You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্বাধীনতার শত্রুদের রুখে দাঁড়ান | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৭ মার্চ ১৯৮১ 

১৯৭১ থেকে ১৯৮১। স্বাধীনতা লাভের একটি দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। ৭১ এর ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষিত হয়েছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা। একদিকে প্রবল প্রতিপক্ষ—পাকিস্তানের বিশাল সেনাবাহিনী এবং পাকিস্তানী ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী তাদের এদেশীয় রাজনৈতিক মিত্ররা, অপরদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী সাড়ে সাত কোটি মানুষ। পাক হানাদার বাহিনীর দোসর সামান্য সংখ্যক সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ব্যক্তি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাদে বাংলাদেশের সকল মানুষই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। স্বাধীনতার এদেশীয় শত্রুরা সংখ্যায় নগণ্য হলেও তাদের পেছনে ছিলো এক বিশাল সেনাবাহিনী, এই বাহিনীর প্রভু পাকিস্তানী শাসক সম্প্রদায় এবং এই শাসক সম্প্রদায়ের প্রভু আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ।
স্বাধীনতার শত্রুরা তখন লড়াইয়ের মাঠে নেমেছিলো ধর্মের লেবাস পরে, ধর্মের জিগির তুলে। অতীতে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক সরকার যে কোন ধরনের আন্দোলন দমন করেছে ’৭১ সালে ‘ইসলাম’ অর্থাৎ পাকিস্তানকে রক্ষার জন্যে তিরিশ লক্ষ মানুষকে গুলি করে, জবাই করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে এবং আরো জঘন্য পন্থায় হত্যা করেছে এবং কয়েক লক্ষ নারীর সম্ভ্রম হরণ করেছে। অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়েছে অজস্র মানুষের ওপর, ঘরছাড়া দেশছাড়া করেছে লক্ষ-লক্ষ পরিবারকে। সবই করেছে তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে।
৭১ এর ২৬ মার্চ যে যুদ্ধের সূচনা হয়েছিলো শেষ হয়েছে প্রায় নয় মাস পরে ১৬ ডিসম্বরে। যুদ্ধ শেষ হলেও স্বাধীনতার শত্রুরা শেষ হয়নি। যারা জেলে ছিলো তারা ‘জাতির পিতা’র বদান্যতায় মুক্তি পেলো এবং সংগঠিত হতে লাগলো। ৭৫ এর ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের সুযোগে তারা আবার আসর জাঁকিয়ে বসলো।
আবার শুরু হয়েছিলো সিরাত সম্মেলন, ইসলামী জলসা প্রভৃতির নাম। প্রাজ্ঞ জননেতা মওলানা ভাসানী তখনই দেশবাসীকে সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনরাবির্ভাব সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন। বেঁচে থাকলে হয়তো মওলানা ভাসানী রাজনৈতিকভাবে এদের মোকাবেলা করতে পারতেন। মওলানা ভাসানীর মৃত্যু এদেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যে শূন্যতার সৃষ্টি করেছে সেটা আজও পূরণ হয়নি। ফলে সাম্প্রদায়িক শক্তি, ৭১ এর সেই মুখচেনা ঘাতকের দল আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। শান দিচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার ছুরিতে যে ছুরি দিয়ে ৭১ সালে নির্বিচারে জবাই করেছিলো এদেশের ধর্মভীরু নিরীহ মানুষদের।
ছুরিতে শান দিতে দিতে উপলক্ষ খুঁজছে ৭১-এর অভিশপ্ত খানে দজ্জালরা। ঘটনা ঘটবার অপেক্ষায় তারা বসে থাকছে না, ঘটনা সৃষ্টি করতেও চাইছে তারা। সিলেটে, রংপুরে এ ধরনের দুটো ঘটনা ঘটে গেছে। একটা কিছু ঘটাবার জন্যেই তারা ৭১-এ হানাদার বাহিনীর প্রধান রাজনৈতিক দোসর গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব প্রদানের দাবি জানিয়েছে।
দেশের যে সকল রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রে বিশ্বাসী তারা নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংকটে এতো বেশি নিমজ্জিত যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাদের পক্ষে সক্রিয়ভাবে কোন আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাছেও এটা কোন সমস্যা নয় তারা ভিন্ন দেশের মাটিতে বসে ভিন্নপন্থায় ক্ষমতা দখলের স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়ে আছেন। এমন একটি সংকটজনক পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ স্বাধীনতার শত্রু এই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়ে একটি অত্যন্ত সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা রাজাকার-আলবদর প্রতিরোধ সপ্তাহের কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন। (মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংবাদিক সম্মেলনের বিবরণ ‘এ সপ্তাহ’ দ্রষ্টব্য।) সরকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ‘স্বাধীনতা বিরোধী চক্র রাজাকার, আলবদর প্রধান গোলাম আজম সহ সকল দেশদ্রোহী বেঈমান খুনীদের বিচার দাবি করেছে। এ দাবি আমাদেরও। আমরা এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী সকল মানুষের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি—স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে এখনই রুখে দাঁড়ান।
০০০

নেপোয় মারে দই
মোহাম্মদ আবু জাফর

ছেলেবেলা থেকে আমরা যাতে দড় হই—দেশপতিরা চান। সে-জন্যে বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে নানা বাস্তব শিক্ষার ব্যবস্থা এদেশে। সেগুলোর একটি হলো : খাবারে ভেজাল মেশানোর উপায় ও লাভের পরিমাণ। এই অঙ্কের একমাত্র উত্তর ফাঁসি অথবা কারাবাস। সে-কথা কোন অঙ্ক বই লেখে না বা বলেন না কোন শিক্ষক। বাল্যকালে নানা প্রবাদ-প্রবচনও শেখানো হয়। যেমন : আঙুল ফুলে কলাগাছ, কয়লার ময়লা যায় না ধুলে, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী, চোরে চোরে মাসতুতো ভাই ইত্যাদি ইত্যাদি। কি ভাবে শেখানো হয় বলা কঠিন। তবে সমাজে কলা গাছ, কয়লা, চোরা ও মাসতুতো ভাইয়ের বড়ই প্রাদুর্ভাব। এতেই প্রমাণ, বাল্য-শিক্ষা ব্যর্থ হয় নি। আরও একটি কথা শুনেছি বাল্যাবস্থায় : নেপোয় মারে দই। এর নিহিতার্থ তখন এক রকম বুঝেছিলাম। পরে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি যে, তখন এই নেপো সাহেবকে আদপেই চিনে নিতে পারিনি। আমাদের আশঙ্কা, এদেশের অনেকেই শৈশবে এই নেপো সাহেবকে ঠিক মতো চিনতে পারেননি বলে পড়ে পড়ে আমাদের মতো শুধু ছেঁচাই খাচ্ছেন এর হাতে। সে ছেঁচা সহ্য করা কঠিন, তার হাত ফসকানো কঠিনতর।
এই নেপো সাহেবের প্রসঙ্গেই প্রশ্ন, এ দেশ কার? বার বার উত্তর মেলে : নেপোর। জনতার কাজ গরু পালা, দুধ দোয়া; কিন্তু যেই দই বসলো, ওমনি সেটি মেরে দিলো নেপো। যদি জিজ্ঞেস করা হয় নেপো দেখতে কেমন, কি তার পোষাক, কি তার মতবাদ? তা হলে দেখা যাবে তার বিশেষ কোন চেহারা নেই, যে-কোন পোষাক পরতে তার আপত্তি নেই, পৃথিবীর তাবৎ মতবাদে বিশ্বাস ঘোষণা করতে কোন অপারগতা নেই। মুহূর্তে সে ভোল পাল্টায়, পাল্টায় বোল। কিন্তু একটি ব্যাপারে সে আদি অকৃত্রিম : জনতার দই মারতে ওস্তাদ সে।
মোটা দাগে কয়েকটা মেসাল দেয়া যেতে পারে। ভারত ভাগ করেছিল এ উপমহাদেশের সামন্ত ও উঠতি বুর্জোয়ারা নিজেদের সুবিধের জন্যে। ইচ্ছে মতো দরিদ্র জনসাধারণকে দলাই মালাই করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সে-সময় নেপোরা হাওয়া বুঝে বাতাসে কথা ছাড়লো : তারা মহা ইসলাম প্রেমিক; ইসলামের তরক্কির জন্যে পাকিস্তান বানাতে হবে। এবং সেই পাকিস্তানে গরীব মুসলমানরা মহা সুখে থাকবে। সে সময়কার ‘মহান নেতা’ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়তেন না এবং সেই ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বহু মন্ত্রী মদও ছাড়েননি। অথচ ইসলামের জন্যে কাঁদতে কাঁদতে পেরেশান হয়ে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জান ও মাল দুটোই ধ্বংস ও চুরি করতেও পিছপা হয়নি তারা। চোখের সামনে কলেমা তৈয়ব-পাঠকারী হাজার হাজার বাঙালী মুসলমানকে গুলি, জবাই ও ধর্ষণ করতে কসুর করেনি তখনকার নেপো সাহেবরা।
নেপোরা এত রেগে গেল কেন? বাড়া ভাতে ছাই পড়েছিল বলে। পাকিস্তানের সামন্তরা, বুর্জোয়া, সামরিক ও সরকারী আমলারা তোফা আরামে মেরে যাচ্ছিল বাংলাদেশের দই। সে পথে সামান্য কাঁটা পড়তেই নেপোদের ধর্মের লেবাস খসে পড়ে; বেরিয়ে পড়ে মধ্যযুগের বর্বরের দাঁতাল চেহারা ও পিশাচের আচরণ। সরল মানুষের রক্ত আর ইজ্জত না খাওয়া পর্যন্ত এবং পিটুনি খেয়ে পিঠটান দিতে বাধ্য না হওয়া পর্যন্ত তারা সেদিন ক্ষান্ত হয়নি। পাকিস্তানী নেপোরা এখন দই মারছে তাদের নিজেদের ডেরায়। সেখানেও দই মারা বেশি দিন চলবে বলে মনে হয় না। তবু আপাততঃ চালিয়ে যাচ্ছে।
কিংবা ধরুন আমাদের ভাষা আন্দোলনের কথা। কারাবাস, গুলি, হত্যা কোন কিছুতেই বাঙালী বাঁধা মানেনি। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আদায় করে ছাড়লো। তখন নেপোরা হাওয়া বুঝে সব বাংলা-ভাষা প্রেমী হয়ে গেল। ভাষাপ্রেম কাকে বলে দেখাতে শুরু করলো। বাংলাদেশের সবুজ ঘাসে শুয়ে স্বপ্ন দেখতে লাগলো মরুভূমির। ভাষা আন্দোলনে আমরাও ছিলাম। আমরাও কম করিনি। যখন ছেলেদের গুলি করা হচ্ছিল তখন আমরা কি করছিলাম জানেন? বরকত, রফিকের মৃত্যুতে শোকের মুহ্যমান হয়ে বুঝলেন কিনা, বড় দুঃখে পোলাও-কোর্মা খাচ্ছিলাম। অন্য দিনের তুলনায়, বুঝলেন কিনা, একটু বেশিই খেয়েছিলাম। কারণ, দুঃখটাও বড় বেশি হয়ে গিয়েছিল কিনা! এই নেপোদের ভাষা প্রেমের ঠেলায় আমরা সেদিন সম্মুখীন হয়েছিলাম এমন সব অবাঙালী শব্দের যার নাম আমরা ইহ-জীবনে শুনিনি, অর্থ উদ্ধার তো দূরের কথা। বাংলা ভাষার দই মারার সে কি হুল্লোড় নেপোদের! প্রবন্ধে, কবিতায়, গানে সে কি প্রেমের বন্যা! তার পাশে কোথায় লাগে ভাষা আন্দোলনের নায়করা, গায়করা, কবিরা! লজ্জায় তাদের মুখ লুকোবার অবস্থা।
অথবা চুয়ান্নো সালের নির্বাচনের কথাই ভাবুন। অত্যাচারিত, শোষিত বাঙালীরা মরিয়া হয়ে এমন ক্ষিপ্ত হলেন যে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হোল। নাকে খত দিয়ে এক দল নেপো দৌড় দিলো পশ্চিমের দিকে, নতুন মতলব হাসিলের আশায়। আর একদল নেপো গাল ভরা সব প্রতিজ্ঞার ঢোল বাজাতে থাকলো এ দেশে বসেই। মোটা ভাত মোটা কাপড়ের স্বপ্ন দুলতে থাকলো অন্নহীন বস্ত্রহীন বাঙালীদের মাথার ওপর। কিছুই হোল না। হোল কিছু লোকের লাইসেন্স-পারমিট, বাড়ি গাড়ি; আর হোল বন্যা ও দুর্ভিক্ষ। গুলি, জেল, জরিমানা। পাকিস্তানের সব টাকা পাহাড় হয়ে জমতে থাকলো বাইশ পরিবারের হাতে।
তখন এদেশের মানুষ হিসেব করে দেখলো যে দেশের দুই অংশের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট অর্থনৈতিক বৈষম্য। পূর্ব বাংলার আয় করা বৈদেশিক মুদ্রা সব পাচার করা হয়েছে পশ্চিমে; সেখানে গড়ে উঠেছে কল-কারখানা, সেখানে জিনিসপত্র সস্তা, চাকরি-বাকরি সব তাদের হাতে, অস্ত্র তাদের হাতে, ব্যবসা তাদের হাতে; এখানে পড়ে আছে সব ছিবড়ে, রসহীন সব ছিবড়ে। বাংলাদেশের সর্বত্র প্রতিবাদ উঠলো এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তখন এক নেপো-সর্দার হাঁকার দিয়ে পড়লো মুক্তকচ্ছ হয়ে। বললো, দুই প্রদেশের মধ্যেকার অর্থনৈতিক বৈষম্যের দফা-রফা না করে ছাড়ছি না আমি। স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল সাহেব স্বরচিত শাসনতন্ত্রের মধ্যেই ঢুকিয়ে নিলো অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রশ্নটি। এবং এমন দক্ষতার সঙ্গে প্রশ্নটির দফাগয়া করা হোল যে, বাঙালীরা রক্ত বিসর্জন দিয়ে বলতে বাধ্য হলেন যে, ভিক্ষের দরকার নেই, কুকুরের হাত থেকে বাঁচাও। দেখা গেল, নেপোরা দিব্বি দই মেরে বসে আছে। বৈষম্য আরও বেড়েছে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যতত্ত্বের (ডিসপ্যারিটি) একজন প্রবক্তাই ভিড়ে গেছেন ফিল্ড মার্শাল দলে! আর জনগণ আরও দরিদ্র আরও দুর্বল হয়ে খাবি খাচ্ছে! ভূমিহীনের সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে ভূড়ির সংখ্যা; আর বেড়েছে নেপোদের ডুগডুগির সংখ্যা।
এরপরই শুরু হয় নাটকের আর একটি অঙ্ক। হঠাৎ করে মার্শাল সাহেবকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গদিতে জাবড়ে বসে গেল এক বেহেড মাতাল জেনারেল। প্রতিটি ক্ষমতা জবরদখলকারী সামরিক কর্মকর্তার মতো সেও ঘোষণা করলো, জনগণের দাবিতে বাধ্য হয়ে গদিতে, নিতান্ত ইচ্ছাশূন্যতা চিত্তে থাকা সত্ত্বেও, একটু বসতে হয়েছে; একান্ত ইচ্ছা, অচিরে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে জয়ী গণপ্রতিনিধিদের হাতে তুলে দিয়ে আমি আমার পুরনো ডেরায় ফিরে যাবো। ইতিহাস লেখে না, সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে কেউ সেখানে ফিরে গেছে। কিন্তু সেদিন অনেকেই খোয়াব দেখেছিলেন যে, উক্ত মাতাল জেনারেল ব্যারাকে ফিরে যাবে। সে সময় হাওয়া ছিল নির্বাচনের, গণতন্ত্রের। নেপোরা সেই হাওয়াই ধরে বসলো। সারাদেশে তারা নির্বাচনের এমন হুজুগ তুলে দিলো যে, জনগণ ভাবলো এই নির্বাচনই হবে বেহেশত পাওয়ার সোজা পথ। শায়েস্তা খানের দরে মিলবে চাল, মিলবে ডাল, মিলবে কাপড়। আর চিন্তা কি? কিন্তু সত্তরের নির্বাচনের পথে চালের বদলে এলো বুলেট। কোন কিছু বোঝার আগেই এদেশের কোটি কোটি মুসলমানদের সব কাফের ঘোষণা করা হোল। লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে পশ্চিমী নেপোরা সারাদেশ লুট করে জাহাজ বোঝাই নিয়ে গেল মালমাত্তা, সোনা দানা। মাতাল নেপো সেনানিবাসে না ফিরে জেলখানায়, আর তার প্রিয় সহযোগী, স্বঘোষিত হ্যামলেট বেঘোরে মরলো কারাকক্ষে।
এরপর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হোল। রাতারাতি বাংলাদেশের প্রতি প্রেমের জোয়ার বইতে লাগলো। মৌলিক গণতন্ত্রের পক্ষে লিখে হাত পাকিয়েছেন যে সব লেখক তারা পর্যন্ত বাংলাদেশ বলতে অজ্ঞান হতে শুরু করলেন। রবীন্দ্রনাথকে হত্যার পক্ষে বিবৃতিদানকারী জনৈক মহাপন্ডিত হঠাৎ করে রবীন্দ্রনাথকেই বন্দনা করে বেধড়ক প্রবন্ধাদি লিখতে শুরু করলেন। এমনকি তাঁর শান্তিনিকেতনকে নিয়ে এমন প্রচন্ড প্রেম প্রকাশ করতে থাকলেন যে ১৯৬৭ সালের রবীন্দ্রভক্তরা পর্যন্ত লজ্জা পেয়ে গেলেন। তাঁদের তখন ‘ছেড়ে দেমা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা! প্রেমের সেই সর্বগ্রাসী টানে একজন গানই লিখে বসলেন ‘জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ।’ বাংলাদেশ আমাদের জন্যে সঞ্জীবনী সুধা—এটা বুঝি; কিন্তু বাংলাদেশ আমাদের মৃত্যু—এটার তাৎপর্য আজ পর্যন্ত আমাদের মতো অজ্ঞ আম-পাবলিক বুঝতে সমর্থ হয়নি। এই পংক্তির প্রথম অংশ শুনে হৃদয় হয়তো নাচে, কিন্তু তার শেষ অংশ শুনে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুক-ওয়ালার সমস্ত কাঠামো কাঁপে। আঁতুড় ঘরেই মুখে নুন তুলে দেয়ার ব্যবস্থাই যেন ধ্বনিত হয় গানটির প্রতিটি ধাক্কায়। সেই অসহায় ব্যাঙের মতোই মন আমাদের হাহাকার করে : ভায়া হে, তোমার কাছে যা নাচন, আমার কাছে তা মরণ!
অন্য ক্ষেত্রেও আবির্ভাব ঘটলো নেপোদের। লাইসেন্স-পারমিট, গাড়ি বাড়ি। পুরনো মদ নতুন বোতলে। নবীন উঠতি বুর্জোয়ারা ঘোষণা করলো, যুদ্ধটুদ্ধ করে বড় ক্লান্ত, বড় ক্ষুধার্ত। তাই বছর তিনেক আর তোমাদের কিছু দিতে পারবো না। আপাততঃ সব পান্তা ভাতই আমরা গুড় দিয়ে খাবো। সেই তিন বছরের মাথায় জনগণ উপহার পেলো দুর্ভিক্ষ, হত্যা ও হাহাকার। আর নেপোরা ভাসতে থাকলো দধি ও মধুতে আট আনায় এক সের চাল দেয়ার প্রতিজ্ঞা ট্রতিজ্ঞা সব গেল উড়ে। সেই সঙ্গে উড়ে গেল জনগণও।
সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হোল, একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের নেপোরা দাবি করে বসলো যে, শুধু তাদের আন্দোলনে ও যুদ্ধে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের পঁচিশ বছরের সংগ্রাম ও রক্তদান, বিভিন্ন প্রগতিবাদী রাজনৈতিক দলের, আন্দোলন ও সংগ্রাম, সবার আগে মাওলানা ভাসানীর পাকিস্তানকে আসসালামে আলাইকুম জানানো, পল্টন ময়দানে আইয়ুব আমলেই ছাত্রনেতাদের প্রায়-স্বাধীনতা ঘোষণা, ১৯৬৯ সালের গণউত্থানে হাজার হাজার মানুষের আত্মদান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রনেতাদের স্বাধীনতার পতাকা তোলা, ১৯৭১ সালে লক্ষ লক্ষ সাধারণ নর-নারীর প্রাণ ও ইজ্জত বিসর্জন, লক্ষ লক্ষ তরুণের দলমত নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও প্রাণ দান এবং সর্বোপরি দেশের ভেতরে বাইরে কোটি কোটি মানুষের দুর্দশা ভোগ ও মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাদান-সবই মিথ্যা হয়ে গেল। সত্য হোল শুধু একটি দল। ১৯৭২ সালে প্রার্থিত সকল দল সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠিত হোল না। সমস্ত দেশ সম্পত্তি হোল একটি দলের। ফলে যা স্বাভাবিক তাই ঘটলো। দলটি ও দলটির নেতা ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল সাধারণ মানুষের হৃদয় থেকে। কেননা, পেট খালি হয়ে গেলে মনও খালি হয়ে যায়। অন্ন প্রেমের চেয়ে আর কোন প্রেম বড়? সে-কথা যে শাসক বোঝে না, জনগণ তাকে শেষ পর্যন্ত ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তার মৃত্যুতে কেউ কাঁদে না। এ সত্য বার বার এসেছে চোখের সামনে। কিন্তু যার চোখে বাঁধা ঠুলি সে তা বুঝবে কি করে? আর এই ঠুলি সুযোগ পেয়ে নেপোরা এমন কষে রাজার চোখে বেঁধে দেয় যে, বাবাজী যে দু’চোখ মেলে বাস্তব পৃথিবীটা দেখবেন সে উপায় আর থাকে না। তিনি থাকেন ঘোরের মধ্যে, তাই বেঘোরে তাঁর মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়ে।
দুঃখের বিষয় অনেক মুক্তিযোদ্ধাই ভেবে বসলেন যে, শুধু তাঁরাই দেশের জন্যে যুদ্ধ করেছেন। যাঁরা দেশের ভিতরে ছিলেন তাঁরা কিছুই করেননি। এ কথা সঙ্গত যে, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্যে কিছু লোকের দেশত্যাগের প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ চালানো, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালানো ও সর্বোপরি যুদ্ধ চালানোর জন্যে দেশের বাইরে থাকার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। যাঁরা সে কাজ করেছিলেন তাঁরা অবশ্যই শ্রদ্ধাই। কিন্তু সবাই তো যুদ্ধ করার জন্যে ওপারে যাননি। অনেকের ক্ষেত্রেই ওটি ছিল পলায়ন মাত্র। অনেকের ক্ষেত্রেই আকস্মিকতাই ছিল মানদন্ড। আকস্মিকতার কারণেই একজন ভারতে যাননি, আর একজন গেছেন। সেই সঙ্গে এটি ছিল সুযোগেরও ব্যাপার। সুযোগ হয়েছিল, গেছেন, সুযোগ হয়নি, যাননি। কোন পক্ষের ক্ষেত্রে দেশপ্রেমের ঘাটতি ছিল—এমন বলার কোন অবকাশ ছিল না।
অথচ সেভাবেই দাঁড় করানো হোল সমগ্র ব্যাপারটিকে। মুজিব নগর থেকে ফেরা অনেকেই দেশে থেকে যাওয়া সাড়ে ছয় কোটি লোককে বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করলেন। পারমিট ও চাকরি সব তাঁদেরই হয়ে দাঁড়ালো প্রায়। বীরত্বের জন্যে অবশ্যই পুরস্কার প্রাপ্য ছিল; কিন্তু সেটি নগদ বিদায়ে পরিণত হোল তখনই উপ্ত হোল বিভেদের বীজ। প্রতিটি অফিসে, প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে এভাবে মানুষ দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। এ যদি কোন যথার্থ বিপ্লবী দল কর্তৃক ক্ষমতা দখলের ব্যাপার হোত তা-হলে হয়তো এমন পরিস্থিতির উদ্ভবই হোত না। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো একটি উঠতি বুর্জোয়া-পাতি বুর্জোয়াদের দলের পক্ষে সবটুকু নিজের কোলে টেনে নিতে গিয়েই দেখা দিল বিপত্তি। দেশের জন্যে যুদ্ধ করার জন্যে সম্মান প্রদর্শনের ব্যবস্থা না করে বেপরোয়া পদোন্নতি ও অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ দানের পদ্ধতি যার মাথা থেকেই আসুক না কেন চিন্তাটি খুব সুস্থ ও মঙ্গলদায়ক ছিল না। এর মধ্যে বিভক্তির যে বীজ ছিল তা দিনে দিনে মহীরূহে পরিণত হয়েছে। এরই সঙ্গে মিশেছে বাংলাদেশ বিরোধীদের হাজারো অপচেষ্টা। প্রতিটি ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের ধ্বংস করার জন্যে তারা তাদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এরই ফলে, আজ প্রায় সর্বত্র মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিকূলতা, বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার শিকার। যথার্থ মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই নাম তালিকাভুক্ত করতেও ভয় পাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গেই প্রশ্ন ওঠে, যারা চিন্তায় বাংলাদেশ-বিরোধী ছিল তাদের সবাইকে ক্ষমতা থেকে না সরালেও যারা সক্রিয়ভাবে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী ছিল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোল না কেন? বলা বাহুল্য এখানেও সেই নেপোদের ভূমিকা। কে সত্যিকারের দালাল তা খতিয়ে দেখার সময় তাদের ছিল না। নেপোদের শত্রু মাত্রই দালাল; সুতরাং জেলখানায় ঢোকাতে হবে। আর নেপোদের মিত্র হলেই সাত খুন মাফ; সুতরাং তাদের জেলখানা থেকে বার করতে হবে। ফলে খাঁটি খুনী খালাস পেলো, আর খাঁটি মানুষ হওয়ার অপরাধে অনেককে ঢুকতে হোল জেলে। তাই ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দালালীর অভিযোগে জেলে নিয়ে যাওয়া তেত্রিশ হাজার বন্দীকে যখন খালাস করার আদেশ দেন তখন দেখা গেল বহু প্রগতিবাদী দেশপ্রেমিকের বন্দীদশা ঘোচেনি। প্রধানমন্ত্রী সে সময় সকল দালালকে মনোযোগ দিয়ে দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাদের অনেকেই যে ‘দেশের কাজে’ যথাযথভাবে আত্মনিয়োগ করেছে তা বাংলাদেশপন্থীরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। নেপোদের ভাগ্য এমনই যে, দুদিকেই সুবিধে। দালাল হিসেবে আটকালেও দু’পয়সা আসে, ছাড়লেও দু’পয়সা আসে।
এইসব যখন চলছিল তখন নেপোদের চোখে পড়লো এক ফ্যাঁকড়া। বাংলাদেশের জন্যে সংগ্রামের সময় বাংলাদেশের সংবিধান বানানোর কালে সমাজতন্ত্রকে ঘোষণা করা হয় এক মূলনীতি বলে। গণতন্ত্রের কথাও ছিল। তবে তার তো হিল্লে করাই হোল এক দল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এখন শুধু সমাজতন্ত্রের হিল্লে করা। জনগণের সামনে সমাজতন্ত্র মানে মোটা ভাত মোটা কাপড়। তারা বড় আশা করে ছিলো। জমি পাবে, বাড়ি পাবে, কাপড় পাবে, ভাত পাবে। নেপোরা ঠিক করলো জনগণকে এমনভাবে সমাজতন্ত্র খাওয়াবে যে, তাদের চৌদ্দ পুরুষ যেন আর তার নামও মুখে না আনে। শুরু হয়ে গেল তেলেসমাতি! ‘সমাজতান্ত্রিক’ উপায়ে বহু কল কারখানা জাতীয়করণ করা হোল; তারপর ‘সমাজতান্ত্রিক’ উপায়েই সেই সব কল-কারখানা নেপোদের কাছে পানির দরে বিক্রি হতে থাকলো। অত্যন্ত ‘সমাজতান্ত্রিক’ পদ্ধতিতে কল-কারখানার নাট বল্টু পর্যন্ত সের দরে বিকোতে লাগলো খোলা বাজারে। নেপো-প্রশাসকরা কোম্পানীর মাল দরিয়ায় ঢালতে লাগলেন। তাঁরা প্রতিজ্ঞানুসারে লোকসানের বিশ্ব-রেকর্ড স্থাপনে আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হলেন। এবং শোনা যায় তাঁরা কামিয়াব হয়েছিলেন। বস্তুত, নেপোরা কাজে কর্মে ও শব্দে দিন রাত এমনভাবে সমাজতন্ত্র দেখাতে ও শোনাতে লাগলেন যে জনগণ সমাজতন্ত্রের চোটে আধ মরা হয়ে গেল। এখন তারা অনেকেই ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি শুনলেই চমকে ওঠে, অনেকের গায়ে জ্বর এসে যায়। ১৯৭৫ পূর্ব নেপোরা বাংলাদেশ থেকে সমাজতন্ত্র শব্দটি উৎখাতের জন্যে বড় কম সফল প্রচেষ্টা চালায়নি!
ইদানিং সবাই পেড়ে ফেলেছেন বিপ্লব বেচারাকে। ডাইনে বাঁয়ে, সামনে পেছনে, ঘরে বাইরে শুধু বিপ্লবের মহাধ্বনি। এ পর্যন্ত জেনে এসেছি, সমাজ কাঠামোর পুরো খোল-নলচে বদলেই বিপ্লব ঘটাতে হয়। এখন দেখানো হচ্ছে, সবকিছু ঠিকঠাক রেখে শুধু বিপ্লবের বুলি ছেড়ে দিয়ে, বিপ্লবের গ্রাস ছেড়ে দিয়ে তা নাকি সম্ভব! দেখা যাচ্ছে ইতিহাস মিথ্যা, মার্কস, লেনিন, মাও সে তুং কোন কাজের নয়, তাদের কথার কোন অনিবার্যতা নেই। বাংলাদেশের খালে বিলে বিপ্লব গড়াগড়ি খাচ্ছে। কত কুড়াবি কুড়ো!—এমনই একটি আহ্বান সর্বত্র। সমাজতন্ত্রের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই এই বিপ্লবের ধাক্কা।
নেপো-সংবাদের এখানেই শেষ নয়। সম্প্রতি অনেক রাজাকার আলবদর নিজেদের বাংলাদেশপ্রেমী ঘোষণা দিয়ে বসে আছে। এর কারণ কি একটাই কারণ—এখন দেখা যাচ্ছে এ দেশটাকে পাকিস্তান বলে আর চালানো যাবে না। জনগণ বাংলাদেশ হিসেবে মানে দেশটিকে। সুতরাং সেখানে কুঠারাঘাত করা মানে নিজের পায়েই তা ঝেড়ে দেয়া। সুতরাং সেটা মুখে স্বীকার করে নিয়ে যদি কিছু বানানো যায় তবে সেটাই বেহতর। ফলে সেই একই নেপো বাবাজীরা চট চট করে বাংলাদেশের সৃষ্টিতত্বে চলে গেল। অনেকেই দাবী করে বসলো যে, বাংলাদেশ সৃষ্টিতে তাদের হাত আছে। এই নেপোদের যুক্তিগুলো এ রকম :
ক) মোনেম খাঁ যদি বাঙালীদের কষে পিটুনি না লাগাতো তাহলে তারা কি এত চটে যেতো পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে? আর পাকিস্তানীদের প্রতি রাগ না হলে তো বাংলাদেশ হতোই না। সুতরাং মোনেম খাঁ আসলে একজন মুক্তিযোদ্ধা।
খ) (ক)-তে বর্ণিত যুক্তি অনুযায়ী রাজকার, আলবদর, আল শামস-এর সদস্যরাও মুক্তিযোদ্ধা।
গ) কোন কোন পাকিস্তানপন্থী কর্তাব্যক্তি ইচ্ছা করলে আরও তীব্রভাবে দালালী করতে পারতেন, তা করেননি। অথবা পাকিস্তানপন্থী হয়েও কেউ কেউ দালালী না করে ঘরে বসে বসে কালিয়া কোপ্তা খেয়েছেন। এটাই কি পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে যথেষ্ট সাহায্য নয়?
ঘ) যুদ্ধকালে সে-রকম কিছু করলে তো ফাঁসি হোত। তা যখন হয়নি তখন খারাপ কিছু করিনি, অর্থাৎ ভালো কিছু করেছি। মুক্তিযুদ্ধকালে ভালো কাজ মানেই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। অতএব আমিও মুক্তিযুদ্ধ করেছি, বাসায় বসে থেকে থেকেই।
এসব দাবি কাটে কার সাধ্য! ফলে উচ্চপদস্থ রাজাকাররা যখন নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করেই বসে তখন আসল মুক্তিযোদ্ধারা আর পালানোর পথ খুঁজে পায় না।
এখানে অপাঙ্গে একটি কথা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। সব রাজাকারই রাজাকার ছিলেন না। কেউ কেউ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদেরই লোক বা তাদের সংবাদদাতা। গাঁ দেশের অনেক সরল বেকার যুবক শুধু চাকুরীর আশায় নিয়েছিলেন সে পেশা, অনেকে হয়েছিলেন ভয়ে। অনেকেরই জানা কথা এ-সব। যারা সজ্ঞানে পাকিস্তান চালু রাখতে ঢুকেছিলো এ-সবের মধ্যে এবং মহাউৎসাহে মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশপন্থী নিধনে তৎপর হয়েছিলো তাদের এখন বাংলাদেশের পক্ষে অশ্রু বিসর্জন অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশপন্থীরই পিলে চমকে দিচ্ছে। কথা তাদের নিয়েই। কারণ তারা শপথ নিয়েছিলো পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের প্রতি অনুগত থাকতে ও প্রাণ দিয়ে পাকিস্তানকে রক্ষা করতে।
অনেকেরই আশঙ্কা বাংলাদেশী সেজে কেউ কেউ সেই শপথ অনুযায়ী কাজ করে চলেছে।
ওদিকে জনগণ কিন্তু মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দুধের যোগান অব্যাহত রেখেছে। তাদের দিন আনা দিন খাওয়া, এবং প্রায়ই না খাওয়া। কোন নেপো গেল আর কোন নেপো এলো এত খোঁজ নেয়ার মতো সময়ও নেই মেহনতী মানুষের। এমনকি সময় যদি থাকেও তাহলে এত সব তলিয়ে বুঝবার মতো জ্ঞানও নেই। আর সেটাই তো একমাত্র ভরসা—কম কম্মে। খাওয়া যাচ্ছে। কাজের মধ্যে কাজ হোল মাঝে মধ্যে বুলি ছাড়া, আর কাঁচা পয়সা কুড়ানো।
নেপো শব্দের উৎপত্তি ‘নৃপ’ থেকে। এখন এর উৎস দাঁড়িয়েছে ‘নে, পোঁ ধর’। বেশি ধরতে ধরতে ‘ধর’ শব্দটি লোপ পেয়েছে। বর্তমানে এরা বাংলাদেশের নামে পোঁ ধরে দই মেরেই যাচ্ছে। এবং এভাবে এরা দই মারতে থাকবে যদ্দিন জনগণ এদের বাধ্য না করে তাদের পা ধরতে।

১ ক। প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর রাজাকাররা যে শপথ-নামায় সই করতো তাতে লেখা থাকতো :
I do solemnly declare that from this moment I shall faithfully follow the injunctions of my religion, and dedicate my life to the service of my society and country. I shall obey and carry out all lawful orders of my superiors. I shall bear true allegience to the constitution of Pakistan as framed by law and shall defend Pakistan, if necessary with my life.

সার্টিফিকেট কপিড ফটো :
[জনৈক রাজাকার স্বাক্ষরিত শপথনামা থেকে। তারিখ ৩১-১০-৭১। সূত্র : Anx `8’, to HQ MLA zone B; Ltr No-1200/3/ML-2 of 02 Oct 71. Schedule B, form of Oath; Rule-16.]

সার্টিফিকেট কপিড ফটো :

খ) এখানে প্রকাশিত রাজাকারদের সার্টিফিকেট দেখা যাচ্ছে :
চ) যশোরের আর্মি ব্যাটল স্কুলে ১৯৭১ সালের ৩রা নভেম্বর থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত একদল রাজাকার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। তাদের মেধার মান নির্ধারণ করা হোত পাঁচটি ভাগে : Outstanding, Above Average; Average; Below Average; fail.
ছ) জনৈক মেজর নজর হোসেন এই আর্মি ব্যাটল স্কুলের কমান্ড্যান্ট ছিল।
এ-সব দেখে বোঝা যায়, বেশ পরিকল্পিতভাবেই দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের খতম করার জন্যে রাজাকারবাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। পাকিস্তানীদের বড় আশা ছিলা তারা কামিয়াব হবে। কিন্তু দেশবাসী ও ন্যায় তাদের বিরুদ্ধে থাকায় তাদের হত্যা, রক্ত, ধর্ষণ, লুন্ঠন ও নিষ্ঠুর অত্যাচার দিয়ে গড়া তাসের প্রাসাদ ন্যায়ের আঘাতে খসে পড়ে।
০০০

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!