You dont have javascript enabled! Please enable it!

পূর্ব বাঙলায় পাকিস্তানী শাসনের প্রথম অধ্যায় | বদরুদ্দীন উমর | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১ আগস্ট ১৯৮০

১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগস্ট বৃটিশ – ভারত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এভাবে দেশ ভাগের সময় বাংলাদেশ ও পাঞ্জাবও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশের পূর্বাংশ ও পাঞ্জাবের পশ্চিমাংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৯৪০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান আন্দোলন পরিচালিত হয় সারা ভারত মুসলিম লীগের নেতৃত্বে। সেজন্য দেশভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রে মুসলিম লীগই ক্ষমতা লাভ করে সরকার গঠন করে।

পাকিস্তান আন্দোলনে মুসলমান কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি জনগণের অপরাপর অংশ ব্যাপকভাবে অংশ গ্রহণ করলেও তার নেতৃত্বে সামন্ত বুর্জোয়া শ্রেণীর, বিশেষতঃ সামন্ত শ্রেণীর হাতেই ছিল। এ কথা কেন্দ্রীয় এবং পশ্চিম পাকিস্তান অঞ্চলের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সত্য। কারণ পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের আঠারো, উনিশ ও বিশ শতকে অনেক কৃষক আন্দোলন, বিশ শতকের তিরিশ, চল্লিশের দশকে শ্রমিক আন্দোলন, মধ্য শ্রেণীর মধ্যে অনেক ধরণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলে এখানে সামন্তবাদী নেতৃত্ব রাজনীতি ক্ষেত্রে তেমন প্রভাবশালী ছিল না। তাই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মূল নেতৃত্বে বাংলাদেশ ছিল বুর্জোয়া – পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে।

পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থা এ দিক দিয়ে ছিল অনেক পৃথক৷ কারণ সেখানে সামন্তবাদী ভূমি ব্যবস্থা বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চল যার অন্তর্গত) তুলনায় অনেক বেশী সুসংগঠিত ও শক্তিশালী ছিলো এবং সেখানে বাংলাদেশের মতো কোন উল্লেখযোগ্য কৃষক আন্দোলনও সংগঠিত হয়নি। এই কারণে মুসলিম লীগের পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃত্ব এবং পূর্ব পাকিস্তানী নেতৃত্বের শ্রেণী চরিত্রের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য পার্থক্য প্রথম থেকেই দেখা যায়। পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃত্ব প্রায় পুরোপুরি সামন্তবাদী বড়ো জমিদার শ্রেণীর দ্বারা গঠিত হলেও পূর্ব পাকিস্তানী নেতৃত্ব গঠিত হয় মধ্য শ্রেণীর দ্বারা। জিন্নাহ নিজে সামন্ত পরিবারের লোক না হলেও তিনি সামন্ত শ্রেণীর নেতৃত্বের উপরই নির্ভরশীল ছিলেন।

এই সবের ফলে পাকিস্তান মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, বিশেষতঃ ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে জিন্নাহর মৃত্যুর পর থেকে, পশ্চিম পাকিস্তানের জমিদার শ্রেণীর উপরই বর্তায়, লিয়াকত আলীর কোন জমিদারী পাকিস্তানে না থাকলেও তিনি ছিলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের এক বড়ো জমিদার পরিবারের লোক। সেই হিসাবে চিন্তা ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃত্বের সাথে তার কোন মৌলিক দ্বন্দ্ব ছিল না।

কিন্তু পাকিস্তানে ক্ষমতার কাঠামো কি ধরণের ছিলো সেটা বোঝার জন্য শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের শ্রেণী চরিত্র দেখলেই বোঝা যাবে না। তার জন্য প্রয়োজন সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী ও শিল্প বুর্জোয়া শ্রেণীর চরিত্র এবং অবস্থান ভালো ভাবে বোঝা।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের উপর প্রথম থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ ছিলো। কারণ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে উচ্চ পর্যায়ের সামরিক অফিসার একজনও ছিল না এবং বাহিনীর প্রায় সমগ্র অংশই গঠিত ছিলো পাঞ্জাবি, পাঠান ও বেলুচদের নিয়ে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র ও প্রায় পুরোপুরি পশ্চিম পাকিস্তানী এবং ভারত থেকে আগত মোহাজেরদের দ্বারা গঠিত ছিলো। সে সময় ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে মাত্র একজনই ছিলেন পূর্ব বাংলার মুসলমান। তাই কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের পুরো আমলাতন্ত্রই গঠিত হয়েছিলো অবাঙ্গালীদের দ্বারা। শুধু তাই নয়, পূর্ব বাংলাতেও প্রাদেশিক সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা তারাই ছিলো। এই অবাঙ্গালী আমলারা প্রথম থেকেই পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও মুসলিম লীগের অন্যান্য নেতাদের থেকেও অনেক বেশী শক্তিশালী ছিলো।

পাকিস্তানের দুউ অংশের মধ্যে প্রায় এক হাজার মাইলের ব্যবধান থাকা এবং কেন্দ্রীয় রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীতে অধিষ্ঠিত হওয়ায় ব্যবসা, শিল্প ইত্যাদির জন্য প্রয়োজনীয় লাইসেন্স পারমিট পাওয়া পশ্চিমাঞ্চলের লোকদের পক্ষে অনেক সুবিধাজনক ছিলো। রাজধানীর এই অবস্থানের জন্য ভারত থেকে যেসব পুঁজি মালিক ও সম্পদশালী ব্যক্তি পাকিস্তানে আসেন, তারাও পশ্চিম পাকিস্তানে, বিশেষতঃ করাচীতে অবস্থান করেন। এ সবের ফলে শিল্প ও ব্যবসা বানিজ্যে পশ্চিম পাকিস্তানেই অধিক প্রসার লাভ করতে থাকে এবং পূর্ব পাকিস্তান এ দিক দিয়ে তুলনামূলক ভাবে ভয়ানক উপেক্ষিত হয়। অপর এক দিক দিয়েও ভৌগোলিক অবস্থান পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে একটা পার্থক্য সৃষ্টি করে। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও পৃষ্ঠপোষকতায় পশ্চিম পাকিস্তানে যে শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে থাকে সেগুলিতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের লোকেরা মজুরী শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত হতে থাকে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা হাজার মাইলের দূরত্ব পার হয়ে সেই সুযোগের কোন ব্যবহার করতে অক্ষম হয়।

সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র, শিল্প ব্যবসায়ী শ্রেণী ইত্যাদির মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাধান্য থাকলেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যদি পূর্ব পাকিস্তানের প্রাধান্য না থাকতো তাহলেও পরিস্থিতির মধ্যে কিছুটা ভারসম্য রক্ষিত হতো। কিন্তু পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের আসল নেতৃত্ব পশ্চিম পাকিস্তানেই ছিলো এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রেও তাই পূর্ব পাকিস্তানের কোন নিয়ন্ত্রণ অথবা উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিলো না। শুধু তাই নয়। তাদের অবস্থান এতোই দূর্বল ছিল যে, ভারত থেকে আগত মুসলিম লীগ নেতাদের অধিকাংশই কেন্দ্রীয় সংবিধান পরিষদে পূর্ব বাংলার সদস্য হিসেবে অর্থাৎ পূর্ব বাংলার নির্দিষ্ট অংশ থেকে নির্বাচিত হন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, মুসলিম লীগ সভাপতি খালেকুজ্জামান প্রভৃতি ছিলেন এই সব কেন্দ্রীয় নেতাদের অন্যতম। বাহ্যতঃ এরা ছিলেন পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি কিন্তু পূর্ব বাংলার স্বার্থের প্রতি তাদের কোন দৃষ্টি ছিলো না। উপরন্তু তারা ছিলেন এই অঞ্চলের জনগণের শত্রু স্থানীয়।

কাজেই সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র, পুঁজি মালিক এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকায় প্রথম থেকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে ভারসাম্যের একটা দারুণ অভাব দেখা দেয় এবং কেন্দ্রীয় সরকার পরিগ্রহ করে আঞ্চলিক চরিত্র। ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশ ধারা এই ভারসাম্যের অভাব ও আঞ্চলিক চরিত্রের দ্বারাই পুরোপুরি ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।

২. পূর্ব উপর শোষণ নির্যাতনের নীতি

যে কোন পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে উপরোক্ত পার্থক্য থাকলে যা হয়, পাকিস্তানের উভয় অংশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ঠিক সে রকমটিই হয়েছিল৷ পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প বিকাশ শুরু হওয়ার সাথে সাথে সেখানে বৈদেশিক মুদ্রার যে প্রয়োজন দেখা দেয় সেটা অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে প্রধানতঃ মেটানো হতে থাকে পূর্ব বাংলার পাট রপ্তানী থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার দ্বারা শুধু তাই নয়। জিন্নাহর জীবিতাবস্থাতেই বিক্রয় কর, যা ইংরেজ আমলে প্রদেশের এখতেয়ার ভুক্ত ছিলো, তা প্রদেশ থেকে কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। এর ফলে বিক্রয় কর থেকে পাওয়া অর্থ পুরোপুরি ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানেই বিনিয়োজিত হয়। আরও নানাভাবে পূর্ব বাংলা থেকে সম্পদ ক্রমাগত পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হতে থাকে। এর ফলে একদিকে যেমন পূর্ব বাংলার উন্নয়ন প্রায় সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয় তেমনি অন্য দিকে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে শুরু হয় এক অসম বিকাশ।

অসম বিকাশের এই নীতি কার্যকর করতে গিয়ে পূর্ব বাংলার উপর নির্যাতন ব্যতীত পাকিস্তান সরকারের অন্য উপায় ছিলো না। এবং পূর্ব বাংলার সরকারী নির্যাতনের মূল হাতিয়ার ছিলো অবাঙালী আমলাতন্ত্র। পূর্ব বাংলার তৎকালীন এই আমলাতন্ত্র অন্য যে কোন দেশের তুলনায় এবং পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত আমলাদের থেকেও অধিক ক্ষমতাশালী ছিলো। কারণ তারা সরকারী নীতি কার্যকর করার ক্ষেত্রে শুধু যে আমলা হিসেবেই নিজেদের দায়িত্ব পালন করতো তাই নয়। রাজনৈতিক কর্তৃত্বও তারা বেশ শক্তিশালী ভাবে ব্যবহার করতো। বস্তুতপক্ষে পূর্ব বাংলার অবস্থা তখন এমন ছিল যে, প্রাদেশিক সরকারের চীফ সেক্রেটারী প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীর উপর পর্যন্ত হুকুমজারি করতে বিশেষ দ্বিধাবোধ করতো না। এ কথা নূরুল আমিনের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, নাজিমুদ্দীনের ক্ষেত্রেও ছিল ঠিক ততখানিই সত্য।

নির্যাতনের নীতি কার্যকর করতে গিয়ে পূর্ব বাংলায় বৃটিশ আমলের বেশ কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক বন্দীকে, যাদের বিপুল অধিকাংশই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, মুক্তি না দিয়ে বিনা বিচারে আটক রাখা হয়। কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম দিকে সরকারের সাথে সীমাবদ্ধ সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করলেও তাদের উপর সরকারী নির্যাতনের মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। কমিউনিস্টদের সভা সমিতির উপর, এমনকি বইয়ের দোকান এবং অফিস ঘরের উপরও সরকারী দল এবং তাদের সমর্থকরা নিয়মিত আক্রমণ চালায়। এই ভাবে কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা না করেও পার্টির সদস্যদের উপর গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করা হয় এবং অনেককে গ্রেফতারও করা হয়। এই উদ্দেশ্যে জননিরাপত্তা আইন জারী করে সরকার বিনা বিচারে আটকের ব্যাপারে নিজের হাতে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে।

কিন্তু শুধু কমিউনিস্ট পার্টিই নয়। সরকারের বিরুদ্ধে এ সময় যারাই কিছুটা সংগঠিত হতে শুরু করে তাদের উপরই নানান সরকারী নিষেধাজ্ঞা ও নির্যাতন শুরু হয়। এইভাবে ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য এলাকা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার উপর হামলা চলে এবং তাদের থেকে বড় অঙ্কের জমানত তলব ও সম্পাদক গ্রেফতার একটা নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়। কলকাতা থেকে সে সময় স্টেটসম্যান, আনন্দবাজার, ইত্তেহাদ ইত্যাদি যেসব দৈনিক সংবাদ পত্র ঢাকায় আসতো সেগুলোর উপরও মাঝে মাঝে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হতো। মাঝে মাঝে পত্রিকার কপি ঢাকা বিমানবন্দর থেকেই সরকার বাজেয়াপ্ত করতো।

শিল্প ও সাংস্কৃতিক জীবনও এই সরকারী নির্যাতনের আওতার বাইরে ছিলো না। এজন্য প্রথম থেকেই তারা পূর্ব বাংলার জনগণের উপর উর্দূকে সরকারী ভাষা হিসেবে চড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে৷ বাংলা ভাষা সংস্কারের নামে অসংখ্য আরবী, ফারসী, তুর্কী শব্দ কৃত্রিমভাবে ঢোকাবার চেষ্টা করে এবং সর্বোপরি বাংলা ভাষার অক্ষর প্রবর্তনের নীতি কার্যকর করার জন্য নানা উদ্যোগ নিতে শুরু করে।

৩. নির্যাতন প্রতিরোধের প্রাথমিক সাংগঠনিক উদ্যোগ

পাকিস্তান আন্দোলনের সময় তৎকালীন বাংলাদেশের মুসলমান কৃষক, শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী যেসব আকাংখার বশবর্তী হয়ে আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন সে আকাংখাগুলি পূর্ণ হওয়ার বিশেষ কোন সম্ভাবনা যে মুসলিম লীগের শাসনাধীন সমাজে নেই, এ কথা তারা বেশ দ্রুতই উপলব্ধি করতে শুরু করেন। কৃষকরা মনে করেছিলেন হিন্দু জমিদার, জোতদার, মহাজনদের হাত থেকে তারা নিষ্কৃতি পাবেন, তাদের জমি হবে, তারা দুই বেলা নিয়মিত আহার জোটাতে পারবেন। তাদের বাসস্থান, চিকিৎসা এবং ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নিশ্চিত হবে। শ্রমিকরা ভেবেছিলেন তাদের কাজের নিশ্চয়তা থাকবে, তারা অন্ততঃ বাঁচার মতো মজূরী তো পাবেনই এমন কি মজুরী তাদের এমন হবে যাতে তারা তাদের জীবনের মান সবদিক দিয়ে যথেষ্ট উন্নত করতে পারবেন। মধ্যবিত্ত লোকেরা বিশেষতঃ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুবকেরা ভেবেছিলেন যে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে তারা মুক্ত হবেন, যোগ্যতা অনুযায়ী তারা কাজ পাবেন, তাদের শিক্ষার মান আরও উন্নত হবে এবং তাদের পক্ষে সম্ভব হবে একটি সুস্থ, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক জীবন গড়ে তোলা। এমন স্বপ্নই জনগণের বিভিন্ন অংশ দেখেছিলেন।

কিন্তু উপরোক্ত কোন আকাংখাই তাদের পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা পাকিস্তানের তৎকালীন ক্ষমতার কাঠামোর মধ্যে ছিলো না। এজন্য অতি শীঘ্রই শুরু হয় তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ। অনেকের মধ্যে এই চেতনা ১৪ ই আগস্টের পূর্বেই দেখা দেয় এবং জুলাই মাসেই তারা গণআজাদী লীগ নামে ঢাকাতে একটি ছোট প্রতিবাদী সংগঠন গঠন করেন। এই সংগঠনের কাজ পরবর্তী সময়ে তেমন উল্লেখযোগ্য না হলেও পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই এই ধরণের উদ্যোগ তৎকালীন পরিস্থিতিতে ছিল যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

সরকারের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিরুদ্ধে প্রথম সত্যিকার সাংগঠনিক উদ্যোগ গৃহীত হয় ৬ ই – ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় একটি যুব সম্মেলনে ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ ‘ নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে ‘যুব ইশতেহার’ নামে একটি ঘোষণা সম্মেলনে গৃহীত হয়। তাতে অন্যান্য অনেক কিছুর মধ্যে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি প্রসঙ্গে বলা হয়ঃ

“নিজের মাতৃভাষায় বিনা খরচে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পাওয়ার মৌলিক অধিকার প্রত্যেক ছেলে মেয়ের রহিয়াছে এবং তাহা তাহাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। জাতীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করিতে হইবে এবং যুবকেরা কার্যে যাহাতে উত্তম সঙ্গীত, নাটক, সাহিত্য ও ছবি উপভোগ করিতে ও বুঝিতে পারে তাহার সুযোগ দিতে হইবে। সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূল্যবোধ বাড়াইবার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য এবং বিশেষ করিয়া গ্রামাঞ্চলে প্রয়োজনীয় সুবিধা দান করিতে হইবে। এই প্রয়োজনে গড়িয়া উঠা যুব কেন্দ্র এবং যুব সংগঠনকে রাষ্ট্রীয় সাহায্য দান করিতে হইবে।…. রাষ্ট্রের অধিনস্থ বিভিন্ন এলাকার পৃথক পৃথক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিকাশকে সরকার স্বীকার করিয়া নিবেন, জীবন ও সংস্কৃতিকে গড়িয়া তুলিতে এইসব এলাকার সকল ব্যাপারে স্বায়ত্তশাসন মানিয়া লইতে হইবে৷

ভাষা বিষয়ে এই সম্মেলনে নিম্নলিখিত প্রস্তাবটি গৃহীত হয়ঃ

” বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আন্দোলনের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তা সম্পর্কে আলাপ আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক। “

এই কর্মী সম্মেলনের পর ২৮ শে ফেব্রুয়ারী থেকে ৬ ই মার্চ, ১৯৪৮ কলকাতায় দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়। তাতে দেশ বিদেশের বহু যুব প্রতিনিধি যোগদান করেন। এই সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুব লীগের প্রতিনিধিরা পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেন।

‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ ছাড়াও এই সময় ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৭ সালের ২ রা সেপ্টেম্বর। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে এই সংগঠনটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

মধ্যশ্রেণী ভুক্ত যুবকদের এই সব সংগঠন ছাড়াও এই সময় শ্রমিকদের কিছু কিছু সংগঠন ছিলো৷ এই সংগঠনগুলির মধ্যে রেল রোড ওয়ার্কাস ইউনিয়নই সে সময় কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সংগঠনটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্কিত। এ ছাড়া রেল কর্মচারী লীগ নামে রেল শ্রমিকদের অপর একটি প্রতিষ্ঠানও ছিল৷ সূতাকল শ্রমিকদের মধ্যে কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন শ্রমিক ইউনিয়ন এ সময়ে বেশ সংগঠিত ছিলো। চা-বাগান শ্রমিক, ডাক ও তার শ্রমিক, ডক শ্রমিক ইত্যাদির মধ্যেও সংগঠন ছিলো। এই সংগঠনগুলিও প্রায় প্রথম থেকেই সরকারের বিভিন্ন নীতি ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করে।

কৃষক সভা নামে কৃষকদের যে সংগঠন ছিলো সেটা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়েছিলো যে, এক পর্যায়ে তার কোন পৃথক সত্ত্বা প্রকৃত পক্ষে ছিলো না। তাই কমিউনিস্ট পার্টির সাথে প্রায় একাকার হয়ে মিশে থাকা অবস্থাতেই এই সংগঠনটি সিলেট, ময়মনসিং, রাজশাহী, যশোর, খুলনা ইত্যাদি জেলায় অল্পবিস্তর সাংগঠনিক কার্যক্রম এ পর্যায়ে চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগস্টের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের মধ্যে ভাঙ্গন দেখা দেয়। যেসব যুবক উৎসাহের সাথে মুসলিম লীগের পক্ষে ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে কাজ করেছিলেন এবং পাকিস্তান আন্দোলনে অন্যান্য প্রকারে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যা তো মুসলিম লীগের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনই, এমন কি যারা বয়স্ক তাদের একটা অংশও প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তৎকালীন নেতৃত্বের সাথে অনেক সাংগঠনিক ও নীতিগত প্রশ্নে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। মুসলিম লীগের এই অংশটি প্রধানতঃ বিভাগ পূর্ব বাংলাদেশে সাংগঠনিক ভাবে আবুল হাসেম – সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তৎকালে এই কর্মীরা মুসলিম লীগের “বামপন্থী ” অংশ হিসেবেই সাধারণ ভাবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৪৭-৪৮ সালে এই গ্রুপের নেতা ছিলেন শামসুল হক, কমরুদ্দিন আহমদ, শেখ মুজিবর রহমান, মুশতাক আহমদ প্রভৃতি।

মুসলিম লীগের এই গ্রুপটি ১৯৪৮ সালের জানুয়ারী মাসে ঢাকা শহরে পুরাতন লীগ কর্মীদের একটি সম্মেলন আহ্বান করেন ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে। এই সম্মেলনকে ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ নামে অভিহিত করা হয়। এই কর্মী সম্মেলনকেই পূর্ব বাংলায় বিরোধী দল গঠনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। যেসব কর্মী “ওয়ার্কার্স ক্যাম্পে” যোগদান করেন, মূলতঃ তারাই পরের বৎসর, ১৯৪৯ সালে গঠন করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ।

৪. ভাষা আন্দোলন

১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এক সাহিত্য সভার পর অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বোধীন তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগেই সর্বপ্রথম ‘রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি কমিটি গঠন হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল হক ভূইয়াঁ এই কমিটির আহবায়ক নির্বাচিত হন। তমদ্দুন মজলিস এর পূর্বে সেপ্টেম্বর মাসে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু ‘ এই নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। ৬ ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে সরকারী ভাষা নীতির প্রতিবাদে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।

২৩ শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৮ তারিখে করাচীতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। ঐ দিনই পূর্ব বাংলার অন্যতম সদস্য ধীরেন দত্ত একটি ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব পরিষদে পেশ করে বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবী উথ্বাপন করেন। প্রস্তাবটি উত্থাপিত হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী, পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন, গঞ্জনফর আলী খান, তমিজুদ্দীন খান প্রভৃতি মুসলিম লীগ নেতারা তার তীব্র বিরোধিতা করেন এবং প্রস্তাবটি নাকচ হয়ে যায়। এ সময় বক্তৃতা প্রসঙ্গে নাজিমুদ্দীন বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীরই এই মনোভাব যে একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।”

নাজিমুদ্দীনের এই উক্তি মুসলিম লীগ সমর্থক ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আকরাম খানের মালিকানাধীন দৈনিক আজাদসহ অপরাপর পত্রিয়ায় কঠোরভাবে সমালোচিত হয় এবং এর প্রতিবাদে ২৬ শে ফেব্রুয়ারী ঢাকার ছাত্র সম্প্রদায় ধর্মঘট পালন করেন। ধর্মঘটের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিকেল কলেজ ও স্কুলের ছাত্ররা মিছিল বের করে বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করে। বিকেলের দিকে একটি সভায় মিলিত হয়ে তারা নাজিমুদ্দীনের বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন ও সরকারী ভাষা নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবী জানান। ভাষা আন্দোলনকে সংগঠিত ভাবে পরিচালনার জন্য এই সভাতেই “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” নামে একটি সর্বদলীয় কমিটি গঠন করা হয় এবং গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমদ্দুন মজলিস, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হল ইত্যাদি ছাত্রাবাস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এর প্রত্যেকটি থেকে দুইজন করে প্রতিনিধি কমিটিতে সদস্য রূপে অন্তর্ভুক্ত হন।

পাকিস্তান গণ পরিষদের সরকারী ভাষার তালিকায় বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত না করার প্রতিবাদে ১২ ই মার্চ সমগ্র পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানিয়ে এই সভায় একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

১১ ই মার্চের ধর্মঘটকে সাফল্যমন্ডিত করার উদ্দেশ্যে ছাত্রেরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভাবে পিকেটিং করেন। ধর্মঘটের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, যশোহর, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম ইত্যাদি পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলা শহর ও অপরাপর এলাকায় ছাত্রছাত্রীরা ব্যাপকভাবে ধর্মঘট, মিছিল ও সভার অনুষ্ঠান করেন। ঐ দিন ঢাকা এবং যশোরে পুলিশের সাথে ছাত্রদের কিছু কিছু সংঘর্ষ ঘটে। ছাত্র যুবকেরা পূর্ব বাংলার অনেক এলাকাতেই ধর্মঘট, মিটিং, মিছিল করতে গিয়ে গ্রেফতার হন।

ধর্মঘট ও সংঘর্ষ চলাকালীন অবস্থায় ১১ ই মার্চ ঢাকাতে যেসব ছাত্র ও যুবক গ্রেফতার হন তাদের মধ্যে শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, শওকত আলী প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।

১১ ই মার্চের ঘটনাবলী সম্পর্কে পূর্ব বাংলা সরকার একটি প্রেসবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন, তাতে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলা হয়, “বাংলাকে কেন্দ্রের সরকারী ভাষা না করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ১১ ই মার্চ আহুত সাধারণ ধর্মঘটকে কার্যকর করবার জন্য আজ ঢাকাতে কিছু সংখ্যক অন্তর্ঘাতক এবং এক দল ছাত্র ধর্মঘট করে। শহরের সমস্ত মুসলিম এলাকা এবং অধিকাংশ অমুসলিম এলাকাগুলি ধর্মঘট পালন করতে অসম্মত হয়। শুধুমাত্র কিছু কিছু দোকানপাট বন্ধ থাকে।… খানা তালাসীর ফলে যে সমস্ত প্রমাণাদি এখন সরকারের হস্তগত হয়েছে তার থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ এবং প্রশাসনিক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে পাকিস্তানকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে একটি গভীর ষড়যন্ত্র চলছে।

১১ ই মার্চের পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদে ১২ ই মার্চ থেকে ১৪ ই মার্চ পর্যন্ত ঢাকা এবং পূর্ব বাংলার প্রায় সর্বত্র ছাত্রেরা ধর্মঘট পালন করেন। ১৩ ই মার্চ একটি সরকারী ঘোষণা অনুযায়ী কলকাতা থেকে প্রকাশিত অমৃতবাজার পত্রিকা, আনন্দবাজার পত্রিকা এবং কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র দৈনিক স্বাধীনতা’ র আমদানী পূর্ব বাংলায় নিষিদ্ধ করা হয়।

১৫ ই মার্চ পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক সভার প্রথম অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল। তার পূর্বে মুসলিম লীগ পরিষদ দলের একটি সভা প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকারী বাসভবন ‘বর্ধমান হাউস’ এ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভা চলাকালে বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্র অনেক রাত্রি পর্যন্ত সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।

ঐ দিনই খাজা নাজিমুদ্দীন ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ র সাথে আলোচনার ইচ্ছে প্রকাশ করেন এবং কমিটির সাথে যোগাযোগের পর তারা এক বৈঠকে বসেন৷ বহু তর্ক বিতর্কের পর ৮ দফা সম্বলিত যে সর্বসম্মত চুক্তিটি গৃহীত হয়, তাতে ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদেরকে অবিলম্বে মুক্তি প্রদান, পুলিশ নির্যাতন সম্পর্কে তদন্ত, ১৯৪৮ এর এপ্রিল মাসে পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক সভায় বেসরকারী আলোচনার জন্য যে দিন নির্ধারিত ছিল সেদিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করে ও তাকে পাকিস্তান গণপরিষদ ও কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষা দিতে উর্দূর সমমর্যাদা দান, স্কুল- কলেজগুলোতে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করা, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করা, সংবাদপত্রের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার ইত্যাদি দাবী স্বীকৃত হয়। এছাড়া চুক্তির অষ্টম ধারাতে নাজিমুদ্দীন বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনার পর তিনি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়েছেন যে, ভাষা আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই।

খাজা নাজিমুদ্দীন চুক্তির প্রায় সব শর্তগুলোই পালন করেন কিন্তু বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে পরে তিনি চুক্তি ভঙ্গ করে তার বিরোধিতা করেন। এ ব্যাপারে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জিন্নাহর ভূমিকা ছিল খুবই উল্লেখযোগ্য। কারণ তিনি ১৯ শে মার্চ ঢাকা সফরে এসে বিভিন্ন সভা সমিতিতে এবং সাংগঠনিক বৈঠকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীর বিরোধিতা করেন এবং নাজিমুদ্দীনকে জোরপূর্বক ৮ দফা চুক্তিতে সাক্ষর করানো হয়েছে এই মর্মে অভিযোগ করে ঘোষণা করেন যে, মুসলিম লীগ সরকার ও দল সেই চুক্তি মেনে নিতে বাধ্য নয়।

৫. কমিউনিস্ট পার্টির নতুন লাইন ও শ্রেণী সংগ্রামঃ

১৮৪৮ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারী ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস কলকাতাতে মিলিত হয়। এই কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক থিসিেসই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নতুন রণনীতি ও কর্মসূচী ঘোষিত হয়। পরিস্থিতির পর্যালোচনা প্রসঙ্গে থিসিসটিতে বলা হয় যে, ভারতো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর্যায় শেষ হয়েছে এবং ভার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে৷ কাজেই এই পর্যায়ে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই বিপ্লবকে সফল করা দরকার। এই সংগ্রামের মাধ্যমেই ভারতে গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজ একই সাথে সাধিত হবে। তার জন্য পার্টিকে শ্রমিক, কৃষক, পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীকে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত ও পরিচালনা করা দরকার। নেহেরু সরকার আসলে ভারতের বুর্জোয়া শ্রেণীরই প্রতিনিধি, কাজেই সংগ্রামী জনগণের গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের মাধ্যমে সেই সরকারকে অপসারিত করতে হবে।

ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির এই দ্বিতীয় কংগ্রেসের সময় পর্যন্ত পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি পৃথকভাবে সংগঠিত হয় নি। এজন্য পূর্ব বাংলার পার্টিও কংগ্রেসে যোগদান করে এবং প্রতিনিধি পাঠায়। কংগ্রেসে ভারতীয় পার্টি যে নতুন রণনীতি নির্ধারণ করে, সেই রণনীতি পূর্ব বাংলাসহ সারা পাকিস্তানেও প্রযোজ্য বলে বিবেচিত হয়। এর ফলে কংগ্রেসের পর পূর্ব বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিক, কৃষক এলাকায় এবং জেলের অভ্যন্তরেও নতুন রণনীতি প্রয়োগ করতে নিযুক্ত হয়।

পূর্ব পাকিস্তান রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ছিল কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাথে সম্পর্কিত ছিলো। ১৯৪৯ সালের ৯ ই মার্চ এ ভারতীয় রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন রেল শ্রমিকদের একটি ধর্মঘট আহ্বান করে। এই ধর্মঘটের সমর্থনে পূর্ব পাকিস্তান রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নও ধর্মঘটের একটি ঘোষণা প্রদান করে। এই ধর্মঘট নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন (রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন যার অন্তর্ভুক্ত ছিলো) এবং রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। একতরফাভাবে ধর্মঘট আহ্বান করা এবং জনগণ ও রেল শ্রমিকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে ৯ ই মার্চের ধর্মঘট ব্যর্থ হয়। ধর্মঘট ভেঙ্গে দেবার জন্য সরকার এবং অপরাপর শ্রমিক সংগঠনের প্রচারণা ও কার্যকলাপও ছিলো ধর্মঘটের ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ। একতরফাভাবে ধর্মঘট আহ্বান করার জন্য ১৯৪৯ সালের ৩০ শে আগস্ট আনুষ্ঠানিক ভাবে রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নকে পূর্ব পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন থেকে বহিষ্কার করা হয়।

১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন এলাকায় অনেক খন্ড খন্ড ও সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালিত হয়। এই এলাকাগুলির মধ্যে ময়মনসিংহ জেলার হাজং প্রধান এলাকাই ছিলো সর্বপ্রধান। এখানে টঙ্ক প্রথা এবং অন্যান্য শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র কৃষক সংগ্রাম একটানা ভাবে কয়েক বছর চলে এবং এই সংগ্রামের খ্যাতি দেশ বিদেশে অনেক বিস্তার লাভ করে। ময়মনসিংহ এর হাজং এলাকা ছাড়াও সিলেট জেলার হাজং এলাকা এবং নানকার অধ্যুষিত এলাকাতেও টঙ্ক প্রথা ও ননকার প্রথার বিরুদ্ধে ব্যাপক সশস্ত্র সংগ্রাম সংগঠিত ও পরিচালিত হয়। তৎকালীন পূর্ব বাংলার অন্য যেসব এলাকায় কৃষক সংগ্রাম অল্পবিস্তর সংগঠিত হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো খুলনা জেলার ধানিবুনিয়া ডুমুরিয়া, যশোর জেলার নড়াইল থানার বড়েন্দর, দূর্গাপুর, চাঁদপুর ও সদর থানার এগারোখান ইউনিয়ন এবং রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ মহকুমার নাচোল থানা।

এই সব এলাকায় সশস্ত্র কৃষক সংগ্রাম ব্যাপক কৃষক জনগণের এবং জনগণের অপরাপর অংশের সাথে সম্পর্কিত না থাকায় শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে পড়ে। এবং এই ভাবে আন্দোলন ভেঙ্গে পড়ার ফলে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠনও ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই সংগ্রামগুলি যে একবারে ব্যর্থ হয় নি সে কথা সত্য। কারণ এই সংগ্রামের ফলেই ময়মনসিংহ এর হাজং এলাকায় এবং সিলেটের নানকার এলাকায় টঙ্ক এবং নানকার প্রথা ১৯৫০ সালে উচ্ছেদ করা হয়।

কিন্তু শুধু কৃষক শ্রমিক এলাকাতেই নয়। জেলের অভ্যন্তরেও কমিউনিস্ট পার্টির নতুন রণনীতি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ এর ফলে জেলের মধ্যে কর্তৃপক্ষ এবং রাজবন্দীদের মধ্যে রাজশাহী, ঢাকা ও অপরাপর জেলের মধ্যে প্রায় দুই বৎসর ধরে অনেক খন্ড খন্ড সংঘর্ষ বাঁধে৷ এর ফলে রাজশাহীতে ১৯৫০ সালের ২৪ শে এপ্রিল রাজবন্দীদের উপর গুলিবর্ষণ করা হয় এবং তার ফলে ৭ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হন। এছাড়া ঢাকা ও অন্যান্য জেলে অনশন ধর্মঘটের সময়েও কয়েকজনের উপর নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করা হয়।

১৯৫০ সালের মাঝামাঝি ভারতীয় এবং পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কাছে রণদীভে থিসিসের অকার্যকারিতা ও ব্যর্থতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কারণ এই সময়ের মধ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম জনবিচ্ছিন্নতার জন্য প্রায় সব জায়গাতেই ব্যর্থ হয় এবং এই ব্যর্থতা সংগঠনের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে৷ কমিনফর্ম এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টি উভয়ই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক সেই পর্যায়ে অনুসৃত সশস্ত্র সংগ্রাম ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রণনীতির সমালোচনা করে তাকে বামপন্থী বিচ্যুত আখ্যা দেয় ও ভ্রান্ত বলে ঘোষণা করে।

ব্যর্থতার এই অভিজ্ঞতা এবং অপরাপর দেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিনফর্মের সমালোচনার পর পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ও তাদের রণনীতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিদের একটি সম্মেলনে এই সিদ্ধান্ত পার্টিগতভাবে গৃহীত হয়। এই সম্মেলনের পর পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি গণসংগঠন ও গণসংযোগের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে এবং এই কর্মসূচী কার্যকর করার উদ্দেশ্যে ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ ইত্যাদি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের মধ্যে উপদলীয় কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সিদ্ধান্ত প্রকৃতপক্ষে শ্রেণী সহযোগিতার নীতির উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলো। বামপন্থী বিচ্যুতির পর এই দক্ষিণপন্থী ঝোঁক এবং বিচ্যুতিই পরবর্তী পর্যায়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনের গতি প্রকৃতিকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করে।

৬. মুসলিম লীগের অবক্ষয় ও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা

১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের সদস্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থী শামসুল হকের কাছে মুসলিম লীগের প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। টাঙ্গাইল নির্বাচনের পূর্বেই মুসলিম লীগ সংগঠনকে ব্যক্তিগত এবং উপদলীয় স্বার্থে কুক্ষিগত করে রাখার ফলে তার মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংকট শুরু হয় তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে মুসলিম লীগ প্রার্থীর পরাজয়ে। এজন্য এই নির্বাচনের পর মুসলিম লীগের সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করে। পুরাতন পরিক্ষিত কর্মীরা প্রায় সকলেই মুসলিম লীগ পরিত্যাগ করায় এবং যোগ্যতাসম্পন্ন নতুন কর্মীর অভাবে মুসলিম লীগের সাংগঠনিক অবস্থা খুবই সংকটজনক দাড়ায়। তার উপর সরকারী কার্যকলাপের বোঝায় ভারাক্রান্ত হয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে সংগঠনটি প্রায় অকেজো হয়ে পড়ে৷ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ দলাদলি ১৯৪৯ এর ১৮-১৯ জুন তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে খোলাখুলি শুরু হয় এবং সংবাদপত্রে সে বিষয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এর ফলে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে মুসলিম লীগের ভাবমূর্তির যা কিছু অবশিষ্ট ছিলো তাও প্রায় বিনষ্ট হয়।

মুসলিম লীগের এই দ্রুত সাংগঠনিক অবক্ষয়ের সাথে সাথে সরকার বিরোধী শক্তি পূর্ব বাংলায় ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে শুরু করে৷ টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থীর পরাজয় এদিক দিয়ে সহায়ক হয়। এই পরিস্থিতিতে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে প্রাক্তন মুসলিম লীগ কর্মীদের একটি সম্মেলন আহ্বানের সিদ্ধান্ত হয় এবং সেই উদ্দেশ্যে মওলানাকে সভাপতি করে গঠিত হয় একটি অভ্যর্থনা সমিতি। এই সমিতি ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ শে জুন সারা পূর্ব বাংলা প্রদেশের মুসলিম লীগ কর্মীদের একটি সম্মেলন আহ্বান করে।

পূর্ব বাংলার প্রায় সব জেলা থেকে আগত প্রতিনিধি স্থানীয় কর্মীদের এই সম্মেলনে অনেকগুলি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সেগুলোর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো বিনা খেসারতে অবিলম্বে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ, প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন, মন্ত্রী মন্ডলীর বিবিধ কার্যকলাপ তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থা, কারারুদ্ধ ছাত্রনেতাদের মুক্তি, অবিলম্বে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন এবং বিক্রয় কর প্রত্যাহার। খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি বিশেষ প্রস্তাব গ্রহণ করে তাতে একটি সর্বদলীয় খাদ্য সম্মেলন আহ্বানের দাবী জানানো হয়।

২৩ শে তারিখে সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়৷ সেই সাথে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক, শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মুশতাক আহমদকে যুগ্ম সম্পাদক করে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট একটি সাংগঠনিক কমিটিও গঠিত হয়। পরে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক একটি ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করে দলটির লক্ষ্য – উদ্দেশ্য ইত্যাদি ব্যাখ্যা করেন।

৭. পূর্ব বাংলায় দুর্ভিক্ষ

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের পর কতকগুলি কারণে পূর্ব বাংলায় খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে এবং পরিশেষে সেই সংকটকে পরিণতন করে দুর্ভিক্ষে। এই দুর্ভিক্ষের কারণকে মোটামুটি তিন ভাগে বিভক্ত করা চলে। প্রথমতঃ বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থা। দ্বিতীয়তঃ বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি পানি নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত সমস্যা। তৃতীয়তঃ সরকারী খাদ্য নীতি এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থা ও দূর্নীতি। ১৯৪৮-৪৯ এবং পরে ১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলায় যে দুর্ভিক্ষবস্থা দেখা দিয়েছিলো তার কারণ আলোচনাকালে এখানে তৃতীয় কারণটির উপরই অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কারণ ভূমি ব্যবস্থা ও পানি নিয়ন্ত্রণ ঘটিত কারণে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো তাকে সঠিক সরকারী খাদ্য নীতি ও অন্যান্য ব্যবস্থার মাধ্যমে মোটামুটি ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেতো। কিন্তু পাকিস্তান অথবা পূর্ব বাংলা, কোন সরকারই সেদিকে লক্ষ্য না করার ফলেই সংকট আয়ত্বের বাইরে চলে যায় এবং তার ফলে হাজার হাজার মানুষ দুই-তিন বৎসরে অনাহারে মৃত্যুবরণ করেন এবং অনেক কৃষক পরিবার জমিজমা বিক্রি করে সর্বশান্ত হয়।

তৃতীয় কারণের মধ্যে সরকারী খাদ্য সংগ্রহ এবং আমদানী নীতির উল্লেখ করা চলে। বিভিন্ন মহল থেকে সরকারকে বার বার সতর্ক করা সত্ত্বেও তারা পূর্ব বাংলার খাদ্য ঘাটতির সঠিক পরিমাণ নির্ণয়ের কোন চেষ্টা করেননি। তাছাড়া জরুরী অবস্থার মুখোমুখি হয়েও অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে তারা বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানীর গুরুত্বকে নীতি হিসেবে একবারেই আমল দেয়নি। কিন্তু দেশে যেখানে খাদ্য উৎপাদনেই ঘাটতি ছিল সেখানে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ যত যোগ্যতার সাথেই পরিচালনা করা হোক তার দ্বারা সামগ্রিক খাদ্য সংকট দূর করার কোন উপায় ছিলো না। খাদ্য আমদানীর ব্যাপারে এই গাফিলতির মূল দায়িত্ব অবশ্য ছিলো কেন্দ্রীয় সরকারের, প্রাদেশিক সরকারের নয়। পূর্ব বাংলার প্রয়োজন কেন্দ্রের দ্বারা উপেক্ষিত হওয়ার ফলেই প্রয়োজনের তুলনায় বিদেশ থেকে পূর্ব বাংলায় খাদ্য আমদানীর পরিমাণ দাড়ায় প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য।

এই দুর্ভিক্ষবস্থা শুধু যে কৃষকদের আঘাত করে তাই নয়। এর দ্বারা শ্রমিকরাও দুর্দশাগ্রস্ত হন এবং অনাহার ও অপুষ্টি তাদের জীবনকেও বিপর্যস্ত করে। এ কারণে অনেক শিল্প কারখানার শ্রমিক এ সময়ে মজুরী বৃদ্ধি ও রেশনের দাবীতে ধর্মঘট করেন।

৮. জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ

‘পূর্ব বাংলা জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিল’ নামে একটি বিল ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপনা পরিষদে প্রথম পেশ করা হয়। প্রায় দুই বৎসর নানান বিতর্কের পর, ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে এই বিলটি কিয়দংশ সংশোধিত হয়ে পরিষদে পাশ হয় এবং আইনে পরিণত হয়।

‘পূর্ব বাংলা জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইন’ যেভাবে প্রণীত হয়েছিলো তাতে প্রকৃতপক্ষে জমিদারী সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ হয় নি। কারণ এই আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রই জমিদারে পরিণত হয়, পূর্ব বাংলা সরকারই হয় কৃষকদের থেকে খাজনা আদায়ের অধিকারী৷ এই ব্যবস্থায় জমিদারদের গোমস্তা ও কর্মচারীদের স্থান দখল করে সার্কেল অফিসার, তহশীলদার, চৌকিদার প্রভৃতি সরকারী কর্মচারী এবং তাদের মাধ্যমে কৃষকদের থেকে নির্যাতনমূলকভাবে খাজনা আদায় এবং তাদের উপর অন্যান্য প্রকার অত্যাচার রীতিমতো অব্যাহত থাকে।

‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইন’ প্রণীত হওয়ার সময় আইনগতভাবে বাৎসরিক কৃষকদের মোট দেয়া রাজস্বের পরিমাণ ছিলো ৮.৪২ কোটি টাকা। কিন্তু জমিদারদের থেকে সরকারের প্রাপ্ত করের অংকের পরিমাণ ছিলো ২.২৪ কোটি টাকা। জমিদারী ক্রয় আইনের বিতর্ক চলাকালে তৎকালীন প্রাদেশিক রাজস্ব মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী যে হিসেব দান করেন সেই অনুযায়ী সরকারের খাজনা আদায় বাবদ খরচ হওয়ার কথা ১.২৪ কোটি টাকা। এই হিসেব মতো সরকার কর্তৃক জমিদারী উচ্ছেদের পর ভূমি খাজনা বাবদ সরকারের অতিরিক্ত আয় ৪ কোটি টাকার মতো হবে বলেও হামিদুল হক উল্লেখ করেন৷ অর্থাৎ সে সময় সরকারের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভূমি রাজস্ব থেকে মোট আয়ের পরিমাণ কোনক্রমেই ৭ কোটি (পরবর্তী ২.২৪ + অতিরিক্ত ৪ কোটি) টাকাে বেশী হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত সরকারী পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, এই বাবদ সরকারের আয় ১৯৫০ সালের পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক বাহিনী কর্তৃক ক্ষমতা দখলের পর থেকে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ১৯৭০ সালে এসে তা দাড়ায় ১৮.৫ কোটি টাকায়। ১৯৫০ সালের ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইন’ চালু হওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় জমিদারীতে কৃষকদের উপর খাজনা শোষণের পরিচয় এর থেকেই স্পষ্ট ভাবে উদঘাটিত হয়।

খাজনার শোষণ ছাড়াও আর একটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য। ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিল’ এর বিতর্ক চলাকালে সরকার পক্ষ থেকে ভূমিহীন গরীব কৃষকদের মধ্যে উদ্বত জমি বিতরণের অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার পর অতি অল্প পরিমাণ জমিই প্রকৃতপক্ষে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। অধিকাংশ জমিই ভূস্বামীরা বেনামী করে নিজেদের দখলে রাখে এবং সরকারও উদ্বৃত্ত জমি বের করা ও কৃষকদের মধ্যে তা বিতরণের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রীতা ও শৈথিল্যের মাধ্যমে উদ্ধৃত জমি কৃষকদের মধ্যে বিতরণের প্রশ্নটি কার্যক্ষেত্রে ধামাচাপা দেয়।

‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইন’ প্রণয়ন করতে গিয়ে সরকার ময়মনসিংহের হাজং অধ্যুষিত এলাকায় টঙ্ক খাজনা (এই খাজনার অর্থ হলো জমিদারের জমিতে চাষ আবাদ করে টাকার খাজনা না দিয়ে বা ভাগে খাজনা না দিয়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শস্য জমিদারকে খাজনা হিসেবে দেওয়া।) রহিত করে টাকায় খাজনা প্রচলন করেন এবং সিলেটের ব্যাপক অঞ্চলে নানকর প্রথা নামক ভূমিদাসত্ব প্রথা উচ্ছেদ করেন। এ দুই ক্ষেত্রেই সরকারী সংস্কার উপরোক্ত এলাকার কৃষকদের কিছু কিছু নতুন আইনগত অধিকার প্রদান করে।

৯. শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠন ও আন্দোলন

১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কোন পাটকল ছিলো না। আদমজীর কাজ সবেমাত্র শুরু হয়েছিলো৷ সুতাকলগুলির সংখ্যা ছয়টির মতো ছিলো। তার মধ্যে কুষ্টিয়ার মোহিনী মিল ও চট্টগ্রামের একটি সুতাকল ব্যতীত বাকী সবগুলিই ছিল নারায়ণগঞ্জ। রাজশাহী জেলার গোপালপুরে একটি চিনিকল ছিলো। একটি সিমেন্ট কারখানা ছিলো সিলেট জেলার ছাতকে। মাত্র এই কয়টি ব্যাতিত সারা পূর্ব বাংলায় তখন প্রকৃতপক্ষে কোন শিল্প কারখানার অস্তিত্ব ছিলো না।

এই থেকেই বোঝা যাবে তৎকালে পূর্ব বাংলার পশ্চাৎপদতা কতখানি গভীর ছিলো। সেই পশ্চাৎপদ অর্থনীতিতে মেহনতি জনগণ বলতে কৃষিকার্যে নিযুক্ত লোকদেরই বোঝাতো৷ কারখানা শ্রমিক এবং অপরাপর ধরণের শ্রমিকদের রাজনৈতিক গুরুত্ব সেই অনুযায়ী অতি অল্পই ছিলো।

এই গুরুত্বহীনতার জন্য অবশ্য শ্রমিকদের সংখ্যাসল্পতাই একমাত্র কারণ ছিলো না। তাদের অসংগঠিত অবস্থাও ছিল এর অন্যতম কারণ৷ রেল, ডাক-তার ও বন্দর শ্রমিকরা কৃষিকার্য রত মেহনতি মানুষদের থেকে সংখ্যায় অল্প হলেও ধর্মঘটের মাধ্যমে প্রয়োজনবোধে তার সাধারণ জীবন ব্যাহত এবং অর্থনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারতেন যদি তারা ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত ভাবে কোন কর্মসূচী গ্রহণ করতে সক্ষম হতেন। এ বিষয়টি তৎকালীন শাসক গোষ্ঠীর দৃষ্টি এড়ায়নি। এজন্য তারা প্রথম থেকেই শ্রমিক আন্দোলনে নিজেদের বিশ্বস্ত লোকদের মাধ্যমে খুব পরিচিত কতকগুলি পদ্ধতি অনুযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলো এবং তাতে সফলও হয়েছিলো।

রেল, সুতোকল, চা বাগান ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রথম দিকে কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত শ্রমিক সংগঠন গুলির অল্পবিস্তর প্রভাব ছিলো। কিন্তু ১৯৪৮ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব যে রাজনৈতিক লাইন এখানে অনুসরণ করেন তাতে সন্ত্রাসবাদের প্রাধান্য থাকায় কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন শ্রেণী সংগঠন গুলো ভেঙ্গে পড়তে থাকে। সরকারী বিভেদ নীতি ও দমন নীতির ফলে এই ভাঙ্গন দ্রুততর হয়।

শ্রমিক আন্দোলন থেকে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব কার্যতঃ বিলুপ্ত হওয়ার পর যে বুর্জোয়া নেতৃত্ব শ্রমিকদের উপর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে তার দ্বারা স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকদের কোন সমস্যারই সমাধান হয় নি। উপরন্তু দিন দিন তাদের অবস্থার অবনতিই ঘটেছিলো। এই কারণে শ্রমিকদের উপর শ্রেণীগত ভাবে বুর্জোয়া নেতৃত্বের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও সেই নেতৃত্ব ক্রমশঃ নানা দলে বিভক্ত হয়ে শ্রমিক আন্দোলনকে টুকরো টুকরো করে চলেছিলো। এতে করে শ্রমিকদের মধ্যে একদিকে যেমন অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছিলো তেমনি অন্যদিকে সরকার ও প্রতিষ্ঠিত ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বের প্রতি তাদের আস্থা কমে আসছিলো।

১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত এবং তারপর ১৯৫১ সালে সারা পূর্ব বাংলায় যে দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি হয় তার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক, অসন্তোষ মাঝে মাঝে রাজনৈতিক বিক্ষোভের রূপে পরিগ্রহ করে। এই রাজনৈতিক বিক্ষোভের খুব ব্যাপক বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে।

১০. পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ

কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনে ১৯৪৮-৫০ এর বিপর্যয় ঘটার পর ১৯৫০ থেকে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে পেটি বুর্জোয়া সংগঠন গঠন এবং পেটি বুর্জোয়া প্রগতিশীল রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ গ্রহণের ঝোঁক দেখা দেয়। তাই কৃষক ও শ্রমিক সংগঠনগুলি ভেঙ্গে পড়ার পর পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রগতিশীল অংশকে সাথে নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠিত করার উপরই কমিউনিস্ট পার্টি কার্যতঃ সব থেকে বেশী গুরুত্ব আরোপ করে।

এ সময় মধ্যশ্রেণীভুক্ত বা পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীভুক্ত প্রগতিশীল যুবকরা রাজনীতিগত ভাবে অনেকেই যথেষ্ট সচেতন ছিলেন কিন্তু এ দেশে তখন এমন কোন রাজনৈতিক দল অথবা গণসংগঠন ছিলো না যার মধ্যে তারা সক্রিয় ভাবে কাজকর্ম করতে পারতেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে যে রাজনৈতিক সংগঠনটি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় তার সাম্প্রদায়িক চরিত্রের জন্য অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিদের পক্ষে তাতে যোগদান করা সম্ভব ছিলো না। অন্য দিকে ১৯৪৭ সালে গঠিত ‘গণ আজাদী লীগ’ তো বটেই, এমন কি ‘গণতান্ত্রিক যুব লীগ ‘ নামক সংগঠনটিও প্রকৃতপক্ষে বিলুপ্ত হয়েছিলো। এবং এগুলোর পরিবর্তে নতুন কোন সংগঠনও পরবর্তী পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। এজন্য একটি নতুন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন পূর্ব বাংলার প্রগতিশীল যুবকরা এ সময় খুব তীক্ষ্ণ ভাবে অনুভব করছিলেন। এই যুবকদের কেউ কেউ কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন এবং অন্য অনেকেই নানাভাবে পার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। এ কারণে কমিউনিস্ট ও অ- কমিউনিস্ট প্রগতিশীল যুবকদের সমন্বয়ে একটি নতুন যুব সংগঠনের চিন্তা ভাবনা যখন কিছু সংখ্যক যুবক শুরু করেন, তখন কমিউনিস্ট পার্টি সেই গঠন কার্যে সহায়তার সিদ্ধান্ত নেয়।

এর পর ১৯৫১ সালের ২৭ শে মার্চ ঢাকাতে পূর্ব বাংলার প্রগতিশীল যুবকদের একটি সম্মেলন আহ্বান করা হয়। ১৭ টি জেলার মধ্যে ১২ টি জেলা থেকে প্রায় ২৫০ জন প্রতিনিধি েই সম্মেলনে ঐ দিন উপস্থিত হন। এই যুব সম্মেলনে যাতে নির্ধারিত স্থান ঢাকা বার লাইব্রেরীতে অনুষ্ঠিত হতে না পারে তার জন্য সরকার শহরে ১৪৪ ধারা জারী এবং বার লাইব্রেরীর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন। এর ফলে সম্মেলন শেষ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীতে কতকগুলি নৌকোর উপর অনুষ্ঠিত হয়।

এই সম্মেলনে ‘পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সম্মেলনে যে খসড়া ম্যানিফেস্টো পেশ করা হয় সেটি সামান্য রদবদলের পর সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এছাড়া সম্মেলনে সাংবিধানিক মূলনীতি কমিটির সুপারিশ বাতিল, রাজবন্দীদের মুক্তি, পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদ বাতিল করে পূর্ণ বয়স্কদের ভোটাধিকারের দাবীতে নির্বাচন অনুষ্ঠান, সংবাদপত্রের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম ও অফিসের ভাষারূপে গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে কতকগুলি প্রস্তাব গ্রহন করা হয়।

১৯৫১ সালের এপ্রিল মাস থেকেই যুবলীগ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের বিভিন্ন নির্যাতন মূলক নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে সভা সমিতি ও আলোচনা শুরু করে। এর সাংগঠনিক বিকাশও বেশ দ্রুত হয়। প্রায় এক বৎসরের মধ্যেই পূর্ব বাংলার শুধু জেলা শহরগুলিতেই নয়, ছোট ছোট শহরে, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও এই সংগঠনটির শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। বস্তুতঃ পক্ষে পূর্ব বাংলায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগই ছিলো বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনগুলির মধ্যে সব থেকে ব্যাপকভাবে সংগঠিত। এবং সেই হিসেবে এই সংগঠনটির ভূমিকাও ভাষা আন্দোলনের সময় ছিলো অপরাপর রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনগুলির মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য।

১১. রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫২

১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব বাংলার কৃষক, শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপর পাকিস্তান সরকারের যে শোষণ, নির্যাতন চলে আসছিলো তার বিরুদ্ধে জনগণের বিভিন্ন অংশ, বিভিন্ন এলাকায় খাদ্য আন্দোলন, কাজ ও মজুরীর আন্দোলন, শিক্ষা সংস্কৃতির উপর হামলার বিরুদ্ধে আন্দোলন, পুলিশী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের জন্য আন্দোলন এবং অন্যান্য আন্দোলন করে আসছিলেন। কিন্তু সেই সব আন্দোলন ছিলো সাধারণভাবে পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও খন্ড খন্ড। এই সব বিচ্ছিন্ন ও খন্ডিত আন্দোলনের মাধ্যমে শোষণের বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভ ক্রমশও পুঞ্জীভূত হচ্ছিলো। এই পুঞ্জীভূত বিক্ষোভেরই ব্যাপক বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্যে।

পাকিস্তানের পুঁজির শোষণ যতই বৃদ্ধি পাচ্ছিলো ততই সারা পাকিস্তানের জনগণ এবং বিশেষভাবে পূর্ব বাংলার জনগণের দুঃখ দূর্দশাও বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। পূর্ব বাংলায় এই শোষণ নির্যাতনের মাত্রা অধিক হওয়ার কারণ পশ্চিম পাকিস্তানী শোষক শাসকদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে তারা শ্রেণী শোষণের বোঝা অধিক হারে পূর্ব বাংলার জনগণের উপর চড়িয়ে দিতো। এই অধিক শোষণ তাই পূর্ব বাংলায় শুধু প্রত্যক্ষ শ্রেণী শোষণের রূপই গ্রহণ করে নাই, তার অপর একটি রূপও ছিলো এবং সে রূপটি হলো জাতীয় শোষণ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন আসলে ছিল এই দ্বিতীয় রূপটির বিরূদ্ধেই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম।

১৯৫২ সালের ১৬ ই অক্টোবর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাওয়ালপিন্ডিতে এক জনসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। তারপর নাজিমুদ্দীন প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন এবং ১৯৫২ সালের জানুয়ারী মাসে ঢাকা সফরে এসে ২৭ শে জানুয়ারী পল্টন ময়দানের এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু।

প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণের পর সারা পূর্ব বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে এবং সভা সমিতি বিক্ষোভ মিছিল ইত্যাদি সংগঠিত হতে থাকে। সরকারী ভাষা নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য ২১ শে ফেব্রুয়ারী পূর্ব বাংলায় হরতাল আহ্বান করা হয়। সরকার ঐদিন ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারী করেন। কিন্তু ঢাকার ছাত্ররা ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে তা ভঙ্গ করেন এবং তারপর পুলিশের সাথে সংঘর্ষে ছাত্রসহ কয়েক ব্যক্তি নিহত হন। এরপর ভাষা আন্দোলন তৎকালীন পূর্ব বাংলার সর্বত্র, এমন কি সারা গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা শহরে সরকারী প্রশাসন কয়েকদিনের জন্য একেবারে ভেঙ্গে পড়ে এবং পুলিশের সাথে সামরিক বাহিনীকেও আইন শৃঙ্খলা রক্ষার নামে পথে নামতে হয়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও ঢাকার দোকানপাট, অফিস আদালত সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে, জনগণ হাজারে হাজারে মিটিং ও মিছিলে জমায়েত হন এবং পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে অনেক সংখ্যায় আহত ও নিহত হন।

২১ শে ফেব্রুয়ারীর পর আন্দোলন প্রায় সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে, নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলে এবং ছড়িয়ে যেতে থাকে। সেই পরিস্থিতিতে যেটুকু সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রণ ছিলো তা সম্ভব হয়েছিলো যুবলীগের দ্বারা। আওয়ামী লীগ ও তার ছাত্রফ্রন্ট পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ সে সময় কিছুটা সংগঠিত হলেও সংগঠন হিসেবে তাদের বিশেষ কোন কার্যকারিতা সে সময় থাকেনি।

দৃঢ় নেতৃত্বের অভাবে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা ব্যতীত অপর কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকায় ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ দিকেই এই আন্দোলন তার গতি ও ব্যাপকতা হারিয়ে ফেলে এবং শীঘ্রই সরকারী প্রশাসন যন্ত্র ব্যাপক ধরপাকড়ের মাধ্যমে তাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। মার্চ মাসের ৭ তারিখে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ‘ সদস্যরাও গ্রেফতার হন।

কিন্তু এভাবে আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততায় সমাপ্তি ঘটলেও ১৯৫২ সালের এই ভাষা আন্দোলনের পর পূর্ব বাংলা রাজনীতিগত ভাবে আর পূর্বের অবস্থানে থাকলো না। পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের রাজনৈতিক ভাগ্য এই আন্দোলনের মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়ে গেলো। এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয়ের মধ্যেই তার প্রতিফলন ঘটলো। এই নির্বাচন প্রকৃতপক্ষে ছিলো পূর্ব বাংলার উপর পাকিস্তানের বড় পুঁজি ও তাদের সরকারের জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক সুসংগঠিত গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ।

১২. ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পূর্ববর্তী পরিস্থিতি

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় উন্নয়নমূলক কোন কাজই প্রকৃতপক্ষে শুরু হয়নি। অন্যদিকে এই অঞ্চলের সম্পদ নানাভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হতে থাকার ফলে এখানকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি ঘটে। খাদ্য ঘাটতি একটি স্থায়ী সমস্যায় পরিণত হয়, লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পায়, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়মিত ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রমিকদের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে দাড়ায় এবং তারা ধর্মঘটের আশ্রয় নিতে থাকেন। কৃষকরা অধিক হারে ঋণগ্রস্ত এবং তার পরিণতিতে জমি থেকে উৎখাত হয়ে বেকার, ভিক্ষুক ও ভবঘুরেতে পরিণত হতে থাকেন। শিক্ষা ব্যবস্থা দ্রুত ভেঙ্গে পড়তে থাকে এবং সাংস্কৃতিক জীবনে নানান সংকট দেখা দেয়।

কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলার উন্নয়নের ব্যাপারে কোন রকম আগ্রহী না থাকায় কোন সমস্যারই সমাধান প্রাদেশিক মুসলিম লীগের পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিলো না। কারণ প্রাদেশিক সরকারের মূল নিয়ন্ত্রণও আসলে অবাঙালী আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে কেন্দ্রের দ্বারাই পরিচালিত হতো। এর ফলে ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লীগের উপর জনগণ সকল আস্থা হারান এবং তারা জনগণ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই বিচ্ছিন্নতার একটা প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৪৯ সালের টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয়ের মাধ্যমে। এবং সেই প্রমাণ পাওয়ার পর নির্বাচন ভীতি শাসক দলকে ভয়ানকভাবে পেয়ে বসে। এই ভীতির জন্যই তারা সাধারণ নির্বাচন যথাসময়ে না করে তার তারিখ পিছিয়ে চলে এবং এমন এক সময় নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় যখন পূর্ব বাংলার ক্ষমতাসীন দলের মূল প্রায় সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ হয়ে গেছে।

পশ্চিম পাকিস্তান এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যেও সংকট দিন দিন তীব্র হতে থাকে। মন্ত্রীত্বের মধ্যে ভাঙ্গন এবং রদবদল নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয় এবং এই ভাঙ্গনের মুখে যে সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া হতে থাকে সেগুলি অনেক ক্ষেত্রেই হয় শাসনতন্ত্রের বরখেলাপ৷ ১৯৫৩ সালের এপ্রিল মাসে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীকে একটি ঘোষণার মাধ্যমে বরখাস্ত করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মহম্মদ আলীকে ফিরিয়ে এনে প্রধান মন্ত্রীত্বের গদীতে বসান। মহম্মদ আলীর কোন সাংগঠনিক অবস্থান শাসক দলের মধ্যে ছিলো না, এজন্য তিনি ছিলেন গোলাম মোহাম্মদের হাতের পুতুল মাত্র।

কেন্দ্রীয় পরিষদকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে একজন প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত এবং অন্য আরেকজনকে নিয়োগ করার ফলে পাকিস্তান মুসলিম লীগের মধ্যে সংকট আরো ঘনীভূত হয় এবং নানান চক্রান্ত করাচীতে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যত্র ঘোরালো আকার ধারণ করে।

১৩. ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন

১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে পূর্ব বাঙলায় সাধারণ নির্বাচনের তারিখ নির্দিষ্ট হয়। নির্বাচনের এই ঘোষণার পর পূর্ব বাঙলায় রাজনৈতিক দলগুলি নতুনভাবে সংগঠিত হয়ে মুসলিম লীগের সাথে মোকাবেলার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করে।

এই সময় রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগই সব থেকে শক্তিশালী। ১৯৪৯ সালের পর শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন এবং তার সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কোন উল্লেখযোগ্য সংগঠন পশ্চিম পাকিস্তানে না থাকায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের মধ্যে কোন সত্যিকার পার্থক্য সাংগঠনিক দিক দিয়ে ছিলো না। তবে এই ভাবে একটা সাংগঠনিক কাঠামো খাড়া করায় সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানী দুই জনই সভাপতির পদ অলংকৃত করে নেতৃত্বের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বিধান করকে সক্ষম হয়।

কিন্তু আওয়ামী মুসলিম লীগ ছাড়াও তখন অন্য রাজনৈতিক সংগঠন পূর্ব বাঙলায় ছিলো।, ১৯৫৩ সালে গণতন্ত্রী দল নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গঠিত হয়৷ এই সংগঠনটির সাথেও কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্ক ছিলো৷ পার্টি সদস্যরা কেউ কেউ এই সংগঠনটির কাজে অংশগ্রহণ করেন৷ যুব লীগের বয়স্ক সদস্য, বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী এবং মুসলিম লীগ থেকে বের হয়ে আসা কিছুসংখ্যক নেতা ও কর্মীর সমন্বয়ে গণতন্ত্রী দল গঠিত হয়।

এ ছাড়া ফজলুল হক হলের নেতৃত্বে কৃষক শ্রমিক পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দলও ১৯৫৩ সালের অক্টোবর মাসে গঠিত হয়। এই দল গঠনের পূর্বে ফজলুল হক ঢাকা হাই কোর্টের এডভোকেট জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। নির্বাচনের নতুন সুযোগের সদ্ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই তিনি চাকরীতে ইস্তফা দিয়ে রাজনৈতিক জীবনে প্রত্যাবর্তন করেন।

সোহরাওয়ার্দী – ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক পার্টির সমন্বয়ে ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসে হয় নির্বাচনী যুক্তফ্রন্ট। ফ্রন্ট গঠিত হওয়ার সময় নেজামে ইসলাম পার্টিকে ফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত করা হলেও গণতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্ট পার্টিকে যুক্তফ্রন্টের বাইরে রাখা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত বামপন্থী কর্মীদের চাপে গণতন্ত্রী দলের কয়েকজনকে যুক্তফ্রন্ট থেকে মনোনয়ন দেয়া হয় এবং কয়েকজন কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে কোন মনোনয়ন না দিয়ে আসনটি খালি রাখা হয়।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে একটি ২১ দফা কর্মসূচী প্রচার করা হয়৷ এই কর্মসূচীতে পূর্ব বাংলার জন্য স্বায়ত্তশাসন, পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হয়।

বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ১৯৫৪ সালের ৮ মার্চ থেকে ১২ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের সময় জনগণের মধ্যে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় এবং তারা বিপুল সংখ্যায় ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নিজেদের ভোট প্রদান করেন। এর ফলে পূর্ব বাঙলা পরিষদে ৩০৯ টি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ লাভ করে মাত্র ৯ টি আসন এবং বাকীগুলি লাভ করে যুক্তফ্রন্ট অথবা যুক্তফ্রন্ট সমর্থিত প্রার্থীরা।

এই নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয় হয়ে দাড়ায় তার বিলুপ্তিরই সামিল। এবং মুসলিম লীগের উপর জনগণের এই আঘাত প্রকৃতপক্ষে পূর্ব বাঙলায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তির উপরই ছিল এক প্রচন্ড আঘাতস্বরূপ, যদিও এই দিকটি সম্পর্কে ভোটদাতা কিংবা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোন উপলব্ধি ঠিক সে সময় ছিল না।

১৪. মুসলিম লীগের পরজয়ের কারণ

পূর্ব বাঙলার উপর পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দ্রীক পাকিস্তানী বড়ো পুঁজির শোষণে শুধু যে কৃষক শ্রমিকরাই জর্জরিত হচ্ছিলেন তাই নয়৷ পূর্ব বাঙলায় পেটি বুর্জোয়া বা মধ্য শ্রেণীয় লোকেরাও এই শোষণের শিকার হচ্ছিলেন এবং তাদের কোন আকাঙ্খাই পাকিস্তানের তৎকালীন সরকার দ্বারা পূরণ হওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিলো না। কাজেই এই আকাঙ্খা পূরণের জন্য তারা মুসলিম লীগের বাইরে অনেক আগে থেকেই সংগঠিত হতে শুরু করেছিলেন। এবং এইভাবে সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী মুসলিম লীগই হয়ে দাড়িয়েছিলো তাদের প্রধান অবলম্বন।

পাকিস্তানী বড়ো পুঁজি পূর্ব বাঙলায় যেভাবে তার শোষণ জারী রেখেছিলো তাতে এই অঞ্চলে পুঁজি গঠিত হওয়ার বিশেষ কোন সম্ভাবনা ছিলো না। ছোট পুঁজি গঠিত হলেও তার কোন বিকাশের সম্ভাবনা ছিলো না। এই পরিস্থিতিতে ছোট পুঁজি বড়ো পুঁজিতে এবং ছোট বুর্জোয়া বড়ো বুর্জোয়ায় পরিণত হওয়ার পথ খুঁজছিলো এবং তার জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করতে চেষ্টা করছিলো৷ মার্কিন, বৃটিশ এবং অপরাপর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি এ সময়ে যে পুঁজি পাকিস্তানে বিনিয়োগ করেছিলো তার বিপুল অধিকাংশই ব্যবহৃত হচ্ছিল পাকিস্তানে। সেদিক থেকেও পাকিস্তান সরকার, মুসলিম লীগ এবং কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে পূর্ব বাঙলার মধ্য শ্রেণীর লোকদের বিক্ষোভ ছিলো। কাজেই তারা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনেই আগ্রহী ছিল বেশি।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে পর্যন্ত পূর্ব বাঙলায় কলকারখানা তেমন কিছু গড়ে ওঠেনি৷ আদমজী পাটকল, চন্দ্রঘোনা কাগজ কারখানা ইত্যাদি কয়েকটি কল কারখানা থাকলেও শিল্পের বিকাশ বলতে এই অঞ্চলে কিছু ছিলো না। তবে ইতিমধ্যে পূর্ব বাঙলা পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা, কাঁচামাল ও রাজস্ব সরবরাহের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিলো। তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পের বাজার হিসেবে পূর্ব বাঙলা অধিকার করেছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান৷

১৯৫০ সালে পূর্ব বাঙলায় জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ হলেও কৃষকদের অবস্থার বিন্দুমাত্র কোন পরিবর্তন হয় নি৷ ব্যক্তির পরিবর্তে রাষ্ট্র জমিদারে পরিণত হয়ে রাজস্বের হার কমিয়ে না এনে বৃদ্ধিই করেছিলো। কৃষকেরা পাকিস্তান আন্দোলনের সময় জমি পাওয়ার যে আশা করেছিলেন তা পূরণ হয়নি এবং হওয়ার কোন সম্ভাবনাও ছিলো সুদূর পরাহত৷ ভাগচাষীরা আধি ব্যবস্থায় অর্ধেক উৎপাদন ভূমি মালিকদের দিতে বাধ্য হচ্ছিলেন, অনেক এলাকায় তাদেরকে তিন ভাগের দুই ভাগও দিতে হচ্ছিলো। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জমির ওপর চাপ বাড়ছিলো কারণ বাড়তি লোকের কাজের কোন সংস্থান ছিলো না। গ্রামীণ কৃষি মজুরদের কোন নির্ধারিত নিম্মতম মজুরী ছিলো না। এজন্য কাজ পেলেও তারা উপযুক্ত মজুরী থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। এ সবের উপর ছিলো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধি। ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে এই পরিস্থিতি চরমে ওঠে যখন কৃষকরা ১৬ টাকা সের দরে লবণ কিনতে বাধ্য হয়।

১৯৫৪ সালে পূর্ব বাঙলায় শ্রমিক শ্রেণীর আকার ছোট হলেও চা বাগান, রেল, পাটকল, সূতাকল, নদী ও সড়ক পরিবহন, ডক, কাগজ কল ইত্যাদিতে কয়েক লক্ষ শ্রমিক নিযুক্ত ছিলেন৷ কিন্তু স্বল্প মজুরী, উচ্চ দ্রব্যমূল্য এবং জীবন ধারণের উপযোগী অন্যান্য ব্যবস্থার অভাবে তাদের জীবন ছিলো দূর্বিষহ।

এ ছাড়া বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিরাও শহর ও গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিক বিকাশ প্রায় সম্পূর্ণভাবে রূদ্ধ থাকা। দেশীয় বাজারের শিল্প দ্রব্য ক্রয় ক্ষমতার একটা বিরাট অংশ পশ্চিম পাকিস্তানী জিনিসপত্র কেনার জন্যই ব্যয় হতো। এছাড়া আমদানীকৃত অন্য বিদেশীয় জিনিস তো ছিলোই৷ এই অবস্থায় দেশীয় শিল্প বাজারের বিস্তৃতির প্রশ্ন ছিলো অবান্তর।

এ সবের সাথে যুক্ত হয়েছিলো রাজনৈতিক নির্যাতন। নির্বাচনের মাধ্যমে শাসন পরিবর্তনের পথ তো পাকিস্তান সরকার রূদ্ধ করে রেখেই ছিলো, উপরন্তু যে কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে তারা আখ্যায়িত করছিলো ইসলাম ও পাকিস্তান বিরোধী এবং রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে। আন্দোলন সম্পর্কিত তাদের এই বক্তব্যের সাথে সঙ্গতি রেখে নানা প্রকার নির্যাতন মূলক আমলাতান্ত্রিক ও পুলিশী ব্যবস্থা জনগণের ও গণতান্ত্রিক কর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রহণ করতে তাদের কোন দ্বিধাবোধ ছিলো না।

এ ছাড়া নিজেদের মধ্যে দলাদলি এবং মুসলিম লীগের আভ্যন্তরীণ দলীয় চক্রান্ত বাইরে বার বার প্রকাশিত হয়ে পড়ার সরকারী দলের ভাঙন এবং অকার্যকরিতা সম্পর্কে জনগণের সন্দেহের কোন অবকাশ ছিলো না। তাদেরকে ভোট প্রদান করে কোন দিক থেকেই যে সুবিধা নেই এ বিষয়ে পূর্ব বাঙলার জনগণ ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে নিশ্চিত হয়েছিলেন। এবং এই ভাবে তারা নিশ্চিত হওয়ার জন্য নির্বাচনে মাত্র ৯ আসন লাভ করে মুসলিম লীগ একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে পূর্ব বাঙলার মাটি থেকে প্রায় উচ্ছেদ হয়েছিলো।

১৫. যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন ও তারপর

সাধারণ নির্বাচনের পর ফজলুল হক যুক্তফ্রন্ট সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৪ সালের ২৫ মার্চ পূর্ব বাঙলার গভর্নর চৌধুরী খালিকুজ্জামান তাকে মন্ত্রীত্ব গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানান। এই আমন্ত্রণ অনুযায়ী, ফজলুল হক তার কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করেন এবং তাতে আবু হোসেন সরকার, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান প্রভৃতি মন্ত্রীসভার সদস্য নিযুক্ত হন।

যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা গঠিত হওয়ার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্ত শুরু করে৷ এই চক্রান্ত কার্যকর করার জন্য তারা পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন জায়গায় দাঙ্গা হাঙ্গামা সৃষ্টির চেষ্টা করে। এই উদ্দেশ্যে ৬ ই মে তারা ঢাকা শহরের চকবাজার এলাকায় এক দাঙ্গা বাঁধায় এবং তাতে বহু সংখ্যক লোক আহত হন। এরপর ১৫ মে তারা নারায়ণগঞ্জের আদমজী পাটকলে শ্রমিকদের মধ্যে এক ভয়াবহ বাঙ্গালী – অবাঙালী দাঙ্গা সৃষ্টি করে। এই দাঙ্গা কয়েকদিন অব্যাহত থাকে এবং এতে ঠিক কতজন নিহত হন তার কোন সঠিক হিসাব পাওয়া না গেলেও তার সংখ্যা ছিল বেশ কয়েক শত। আহতের সংখ্যা হাজারের কম ছিলো না। আদমজীর এই দাঙ্গাকে কেন্দ্রীয় সরকার অবাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে বাঙালীদের আক্রমণাত্মক নীতিরই একটি উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করে প্রাদেশিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণার ব্যবস্থা করে। পূর্ব বাঙলা সরকার এবং যুক্তফ্রন্টের নেতারা এই প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও পাল্টা বক্তব্য প্রদান করলেও শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তেরই জয় হয় এবং ৩০ শে মে তারিখে গভর্নর জেনারেল ৯২ (ক) ধারা বলে পূর্ব বাঙলার মন্ত্রী পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে গভর্নরের শাসন বলবৎ করেন। ঐ একই দিনে পাকিস্তানের দেশ রক্ষা সচিব ইস্কান্দার মির্জা ঢাকায় আসেন এবং নতুন গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

ব্যাপক গণসমর্থণের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত যুক্তফ্রন্ট সরকার কোন কাজে হাত দেওয়ার পূর্বেই এই ভাবে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার ও মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আরও তীব্র আকার ধারণ করে। এই বিক্ষোভের সুযোগ সাংগঠনিক ভাবে সবচেয়ে বেশী গ্রহণ করতে সক্ষম হয় আওয়ামী লীগ কারণ তারাই তখন ছিলো রাজনৈতিক দল হিসেবে সব থেকে সংগঠিত। ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক পার্টি নির্বাচনের মাত্র পাঁচ মাস পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার তেমন কোন সংগঠনও নির্বাচনের পূর্বে গড়ে ওঠেনি। ফজলুল হকের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার জন্যই এই দলের প্রার্থীরা নির্বাচনে মনোনয়ন পান ও জয়লাভ করেন।

যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার পতনের পর আওয়ামী মুসলিম লীগের সাথে বামপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সম্পর্ক উন্নত হয় কারণ তারা সকলেই তখন গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ব্যাপকভাবে সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। অনেকে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করতেও ইচ্ছুক হন, কিন্তু দলটির সাম্প্রদায়িক নাম তার পথে প্রতিবন্ধক হয়। এজন্য আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতারা বিশেষতঃ ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী উভয়ই তাদের সংগঠনকে অসাম্প্রদায়িক নাম দেওয়ার পক্ষে মত পোষণ করেন। এর ফলে ১৯৫৫ সালে এই দলটির নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে নতুনভাবে নাম রাখা হয় ‘পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ‘।

পূর্ব বাঙলার যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দেওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাঙলাসহ সারা পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টির উপর এক সর্বাত্মক আক্রমণ চালায়। ১৯৫৪ সালের ৬ ই জুলাই পূর্ব বাঙলা সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনী ঘোষনা করেন। এরপর তারা ২৩ শে জুলাই করাচীতে এবং ২৪ শে জুলাই পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু প্রদেশ ও বেলুচিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৪ সালের এই সময় পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির উপর কার্যক্ষেত্রে অনেক নির্যাতন হলেও সরকারী ভাবে দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি, এমন কি ১৯৪৮-৫০ সালেও নয়। কিন্তু ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিলের পর সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে কমিউনিস্ট পার্টির উপর এই নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। এই পদক্ষেপ তারা শ্রেণী চেতনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েই গ্রহণ করেছিলেন এবং এ সময়ে তাদের শ্রেণী চেতনা এত উচ্চ মার্গে ওঠার কারণ তৎকালীন পরিস্থিতির সুযোগে শ্রেণী সংগ্রাম যাতে পূর্ব বাঙলায় ও সেই সাথে পাকিস্তানের অপর কোন স্থানে সঠিকভাবে সংগঠিত হতে না পারে সে বিষয়ে তাদের সতর্কতা।

১৬. আওয়ামী লীগে কমিউনিস্টদের যোগদান ও তার পরিণতি

১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে তার নাম পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগ ধারণ করার পর অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলে কাজ করতে ইচ্ছুক অনেক উৎসাহী যুবক এই দলে যোগদান করেন। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় সরকার ও তার তাবেদার প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের বিভিন্ন গনবিরোধী ও নির্যাতনমূলক নীতি ও কাজের বিরোধিতা করে আসছিলো। এই বিরোধিতার সময় শাসকদল তা তাদের সরকার সব সময়ই অপরাপর বিরোধী শক্তিগুলির মতো আওয়ামী মুসলিম লীগকেও ইসলাম ও পাকিস্তান বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করতো। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে এইভাবে আখ্যায়িত হতে থাকার ফলে আওয়ামী মুসলিম লীগ কর্মীদের এক বড়ো অংশের মধ্যেও এই চেতনার সৃষ্টি হয় যে, পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক নামে এবং ইসলামী রাষ্ট্র ইত্যাদির কথা বলে কোন প্রকৃত গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠিত করা সম্ভব নয়। আসলে পরিস্থিতিও হয়ে দাড়িয়ে ছিলো তাই৷ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে না দাড়িয়ে কোন প্রকার সরকার বিরোধী ও সরকার দল বিরোধী আন্দোলনের বিকাশ ঘটানোই তৎকালে সম্ভব ছিলো না। এটা ছিল পরিস্থিতির একটা দিক। অপর দিকটিছিলো এই যে বহু সংখ্যক অসাম্প্রদায়িক যুবক ও উৎসাহী ব্যক্তি দলটিতে যোগদান করতে উৎসাহী ছিলেন কিন্তু আওয়ামী মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক নামের জন্য তাদের পক্ষে সেটা সম্ভব হচ্ছিলো না। কাজেই ‘মুসলিম ‘ শব্দটি নাম থেকে বাদ দিলে তাদের দলে যোগদানের পথ উন্মুক্ত করা হতো। এই সব কারণ একত্রিত হয়ে ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলটির নাম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানী উভয়েই দৃঢভাবে এই নাম পরিবর্তনের পক্ষে ছিলেন। দৃঢভাবে এই নাম পরিবর্তনের বিপক্ষে ছিলেন মুসতাক আহমদ। কাউন্সিলরদের বিপুল অধিকাংশই সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর পেছনে থাকার ফলে বিরাট সংখ্যাধিক্যে নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত হয়।

আওয়ামী লীগ মূলতঃ ছিলো পূর্ব বাঙলার পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক দল। কিন্তু ১৯৫৪ সালের নির্বাচন পর্যন্ত তার মধ্যে শ্রেণী স্বার্থ সম্পর্কিত ইতিবাচক চিন্তা ভালোভাবে দানা বাঁধেনি।
সরকারের বিভিন্ন নির্যাতনমূলক নীতি ও কাজকর্মের বিরোধিতা তারা করেছিলো এবং সেই হিসেবে একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীই সেখানে প্রাধান্যে ছিলো। অর্থাৎ শ্রেণীগত রাজনৈতিক চিন্তার দিক থেকে আওয়ামী লীগের অবস্থা তখনো পর্যন্ত অনেকখানি তরল ছিলো। ১৮৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের শরীক হিসাবে জয়লাভ, মন্ত্রীত্ব গঠন ইত্যাদির পর ধীরে ধীরে দলটির ইতিবাচক শ্রেণী চিন্তা ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে থাকে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া এই পর্যায়ে শুরু হলেও তা একটা সুস্পষ্ট রূপ লাভ করতে আরও কিছু সময় লাগে এবং ১৯৫৭ সালের দিকে আওয়ামী লীগ বাঙালী পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী স্বার্থের রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে পুরোপুরিভাবে গঠিত হয়।

আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক নাম পরিত্যাগ করার পর পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে আওয়ামী লীগের সাথে সহযোগিতার চিত্র দেখা দেয় এবং ক্রমশ প্রবল হয়। ১৯৪৮-৫০ সালের সন্ত্রাসবাদী লাইনের ব্যর্থতার পর কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে বাম বিচ্যুতির পরিবর্তে দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতির অনেক লক্ষণ দেখা যায়। এই লক্ষণগুলির মধ্যে সর্বপ্রধান ছিলো জনগণের কল্যাণে কাজ করার অজুহাতে বুর্জোয়া – পেটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রবেশ করে আত্মরক্ষা এবং আত্মবিকাশ ঘটানোর প্রচেষ্টা।

১৯৫৩ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের মধ্যে কাজ করার অসুবিধা থাকায় এই উদ্দেশ্যে তারা ‘গণতন্ত্রী দল’ নামে একটি পেটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল খাড়া করতে সহায়তা করেন। কিছু সংখ্যক কমিউনিস্ট পার্টি সভ্যকে এই সংগঠনে যোগদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। যুব লীগের সদস্যের গণতন্ত্রী দলের সাথে সম্পর্কিত থাকার ফলে যুব লীগ ও গণতন্ত্রী দল পাশাপাশি কাজ করে এবং অনেক প্রগতিশীল আন্দোলনে শরীক হয়। কিন্তু তৎকালে পূর্ব বাঙলায় পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক আকাংখাগুলি পূর্ণ করার ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট প্রভাবাধীন গণতন্ত্রী দলের প্রগতিশীলতার কতকগুলি দিক ছিলো প্রতিবন্ধক স্বরূপ। এই দিকগুলির মধ্যে ভূমি ব্যবস্থা পরিবর্তনের কর্মসূচী ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতাই ছিল প্রধান। এ কারণে একটি পেটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল হিসেবে গণতন্ত্রী দলের তেমন কোন বিকাশ ঘটছিলো না। এই অবস্থায় বৃহত্তর ‘গণসংযোগে’ র জন্য কমিউনিস্ট পার্টি আরও একটি বড়ো গণতান্ত্রিক দলের মধ্যে কাজ করার বিষয় চিন্তাভাবনা করে এবং এই চিন্তা কমিউনিস্ট পার্টি ও যুক্তফ্রন্ট সরকারের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের হামলা, আওয়ামী লীগের বর্দ্ধমান জনপ্রিয়তা ইত্যাদির প্রেক্ষিতে ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে।

১৯৫৬ সালে কলকাতায় পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির একটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রবেশ করে কমিউনিস্টদের কাজ করার কৌশল সম্পর্কে কিছু বিতর্কের পর বিপুল সংখ্যাধিক্যে আওয়ামী লীগের মধ্যে কাজ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্তের প্রতি আওয়ামী লীগের কোন আনুষ্ঠানিক সমর্থন ছিলো না কারণ এ বিষয়ে কোন চুক্তি অথবা আনুষ্ঠানিক আলোচনা দুই দলের মধ্যে হয় নি। কাজেই আওয়ামী লীগের মধ্যে ঢুকে কাজ করা সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত ছিলো পূর্ব পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির একতরফা এবং ‘গোপনীয় ‘। কিন্তু গোপনীয় হলেও এই সিদ্ধান্তের কথা আওয়ামী লীগের উচ্চতর থেকে নিম্নতম পর্যায় পর্যন্ত সকলেরই জানা ছিলো। কারণ কলকাতা সম্মেলনের পরই কিছু সংখ্যক চিহ্নিত কমিউনিস্ট আওয়ামী লীগের সদস্য পদের জন্য দরখাস্ত করেন। কিন্তু এই জ্ঞান সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ কমিউনিস্টদের এই পদক্ষেপের মধ্যে ক্ষতির থেকে লাভের দিকটির উপরই গুরুত্ব প্রদান করেছিলো বেশী। এবং এই লাভের দিকটি ছিলো আওয়ামী লীগের মধ্যে উৎসাহী যুবক ও কর্মীদেরকে আকর্ষণ করা এবং তার মাধ্যমে সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি ও সাংগঠনিক বিকাশের ব্যাপারে যথেষ্ট আস্থাশীল থাকায় দলের অভ্যন্তরে কমিউনিস্টদের তৎপরতা থেকে তেমন কোন গুরুতর বিপদের আশংকা তারা করেনি।

১৯৫৬ সালের বেশ কিছু সংখ্যক কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্কিত রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগে যোগদানের পর কমিউনিস্ট পার্টি মওলানা ভাসানীকে অবলম্বন করে দলের মধ্যে নিজেদের একটা অবস্থান গড়ে তোলার চেষ্টা করে। এই সাথে তারা চেষ্টা করে আওয়ামী লীগকে নিজেদের একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম হিসেবে গড়ে তুলতে। এ কাজ করতে গিয়ে তারা চেষ্টা করে আওয়ামী লীগকে আরও একটি গণতন্ত্রী দলে পরিণত করতে। (কমিউনিস্টরা আওয়ামী লীগে যোগদানের সিদ্ধান্তের পর গণতন্ত্রী দল বিলুপ্ত হয়।) এজন্য গণতন্ত্রী দলে অবস্থানের সময় তারা যে সব নীতি তার মাধ্যমে কার্যকর করতে চেষ্টা করতো সেই নীতিগুলিই তারা আবার আওয়ামী লীগের মধ্যেও গ্রহণের জন্য চেষ্টা করতে থাকে। এ ব্যাপারে কমিউনিস্টদের মূল অবলম্বন হয়ে দাড়ান প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হাামিদ খান ভাসানী।

১৯৫৪ ও ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান সরকার সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে কয়েকটি সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এই চুক্তিগুলির মধ্যে প্রথম হলো, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংগঠন (সাউথ ইস্ট এশিয়া ট্রেটি অরগানাইজেশন, সিটো। এই চুক্তিটিতে স্বাক্ষরকারী দেশ ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন ও পাকিস্তান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তদারকীতে ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান, ইরাক, ইরান ও তুর্কির সাথে অপর একটি সামরিক চুক্তি করে। তখন চুক্তিটির নাম হয় বাগদাদ প্যাক্ট। কিন্তু ১৯৫৯ সালে ইরাকে রাজতন্ত্র ও সেই সাথে মার্কিন প্রভাব উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর ইরাক চুক্তির বাইরে চলে যায় এবং চুক্তিটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় কেন্দ্রীয় চুক্তি সংগঠন (সেন্টার ট্রেটি অরগানাইজেশন, সেন্টো)। এ ছাড়া পাকিস্তান ১৯৫৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি দ্বিপাক্ষিক সামরিক চুক্তিতেও আবদ্ধ হয়। এই সব চুক্তিগুলির মূল উদ্দেশ্য ছিল সামরিক ভাবে সোভিয়েট ইউনিয়ন ও চীনকে ঘেরাও করা এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের জনগণের বিপ্লবী সংগ্রাম প্রতিহত করা।

কমিউনিস্টরা আওয়ামী লীগে যোগদানের পর সংগঠনের মধ্যেকার প্রগতিশীল অংশের সাথে মিলিতভাবে এই সব সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে প্রচার চালান এবং আওয়ামী লীগ কর্তৃক এগুলি বাতিলের পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণের চেষ্টা করতে থাকেন। এ ব্যাপারে মওলানা ভাসানী তাদের সহায়ক হন এবং তিনি এই চিন্তার স্বপক্ষে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের মধ্যে যথেষ্ট সমর্থন গড়ে তোলেন।

কিন্তু আওয়ামী লীগের মধ্যে এই সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী আন্দোলন যখন জোরদার হয় সে সময়ে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রে একটি কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন (১১ ই সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬)।

সোহরাওয়ার্দী বরাবরই ছিলেন ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে বন্ধুত্বের পক্ষপাতী এবং তাদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহী। সেই হিসেবে তিনি সামরিক চুক্তিগুলির বিরুদ্ধে তো ছিলেনই না, উপরন্তু তিনি ছিলেন এগুলির দৃঢ সমর্থক। এদিক দিয়ে মুসলিম লীগ সরকারের বৈদেশিক নীতির সাথে তার কোন উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ছিলো না, যদিও তিনিই ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি চীন সফর করেন এবং যার আমলে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই পাল্টা সফরে পাকিস্তান আসেন।
আওয়ামী লীগের মধ্যে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা সামরিক চুক্তি বাতিলের জন্য যে চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন তার ফলে সোহরাওয়ার্দীর সাথে ভাসানীর সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে এবং ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে এই দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে।

১৯৫৭ সালের ৭ ই ও ৮ ই ফেব্রুয়ারী মওলানা ভাসানী কাগমারীতে আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের একটি অধিবেশন আহ্বান করেন। এই অধিবেশনে তিনি নিজে পাক – মার্কিন সামরিক চুক্তি এবং সিটো ও সেন্টো চুক্তি বাতিলের জন্য একটি প্রস্তাব উথ্বাপন করেন। মওলানা ভাসানীর সাথে এ বিষয়ে চূড়ান্ত বোঝাপড়ার জন্য এই অধিবেশনে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীও উপস্থিত ছিলেন। কাজেই মওলানা ভাসানী সামরিক চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব পেশ করার পর চুক্তি বাতিলের পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক তিক্ত তর্ক বিতর্ক শুরু হয়। এই বিতর্ক কালে পূর্ব বাঙলার আওয়ামী লীগ মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান, প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সম্পাদক ও মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান, মুসতাক আহমদ প্রভৃতি সোহরাওয়ার্দীকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন এবং মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের মধ্যে তার পুরাতন অনুসারী ও সমর্থকদের সমর্থন লাভে প্রায় সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হন। এক্ষেত্রে তার পেছনে কমিউনিস্ট এবং কমিউনিস্টদের সাথে যুব লীগ থেকে আওয়ামী লীগে আগত ব্যক্তিরাই দৃঢ়ভাবে অবস্থান করেন। এর ফলে প্রস্তাবটি ভোটে দেওয়ার পর বিপুল ভোটাধিক্যে তা নাকচ হয়ে যায় এবং এই ভাবে প্রস্তাবটি নাকচ হয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের শ্রেণী পরিচয়টি পূর্বের থেকে অনেক স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এ দিকে আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে সামরিক চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব নাকচ হয়ে যাওয়ার ফলে মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী ও তার সমর্থকদের সাথে একত্রে কাজ করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং একটি নতুন দল গঠনের উদ্যোগ নেন। এ ব্যাপারে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা তাকে সমর্থন জানান এবং শেষ পর্যন্ত মওলানা ভাসানী তার সমর্থকরা সহ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে ১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন পেটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল গঠন করেন। মওলানা ভাসানী এই দলের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ন্যাপের মধ্যে কমিউনিস্টদের অবস্থান শক্তিশালী হয়। এইভাবে আওয়ামী লীগ পরিত্যাগ করে আসার সময় জুলাই মাসেই মওলানা ভাসানী ঢাকার পল্টন ময়দানের এক জনসভায় পশ্চিম পাকিস্তানকে উদ্দেশ্য করে ‘আসসালামো আলাইকুম’ জানান। পাকিস্তানের দুই অংশের একত্রে থাকা যে শেষ পর্যন্ত সম্ভব নয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থের কথা চিন্তা করেই যে সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগকে একটি অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন এই উপলব্ধি ভাসানীর মধ্যে জন্মানোর ফলেই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের ঐভাবে বিদায় সম্ভাষণ জানান।

১৭. কেন্দ্রীয় সরকারের ভাঙ্গাগড়া

১৯৫৪ সালের ৩০ শে মে পূর্ব বাংলার ৯২ (ক) ধারা জারী করে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেয়ার পর থেকে পূর্ব বাংলায় মন্ত্রীত্বের যে ভাঙ্গাগড়া শুরু হয় তাকে সারা পাকিস্তানের প্রেক্ষিতে দেখতে হলে কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে কি ধরণের ভাঙ্গন ও রদবদল এই পর্যায়ে দেখা দিয়েছিলো সেটার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

১৯৫৩ সালের ১৭ ই এপ্রিল গভর্নর জেনারেল গোলাম মহম্মদ প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনকে আকস্মিকভাবে পদচ্যুৎ করেন এবং ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মহম্মদ আলীকে তলব করে এনে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব তার ওপর অর্পণ করেন। গণপরিষদের সাথে কোন পরামর্শ না করে এবং বিষয়টি সেখানে বিবেচিত হতে না দিয়েই তিনি তার বিশেষ ক্ষমতাে ব্যবহার দ্বারা এই রদবদল ঘটান। পরে ঐ বৎসরই ১৭ ই অক্টোবর তারিখে প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ আলীকে পাকিস্তান মহম্মদ আলীকে পাকিস্তান মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সভাপতিও নির্বাচিত করা হয়। এ সব কিছুই ঘটে গভর্নর জেনারেল গোলাম মহম্মদের নির্দেশে।

এর প্রায় ১ বৎসর পর পাকিস্তান গণপরিষদের ১৯৫৪ সালের ২১ শে সেপ্টেম্বর অধিবেশনে পাকিস্তানের আইন সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রী অথবা অন্য কোন মন্ত্রীকে পদচ্যুত করা সম্পর্কিত গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা লোপ করা হয়। গণপরিষদের এই পদক্ষেপের পর ২৪ শে অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে গভর্নর জেনারেল গোলাম মহম্মদ সমগ্র পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন এবং গণপরিষদ ভেঙ্গে দেন। নতুন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত মন্ত্রীসভা পুনর্গঠন করে তিনি প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ আলীকে শাসনকার্য চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। এই নির্দেশ অনুযায়ী মন্ত্রীসভা পুনর্গঠন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ আলী ১৯৫৪ সালের ২০ শে ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে এবং পরে ১৯৫৫ সালের জানুয়ারীতে আবু হোসেন সরকারকে মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে গ্রহণ করেন।

ইতিপূর্বে গণপরিষদ ভেঙ্গে দেওয়ার পর গণপরিষদের সভাপতি তামিজুদ্দীন খান সিন্ধু চীফ কোর্টে গভর্নর জেনারেলের ঘোষণার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন। মামলা শেষ পর্যন্ত ফেডারেল কোর্টে গেলে ১৯৫৫ সালের ১০ ই মে পাকিস্তান ফেডারেল কোর্ট এই মর্মে সর্বসম্মত রায় প্রদান করেন যে, গভর্নর জেনারেল আইনতঃ গণপরিষদ বাতিল করতে পারেন।

ইতিমধ্যে ২৭ শে মার্চ, ১৯৫৫ তারিখে গভর্নর জেনারেল কেন্দ্রীয় সরকারের ১৯৫৫-৫৬ সালের বাজেট অনুমোদনের ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং এ ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের সকল দেশীয় রাজ্য ও প্রদেশকে এক ইউনিটভুক্ত করার এবং পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান রাখার ক্ষমতাও গ্রহণ করেন।

১৫ ই এপ্রিল গোলাম মহম্মদ একটি সরকারী আদেশ জারী করে ১০ ই ও ১১ ই মে তারিখে পশ্চিম পাকিস্তানের মারী শহরে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী কনভেনশন আহ্বান করেন। এরপর দিনই তিনি এক ঘোষণা প্রকাশ করে দেশের শাসন তান্ত্রিক ব্যবস্থা ও শাসনযন্ত্রের সম্ভাব্য বিপর্যয় রোধের উদ্দেশ্যে এবং রাষ্ট্রীয় সংহতি ও সরকারের বর্তমান অবস্থা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় আইন সমূহ বৈধকরণ এবং প্রয়োগের উপযোগী ক্ষমতা নিজ হাতে গ্রহণ করেন। ২৭ শে এপ্রিল তিনি অপর একটি ঘোষণায়, ভারত স্বাধীনতা আইনের ৮ ধারা অনুযায়ী গণপরিষদ কর্তৃক প্রয়োগযোগ্য সমস্ত ক্ষমতা শাসনতান্ত্রিক কনভেনশনকে অর্পণ করেন।

১০ ই ও ১১ ই মে মারীতে অনুষ্ঠিত শাসনতান্ত্রিক কনভেনশনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা একত্রিত হন এবং কতকগুলি শাসনতান্ত্রিক বিষয়ে ঐক্যমতে পৌছান। এ বিষয়গুলি হলো পাকিস্তানের দুই অংশে দুটি প্রদেশ গঠন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলিকে একই প্রশাসনিক ইউনিটের অন্তর্ভুক্তিকরণঃ দুটি প্রদেশেই পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন এবং তাদের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নির্দিষ্টকরণঃ সরকার ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দুই অংশের মধ্যে সমতা রক্ষা করাঃ কোন সম্প্রদায়ের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা না রেখে যৌথ নির্বাচন প্রথার মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠান ; এবং বাংলা ও উর্দু উভয়কেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ।

এই ঐক্যমত্যকেই বলা হয় মারী চুক্তি এবং এই চুক্তির পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবস্থা পরিষদ সমতার ভিত্তিতে একটি জাতীয় গণপরিষদ নির্বাচিত করেন।

১৯৫৫ সালের ৭ ই আগস্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা গভর্নর জেনারেল হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ঐদিনই পাকিস্তানের অর্থ সচিব চৌধুরী মহম্মদ আলী করাচীতে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা নির্বাচিত হন এবং প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মহম্মদ আলী পদত্যাগ করেন৷ এরপর ১১ ই আগস্ট চৌধুরী মহম্মদ আলীর নেতৃত্বে একটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। ৩১ শে সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের গণপরিষদ ৪৩-১৩ ভোটে পশ্চিম পাকিস্তান একত্রীকরণ বিল পাশ করে। ১৯ শে অক্টোবর গোলাম মহম্মদ গভর্নর জেনারেলের পদে ইস্তফা প্রদান করেন।

১৯৫৬ সালের ২৯ শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান গণপরিষদে ইসলামী প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র পাকিস্তানের শাসনযন্ত্র গৃহীত হয় এবং ৫ ই মার্চ তারিখে ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। এরপর ২৩ শে মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সংবিধান প্রবর্তিত হয়।

১৮. পূর্ব বাংলায় মন্ত্রীত্বের ভাঙ্গন ও রদবদল

মারী শাসনতান্ত্রিক সম্মেলনের পর ৬ ই জুন, ১৯৫৫ তারিখে পূর্ব বাংলার গভর্নর আবু হোসেন সরকারকে প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা গঠনের আহ্বান জানান। সেই অনুযায়ী আবু হোসেন সরকার আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে একটি মন্ত্রীসভা গঠন করেন। পূর্ব বাংলা ব্যবস্থা পরিষদে তাদের কোন সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় আবু হোসেন সরকার প্রাদেশিক পরিষদের কোন অধিবেশন আহ্বান না করেই কাজ চালিয়ে যান৷

১৯৫৬ সালের ২১ শে মে আবু হোসেন সরকার জন নিরাপত্তা আইনে আটক সকল রাজবন্দীদের মুক্তিদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন এবং এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পূর্ব বাংলার জেলগুলি থেকে বহু সংখ্যক কমিউনিস্ট রাজবন্দীও মুক্তি লাভ করেন। এদের অনেকেই ১৯৪৮-৫০ সালের দিকে গ্রেফতার হয়ে বিনাবিচারে জেলে আটক ছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে রাজবন্দীদের মুক্তি ছিলো ২১ দফার একটি গুরুত্বপূর্ণ দফা।

২২ শে মে, ১৯৫৬ তারিআে পূর্ব বাংলা ব্যবস্থা পরিষদের বাজেট অধিবেশন আহ্বান করা হয় কিন্তু সেদিন পরিষদের স্পীকার আবদুল হাকিম বাজেট পেশের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন। তুমুল হট্টগোলের মধ্যে স্পীকার ঘোষণা করেন যে, তিনি মুখ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারকে বাজেট পেশ করার অনুমতি দেবেন না। এই ঘোষণার পর তিনি অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিষদের অধিবেশন মুলতুবী ঘোষণা করেন।

এই ঘটনার চারদিন পর ২৬ শে মে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা ১৯৩ ধারা জারী করে পূর্ব পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা নিজের হাতে গ্রহণ করেন এবং এর ফলে প্রাদেশিক মন্ত্রীসভাও বাতিল হয়ে যায়। এর মাত্র কয়েকদিন পর ১ লা জুন তারিখে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা পূর্ব পাকিস্তানে আবার শাসনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং আবু হোসেন মন্ত্রীসভা পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।

এই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য পরিস্থিতির ভয়ানক অবনতি ঘটে। ১৯৫৬ সালের ৫ ই মার্চ ফজলুল হক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং খাদ্য পরিস্থিতি মোকাবেলার উদ্দেশ্যে তিনি ৩০ শে জুন সেনাবাহিনীর হাতে খাদ্য বন্টন, পরিবহন ও পরিকল্পনার সকল ভার অর্পণ করেন। ১২ ই জুন পূর্ব পাকিস্তানের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল জিলানী প্রদেশের খাদ্য সংক্রান্ত দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ইতিপূর্বে সামরিক বাহিনীর হাতে খাদ্য সম্পর্কিত সকল দায়িত্বভার অর্পনের উদ্দেশ্যে গভর্নর ফজলুল হক খাদ্য সংক্রান্ত অপরাধের জন্য বেত্রাঘাত, জরিমানা ও কারাদণ্ডের ব্যবস্থা সম্বলিত একটি অর্ডিন্যান্স জারী করেন। এই অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী এক মাসের মতো সময়ে সামরিক বাহিনী বেশ কিছু সংখ্যক লোককে কারাদণ্ড, জরিমানা ও বেত্রাঘাতের দন্ডে দন্ডিত করে।

১২ ই আগস্ট প্রাদেশিক সরকারের একটি ইস্তাহারে বলা হয় যে, সামরিক বাহিনীর উপর খাদ্য সম্পর্কিত দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালিত হওয়ার পর খাদ্য দফতরের ভার প্রাদেশিক সরকার আবার নিজ হাতে ফিরিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু এর ৫ দিন পরই সীমান্ত এলাকায় খাদ্য চোরাচালান বন্ধ করার উদ্দেশ্যে সীমান্ত এলাকার খাদ্য শাসন ব্যবস্থা পুনরায় সামরিক বাহিনীর হাতে অর্পণ করা হয়।

ঠিক এই সময় প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। ১৩ ই আগস্ট প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশন শুরু হওয়ার কয়েক ঘন্টা পূর্বে অপ্রত্যাশিত ভাবে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর বাজেট অধিবেশন বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করে একটি নির্দেশ জারী করেন। এরপর বাজেটের ব্যাপারে অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার ৩০ শে আগস্ট গভর্নর ফজলুল হকের কাছে তার মন্ত্রীসভার পদত্যাগপত্র দাখিল করেন।

সরকারের এই অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে ৩ রা সেপ্টেম্বর ডেমরা, মাউতাইল, কামারপাড়া, লইনপুরা, মুন্সিগঞ্জের তনতরা ও বেলতলী এবং ঢাকা শহরের রায়েরবাজার ইত্যাদি এলাকা থেকে প্রায় দশ হাজার নরনারী খাদ্যের দাবীতে ঢাকা আসে এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পরদিন ঢাকায় আবার খাদ্যের দাবীতে মিছিল বের হয় এবং জনতার সাথে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। এই সংঘর্ষে ৪ জন নিহত ও ৩ জন আহত হয়। খাদ্যের দাবীতে এই বিক্ষোভ আওয়ামী লীগের দ্বারাই সংগঠিত হয়।

এই ঘটনার ৩ দিন পর ৬ ই সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬ তারিখে গভর্নর ফজলুল হক ঢাকায় উপস্থিত প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার নির্দেশে আওয়ামী লীগকে মন্ত্রীসভা গঠনের আহ্বান জানান এবং আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভা ঐ দিনই শপথ গ্রহণ করে। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ইস্কান্দার মীর্জা উপস্থিত থাকেন এবং ঐদিন রাত্রেই সোহরাওয়ার্দীকে সাথে নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন৷ এর দুইদিন পর চৌধুরী মহম্মদ আলী ৮ ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দেন এবং ১১ ই সেপ্টেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করেন। আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ২০ শে সেপ্টেম্বর তারা পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থা পরিষদে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক জননিরাপত্তা আইন বাতিল করে। ৩০ শে সেপ্টেম্বর একটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত বেসরকারী প্রস্তাব অনুযায়ী পাকিস্তান সরকারের প্রত্যেক বিভাগে অবিলম্বে বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে চালু করার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ১ লা অক্টোবর, ১৯৫৬ তারিখে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তনের সুপারিশ করে একটি প্রস্তাব উথ্বাপন করেন। প্রস্তাবটি ১৫৯-১ ভোটে গৃহীত হয়।

এই পদক্ষেপগুলির মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক জননিরাপত্তা আইন বাতিল। কিন্তু এই আইন বাতিলের দ্বারা কার্যক্ষেত্রে তেমন কোন আইনগত গণতান্ত্রিক অধিকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দ্বারা অর্জিত হতে পারেনি। কারণ যে আওয়ামী লীগ প্রদেশে এই ধরণের একটি অগণতান্ত্রিক আইন বাতিল করেছিলো তারাই আবার কেন্দ্রীয় পরিষদে নিরাপত্তা আইনের স্বপক্ষে ভোট দিয়ে এক হাতে দেয়া অধিকার অন্য হাতে কেড়ে নিয়েছিলো। এর ফলে জাতীয় নিপীড়ন ও শ্রেণী নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে নিরাপত্তা আইন পরবর্তী পর্যায়ে পূর্বের মতোই পূর্ব পাকিস্তানে কার্যকর ছিলো।

১৯. কেন্দ্র ও দুই প্রদেশে শাসনতান্ত্রিক নৈরাজ্য

১৯৫৬ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন এবং ১৯৫৭ সালের ১১ ই অক্টোবর পদত্যাগ করেন। মধ্যবর্তী এই তেরো মাসের প্রধানমন্ত্রীত্ব কালে তিনি এমন কোন কাজই করেননি যা উল্লেখের যোগ্য এবং জনগণের স্বার্থের পক্ষে নিতান্ত অনুকূল। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তার সরকার কৃষক শ্রমিকের পক্ষে স্বার্থোপযোগী কোন পরিবর্তন সাধন করতে পারেনি এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সামরিক চুক্তিগুলি রক্ষা করে ও অন্য অনেক অপকীর্তি করে পাকিস্তানকে দক্ষিণ এশিয়ার ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একটি খুঁটি হিসেবে পরিচিত হতেই সাহায্য করেছিলো। তার এইসব নীতির প্রভাব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের উপরও পড়েছিলো এবং তার ফলে দলটির মধ্যে দক্ষিণপন্থী ঝোঁক ক্রমশ প্রবল হচ্ছিলো। ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কাগমারীতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে এই ঝোঁকেরই একটি দৃঢ় বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠ প্রতিনিধিদের দ্বারা মওলানা ভাসানী উপস্থিত সামরিক চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব বাতিল হয়ে যাওয়ার মধ্যে।

কেন্দ্র সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভার পতনের পর ১৮ ই সেপ্টেম্বর ইসমাইল ইব্রাহিম চুন্দ্রীগর একটি কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করেন কিন্তু দুই মাসেরও কম সময় পর ১১ ই ডিসেম্বর তারিখে তিনি পদত্যাগ করেন। এর পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন পূর্ব পাকিস্তানের এক কালীন গভর্নর ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফিরোজ খান নূন।

এই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানেও মন্ত্রীত্বের অনেক রদবদল ঘটে এবং কোন স্থিতিশীল সরকার গঠন কারও পক্ষেই সম্ভব হয় না। পূর্ব পাকিস্তানে অবশ্য শাসনতান্ত্রিক নৈরাজ্য আরও বেশী ঘোরতর আকার ধারণ করে।

কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে গুরুতর মতবিরোধ সৃষ্টি হওয়ায় ইস্কান্দার মীর্জা প্রাদেশিক গভর্নরের পদ থেকে ফজলুল হককে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেন। ৩১ শে মার্চ, ১৯৫৮ তারিখে অপসারিত হওয়ার ঠিক পূর্বে ফজলুল হক আতাউর রহমানের মন্ত্রীসভাকে বরখাস্ত করেন এবং আবু হোসেন সরকারকে রাতারাতি সরকার গঠনের নির্দেশ দেন ও তার মন্ত্রীসভাকে শপথ গ্রহণ করান। তবে আবু হোসেন সরকারের সেই মন্ত্রীত্ব ১২ ঘন্টার বেশী স্থায়ী হয় নি। হামিদ আলী অস্থায়ী গভর্নর রূপে ১ লা এপ্রিল সকালে শপথ গ্রহণ করার পরই আবুল হোসেন সরকারকে বরখাস্ত করেন এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আতাউর রহমান খানকে মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করেন ও তার মন্ত্রীসভাকে শপথ গ্রহণ করান।

পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম হওয়ার জন্য ১৮ ই জুন বিরোধী দল একটি ছাটাই প্রস্তাব উথ্বাপন করেন এবং সেই প্রস্তাবের উপর গৃহীত ভোটে পরাজিত হওয়ায় আতাউর রহমান খান নতুন গভর্নর সুলতানউদ্দীন আহমেদের কাছে পদত্যাগ পত্র পেশ করেন। এই ভোটাভুটিতে সরকারের পক্ষে ১২৬ ও বিপক্ষে ১৩৮ ভোট প্রদত্ত হয়। বিরোধী পক্ষে কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ, তফসিল জাতি ফেডারেশন, ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ পার্টি, দলত্যাগী আওয়ামী লীগ ও দলত্যাগী কংগ্রেস সদস্যরা ভোট প্রদান করেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ২৮ জন সদস্যের মধ্যে ১৯ জন উপস্থিত থাকলেও তারা পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভোট দানে বিরত থাকেন। এইভাবে আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভার পতনের পর ২০ শে জুন তারিখে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আবু হোসেন সরকার পুনরায় শপথ গ্রহণ করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।

কিন্তু ২০ শে জুন নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করলেও আবু হোসেন সরকারের এই মন্ত্রীত্ব স্থায়ী হয়েছিলো মাত্র ৭৫ ঘন্টা। ২৩ শে জুন, ১৯৫৮ তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান আবু হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উথ্বাপন করেন এবং প্রস্তাবটি ১৫৬-১৪২ ভোটে গৃহীত হয়। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ২৮ জন সদস্য আওয়ামী লীগের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট প্রদান করেন। এইভাবে আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রীত্বের পতনের পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা দুই মাসের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৩ ধারার শাসন প্রবর্তন করেন।

ঠিক দুই মাস কেন্দ্রের শাসন বলবৎ থাকার পর ২৫ শে আগস্ট আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে ৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়।

এই সময়ে শুধু যে আওয়ামী লীগের সাথে যুক্তফ্রন্টের অন্য শরীক দলগুলির দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে তাই নয় মন্ত্রীত্বের বখরা ভাগাভাগি নিয়ে এ সময় প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান এবং প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের প্রতাপশালী সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে উপদলীয় চক্রান্ত মন্ত্রী সভায় ও পার্লামেন্টারি পার্টির মধ্যে অনেক সমস্যার সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগের এই অভ্যন্তরীণ সংকট পূর্ব পাকিস্তানে শাসনতান্ত্রিক নৈরাজ্য বাড়িয়ে তোলে।

এই অবস্থায় ২০ শে সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ব্যবস্থা পরিষদের অধিবেশন কালে আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি এবং অপরাপর দলগুলির মধ্যে পরিষদের অভ্যন্তরে এক দাঙ্গা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে তারা স্পীকারের উপরও হামলা করেন। ফলে পরিষদের অধিবেশনে সেদিন মুলতবী হয়ে যায়।

তিনদিন পর ২৩ শে সেপ্টেম্বর পরিষদের অধিবেশন আবার শুরু হলে তার সাথে সাথে দাঙ্গা পরিস্থিতিরও পুনরাবৃত্তি ঘটে। এই দাঙ্গার সময় সদস্যরা এলোপাথাড়ীভাবে পরস্পরকে নানা ধরণের জিনিস ছুঁড়ে মারতে থাকার সময়ে ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী মাথায় গুরুতর আঘাত পান। ডেপুটি স্পীকার ছাড়া অপর চারজন পরিষদ সদস্যও এই মারামারির ফলে আহত হন। ডেপুটি স্পীকারকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয় এবং দুইদিন পর ২৫ শে সেপ্টেম্বর সেখানে তার মৃত্যু ঘটে।

২০. পাকিস্তান সামরিক শাসন জারী

সংসদীয় বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলির কার্যকলাপের ফলে ব্যাপক জনগণ ক্রমশ আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টিসহ অপর পার্টিগুলির প্রতি বীতশ্রদ্ধ ও বিরূপ হয়ে ওঠেন। কিন্তু ২০ শে ও ২৩ শে সেপ্টেম্বরের ঘটনাবলী এবং ২৫ শে তারিখে ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলীর মৃত্যু তাদের প্রতি জনগণের শেষ আস্থারও অবসান ঘটায়। তাদের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য জনগণের মধ্যে একটা নিদারুণ অস্থিরতা আসে।

এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা সারা পাকিস্তানে সামরিক আইন জারী করেন। সেই সাথে তিনি ১৯৫৬ সালে গৃহীত শাসনতন্ত্র বাতিল করেন, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারসমূহ ভেঙ্গে দেন এবং দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল মুহম্মদ আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক প্রশাসক নিযুক্ত করে সামরিক আইন পরিচালনার ভার তার উপর অর্পণ করেন।

১১ ই অক্টোবর পূর্ব বাংলার প্রাক্তন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ জাকির হোসেন পূর্ব বাংলার গভর্নর হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করেন। পরদিন ১২ ই অক্টোবর পাকিস্তান দূর্নীতি দমন আইন এবং ১৯৫৮ সালের ৭২ নং অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদ ও হামিদুল হক চৌধুরী, প্রাক্তন প্রাদেশিক মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও আবদুল খালেক বিলুপ্ত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নুরুদ্দীন আহমদ, আবদুল হামিদ চৌধুরী, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অতিরিক্ত চীফ হুইপ কোরবান আলী এবং কয়েকজন আমলাকে গ্রেফতার করে। সেই সাথে ঐ একইদিন পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে (যে আইন পাশ করার জন্য আওয়ামী লীগওয়ালারা কেন্দ্রীয় পরিষদে ভোট প্রদান করেছিলেন) মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে মীর্জাপুর হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে এসে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আটক করা হয়।

পশ্চিম পাকিস্তানেও এই ধরণের কিছু ধরপাকড়ের পর ২৪ শে অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা ১২ সদস্য বিশিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা গঠন করেন এবং জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। এই ১২ জনের মধ্যে ৪ জন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানী।

ইস্কান্দার মীর্জা এইভাবে মন্ত্রীসভা গঠন করার পর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রভাবশালী কয়েকজন জেনারেল তাকে বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই অনুযায়ী জেনারেল আজম খান, জেনারেল শেখ ও জেনারেল বাকী ২৭ শে অক্টোবর ইস্কান্দার মীর্জার কাছে গিয়ে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন এবং জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন। মীর্জা যেসব ব্যক্তিকে নিজের মন্ত্রী পরিষদের অন্তর্ভুক্ত করেন তাদের সকলকেই প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মন্ত্রীসভায় বহাল রাখা হয়।

২১. পাকিস্তানে সংসদীয় শাসন অবসানের কারণ ও তাৎপর্য

পাকিস্তানে সংসদীয় শাসনের অবসান কোন আকষ্মিক ব্যাপার ছিলো না। ১৯৫৩ সাল থেকেই প্রথম কেন্দ্রে এবং পরে সেই সাথে প্রদেশগুলিতে যথাক্রমে গভর্নর জেনারেল গোলাম মহম্মদ ও ইস্কান্দার মীর্জা স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ এবং মন্ত্রীত্ব ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে দিয়ে সংসদীয় শাসনকে দ্রুত অবসানের পথে চালনা করেন। কিন্তু এই ভাঙ্গাগড়ার কাজটি তাদের মাধ্যমে সংঘটিত হলেও তাদের ক্ষমতার লোভকেই এর জন্য মূলতঃ দায়ী করা চলে না। এইসব পরিবর্তনের মূল কারণ পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক ভিত্তিভূমি এবং ঐতিহাসিক বিকাশের মধ্যেই নিহিত ছিলো। এবং সেটা থাকার কারণেই গভর্নর জেনারেলের পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলোচ্ছেদ করা।

কেন্দ্র এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারের ক্ষেত্রে গভর্ণর জেনারেল কি ধরণের হস্তক্ষেপ করেছেন সেটা আমরা দেখেছি৷ পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও ঠিক সে রকমটিই ঘটেছিলো। ১৯৫৪ সালের ৮ ই নভেম্বর সিন্ধুর গভর্নর কর্তৃক পীরজাদার মন্ত্রীসভা পদচ্যুত হয়। ১৯৫৫ সালের ২১ শে মে পাঞ্জাবের গভর্নর গুরমানী ফিরোজ খান নূনের পাঞ্জাব মন্ত্রীসভাকে বরখাস্ত করেন। তারপর ১ লা আগস্ট, ১৯৫৫ তারিখে পাঞ্জাব মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ৩ জন সহচরসহ নূনকে মুসলিম লীগ থেকে ৫ বৎসরের জন্য বহিষ্কার করেন। এর ফলে ১৯৫৭ সালের ২০ শে মার্চ প্রেসিডেন্ট মীর্জার পশ্চিম পাকিস্তানের মন্ত্রীসভা বাতিল করে শাসনতন্ত্রের ১৯৩ ধারা অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনভার নিজ হাতে গ্রহণ করেন।

পরে ১৯৫৭ সালেই সেখানে শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করে সরদার আবদুর রশীদকে (পূর্বে একে উত্তর – পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়) পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। এর পর ১৯৫৮ সালের ১৮ ই মার্চ তাকে পদচ্যুত করে পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোজাফফর আহমদ কিজিলরাশকে নিযুক্ত করেন। ঐ বৎসরই ৯ ই মে তারিখে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও খান আবদুল গাফফার খানের ভ্রাতা ডক্টর খান সাহেব লাহোরে এক আততায়ীর হাতে নিহত হন।

এইসব ঘটনা প্রবাহের দিকে তাকালে বোঝা যায় যে, পাকিস্তানে শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা অবসানের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল এবং সামরিক শাসন ব্যতীত সেই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার অপর কোন পথই উন্মুক্ত ছিলো না।

আসলে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যে ভাঙ্গাগড়া চলছিলো তার মূল কারণ পূর্ব পাকিস্তানে যত না নিহিত ছিল তার থেকে অনেক বেশী নিহিত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। শুধু তাই নয়, পূর্ব পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক নৈরাজ্য সৃষ্টির মূল কারণও ছিলো কেন্দ্রের মাধ্যমে তার উপর পশ্চিম পাকিস্তানের বিকাশমান সংকটের ক্রমবর্ধমান চাপ।

এই সংকটের চরিত্র কি ছিলো? এক কথায় বলা চলে পশ্চিম পাকিস্তানে ১৯৪৭ সাল থেকে প্রাপ্ত সমস্ত প্রভাবিত রাজনৈতিক ক্ষমতার কাঠামোর সাথে নবগঠিত পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক শক্তির এমন এক দ্বন্দ্ব যা প্রচলিত শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে মীমাংসিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিলো না। পশ্চিম পাকিস্তানী সামন্তবাদী ভূস্বামী শ্রেণী বিস্তৃত গ্রামাঞ্চলে ভোট নিয়ন্ত্রণ করতো এবং তারই জোরে তারা ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতায় এসেছিলো। তারপর পাকিস্তানেও সেই একই শ্রেণী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলো। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত কোন পরিবর্তনই এই অবস্থার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি।

কিন্তু এইভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও ভূস্বামী শ্রেণী জনগণের ও জাতির সামনে কোন নতুন কর্মসূচী উপস্থিত করতে পারেনি। পরিস্থিতির পরিবর্তনের তাগিদে শ্রেণীগত ভাবে তারা কোন উল্লেখযোগ্য সরকার পর্যন্ত সমাজ কাঠামোর মধ্যে উপস্থিত করতে সক্ষম হয়নি। অপর দিকে ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানে অর্থাৎ মূলতঃ পশ্চিম পাকিস্তানে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছিলো, তার ফলে সেখানে সৃষ্টি হয়েছিলো একটি প্রতিপত্তিশালী পুঁজি মালিক শ্রেণী। এই পুঁজি মালিকদের বিরাট অংশ আবার ছিলো বহিরাগত। এরা অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলো, পুঁজির বিকাশের জন্য একটা আমূল ভূমি সংস্কার এদের পক্ষে প্রয়োজনীয় হয়েছিলো, অন্যান্য অনেক সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করার তাগিদও তাদের মধ্যে ছিলো কিন্তু উপযুক্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা তাদের হাতে ছিলো না। সামন্তবাদী রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ক্ষমতার মধ্যে এই দ্বন্দ যত তীব্র হচ্ছিলো ততই এক ধরণের সংগ্রাম এই দুই শ্রেণীর মধ্যে হচ্ছিলো তীব্র থেকে তীব্রতর এবং তারই প্রতিফলন ঘটছিলো ক্রমবর্ধমান শাসনতান্ত্রিক নৈরাজ্যের মধ্যে।

এই প্রক্রিয়ার একটা দিক ছিলো রাজনৈতিক ক্ষমতা ক্রমশঃ রাজনৈতিক দলের ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাত থেকে আমলাতন্ত্রের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া। এবং পরিস্থিতি অধিকতর সংকটজনক হওয়ার সাথে সাথে পর্দার অন্তরালে ও তারপর সরাসরি তা সামরিক বাহিনীর কাছে হস্তান্তরিত হওয়া। এইভাবে প্রক্রিয়াটি কাজ করার ফলেই কেন্দ্র ও পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিবর্গ পরিণত হচ্ছিলেন আমলাতন্ত্র ও সামরিক অফিসারদের হাতের পুতুলে এবং সরকার ও মন্ত্রীসভা রদবদলের নামে তারা এক ধরনের পুতুল নাচের মাধ্যমেই এক শ্রেণীর হাত থেকে ক্ষমতা অপর শ্রেণীটির কাছে হস্তান্তরের কাজ করে চলছিলো। এই কাজ প্রকৃতপক্ষে ছিলো বিকাশমান অর্থনৈতিক ক্ষমতার সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতার সামঞ্জস্য বিধান। পাকিস্তানের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এইভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যতীত উপরোক্ত সামঞ্জস্য বিধানের অপর কোন বিকল্প পথ ছিলো না।

সামন্তবাদী ব্যবস্থায় শোষণের মূল রূপটি হয় ভূমি খাজনা ও রাজস্ব আদায়। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এই শোষণের মূল রূপ দাড়ায় প্রত্যক্ষ ভাবে শ্রমশক্তি শোষণ ও পরোক্ষভাবে বাজারের শোষণ। এই দুই শোষণই পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দীক পাকিস্তানের বড় পুঁজি পশ্চিম পাকিস্তানের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চল উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং সেই সাথে পাঞ্জাবের জনগণের উপর জারী করেছিলো৷ কিন্তু এই প্রদেশগুলির মধ্যে পাঞ্জাব যেহেতু সব থেকে বড় এবং সবদিক দিয়ে শক্তিশালী ছিলো সেজন্য পাঞ্জাবের বিভিন্ন শ্রেণীর লোকের উপর এই শোষণ নির্যাতনের মাত্রা ছিলো অপেক্ষাকৃত কম।

পশ্চিম পাকিস্তানের অনুন্নত অঞ্চলগুলির যখন এই অবস্থা তখন পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা যে তার থেকে কিছু ভালো হবে না সেইটা স্বাভাবিক। কারণ পূর্বোল্লিখিত বিভিন্ন কারণে পাকিস্তানের দুই অংশে ক্ষমতার ভারসম্যের অভাব প্রথম থেকেই ছিলো এবং সেই অনুযায়ী শোষণের মাত্রার পার্থক্যও ছিলো। এজন্য পূর্ব পাকিস্তানে শ্রেণী শোষণের ক্ষেত্রে সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী ক্ষমতার দ্বন্দ্বের থেকে অনেক বেশী তীব্র ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের উপর পাকিস্তানের বড় পুঁজির জাতীয় নিপীড়ন থেকে উদ্ভুত দ্বন্দ্ব, যে দ্বন্দ্বের একপক্ষ ছিলো কেন্দ্রীয় সরকার (আমলাতন্ত্র, সেনাবাহিনী, পুঁজি মালিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি) এবং অপরদিকে ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ও প্রায় সর্ব শ্রেণীর মানুষ। এই দ্বন্দ্ব যতই বিকাশ লাভ করছিলো ততই পরিস্থিতি আয়ত্তে রাখার জন্য কেন্দ্রের পক্ষে প্রয়োজন হচ্ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার ও প্রশাসনে হস্তক্ষেপ এবং এই হস্তক্ষেপ আমলাতান্ত্রিক ও সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে সম্ভব ছিলো না। এই পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে সংকটজনক ছিলো এবং এই সংকটের প্রতিফলন ঘটছিলো পূর্ব পাকিস্তান শাসনতান্ত্রিক নৈরাজ্যের মধ্যে।

পূর্ব পাকিস্তানে সামন্ত অবশেষের প্রতিভূ ভূমি মালিকদের, মহাজনদের, ফড়িয়া ব্যবসাদারদের ও আঞ্চলিক ছোটখাট শিল্প পুঁজির শোষণ জনগণের উপর ছিলো, কিন্তু যে জাতিগত শোষণ ও সেই সাথে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নির্যাতন কেন্দ্রীয় সরকার ও পাকিস্তানী বড় পুঁজি পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র জনগণের উপর জারী রেখেছিলো তার ফলে সামগ্রিক ভাবে পূর্ব পাকিস্তানের উপর শোষণ ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের অনুন্নত অঞ্চলগুলির উপর শোষণ ও নির্যাতনের থেকেও বেশী। এই শোষণ নির্যাতন পূর্বে বর্ণিত পাকিস্তানের সামগ্রিক ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যেই কার্যকর হতো।

পূর্ব পাকিস্তানের উপর এই অতিরিক্ত শোষণ নির্যাতনের ফলে এখানে প্রতিরোধের তীব্রতা ও ব্যপ্তীও ছিলো তুলনায় অধিক। ‘কি করিতে হইবে ‘ নামক বিখ্যাত রচনায় রাজনৈতিক সংগ্রামের বিকাশ প্রসঙ্গে লেনিন বলেছিলেন যে, অনেক সময় অর্থনৈতিক নয় এমন শোষণ নির্যাতন ব্যাপকতর ও গভীরতর রাজনৈতিক সংগ্রামের জন্মদান করতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানে তার উদাহরণ অনেক ছিলো, যার মধ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন হলো সব থেকে উল্লেখযোগ্য। পূর্ব পাকিস্তানে এই ধরণের নির্যাতনের পরিমাণ অনেক বেশী হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার এই অঞ্চলের জনগণের সংগ্রামকে খুব আশংকা ও ভীতির চোখে দেখতো এবং সর্বদা তাকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য সতর্ক ও সচেষ্ট থাকতো। তাদের এই সতর্কতা ও সচেষ্টতা অনেক ক্ষেত্রেই স্পর্শকাতরতায় পরিণত হতো এবং তার ফলে পরিস্থিতি অধিকতর জটিল আকার ধারণ করতো।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয়ের পর পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক পরিস্থিতির যে বিকাশ ঘটেছিলো, তাতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অনেক সম্ভাবনা ছিল। এবং আওয়ামী লীগ সেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করতে পারতো। কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি৷ তার কারণ শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্বোল্লিখিত সংকটের আঘাত আওয়ামী লীগের উপর পড়েছিলো এবং সেই আঘাতে আওয়ামী লীগের যেটুকু গণতান্ত্রিক চরিত্র ছিলো সেটাও দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছিলো। আওয়ামী লীগ থেকে মওলানা ভাসানীর বিদায় এই আঘাত ব্যতীত সম্ভব ছিলো না।

কেন্দ্রীয় সরকারও সেই সাথে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের উপর প্রত্যক্ষভাবে আমলাতান্ত্রিক ও পরোক্ষভাবে সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে বড় পুঁজির হামলার ফলে মন্ত্রীত্বে যে রদবদল ঘটেছিলো তা পাকিস্তানের বিদ্যমান শাসনতান্ত্রিক কাঠামোকে ছিন্নভিন্ন করেছিলো৷ এই অবস্থায় পাকিস্তানের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র পথ ছিলো সামরিক বাহিনী ও আমলাতন্ত্র কর্তৃক সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণ। এই কাজটিই তারা করেছিলো ১৯৫৫ সালের ৭ ই অক্টোবর এবং তারপর ২৭ ই অক্টোবর। এই প্রক্রিয়া ব্যতীত বড় পুঁজির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন দ্বিতীয় পথ ছিলো না। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন প্রবর্তন তাই বস্তুতপক্ষে ছিলো পুরাতন ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্ব অপসারণ করে পাকিস্তানে বড় পুঁজি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় শাসন প্রবর্তন। জেনারেল আইয়ুব খান তাই যতো ছিলেন সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধি তার থেকে তিনি অনেক বেশী ছিলেন পাকিস্তানের বড় পুঁজির প্রতিনিধি এবং সেই সাথে এই বড় পুঁজির মহাজন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এক বিশ্বস্ত খেদমতগার। আইয়ুব খানের আমলে পাকিস্তানের ইতিহাস এই প্রতিনিধিত্ব এবং এই খেদমতগারীরই ইতিহাস।

***

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1980.08.01-bichitra.pdf” title=”1980.08.01 bichitra”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!