You dont have javascript enabled! Please enable it! স্বাধীনতা যুদ্ধে একটি পদাতিক দলের অভিযান | ব্রিগেডিয়ার আমীন আহম্মদ চৌধুরী বীরবিক্রয় | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৭ ডিসেম্বর ১৯৮২ - সংগ্রামের নোটবুক

স্বাধীনতা যুদ্ধে একটি পদাতিক দলের অভিযান | ব্রিগেডিয়ার আমীন আহম্মদ চৌধুরী বীরবিক্রয় | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৭ ডিসেম্বর ১৯৮২

রণনীতি ও রণকৌশলগত অবস্থান থেকে লেখক এ লেখাটি তৈরি করেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের আবেগবর্জিত তথ্যনির্ভর বর্ণনা হিসেবে লেখাটি আমরা প্রকাশ করছি।
স্বাধীনতাযুদ্ধ এখন আমাদের, যোদ্ধাদের স্মৃতিতে জেগে আছে। এবং সঙ্গত কারণেই, স্মৃতির প্রতারণা থেকে আমরা মুক্ত নই। এ বাস্তবতার কারণেই প্রয়োজন, জাতীয় ভিত্তিতে যুদ্ধকে ধারণ করা—যেভাবে লেখক করেছেন।
দেশের সর্বত্র যারা যুদ্ধের, যুদ্ধ অভিজ্ঞতার অংশীদার, তাদের কাছে আমাদের আবেদন, এভাবে জাতীয় অস্তিত্বের লড়াইয়ের চিত্র ধারণ করুন। সম্ভব হলে, তা বিচিত্রা কার্যালয়ে পাঠাতে পারেন। বিচিত্রা সমাজ থেকে আহরিত এই তথ্যনির্ভর চিত্র সংরক্ষণ করবে এবং প্রয়োজনে, পাঠকদের উপহার দেবে।–সম্পাদক

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে মহালছড়ি—বুড়িঘাট এলাকায় যুদ্ধ চলাকালীন শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের (যিনি ২৭ এপ্রিল ৭১ সালে মহালছড়ি যুদ্ধে শহীদ হন) ভীত সন্ত্রস্ত এম জি ওয়ালা থেকে এম জি কেড়ে নিয়ে নিজেই ফায়ার করতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু কেড়ে নেওয়ার সময় তিনি এম জি’র ব্যারেল বাঁ হাতে দিয়ে ধরেছিলেন। উত্তপ্ত ব্যারেল তাঁর হাতের তালু ঝলসে দেয় তখন বাঁ হাত কাঁদাতে ঢুকিয়ে ডান হাত দিয়ে ফায়ার বজায় রাখেন। একটি ছোট ভুল যুদ্ধে কি মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে তা উপরের বাস্তব ঘটনার বর্ণনা থেকে সহজে অনুমান করা যায়। স্বাধীনতাযুদ্ধের এই ছোট ছোট ঘটনাগুলো ধরে রেখে তার চেয়েও ছোট ছোট শিক্ষণীয় বিষয়গুলোকে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করে আগামীদিনের পাথেয় হিসাবে রাখার উদ্দেশ্যেই এই লেখার প্রচেষ্টা। সেই হিসাবে আমরা একটি প্লাটুনের এ্যাকশনকে পর্যালোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে সাব্যস্ত করি। এই প্লাটুনটি হচ্ছে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৭ নম্বর প্লাটুন। যার অধিনায়ক ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত অনারারী ক্যাপ্টেন আবদুল ওহাব বীর বিক্রম। কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল গফফার হাওলাদার বীর উত্তম। তথ্য পর্যালোচনায় সাহায্য করেছেন স্থানীয় জনসাধারণ এবং তথ্য সংগ্রহে খসড়া তৈরিতে সাহায্য করেছেন ক্যাপ্টেন আবদুল হাজিজ।
ক্যাপ্টেন আবদুল ওহাব ও সুবেদার মঙ্গল মিঞাকে অভিযান এলাকায় সরেজমিনে নিয়ে যাওয়ার পরেও সাথীদের পূর্ণাঙ্গ নাম ঠিকানা, নিজস্ব দলের সংখ্যা, দুশমনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অস্ত্রের সঠিক অবস্থানগুলো এগার বছর পর পুনরায় সঠিকভাবে মনে রাখতে পারেননি। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে তাদের বক্তব্য ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের মাঝে যথেষ্ট মিল রয়েছে, যা তাদের বক্তব্যের সততার স্বপক্ষেই রায় দেয়। যুদ্ধচলাকালীন সময়ে প্রেরিত মুক্তিবাহিনীর Situation report গুলো আমাদের হাতে নেই তা না হলে বক্তব্য, বিশেষ করে নাম ধাম ও দুশমনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যাচাই করা যেত। যাচাই করা আরও সহজ হতো যদি পাকিস্তানী রিপোর্টগুলো মিলিয়ে দেখার সুযোগ পাওয়া যেত। অবশ্য আমরা বক্তব্য বা ফলাফলের উপর গুরুত্ব না দিয়ে মূল ঘটনার উপর গুরুত্ব দিতে বিশেষ আগ্রহী।

অনারারী ক্যাপ্টেন (অবঃ) আবদুল ওহাব বীর বিক্রম
কুমিল্লা ২ নম্বর সেক্টরের অধীন কসবা ও মন্দভাগ এলাকার অতি পরিচিত নাম এই সুবেদার সাহেব। এগার বছর পর আজও ঐ এলাকায় আবাল বৃদ্ধ-বনিতা এক লহমায় সুবেদার ওহাবকে চিনেছিল এবং তাঁর ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিগত সততা ও দুঃসাহসিকতার জন্য এলাকাবাসী আজও তাঁকে নিয়ে গর্ব করে। এগারো বছর পরও বহুদূর দুরান্ত থেকে লোক এসেছিল তাঁকে এক নজর দেখার জন্য।
[অনারারী ক্যাপ্টেন আবদুল ওহাব ১৯২৯ সালের ১৫ই মার্চ কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার থানার হাজমেহার ইউনিয়নের মরিচ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালের ১ এপ্রিল কুমিল্লার জাফরগঞ্জ ডাকবাংলোতে অবস্থানকালে মরহুম ক্যাপ্টেন আবদুল গনি তাকে সেনাবাহিনীতে রিক্র্যুট করেন। সেনাবাহিনীতে ফুটবল খেলায় একজন দক্ষ গোলকিপার হিসাবে সর্বস্তরে উনার পরিচিতি ছিলো। ১৯৬৩ সালে ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর সাথে বদলী হন। ১৯৭০ সালের শেষ দিকে লাহোর থেকে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে বদলী হয়ে কুমিল্লা আসেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ৪ ইস্ট বেঙ্গলের চার্লি কোম্পানীকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাঠানো হয়। এ সময় ২৬ মার্চের পর প্রথমে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শাফায়েত জামাল বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বে ও পরে নিহত ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তখন সুবেদার ওহাব চার্লি কোম্পানীর ৭ নম্বর প্লাটুনের কমান্ডার ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য তিনি বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৮০ সনের মার্চ মাসে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে দীঘিনালা সেনানিবাস সংলগ্ন নিজ্স্ব বাড়িতে তিনি বসবাস করছেন। তাঁর দুই ছেলে ও ছয় মেয়ে রয়েছে।–লেখক]

স্বাধীনতা যুদ্ধে ৭ নম্বর প্লাটুনের অভিযান
রেলওয়ে ট্রলি ধ্বংস অভিযান
মুক্তিযুদ্ধের একেবারে প্রথম দিকে সুবেদার ওহাব-এর নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানগুলির মধ্যে মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনে পাক সেনাদের গোলাবারুদ ও রসদ বহনকারী একটি ট্রলি ধ্বংস অভিযান একটি। ৭১-এর ১৮ জুনে পরিচালিত এই অভিযানে উক্ত রেলওয়ে ট্রলি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এটি ছিল একটি ত্বড়িৎ ফাঁদ এবং এই অভিযানের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শত্রুর সংবাদ লাভের পর কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ছাড়াই অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে ওৎপেতে সাফল্যজনকভাবে ট্রলির ধ্বংস কাজ সম্পন্ন করা।

মন্দভাগ স্টেশন এলাকার নকশা :

মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ এবং আক্রমণ তীব্রতর আকার ধারণ করার পূর্বে যখন পাক বাহিনী আখাউড়া কুমিল্লা রেলওয়ে লাইন যোগাযোগ মাধ্যম (এল অব সি) হিসাবে ব্যবহার করতে থাকে তখন বি এস এফ-এর মারফৎ সংবাদ পাওয়া যায় যে, পাক সেনারা একটি রেলওয়ে ট্রলিতে গোলাবারুদ ও সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে কসবা স্টেশন থেকে সালদা নদী স্টেশন এলাকায় অবস্থিত প্রতিরক্ষা ব্যূহতে নিয়ে যাচ্ছে। এই সময় ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর ৭ নম্বর প্লাটুন কসবার পূর্বে দেবীপুরে অবস্থান করছিল। শত্রু ও ট্রলির উপর এ্যামবুশ করার জন্য ৭ নম্বর প্লাটুনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। বেলা তখন আনুমানিক সাড়ে এগারোটা।
যখন এই সংবাদ পাওয়া যায় তখন লক্ষ্যবস্তুর অর্থাৎ ট্রলির অস্ত্র গন্তব্যস্থানের দিকে ধাবিত হচ্ছে অথচ গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই তা ধ্বংস করতে হবে। কাজেই হাতে সময় অল্প। সুবেদার ওহাব প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আনুমানিক ৪০ জনের একটি দল প্রস্তুত করেন এবং মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনে শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য এ্যামবুশ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাঁর দল নিয়ে অনেকটা দৌড়ে ও তাড়াহুড়া করে মন্দভাগ স্টেশনের পূর্বদিকে রেললাইন থেকে মাত্র দেড়শ’ গজ দূরে অবস্থান করেন (১ নং চিত্রে দেখুন)। তার সাথে ছিল ২টি মেশিন গান, ৬/৭টি এল এম জি, ১টি দুই ইঞ্চি মর্টার এবং ব্লিন্ডিসাইড। সুবেদার ওহাব তাঁর দলকে গ্রাম ও গাছ-পালার আড়ালে এমনভাবে মোতায়েন করেন যে একেবারে কাছে থেকেও তাদের অবস্থান দেখে ফেলার সম্ভাবনা শত্রুর ছিল না। বলাবাহুল্য, তাদের পোশাকও ছিল স্থানীয় জনসাধারণের মত। যখন তাঁর দল অবস্থান গ্রহণ করে তখন শত্রুর রেলওয়ে ট্রলি মন্দভাগ স্টেশনের উত্তরে সিগন্যাল পোস্টের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তখন বেলা আনুমানিক আড়াইটা। রেলওয়ে ট্রলিকে মাঝখানে রেখে রেল লাইনের দু’পাশ দিয়ে পাক সেনারা পায়ে হেঁটে অগ্রসর হচ্ছিল এবং রেল লাইন ছাড়াও পশ্চিম দিকের কসবা-সালদা নদী ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা ধরেও বেশ কিছু পাকসেনা এগিয়ে আসছিল।
মানচিত্র লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন রেলওয়ে ট্রলি যখন ফাঁদ এলাকায় প্রবেশ করে তখন সুবেদার ওহাবের ফায়ারের সাথে সাথে তাঁর দল লক্ষ্যবস্তুর উপর আঘাত হানে। আচমকা এই আক্রমণে রেলওয়ে ট্রলি দাঁড়িয়ে যায় এবং অধিকাংশ পাক-সেনা যদিও হকচকিয়ে যায় কিন্তু পর মুহূর্তে উঁচু রেল লাইনের পশ্চিমদিকের আড় গ্রহণ করে মুক্তিবাহিনীর গুলিবর্ষণ করে পশ্চাদপসারণ করতে থাকে। কিছুক্ষণ গুলিবর্ষণের পর সুবেদার ওহাব সিপাই হেফজু মিয়া ও অপর একজনকে ট্রলিটি ট্রেনে স্টেশনের দিকে নেওয়ার জন্য আদেশ দেন। তারা ক্রলিং করে ট্রলির কাছে গিয়ে রেল লাইনের অপর পাশে দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে কিন্তু লক্ষ্যে না পৌঁছানোয় বিস্ফোরিত হওয়া সত্ত্বেও সেগুলি শত্রুর কার্যকরী ক্ষতি করতে পারেনি। যখন ট্রলিটিকে টেনে আনার চেষ্টা করছিল তখন সিপাহী নসু মিয়ার ফায়ারে হঠাৎ করে ট্রলির অভ্যন্তরের গোলাবারুদ আগুন ধরে সে গুলি সশব্দে বিস্ফোরিত হতে শুরু করে এবং ট্রলিতে আগুন ধরে যায়। গোলাবারুদের কিছু বাক্স ট্রলি থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। সুবেদার ওহাব তৎক্ষণাৎ তাদেরকে ট্রলির কাছ থেকে সরে আসতে নির্দেশ দেন।
মুক্তিবাহিনী ছিটকে পড়া বেশ কিছু গোলাবারুদ সংগ্রহ করে।
সুবেদার ওহার তাঁর দল নিয়ে সেখান থেকে ক্যাম্পে প্রত্যাবর্তন করেন। এই দলের সাথে যারা এ্যামবুশে অংশ নেয় তাদের কয়েকজনের নাম : নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিয়া, হাবিলদার মোসলেম, নায়েক তোফাজ্জল হোসেন পাটোয়ারী, সিপাহী হেফজু মিয়া, সিপাহী গোলাম রহমান, সিপাহী কালাম এবং নায়েক সোবহান।
এই অভিযানের পরদিন সকালে সুবেদার ওহাব পুনরায় উক্ত স্থানে গিয়ে ট্রলিটি জ্বলন্ত অবস্থায় দেখতে পান। তিনি স্থানীয় লোকের সাহায্যে ট্রলি থেকে কিছু সামগ্রী উদ্ধারের চেষ্টা করেন। সেখান থেকে প্রচুর আটা ও চাল গ্রামবাসীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। ট্যাংক বিধ্বংসী রাইফেল, মর্টার ইত্যাদি অস্ত্রের গোলাবারুদ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায় এবং অনেক টেলিফোন ও বেতার যন্ত্র পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এই অভিযানের ফলে কসবা ও সালদা নদী সংযোগকারী রেলওয়ে লাইন শত্রুর ব্যবহারের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
এই অভিযানে মুক্তিবাহিনীর সাফল্য পাকসেনাদের এত বেশি ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায় যে, তারা পরবর্তী কয়েকদিন প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে ঐ এলাকায় নির্বিচারে নিরীহ গ্রামবাসীদের হত্যা করে। জনাব আবদুল মালেক (হেড মাস্টার, বায়েক হাইস্কুল)-এর বক্তব্য অনুযায়ী ট্রলি ধ্বংস হওয়ার পর পর পাক সেনাবাহিনী বায়েক গ্রামের ৪৭ জনকে হত্যা করে। এদের মধ্যে ঐ গ্রামের একজন অশীতিপর বৃদ্ধ তমিজ উদ্দিন সর্দারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী যারা এখনো জীবিত আছেন—(ক) মোঃ কেরামত আলী; পিতা মৃতঃ মনসুর আলী, বায়েক, কসবা; (খ) আবুল হাশেম; পিতা : মিন্নত আলী, কলতা দিঘীর পাড়; (গ) আবুল করিম; পিতাঃ আসমত আলী; বায়েক, কসবা; (ঘ) আবদুস সোবহান; পিতা : দিল্লর আলী, বায়েক, কসবা; (ঙ) মোহাম্মদ আলী; পিতা : আসমত আলী, বায়েক কসবা। এ ছিল অত্যন্ত তাড়াহুড়ায় নির্মিত ফাঁদ যা সহজ পরিকল্পনায় ও অল্প প্রস্তুতিতে কার্যকর করা হয়েছিল। এ অভিযানের বিশেষ দিকগুলো হলো : (ক) ফাঁদ দলের অত্যন্ত ত্বড়িৎ গমনাগম এবং শত্রুর রেলওয়ে ট্রলি সম্পর্কে খবর পাওয়ার পর দ্রুত অবস্থানে নিয়ে বাড়তি সময় লাভ করে লক্ষ্যবস্তুকে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তাদেরকে ফাঁদের মধ্যে পাওয়া। যুদ্ধের ময়দানে সময়ের সদ্ব্যবহার করাই প্রত্যেক সেনানায়কের জন্য হয় অগ্নিপরীক্ষা এবং যিনি ঐ পরীক্ষায় সফল হন তিনিই যুদ্ধের গতিকে নিজের আয়ত্ত্বে আনতে সক্ষম হন। সুবেদার ওহাবের কৃতিত্বই সেখানে। (খ) শত্রুকে সঠিক সময়ে গুলিবর্ষণ করে তাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলার মাধ্যমে সারপ্রাইজ অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল। (গ) অধিকসংখ্যক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের কার্যকরী গোলাবর্ষণ দ্বারা শত্রুর জনশক্তির প্রাধান্য বিশেষভাবে হ্রাস করা সম্ভব হয়েছিল। এতে প্রমাণিত হয় যে, কো-অর্ডিনেটেড বা সমন্বিত ফায়ার দিয়ে নিজস্ব জনশক্তির স্বল্পতাও পুষিয়ে নেয়া যায়। (ঘ) এ্যামবুশ দল বেসামরিক পোশাক পরিধান করার ফলে এবং এলাকা ও প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়াতে দিবালোকেও তারা শত্রুর নজর এড়াতে সক্ষম হয়। (ঙ) শত্রুর দিক থেকে বলা যায় যে, তারা যদি হতবুদ্ধি না হয়ে এ্যামবুশকারীদলের উপর সরাসরি চার্জ করে বের হয়ে যেত তবে সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হতো। কেননা এই ধরনের এ্যামবুশে সেটাই বেশি প্রয়োজন। এতে তাদের হয়তো কিছুটা ক্ষয়ক্ষতি হতো কিন্তু তারা এ্যামবুশকারী দলের উদ্দেশ্য বানচাল করে দিতে পারত। এমনকি সমস্ত দলকে উল্টো ধ্বংস করে দিতে পারত।
কিন্তু গেরিলা আক্রমণের কাছে নিয়মিত বাহিনীর দ্বিধান্বিত হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।

শালগড় অভিযান
মুক্তিযুদ্ধে চরম আকার ধারণ করার পূর্বে এপ্রিল মাসের শেষ দিকে কিংবা মে মাসের শুরুতে ৪ ইস্ট বেঙ্গল-এর ৭ নম্বর প্লাটুন কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের উপর বড় শালগড় এলাকায় কুমিল্লায় দিক থেকে আগত প্রায় ২৫/২৮টি গাড়ির একটি কনভয়ের উপর এ্যামবুশ করে। উক্ত সংখ্যার তুলনায় এ্যামবুশ দলের সংখ্যা নিতান্ত কম (২২/২৪ জন) থাকলেও তারা উক্ত কনভয়ের উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন করতে সমর্থ হয়। এই অভিযানের ফলে শত্রুর আওতাধীন এলাকার মধ্যে নিজস্ব প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়।
যোগাযোগের জন্য পাকবাহিনী কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সি এন্ড বি সড়ক নিয়মিত ব্যবহার করত; তা সুবেদার ওহাব জানতে পারেন। তিনি এই সড়কের উপর শত্রুর ফাঁদ পাতার সুযোগ গ্রহণ করেন। সেই অনুযায়ী ১টি মেশিন গান, ১টি ব্লিন্ডিসাইড ও বেশ কয়েকটি লাইট মেশিন গান নিয়ে তাঁর প্লাটুন সীমান্তের ওপারে দেবীপুর থেকে মন্দভাগ হয়ে কয়েমপুরের দক্ষিণ দিক দিয়ে চন্দলা গ্রামে বিকাল চারটার দিকে উপস্থিত হন। সেদিন সেখানে বাজার ছিল বলে তারা লোকজনের দৃষ্টি এড়ানোর জন্য গ্রামের দক্ষিণ-পূর্বকোণে পুকুরের ধরে ঝাড় জঙ্গলে অবস্থান নেন। স্থানীয় মেম্বর পরে তাঁদেরকে স্কুলে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সেখানে অবস্থান করা তাদের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক ছিল বলে স্থানীয় কয়েকব্যক্তির পরামর্শ অনুযায়ী উক্ত প্লাটুন খুব ভোরে দু’মাইল পশ্চিমে সিদলাই গ্রামে চাঁদ মিয়া মেম্বরের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সকালে সুবেদার ওহাব সাধারণ বেশ পরে সেখান থেকে শালগড় এলাকায় সি এন্ড বি সড়ক রেকি (বর্ষবেক্ষণ) করার সময় উক্ত পথে দু একটি আর্মির গাড়ি চলাচল দেখতে পান। তিনি রাস্তার অতি নিকটে গিয়ে ফাঁদের স্থান নির্বাচন করেন। ঐ এলাকার জনসাধারণ মুক্তিবাহিনীর প্রতি তেমন সহযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ করতেন না, তাই নিজের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সুবেদার ওহাব রাস্তা ও গ্রাম এড়িয়ে ফাঁকা জায়গা দিয়ে চলাচল করেন।
দুপুরে খাওয়ার পর জনৈক ফকিরের নিকট সংবাদ পাওয়া যায় যে, ঐদিন রাত্রে সি এন্ড বি সড়কে পাকবাহিনী কারফিউ ঘোষণা করেছে। এতে সুবেদার ওহাব অনুধাবন করেন যে, ঐদিন রাতে ঐ সড়ক পাক সেনারা চলাচলের জন্য ব্যবহার করবে। সুতরাং তিনি সেই রাতেই সি এন্ড বি সড়কে ফাঁদ পাতার সিদ্ধান্ত নেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী প্লাটুন সিদলাই গ্রামে অপ্রয়োজনীয় এবং ভারী জিনিসপত্র ৪ জনের তত্ত্বাবধানে রেখে রাতের অন্ধকারে বড় শালগড় এলাকায় সি এন্ড বি সড়কের পাশে ফাঁদ স্থাপন করে (চিত্রে দেখুন)। সুবেদার ওহাব তাঁর দলকে এক সারিতে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত করে অবস্থান বসান। তিনি এল এম জি নিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে তৃতীয় বৈদ্যুতিক স্তম্ভের নিকটে (আলু ক্ষেত) ছিলেন এবং তাঁর কাছাকাছি নায়েক তোফাজ্জল হোসেন সর্বউত্তরে অবস্থান নেয়। জায়গা দেখানো ও ব্রিফিংয়ের পর দলকে মোতায়েন না করে প্লাটুন অধিনায়ক সকলকে এক সাথে রাখেন। শত্রুর আগমনের দিক জানা ছিল না এং দলের সদস্যরা তাদের অবস্থানে ঘুমিয়ে পড়তে পারে কিংবা একা থাকলে দুঃশ্চিন্তা ও মানসিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে পারে এ কথা চিন্তা করেই সকলকে একত্রে রাখা হয়। রাত আনুমানিক ১২টায় দক্ষিণ দিক থেকে অনেক গাড়ির আলো দেখা যায়। সঙ্গে সঙ্গে সুবেদার ওহাব সতর্ক করেন এবং প্রত্যেককে নির্দিষ্ট স্থানে পাঠিয়ে দেন।
শত্রুর অধিকাংশ গাড়ি যখন ফাঁদ এলাকায় প্রবেশ করে তখন এ্যামবুশ দল গুলিবর্ষণ শুরু করে। কিন্তু বেবিটেক্সি মনে করে নায়েক তোফাজ্জল প্রথম গাড়িতে ফায়ার করেনি বলে সেটা কিছুটা আগে চলে যায়। প্রায় ৪ মিনিট এ্যামবুশ দল শত্রুর উপর অবিরাম গুলিবর্ষণ করে। সুবেদার ওহাব তাঁর দলের গুলিবর্ষণ বন্ধ করে সকলকে স্থান ত্যাগ করতে বলেন সিগন্যাল পিস্তলে ফায়ার করে। এই সময় দুইজনকে কভারিং ফায়ার দিতে বলা হয় এবং তারা কম্যান্ডারের সাথেই সেখান থেকে পশ্চাদপসারণ করে।
এ্যামবুশ স্থল থেকে সৈয়দপুর স্কুলের ১ জন ছাড়া বাকি সকলেই সময়মত উপস্থিত হয়। সে পথ ভুলে গিয়েছিল এবং ভয়ে তার এল এম জি ঝোঁপের মধ্যে ফেলে আসে। পরে সে সরাসরি সিদলাইতে গিয়ে দলের সাথে মিলিত হয়।
সিদলাইতে চা-নাস্তা খাওয়ার পর উক্ত দল যখন চান্দলা হয়ে মন্দভাগের কাছে ক্যাম্পে ফেরে তখন পূর্বাকাশ ধীরে ধীরে ফর্সা হতে শুরু করেছে।

শালগড় এলাকার নকশা :
এই অভিযানে শত্রুর দুটি গাড়িতে আগুন ধরে যায় এবং সুবেদার ওহাবের মতে, ১৮টি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার মধ্যে ১০টি গাড়ির বেশি ক্ষতিসাধন হয়। এতে কতজন পাকসেনা হতাহত হয় তা জানা যায়নি। তবে উঁচু রাস্তার পশ্চিম পাড়ে আশ্রয় নিয়ে তাদের অনেকেই গুলির আঘাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সমর্থ হয়।
বড় শালগড় (নোহাটি) গ্রামের নসু মিঞা, বসু মিঞা, যোগেশ চন্দ্র সুত্রধর, ওদুদ মিঞা এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী। একটি গাড়ির ধ্বংসাবশেষ এখনও নালার পানির ভিতর আছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির পরিমাণ অনেক ছিল বলে সকালে গাড়ি চলাচলে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
মাত্র বিশ জনের একটি ক্ষুদ্র দলের এ্যামবুশের ফলে শত্রুর উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধিত হয়। এ অভিযানের বিশেষ দিকগুলো হলো : ফাঁদ দল তাদের যাতায়াত নিরাপত্তা এবং পাকবাহিনীর সহযোগিতাকারী স্থানীয় লোকজন কর্তৃক চিহ্নিত না হবার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। লোকজনের সন্দেহ এড়ানোর জন্য তারা তাদের অস্ত্রসমূহ থলিতে বহন করেছিলেন। কম্যান্ডার সঠিকভাবে শত্রু কনভয়ে চলাচল অনুমান করতে পেরেছিলেন কিন্তু এ ধরনের অনুমানের উপর ভিত্তি করে কার্যক্রম গ্রহণ অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। এখানে সুবেদার ওহাব অনুমানের সঙ্গে বাস্তব অবস্থার সমন্বয় সাধন করেন।
এ্যামবুশের সময় বিভিন্ন দল নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে শত্রুর জন্য প্রতীক্ষা করবে, কিন্তু সুবেদার ওহাব তাঁর দলের প্রশিক্ষণ ও মনোবল যাচাই করে শত্রু দেখার আগে পর্যন্ত তাঁর দলকে একত্রিত রেখেছিলেন। এটা প্রচলিত শিক্ষার ব্যতিক্রম হলেও দলের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য তাঁর সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয়। যার ফলে সৈনিকরা সম্ভবতঃ গুলিবর্ষণ করেও সংঘবদ্ধভাবে পশ্চাদপসারণ করতে সক্ষম হয়েছিল। লক্ষণীয় বিষয় যে, কভারিং ফায়ার দেওয়ার জন্য যাকে একাকী এবং একটু দুরে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সে তার এল এম জি ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য দলকে আগে থেকে একাকী দূরে দূরে পাঠিয়ে দিলে হয়ত তারাও মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে এমনি করে পালিয়ে যেত এবং গোটা এ্যামবুশ অপারেশন শুরু করার আগেই শেষ হয়ে যেত। একজন সামরিক দলের অধিনায়ককে তাঁর সৈনিকদের এই ধরনের আচরণ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকা দূরদর্শিতার পরিচায়ক। আর এটা মনে রাখা প্রয়োজন, এ যুদ্ধ হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে।

ঝিকরা অভিযান
এটি সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে পরিচালিত আর একটি উল্লেখযোগ্য এ্যামবুশ। জুলাই মাসের ১০ তারিখে কসবা থানাধীন ঝিকরা গ্রামের নিকট এই অভিযান চালানো হয়। এই অভিযানে প্রায় ১২ জন আরোহীসহ (এর মধ্যে সম্ভবতঃ ৮ জন অফিসার) পাক বাহিনীর ১টি স্পীড বোট সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। সহজ পরিকল্পনা, নিজেদের মধ্যে সমঝোতা এবং উদ্দেশ্য কার্যকর করার মনোবল থাকলে দিনের বেলাতেও যে এ্যামবুশ করে শত্রুকে ধ্বংস করা সম্ভব এটা তারই একটা জ্বলন্ত উদাহরণ।
৭১-এর মে জুন মাসে পাক সেনারা কসবা থানার সালদা নদী, মন্দভাগ বাজার, কামালপুর ইত্যাদি এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করে। এই সব এলাকায় যোগাযোগের জন্য কুমিল্লা থেকে সি এন্ড বি সড়ক যোগে তারা কালামুড়িয়া ব্রীজ পর্যন্ত আসার পর সেখান থেকে উল্লিখিত স্থানসমূহে রসদ, গোলাবারুদ ও সেনাবাহিনী পাঠানোর জন্য নদীপথ ব্যবহার করত।
সালদা নদী পথে শত্রুর চলাচল সম্বন্ধে সুবেদার ওহাব অবগত ছিলেন। কোনাবনে অবস্থানরত তাঁর প্লাটুন নিয়ে এই পথে শত্রুর উপর এ্যামবুশ করার জন্য তিনি কোম্পানী অধিনায়কের অনুমতি গ্রহণ করেন। সেই অনুযায়ী তিনি ৩০/৩৫ জনের একটি দল প্রস্তুত করেন যার সহ অধিনায়ক ছিলেন নায়েক সুবেদার মঙ্গল মিঞা। ভারী অস্ত্রের মধ্যে ছিল ১টি মেশিন গান, ৭/৮টি লাইট মেশিন গান।
অভিযানের দিন অতি প্রত্যুষে সুবেদার ওহাব তাঁর প্লাটুন নিয়ে কোনাবন শিবির ত্যাগ করেন এবং কালতাদিঘীর পাড় ও নেপতার হাট হয়ে সকাল নয়টায় তিনি মইনপুর গ্রামের পশ্চিম দিকে উপস্থিত হন। সেখানে পৌঁছে তারা দেখতে পান যে, ১টি স্পীড বোট ও ৬/৭টি নৌকায় প্রায় ১০০ জন পাকসেনা নদীর উভয় তীরে পায়ে হাঁটা প্রহরা-দলসহ সালদা নদী দিয়ে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সুবেদার ওহাব অনুমান করেন যে, শত্রু ঐদিনই একই পথে প্রত্যাবর্তন করবে এবং তখনই তাকে আঘাত হানার জন্য তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাঁর দলকে মইনপুর গ্রামে রেখে শত্রু চলে যাওয়ার পর সুবেদার ওহাব একা নদীর পাড়ে গিয়ে এ্যামবুশের স্থান নির্বাচন করেন।

ঝিকরা এলাকার নকশা :

ঐ এলাকার বিভিন্ন স্থানে পাক বাহিনী প্রতিরক্ষা অবস্থানে থাকায় তাঁর দলের উপর আক্রমণের আশংকা করে সুবেদার ওহাব মইনপুর গ্রামের উত্তরে অবস্থিত কামালপুর গ্রাম থেকে প্রায় এক হাজার গজ পূর্বে বিনি নদীর পশ্চিম পাড়ে খালের উপর ব্রীজে ১টি মেশিন গান (হাবিলদার মুসলিমের দায়িত্বে), মইনপুর গ্রামের উত্তর-পশ্চিমে গোবিন্দপুরের দিকে মুখ করে আরো ১টি লাইট মেশিন গান মোতায়েন করেন।
ফাঁদ পাতার জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের পর বেলা ১২টার দিকে প্লাটুনকে নির্ধারিত স্থানে মোতায়েন করা হয় (চিত্রে দেখুন)। সুবেদার ওহাব ১টি এল এম জি সহ ৫/৬ জনকে নিয়ে নদীর পূর্ব পাড়ে একটি বটগাছের পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন। নায়েক সুবেদার মঙ্গল মিঞা ৩/৪টি এল এম জি ও ৬ জনকে নিয়ে নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থান নেন। অপর একটি দলকে এল এম জিসহ বটগাছের ঠিক উত্তরে ২৫/৩০ গজের মধ্যেই মোতায়েন করা হয়। সিপাই শামসু ও তাঁর সঙ্গে আর একজনকে বটগাছের দক্ষিণে নদীর বাঁকে রাখা হয় পূর্ব সংকেত দেয়া এবং প্রয়োজনবোধে শত্রুকে গুলি করার জন্য। ঐ এলাকায় পানির উপর বেড়ে ওঠা ৩/৪ হাত লম্বা ধান ও ছন জাতীয় গাছ থাকায় তারা দিনের বেলায় শত্রুর দৃষ্টি থেকে নিজেদের আড়াল করে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
দুপুর দুটার দিকে শত্রুর স্পীড বোটটিকে দলের অন্যান্যদের থেকে অনেক আগে বেশ দ্রুত ফিরে আসতে দেখা যায়। যখন ফাঁদ দলের আওতার মধ্যে পৌঁছে যায় তখন সুবেদার ওহাব তাঁর এল এম জি দিয়ে স্পীড বোটের উপর গুলি শুরু করেন এবং পরিকল্পনা মাফিক দলের অন্যান্য সদস্যরা স্পীড বোটের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। এই সময় স্পীড বোট থেকে সুবেদার ওহাবের দূরত্ব ছিল মাত্র ২৫/৩০ গজ। আচমকা এই গুলিবর্ষণে আক্রান্ত হওয়ার জন্য শত্রু মোটেই প্রস্তুত ছিল না, ফলে আত্মরক্ষার কোনো সুযোগই তারা পায়নি। এত নিকট থেকে ফায়ার করার ফলে স্পীড বোটটি ঝাঁঝরা হয়ে যায় এবং এর সকল আরোহীই নিহত হয়।
স্পীড বোটের আরোহীর মধ্যে সম্ভবতঃ ছিল পাকবাহিনীর ২ জন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, ২ জন মেজর, ৪ জন ক্যাপ্টেন (এদের মধ্যে ১ জন ছিল বাঙালী মেডিক্যাল অফিসার) এবং ৩৩ বেলুচ রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর। দুই জন লেফটেন্যান্ট কর্নেলের মধ্যে ১ জন ছিলেন ৩৩ বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাজহারুল কাইয়ুম। এই দলে নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল কুখ্যাত ক্যাপ্টেন বোখারী যার অত্যাচারে কুমিল্লা শহরে ত্রাস ও আতংকের সৃষ্টি হয়েছিল। অভিযানকারী দল স্পীড বোট থেকে ১টি এম জি ১ এ ৩, ১টি এস এম জি, গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন ম্যাপ এবং বেতার যন্ত্র উদ্ধার করে।
এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন আবদুল জলিল; পিতা : আবদুল গফুর, মইনপুর, কসবা।
সাত নম্বর প্লাটুন কর্তৃক সম্পাদিত এ্যামবুশসমূহের মধ্যে এটা ছিল সবচেয়ে সফল অভিযান। এতে আনুমানিক ১২ জন নিহত হয় যার মধ্যে ৮ জনই অফিসার ছিল বলে ধারণা করা হয়। এই অভিযানে প্রমাণিত হয় যে, দিবা-ফাঁদও সফল হতে পারে যদি তাঁর পরিকল্পনা সহজ হয় এবং দলের সদস্যবৃন্দ লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকে। তাছাড়াও এই সাফল্যের উল্লেখ্য দিক হলো : পূর্বাহ্নেই রেকি করে স্থানটি অতি সতর্কতার সাথে নির্বাচন করা হয়েছিলো। ফাঁদটি এমন জায়গায় কার্যকরী করা হয়েছিলো যেখানে শত্রুর যাতায়াত ছিল এবং কাছাকাছি বেশ কিছু শত্রুঅধ্যূষিত এলাকা থাকলেও ফাঁদদলকে রক্ষা/নিরাপদ রাখার জন্যে কমান্ডার সঠিকভাবেই তিনটি স্থানে বহিরাগত শত্রুদলের উপর নজর রাখা বা বাঁধা প্রদানের জন্য নিরাপত্তা প্রহরী দল নিয়োগ করেন। সালদা নদীর অপর পাড়ে নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিঞার অধীনে একটি অবস্থান ছিলো যেটা পরিহার করা যেতো। যদি এ্যামবুশটি অসফল হতো তবে উক্ত স্থান থেকে আসা এবং প্রধান দলের সাথে মিলিত হওয়া সম্ভব হতো না। তাছাড়া স্পীড বোট পূর্বের মত নদীর উভয় তীর দিয়ে টহল দল কর্তৃক অনুসরণ করা হয়নি। এ্যামবুশ কমান্ডার স্বীকার করেছেন যে, স্পীড বোটটি যদি টহল/প্রহরীসহ আসতো তবে তাঁর দলেও হতাহত হতো। যদিও তাঁর দলের অনেকেই কম্যান্ডারকে উদ্দেশ্য ত্যাগ করতে বলেছিলো; কিন্তু তিনি তাদের কথায় কর্ণপাত না করে অভিযান কার্যকরী করতে অবিচল ছিলেন যা অধিনায়োকোচিত গুণ।
লক্ষ্যবস্তুর আবির্ভূত হলে এ্যামবুশদল অত্যন্ত দক্ষতার সাথে স্বল্পতম দূরত্ব থেকে অধিকসংখ্যক অস্ত্র দ্বারা কার্যকরী ফায়ার শুরু করেছিলো। প্রচলিত প্রশিক্ষণে লক্ষ্যবস্তুর উপর ঘনীভূত ফায়ার এবং মৃত্যু এলাকা অভ্যন্তরে এলে শত্রুর উপর গুলিবর্ষণ করার যে শিক্ষা—সুবেদার ওহাবের দল এই অভিযানে তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করেছেন।

দেউশ-মন্দভাগ বাজার অভিযান
মন্দভাগ বাজারে পশ্চিমে দেউশ এলাকায় পাকসেনাদের একটি নৌকা বহরের উপর এই অভিযান পরিচালিত হয়। ঐ এলাকায় রাতের অন্ধকারে ৭ নম্বর প্লাটুনের প্রতিরক্ষা অবস্থানে পাকসেনারা নৌকাসহ প্রবেশ করলে মুক্তিবাহিনী প্রচন্ড আঘাত হানে। ঐ এলাকায় অভিযানগুলির মধ্যে দেউশ-মন্দভাগ বাজার অভিযানে সর্বোচ্চ সংখ্যক পাকসেনা নিহত ও আহত হয়। একটি প্লাটুনের জন্য এই অভিযান ছিল বিরাট সাফল্য। অফিসারসহ এই অভিযানে পাকসেনাদের কমপক্ষে ৫০ জন নিহত এবং আরো বেশি আহত হয়। এর গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিলো প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণকারী মুক্তিসেনাদের সতর্কতা নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সর্বোপরি শত্রুর আক্রমণের বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় ও সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরোধ।
আগস্ট মাসের প্রথম দিকে সালদা নদীতে প্রথম আক্রমণের সময় ৭ নম্বর প্লাটুনকে চোব্বাইশ-ছোট নাগাইস এলাকায় প্রতিরোধ ভূমিকা পালনের দায়িত্ব দেয়া হয়। ঐ আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার পর উক্ত প্লাটুনকে দেউশ-মন্দভাগ বাজার এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থানে নিয়োজিত নায়েব সুবেদার বেলায়েতের নেতৃত্বাধীন ১০ নম্বর প্লাটুনকে বদলী করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। মন্দভাগ বাজারে দু’দিন বিশ্রামের পর সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে ৭ নম্বর প্লাটুন সেখান থেকে সালদা নদী এলাকায় গমন করে। সন্ধ্যার পর পরই দায়িত্ব গ্রহণ শেষ হয় এবং ১০ নম্বর প্লাটুন সেখান থেকে সালদা নদী এলাকায় গমন করে। মন্দভাগ বাজারকে তল (depth) হিসাবে রেখে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে চান্দলা খাল এবং উত্তর পশ্চিম দিকে সালদা নদী কভার করার ফলে প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিলো মোটামুটিভাবে আদর্শ। সুবেদার ওহাবের জনশক্তি ছিলো প্রায় ৬০ জন, সহ অধিনায়ক নায়েব সুবেদার মঙ্গল মিঞা এবং ভারী অস্ত্রের মধ্যে ছিলো ২টি এম জি, ৭/৮টি এল এম জি ও ১টি ৬০ মিলিমিটার মর্টার।

দেউশ-মন্দভাগ বাজার এলাকার নকশা :

কসবা-সালদা নদী রেলওয়ে লাইনের প্রচুর ক্ষতিসাধিত হওয়ার ফলে তা পাকসেনাদের ব্যবহারের জন্য অযোগ্য হয়ে পড়ে। এ সময় বর্ষাকাল থাকায় চারিদিক পানিতে নিমজ্জিত ছিলো। ফলে সালদা নদীর সাথে যোগাযোগ রক্ষায় পাক বাহিনীকে কুটি থেকে সালদা নদী পথ অথবা চান্দলা খাল ব্যবহার করতে হতো। এই সকল পথে প্রায়ই রসদ ও যুদ্ধ সরঞ্জাম বহনকারী নৌকায় পাকসেনারা সালদা নদীতে যাতায়াত করত। ৭ নম্বর প্লাটুনের দায়িত্ব ছিলো মন্দভাগ বাজার হয়ে সালদা নদী যাতায়াতকারী শত্রুর যেকোন দলকে প্রতিহত করা।
ঐ দিন চান্দলা খাল দিয়ে ৩৩ বেলুচ রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানী রাতের অন্ধকারে সালদা নদী অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে।
সুবেদার ওহাবের প্রতিরক্ষা ছিলো নিম্নরূপ (ছবি দেখুন)
এম জি (ক) চান্দলা খালের দক্ষিণ পাড়ে আবু মিঞার বাড়ির পাশে। (খ) এটির অবস্থান চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।
এল এম জি (ক) মসজিদের পাশে। (খ) ২ নম্বর পুকুরের নিকট। (গ) ১ নম্বর পুকুরের পাড়ে। (ঘ) স্কুলের পাশে। (ঙ) খালের দক্ষিণ পাড়ে।
ভোর ৪টার দিকে শত্রুর অগ্রসরমান নৌবহরের শব্দ চান্দলা খালে মাছ ধরায় নিয়োজিত জনৈক আবু মিঞা প্রথম শুনতে পায়। তার সন্দেহ হওয়াতে সে তাঁর বাড়ির নিকটবর্তী এম জি পোস্টে খবর দেয়। কিন্তু উক্ত এম জি পোস্টে কোন প্রতিক্রিয়া হওয়ার পূর্বেই প্রথম নৌকা প্রতিরক্ষা অবস্থানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ঠিক এ সময় মসজিদের পাশের এল এম জি পোস্টের নায়েক আতাউর রহমান (প্রাক্তন এন সি ও ১ ই বেঙ্গল) নৌকাকে থামার আদেশ দেয়। তখন শত্রু সেখানে মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি টের পায় এবং নায়েক আতাউর রহমানকে নৌকা থেকে উর্দূতে গালিগালাজ করে। এতে নায়েক আতাউর পাকসেনাদলের উপস্থিতি সম্বন্ধে নিশ্চিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে তার এল এম জি দিয়ে গুলিবর্ষণ করে। এতে সমগ্র প্রতিরক্ষা সচকিত হয়ে উঠে এবং নৌকার উপর গুলি বর্ষণ শুরু করে।
এ সময় সুবেদার ওহাব তাঁর প্লাটুন নিয়ে সদর দফতর মন্দভাগ বাজারে অবস্থান করছিলেন। তিনি সম্মুখে এসে যথা সম্ভব ফায়ার নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং প্রথমে মসজিদের এল এম জি পোস্ট ও পরে আবু মিঞার ঘরের পশ্চিম দিকের এম জি পোস্ট থেকে শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। শত্রুর ৭/৮টি নৌকা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং উক্ত পাকসেনা দলের অধিকাংশই নিহত বা আহত হয়।
সূর্য ওঠার পর সকালে সুবেদার ওহাব তাঁর দলের কিছু সদস্য নিয়ে নৌকা এবং খাল থেকে ১৫/২০টি লাশ উদ্ধার এবং স্থানীয় দু’একজন লোকের সহায়তায় (দেউশ গ্রামের মহব্বত আলী পাকসেনাদের লাশ দেখেছে এবং ১২টি লাশ কোনাবন পর্যন্ত বহন করেছে বলে জানায়) বেশ কিছু লাশ কোনাবন কোম্পানী সদরে পাঠানো হয়।
ভোর রাতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর সকালের দিকে (বেলা ৯/১০টা) বেশ কিছুসংখ্যক পাকসেনা সংগঠিত হয়ে এবং নতুন শক্তি নিয়ে পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে অগ্রসর হতে শুরু করে। এ সময় সুবেদার ওহাব এম জি পোস্ট এবং দলের অন্যান্য সদস্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে অত্যন্ত কার্যকরীভাবে শত্রুর উপর গুলিবর্ষণ করলে অনেকেই নিহত এবং আহত হয়। কিলিং জোনের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর সমন্বিত গুলিবর্ষণের ফলে পাকসেনাদের প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। এবং তারা অগ্রসর হওয়ার বাসনা ত্যাগ করে। কিন্তু সম্মুখ সমরে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করার পর দুপুর প্রায় একটার দিকে শত্রু দেউশ প্রতিরক্ষার উপর প্রচন্ড বিমান হামলা শুরু করে। বিমান আক্রমণে ৪টি বিমান অংশ নিয়ে পর্যায়ক্রমে দুদিক থেকে গুলিবর্ষণ করে। সৌভাগ্যক্রমে সুবেদার ওহাবের প্লাটুন বিস্তৃত হয়ে নিকটস্থ গ্রাম ও গাছপালার আড়ালে আশ্রয় নেওয়ায় কেউ হতাহত হয়নি। তবে এই বিমান হামলায় দু’জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয় বলে নয়নপুর গ্রামের শাহ এমরান গাজী জানান।
বিমান হামলার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে সুবেদার ওহাব তাঁর অপারেটর হাবিলদার মোসলেমের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে হামলা চলাকালীন এবং তারপরে প্রায় ১ ঘন্টা কোম্পানী দফতরে যোগাযোগ করতে সক্ষম হননি। এদিকে কোন যোগাযোগ না হওয়ায় কোনাবনে অবস্থিত ক্যাম্পের সকলে চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং নায়েক সুবেদার শহীদকে ৩/৪ জনসহ সংবাদ জানার জন্য পাঠানো হয়। নায়েক সুবেদার শহীদ দেউশে পৌঁছে সুবেদার ওহাবের দলকে নিরাপদ অবস্থায় দেখতে পান এবং কোম্পানী সদরে সংবাদ জানানো হয়।
এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী : (ক) সিদ্দিকুর রহমান ভূঁইয়া; পিতা : মৃত আসমত আলী, দেউশ, কসবা। (খ) আবদুল গফুর; দেউশ, কসবা। এরা দুজন ভোর রাতে পাকসেনাদের উপর গুলিবর্ষণের পর তাঁরা মসজিদে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
এই অভিযানে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে রাতের অন্ধকারে অপ্রস্তুত অবস্থায় ঢুকে পড়া শত্রুকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। এর উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হচ্ছে : স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসমূহ মোটামুটি আদর্শ স্থানে স্থাপনের ফলে একটা শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র স্থাপনের নীতিসমূহ যুদ্ধের সময় মেনে চলার জন্য সামরিক প্রশিক্ষণে সব সময় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। দেউশ মন্দভাগ বাজার অভিযানে দেখা গেছে যে, সব স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ফিল্ড অব ফায়ার, পারস্পরিক সহযোগিতা, কনসিলমেন্ট ইত্যাদি থাকার ফলে উক্ত প্লাটুন তাদের অবস্থান থেকে শক্তিশালী ও অত্যন্ত কার্যকরী গুলিজাল সৃষ্টি করেছিলো তা ভেদ করা শত্রুর পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব হয়নি, বরং তাদেরকে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। প্রতিরক্ষা অবস্থানে শত্রুর আগমন সম্বন্ধে জানার জন্য (Continious Alertness) অবিরাম সতর্কতা অবলম্বনে এবং কোন কিছু দেখা কিংবা শোনার জন্য সজাগ দৃষ্টি রাখা একান্ত প্রয়োজন। এই অভিযানে দেখা গেছে যে, খালের প্রথম এম জি পোস্ট অতিক্রম করে এল এম জি পোস্টের নিকট শত্রুর নৌকা পৌঁছার পর তাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়। এতে করে একদিক দিয়ে শত্রুকে নাগালের মধ্যে পাওয়া সম্ভব হলেও এটা বিপদজ্জনক ছিলো।
প্রথম দিকে সমস্ত প্লাটুন একযোগে ফায়ার শুরু করে। সুবেদার ওহাব সামনে এসে ফায়ার নিয়ন্ত্রণে আনেন। অনিয়ন্ত্রিত ফায়ার শুধু গুলির অপচয় করে, কার্যকর ফল আনতে পারে না।
বিমান হামলার সময় সুবেদার ওহাবের প্লাটুন ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাছপালার আড়ালে আশ্রয় নেওয়ার ফলে তাদের কোন ক্ষতিসাধিত হয়নি।
বিমান হামলা শুরু হওয়ার ঠিক পূব মূহূর্তে সুবেদার ওহাবের সিগন্যাল অপারেটর তাঁর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ফলে অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাঁর পক্ষে যোগাযোগ করা সম্ভবপর হয়নি।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1982.12.17-bichitra.pdf” title=”1982.12.17 bichitra”]