You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.07.14 | জাতীয়করণের বিরুদ্ধে মোজাফফর বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিয়েছিলেন | দৈনিক আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

জাতীয়করণের বিরুদ্ধে মোজাফফর বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিয়েছিলেন

বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দান কালে অনেক কথার ভিড়ে একটা কথা বলে ফেলেছিলেন। সরকারের জাতীয়করণ নীতি প্রসঙ্গে আলোচানার এক জায়গায় তিনি বলেছেন, “আমি বঙ্গবন্ধুকে এই মুহূর্তে সকল ব্যাংক, বীমা, বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ না করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। এবং কেবল মাত্র পরিত্যক্ত শিল্প কারখানা জাতীয়করণের পরামর্শ দিয়েছিলাম। অধ্যাপক সাহেবের বক্তব্যের যোগসূত্র হিসেবে মাত্র দু’ মাস আগে বঙ্গবন্ধুর এক ভাষণের ওপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে আসা যেতে পারে। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বিজ্ঞজনেরা জাতীয়করণ ঘোষণার আগে আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, সব কিছু এই মুহূর্তে জতীয়করণ করা ঠিক হবে না। জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরও তারাই বলেছেন সব ব্যাংক, বীমা, বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ করা ঠিক হয় নি। পরামর্শটা যে একান্ত গোপনে দেয়া হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। বঙ্গবন্ধুর প্রকাশিত এই তথ্য শুনে স্বাভাবিক ভাবেই এসব পরামর্শ যে “ডান দিক থেকে আসছে সে বিষয়ে একরকম নিশ্চিত হয়ে পরামর্শ দাতাদের সম্পর্কে কৌতুহলের উদ্রেক হয়েছিল। সাংবাদিক সম্মেলনে জনগণের সে কৌতুহলের অবসান ঘটিয়েছে। মোজাফফর সাহেবের এ সততা পূর্ণ স্বীকারোক্তি থেকে একটা সিদ্ধান্তে পৌছানো খুব সহজ হয়ে গেছে যে বঙ্গবন্ধুকে জাতীয়করণ বিরোধী। পরামর্শদাতা বিজ্ঞজন হলেন মোজাফফর হোসেন নিজেই, আর এর সাথে ‘রা যোগ হলেও মোজাফফর সাহেব সেখানে অন্যতম। মুস্কিলটা হচ্ছে মোজাফফর সাহেবকে বাদ দেয়া যেতে না পারায় সাংবাদিক সম্মেলনে তাৎপর্য ও গুরুত্বের দিক থেকে একটা বড় কিছুর দাবিদার হলেও মোজাফফর সাহেবকে আমরা এদেশের বামপন্থী আন্দোলনের পিন পয়েন্টে মাপকাঠিতে বিচার করে থাকি। এবং সে বিচার ভঙ্গিপ্রসুত দৃষ্টিতে তাকে বামপন্থীদের মুখপাত্র হিসেবে ধরে নিয়েই বিষয়টি একটু আলোচনা করে দেখার প্রয়োজনীয়তাকে নাকচ করে দেয়া যাচ্ছে না।
সমাজতন্ত্র কায়েম ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মূল লক্ষ্য, একচেটিয়া পুঁজিবাদ সমাজতন্ত্রের পথে একটা বিরাট বাধা। অজানা নয় যে, পাকিস্তানি শাসনামলে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত সকল অঞ্চলের ওপর চলছে এক নির্মম শোষণ। আর সেই শোষণের অর্থাৎ এক চেটিয়া পুঁজির কেন্দ্র ছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান (যা এখন পাকিস্তান)। বাংলাদেশ ছিল এই শোষণ, লুণ্ঠনের একটা অবাধ ক্ষেত্র। পাকিস্তানি একচেটিয়া পুঁজি শোষণের ফলে এ অঞ্চলে নিজস্ব কোনো সুষ্ঠু অর্থনীতি গড়ে উঠতে পারে না। এই শোষণ এক দিকে যেমন অগণন শ্রমিক কৃষক মেহনতী মানুষকে স্ব স্ব অবস্থান থেকে টেনে এনে পথে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, সর্বশান্ত ও নিঃস্ব করেছে, অপরদিকে একচেটিয়া পুঁজির মালিকদের চক্রান্ত ও সুচতুর পদক্ষেপে এখানকার উঠতি বাঙালি ধনিকদের ব্যবসায়িক উচ্চবিলাসকে সহজ গতিতে পরিশীলিত হতে দেয় নি। বাধা আর আঘাত পেয়ে পেয়ে বাঙালি ধনিকদের মেরুদণ্ড যায় ভেঙে। দেশের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের মৌলিক দ্বন্দ্ব এবং সে প্রেক্ষিতে পাকিস্তানে একচেটিয়া পুঁজি ও তার আন্তর্জাতিক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের গভীর সংকটও রয়েছে। এই ক্ষেত্রে আমি সেই আলোচনায় যেতে চাচ্ছি না। প্রয়োজন সাপেক্ষে ভবিষ্যতে আলোচনার ইচ্ছা রাখছি। যাই হোক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পটভূমিকায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে যেকটি মৌলিক সমস্যার মধ্য থেকে বাংলাদেশকে বের করে নিয়ে আসা গেছে তার একটি হচ্ছে একচেটিয়া পুঁজির শোষণ। যেহেতু একচেটিয়া পুঁজির কেন্দ্র ছিল পশ্চিম পাকিস্তান, সেহেতু পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ একচেটিয়া পুঁজির শিকল থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে আসতে পেরেছে। এই স্বাধীনতা জাতীয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে দু’টো পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। প্রথমতঃ স্বাধীন বাংলাদেশে আবার একচেটিয়া পুঁজি গড়ে উঠতে দিয়ে দেশের সকল সম্পদ কয়েক ব্যক্তির মালিকানায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা। ছোট ছোট বাঙালি ধনিকদের বড় এবং বিরাট পুঁজি গড়ে তোলার সুযোগ করে দেয়া। আইনের মারপেঁচে শ্রমিক কৃষক মেহনতী মানুষের ওপর বাঙালি ধনিকদের শোষণকে জায়েজ ও চিরস্থায়ী করার ব্যবস্থা। পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশে নতুন করে আদমজী-ইস্পাহানী হওয়ার সুযোগকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় লালন করা হয়। দ্বিতীয়তঃ অতীতের অভিজ্ঞতা নিসৃত কঠিন শিক্ষা থেকে একচেটিয়া পুঁজি গড়ে ওঠার মাধ্যমে বৃহৎ শিল্প, ব্যাংক, বীমা, শিপিং ইত্যাদি রাষ্ট্রায়াত্ত করে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলা। দেশকে অপুঁজিবাদি বিকাশের পথে সমাজতন্ত্রের লক্ষে নিয়ে যাওয়া। শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে জনগণের জন্যেই চিরস্থায়ী সুখ সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। উল্লেখ করা দরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতোমধ্যেই এই দ্বিতীয় পথেই বাংলাদেশের জন্যে পথ। নির্দেশ করেছেন। সমাজতন্ত্রের উত্তরণের জন্যে এক কঠিন সংগ্রামী ভূমিকা নিয়েছেন। সমাজতন্ত্রকে মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করেছেন। জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নিয়ে সমাজতন্ত্রের পথে পা ফেলেছেন। আমরা জানি ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি সমাজতন্ত্র চায়। সমাজতন্ত্রের সংগ্রামে তার ভূমিকার একটা ঐতিহাসিক ঐতিহ্য রয়েছে। তাই সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পদক্ষেপ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর জাতীয়করণের ঘোষণাকে অভিনন্দন বা কেবলমাত্র সমর্থন নয়, এই ঘোষণা বাস্তবায়িত করার জন্যই ন্যাপ বঙ্গবন্ধুর হাতকে শক্তিশালী করার জন্যে সক্রিয় হোক এটাই জনগণ আশা করছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে : ন্যাপ সভাপতি সব বৃহৎ শির জাতীয়করণ না করে কেবল মাত্র পরিত্যক্ত সম্পত্তি জাতীয়করণের পরামর্শ দিতে গেলেন কেন? এটা কি ন্যাপের দলীয় সিদ্ধান্ত? যতদূর জানা গেছে—তাও নয়! গোলমালটা সেখানেই। দলীয় সিদ্ধান্ত নয়, অথচ দলের সভাপতি আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কানে দলের একটা মৌলিক নীতি বিরোধী পরামর্শই বা দিতে গেলেন কেন? যাই হোক, মোজাফফর সাহেবের পরামর্শ মতো কাজ করলে কি দাঁড়ায় সেটাই দেখা যাক আপাততঃ। বঙ্গবন্ধু (মোজাফফর সাহেবের ভাষায় দুর্বল বুর্জোয়াদের নেতা”) স্বাধীনতার পরে পরেই জাতীয়করণ ঘোষণা করেই জাতীয় স্বার্থে বাঙালি ধনিকদের আদমজ৷ ইস্পাহানি হওয়ার পথে এক কঠিন প্রাচীর তুলে দিয়েছেন। একচেটিয়া পুঁজির ভ্রণকেই টুটি টিপে ধরেছেন। সমাজতন্ত্রের পথে এটা এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধু জানেন, আর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলও এ বিষয় নিশ্চিত যে, এই সময় জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত না নিয়ে বাঙালি ধনিকদের সংঘঠিত হওয়ার সুযোগ দেয়া হলে সাংঘাতিক সংকট সৃষ্টি হতো এবং তা অতি দ্রুত গভীরতা লাভ করতে পারতো বলেও পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, এসব দিক বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী ঐতিহাসিক সর্বোপরি অসীম সাহসিকতাপূর্ণ। মোজাফফর সাহেবের পরামর্শ কার্যকরী হলে এর বিপরীতটাই হতে পারতো। পর্যবেক্ষক মহলের প্রশ্ন : মোজাফফর সাহেব বাঙালি ধনিকদের একটা প্রগতিশীল চাঞ্চ করে দেয়ার জন্যেই কি তবে এ পরামর্শটা বঙ্গবন্ধুর কাছে তুলেছিলেন? কার অথবা কাদের সাথে তিনি এ বাঙালি ধনিক রক্ষার মহান দায়িত্ব পালনে ব্রতী হয়েছিলেন? আর সে স্বার্থের মধ্যেই তার কোনো স্বার্থ নিহীত রয়েছে কি না? থাকলে সে রহস্য উন্মোচিত হওয়া উচিত বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।৫০

রেফারেন্স: ১৪ জুলাই ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ