দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য ঐক্যবদ্ধ সগ্রামের আহ্বান
ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করার সংগ্রামে আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশ ন্যাশন্যাল আওয়ামী পার্টির জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে রোববার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত জনসভায় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এ আহ্বান জানিয়ে বলেন যে, মজুতদার, চোরাচালানী, দুষ্কৃতকারী, দুর্নীতি পরায়ন এমসিএ, রিলিফ নিয়ে ছিনিমিনি, স্বজনপ্রীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে একযোগে কাজ করে যাওয়ার জন্য ন্যাপ আওয়ামী লীগ সরকারকে সক্রিয় সহযোগিতা দানে প্রস্তুত রয়েছে। জনসভায় তিনি সভাপতির ভাষণ দিচ্ছিলেন। সভায় আর যারা বক্তৃতা দেন তারা হচ্ছেন ন্যাপের নবনির্বাচিত সহ-সভাপতি চৌধুরী হারুনর রশিদ, সাধারণ সম্পাদক শ্রী পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সম্পাদক মন্ডলীর সদস্যা অগ্নিকন্যা বেগম মতিয়া চৌধুরী, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি ও শ্রমিক নেতা কমরেড মোহাম্মদ ইলিয়াস ও ভারতীয় কমিউনিস্ট নেতা অধ্যাপক শান্তিময় রায়। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ তার ভাষণে বলেন, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। এর জন্যই একদিন ন্যাপ কর্মীদের বহু নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। ভারত ও রাশিয়ার দালালীর অভিযোগ শুনতে হয়েছে। ন্যাপ সভাপতি জনসভায় বলেন, চরম খাদ্যাভাবে মানুষের চোখে ঘুম নেই। দুর্নীতি, রিলিফ, চুরি, কতিপয় এমসিএদের অপকর্ম, স্বজনপ্রীতি, অবিচার, লুট, রাহাজানি ও চোরাকারবারীদের জন্য জনগণের মনে শান্তি নেই। যারা একদিন বহু আশা নিয়ে ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল, তারাই এখন গণবিরোধী ভূমিকার জন্য এমসিএদের বিরুদ্ধে সমলোচনায় মুখর। বিক্ষুব্ধ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেন, বাংলার মানুষ প্রাণ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসে। কিন্তু তাই বলে চোর ও দুর্নীতি পরায়ণ কোনো ব্যক্তিকে তারা প্রশ্রয় দেবে না। বঙ্গবন্ধুর ওপর জনগণের অগাধ আস্থা রয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই কতিপয় দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এটা জনগণ আশা করে। তিনি বলেন, ইন্দোনেশিয়া আমাদের সামনে একটি শিক্ষা, মানুষের সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা দুর্নীতি ও অরাজকতার সুযোগ নিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সিআইএ এজেন্টদের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতাকে বিপদগ্রস্থ করতে চাইছে। ন্যাপ প্রধান এই প্রসঙ্গে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন, দেশের এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়ে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও জনগণকে অরাজকতার পথে ঠেলে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তকে সাহায্য করতে চাই না। মওলানা ভাসানীর মতো দায়িত্বহীন বক্তব্য রেখে ন্যাপ রাজনীতি ওসব নেতৃত্বে বিশ্বাস করে না। তিনি বলেন, ন্যাপ মনে করে যে এক লাফে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো যাবে না। সমাজতন্ত্র এখনো অনেক দূরে। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেন, নকসাল পন্থীরা এক লাফে সমাজতন্ত্রে পৌঁছাতে চায়। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জোতদারের প্রাণ নিয়েই সমাজতন্ত্রে পৌছানো যায় না। অবশ্য তারা একবার চেষ্টা করে দেখতে পারে। এতে তারা জনগণ থেকে আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
চৌধুরী হারুনর রশীদ : ন্যাপের সহ-সভাপতি চৌধুরী হারুনর রশীদ বলেন, সগ্রামী জনতার একতার ফলেই মাত্র নয় মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। আর এই ঐক্যপথেই সমাজতন্ত্র কায়েম করতে হবে। তিনি বলেন, চীন-মার্কিন চক্রান্ত বাংলাদেশ-ভারত-সোভিয়েত বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে সক্ষম হবে না। কতিপয় গণবিরোধী ব্যক্তির সমালোচনা করে চৌধুরী হারুনর রশীদ বলেছেন, স্বাধীনতার পর কতিপয় ক্ষেত্রে পরিত্যাক্ত সম্পত্তি জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত না হয়ে ব্যক্তি মালিকানায় কুক্ষিগত হয়েছে। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, কতিপয় স্বার্থপর ব্যক্তি এ ধরনের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে আসছে। দুর্নীতিতে লিপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সগ্রাম গড়ে তুলবে।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য : ন্যাপের নতুন সাধারণ সম্পাদক শ্রী পঙ্কজ ভট্টাচার্য দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি দেশ থেকে সকল রকম দুনীতিবাজ, ষড়যন্ত্রকারী, মজুতদারী, চোরাকারবারী, মুনাফাখোর, স্বাধীনতা বিরোধী চীন-মার্কিন চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাবে। জনতাকে সাথে নিয়ে ন্যাপ গণবিরোধী শক্তিকে নির্মূল করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। পঙ্কজ ভট্টাচার্য আরো বলেন, ন্যাপ কর্মীদের দায়িত্ব হবে কলকারখানা ও ক্ষেতে-খামারে উৎপাদন বাড়ান। প্রয়োজন হলে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমরা আবার রক্ত দেব কিন্তু স্বাধীনতাকে বিপন্ন হতে দেব না।
মতিয়া চৌধুরী : ন্যাপ নেত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, আদর্শের জন্য ন্যাপ আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু ঘুষ, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, অবিচার ও শোষণকে ন্যাপ সমর্থন দিতে পারে না। ন্যাপ নেত্রী বলেন, দুর্নীতি নির্মূল করতে না পারলে ভবিষ্যতে মানুষ মরবে। আর এর সুযোগ নিয়ে আমেরিকা সাহায্য দানের নামে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, দুর্নীতি বন্ধের জন্যই আমরা সর্বদলীয় ঐক্য চাই। হালুয়া-রুটিতে ভাগ নেয়ার জন্য নয়। ঢাকার বাসা রেডক্রসের কম্বল বিক্রি হচ্ছে। এমন কি দখলদার আমলের শান্তি কমিটির চেয়াম্যান ও সদস্যদের। নিয়ে রিলিফ কমিটি গঠিত হয়েছে। দুর্নীতিবাজ এম সি এ-র বিরুদ্ধে চোরাচালানের সুনিদি অভিন্ন থাকা সত্ত্বেও কেন তার বিচার হয়নি? জনগণ এ প্রশ্নের জবাব চায়। মতিয়া চৌধুরী-এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আওয়ামী লীগের নিঃস্বার্থ ও সৎ এম সি এ দের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন আসুন জনতার স্বার্থে আমরা একত্রে কাজ করি। তিনি বলেন, আমাদের আহ্বানে সাড়া না দিলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি জনতাকে সাথে নিয়ে দুর্নীতি, দুষ্কৃতি, মজুতদারী, চোরাকরবারীর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সংগ্রাম গড়ে তুলবে। সভায় কতিপয় প্রস্তাব গৃহীত হয়।৭৬
রেফারেন্স: ২১ মে ১৯৭২, দৈনিক বাংলা
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ