কোনো সম্মেলনের সিদ্ধান্তে মত পাল্টাতে পারবো না- বঙ্গবন্ধু
কুষ্টিয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান আজ এখানে ঘোষণা করেন যে, তার সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেত বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশের মাটিতেই এদের বিচার হবে। তিনি বলেন, এই বিষয়ে কোনো পর্যায়ের কোনো সম্মেলনের সিদ্ধান্তে আমাদের মত পাল্টাবে না। প্রধানমন্ত্রী এখানে আগমনের পর এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। এই বক্তৃতায় তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের পক্ষে ওকালতি করার জন্য জনাব ভুট্টোকে ভর্ৎসনা করেন। তিনি বলেন, বাংলদেশে এরা ইতিহাসের সব চাইতে মর্মান্তিক গণহত্যা চালিয়েছে। অথচ ভুট্টো সাহেব বলতে চান, তারা কর্তব্য পালন করেছে। শেখ সাহেব এই প্রেক্ষিতে তাকে প্রশ্ন করেন, নিরীহ অসামরিক নাগরিকদের হত্যা, লুটতরাজ, আর অমানুষিক নির্যাতন চালান তার সৈনিকদের স্বাভাবিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে কি না? তবে তিনি বলেন, যাইহোক না কেন আমরা অপরাধীদের ছেড়ে কথা কইব না। আমরা তাদের সাজা দিব।
সবুজ বিল্পব আনতে হবে : সভায় জাতীয় সমস্যাগুলো উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু দেশে সবুজ বিপ্লব আনার অভিযানে ব্রতী হওয়ার জন্য জনগণের কাছে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, চাষিরা জাতির মেরুদণ্ড। এদের ভাগ্য উন্নয়ন না করে, কৃষি উন্নয়ন না এনে সত্যিকার কোনো প্রগতি আশা করা যায় না। তিনি আরও বলেন যে, কোনো স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাবান জাতি চিরদিন বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে পারে না-খাদ্যের মতো অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য পাবার আশায় বসে থাকতে পারে না। “এছাড়া বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি আমাদের নতুন রাষ্ট্রের তহবিলের ওপর বোঝা বাড়াবে। এখন আমাদের যেটা কর্তব্য সেটা হচ্ছে অধিক খাদ্যের ফলন করা।” তিনি বলেন, একবার খাদ্য ঘাটতি পূরণ করা গেলে প্রগতি আর উন্নতির চাকাও বেগবান হয়ে উঠবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, এখন থেকে সরকার গ্রামের উন্নয়ন সাধন করবে। দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ লোক গ্রামে থাকে অথচ অতীতে এই দিকে নজরই দেওয়া হয়নি।
সমাজ বিরোধীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি : তিনি বক্তৃতায় জনগণকে সমাজ বিরোধী ব্যক্তিদের। সম্পর্কে হুশিয়ার করে দেন এবং বলেন, এরা শান্তি নষ্ট করতে চায়। শেখ সাহেব বলেন যে, এদের রেহাই নেই। মজুতদার, মুনাফাখোর, গুন্ডা, লুটেরা আর চোরা কারবারীদের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে সমাজের বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করা হবে। তিনি এখানকার জেলা কর্তৃপক্ষকে কাফু দেওয়ার পরামর্শ দেন। ঢাকা ও অন্যান্য জেলার মতো ঘরে ঘরে তল্লাশী চালাতে বলেন।
সংবিধান প্রসঙ্গ : প্রস্তাবিত সংবিধান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, এতে জনগণের অধিকার সংরক্ষিত থাকবে। এর ভিত্তি হবে গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতা। তিনি বলেন, আমাদের জীবনবোধ গণতন্ত্রে নিহিত এতে মুজিব গ্যারান্টি আছে। কিন্তু তা বলে এতে যেমন খুশি চলার বা দায়িত্বহীনের মতো কথা বলার অধিকার দেয়া হয়নি। এই রকম কেউ বললে তাকে সমুচিত শাস্তি দেওয়া হবে। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকার শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। এতে মানুষের চাহিদা মিটানো হবে এবং তার নিশ্চয়তাও থাকবে। বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতা উল্লেখ করে বলেন, এই কথার অর্থ ধর্মহীনতা নয়। তা বলে ধর্মের নামে নিরীহ মানুষকে শোষণ করা চলবে না। আর জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা বাঙালি হিসাবে নিজেদের ঐতিহ্য সম্পর্কে গৌরববোধ করি। আমরা কারো সংস্কৃতির ধারা নেবো না, অনুপ্রবেশ ঘটাতেও দেব না। এই সভায় আওয়ামী লীগের সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান সভাপতি ছিলেন।
স্বতঃস্ফুর্ত সম্বর্ধনা : এর মাত্র ২ ঘণ্টা আগে বঙ্গবন্ধু ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে এসে পৌছালে এক বিরাট জনতা তাকে স্বাগত জানায়। তিনি জনাব জিল্লুর রহমান ও জনাব শাহ মোয়াজ্জেমসহ হেলিকপ্টার থেকে নামলে জনতা সোচ্চার স্লোগান তুলে “ জয় বাংলা” “জয় বঙ্গবন্ধু”। এছাড়া তার সভায় বক্তৃতার সময়ও মূহুরমূহু স্লোগান উঠতে থাকে।৫
রেফারেন্স: ২ জুলাই ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ