You dont have javascript enabled! Please enable it!

নোয়াখালীর মাইজদিতে বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা, আপনারা অনেক কষ্ট করে অনেক দূর থেকে এসেছেন। আপনাদের আমি কষ্ট দিতে চাই না, বেশি সময় আমি বিরক্ত করতে চাইনা। জেল থেকে বের হয়ে আসার পরে ভেবেছিলাম আপনাদের কাছে তাড়াতাড়ি আসব কিন্তু আসতে পারি নাই, আমি জানি, আমি যখন জেলের মধ্যে কারাবন্দি ছিলাম পশ্চিম পাকিস্তানে, আমি জানি যখন আমি দিন গুনছিলাম কবে আমার ফাসি হবে। আমি জানতাম আপনারা আমার মা-বোনেরা-ভাইয়েরা বাংলার গ্রামে গ্রামে রোজা রাখতেন, দোয়া করতেন এবং এই পিচাশদের বিরুদ্ধে সগ্রাম করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আপনারা জানেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী আমার দেশের কি সর্বনাশ করেছে। লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে হত্যা করেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথের ভিখারী করেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার কোটি ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। আমার জমির ক্ষেতের ফসল জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার রাস্তা-ঘাট ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। আমার রেল লাইন ভেঙে দিয়েছে। আমার ফ্যাক্টরী কারখানা নষ্ট করেছে। আমার ছেলেদের কাপুরুষের মতো ঘরের থেকে ধরে নিয়ে টুকরা টুকরা করে কেটেছে। তারা বলে মুসলমান, তারা বলে মানুষ। তারা বলতেন আমরা মুসলমান। এতো বড় নরপশু দুনিয়ার কোথাও পয়দা হয় নাই। আপনাদের মনে আছে যেদিন আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় সেদিন আমি বলে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের মানুষ, আমি জানিনা তোমাদের কাছে আর কথা বলতে পারব কিনা? হতে পারে এই আমার শেষ। হতে পারে ওরা আমাকে হত্যা করবে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তোমরা যুদ্ধ কর। আমার পুলিশ, আমার ইপিআর, আমার সৈন্য বাহিনী, আমার সরকারি কর্মচারী, আমার শ্রমিক, আমার কৃষক, আমার বুদ্ধিজীবী, আমার ছাত্র …..। লক্ষ লক্ষ মায়ের বুক খালি হয়ে গিয়েছে, লক্ষ লক্ষ ছেলে আজ পা কাটা, লক্ষ লক্ষ সংসার আজ ছাড়খার হয়ে গেছে। কি পেয়েছি ? আমি যেদিন জেলের থেকে বেরিয়ে আসলাম। আমি যখন রেসকোর্স ময়দানে খাড়া হলাম, আমি যখন বাংলার মাটি পাড়া দিলাম। আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই। অনেক রাত আমি ঘুমাই নাই। অনেক দিন আমি বসে বসে কাটিয়েছি। যেদিন থেকে এসে আমি বাংলায় নেমেছি। তারপর থেকে একদিনও আমি বিশ্রাম করি নাই। কি করব? আমার পোর্ট নাই। পোর্ট ভেঙে দিয়ে গেছে। আমার গুদামের চাউল লুট করে জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার কাগজপত্র পর্যন্ত অফিসের জ্বালিয়ে দিয়েছে এমনকি নোটগুলি পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা লুট করে নিয়ে গেছে। বাংলার সোনা লুট করে নিয়ে গেছে। বাংলার মানুষকে হত্যা করেছে।
ভাইয়েরা আমার, ইনশাল্লাহ ৩০ লক্ষ লোকের রক্তের বিনিময়ে আজ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে? আজ বাংলার মানুষ না খাওয়া, আমি জানি। আমি জানি আজ বাংলার মানুষ দুঃখী, আমি জানি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খায় না, আমি জানি বাংলার মানুষের ঘর নাই। এক কোটি লোক বাংলাদেশ থেকে ভারতবর্ষে স্থান নিয়েছিল। দেশ ত্যাগ করে গিয়েছিল। এক কোটি লোক ফিরে এসেছে। কোথায় আমি খাবার পাব? কোথায় আমি টিন পাব? কোথায় আমি পয়সা পাব? কোথায় আমি বাংলার মানুষকে পেট ভরে খাবার দিব। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন চিন্তা করেছি কি করব? কিন্তু জানি বাংলার মানুষ দুঃখী। আমি দেখলাম সব গেছে কিন্তু বাংলার মানুষ, বাংলার মাটি, বাংলার আকাশ, বাংলার বাতাস, বাংলার নিঃস্বার্থ কর্মীকে হত্যা করতে পারে নাই। ইনশাল্লাহ সোনার বাংলা একদিন সোনার বাংলা হবে। এদেশের মানুষ পেট ভরে খাবার খাবে। জালেম আমার সম্পদ নিতে পারে। জালেম আমার টাকা নিতে পারে, জালেম আমার ঈমান নিতে পারে নাই, জালেম আমার মাটি নিতে পারে নাই। ইনশাল্লাহ বাংলার মানুষ যদি সৎ পথে থাকে, ভালোভাবে কাজ করে। ঈমানদারীর সাথে কাজ করে। আমি বিশ্বাস করি সোনার বাংলার মানুষ আবার সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারবে এই বিশ্বাস আমার আছে।
ভাইয়েরা আমার, আমি দেখলাম কি শতকরা ৬০ জন পুলিশকে হত্যা করেছে। নোয়াখালীর ভাইয়েরা এখনও পাষন্ডের দল আমার ৩০ লক্ষ লোককে হত্যা করে শান্তি পায় নাই। আমার চার লক্ষ বাঙালিকে পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে রেখেছে। ভুট্টো সাহেব তাদেরকে দিবেন না। ভুট্টো সাহেব তাদের নিয়ে ব্যবসা শুরু করে দিয়েছেন। ভুট্টো সাহেব তাদের ছাড়বেন না। ভুট্টো সাহেব মনে করেছেন যে, বাংলার মানুষকে আটকে রেখে তিনি আমাদের মাথা নত করাবেন। যে জাতি রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে, সেই জাতি কারো কাছে মাথা নত করতে পারে না। ভুট্টো সাহেব, আল্লাহ যদি আমাকে বাঁচায় রাখে, বাংলার মানুষকে আমি বাংলায় ফিরিয়ে আনব- আপনি রাখতে পারবেন না। আপনি মনে করেছেন তাদের আটকিয়ে রাখলে যারা যুদ্ধাপরাধী তাদের আমি বিচার করবো না। যারা আমার ২ লক্ষ মা বোনদের ওপর পাষবিক অত্যাচার করেছে, যারা আমার ছেলেদের নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে, যারা আমার গরীবের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, যারা আমার মা বোনকে পথের ভিখারী করেছে তাদের বিচার এই বাংলার মাটিতেই হবে যদি আমি বেঁচে থাকি। ভুট্টো সাহেব, আপনি জানেন মৃত্যুকে আমি ভয় করিনা। মেশিন গানের সামনে আমি বুক পেতে দাঁড়াতে পারি। আপনি জানেন ফাসির জন্য আমার কবর খুড়ে ছিলেন, কিন্তু আমি মাথা নত করি নাই। এজন্যই আমার বাংলার মানুষ আমাকে ভালোবাসে। ভুট্টো সাহেব, অবশ্য এখনও এদেশকে মানেন না। বাংলাদেশ বলে স্বাধীন না। দুনিয়ার ৭৫টা দেশ মেনেছে। দুনিয়ার জাতিসংঘের অনেক কমিটির আমি সদস্য হয়েছি। উনি বাংলাদেশকে মানেন না। আমি তোমারে মানি কিনা সেটাই বড় কথা, তুমি আমারে মান না মান সে কথা পরে। আমার দেশ বাংলাদেশ, আমার স্বাধীনতা থাকবে, আমার পতাকা থাকবে। আমার বাংলাদেশের মানুষ, তোমাদের গোলামী আর কোনোদিন আমরা করতে পারবো না। সুখে থাক, সুখে, আরামে থাক আশির্বাদ করি। পাপের প্রায়শ্চিত্ত কর, আল্লাহর কাছে মাফ চাও, যা করেছ। আর যা নিয়েছ ভদ্রলোকের মতো ফেরত দিলে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। চব্বিশ বছরে আমার সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে গেছ। এখন বড় কড় কথা বলে, ওনারা বলে মুসলমান, ওনারা ইসলামের কথা বলেন। ঘরে ঘরে মদ খাইয়া পইড়া থাকেন আর ইসলাম ইসলাম করেন। বাংলাদেশে আমি মদ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। তুমি বন্ধ করতে পার নাই। তুমি পারবা না। আমার নাই কিছু। আপনাদের আমি কিছু দিবার পারবো না। দেব কোত্থেকে। হ্যা একথা সত্যি, আপনাদের যত বকেয়া খাজনা ছিল সব আমি মাফ করে দিয়েছি- দেই নাই? আপনাদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা রোজ কেয়ামত পর্যন্ত মাফ হয়ে গেছে। আমি কইরা দিয়েছি। আপনাদের গ্রামে টাকা দেওয়া হয়েছে। আপনাদের লবনের খাজনা মাফ কইরা দেয়া হয়েছে। আমি পাব কোথায়? আমি দেব কোত্থেকে? আমি তো মাইনষের কাছে বাংলার স্বাধীনতা বিক্রি করে পয়সা আনতে পারি না। কোটি কোটি খাবার আমার আনতে হচ্ছে। আরেকটা অসুবিধা হয়ে গেছে, আমি ভিক্ষাটিক্ষা কইরা আনি, গ্রামে গ্রামে পাঠাই, ডাকাত দল এইগুলা চাইটা চাইটা খায়। চুরি করে খায়। আমি সাবধান করে দিচ্ছি, খবরদার গরীবের হক কেউ মাইরা খাবানা। আমি গরীবের জন্য, গরিব আমার জন্য। বাংলাদেশের গরিব কৃষকের রাজ কায়েম হবে। বাংলাদেশে গরীবের রাজ কায়েম হবে। শোষণের রাজ কায়েম হবে না। ভাইয়েরা আমার, ঘুষ দুর্নীতি বন্ধ কর, ঘুষ খাওয়া বন্ধ কর। গরীবের রক্ত চোষা বন্ধ কর। গরীবের রক্ত খাওয়া বন্ধ কর। গরীবের পয়সা মেরে খাওয়া বন্ধ কর। না হলে ভালো হবেনা। তোমরা আমাকে চেন। আজকে ২২ তারিখ, বড় বড় বাড়ি দখল করেছে, বড় বড় গাড়ি দখল করেছে বড় বড় জায়গায়। আজ ২২ তারিখ ৪ টা বাজে। এই চারটার পর থেকে বড় বড় শহরে এ্যাকশন নেয়া হবে। যারা বাড়ি ঘর লুট করবে তাদের বাড়ি ঘর থেকে উচ্ছেদ করা হবে। যাদের গুদামে চাল রেখে চালের দাম বাড়ায়ে গরিবকে লুট করে খাবার খায়, সাবধান হয়ে যাও। আইন আমি পাশ করছি। আইন আমার প্রতিক্রিয়ায় আছে। দরকার হয় এমন আইন করবো যে, প্রকাশ্য জায়গায় গুলি করে মারা হবে-কেউ খবর পাবে না। কিন্তু গরিবকে লুট করে খেতে দেওয়া হবে না। ভাইয়েরা আমার, বোনেরা আমার, একদল লোক আছে রাস্তায় বের হয়েছে, স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখে নাই। ইয়াহিয়া খানের দালালী করেছে, আইয়ুব খানের দালালী করেছেন, এখন আমি গণতন্ত্র দিয়েছি ওনারা কথা বলতে শুরু করেছেন। খুট খাট, পুসপাস ফুসফাস করেন। একটু আস্তে আস্তে কও, ছিলা কোথায় চানরা, করেছিলা কি চানরা-দালালী করেছ? ইয়াহিয়া খানের? পয়সা খেয়েছ আইয়ুব খানের, পয়সা খেয়েছ ইস্কান্দর মির্জার। যখন জীবনের দশটি এগারটি বছর আমি জেলের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছি, আমার সহকর্মীরা জেলের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছে তখন তোমরা বসে বসে পোলাও কোরমা খেয়েছ। এখন সুযোগ পাইয়া এটা করল না, ওটা করল না। কোথেকে করব? খাজনা-মাফ। ট্যাক্স-মাফ। লবণ কর মাফ। পয়সা কোত্থেকে আসবে? করবো কোত্থেকে? কাজ করতে হবে। ফসল উৎপাদন করতে হবে। কারখানায় কাজ করে উৎপাদন বাড়াতে হবে। তাহলেই তো পয়সা আসবে। তাহলেই তো মানুষকে কাজ দিতে পারব। তা না হলে পারব কোত্থেকে? বাজে কথা বললে চলবে না, আমি মিথ্যা কথা বলি না। রেসকোর্স ময়দানে জিজ্ঞাসা করলাম আমি তোমাদের কি দিয়েছি ? প্রায় ১০০ কোটি টাকার মতো রিলিফ এই বাংলাদেশে দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ২৬ কোটি টাকার ট্যাক্স ফ্রি দেয়া হয়েছে। খাজনা, ট্যাক্স মাফ করা হয়েছে।
আপনারা জানেন কোটি কোটি মন চাউল কিন্তু ট্রাক নাই, বাস নাই, রেলওয়ে নাই, পুল ভাঙ্গা ছিল। দুনিয়া থেকে চাল কিনব, চিটাগাং পোর্টে আনব। সেখান থেকে গ্রাম পৌঁছাইয়া দিব। অন্ততপক্ষে প্রত্যেকটা গ্রামে গ্রামে কিছু কিছু খাবার আপনাদের জন্য আমি পৌছায়াছি এই ভাঙ্গা হাতে। কিন্তু নাই কিছু। আমি কিছু দেবার পরব না, আমি মিথ্যা থোকা আপনাদের দেইনা। কোনোদিন দেইনি, কোনোদিন দেব না। তিন বৎসর আমি আপনাদের কিছুই দেবার পারবনা, আপনারা রাজী আছেন কিনা আমি জানতে চাই? তার মানে আমি দেবনা এটা ঠিক না। আমি যেখান থেকে পারি, ভিক্ষা কইরা আইনা বাংলার গরীবের সামনে আমি হাজির করার চেষ্টা করব। কিন্তু গরীবের খেয়ে বাঁচতে হবে। কিন্তু একটা কথা নাকে খৎ দিয়া দুনিয়ার কাছ থেকে আমি আনতে পারব না। সত্য কথা ভারতবর্ষ আমারে দুই তিন কোটি মন খাবার দিয়েছে। আনলোড ইউনাইটেড ন্যাশন থেকে আমি ছয় লক্ষ টন খাবার পাচ্ছি। তার মধ্যে ইউএসএ চার লক্ষ টন দিয়েছে। রাশিয়া আমার বন্ধু, তারা আমাকে দিচ্ছে। অষ্ট্রেলিয়া ক্যানাডাস সেখান থেকে আমি আনছি। বার্মা থেকে চাল আমি কিনছি, জাভা থেকে চাল আমি কিনতেছি। কিন্তু জাহাজ নাই। জাহাজ ভাড়া কইরা আনতে হবে। চট্টগ্রামে পৌছবে, ট্রাক লাগবে, রেল লাইন ইঞ্জিন নাই, পাঠাতে হবে নোয়াখালি, পাঠাতে হবে গ্রামে, সময় লাগবে ভাই, সময় লাগবে। মিথ্যা ধোকা দেবার পারবনা। আমি কাউকে ধোকা দেইনা। তবে বাংলার যে সম্পদ, এই সম্পদ আপনাদের। যেখান থেকে আয় করি না কেন, যেখান থেকে আনি না কেন, সে সম্পদ বাংলার গরিবদের জন্য আনা হবে। স্কুল-কলেজ হয়ে গেছে। তার জন্যে টাকা দিতে হবে। এছাড়াও গরিব কর্মচারী যারা না খেয়ে কষ্ট পেত, তাদের আমি মাসে ২৫ টাকা, ২০ টাকা, বেতন বাড়াইয়া দিছি। তাতে আমার দিতে হয়েছে। ৩৫ কোটি টাকা। কোথায় পাব? কোনো জায়গা থেকে আসবে? কীভাবে দেব বিশ্বাস করেন ভাইয়েরা, আমি রাত্রে ঘুমাতে পারিনা, আমি চিন্তা করতে পারি না, জেল থেকে যেদিন আমি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসছি তারপরের থেকে একদিনও আমি বিশ্রাম করি নাই। আমার পক্ষে দিনের আরাম, রাতের বিশ্রাম হারাম হয়ে গেছে। আমি আপনাদের দিকে চাইতে পারি না। দেখলে আমার বুক ফেটে যায়। আমি আসতেছিলাম। আমি রাস্তার ওপর গাড়ি থামাইছি। গাড়ি থামছে, আসতে পারে না। গ্রামের লোক দাড়াইয়া রইছে। ‘বাবা তোমারে একটু দেখব, তোমার কাছে কিছু চাই না, তোমার দেখব’। আপনারা আমারে দোয়া কইরেন, আপনারা যেভাবে আমাকে ভালবাসেন, আমি যেন আপনাদের এই ভালবাসা নিয়া মরতে পারি। এর বেশি আমিও আপনাদের ভালবাসি। মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসি। আমার দেবার মতো যা আছে-একটা জান, তা বাংলার মানুষের জন্য আমি মর্গেজ করে দিয়েছি। ভাইয়েরা আমার একটা কথা বলে যাবার চাই। লাইটেল ফাইটেল আর চলবে না। ১০০ বিঘার বেশি জমি কেউ রাখতে পারবেনা এবং বাকি জমি, যাদের জমি নাই তাদের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে। আমি ডিসি সাহেবকে অর্ডার দিয়ে রাখছি-দেখেন কোনো কোনো লাঠিয়াল জমি দখল করে রাখছে, সোজা জেলখানায় দিয়ে দেন আর গরীবের মধ্যে সে জমি ভাগ করে দেন। কোনো ভয় নেই আপনার, ছাড়বো না। ১০০ বিঘার বেশি কেউ রাখতে পারবে না। বাকি যা আছে তা গরীবের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে-এটাই গভর্নমেন্টের আইন এবং এই আইনই কাজ হবে এবং আমি সরকারি কর্মচারীদের হুকুম দিয়ে যাচ্ছি-যত তাড়াতাড়ি হয় এর যেন ব্যবস্থা করা হয়। আর আইন শৃঙ্খলা রাখেন। চোর, ডাকাত, গুন্ডা মানুষের শান্তি যেন নষ্ট করতে না পারে। চোর ডাকাত গুন্ডাদের আপনারা গ্রামের লোক তাদের পুলিশের কাছে দিয়া দিবেন, তাদের শাস্তি দেয়া হবে। আর কিছু কিছু রাজাকার, আলবদর, যারা আমার লোকেরে মারছে তারা পালাইয়া পালাইয়া বেড়াচ্ছে এবং জায়গায় জায়গায় সুযোগ পাইয়া কাছিমের মতো মাথা বাহির করতাছে। তোমাদের যে এখন পর্যন্ত কিছু করা হয় নাই, তার অর্থ দূর্বলতা নয়- তোমরা সাবধান হয়ে যাও। তোমাদের লিষ্ট আমাদের কাছে আছে। যদি বাড়াবাড়ি কর, তাহলে মনে রেখ যুদ্ধাপরাধী আইনে তোমাদের চলে যেতে হবে। তোমাদের বিচার হবে। এ সম্বন্ধে তোমরা নিশ্চিন্তে থাকতে পার। আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা আপনারা, বহু কষ্ট করছেন। লক্ষ লক্ষ লোক। বৃষ্টি-কাদার মধ্যে আপনারা রয়েছেন। আমার দুঃখ হচ্ছে ভাইয়েরা আমার, বোনেরা আমার। আপনাদের আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি। তবে একটি কথা বলে যাই, আওয়ামী লীগের নেতারা, আওয়ামী লীগ এই দেশের গরীবের প্রতিষ্ঠান। আওয়ামী লীগ গরীবের প্রতিষ্ঠান থাকবে। আওয়ামী লীগ গরীবের জন্য সংগ্রাম করেছে। যদি কোনো আওয়ামী লীগের নেতা দুর্নীতি করে তাদের পার্টি থেকে বাহির কইরা দেও। কিন্তু আওয়ামী লীগের যেন বদনাম না হয়। আপনারা ইউনিয়নে ইউনিয়নে নিঃস্বার্থ কর্মীরা আওয়ামী লীগ সুপ্রতিষ্ঠিান গড়ে তোলেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করেন এবং সরকারি কর্মচারীর সঙ্গে এবং পুলিশের সঙ্গে কো-অপারেশন কইরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান না হলে আমার সুখ কালি করবেন না, আমার মুখে কালি দেবেন না। সাত কোটি, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুখে কালি দেবেন না। আমার কর্মীদের কাছে এই আমার আবেদন। বাংলা, বাংলাদেশ প্রত্যেক বাঙালি এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গিয়ে কাজ করে খাবার অধিকার রয়েছে। কেউ বন্ধ করতে পারবে না। একটা কথা বলে যাই, বাংলাদেশ চারটি নীতির ওপর চলবে। জাতীয়তাবাদ, এটা হলেও কি? আমরা বাঙালি। আমাদের জয় বাংলা আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ। এই বাঙালি আমরা। আমরা বাঙালি না? দুই নম্বর, আমি গণতন্ত্র বিশ্বাস করি। কিন্তু গণতন্ত্র মানি। যা ইচ্ছে তাই লিখবেন। যা ইচ্ছে তাই বলবেন তাকে গণতন্ত্র বলে না। গণতন্ত্রের একটা নীতি আছে। এই গণতন্ত্র আমি বিশ্বাস করি। আপনারা গণতন্ত্র বিশ্বাস করেন না? আমরা সমাজতন্ত্র বিশ্বাস করি। যাকে বলা যায় শোষণহীন সমাজ। শোষণহীন সমাজ মানে কেউ কাউকে শোষণ করতে পারবে না। আপনারা চান না? আমরা ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করি। তার অর্থ ধর্ম বিরোধী নই। মুসলমান, মুসলমান ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধ তাদের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু হিন্দু ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তাদের ধর্ম পালন করবে। এক ধর্ম অন্য ধর্মের ওপর অত্যাচার করবে না। আর ধর্মের নামে জুয়াচুরি, পকেটমার, লুটতরাজ, ব্যবসা, আর পশ্চিম পাকিস্তানের টাকা খাইয়া রাজনীতি করা যাবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি চলবে না, ধর্মের নামে লুটতরাজ চলবে না। তবে আমি মুসলমান। আমি মুসলমান হিসাবে আমার ধর্মকর্ম পালন করব। কি মানেন? আমার ধর্ম আমার কাছে, তোমার ধর্ম তোমার কাছে কুলাইয়া আইয়ুআল কাফেরুনা, লা আ বুদুনা মা আতা বুদুনা ওলা আনতুম আফেদুনা মাবুদ, লাকুম দিনউকুম ওয়ালিয়াদিন।”
“তোমার ধর্ম তোমার কাছে, আমার ধর্ম আমার কাছে।” এইটাই হলো ধর্ম নিরপেক্ষতা রাষ্ট্র। বাংলাদেশে তাই থাকবে। তাই আমি আশা করি। আপনাদের এতো বিশ্বাস আছে? বৃষ্টি কাদা চলে যাক, আমিও একটু কাজকর্ম গুছাইয়া লই, সব ঠিকঠাক করি, আবার নোয়াখালি এসে আপনাদের সাথে দেখা কইরা যাব। ঠিক, আছ? আমি যা বলব আপনারাতো তা করবেন? আপনারা দিনভর পরিশ্রম করে উৎপাদন করবেন? চোরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবেন যাতে শোষণহীন সমাজ হয়, চেষ্টা করবেন? সকলে হাত তোলেন-জয় বাংলা।৯২

রেফারেন্স: দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!