You dont have javascript enabled! Please enable it!

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

আমার ভাই ও বোনেরা, আজ ৭ জুন। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯৬৬ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগ ৬ দফা ঘোষণা করেছিল। এই ঘোষণায় সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক গোষ্ঠী ক্ষেপে গিয়েছিল। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যে, আমরাও তাদের বুঝতে পেরেছি। তারা জানতে পেরেছিল, বাঙালিদের আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। তাই আইয়ুব খান ও মোনায়েম খান তাদের সৈন্য বাহিনী দিয়ে আমার লোকদের ওপর ঝাপিয়ে পরেছিলেন। আমি তখন কারাগারে বন্দি হয়ে যাই।
আপনাদের নিশ্চয়ই আরও মনে আছে, আমাকে যশোরে গ্রেফতার করা হয়, তারপর যশোর থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ঢাকা থেকে আমাকে সিলেট নেয়া হয় এবং সেখানেও আমাকে গ্রেফতার করা হয়। সিলেট থেকে ময়মনসিংহ নেয়া হয়। এবং ময়মনসিংহেও আমাকে গ্রেফতার করা হয়। এমনি করে গ্রেফতারের পালা চলে। সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের তাজউদ্দিন আহমদ, জহুর আহমেদ চৌধুরী, খন্দকার মোশতাক আহমদ প্রমুখ নেতারা গ্রেফতার হন। পরে আমার সহকর্মী বন্ধু মিজানুর রহমান চৌধুরী, শামসুল হক, মোল্লা জালাল উদ্দিন, মনসুর আলী, মরহুম আব্দুল আজিজ (চট্টগ্রাম), মরহুম আমজাদ হোসেন (যিনি পাবনায় মৃত্যু বরণ করেছেন) এবং হাজার হাজার আওয়ামী লীগ পন্থী, ছাত্র ও শ্রমিক কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। শুধু তাই নয়, ৭ জুন তারিখে তেজগাঁও, ভিক্টোরিয়া পার্ক, নারায়ণগঞ্জ, মুক্তাগাছা এবং আরো অনেক জায়গাতে গুলি করে আমার শত শত ভাই বোনকে হত্যা করা হয়। আইয়ুব খান মনে করেছিলেন, গুলি করে বাঙালিদের দাবিয়ে দিবেন। কিন্তু তিনি তা পারেন নাই। সেই দিনই শুরু হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম। অনেকে হয়ত বুঝতে পারেন নাই। কিন্তু আমরা জানতাম, এ ব্যাপারে কোথায় গিয়ে দাড়াবে। এ জন্য ধাপে ধাপে আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া হয়। এরপর আমি যখন গ্রেফতার হয়ে যাই, আমার সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী সভাপতি হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তারপর তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি বা সম্পাদক হয়েছেন, তাকেও গ্রেফতার করে জেলে দেয়া হয়েছে। তারপরেও ষড়যন্ত্র হয়। আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করে তারমধ্যে থেকে এক দলকে নবাবজাদা নাসরুল্লাহ খান সরিয়ে নিয়ে যান। তাতেও আমাদের দাবাতে না পেরে আমার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হয়। আপনাদের সব ইতিহাসই মনে আছে। সেদিনও আপনারা শুনেছেন, অনেক দল আইয়ুব খানের টাকা খেয়ে ৬দফা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছিল। তারপর আসুন। ১৯৬৮-৬৯ সালের ঘটনাগুলোর কথায়। সে সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু করে। আওয়ামী লীগও আন্দোলনে যোগদান করে এবং তাতে নেতৃত্ব দেয়। তারপর আইয়ুব খান আমাকে আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। সেদিনও আমার দেশের বহু লোককে জীবন দিতে হয়েছে। রক্ত আমাদের অনেক দিতে হয়েছে, কোনো দেশ, কোনো জাতি তা দেয় নাই। আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ লোকে বলে, মানুষের স্মৃতি শক্তি নাকি দূর্বল। সে নাকি অল্প দিনেই সব ভুলে যায়, কিন্তু কেমন করে ভুলবে? ২৩-২৪ বছর আওয়ামী লীগকে নিয়ে আমি সংগ্রাম করেছি। এই সময়ের মধ্যে মাত্র ১২-১৩ মাস সোহরাওয়ার্দী সাহেব ক্ষমতায় ছিলেন। সর্বক্ষণেই উজানে আমাদের নৌকা বাইতে হয়েছে। এবং বারবার গ্রেফতারও হতে হয়েছে; রক্ত দিতে হয়েছে। সে ইতিহাস আজও অম্লান রয়েছে।
নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা : তারপর যখন নির্বাচনে আপনারা আমাকে ভোট দিলেন, তখনও একদল লোক নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করেছিল। আমি বলেছিলেম, দুনিয়াকে দেখিয়ে দিতে হবে যে, বাংলার মানুষ এক বাংলার মানুষ স্বাধীনতা দিয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে এসব প্রমাণ হয়ে গেলেও কিন্তু ষড়যন্ত্র বন্ধ হলো না। ইয়াহিয়া খান সাহেব এসে গদিতে বসলেন। অর্থাৎ এক খান গেলেন, আর এক খান এলেন। ইয়াহিয়া খান এসে শুরু করলেন নির্বাচনের কথা, মিষ্টি কথা, ফিসফিস করা, ছোট ছোট কথা, বড় বড় কথা আর সঙ্গে সঙ্গে সৈন্য বাড়াতে লাগলেন বাংলার বুকে, আমার ওপর আঘাত হানার জন্য। আমরা প্রস্তুত হলাম। আমরা এখানে দাড়িয়ে শপথ নিলাম ৩ জানুয়ারি তারিখে, যে আদর্শে বাংলার মানুষ আমাদের ভোট দিয়েছে তাতে আপষ নাই। আপনারা জানেন ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি মনে করেছিলেন, আমাকে প্রধানমন্ত্রী বললেই আমি গলে গদগদ হয়ে যাব আর আমি আমার দাবি ছেড়ে তার সাথে হাত মেলাব। কিন্তু তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে জানতেন না। আওয়ামী লীগকেও জানতেন না। তার এটাও জানা ছিল না যে, প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য মুজিবুর রহমান রাজনীতি করে নাই। আমি রাজনীতি করেছি বাংলার মানুষকে বাঁচাবার জন্য, বাংলার মানুষকে স্বাধীনতা দেবার জন্য, বাংলার মানুষকে শোষণহীন সমাজ গড়ার জন্য। আমি রাজনীতি করেছি পশ্চিম পাকিস্তানের হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করার জন্য। বাংলার মানুষ যাতে মানুষের মতো দুনিয়ায় দাঁড়াতে পারে তার জন্য এবং বাংলার সম্পদ যাতে পশ্চিমারা লুট করে খেতে না পারে তারই জন্য আমি সগ্রাম করেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য সংগ্রাম করি নাই।
ভায়েরা আমার, এরপর অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন এবং তার পরের ঘটনাবলি সম্পর্কে আমি সংক্ষেপে কিছু বলার চেষ্টা করবো। সে সবের আলোচনায় বেশি সময় আজ আমি নেব না। কারণ, আরও অনেক কথা আপনাদের বলতে হবে। জেল থেকে বের হয়ে এখানে এসে আমি সামান্য কয়েকটি কথা বলেছিলাম। সেদিন আমি বেশি কিছু বলতে পারি নাই। কারণ মাঝে মাঝে আমার চোখে পানি এসে গেছে। তারপরে ভারতের মহিয়ষী নারী মিসেস গান্ধী যখন এখানে আসেন, তাকে অভ্যর্থনা জানাতে আপনাদের সামনে এসেছিলাম এবং কয়েক মিনিট বক্তৃতা করেছিলাম। তিনি অতিথি। তার সামনে অন্য কথা বেশি বলা যায় না।
মুক্তি সংগ্রামের সূচনা : আজ দেশের অবস্থা সম্বন্ধে আপনাদের জানা দরকার। ৩০ লক্ষ লোক রক্ত দিয়েছে। ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া বর্বর বাহিনী আমার ওপর আক্রমণ চালায়। সেদিন রাত্রে আমার অবস্থা যে কেমন ছিল সেটা কেবল আমিই জানি। আমি জানতাম ঘর থেকে বের হলেই আমাকে গুলি করে মারবে। মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু বাংলার মাটিকে আমি ছাড়তে পারি নাই। রাত্রি ১১ টার সময় আমার সমস্ত সহকর্মীকে, আওয়ামী লীগ নেতাদের হুকুম দিলাম, বের হয়ে যাও। যেখানে পার, এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। খবরদার, স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত সংগাম চালিয়ে যেও। রাত্রে আমি চট্টগ্রামে নির্দেশ পাঠালাম। আগে যাকে ই, পি, আর বলা হত তাদের সদর দফতর ছিল চট্টগ্রামে। পিলখানা হেডকোয়ার্টার তখন শত্রুরা দখল করে নিয়েছে। ওদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। আমি যখন পিলখানার সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না তখন আমি চট্টগ্রামের সাথে যোগাযোগ করে বললাম আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। তোমরা বাংলার সব জায়গায় ওয়ারলেসে এ খবর দিয়ে দাও। পুলিশ হোক, সেনা বাহিনী হোক, আওয়ামী লীগ হোক, ছাত্র হোক, যে যেখানে আছে পশ্চিমাদের বাংলা থেকে খতম করা না পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাও, বাংলাদেশে স্বাধীন কর। তারা আমার কথা মতো খবর পৌঁছেছিল। সে রাত্রে কেবল আমার বাড়িতে নয়, রাজারবাগ, পিলখানা, আওয়ামী লীগের অফিস আর ছাত্রাবাসেও আক্রমণ চলে। বেছে বেছে আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। রাজারবাগের পুলিশরা ৬ ঘণ্টা ৩০৩ রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। ঢাকায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩ থেকে ৪ টা ব্যাটেলিয়ন ছিল। হঠাৎ আক্রমণ করে তাদেরকে মেরে ফেলা হয়। এমনি করে সমস্ত বাংলাদেশের ছাত্র-যুবক কৃষকদের মেরে ফেলা হয়। আমার সহকর্মীরা পালিয়ে মুজিবনগরে আশ্রয় নেন। সেখানে তারা স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দিয়ে স্বাধীন সরকার কায়েম করেন। নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হন, আর তাজউদ্দিন হন প্রধানমন্ত্রী। মনসুর আলী, কামারুজ্জামান এবং মোশতাক আহমদকে নিয়ে সরকার গঠিত হয়।
দালালদের সমালোচনা : এখন যারা সমালোচনা করে বক্তৃতা দিচ্ছেন, তখন তাদের কাউকে এসব কাজে দেখা যায় নাই। তাদের কেউ যুদ্ধে এগিয়ে আসেন নাই। তারা কেবল প্রাণ বাঁচানোর জন্য পালিয়ে বেড়াতেন। অথচ আওয়ামী লীগের নেতারা তখন মুজিবনগরে বসে আবার সকলকে একতাবদ্ধ করে তারা যুদ্ধ চালিয়ে যান। সে সময়ে বাংলাদেশ থেকে ১ কোটি লোক পালিয়ে গিয়ে পশ্চিম বাংলা, মেঘালয়, আসাম, আর ত্রিপুরায় আশ্রয় নেন। তার স্ত্রী-পুরুষ কন্যার হাত ধরে দেশ ছেড়ে চলে যায়। তখন ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় হাজার হাজার লাশ। সারা বাংলার রাস্তায় রাস্তায় হাজার লাশ। নদীতে লাশ, ঘরে ঘরে লাশ। মা-বোনের আর্তনাদ, চারদিকে হাহাকার, সর্বহারার আর্তনাদ। তবুও সেদিন সমালোচকদের কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় নি। তারা বরং ইয়াহিয়া খানের দালালি করেছে। তারপরের যুদ্ধের ইতিহাস আপনারা জানেন। পাকিস্তানবাহিনী ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিল। ১ কোটি লোক দেশ ত্যাগ করল। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হলো। শ্রমিক আর ছাত্রদের গুলি করে মারা হলো। আজ অনেকেই সমালোচনা করে বক্তৃতা করেন আর আমার সহকর্মী মশিহুর। রহমানকে দুই মাস পর্যন্ত মারতে মারতে হত্যা করা হয়েছে। আমার আর একজন এম সি এ আমীন উদ্দিনকে আধামরা করে জীপের পিছনে বেঁধে দিল, গুরিয়ে গুরিয়ে মেরে ফেলা হয়। আমার এক চাচাকে ছয় টুকরো করে রাস্তার মাথায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। সৈয়দপুরের এম সি এ নাজমুল হুদা। সরকারকে গুলি করে হত্যা করে দুই ভাগ করে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছিল। এখন যারা বড় বড় কথা বলেন, তখন তারা কোথায় ছিলেন? সবাই স্বাধীনতা পেয়ে গেছে। কিন্তু একি চোরাকারবারীর স্বাধীনতা, মুরাফাখোরের আর মজুতদারের স্বাধীনতা? রাজাকারের আর আলবদরের স্বাধীনতা? আমি কিছু বলি না। এজন্য কি তারা ভেবেছে আমি নরম মানুষ? আমি নরম মানুষ নই। আমি তাদের খেলতে দিয়েছিলাম। আমাকে আপনারা জাতির পিতা আঁখ্যা দিয়েছেন। আমি প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য আসি নাই। আমি সাড়ে সাত কোটি মানুষকে ভালোবাসি। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আমাকে ভালোবাসে। জীবনে কখনো আমি তাদের সাথে বেঈমানী করি নাই। চারবার আমাকে ফাসি দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। তবুও আমি মাথা নত করি নাই। তা সত্ত্বেও কেন এত কথা বলা হয়?
যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি : জেল থেকে বের হয়ে আসার পর আমি বলেছিলাম আমার কর্তব্য বোধহয় শেষ হয়ে গেছে। আমার দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমার পতাকা আজ দুনিয়ার আকাশে উড়ে। আমার দেশ বাংলাদেশ আজ দুনিয়ার মানচিত্রে স্থান পেয়েছে। আজ আমি বলতে পারি, আমি বাঙালি। আজ আমি বলতে পারি, বাঙালি একটি জাতি। আজ আমি বলতে পারি বাংলার মাটি আমার মাটি। এর বেশি তো আমি চাই নাই। আপনারা আমাকে সব দিয়েছেন। আপনারা তো আমাকে জাতির পিতা বানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীত্ব আমার জন্য বড় জিনিস নয়। যা কোনো দিন কোনো মানুষ পায় নি, তা আমি পেয়েছি। আপনারা যা দিয়েছেন, সে হলো আপনাদের ভালোবাসা। আমাকে আপনারা দোয়া করবেন, আমি যেন আপনাদের ভালোবাসা নিয়ে মরতে পারি, এর বেশি কিছু আমি চাই না। জেল থেকে বের হয়ে এসে আমি দেখেছিলাম রেলওয়ে ভেঙে গেছে, চালের গুদাম নাই, দোকানে মাল নাই। ব্যাংকের টাকা জ্বালিয়ে দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা লুট করে নিয়েছে। আমি আরও দেখেছিলাম মানুষের কাছের বন্ধুকে। আমার দেশের লোক আমাকে ভালোবাসে। তাই আমার সহকর্মী বললেন, তোমাকেই তো সব কিছুর ভার নিতে হবে। তার ফলে আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব নিতে বাধ্য হলাম। বিশেষ করে এই জন্য যে, আমার বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা দুই লক্ষ অস্ত্র দিয়েছে। অস্ত্র সমর্পণের এমন নজির দুনিয়ার ইতিহাসে আর দেখা যায় না। আমাদের গুদামে চাল নাই, পকেটে পয়সা নাই। পোর্ট ভেঙে দিয়েছে। বাস-ট্রাক পুড়িয়ে দিয়েছে। রেলগাড়ি চলে না। রাস্তায় গাড়ি চলতে পারে না। চট্টগ্রাম ও চালনা পোর্টের মুখে সমস্ত জাহাজ ডুবিয়ে রেখে দিয়েছে। এই অসস্থায় বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বাঁচাবো কি করে? দস্যুর দল মানুষ হত্যা করে খুশি হয় নাই। আমার সম্পদ ধ্বংস করে লুট করে নিয়ে গেছে। অথচ আজ একদল লোক এ সবের জন্য ভারতকে দোষ দিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ১ কোটি লোককে মিসেস গান্ধী খাবার দিয়েছিলেন, কাপড় দিয়েছিলেন, আশ্রয় দিয়েছিলেন। এসব কি তারা দেখে আসে নাই?
খাদ্য ও ত্রাণ : আমার দেশ স্বাধীন দেশ। ভারত হোক, আমেরিকা হোক, রাশিয়া হোক, গ্রেট বৃটেন হোক, কারো এমন শক্তি নাই যে, আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি, ততক্ষণ আমার দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু বন্ধু রাষ্ট্রকে বন্ধু বলতে লজ্জা করা উচিত নয়। যে দিন আমার সরকার ক্ষমতায় আসে, সেদিন এক ছটাক চাল ছিল না। আমি তাই ভারতের কাছে চাল চাই। ভারত তখন আমাদের সাড়ে সাত লক্ষ টন চাল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এরই মধ্যে তাদের কাছ থেকে আমি ১ কোটি ৬২ লক্ষ মণ চাল পেয়েছি। এই চাল গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আনলোডও চাল দিয়েছে। রাশিয়াও আমাকে সাহায্য করেছে। রাশিয়া আমার বন্দর সাফ করে না। দিলে আমি খাবার আনতে পারতাম না। আমার বন্ধু রাষ্ট্র রাশিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাকে সাহায্য করেছে। কিন্তু এই বন্ধুত্ব নষ্ট করার ক্ষমতা কারও নাই। বাংলার মানুষকে আমি জানি। আমাকেও বাংলার মানুষ চেনে। বাংলার মানুষকে আমি ভালোবাসি, বাংলার মানুষ আমাকে ভালোবাসি। আমি তাদের জন্য কোনো কাজে হাত দিয়ে কখন হাল ছাড়ি না। আপনাদের কাছে আমি প্রথম দিন বলেছি, ৩ বছর আপনাদের কিছুই দিতে পারবো না। পরে সাড়া বাংলাদেশেই আমি এ কথা বলেছি। কিন্তু পারবোনা বললেও আমি দিয়েছে। রিলিফের জন্য, ঘরবাড়ি তৈরি করার জন্য এ ৬ মাসে ২৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। টেস্ট রিলিফের জন্য গ্রাম অঞ্চলে দেওয়া হয়েছে ২৬ কোটি টাকা। স্কুল কলেজের জন্য দেওয়া হয়েছে ১০ কোটি টাকা। রিলিফ ক্যাম্পের জন্য দেওয়া হয়েছে ১০ কোটি টাকা। মোট ৭৫ কোটি টাকা এই ৬ মাসে দেওয়া হয়েছে। রিলিপ, কৃষি ঋণ এবং সমবায় ঋণ দেওয়া হয়েছে ২৬ কোটি টাকা। এছাড়া , যত বকেয়া খাজনা ছিল সব মাফ করে দিয়েছি। একদিন এই ময়দানে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ করে দিব। আমি তা দিয়েছি। আমাদের বন্দর ঠিক হয়ে গেছে। এখন বিদেশ থেকে মাল আসতে পারবে, আমার তেল ছিল না, ভারত তেল দিয়েছে। আমাকে সব জিনিসিই অন্যের কাছ থেকে আনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ তো কলোনী ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের বাজার ছিল। পশ্চিমারা সেখানে মাল তৈরি করত আর বাংলাদেশ সেই মাল বেঁচে পকেটে টাকা নিয়ে উড়ে চলে যেত। আজ জিনিসপত্রের ঘাটতি পড়েছে। সব জিনিসই আমাকে বাইরে থেকে আনতে হবে।
শিল্প জাতীয়করণ ও শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি : আমার শ্রমিক ভায়েরা, কৃষক ভাইদের জন্য আমি টেস্ট রিলিফ দিচ্ছি, বিনা শর্তে ঋণ দিচ্ছি, খাজনা মাফ করেছি। এই সঙ্গে আমি ব্যাংক জাতীয়করণ করেছি। বড় বড় শিল্প কারখানা আর ইন্সিওরেন্স কোম্পানি জাতীয়করণ করেছি। এসব জাতীয়করণের অর্থ আমাদের বুঝে দেখতে হবে। এগুলো সাড়ে সাত কোটি লোকের সম্পদ। শ্রমিকেরা সারা জীবন শিল্প কারখানা, ব্যাংক, ইন্সিওরেন্স কোম্পানি ইত্যাদি জাতীয়করণের দাবি জানিয়েছেন। এগুলো জাতীয়করণের অর্থ হলো শোষণের চাবি কাঠি ধ্বংস করে দেওয়া। আমরা শোষণের চাবিকাঠি ধ্বংস করে দিয়েছি। আপনারা জানেন, পশ্চিমাদের হাতে যে সব কলকারখানা ছিল তার সব টাকা তারা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আপনারা শুনে আশ্চর্য হয়ে যাবেন যে, কারখানা চালাতে এই গভর্নমেন্টের ১৫৮ কোটি টাকা দিতে হয়েছে। যদি কারখানা চালিয়ে উৎপাদন না করতে পারেন, আমি বেতন বাড়াবো কোথা থেকে? আপনারা আমার কাছে চান নাই, আমার কাছে দাবি করার দরকারও নাই। আমি আপনাদের জন্য জীবন ভর দাবি করেছি। আমার কাছে আপনারা কি দাবি করবেন? আপনারা না বললেও আমি ২৫ টাকা বেতন বাড়িয়ে দিয়েছি। তাতেও ৩৫ কোটি টাকা বাড়াতে হয়েছে। আপনারা যদি উৎপাদন না করেন, আমি টাকা দেব কোথা থেকে? আমি কি তবে বাংলাদেশকে বিক্রি করে টাকা দিব? না বাংলাদেশকে বিক্রি করতে পারব না। আমাকে সমালোচনা করে বলা হয়েছে, আমি ধর্মঘট কেন বন্ধ করলাম? কিন্তু আমি তো ধর্মঘট বন্ধ করতে চাই নি। তবে, আমি যদি শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য টুঙ্গিতে টাকা পাঠাই বা রিলিফের টাকা দিই আর সেখানে সেই টাকা কেড়ে নেয়া হয় এবং তারপর আবার যদি কেউ বেতন নিতে আসে তবে সেটা কি ভালো হয়? শ্রমিকদের কর্তব্য হলো উৎপাদন করা।
ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন : আমি এখানে আজ আর একটি কথা ঘোষণা করছি। সরকার যেসব কারখানা জাতীয়করণ করেছেন, এখন থেকে সেগুলির প্রত্যেকটির ম্যানেজমেন্ট বোর্ডে দুই জন করে সদস্য থাকবে। এবং শ্রমিকরা নির্বাচনের মাধ্যমে এই সদস্যদের বোর্ডে পাঠাবেন। এছাড়া বোর্ডে সরকারের এবং ব্যাংকের পক্ষ থেকে তিনজন সদস্য থাকবেন এবং এই পাঁচজন বসে কারখানা চালাবেন। যাই আয় হোক না কেন, আদমজী, দাউদ বা আমিনের পকেটে যাবে না। কোথায় যাবে, তা আপনারা জানতে পারবেন। আপনারা হলেন শতকরা একজন বা দেড়জন আর বাংলার কৃষক হলো শতকরা ৮৫ জন। আয়ের একটা অংশ আপনারা নেবেন। আর বাকি অংশ দেশের কৃষকদের। তাদের টাকা দিয়ে শিল্প-কারখানা চালানো হয়। তাদেরও ভোগ করার অধিকার রয়েছে। শ্রমিক ভায়েরা, দুধ খান, গরু জবাই করে খেয়ে ফেলবেন না। তাতে দেশ চলবে না। আর লাল বাহিনীর ভায়েরা, আপনারা হবেন আদর্শকর্মী। আপনাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। আর আপনাদের দেখতে হবে যে, ৮ ঘণ্টার জায়গায় লাল বাহিনীর ছিল দশ ঘণ্টা পরিশ্রম করে এবং এই কাজ দেখিয়ে অন্য শ্রমিকদের উৎসাহ দিতে হবে। আপনারা ১০ ঘণ্টা না পারেন ৯ ঘণ্টা কাজ করুন বা ৮ ঘণ্টা করুন। উৎপাদন বাড়ান। তাহলে লাল বাহিনী আপনাদের ইজ্জত থাকবে। লাল টুপি মাথায় দিয়ে বেড়ালে লাল বাহিনী ইজ্জত পাওয়া যাবে না।
সমাজবিরোধী কার্যকলাপ : ভায়েরা আমার, আজ আপনাদের বেতন বাড়ালেই সুবিধা হবে না। সে জন্য বাংলাদেশে ৪ হাজার ২শ দোকান খোলা হয়েছে। প্রত্যেক ইউনিয়নে একটি করে ন্যায্যমূল্যে জিনিসপত্র দেওয়ার জন্য শ্রমিক এলাকায়ও এ ধরনের দোকান খোলা হবে। তাতে খরচ হবে ১৯ কোটি টাকা। তবে মজুতদার, চোরাকারবারী আর চোরাচালানীরা হুশিয়ার হয়ে যাও। তাতে তাদের আমি সোজা কথায় বলে দিচ্ছি, ৫ মাস আমি তাদের অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, বুঝিয়েছি, অনেক করে বলেছি, এ কাজ করো না। আমার বিশ্বাস ছিল যে, তারা আমার কথা শুনবে। কিন্তু দেখেছি চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী। তাই তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলতে চাই, যারা শহরে সরকারি বাড়ি-গাড়ী দখল করে আছ যারা দোকান বা জমি দখল করে আছ, যারা মজুদ করেছো, জিনিসপত্র বিক্রি করছে না, জিনিসের দাম বাড়াবার চেষ্টা করছে, তাদের রেহাই নাই। আমি ভিক্ষা করে দুনিয়ার নানা দেশ থেকে জিনিসপত্র আনছি আমার গরিব দুঃখীদের জন্য সেই জিনিস যারা লুট করে খাচ্ছো, তাদেরও রক্ষা নাই। আমি ১৫ দিন সময় দিলাম। ১৫ দিনের মধ্যে যদি সরকারি বাড়ি না ছাড়ো, যদি মজুদ করে রাখ, এক একটি এলাকায় আমি কাফু দেবো আর সমস্ত পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট আর আমার স্বেচ্ছাসেবকরা সেখানে তল্লাসী চালাবেন। এতদিন আমি কিছু বলি নাই। এখন বলে দিলাম, হুকুম দিয়ে দিলাম। এর পরেও বড় বড় বক্তৃতা করবে আর রাত্রি বেলায় চোরাগাড়ীতে চড়বে, এটা হবে না। আমার লাশ থাকতে নয়। বার বার ঘুঘু তুমি ধান খেয়ে যাও। আর ঘুঘু খাওয়ার চেষ্টা করো না। আমি পেটের মধ্যে হতে ধান বের করবো। চিন্তার কারণ নাই।
এম সি এ দের সমালোচনা : ভায়েরা আমার, আর একটা কথা আমি আপনাদের কাছে বলতে চাই। আওয়ামী লীগ ২৩ বছর এই বাংলাদেশে রাজনীতি করছে। এখন কিছু লোক আওয়ামী লীগের এমসিএদের নিন্দা করে। কিন্তু ২৩ জন এমসিএকে বহিষ্কার করেছে কোনো পার্টি? এমন বহিষ্কারের নজির পৃথিবীর আর কোনো ইতিহাসে আছে? কিন্তু আমি বহিষ্কার করেছি, আওয়ামী লীগ করেছে। ভবিষ্যতে যদি কোনো এমসিএ বা পার্টি সে যে পার্টিরই হোক না কেন, কিংবা কোনো শ্রমিক নেতা বা ছাত্র নেতা চুরি করে, তাহলে আমি মাফ করবো না। এখন এমসিএদের সমালোচনা করার অর্থ কী? যারা সমালোচনা করেন, তারা ভাবেন, আমি নির্বাচনের ব্যবস্থা করবো। তারা যদি এমসিএর দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন, তাহলে নিজেরা নির্বাচনে দাড়িয়ে জয়লাভ করবেন। কিন্তু সব এমসিএ-ই কি চোর? কোনো এমসিএ কি যুদ্ধ করেন নাই? তারা কি গুলি খেয়ে মরেন নাই? এমসিএদের মধ্যে ভালো মানুষ আছে, খারাপ মানুষ ও আছে। সব দলেই ভালো মন্দ মানুষ আছে। যারা খারাপ, তারা সব সময়ই খারাপ। আমার দলের মধ্যে কেউ যদি চুরি করে বিশ্বাস রাখতে পারেন, তাকে কেমন করে শায়েস্তা করতে হয়, আমি জানি। তার পরিষদ সদস্যপদ আমি কেড়ে নেব। কিন্তু এমসিএদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা খারাপ। তারা গণপরিষদের সদস্য। তারা নির্বাচনের মাধ্যমে এসেছেন, তারা শাসনতন্ত্র তৈরি করবেন। আমি বাংলাদেশে শাসনতন্ত্র দিতে চাই, ইয়াহিয়া খান বা আইয়ুব খানের মতো গভর্নমেন্ট চালাতে চাই না। জনগণকে আমি ভয় করি না। জনগণকে আমি ভালোবাসি। সেজন্য শাসনতন্ত্র যত শীঘ্র হয় আমি দিব।
জাতীয় আদর্শ : এখন আমাদের একটা স্লোগান। আগে ছিল ৬ দফা এখন বলি ৪টি স্তম্ভ। আমার বাংলার সভ্যতা, আমার বাঙালি জাতি এ নিয়ে হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাংলার বুকে বাঙালির জাতীয়তাবাদ থাকবে। এ হলো আমার এক নম্বর স্তম্ভ। দ্বিতীয় স্তম্ভ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র আমি দুনিয়া থেকে ভাড়া করে আনতে চাই না। এ সমাজতন্ত্র হবে বাংলার মাটির সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, তার অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন। বাংলাদেশের ধনীদের আমি আর ধন সম্পদ বাড়াতে দেব না। বাংলারে কৃষক, মজুর, বাংলার বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক এদেশে সমাজতন্ত্রের সুবিধা ভোগ করবে। কিন্তু সমাজতন্ত্র যেখানে আছে সে দেশে গণতন্ত্র নাই। দুনিয়ায় আমি বাংলার মাটি থেকে দেখতে চাই যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমি সমাজতন্ত্রকে কায়েম করবো। আমি ব্যক্তি স্বাধীনতা বিশ্বাস করি। আমি জনগণকে ভালোবাসি, আমি জনগণকে ভয় পাই না। দরকার হলে আবার ভোটে যাবো গণতন্ত্র বাংলায় অবশ্যই থাকবে। চতুর্থ : বাংলাদেশ হবে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্ম নিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্ম নিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেয়া হবে না। এই হলো ৪ দফা, ৪ স্তম্ভ।
পাকিস্তানে আটক বাঙালি : আর একটা কথা বলি। ভুট্টো সাহেব নারাজ হয়ে গেছেন। তিনি আবোল-তাবোল বকছেন। এবং আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য আকুলী বিকুলী করছেন। আমি বলছি, বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিন। তারপর এসব বিবেচনা করে দেখবো। তিনি এর মধ্যে আমার বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেছেন। তিনি একটু ভয় পেয়ে গেছেন নাকি? ওরা আমার মা-বোনদের ওপর অত্যাচার করেছে, যারা পশুর মতো আমার জনগণকে হত্যা করেছে, যারা নিরপরাধ কৃষক শ্রমিক ছাত্রকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার করলে নাকি তিনি বড় অসন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু ভুট্টো সাহেব, শুনে রাখুন তাদের বিচার বাংলার বুকে অবশ্যই হবে। ভুট্টো সাহেব আমার ৪ লক্ষ বাঙালিকে আটকে রেখেছেন। তারা নিরপরাধ কিছুই করে নাই। তবুও তিনি দরকষাকষী করছেন। কিন্তু তিনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, আমি আমার বাঙালিদের ইন্শাল্লাহ বাংলার বুকে ফেরত আনবো। তিনি ঠেকাতে পারবেন না। তবে, একটা অনুরোধ করবো আপনাদের কাছে। যে সমস্ত বাঙালি এখানে আছে, যারা আলবদর রাজাকার নয়, যারা বাংলার মাটিতে বাঙালি হিসেবে বাস করতে চায়, আমি আগেও বলেছি, এখনও বলি, তাদের বাংলায় থাকবার অধিকার রয়েছে। যারা যেতে চায়, ভুট্টো সাহেব যেন মেহেরবানী করে তাদের নিয়ে যান। আমার আপত্তি নাই। তিনি বলেছেন, তিনি তাদের নেবেন না। কেন নেবেন না? তাদের হাতে তো বন্ধুক তারাই দিয়েছিলেন। তাদেরও তো ব্যবহার করেছিলেন। তাদের দিয়ে বাঙালিদের হত্যা করেছিলেন। এখন কেন নেবেন না? যারা যেতে চায়, তাদের নিয়ে যান। আমি ছেড়ে দেব। আমার চার লক্ষ লোক ছেড়ে দিন। ভুট্টো সাহেব যেন একথা মনে না করেন যে বাংলাদেশে শুধু বিহারী আছে, পশ্চিম পাকিস্তানেরও অনেকে আমার কাছে আছে। ভুট্টো সাহেব আমার লোক ফেরত দিন। আমিও তাদের লোক ফেরত দিচ্ছি। যুদ্ধ বন্দির সঙ্গে জনসাধারণ কোনো দিন এক হতে পারে না। এমন নজির দুনিয়ায় নাই, কোনোদিন হয় নাই। এক দল লোক দুনিয়ায় চিৎকার করে বেড়াচ্ছেন যে, বিহারীরা বড় কষ্টে আছে। যখন আমার বোন না খেয়ে মরছিল তখন গুলি করে মারছিলেন, যখন এদেশের মানুষ ধরে ধরে কুর্মিটোলায় গুলি করেছিল, যখন জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল, তখন কেন মেহেরবানী করে তার প্রতিবাদ করেন নাই? এখন কেন তারা কেঁদেকেটে একেবারে অস্থির হয়ে পড়েছে?
ত্রাণ বিদেশী সাহায্য : আমার বাংলার এক কোটি লোক পশ্চিম বাংলা এবং ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকে ছয় মাসে ফিরে এসেছে। তাদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের খাবার দিতে হয়। আমার বাংলাদেশের দেড় কোটি লোক এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে, ও গ্রাম থেকে এ গ্রামে পালিয়ে বেড়াতো। তাদের জন্য কেউ মায়া কান্না কাদে নাই। গ্রামে যান। দেখে আসুন, আমার মানুষ না খেয়ে আছে। আমার মানুষের কাপড় নাই। আমার কৃষকের বীজ নাই। আমার মানুষের চাল নাই। আমি তো পরিষ্কার বলেছি দুনিয়ায় সমস্ত দেশ থেকে আমি সাহায্য নিতে রাজি আছি কিন্তু সে সাহায্য হবে শর্তহীন। শর্ত দিয়ে কারো কাছ থেকে আমি ভিক্ষা আনতে পারবো না। শর্ত ছাড়া যদি কেউ আমাকে সাহায্য করতে চায় দুনিয়ায় যে কোনো দেশ থেকে সাহায্য নিতে আমি রাজি আছি। তবে এমন কিছু আনতে চাই যা ভবিষ্যতে আমার অসুবিধা হতে পারে সেজন্য আমি একটু আস্তে আস্তে চলি।
শিল্পের উৎপাদন : শ্ৰমিক ভায়েরা আল্লাহর ওয়াস্তে একটু উৎপাদন কর। আল্লাহর ওয়াস্তে, মিল খেয়ে ফেলো না। পয়সা থাকবে না। ব্যাংক থেকে ১৫৭ কোটি টাকা তোমাদের আমি দিয়েছি শিল্প প্রতিষ্ঠান চালাবার জন্য। অনেক মিল বন্ধ। তবুও মাইনে দিয়ে চলছি। অনেক মিলে অর্ধেক কাজ হয়। সেখানেও আমি মাইনে দিয়ে চলছি। আমি তাদের ভালোবাসি, এই জন্যই তো আমি বিনা কথায় ২৫ টাকা মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছি। তাদের ২/৩ বৎসর কষ্ট করতে হবে। উৎপাদন করতে হবে। ইনশাল্লাহ, একবার যদি উৎপাদন বেড়ে যায়, তাহলে আর কোনো কষ্ট হবে না। শ্রমিকরা সমস্ত মানুষের সঙ্গে সমানভাবে দেশের সম্পদ ভাগ করে খেতে পারবে। কিন্তু ৪ সের দুধ হলে তারা ১ সের খাবে। বাকি ৩ সের গ্রামের সমস্ত লোককে দেবে। ৪ সেরই যেন নিজেরা না খায়। তাহলে গ্রামের লোক বাঁচবে না। গ্রামে থাকে কারা? আপনারা আমার বাবা-মা। যারা গ্রামে বাস করে, তারাই কৃষক। তাদের প্রতি আমার কর্তব্য রয়েছে। তাদের আমি ২৫ বিঘা জমি পর্যন্ত খাজনা মাফ করেছি। তাদের আমি ঋণ দিচ্ছি। দরকার হলে আরো দেব। আমি চাই, তারা খাদ্য উৎপাদন করুক। আমি বেশি দিন ভিক্ষা করতে পারবো না। আমার ৩০ লক্ষ টন খাদ্যের দরকার। ১৭ লক্ষ টন আমি পেয়েছি আরও ১০ লক্ষ টন ইনশাল্লাহ আমি পাব। খাদ্য-সামগ্রির অভাব হবে না। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গিয়েছিল। আবার একটু কমের দিকে আসছে। আমাদের অনেক খবরের কাগজ যেগুলির দাম বাড়তে দেখলে লাফ দিয়ে কেবল বাড়ায়। যখন কমে তখন আর মেহেরবানী করে কিছু লেখে না। তারা যেন দাম কমলে একটু লেখে। আমার তো ছোট চাদরের অবস্থা। মাথা দিলে পা খালি, গায়ে দিলে বুক খালি। চাল আনলে ডাল আসে না। ডাল আনলে নুন আসে না। নুন আনলে তেল আসে না, তেল থাকলে লবণ থাকে না। আনতে হয় চট্টগ্রাম পোর্ট থেকে, চালনা পোর্ট থেকে। ভায়েরা আমার, আমি জানতে চাই, আপনাদের আমার ওপর আস্থা আছে কি না? আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা আছে কি না ? বাংলাদেশকে গড়বেন কি গড়বেন না ? ৩ বছর আমি কিছু দিতে পারব না। একদল লোক বলছে, মুজিবুর রহমান লন্ডন যাবে। কিন্তু মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ ছেড়ে কোথাও যাবে না। মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষকে সুখী করতে চায়। মুজিবুর রহমান সব ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমি কেন সব ছাড়বো? আজ মুনাফাখোর, আড়ৎদার, চোরাকারবারী সাবধান হয়ে যাও। ভবিষ্যতে যদি জিনিসের দাম আর বাড়ে, আমি তোমাদের শেষ করে দেব কারফিউ করে করে। আর দরকার যদি হয়, আইন পাশ করব। যদি চোরাকারবারী বা আড়ৎদার আমার কথা না শোনে তাদের ছাড়বো না। আর যারা অস্ত্র নিয়ে চলে, তারা সোজা পথে না এলে আমি বাধ্য হয়ে আইন পাশ করবো তাদের গুলি করে হত্যা করার জন্য। আর সরকারি কর্মচারী ভাইয়েরা, আপনারা ঘুষ খাবেন না। আমার লোক আছে। আমি সব খবরই পাচ্ছি। ঘুষখোরদের নয় নম্বর ধারায় চাকুরি যাবে, জেলখানায় যাবে। আর চোর, গুন্ডা, বদমাইশ, ডাকাত, সাবধান হয়ে যাও। কর্মী ভাইয়েরা, গ্রামে গ্রামে তোমরা পাহারা দাও, যাতে চোর, গুন্ডা, বদমাইশ মানুষের শান্তি শৃঙ্খলা নষ্ট করতে না পারে। আর যারা শুধু সমালোচনা করে বক্তৃতা করে, তাদের কাছে অনুরোধ করি, গ্রামে গিয়ে একটু কাজ করুন, একটু রিলিফের কাজ করুন। তাতে ফল হবে। আমি এবার তাহলে চলি। খোদা হাফেজ।২৭

রেফারেন্স: দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!