৈন্যসংখ্যা জানাতে বলা হয়। মোট জনশক্তি দাঁড়ায় পদাতিক, প্রকৌশলী, অস্ত্র, সংকেত তড়িৎ ও যন্ত্র-প্রকৌশলী এবং সেনাবাহিনীর সার্ভিস কোরের প্রতিনিধিত্বকারী লোক নিয়ে প্রায় ১২ কোম্পানী। প্রায় ১৫০০ ই পি সি এ এফ ১৮০০ পুলিশ এবং ৩০০ অনুগত রাজাকার সব মিলিয়ে দাঁড়ায় ৫০০০ হাজার। এই জগাখিচুড়ি বাহিনীর অধিনায়কত্বের জন্যে বিভিন্ন দফতর থেকে উদ্বৃত্ত স্টাফ অফিসার তুলে আনা হয়।
জওয়ানদের অধিকাংশের কাছেই রয়েছে ৩০৩ রাইফেল। এরা যাতে অতিরিক্ত আক্রমণ-শক্তি লাভ করে, সেজন্যে বিভিন্ন উৎস থেকে এক স্কোয়াড্রন ট্যাংক, তিনটা মর্টার (৩ ইঞ্চি), চারটা রিকয়েললেস রাইফেল, ৬-পাউন্ডী দুটো কামান এবং গোটা কয়েক মেশিনগান সংগ্রহ করে বিভিন্ন অঞ্চলে বিতরণ করা হয়। এইসব ‘ভারী অস্ত্র’ সাধারণভাবে কালিয়াকৈর-টঙ্গী অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়, কারণ ভারতীয় ছত্রী ব্রিগেড এই দিক দিয়ে হামলা চালাবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে গোলা-বারুদের কোন অভাব ছিল না।
লস্কর ও অস্ত্রের এই বিবরণ কাগজের উপর দেখতে বেশ ভালই মনে হয়, কিন্তু আসলে যু্দ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি খুবই শোচনীয়। সৈন্যদের মনে বল নেই, অস্ত্রে ধার নেই, সেই অস্ত্র সেকেলে, মরচেধরা। তার চাইতে খারাপ অবস্থা হচ্ছে এই যে, সৈন্যরা লড়তে আদৌ ইচ্ছুক নয়। তারা যার যার জায়গায় পুতুলের মত দাঁড়িয়ে থাকে—যেন একটুখানি আঘাত লাগলেই গড়িয়ে পড়বার জন্যে প্রস্তুত।
১৩ ডিসেম্বর উত্তর সেক্টরের দায়িত্বে নিয়োজিত একজন ব্রিগেডিয়ার তার দুর্ভেদ্য আয়োজন দেখবার জন্যে আমাকে টঙ্গীর দিকে নিয়ে যান।
বললেন, ‘দেখো, পাকা রাস্তার উপর কাটা দাগটা হচ্ছে মাইনের জন্যে। গর্তের মধ্যে এই ঠুলিটা হচ্ছে আমাদের কামানের অবস্থান। ঐ যে ঐখানে টঙ্গী-ঢাকা সড়কের এইপাশে আমাদের রিকয়েললেস রাইফেল রাখা আছে। আরও উত্তরে গাছ-পালার ঝোঁপের মধ্যে রাখা আছে আমাদের ট্যাংক।’
তারপর আমরা জীপ থেকে নামলাম আরও কাছে থেকে ব্যাপারগুলো দেখবার জন্যে। রিকয়েললেস রাইফেল আছে ঠিকই কিন্তু তারজন্যে ভাল ধরনের গোলা বারুদে দেয়া হয়েছে। মর্টারে ‘বোমা’ আছে বটে কিন্তু ‘সাইট নেই। শত্রুর বিমান আমাদের একটা কামান ধ্বংস করে দিয়ে গেছে এবং দ্বিতীয় কামানটি হয়ত ধ্বংস হবার অপেক্ষায় রয়েছে। একমাত্র মেশিনগানের জন্যে রয়েছে সঠিক লোক ও সঠিক গোলাবারুদ।
কুর্মিটোলা বিমানক্ষেত্রের কাছে ব্রিগেডিয়ার একজন তরুণ মেজরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন বোধ হচ্ছে?’
উত্তর পাওয়া গেল, ‘ভালই, তবে আমাদের জওয়ানরা একটামাত্র মর্টার আর দুটো মেশিনগান নিয়ে ভারতের প্রচন্ড হামলা রুখবার মত সাহস অনুভব করছে না।’
‘বাজে বোকোনা। ওদেরকে উৎসাহিত করো। যুদ্ধ কখনো অস্ত্র দিয়ে জেতা যায় না।’
ফিরে গেলাম পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ডের সদর দফতরে। সেখানে ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকী ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় খন্ডযুদ্ধ সংগঠিত করার কথা বললেন। কেউ একজন উল্লেখ করলেন, ‘নগরীর রাস্তায় কেমন করে খন্ডযুদ্ধ সংগঠিত হবে যেখানে কিনা ঝাঁকে ঝাঁকে লোক আমাদের প্রতি সর্বদা বৈরিতা পোষণ করে? আপনাকে কুত্তারমত তারা তাড়া করবে। একদিক দিয়ে ভারতীয়রা আসবে মারতে, অন্যদিক দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা।’ ফলে প্রস্তাবটা বাতিল করতে হয়।
শত্রুর শক্তি আর আমাদের নিজেদের সম্পদের দিকে তাকালে দেখা যাবে ঢাকার প্রতিরক্ষাটা ঠিক তাসের ঘরের মত। আর, খন্ডযুদ্ধের কথা যদি বলেন, সেটাতো সর্বাত্মক কৌশলগত অভিযানের অংশ নয়। সেটা হচ্ছে, মগজের মধ্যে ঢুকেছে, তাই বলে দেওয়া—এর বেশি আর কিছু নয়। জানেনই তো, ডুবন্ত মানুষ খড়-কুটো পেলে তাই ধরে বাঁচতে চায়।
০০০

আত্মসমর্পণ
মেজর জেনারেল রহীম চাঁদপুর থেকে পালাতে গিয়ে সামান্য আহত হয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার নেবার পর জেনারেল ফরমানের বাসভবনে সুস্থ হতে থাকেন। বাড়ির একটা পৃথক অংশে ফরমানের সঙ্গে থাকতেন তিনি। ১২ ডিসেম্বর, সর্বাত্মক যুদ্ধের নবম দিন। স্বভাবতঃই তারা দুজন তখনকার সর্বাধিক সংকটপূর্ণ প্রশ্নটির মধ্যে নিজেদের নিবদ্ধ রাখবেন : ঢাকাকে কি রক্ষা করা যাবে? তারা খোলাখুলি মত বিনিময় করলেন। রহীমের স্থির বিশ্বাস যে, যুদ্ধবিরতিই হচ্ছে প্রশ্নটির একমাত্র উত্তর। কিন্তু ফরমান এই উত্তর শুনে বিস্মিত হলেন। কারণ, তিনি সবসময় ভারতের বিরুদ্ধে প্রলম্বিত, চূড়ান্ত যুদ্ধের পক্ষে মত জাহির করে এসেছেন। একটুখানি শ্লেষের সুরে তিনি বললেন, ‘এইটুকুতেই ঘাবড়ে গেলে বাছা—এত তাড়াতাড়ি?’ তবুও অটল রহীম বললেন, বড্ড বেশি দেরি হয়ে যাচ্ছে।
এমন সময় আহত জেনারেলকে দেখবার জন্য এলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী ও মেজর জামশেদ। রহীম একই কথা বললেন নিয়াজীকেও। এতে নিয়াজীর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দিল না। তার মন থেকে তখনও হয়তো বিদেশী সাহায্যের ভরসাটুকু নিঃশেষে মুছে যায়নি। এদিকে ফরমান প্রসঙ্গটাকে এড়িয়ে পাশের কামরায় গিয়ে ঢুকলেন।
জেনারেল নিয়াজী, রহীমের সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে ফরমানের কামরায় গিয়ে বললেন, ‘তাহলে সংকেত বার্তা রাওয়ালপিন্ডিতে পাঠিয়ে দাও।’ শুনে মনে হল, জেনারেল রহীমের পরামর্শ তিনি মেনে নিয়েছেন, যেমন শান্তিকালে সব সময় তিনি তার পরামর্শ মেনে চলতেন। জেনারেল নিয়াজী চাইলেন, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটা গভর্নমেন্ট হাউস থেকে প্রেসিডেন্টের কাজে পাঠানো হোক। ফরমান সবিনয়ে বললেন, প্রয়োজনী সংকেত বার্তা পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ডের সদর দফতর থেকেই প্রেরিত হওয়া উচিত। কিন্তু জেনারেল নিয়াজী বললেন, ‘না, সংকেত বার্তা এখান থেকেই যাক কি ওখান থেকেই যাক, তাতে কিছুই এসে যায় না। আসলে অন্যত্র আমার কিছু জরুরী কাজ আছে। তুমি তাহলে এখান থেকেই পাঠিয়ে দাও।’
ফরমান ‘না’ করবার আগেই মুখ্য সচিব মুজাফফর হোসেন কামরায় এলেন এবং আলোচনার বিষয়বস্তু বুঝতে পেরে বললেন, ‘আপনি ঠিক বলেছেন। সংকেত বার্তা এখান থেকেই পাঠানো যেতে পারে।’ এইভাবে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে গেল।
জেনারেল ফরমান যে জিনিসের বিরোধিতা করছিলেন, সেটা ঠিক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নয়, বরং সেই প্রস্তাবের উদ্যোক্তা হবার দায়িত্ব। একই বিষয়ের উপর পাঠানো তার পূর্ববর্তী সংকেতবার্তা রাওয়ালপিন্ডিতে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। বারবার তিনি লজ্জা পেতে চান না। জেনারেল নিয়াজী চলে গেলেন তার ‘জরুরী কাজ’ সম্পাদন করতে। তখন মুজাফফর হোসেন সেই ঐতিহাসিক লিপির খসড়া তৈরি করলেন। ফরমান সেটা দেখলেন এবং গভর্নরের কাছে পেশ করলেন। গভর্নর সেটা অনুমোদন করে সেইদিনই (১২ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় পাঠিয়ে দিলেন প্রেসিডেন্টের কাছে। লিপিতে ‘অজস্র নিরীহ প্রাণ বাঁচাবার জন্য’ ইয়াহিয়া খানকে ‘যথাসাধ্য করা’র অনুরোধ জানানো হল।
পরের দিন গভর্নর ও তার মুখ্য সহযোগীরা রাওয়ালপিন্ডি থেকে আদেশের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট সম্ভবতঃ এতই ব্যস্ত ছিলেন যে, তিনি সিদ্ধান্ত দেবার সময় করতে পারেন নি। আরও একদিন পর (১৪ ডিসেম্বর) গভর্নমেন্ট হাউসে উচ্চপর্যায়ের সভার আয়োজন হয়েছিল এবং তখন বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে ৩টি ভারতীয় মিগ বিমান গভর্নমেন্ট হাউসের উপর হামলা চালায় এবং প্রধান হলঘরের বিরাট ছাদ ফাটিয়ে ফেলে। বিমান হামলার হাত থেকে বাঁচবার জন্য গভর্নরকে আশ্রয়ের সন্ধানে পালাতে হয় এবং তৎক্ষণাৎ তিনি পদত্যাগপত্র লিখে ফেলেন। ক্ষমতার এই পীঠস্থানের অভ্যন্তরে বসবাসকারী প্রায় সবাই বিমান হামলা থেকে রক্ষা পান, মারা যায় কেবল শোভাবর্ধক কাচের খাঁচায় রাখা কিছু নিরীহ মাছ। তারা উত্তপ্ত পাথর-কুচির মধ্যে ছটফট করতে করতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।
১৪ ডিসেম্বর গভর্নর, তার মন্ত্রিসভা এবং পশ্চিম পাকিস্তানী অসামরিক কর্মচারীরা আন্তর্জাতিক রেডক্রস কর্তৃক ‘নিরপেক্ষ অঞ্চলে’ রূপান্তরিত হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে গিয়ে আশ্রয় নেন। পশ্চিম পাকিস্তানী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন মুখ্য সচিব, পুলিশের আই-জি, ঢাকা বিভাগের কমিশনার, প্রাদেশিক সচিবগণ এবং আরও কয়েকজন নিরপেক্ষ অঞ্চলে প্রবেশাধিকার পেতে তারা লিখিতভাবে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে ‘সম্পর্ক ছিন্ন করেন’। কারণ যুদ্ধমান রাষ্ট্রের কোন ব্যক্তি রেডক্রসের আশ্রয় লাভের অধিকারী নয়।
১৪ ডিসেম্বর ছিল পূর্ব পাকিস্তান সরকারের শেষ দিন। একাধারে সরকারের ও গভর্নমেন্ট হাউসের আবর্জনা যততত্র ছড়িয়ে ছিল। বাংলাদেশের ‘সীজারিয়ান জন্ম’কে চূড়ান্ত করবার উদ্দেশ্যে শত্রুর যে কাজ বাকী ছিল, তা হচ্ছে জেনারেল নিয়াজী ও তার অসংগঠিত বাহিনীসমূহকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা। এতদিনে জেনারেল নিয়াজীও বৈদেশিক সাহায্যের সব আশা হারিয়ে বসেছেন। তিনি আবার তার আগের হতাশার মেজাজ ফিরে পেয়েছেন এবং নিজের সুরক্ষিত কেবিন ছেড়ে কখনও তিনি বাইরে বের হচ্ছেন না। সময়ের রথ তিনি অনেক ছুটিয়েছেন, কিন্তু কখনও তিনি তার গতি ও লক্ষ্য নিয়ন্ত্রণ করেন নি।
সুতরাং, তিনি প্রেসিডেন্ট তথা সর্বাধিনায়ককে আসল অবস্থা জানালেন এবং উপদেশের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন। রাতে (১৩-১৪ ডিসেম্বর) আমার সামনে তিনি জেনারেল হামিদকে টেলিফোন করে বললেন, ‘স্যার, আমি প্রেসিডেন্টের কাছে কিছু প্রস্তাব পাঠিয়েছি। আপনি দয়া করে তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা নেয়াতে পারেন কিনা দেখুন।’
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তথা সামরিক আইন প্রশাসক তার বহুমুখী ব্যস্ততা শেষ কবে সময় করতে পারলেন এবং পরের দিন গভর্নর ও জেনারেল নিয়াজীকে আদেশ করলেন, ‘লড়াই বন্ধ করার জন্য এবং জীবন রক্ষার জন্য সর্ববিধ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হোক।’ জেনারেল নিয়াজীর কাছে পাঠানো সংকেত বার্তায় তিনি বললেন :
হাওয়ালা আমার কাছে প্রেরিত গভর্নরের বার্তা। প্রচন্ড প্রতিকূলতার মুখে আপনি বীরোচিত যুদ্ধ লড়েছেন। জাতি আপনার জন্য গর্বিত এবং বিশ্ব প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধানে উপনীত হবার জন্য মানবিকভাবে যা কিছু করা সম্ভব ছিল, আমি তার সবই করেছি। এখন আপনি এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছেন, যেখান থেকে অধিকতর প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়া মানবিকভাবে সম্ভব নয় এবং তা কোন প্রয়োজনীয় উদ্দেশ্যও পূর্ণ করবে না। বরং তাতে আরও জীবন ক্ষয় হবে এবং ধ্বংস ডেকে আনবে। লড়াই বন্ধ করার জন্য এবং সশস্ত্রবাহিনীর লোক, সকল পশ্চিম পাকিস্তানী ও অনুগত সকল ব্যক্তির জীবন রক্ষার জন্য আপনাকে এখন প্রয়োজনীয় সর্ববিধ ব্যবস্থা নিতে হবে। এদিকে আমি পূর্ব পাকিস্তানে অবিলম্বে বৈরিতা বন্ধ করতে এবং সশস্ত্রবাহিনীসমূহ ও দুষ্কৃতকারীদের হামলার লক্ষ্য হতে পারে এমন সকল ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারতকে আহ্বান জানাবার জন্য জাতিসংঘকে সচল করেছি।
এই জরুরী তারবার্তা ১৪ ডিসেম্বর ১৩টা ৩০ মিনিটে রাওয়ালপিন্ডি থেকে ছাড়া হয় এবং তা ঢাকায় এসে পৌছায় ১৫টা ৩০ মিনিটে (পূর্ব পাকিস্তান মান সময়)।
প্রেসিডেন্টের এই তারবার্তার তাৎপর্য কী? এর অর্থ কী জেনারেল নিয়াজীর জন্য আত্মসমর্পণের আদেশ? নাকি চাইলে যুদ্ধ আরও চালিয়ে যাওয়া? পাঠক যদি পারেন, তাহলে এর একটা অর্থোদ্ধারের জন্য চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
জেনারেল নিয়াজী ঐ দিন সন্ধ্যায় যুদ্ধবিরতি সফলের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। মধ্যস্থতাকারী হিসাবে তিনি সোভিয়েত ও চীনা কূটনীতিকদের কথা চিন্তা করেন, কিন্তু পরে ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল মিস্টার স্পিভাককে মনোনীত করেন। জেনারেল নিয়াজী মিস্টার স্পিভাকের কাছে যাবার জন্য মেজর জেনারেল ফরমান আলীকে সঙ্গ দেবার অনুরোধ জানান। কারণ ফরমান আলী গভর্নরের উপদেষ্টা হিসাবে বৈদেশিক কূটনীতিবিদদের সঙ্গে ওঠা-বসা করেছেন। তারা মিস্টার স্পিভাকের কার্যালয়ে পৌঁছালে ফরমান পার্শ্বকক্ষে অপেক্ষা করতে থাকেন আর নিয়াজী ভেতরে গিয়ে কথাবার্তা চালান। নিয়াজীর চড়া গলার আলাপ শুনতে থাকেন ফরমান এবং লক্ষ্য করেন যে, স্পিভাকের সহানুভূতি লাভের আশায় নিয়াজী তার রূঢ় যুক্তিবাদ দাঁড় করিয়ে যাচ্ছেন। এক সময় নিয়াজীর যখন মনে হয় যে, ‘বন্ধুত্ব’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন তিনি মার্কিন কনসালকে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির শর্তাবলী নিয়ে আলাপ-আলোচনা চালাতে বলেন। মিস্টার স্পিভাক সকল ভাবপ্রবণতা পরিহার করে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘আপনার পক্ষে আমি যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে পারি না। তবে আপনি চাইলে আমি কেবল একটা বার্তা পাঠাতে পারি।’
ভারতের স্টাফ প্রধান (সেনাবাহিনী) জেনারেল স্যাম মানেক-শ’র কাছে পাঠাবার উদ্দেশ্যে একটা বার্তার খসড়া তৈরির জন্য জেনারেল ফরমানকে ডাকা হল। তিনি পূর্ণ এক পৃষ্ঠার যে লিপি প্রস্তুত করলেন, তাতে আশু যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয় নিম্নরূপ নিশ্চয়তাবিধানের শর্তসহ : পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীসমূহ ও আধা-সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তা; মুক্তিবাহিনীর প্রতিশোধ গ্রহণ থেকে অনুগত অসামরিক নাগরিকদের রক্ষা; এবং অসুস্থ ও আহত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুচিকিৎসা।
লিপি প্রস্তুত হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে মিস্টার স্পিভাক বললেন, ‘কুড়ি মিনিটের মধ্যে এটা প্রেরিত হবে।’ জেনারেল নিয়াজী ও ফরমান এডিকং ক্যাপ্টেন নিয়াজীকে উত্তরের জন্য সেখানে বসিয়ে রেখে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডে ফিরে এলেন। তিনি রাত ১০টা পর্যন্ত বসে থাকলেন, কিন্তু কিছুই ঘটল না। তাকে বলা হল, পরে খোঁজ নেবেন, এখন ঘুমাতে যান। সারারাত ধরে কোন উত্তর এল না।
বস্তুতঃ মিস্টার স্পিভাক ঐ বার্তা জেনারেল (পরে ফিল্ড মার্শাল) মানেক-শ’র কাছে পাঠান নি। তিনি তা পাঠিয়েছেন ওয়াশিংটনে। ওয়াশিংটনে মার্কিন সরকার কোন ব্যবস্থা নেয়ার আগে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পরামর্শের জন্য চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খানকে পাওয়া যায়নি। কোথাও তিনি দুঃখ ভুলবার চেষ্টা করছিলেন। পরে আমি জানতে পারি যে, সেই কোন ৩ ডিসেম্বরে তিনি যুদ্ধের ব্যাপারে আগ্রহহীন হয়ে পড়েন এবং তারপর থেকে তিনি কখনও আর নিজের কার্যালয়ে আসেন নি। সাধারণত তার সামরিক সচিব সর্বশেষ যুদ্ধ-পরিস্থিতিচিহ্নিত একটা মানচিত্র নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে যান। কখনও কখনও এই মানচিত্র তিনি দেখেন এবং একবার তিনি বলেন, ‘এই পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আমার কীইবা করার থাকতে পারে।’
১৫ ডিসেম্বর মানেক-শ’ যে উত্তর দেন, তাতে তিনি বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী যদি ‘আমার অগ্রসরমান বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে, তাহলে যুদ্ধবিরতি গ্রহণ করা হবে এবং লিপিতে উল্লিখিত কর্মচারীদের নিরাপত্তা রক্ষা করা হবে।’ খুঁটিনাটি প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে আলাপ-আলোচনার জন্য তিনি ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ডের আসন কলকাতায় একটি বেতার তরঙ্গও প্রদান করেন।
মানেক-শ’র জবাব রাওয়ালপিন্ডি পাঠানো হল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান ১৫ ডিসেম্বরের সন্ধ্যা নাগাদ যে উত্তর পাঠান, তাতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ছিল, ‘আমার পরামর্শ হচ্ছে, তারা যখন তোমাদের চাহিদা পূরণ করছে, তখন তোমরাও এইসব শর্তে যুদ্ধবিরতি মেনে নাও।…….অবশ্য এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি যদি জাতিসংঘ কর্তৃক দেয় সমাধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তাহলে এটা বাতিল ও অপ্রযোজ্য বলে গণ্য হবে।’
১৫ ডিসেম্বর অপরাহ্ন ৫টা থেকে পরের দিন বেলা ৯টা পর্যন্ত অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে এর মেয়াদ ১৬ ডিসেম্বরের অপরাহ্ন ৩টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়, যেন যুদ্ধবিরতি শর্তগুলি চূড়ান্ত করবার জন্য সময় পাওয়া যায়। জেনারেল হামিদ যখন নিয়াজীকে যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়ার ‘পরামর্শ’ দেন, তখন নিয়াজী সেটাকে ‘অনুমোদিত’ বলে মনে করেন এবং তার স্টাফ প্রধান ব্রিগেডিয়ার বকরকে সৈন্য-পরিস্থিতি নির্ধারণের জন্যে প্রয়োজনীয় আদেশ জারি করতে বলেন। পূর্ণ এক পৃষ্ঠাজুড়ে লেখা সংকেতবার্তায় সৈন্যদের ‘বীরোচিত লড়াই’-এর প্রশংসা করা হয় এবং স্থানীয় অধিনায়কদের ভারতীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়, যাতে যুদ্ধবিরতির আয়োজন করা যায়। এতে ‘আত্মসমর্পণ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। বলা হয়, ‘দুর্ভাগ্যবশতঃ, অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করার বিষয়টিও এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে।’
সংকেতবার্তাটি যখন পাঠানো হয় তখন মধ্যরাত্রি (১৫-১৬ ডিসেম্বর)। একই সময়ে ৪ বিমান চলাচল স্কোয়াড্রনের অফিসার কম্যান্ডিং লেফটেন্যান্ট কর্নেল লিয়াকত বুখারীকে সর্বশেষ শলা-পরামর্শের জন্যে ডেকে পাঠানো হয়। তাকে সেই একই রাত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভেতর দিয়ে আকাশ পথে বার্মার আকিয়াবে আটজন পশ্চিম পাকিস্তানী সেবিকা ও আঠাশটি পরিবারকে পাঠিয়ে দিতে বলা হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল লিয়াকত যুদ্ধকালের মতই স্বাভাবিক ও শান্তভাবে এই আদেশ মানেন। ১২ দিনের সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রতিটি দিনে তার হেলিকপ্টারগুলো ছিল পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ড থেকে সর্বাধিক দুর্দশাগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকায় লোক ও অস্ত্রশস্ত্র পাঠাবার জন্যে লভ্য একমাত্র মাধ্যম। তাদের এই অপরিমেয় বীরত্বের কথা এখানে অল্প কথায় ব্যক্ত করা যাবে না।
১৬ ডিসেম্বরের খুব ভোরে দুটি এবং প্রকাশ্য দিবালোকে আরও একটি হেলিকপ্টার রওয়ানা হয়ে যায়। এতে ছিলেন মেজর জেনারেল রহীম খান এবং আরও কয়েকজন। কিন্তু সেবিকাদের তাদের হোস্টেল থেকে ‘সময়মত সংগ্রহ করা যায়নি’ বলে তাদের নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। সবকটি হেলিকপ্টার বার্মায় নিরাপদে অবতরণ করে এবং যাত্রীরা পরে করাচী পৌঁছে যান।
আবার ঢাকা, এবং সেই দুর্ভাগ্যজনক মুহূর্তটি অতি নিকটবর্তী। টাঙ্গাইল থেকে এগিয়ে আসা শত্রুবাহিনী যখন টঙ্গীর কাছাকাছি এসে পৌঁছায়, তখন আমাদের ট্যাংকবহরের গোলা দিয়ে তাদের স্বাগত জানানো হয়। টঙ্গী-ঢাকা সড়ক সুরক্ষিত মনে করে তারা পার্শ্ববর্তী পরিত্যক্ত রাস্তা ধরে মানিকগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। ৬ ডিসেম্বর কর্নেল ফজলে হামিদ খুলনা থেকে যেমন সরে গিয়েছিলেন, এই মানিকগঞ্জ থেকেও তিনি ঠিক তেমনিভাবে আগেই সরে গিয়েছিলেন। ফজলে হামিদের বাহিনীর অনুপস্থিতির জন্যে শত্রুবাহিনী অতিসহজেরই উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ঢাকায় প্রবেশের অবাধ সুযোগ লাভ করে।
ঢাকার সেনানিবাস ছাড়া গোটা প্রাদেশিক রাজধানীর প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্রিগেডিয়ার বশীর ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় জানতে পারেন যে, মানিকগঞ্জ-ঢাকা সড়ক সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় আছে। সেই রাত্রির প্রথম অর্ধেক তিনি প্রায় এক কোম্পানীর সমান ই পি সি এ এফ-এর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকজনদের যোগাড় করতে পাঠিয়ে দেন এবং এদের মীরপুর সেতুর কাছে ঠেলে দেন মেজর সালামতের তত্ত্বাবধানে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে মুক্তি বাহিনী খবর দিয়ে রেখেছিল যে, সেতুটি অরক্ষিত অবস্থায় আছে, তাই তাদের ঝটিকা বাহিনী ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যরাত্রির দিকে ঢাকা নগরীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ততক্ষণে মেজর সালামতের জওয়ানরা সেখানে অবস্থান নিয়ে ফেলেছে এবং তারা অগ্রসরমান শত্রুবাহিনীর দিকে অন্ধের মত গুলি ছুঁড়তে থাকে। তারা বেশে কয়েকজন শত্রু সৈন্যকে নিহত এবং দুটি ভারতীয় জীপ আটক করে বলেও দাবী জানায়।
এদিকে অগ্রসরমান ঝটিকা বাহিনীর পিছনেই আসছিলেন ১০১ যোগাযোগ অঞ্চলের মেজর জেনারেল নাগরা। তিনি মীরপুর সেতুর পশ্চিমপ্রান্তে অব্স্থানে নেন এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর কাছে একটি চিরকুট লিখে পাঠান। এতে বলা হয়, ‘প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি মীরপুর সেতুর কাছে আছি। আপনার প্রতিনিধি পাঠান।’
সকাল ৯টার দিকে জেনারেল নিয়াজী যখন চিরকুটটি পান, তখন মেজর জেনারেল জামশেদ, মেজর জেনারেল ফরমান ও রিয়ার এডমিরাল শরীফ তার সঙ্গে ছিলেন। ফরমান তখনও ‘যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত বার্তার’ জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। তাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই (নাগরা) কি আলোচনাকারী দলের লোক?’ জেনারেল নিয়াজী এর কোন উত্তর দেননি। কঠিন প্রশ্ন সামনে দাঁড়াল : একে কি স্বাগত জানানো হবে, না প্রতিরোধ করা হবে?
মেজর জেনারেল ফরমান জেনারেল নিয়াজীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কি কোন রিজার্ভ সৈন্য আছে?’ নিয়াজী এবারও কিছু বললেন না। রিয়ার এডমিরাল শরীফ পাঞ্জাবী ভাষায় বললেন, ‘শুনছ, ও জানতে চাচ্ছে, তোমার ঝোলায় কি কিছু আছে?’ নিয়াজী ঢাকা নগরীর রক্ষক জামশেদের দিকে তাকালেন এবং ডাইনে বাঁয়ে এমনভাবে মাথা নাড়ালেন, যার অর্থ হচ্ছে ‘কিছুই নেই।’ তখন ফরমান ও শরীফ প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘তাহলে যাও, গিয়ে সে (নাগরা) যা বলে, তাই তামিল কর।’
জেনারেল নিয়াজী মেজর জেনারেল জামশেদকে পাঠালেন নাগরাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে। মীরপুর সেতুতে অবস্থানরত আমাদের সৈন্যদের তিনি বললেন যুদ্ধবিরতির প্রতি মর্যাদাবান থাকতে এবং নাগরাকে শান্তিপূর্ণভাবে ভেতরে আসবার ব্যবস্থা করে দিতে। ভারতীয় জেনারেল অল্প কয়েকজন সৈনিক আর বুকভরা পথ দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করলেন। এইভাবে ঢাকা নগরীর প্রকৃত পতন সংঘটিত হল।
ঢাকার পতন হল অত্যন্ত শান্তভাবে, ঠিক যেমন হার্টের রোগীর হয়। না কোন অঙ্গহানি হল, না একটু আঘাত লাগল গায়ে। যা ছিল স্বাধীন নগরী, এক মুহূর্তের ব্যবধানে তা এখন পরাধীন। সিঙ্গাপুর, প্যারিস কিংবা বার্লিনের পতনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এখানে হয়নি।
এদিকে পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ডের রণকৌশলগত সদর দফতর গুটিয়ে ফেলা হল। অভিযান পরিচালনা সম্পর্কিত সব মানচিত্র সরিযে ফেলা হল। ভারতীয়দের স্বাগত জানাবার জন্যে প্রধান সদর দফতর ঝেড়েমুছে পরিষ্কার করা হল এবং ব্রিগেডিয়ার বকর বললেন, ‘একে এখন আরও সুন্দর দেখাচ্ছে।’ সংলগ্ন অফিসার্স মেসকে আগে থেকে সাবধান করে দেওয়া হল ‘মেহমানদের’ জন্যে অতিরিক্ত খাদ্য প্রস্তুত রাখার জন্যে। কেতাদুরস্ত প্রশাসনের জন্যে বকরের জুড়ি মেলা ভার।
দুপুরের অল্প পরে ব্রিগেডিয়ার বকর বিমানবন্দরে গেলেন তাঁর ভারতীয় প্রতিপক্ষ মেজর জেনারেল জ্যাকভকে অভ্যর্থনা জানাতে। এদিকে নিয়াজী নাগরার সঙ্গে রসিকতায় মেতে উঠলেন। সেই রসিকতার ভাষাগুলি…টাকে রাখিনি বলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী এবং সেগুলো ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করারও যোগ্য নয়।
মেজর জেনারেল জ্যাকভ ‘আত্মসমর্পণের দলিল’ এনে হাজির করলেন জেনারেল নিয়াজী এবং তার স্টাফপ্রধান যেটাকে ‘খসড়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি’ নামে অভিহিত করা শ্রেয়ঃ বলে মনে করলেন। জ্যাকভ কাগজপত্র বকরের কাছে হস্তান্তর করলেন, বকর আবার তা মেজর জেনারেল ফরমানের সামনে রাখলেন। দলিলের যে দফায় লেখা আছে, ‘ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কম্যান্ড’, সেই দফার উপর জেনারেল ফরমান আপত্তি তুললেন। জ্যাকভ বললেন, ‘কিন্তু দিল্লী থেকে তো এটা এইভাবেই এসেছে।’ একপাশে দাঁড়ানো ভারতীয় সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের কর্নেল খেরা ফোড়ন কাটলেন, ‘আরে দাদা, এটাতো ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আসলে আপনারা কেবল ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করছেন।’
দলিলটা এরপর নিয়াজীর কাছে ঠেলে দেওয়া হয় এবং তিনি একনজর চোখ বুলিয়ে নিয়ে সেটাকে টেবিলের অন্য পাশে ফরমানের দিকে ঠেলে দেন। ফরমান বললেন ‘গ্রহণ করা হবে কি হবে না তা’ অধিনায়কদের ব্যাপার। নিয়াজী কিছুই বললেন না। এর অর্থ হচ্ছে যে, তিনি সেটা মেনে নিলেন।
দুপুর গড়িয়ে গেলে জেনারেল নিয়াজী মোটরযোগে ঢাকা বিমানবন্দরে যান ভারতের পূর্বাঞ্চল কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে অভ্যর্থনা জানাতে। তিনি সস্ত্রীক হেলিকপ্টারযোগে পৌঁছালেন। বহু বাঙালী জনতা তাদের এই ‘ত্রাণকর্তা’ ও তাঁর স্ত্রীকে মাল্যভূষিত করার জন্যে যেন প্রতিযোগিতায় নামলেন। নিয়াজী তাঁকে সামরিক অভিবাদন জানালেন এবং করমর্দন করলেন। সে এক মর্মস্পর্শী দৃশ্য। বাঙালীরা একসঙ্গে বিজেতা ও বিজিতকে বুক ভরে দেখবার সুযোগ লাভ করেন এবং তারা অরোরা ও নিয়াজীকে যথাক্রমে পরম ভালবাসা ও চরম ঘৃণার দৃষ্টি দিয়ে দেখবার মানসিকতাটা গোপন করেন নি।
তুমুল হৈ-হল্লা ও শ্লোগানের মধ্য দিয়ে তাঁরা মোটরযোগে রমনা রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে) যান। সেখানে আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্যে মঞ্চ আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল। ভাবপ্রবণ বাঙালী জনতার ভিড়ে সারা মাঠ গমগম করছিল। একজন পশ্চিম পাকিস্তানী জেনারেলের প্রকাশ্য লাঞ্ছনা দেখবার জন্যে তারা সবাই ছিল অত্যন্ত উদগ্রীব। একই সঙ্গে নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মেরও উপলক্ষ ছিল সেটা।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছোট একটি দল সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায় বিজেতাকে সম্মানসূচক অভিবাদন জানাবার জন্যে। অন্যদিকে ভারতীয় সৈনিকদের একটি দল বিজিতকে পাহারা দিতে থাকে। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর দেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী। আনুমানিক ১০ লাখ বাঙালী এবং বহু বিদেশী সাংবাদিক এই দৃশ্য পূর্ণমাত্রায় দেখবার সুযোগ লাভ করেন। তারা দুইজন উঠে দাঁড়ান। জেনারেল নিয়াজী তার রিভলবার বের করে অরোরার হাতে সমর্পণ করেন ঢাকা নগরীকে সমর্পণের নিদর্শনস্বরূপ। অর্থাৎ সেই সঙ্গে সমর্পণ করা হয়ে গেল গোটা পূর্ব পাকিস্তানকে।
ঢাকা গ্যারিসনকে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্যে তাদের ব্যক্তিগত অস্ত্রশস্ত্র নিজেদের কাছে রাখতে দেওয়া হয়। স্থির হয় যে, যথেষ্ট সংখ্যায় ভারতীয় বাহিনী নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের জন্যে এসে না পৌঁছানো পর্যন্ত এই ব্যবস্থা কার্যকর থাকবে। এই গ্যারিসন ১৯ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় সেনানিবাসের গলফ মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। ঢাকার বাইরে অবস্থিত সৈন্যরা স্থানীয় অধিনায়কদের ব্যবস্থাপনায় ১৬ থেকে ২২ ডিসেম্বরের মধ্যে সুবিধামত তারিখে তাদের অস্ত্র ত্যাগ করে।
অল-ইন্ডিয়া রেডিও সেই ১৪ ডিসেম্বর থেকে আত্মসমর্পণের খবর সম্প্রচার করতে শুরু করে দেয়। এই সম্প্রচার ঢাকা ও অন্যান্যস্থানের অবাঙালী জনসংখ্যাকে আতঙ্কিত করে তোলে। তাদের অনেকেই পাকিস্তানী সৈনিকদের দুর্ভাগ্যের অংশীদার হবার জন্যে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে সেনানিবাসের দিকে অগ্রসর হয়। এইরকমের হাজার হাজার অবাঙালী মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে মৃত্যুবরণ করে। এইসব নির্যাতনের লোমহর্ষক কাহিনী আমি শুনেছি। মানুষের বুকের রক্ত হিম করে দেওয়ার মতো এসব কাহিনী এই স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।
এইসব নিরীহ লোককে বাঁচাবার মত সময় ভারতীয়দের ছিল না। তারা তখন অত্যন্ত ব্যস্ত ছিল বিজয়-উত্তর লুটের মাল ভারতে পাচার করতে। বড় বড় ট্রেন আর সারিবদ্ধ ট্রাক বোঝাই করে সামরিক সরঞ্জাম, খাদ্যসামগ্রী, শিল্পপণ্য এবং রেফ্রিজারেটর গালিচা ও টেলিভিশন সেটসহ বহু গার্হস্থ্য সামগ্রী ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাঙলাদেশের রক্ত নিঃশেষে এমনভাবে শুষে নেয়া হয় যে, ‘স্বাধীনতার’ ঊষালগ্নকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে পড়ে থাকে শুধু একটা খোলস। এক বছর পর এই উপলব্ধি সাড়া জাগিয়েছিল বাঙালীদের চেতনায়।
ভারতীয়রা বাঙলাদেশের সম্পদ যত পেরেছে নিজেদের রাজ্যে স্থানান্তরিত করা হয়ে যাবার পর ভারতের বিভিন্ন যুদ্ধবন্দী শিবিরে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের স্থানান্তরিত করতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে ১৯৭২-এর শেষ পর্যন্ত। অবশ্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী, মেজর জেনারেল ফরমান, রিয়ার এডমিরাল শরীফ, এয়ার কমোডর ইনামুল হকসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের তারা ২০ ডিসেম্বর বিমানযোগে কলকাতা নিয়ে যায়। আমিও তাদের সঙ্গে ছিলাম।
২০ ডিসেম্বর অপরাহ্ন ৩টা ৩০ মিনিটে আমি যখন শেষবারের মতো ঢাকা বিমানবন্দর ত্যাগ করলাম, তখনকার সেই ঢাকা ১৯৭০-এর জানুয়ারীতে আমি যখন প্রথম এখানে নামি, তখনকার ঢাকার চাইতে কত পৃথক! পাকিস্তানী সৈন্যের খাকীর জায়গায় স্থান করে নিয়েছে সবুজবেশী সৈন্যরা। ভারতীয় সবুজ পোশাক। বাঙালীরা সেই একই জায়গায় রেলিং-এ বসে অবাক হয়ে পরিবর্তন দেখছে। এই পরিবর্তন তাদের হতবুদ্ধি করে তুলল, যে পরিবর্তন হয়ত ভবিষ্যতে একদিন তাদের আরও শোচনীয় আধিপত্যের নিগড়ে আবদ্ধ করবে। তবে কি তারা কেবল জোয়াল পরিবর্তন করল?
পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে কোন তদন্ত কমিশনের সামনে যখন জেনারেল নিয়াজীর হিসাব বুঝিয়ে দেবার সময় বা প্রয়োজন দেখা দেবে, তার আগে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে পৌঁছাবার পরপরই আমি তার সঙ্গে বসে যুদ্ধের আনুপূর্ব পরিস্থিতি আলোচনার সুযোগ নিলাম। তিনি আলাপ করলেন স্পষ্টভাবে ও তীর্যকভাবে। তার কথায় কোন অনুতাপ বা বিবেকের দংশন ছিল না। পাকিস্তানের ভাঙনের জন্যে কোন রকমের দায়িত্ব মেনে নিতে তিনি অস্বীকৃতি জানালেন এবং সব দোষ চাপালেন জেনারেল ইয়াহিয়া খানের উপর। আমাদের আলাপের কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কখনও কি আপনি ইয়াহিয়া খান বা হামিদকে জানিয়েছেন যে, যে সম্পদ আপনাকে দেওয়া হয়েছে, আপনার উপর আরোপিত দায়িত্ব পালনের জন্যে তা যথেষ্ট নয়? তারা কি বেসামরিক নাগরিক যে, এসব জানেন না? তারা কি জানেন না যে, ঘরে-বাইরে বিদ্যমান বড় বড় বিপদের মুখে পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করবার ব্যাপারে তিনটা পদাতিক ডিভিশন যথেষ্ট নয়? আপনি যাই বলুন না কেন, ঢাকাকে রক্ষার ব্যাপারে আপনার অক্ষমতা রণাঙ্গনের অধিনায়ক হিসেবে আপনার বিরুদ্ধে একটা তীর্যক হয়ে থাকবে। পরিস্থিতি অনুযায়ী এমনকি দুর্গে বসে থেকে প্রতিরক্ষা যদি একমাত্র সম্ভাব্য মতবাদ হয়, তবে বলব, আপনি তো ঢাকাকে দূর্গ করে গড়ে তোলেন নি। ঢাকায় কোন সৈন্য ছিল না।’
উত্তরে নিয়াজী বললেন, ‘এজন্যে রাওয়ালপিন্ডি দায়ী। তারা আমার কাছে নবেম্বরের মাঝামাঝি ৮টা পদাতিক ব্যাটেলিয়ন পাঠাবে বলে কথা দিয়েছিল, কিন্তু পাঠায় মাত্র ৫ ব্যাটেলিয়ন। পশ্চিম পাকিস্তানে রণাঙ্গন খুলে গেল বলে আমাকে আগেভাগে না জানিয়ে বাকী ৩টা ব্যাটেলিয়ন পাঠানো বন্ধ রাখা হল। অথচ আমি এই অবশিষ্ট ৩ ব্যাটেলিয়ন সৈন্য ঢাকায় মোতায়েন করতে চেয়েছিলাম।’
‘কিন্তু ৩ ডিসেম্বরে আপনি যখন জানতেন যে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আর বেশি কিছু আসবে না, তখন আপনি আপনার নিজস্ব সম্পদ থেকে কেন সঞ্চয় ভান্ডার গড়ে রাখেন নি?’
‘কারণ, একসঙ্গে সব সেক্টরের উপর প্রবল চাপ এসেছিল। সব সেক্টরের জন্যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল সৈন্য পাঠানো হবে বলে। অথচ একটাও সৈন্য পাঠানো হয়নি।’
আমি পরামর্শ দিলাম, ঢাকাতে আপনার অল্পস্বল্প যা ছিল, তাই দিয়ে আপনি আরও কয়েকদিন অন্ততঃ যুদ্ধটা প্রলম্বিত করতে পারতেন।’
তিনি উত্তর দিলেন, ‘কিসের জন্যে? তাতে তো আরও বেশি মৃত্যু, আরও বেশি ধ্বংস ডেকে আনা হত। ঢাকার সব নর্দমা ভরে যেত। সব রাস্তায় লাশ আর লাশ স্তূপীকৃত হয়ে থাকত। পৌর সুযোগ-সুবিধা বলতে কিছুই থাকত না। মারী, মহামারীতে দেশ ছেয়ে যেত। তারপরেও পরিণতি হত একই। আমি বরং ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দী পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়াকে বেশি ভাল বলে মনে করব ৯০ হাজার বিধবা আর ৫ লক্ষ এতিম শিশু নিয়ে যাওয়ার চাইতে। এই আত্মত্যাগ হত কত অলাভজনক।’
‘যদিও সমাপ্তিটা হত একই ধরনের, কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইতিহাস হত ভিন্ন রকমের। তখন সামরিক তৎপরতার ইতিহাসে সেটা লেখা হত উৎসাহব্যঞ্জক একটা অধ্যায় হিসেবে।’
জেনারেল নিয়াজী এর কোন উত্তর দেননি।

ভাষান্তর : নেয়ামাল বসির/সিরাজুল ইসলাম কাদির/সৈয়দা নাজমা ওয়াহিদ।
০০০

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!