You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.07.15 | সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকবে- বঙ্গবন্ধু | দৈনিক আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকবে- বঙ্গবন্ধু

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় সংবাদপত্রকে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করবে না, যদি তারা সংবাদপত্রের নীতি মোতাবেক জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখে অত্যন্ত দায়িত্বের সাথে কাজ করে যান। বঙ্গবন্ধু রোববার সকাল ১০ টায় জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণদান প্রসঙ্গে এই কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেন যে, যেহেতু বাংলাদেশ সরকার গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সেহেতু বাংলাদেশের সংবাদপত্র পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। আমরা আজ পর্যন্ত সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করিনি। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা-রাষ্ট্রের এই চার আদর্শের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, সাংবাদিকরাও এই চার আদর্শে বিশ্বাস করেন। বঙ্গবন্ধু পুনরায় উল্লেখ করেন। যে, তার সরকার এই চার রাষ্ট্রীয় আদর্শের ওপর ভিত্তি করে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে। গণতন্ত্রের আদর্শ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন যে, গণতন্ত্র অর্থ গাড়ি হাইজ্যাক করার স্বাধীনতা নয়, গণতন্ত্রের অর্থ বাড়ি দখল বা মানুষ হত্যা করা নয়, গণতন্ত্রের অর্থ অন্যের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করার স্বাধীনতা নয়-গণতন্ত্রের কিছু মৌল নীতি ও আদর্শ রয়েছে। একইভাবে সংবাদপত্র তার নিজস্ব নীতিমালা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব সাংবাদিকই ফেরেস্তা নন। কারণ বিগত ন’মাসে পাকিস্তান হানাদারবাহিনী কর্তৃক যেসব মহৎ প্রাণ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, তাদের হত্যার পেছনে সাংবাদিকদেরই হাত রয়েছে। কিছু সাংবাদিক পাকিস্তান হানাদারবাহিনীকে সংবাদ সরবরাহ করেছেন। এমনও সাংবাদিক আছেন, যারা নিয়মিত ভাবে ক্যান্টনমেন্টে খাদ্য সরবরাহ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, কোনো এক পত্রিকায় জনৈক সহকারী সম্পাদক পরবর্তীকালে কুখ্যাত আল বদর বাহিনীর দ্বিতীয় প্রধান হয়ে কাজ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, এসব সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে তা নিশ্চয়ই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ওপর হস্তক্ষেপ করা হবে না। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের আত্মসমালোচনা করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, যেসব সাংবাদিক বিগত হানাদার আমলে পাকিস্তানবাহিনীর সহযোগিতা করেছেন, তাদের এই পেশা থেকে বহিষ্কার করুন। তিনি বলেন যে, পাকিস্তান হানাদারবাহিনীর সহযোগী এই সব ব্যক্তিরা আজও গোপনে জাতীয় স্বার্থের বিরোধীতা করে চলছে। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, অবাঞ্ছিত সরকারি কর্মচারীদের স্ক্রিনিং করার উদ্দেশ্যে হাইকোর্ট জজের নেতৃত্বে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, সমাজের বিভিন্নস্তর থেকে জনস্বার্থ বিরোধী ব্যক্তিদের নির্মূল করার জন্য সরকার ইতোমধ্যে কঠোর ব্যবস্থা করেছে। বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন যে, তার নিজ দলের কিছু সংখ্যক দুর্নীতি পরায়ণ এম সি এ কে কারাগারে আটক করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও ক্ষমা করা হয়নি। তিনি প্রশ্ন করেন যে, তাহলে সাংবাদিকতায় নিয়োজিত দুর্নীতি পরায়ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও কেন এই ধরনের ব্যবস্থা গৃহীত হবে না। বঙ্গবন্ধু জাতীয় সংবাদপত্রকে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, তিনি সর্বদাই গঠনমূলক সমালোচনাকে আভিনন্দন জানাবেন। তিনি সরকারের ভুলভ্রান্তি তুলে ধরার জন্য সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান। সাংবাদিক ইউনিয়নের দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, সারা জীবন আমি সাংবাদিকদের সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। অদূর ভবিষ্যতেও থাকব। তিনি বলেন যে, সময়ের ব্যবধানে সাংবাদিকদের ন্যায্য দাবি দাওয়া অবশ্যই পূরণ করতে হবে। এই প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের তিনি বলেন যে, আপনারা নিজেদের জনগণ থেকে আলাদা শ্রেণি হিসেবে বিবেচনা করবেন না। নিজেদের জনতার অংশ হিসেবে ভাবতে শিখুন। জনগণের কাছে আমি ৩ বছর সময় চেয়েছি। আপনারাও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। অতএব আপনাদেরও আগামি ৩ বছর কিছু দিতে পারব না। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মাত্র ছয় মাস বয়সে এই সরকারের বিজয় সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, সামান্য পরিমাণে হলেও বাংলাদেশ সরকার দেশের ৬৫ হাজার গ্রামের ভূখা মানুষের হাতে খাদ্য পৌছে দিতে পেরেছে। বঙ্গবন্ধু অভিযোগ করেন, কিছু সংখ্যক পত্রিকা দায়িত্বহীনভাবে তাদের খেয়াল খুশী মতো সংবাদ পরিবেশন করে চলেছে। এই প্রসঙ্গে তিনি ফাইল ঘেটে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার কয়েকটি সংবাদ শিরোনামের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এক লক্ষ বামপন্থী হত্যা, বিমানবাহিনীতে বিদ্রোহ, গণ হত্যা চলছে, রুশ-ভারত চক্রান্ত, আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ইত্যাদি সংবাদ শিরোনামের কথা উল্লেখ করেন। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলেন যে, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এই জন্য বাঙালি জাতি বিশ্বের কাছে গর্ব করতে পারে। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, স্বাধীনতার পূর্বে ব্যাপকহারে আওয়ামী লীগ কর্মী ও দেশপ্রেমিকদের হত্যা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, সাংবাদিকদের একটি অংশ সাম্প্রদায়িকতার। বিষবাষ্প ছাড়ানোর চেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছেন। তারাই বিভিন্নভাবে আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট করার প্রচারণা চালাচ্ছে। “অনাহারে মানুষ মরছে” শীর্ষক সংবাদ শিরোনাম সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, সরকার প্রতি ঘরে ঘরে খাদ্য পৌছে দেয়ার সম্ভাব্য সব রকম চেষ্টা করে যাচ্ছে। সরকার বিদেশ থেকে খাদ্য ভিক্ষা করে জনগণের কাছে পৌছে দেওয়ার চেষ্টায় সর্বদায় নিয়োজিত রয়েছে। পাঁচ লক্ষ টন খাদ্য ভারতে পাচার” শীর্ষক সংবাদ শিরোনামের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু তকালীন খাদ্য মজুতের পরিমাণ হিসাব করে বলেন যে, দেশে যখন এই পরিমাণ খাদ্য মজুতই ছিলনা তখন এতো খাদ্য পাচার করা কি করে সম্ভব হতে পারে? বঙ্গবন্ধু বলেন। যে, যখন কিছু সাংবাদিক দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তখন কিছু সাংবাদিক এ দেশে জে. ফরমান আলীর আশীর্বাদ নিয়ে সংবাদপত্র বের করেছেন। এখন তারা আজ বড় বড় প্রগতিশীল সেজে সরকারের সমালোচনা, এমনকি স্বাধীনতার মূলে কুঠারাঘাত করার চেষ্টা করছে। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, আপনারা সরকারের বিরুদ্ধে লিখতে পারেন কিন্তু স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কিছু লিখলে বাংলার জনগণ তা ক্ষমা করবে না। বঙ্গবন্ধু পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেন যে, সরকার দেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে অত্যন্ত দৃঢ়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে ফ্রিস্টাইল’ মনোভাব চলছে। স্বাধীন দেশে তা বরদাস্ত করা হবে না। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, তিনি কারো অধিকার কেড়ে নিতে চান না। কারণ তিনি সংগ্রামেরই সন্তান এবং সংগ্রামের মাধ্যমে তিনি আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই অর্জিত স্বাধীনতার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে বাংলার মানুষ যে পরিমাণ স্বাধীনতা ভোগ করেছে বিশ্বের ইতিহাসে তার কোনো নজীর নেই। সমাজ বিরোধী ব্যক্তিদের জন্য কাফু জারির কথা উল্লেখ করে বলেন যে, আমি জানি এর ফলে সাধারণ মানুষের যথেষ্ট অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি দেশের বৃহৎ স্বার্থের খাতিরেই জনগণকে এতোটুকু কষ্ট করার অনুরোধ জানান। চালের মণ ১২০ টাকা’ শীর্ষক একটি সংবাদ শিরোনামের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, এটা নিশ্চয় ভুল করে ছাপানো হয় নাই। জনগণের মধ্যে ভীতির উদ্রেক করার জন্যই ইচ্ছাকৃতভাবে এই সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। পরিশেষে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, সমাজতন্ত্র কায়েমের পথে নানাবিধ বাধা সম্পর্কে সরকার অত্যন্ত সচেতন। বঙ্গবন্ধু বলেন, এমন কিছু ব্যক্তি রয়েছেন যারা হত্যার অপরাধে অপরাধী, যারা রাজাকার ও আল বদরদের সহযোগী ছিলেন তারাই ভোল পাল্টে আজ অতি প্রগতিশীল সেজেছেন। এদের অনেকেই ‘বড় নেতাদের’ কাছে আশ্রয় নিয়েছে এবং রাতারাতি “রাজনৈতিক সচিব’ ও সম্পাদক” বনে গিয়েছেন।৫৬

রেফারেন্স: ১৫ জুলাই ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ