মুক্তিবাহিনীর সমস্যা ও অভাব অভিযােগ
আমাদের মুক্তিবাহিনী ভাইদের তাদের আশ্রয়ের জন্য কতকগুলাে বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বলে আমরা অনেক জায়গা থেকে জানতে পেরেছি। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ আজ নানাবিধ অর্থনেতিক দূরবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। ওদের বাড়ী-ঘর সহায় সম্বল যা ছিল সবকিছুই পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার পশুরা পুড়িয়ে দিয়েছে ও লুট করে নিয়েছে। তাই মুক্তিবাহিনীর প্রতি অকৃত্রিম সহানুভূতি সমর্থন থাকা সত্বেও দিনের পর দিন মুক্তিবাহিনী ভাইদের আশ্রয় দিয়ে রাখার মত অর্থনৈতিক অবস্থা এখন আর তাদের নেই। সেজন্য মুক্তিবাহিনী ভাইদের এখন এমন ভাবে আশ্রয় নিতে হবে যার ফলে বাংলার দরিদ্র মানুষের উপর যেন অর্থনৈতিক চাপ না পড়ে। আমরা এও জানতে পেরেছি। কতকগুলাে জায়গায় ভুল করে আশ্রয় নেওয়ার জন্য অনেক ছেলেদের জীবনের উপর ঝুঁকি এসে। পড়েছে। সেজন্য আশ্রয়ের ব্যাপারে নিম্নলিখিত দৃষ্টিভংগী নিলে কিছুটা সুবিধা করা যেত বলে মনে হয় । এমন এলাকায় আশ্রয় নিতে হবে যেসব এলাকা কিছুটা দুর্গম।আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য স্বাধীনতাকামী দলের যেসব এলাকায় প্রতিপত্তি রয়েছে। এবং যেসব এলাকায় দালাল, রাজাকারদের সংখ্যা কম। নদীপথ ও বন-জঙ্গল সব চেয়ে ভাল স্থান। এর ফলে গরীব মানুষদের বাড়ী-ঘরে আশ্রয় নেওয়ার প্রয়ােজন থাকবে না। যেসব বাড়ীতে লােক সমাগম কম। আশ্রয়দাতার আত্মীয়-স্বজন স্বাধীনতার সমর্থক কিনা সেটাও জেনে নিতে হবে। এবার তথাকথিত রােমান্টিক বিপ্লবীদের সম্বন্ধে কিছু বলতে হবে। কারণ এই তথাকথিত বিপ্লবীরা স্বাধীনতার সগ্রামে বাধা সৃষ্টির অপচেষ্টায় মেতেছে। আমরা পাবনা, যশাের, খুলনা প্রভৃতি জেলা হতে এরূপ সংবাদ পেয়েছি। চীনের সমর্থক বলে স্ব-ঘােষিত তথাকথিত বামপন্থীরা উক্ত সমস্বত জেলায় ধীরে ধীরে পাক সামরিক বাহিনীর সহযােগিতায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কার্যে প্রবল বাধার সৃষ্টি করেছে। তারা এখন পুরােদমে পাক সেনাবাহিনীকে সহযােগিতা করছে এবং উক্ত সমস্ত জেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
তারা মুক্তিবাহিনী সদস্যদের গােপন ঘাঁটি, আশ্রয়স্থলের সংবাদ সামরিক বাহিনীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। এছাড়া তারা মুক্তিবাহিনীর আশ্রয়দাতা ও সমর্থকদের নিরীহ আত্মীয় স্বজনের খোঁজ করে তাদের নির্মমভাবে গলা কেটে হত্যা করছে। এর ফলে মুক্তি বাহিনী ভাইদের প্রবল অসুবিধা হচ্ছে। সেজন্য সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করব তারা যেন অবলিম্বে খোজ খবর নিয়ে সেখানে উক্ত তথাকথিত সুযােগ-সন্ধানী বিপ্লবীদের উৎখাত করার জন্য বিশেষ বাহিনী প্রেরণ করেন। উপরে বর্ণিত তথাকথিত বিপ্লবীরা নানাবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তারা নাকি মুক্তি বাহিনীর বিজয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদের নিজের হাতে নেতৃত্ব কেড়ে নিয়ে নেওয়ার স্বপ্নে বিভাের হয়ে পড়েছেন, আমরা তাদের শক্তি সম্বন্ধে অবশ্য সচেতন। আমরা জানি মুক্তি বাহিনীর পিছনে রয়েছে সমগ্র বাঙ্গালী জাতি। সেজন্য সামান্য শক্তি নিয়ে তারা কিছু করতে পারবে না সেটাও জানি। তবুও আমাদের তাদের প্রতি প্রখর দৃষ্টি রাখতে হবে। গত মার্চ-এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের অনেক জেল খুলে দেওয়ার ফলে অনেক চোর, ডাকাত, মুজিবের হয়ে এসে তারা এখন মূলতঃ সামরিক বাহিনীর সাথেই সহযােগিতা করছে। তাদেরকে দমন করার জন্যও বাংলাদেশ সামরিক কর্তৃপক্ষের এখন থেকেই দৃষ্টি দিতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে এরা প্রবল অসুবিধের সৃষ্টি করবে।
দাবানল । ১৬
২৮ নড়েম্বর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯