শোষণমুক্ত সমাজ কায়েমের সংগ্রাম শুরু হয়েছে- তরুণদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ডাক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা-এই চার মূলনীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুখী, সমৃদ্ধিশালী ও শোষণহীন বাংলাদেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করার জন্য তরুণ সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, যারা রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি বিরোধী তাদের বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নাই। বঙ্গবন্ধু শুক্রবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (সিদ্দিকী-মাখন) তিন দিনব্যাপী জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে এই কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি-বরং নবতর পর্যায়ে পুনরায় শুরু হয়েছে। আর এ সংগ্রাম হচ্ছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা এবং শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের সংগ্রাম। স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বহু পূর্বেই শুরু হয়েছিল আর সশস্ত্র সগ্রামের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত তার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে এ সংগ্রামের শুরু হয়। তথাকথিত বিপ্লবীদের সমালোচনা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল আজকের বিপ্লবীদের অনেকেরই তখন জন্ম হয়নি।
বাঙালি তীক নয় : স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালিদের আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বের দরবারে আজ প্রমাণিত হয়েছে বাঙালিরা ভিরু নয় ! বিগত স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালিরা তাদের এ অপবাদ ঘুচিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, বিগত ২৪ বৎসর পাকিস্তানিরা বাঙালিদের হাতে অস্ত্র দেয়নি। বাঙালিরা হাতে অস্ত্র নিয়েছে। প্রমাণ করে দিয়েছে বিশ্বে তাদের শৌর্যের কথা।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসেনি : বঙ্গবন্ধু বলেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এসেছে কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসেনি। রাষ্ট্রীয় চার নীতি নিয়েই জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যে এগুতে হবে। অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে ছাত্র সমাজকে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
চারনীতি প্রসঙ্গে : বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন যে, জাতীয়তাবাদী হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি। আর এই স্বাধীনতাবাদ একদিনে সৃষ্টি হয়নি। চরম দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থীদের তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ধাপে ধাপে আমাকে জনগণের মনে জাতীয়তাবাদী প্রেরণা যোগাতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলেন, আমরা সমাজতন্ত্র বিশ্বাস করি। সমাজতন্ত্রই মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির একমাত্র পথ। আর গণতন্ত্রের মাধ্যমেই আমরা এদেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করব। তিনি বলেন, গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ভোগ করতে হলে প্রত্যেকেই গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক হতে হবে।
বিভিন্ন দল প্রসঙ্গে : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, যেসকল রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় মূল চারনীতি বিশ্বাস করে না সেইসব দল বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবে কি না তা ভেবে দেখা উচিত। জামাত, পি, ডি, পি মুসলিম লীগ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বাংলা ও বাঙালির স্বার্থ এবং স্বাধীনতা বিরোধী কাজের জন্যে। সুতরাং বাংলাদেশের চার মূলনীতির ওপর যেসব দলের আস্থা নেই তাদের বাংলাদেশে রাজনীতি করা অনুচিত।
খাদ্য পরিস্থিতি : দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু বলেন, বর্তমানে জনগণ মারাত্মক খাদ্যের সংকটের সম্মুখিন। বর্তমানে দেশের ৩০ লক্ষ টন খাদ্যের প্রয়োজন। সরকার মাত্র ১৭ লক্ষ টন খাদ্যের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। বন্ধু রাষ্ট্র ভারতে খাদ্য পাচার হয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণীর মানুষের এরূপ অপপ্রচার সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ভারতের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা একটা ফ্যাশান হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্মরণ রাখতে হবে, আমাদের চরম দুর্দিনে ভারত আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। স্বাধীনতার পর ভারত আমাদেরকে সাড়ে সাত লক্ষ টন খাদ্য সাহায্য করেছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নিয়ে তাদের আতিথেয়তা গ্রহণ করে আজ দেশে ফিরে মিথ্যা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
আসুন এক সাথে কাজ করি : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, লক্ষ্য যখন আমাদের এক তখন আসুন আমরা একসাথে মিলে সোনার বাংলা গঠনে আত্মনিয়োগ করি। বিভিন্ন মতের পার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু দেশকে গড়ে তুলতে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে একসাথে কাজ করতে আপত্তি কিসে। তিনি ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টিকে সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্যে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানান। ছাত্রলীগের ঐতিহ্য রয়েছে : বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের ইতিহাস ব্যাখ্যা করে বলেন, ছাত্রলীগের সংগ্রামী আদর্শ, ঐতিহ্য ও ইতিহাস রয়েছে। রাতারাতি এই প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। আদর্শের সগ্রামে উদ্বুদ্ধ ছাত্রলীগকে তিনি নীতির জন্য সংগ্রাম করে যেতে বলেন। বঙ্গবন্ধু ছাত্রসমাজকে সোনার বাংলা গঠনে আত্মনিয়োগ করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে তার বক্তৃতা শেষ করেন।৭৭
রেফারেন্স: ২১ জুলাই ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ