You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.06.22 | যেকোন স্থানে যে কোন সময় তল্লাশী কার্ফু- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুল মান্নান | দৈনিক বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

যেকোন স্থানে যে কোন সময় তল্লাশী কার্ফু

বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুল মান্নান বৃহস্পতিবার রাতে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক বেতার ভাষণে বলেন, বঙ্গবন্ধুর দেয়া ১৫ দিনের নির্ধারিত সময়সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকে সমাজবিরোধী। ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্যে ঢাকা এবং দেশের সর্বত্র সরকার পুলিশ ও জাতীয় রক্ষীবাহিনী মোতায়েন করেছেন। তিনি বলেন, যে কোনো মূল্যেই এ দেশ থেকে সমাজবিরোধীদের নির্মূল করতে সরকার দৃঢ় সংকল্প। বঙ্গবন্ধুর দেয়া নির্ধারিত সময়সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকেই সরকার সারাদেশে সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক অভিযান শুরু করেছেন। সমাজবিরোধীদের খুঁজে বের করে ধ্বংস করার জন্যে প্রয়োজন হলে যেকোনো স্থানে যেকোনো মুহূর্তে সান্ধ্য আইন জারী করে তল্লাসী চালানো হবে। গত ৭ জুন অপরাহ্নে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণে দেশের সকল সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের হুশিয়ার করে দিয়ে, তাদের সকল প্রকার দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপ বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এ সতর্কবাণীও উচ্চারণ করেছিলেন যে, সমাজবিরোধী মুষ্ঠিমেয় লোক যদি ১৫ দিনের মধ্যে সকল প্রকার খুন-খারাবি, চুরি-ডাকতি, রাহাজানি, কালোবাজারী, চোরাচালানী ও মুনাফাখোরী বন্ধ না করে, যদি তারা বেআইনিভাবে দখলকৃত বাড়ি-গাড়ি ফেরত না দেয়, যদি তারা বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ সরকারের হাতে সমর্পণ না করে এবং যদি মজুতদাররা তাদের অপরাধমূলক কার্যকলাপ বন্ধ না করে, তাহলে সরকার যেকোনো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কুষ্ঠিত হবে না। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া সে ১৫ দিনের মেয়াদ আজ বিকেল ৪ টায় শেষ হয়েছে। গত ২ সপ্তাহ ধরে আমি অত্যান্ত আনন্দের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, দেশের শান্তিপ্রিয় জনগণের সার্বিক ও সাহায্যে বলিয়ান হয়ে, পুলিশবাহিনী ও দেশের নিরাপত্তা, শান্তি ও শৃঙ্খলা বিধানরত সরকারি বাহিনী প্রচুর মজুদ মালামাল, অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, চোরাই গাড়ি ও বেআইনিভাবে দখলকৃত বাড়ি উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছে। জনসাধারণের এই সার্বিক সাহায্য ও সহানুভূতির ফলে দেশের মধ্যে কর্মউদ্দীপনা এসেছে। এছাড়া স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এই আইন শৃঙ্খলায় বিশ্বাসী জনগণ বেশ কিছু হাতিয়ার, গোলাবারুদ, বাড়ি, গাড়ী ফেরত দিয়েছেন। শান্তিকামী দেশবাসী ভাইদের এই সাহায্য ও সহানুভূতিতে আপনাদের সরকার অত্যান্ত আনন্দিত। কিন্তু অত্যান্ত দুঃখের বিষয় এই যে, আজও কিছু সংখ্যক ঘৃণ্য সমাজবিরোধী বঙ্গবন্ধুর উদারতাকে সরকারের দুর্বলতা মনে করে আপনাদের শান্তিকে বিঘ্নিত করেছে এবং অসামাজিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এটা অনস্বীকার্য যে, আজও বাংলাদেশের বিভিন্নস্থানে বেআইনিভাবে কিছু গোলাবারুদ, হাতিয়ার, চোরাই গাড়ী লুকায়িত আছে। আজও অনেকে বেআইনিভাবে বাড়ি ঘর দখল করে রয়েছে এবং অদ্যবধি কিছু সংখ্যক চোরাচালানী, কালোবাজারী, মুনাফাখোর সাধারণ মানুষকে শোষণ করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এখনও গুটি কয়েক খুনি, ডাকাত, চোর, গুন্ডা, বদমাইশ আগ্নেয়াস্ত্রে বলে বলিয়ান হয়ে তাদের দুষ্কৃতি ছালিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আপনাদের জানমাল রক্ষার্থে জনমনে স্বস্তি বিধানের মহান ও পবিত্র কর্তব্য পালনের উদ্দেশ্য আজ অপরাহ্ন ৪টা থেকে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ১৫ দিন মেয়াদের সমাপ্তির পর মহুত্ব থেকে সমাজ বিরোধীদের উচ্ছেদকল্পে বাংলাদেশ পুলিশ ও জাতীয় রক্ষীবাহীনী নিয়োগ করা হয়েছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যে কোনো এলাকায় যে কোনো মুহূর্তে থানা তল্লাসী করার জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দেশের সকল আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোকে আমি নির্দেশ দিয়েছি। প্রয়োজন হলে যে কোনো এলাকায় ‘সান্ধ্য আইন জারি করে সকল প্রকার দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে থানা তল্লাসী হবে। ভাইয়েরা আমার, স্বাধীনতার সংগ্রাম থেকে আরম্ভ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আপনারা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে সরকারকে আন্তরিক সাহায্য করেছেন, অনুভূতি জানিয়েছেন। বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় জনসাধারণ ভাই-বোনেরা অনেক দুঃখের রাত্রি ও সংগ্রামে জয়ী হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চাইবেন-এটাই স্বাভাবিক। সশস্ত্র সংগ্রামের সেই রক্তঝড়া দিনের পরে আমরা স্বভাবতই ভেবেছিলাম এদেশের প্রতিটি মানুষ খাঁটি সোনা হয়ে বেরুবে। যাবতীয় সমাজবিরোধী তৎপরতা দেশের বুক থেকে নির্মূল হবে। কিন্তু গুটি কতক সমাজদ্রোহী সমাজশত্রু এখনও তৎপরতা রয়েছে এবং দেশের ও সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্নত করে চলেছে। এই শক্রদের আমরা দমন করবোই। স্বভাবতই আমরা আশা করি এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সরকারের জনকল্যাণমূলক যে কোনো প্রচেষ্টাকে আপনারা যেভাবে সাহায্য করেছেন সেভাবে এবারও আপনাদের জানমাল ও স্বার্থের নিরাপত্তার খাতিরে সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা করবেন সহানুভূতিও দেখাবেন। এ প্রচেষ্টাকে পূর্ণভাবে সফল করার জন্য আমার দেশের শান্তিকামী প্রতিটি মানুষের সার্বিক সাহায্য ও সহানুভূতি কামনা করি। বাংলাদেশের প্রতি ঘরকে শান্তি ও সমৃদ্ধির উৎস করে তোলার জন্য সরকারের প্রতিটি কাজে সহযোগিতা করুন, সমাজ শক্রদের দমনের জন্য সকল প্রকার খবরাখবর থানা পুলিশকে জানিয়ে দিন এবং যেখানেই আইন-শৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ সমাজ শত্রু দমনে এগিয়ে যাবেন, সকল দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভুলে তাদের সক্রিয়ভাবে সাহায্য করুন। এখানে আরো একটি কথা বলা দরকার সমাজশত্রু ও সমাজদ্রোহী ব্যক্তিরা সংখ্যায় যত কম হোক সহজে নতি স্বীকার করবে তা ভাববেন না। তারা নানাভাবে নানা গুজব ছড়িয়ে সরকারের এই প্রচেষ্টাকে বানচাল করে দেয়ার চেষ্টা করবে। কোথাও কোথাও দেখা যাবে তারা নিজেরাই আইন-শৃঙ্খলার নাম করে নিজেদের হাতে আইন তুলে নেবার চেষ্টা করছে। এই ছদ্মবেশী সমাজশত্রুদের অবশ্যই রুখতে হবে। সরকার যেমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কাউকে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে দেবে না আপনারা তেমনি নিজের হাতে যারা আইন তুলে নিতে চায় ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিহত করুন। সমাজশত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গিয়ে কোথাও কোথাও শান্তি প্রিয় জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় কিছুটা ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে, কোথাও কোথাও সামান্য ভুলভ্রান্তিও হতে পারে, এজন্য আমি আগেভাগেই এ ব্যাপারে আপনাদের সহৃদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আপনারা সরকারের এই প্রচেষ্টাকে নিজেদের বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এটাই আপনাদের কাছে আপনাদের সরকার আশা করে। আসুন, এবার আমরা লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা পবিত্র বাংলার মাটিকে নিখাদ সোনায় ভরে তুলি। আসুন, আমরা সোনার বাংলার সোনার মানুষকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত শান্তির সন্ধান দেই। আসুন, আমরা শহীদের তাজা রক্তে ভেজা সোনার বাংলাকে শাশ্বত সুন্দর করে গড়ে তুলি।৮৬

রেফারেন্স: ২২ জুন ১৯৭২, দৈনিক বাংলা
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ