You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশে গণহত্যা | মোহাম্মদ আবু জাফর | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৯ মে ১৯৮০

১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সরকার ও সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশী দালালরা অত্যন্ত পরিকল্পিত পন্থায় বাংলাদেশের জনগণের জাতিগত জাতীয়তাগত, ভাষা-ধর্ম সংস্কৃতিগত ও গোত্রগত অস্তিত্ব ধ্বংস করার জন্যে অসামরিক নিরীহ নিরস্ত্র নরনারীকে হত্যা করে ও নানা উপায়ে তাদের (অস্পষ্ট) অবমাননা করে। একটি সশস্ত্র সংঘর্ষকালে বেসামরিক ও সামরিক ও সশস্ত্র নরনারীর প্রাপ্য সুবিধা ও আচরণ থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন-সমূহ লংঘন করে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুন্ঠন, পাশবিক অত্যাচার ও সম্পত্তি ধ্বংসের পথ বেছে নিয়ে পাকিস্তানী নরপশু ও তাদের সহযোগিরা বাংলাদেশের সকল ধর্মের নরনারীদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার কুচেষ্টা দীর্ঘ নয় মাস অব্যাহত রাখে।
অতি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহনে সাহায্যে তারা যে অকল্পনীয় অত্যাচার চালায় তার ফলে সারা বছরই বাংলাদেশের সবখানেই বয়ে গেছে রক্তের বন্যা— শহরে মৃতদেহ, গ্রামের মৃতদেহ, সাগরে মৃতদেহ, নদীতে মৃতদেহ, গৃহাঙ্গনে মৃতদেহ, সবুজ প্রাঙ্গণে মৃতদেহ এই ছিল সে-সময় বাংলাদেশের সব খানকার চিত্র। লক্ষ লক্ষ বিবাহিত ও অবিবাহিতা, অপ্রাপ্ত বয়স্কা ও বৃদ্ধ নারী নরপশুদের হাতে সতীত্ব ও প্রাণ হারায়। প্রাণ হারায় লক্ষ লক্ষ অবুঝ শিশু অত্যন্ত করুণ ও বীভৎসভাবে। কোটি কোটি টাকার ঘর-বাড়ি, ব্যবসায়- প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দির, গীর্জাসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়। ধ্বংস হওয়া শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ, বিদ্যালয়-গ্রন্থাগার, অফিস আদালত, কল-কারখানা, রাস্তাঘাট, প্রাণের নিরাপত্তার অভাবে এক কোটি নর-নারী ঘর বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়, আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। নিরপরাধ শান্তিকামী নিরীহ দেশবাসীর উপর স্থল জল ও বিমানপথে সশস্ত্র আক্রমণ চালানো হয়। তার ফলে দেশের ভেতরেও অসংখ্য পরিবারকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পালিয়ে বেড়াতে হয় নিরাপত্তা সন্ধানে। এদেশের মানুষ নিজেরই গৃহে হয় হত ও অবমানিত, নিজেরই গৃহ থেকে হয় বিতাড়িত।
যে-কোন দেশের জন্যে এধরনের পরিস্থিতি অত্যন্ত অস্বাভাবিক। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তখনই যখন কোন গোষ্ঠী সম্পূর্ণ অকল্পনীয় ও অননুমোদনযোগ্য একটি কর্মপন্থা গ্রহণ করে। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী শাসক-গোষ্ঠী ও তাদের দোসররা যে কর্ম পন্থা গ্রহণ করেছিল তার নাম পরিকল্পিত গণহত্যা।

একথা সত্য, সরকার মানে দেশবাসীর মামা নয় যে নানা আবদার চলবে। কিন্তু দেশবাসী মানেই সরকারের ভাগনেও নয় যে তাদের উপর যা- খুশি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া যাবে। জনগণই সার্বভৌমত্বের মালিক। সরকার সেই সার্বভৌমত্বের পক্ষে কাজ করে এবং রাষ্ট্র সেই সার্বভৌমত্বের প্রতীক। যে আইন মেনে সরকার ক্ষমতা হাতে নেয় এবং যে আইন ক্ষমতাসীন সরকার তৈরী করে সবগুলোই সরকার মানতে বাধ্য। রাষ্ট্রের অধিবাসীদের জান-মাল বিনষ্ট করার কোন অধিকার সরকারের নেই। আদালতে নিয়মমাফিক প্রমাণিত করে কোন আসামীর শাস্তি দেয়ার অধিকারও কোন সরকারের নেই। প্রতিষ্ঠিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে ব্যাপ্তি, সমষ্টি ও সরকার একই সঙ্গে বাঁধা। পাকিস্তানী সরকার ও তাদের দোসররা ১৯৭১ সালে সকল প্রকার আইন ভঙ্গ করেই যথেচ্ছা অত্যাচার চালায়। কোনো দেশের সরকার যাতে দেশবাসীদের জান-মাল ধ্বংস করতে না পারে সে-জন্যে বহু বছরের পর্যালোচনার পর প্রণীত হয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক আইন। পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রই তার আওতায় পড়ে। প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার তার জন্ম-লব্ধ এবং কোন সরকার তা অপহরণ করতে পারে না। ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘ সনদের ত্রিশটি ধারায় পৃথিবীর সকল নর-নারীর মৌলিক অধিকারসমূহ নির্দেশিত হয়েছে। সেগুলো হচ্ছেঃ জাতি, বর্ণ, নরনারী, ভাষা, ধর্ম, রাজনৈতিক বা অন্য পরিচিতি (স্টেটাস) নির্বিশেষে সকল পুরুষ ও নারী মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ ভোগ করবে। এই সমস্ত অধিকার ও স্বাধীনতা প্রধানত দু শ্রেণীরঃ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারসমূহ এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারসমূহ। প্রথম শ্রেণীর মধ্যে পড়েঃ ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার, দাসত্ব থেকে স্বাধীনতা, নির্যাতন (অস্পষ্ট) নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তি থেকে স্বাধীনতা, নির্বিচার গ্রেফতার ও আটক থেকে স্বাধীনতা, একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত কর্তৃক ন্যায্য বিচার লাভের অধিকার, দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ গণ্য হওয়ার স্বাধীনতা, চিঠিপত্রের ব্যক্তিগত চরিত্র ও গোপনীয়তা অলংঘনীয় রাখার নিশ্চয়তা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত ও বসবাসের স্বাধীনতা, নির্যাতনের প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা ও লাভের অধিকার, জাতীয়তা লাভের অধিকার, বিবাহ ও পরিবারের স্থাপনের অধিকার, সম্পত্তির মালিকানা লাভের অধিকার চিন্তা, বিবেক ও ধর্মের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সভা ও সমিতি করার স্বাধীনতা, ভোট দেওয়া ও সরকারের কাজ অংশগ্রহণের অধিকার। দ্বিতীয় শ্রেণীর অধিকারের মধ্যে পড়েঃ সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, কাজ করা, বিশ্রাম নেয়া ও অবসর যাপনের অধিকার জীবনযাত্রার যথোপযুক্ত মান লাভের অধিকার, (অস্পষ্ট) শিক্ষার অধিকার এবং সমাজের সাংস্কৃতিক জীবন অংশগ্রহণের অধিকার। পাকিস্তান এই জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষরকারী হয়েও প্রতিটি ধারাই ১৯৭১ সালে সে লংঘন করে।

প্রত্যেক নরনারীর মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্যে যেসব আন্তর্জাতিক আইন তৈরী হয় তার একটি হোলঃ সকল প্রকার জাতিসত্তাগত ভেদ-নির্ভর আচরণ নির্মূল করার জন্যে ১৯৬৫ সালে গৃহীত আন্তর্জাতিক চুক্তিসভাপত্র (ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন) ১৯৬৬ সালে জাতিসংঘ সকল নরনারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত দুটি আন্তর্জাতিক চুক্তিনামা গ্রহণ করে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত নানা আন্তর্জাতিক আইনে মানুষের মৌলিক অধিকার স্বীকার ও রক্ষার যে ব্যবস্থা করা হয় তা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আরও কঠোরতর আইন কাঠামো লাভ করে। প্রতিটি সভ্য-দেশের শাসনতন্ত্রে প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার জাতিসংঘ সনদের আলোকে স্বীকার করা হয়েছে এবং বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ আইন ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপ্রেক্ষিতে কোন বিশেষ সরকারের অসুবিধা সত্ত্বেও ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হরণের অধিকার কারও নেই। সরকারের সমালোচনা মাত্রই রাষ্ট্রবিরোধীতা নয়— এই নীতি ঘোষিত হয়েছে। সেই সঙ্গে এটিও গৃহীত হয়েছে যে কোন দেশের নাগরিক সেই দেশের সরকারের যথেচ্ছার শিকার হওয়ার সামগ্রী নয়।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে হিটলার ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা অসংখ্য নিরস্ত্র অসামরিক নরনারীকে সুপরিকল্পিত উপায়ে হত্যা করে। তারা ভঙ্গ করে প্রতিষ্ঠিত সমস্ত প্রচলিত ও আন্তর্জাতিক আইন, এ জন্যে গণহত্যার অপরাধে ন্যুবেমবার্গ আদালতে তাদের বিচার করে শাস্তি দেয়া হয়।

মূলত হিটলারের নিষ্ঠুরতার ফলে পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহ গণহত্যা সম্পর্কিত আইন বিধিবদ্ধ ও কঠোরতর করতে সচেষ্ট হয়। ন্যুরেমবার্গ সনদে এ -সম্পর্কিত কিছু বিধি ব্যবস্থা ছিল। পরবর্তীকালে এ প্রেক্ষিতে একাধিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং জাতিসংঘ বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে চেষ্টা করতে থাকে। তারই ফলে ১৯৪৮ সালের গণহত্যা চুক্তিসভাপত্র (জেনোসাইড কনভেনশন) ও ১৯৪১ সালে চুক্তিসভাপত্র (জেনেভা কনভেনশন) গৃহীত হয়। সংশ্লিষ্ট আরো কিছু কার্যকরী ব্যবস্থাও গৃহীত হয় একই সঙ্গে। এখানে বিধিবদ্ধ আইনগুলোর প্রায় সবই প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিভূ-মাত্র, চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরকারী না হলেও প্রতিটি রাষ্ট্রের উপর এই আইন প্রযোজ্য। পাকিস্তান এই চুক্তিসভাপত্রের একজন স্বাক্ষরকারী বলা বাহুল্য, পাকিস্তান সে-সময়ে এই চুক্তি পত্রে স্বাক্ষর করেছিল বাংলাদেশে সেগুলো অমান্য করার জন্যেই।

ন্যুরেমবার্গ সনদে যুদ্ধের পূর্বে ও যুদ্ধকালে হত্যা, অন্যায় আচরণ, দাসত্ব বা অন্য কোন কাজে দখলকৃত এলাকার অসামরিক জনসাধারণকে নিয়োগ যুদ্ধাপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধঃ অসামরিক জনসাধারণকে হত্যা, সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্নকরণ, দাসত্বে নিযুক্তি অন্যত্র চালান দেয়া ও তাদের প্রতি অন্যান্য অমানুষিক আচরণ। যুদ্ধবন্দীদের প্রতি অন্যায় আচরণ, নগর শহর বা গ্রাম খেয়ালখুশিমতো ধ্বংস করা সনদে অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে গৃহীত এক প্রস্তাবে গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক আইনে দণ্ডনীয় বলে ঘোষণা করা হয়। সেই অপরাধের জন্যে দোষী প্রমাণিত হলে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারী কর্মচারী অথবা ব্যক্তিবিশেষও দন্ডনীয়। এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে অপরাধী ব্যক্তিরা যথাযথ বিচারে প্রাপ্তব্য শাস্তি এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে তাদের সরকারী পদমর্যাদার আশ্রয় গ্রহণ করতে পারেন না…… কোন রাষ্ট্র যদি আন্তর্জাতিক আইন-দত্ত ক্ষমতার বাইরে ক্রিয়াশীল হয়ে কাউকে কোন কর্তব্য সম্পাদনের অধিকার প্রদান করে তাহলে সেই অধিকারবলে কর্তব্য সম্পাদনকালে যুদ্ধের আইন ভঙ্গ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দায়মুক্ত হতে পারেন না….. একজন সৈনিককে যে যুদ্ধের আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে হত্যা ও অত্যাচার করার আদেশ দেয়া হয়েছিল— নিষ্ঠুরতার পক্ষে যুক্তি হিসেবে এটি কখনও স্বীকৃত হয়নি, এমনকি সেই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে শাস্তি কমানোর জন্য অনুরোধ করা গেলেও।
১৯০৭ সালে গৃহীত হেগ চুক্তিসভাপত্রের বিভিন্ন ধারায় বলা হয় যে শহর গ্রাম, বাসগৃহ বা ভবনাদির উপর বোমাবর্ষণ নিষিদ্ধ। অবরোধ বা বোমাবর্ষণের সময় সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত না হলে ধর্ম, শিল্পকলা, বিজ্ঞান বা দাতব্যকর্মে উৎসর্গীকৃত ভবনাদি, ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ, হাসপাতাল এবং পীড়িত ও আহত ব্যক্তিদের আশ্রয় দেয়া হয় এমন সব স্থান যতদূর সম্ভব আঘাত না করার জন্যে প্রয়োজনীয় সবরকম ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে। ১৯২৩ সালে গৃহীত বিমানযুদ্ধে কল্যাণকর হেগ আইনে আরও বলা হয়ঃ ধর্ম, শিল্পকলা, বিজ্ঞান ও দাতব্যকর্মে উৎসর্গীকৃত ভবনাদি, ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ, হাসপাতাল প্রভৃতির উপর বোমা বর্ষণ করা চলবে না।
১৯৪৮ সালে গৃহীত গণহত্যা চুক্তিসভাপত্রে নির্বিচারে নরনারীকে হত্যা করার জন্যে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা আছে। সেই আইনে যুদ্ধকালে বা শান্তির সময়ে গণহত্যা আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ, জাতিসংঘের লক্ষ্যের পরিপন্থী ও সভ্যজগৎ কর্তৃক নিন্দনীয় বলে ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্রগুলো গণহত্যা বন্ধ করতেও অপরাধীদের শাস্তি দিতে দৃঢ় সংকল্প ঘোষণা করে উক্ত চুক্তিসভাপত্রের সংশ্লিষ্ট ধারাসমূহে বলা হয়েছেঃ

ধারা-২ঃ বর্তমান চুক্তিসভাপত্রে জাতীয়তাগত, জাতিগত, জাতিসত্তাগত বা ধর্মগত কোন গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণরূপে বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে নিম্নবর্ণিত যে-কোন আচরণ গণহত্যার শামিল হবে।

ক. কোন গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা।
খ. কোন গোষ্ঠীর সদস্যদের সাংঘাতিক দৈহিক বা মানসিক ক্ষতি সাধন করা।
গ. ইচ্ছাকৃতভাবে কোন গোষ্ঠীর উপর এমন পরিকল্পিত জীবনযাত্রা ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া যাতে তাদের দৈহিক অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে বা আংশিকভাবে ধ্বংস হয়ে যায়।
ঘ. কোন গোষ্ঠীর মধ্যে মানব জন্ম রোধের জন্য কোন ব্যবস্থা আরোপ করা।
ঙ. কোন গোষ্ঠীর শিশুদের জোর করে অন্য গোষ্ঠীদের চালান দেয়া।

ধারা-৩ঃ নিম্নবর্ণিত আচরণসমূহ শাস্তিযোগ্যঃ
ক. গণহত্যা।
খ. গণহত্যার জন্যে ষড়যন্ত্র করা।
গ. গণহত্যার পক্ষে সরাসরি ও প্রকাশ উত্তেজনা সৃষ্টি।
ঘ. গণহত্যার চেষ্টা করা।
ঙ. গণহত্যায় সহযোগিতা করা।

ধারা-৪ঃ যে ব্যক্তি ৩ সংখ্যক ধারায় বর্ণিত গণহত্যা বা অন্য কোন আচরণ করবে তাকে শাস্তি দেয়া হবে, তা সে শাসন-তন্ত্রানুসারে দায়িত্বভারপ্রাপ্ত শাসক, সরকারী কর্মচারী বা সাধারণ ব্যক্তিবিশেষ হোক না কেন।
বাংলাদেশে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী যে নৃশংস গণহত্যা চালায় তা পূর্ব পরিকল্পিত। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব বাংলাকে শোষণ করা তাদের একটি পেশা হয়ে দাঁড়ায়। সে জন্যে ছলে-বলে-কলে কৌশলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সমস্ত চেষ্টা তারা ব্যর্থ করে দেয়। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের ফলে আইউব খানের পতন তাদের খুবই শংকিত করে তোলে। তখন থেকেই তাঁরা বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে চরম নির্মম ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা করতে থাকে। একথা অনেকেরই জানা ছিল। ১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিল লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকা সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করে মন্তব্য করেঃ

গত সপ্তাহে নৃশংস যোগ্যতার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে আত্ননিয়ন্ত্রণের অধিকারকামী পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের জীবনীশক্তিও নিঃশেষ করা ছাড়া আর সবই করেছে। পাকিস্তানের জেনারেল ও কর্নেলরা খুব সাবধানে দু বছর ধরে যে পরিকল্পনা করেছে, তারই ফলে এই নৃশংসতা। ৩০শে এপ্রিলের ডেলি টেলিগ্রাফ মন্তব্য করেঃ ‘সমস্ত ব্যাপারটি টিক্কা খানের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে বলে মনে হয়।’ এই পত্রিকার প্রতিনিধি ম্যাসকারেন হাস বেশ কিছুকাল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘোরেন এবং সব কিছু প্রত্যক্ষ করেন। তারপর তার পরিবার নিয়ে চলে যান লন্ডনে সত্য কথা নির্ভয়ে পৃথিবীকে জানানোর জন্যে। সানডে টাইমসের ১৩ই জুন সংখ্যায় প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত দীর্ঘ রিপোর্ট। তিনি এই গণহত্যা পূর্বপরিকল্পিত বলে মন্তব্য করেন। গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের মিথ্যা আশ্বাসের আড়ালে তারা পরিকল্পনা করছিল বাংলাদেশে গণহত্যার। তিনি কিভাবে বাংলাদেশে সৈন্য আনা হয়, অস্ত্র আনা হয়, গুপ্তহত্যায় নিয়োগ করা হয় কমান্ডো বাহিনী, কিভাবে প্রতারণা করে বাংলাদেশের মানুষদের নির্বিচারে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।

এ কথা এখন সবারই জানা যে, ২৫শে মার্চ রাতে পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তানী হায়েনার দল ঢাকার নিরস্ত্র জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু অধ্যাপক ছাত্র ও কর্মচারীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়৷ বিভিন্ন হলে শত শত ছাত্রকে হত্যা করা হয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হত্যা করা হয় শত শত পুলিশকে, পিলখানায় হত্যা করা হয় ইপিআর বাহিনীর সদস্যদেরকে। পত্রিকা অফিস ধ্বংস করা হয়। জ্বালিয়ে দেয়া হয় শত শত ঘরবাড়িঃ জ্বলন্ত ঘরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা শত শত শিশু, বৃদ্ধ, নর-নারীকে মেশিন গানের গুলিতে হত্যা করা হয়।
বুলডোহার চালিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয় বহু আবাসিক এলাকা। ঢাকায় ২৫টি এলাকা পাকিস্তানীরা ধ্বংস করে দেয়। বহু নারীর সতীত্ব কেড়ে নিয়ে তাদের, হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। সারা ঢাকা শহরে চালানো হয় মৃত্যুর তান্ডবলীলা। টিক্কা খান সেনানিবাস থেকে মহাউল্লাসে এই গণহত্যা কার্য পরিচালনা করে। বেতারে তাদের কথোপকথন ইতি পূর্বে নানা পত্রপত্রিকায় বেরিয়েছে। ৩০শে মার্চের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা জানায় যে প্রথম আক্রমণেই বাংলাদেশে তিন লক্ষ নর-নারীকে হত্যা করা হয়।

এর পরপরই সারা বাংলাদেশেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশী দালালরা গণহত্যায় মেতে ওঠে। যশোরে প্রথম দিকেই হত্যা করা হয় ২০ হাজার নর নারীকে। সেখানে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ দোকান, সমস্ত বেকারী জ্বালিয়ে দেয়া হয়। মঙ্গলা বন্দর ধ্বংস করে দেয়া হয়। কয়েক দিনের মধ্যে ২২ হাজার অধিবাসীর সংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১০০০ এ। অত্যাচারের ফলে যশোর জেলার ২৫ লক্ষ লোকের ৫ লক্ষই পালিয়ে যায় ভারতে। ফুলতলা থানার ৫০ ভাগ লোকই ভারতে পালিয়ে যায়। কুষ্টিয়ায় তান্ডবলীলা চলে ১২ দিন ধরে। কুষ্টিয়া পুরো ধ্বংস করে দেয়া হয়। কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানীরা দ্বিতীয় মাইলাই সৃষ্টি করে।

প্রকৃত প্রস্তাবে সমগ্র বাংলাদেশে হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণ ধ্বংসের যে স্রোত বয়ে যায় তার বিবরণ সংক্ষেপে দেয়া খুবই কঠিন। এ সম্পর্কে একাধিক গ্রন্থে লিখিত হয়েছে, লিখিত হয়েছে প্রবন্ধাদি। মুক্তধারা প্রকাশিত রক্তাক্ত বাংলা গ্রন্থে ‘বাংলাদেশে গণহত্যা’ শীর্ষক যে প্রায় পঞ্চাশ পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ আছে উৎসাহী পাঠকবৃন্দ সেটি পড়ে দেখতে পারেন। আমরা যে প্রবন্ধের বহু সাহায্য নিয়েছি আমরা ক্ষুদ্র পরিসরে দেশীয় ও আন্তর্জাতীয় আইন লঙ্ঘন করে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী ও তাদের দালালরা যে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ,
মানবতার প্রতি অপরাধ ও অন্যান্য অপরাধ করে সে সম্পর্কে সংক্ষেপে সুনির্দিষ্ট চিত্র উপস্থাপনের চেষ্টা করবো।

১। বাঙালীদের ও রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের নিশ্চিহ্ন করার একটি পরিকল্পনা পাকিস্তানী শাসকবৃন্দ গ্রহণ করে পূর্বাঞ্চলীয় সদর দফতরে মেজর জেনারেল শওকত রাজার স্বীকারোক্তিতে ও অন্যান্যদের কথায় ও কাজে এবং নানা প্রমাণাদির মাধ্যমে সেটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

২। বিশেষ করে রাজনৈতিক কর্মীদের, বুদ্ধিজীবীদের, শিক্ষক ছাত্র, সরকারী কর্মচারী, ডাক্তার, সাংবাদিক, পুলিশ ও ইপি আর বাহিনীর সদস্যদের এবং বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়।

৩। শহর, বন্দর ও গ্রামের উপর নির্বিচারে বিমান হামলা চালিয়ে ও বোমাবর্ষণ করে অসামরিক জনসাধারণের জান-মাল ধ্বংস করা হয়।

৪। বিমান হামলা, কামানের গোলাবর্ষণ, যুদ্ধজাহাজ ও গানবোটের আক্রমণ ও সেনাবাহিনীর আক্রমনে বহু ঘরবাড়ি, শিক্ষা ভবনাদি, মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, হাসপাতাল, সরকারী ভবনাদি, জনগণের ঘরবাড়ি ও সম্পদসমূহ ধ্বংস হয়ে যায়। ইচ্ছাকৃত ভাবে এই ধ্বংস কাজ চালানো হয়।

৫। নিরপরাধ ও নিরস্ত্র নর নারীকে হত্যা ও নির্যাতন করার নানা পন্থা আবিষ্কার ও প্রয়োগ করা হয়। নর-নারীকে আগুনে পোড়ানো হয়, স্কুলের শিশুদের ও গর্ভবতী নারীদের গুলি করে হত্যা করা হয়। মায়ের কোলের শিশুকে হত্যা করা হয়। বাচ্চা শিশুর কানে গুলি করে মাথা উড়িয়ে দেয়া হয়। স্ত্রীর সামনে স্বামীকে জীবন্ত কবর দেয়া হয়, পিতামাতার সামনে শিশুদের হত্যা করা হয় ও মেয়েদের ধর্ষণ করা হয় শিশুদের আকাশে ছুঁড়ে দিয়ে বেয়োনেটে গেঁথে ফেলা হয়, শিশুদের মাংসের মতো টুকরো টুকরো করে কাটা হয় এবং শরীর থেকে সমস্ত রক্ত বার করে নিয়ে হত্যা করা হয় বহু নর-নারীকে।

৬। হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করা হয়। ক্রমাগত ধর্ষণ, মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ধর্ষণ, ধর্ষণের পর গোপনাঙ্গে বেয়োনেটের খোঁচা দিয়ে হত্যা, জোর করে মেয়েদের বেশ্যাবৃত্তিতে বাধ্য করা, মেয়েদের জন্মদান ক্ষমতা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়া, গর্ভবতী মেয়েদের নিঃসম্বল করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে বাধ্য করা, সুন্দরী যুবতী মেয়েদের জোর করে পশ্চিম পাকিস্তানে চালান করে দেয়া ও জোর করে বিয়েতে বাধ্য করা হয়।

৭। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিশেষ করে হিন্দুদের নির্বিচার হত্যা করা, তাদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে দেশত্যাগে বাধ্য করা, নানা উপায়ে নির্যাতন করা ও তাদের সম্পত্তি ও ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়।

৮। নানা রাসায়নিক দ্রব্যাদি ও (অস্পষ্ট) বোমা ব্যবহার করে অসংখ্য নর-নারীকে হত্যা ও সম্পত্তি ধ্বংস করা হয় এবং ধান ও পাট সম্পদ ধ্বংস করে দেয়া হয়।

৯। সুপরিকল্পিতভাবে জনসাধারণের সম্পদ লুণ্ঠন করা হয়।

১০। জনসাধারণের ঘরবাড়ি, খামার বাড়ি, জমি-জমা, ফসল-পাতি, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য স্থায়ী ও অস্থায়ী সম্পত্তি তাদের রাজনৈতিক ধর্মীয় শত্রুদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

১১। আহত ও অসুস্থ নর-নারীর কোন প্রকার যত্ন না নিয়ে প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের হত্যা করা হয় অথবা আগুনের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়। হাসপাতাল থেকে অসুস্থ রোগীদের টেনে বাইরে এনেও হত্যা করা হয়।

১২। মৃত ও জীবন্ত নরনারীর অসংখ্য দেহ এক জায়গায় জমিয়ে সৈন্যরা তাঁদের উপর পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। বহু বাঙ্গালীদের জীবন্ত পোড়ানো হয়। যথাযথ অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা না করে বহু মৃতদেহ নদীতে, কূপে বা পুকুরে ফেলে দেয়া হয় অথবা একটি স্থানে স্তুপ করে রাখা হয়। কখনও মৃতদেহের স্তুপ দিয়ে রাস্তায় বেরিকেড তৈরী করা হয়।

১৩। মুসলমান, হিন্দু, খৃষ্টান ও বৌদ্ধদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচরণসমূহের প্রতি কোন প্রকার শ্রদ্ধা দেখানো হয়নি। বহু ইমাম ও মুসল্লীদের গুলি করে হত্যা করা হয়। দ্রুত কবর দেয়ার বিধান থাকা সত্ত্বেও বহু মুসলমানের পচা গলা লাশও সরিয়ে নিতে দেয়নি পাকিস্তানী সৈন্যরা। ধর্মানুসারে জানাজা পড়ার কোন সুযোগ দেয়া হয়নি। হিন্দুদের শবদেহ পোড়ানোর কোন সুযোগ দেয়া হয়নি। মসজিদ ও মন্দির বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হয়। বৌদ্ধ মন্দির ও গীর্জা আক্রমণ করে লুঠ করা হয়।

১৪। ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর ও কুমিল্লায় আটক শিবির স্থাপন করে হাজার হাজার অরাজনৈতিক বা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে সন্দেহকৃত নরনারী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের স্ত্রীবর্গ ও শিশুদের এই সব শিবিরে জঘন্য পরিবেশ আটকে রাখা হয়। খাবার ও পানির কোন প্রকার সুবন্দোবস্ত ছিল না এবং হাত মুখ ধোয়ার ও পায়খানা-পেশাবের কোন ব্যবস্থাও বিশেষ ছিল না সব সময় জীবন-হারানোর আতংক ও মানবেতর অবস্থায় তাদের আটকে রাখা হয়।

১৫। বহু অনাথ বাঙ্গালী শিশুদের পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। বহু বাঙ্গালী শিশুদের সামরিক বাহিনীর সমর্থকদের হাতে তুলে দেয়া হয় যাতে করে তারা বাঙ্গালী সংস্কৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে।

১৬। বহু এলাকায় প্রতিরোধ সৃষ্টির জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হয়। কেবল প্রতিরোধ উঠে গেলেই অস্থায়ীভাবে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা তুলে নেয়া হয়। সাধারণ ভাবে জনসাধারণের মধ্যে আতংক সৃষ্টি করাই এই ধরনের অত্যাচারের উদ্দেশ্য ছিল।

১৭। সৈন্য বাহিনীর ধ্বংসলীলার ফলে লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায় এবং তারা সবাই আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। তারা শিকার হয় অনাহার ও মৃত্যুর তারা শিকার হয় অপমানজনক আচরণের।

১৮। সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ড ও অত্যাচারের ফলে এদেশের এক কোটি মানুষ প্রাণ বাঁচানোর জন্যে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে চলে গিয়ে বাস্তুহারা ও পথের ভিখারী হয়ে যায়।

১৯। আওয়ামী লীগ সহ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অপরাপর দলের প্রতি সহানুভূতিশীল নরনারী সহ গণহত্যা বিরোধী সকল রাজনৈতিক কর্মী ও তাদের সমর্থকদের খুঁজে বার করে হত্যা করা হয়েছে। জার্মান গেস্টাপোদের মতো একটি কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে বহু লোককে হত্যা করা হয়েছে, হলুদ তালিকাভুক্তদের চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয় অথবা জেলে পাঠানো হয় অথবা তাদের অনেককে পাঠানো হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। বহু প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার বাঙ্গালী কর্মচারীদের বরখাস্ত করে সেখানে নিযুক্ত করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানীদের।

২০। বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামের মহান ঐতিহ্য শহীদ মিনার ভেঙ্গে দিয়ে সেখানে জোর করে স্থাপন করা হয় মসজিদ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উপর সর্বাত্মক আঘাত হেনে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়। শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের নির্বিচারে হত্যা করে সমাজের শিক্ষা, সংস্কৃতির ভিত্তি ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়। হাজার হাজার বাংলা বইপত্র ধ্বংস করা হয়৷ রাতারাতি পরিবর্তিত হয় বিদ্যালয়সমূহের পাঠ্যসূচী।

২১৷ এ সবের ফলে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে বাঙ্গালীদের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। নির্মম হত্যাকাণ্ড ও অত্যাচার চালিয়ে অস্বীকার করা হয় বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার। সমস্ত রাজনৈতিক বিরোধিতা জোর করে স্তব্ধ করে দেয়া হয়। হত্যা, ধর্ষণ, আতংক- সৃষ্টির মাধ্যমে পূর্ব বাঙলাকে বানানো হয় পাকিস্তানের একটি উপনিবেশে
The Genesis Of Bangladesh Sufrata Roy Chowdhury.
সামগ্রিক বিচারে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দালালরা বিমান ও নৌবাহিনী ও পদাতিক বাহিনী ব্যবহারের সমস্ত আইন ভঙ্গ করে জাতিসংঘ সনদ পদদলিত করে। ১৯৪৮ সালের গণহত্যা চুক্তিসভাপত্রসহ সমস্ত আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে।
সেজন্য পাকিস্তানী শাসন-গোষ্ঠী, তাদের সেনাবাহিনীর সদস্যবৃন্দ, সরকারী কর্মচারীবৃন্দ, তাদের সহযোগী সকল নরনারী ও তাদের সঙ্গে সহযোগিতাকারী এদেশী দালালরা গণহন্তা। তাদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাদের গ্রেফতার করে বিচার করা আইনত কর্তব্য। এমনকি মৃত্যুর পরও তাদের যথাযথভাবে বিচার হওয়া উচিত। গণহত্যাদের মাস করার অধিকার কারও নেই। এ-জন্যেই হিটলারের দোসরদের এখনও বন্দী করে বিচার করা হয়। বহু বছর পর ধৃত আই-কম্যানেরও বিচার অনুষ্ঠিত হয়। নৈতিক দিক থেকেও দেখা যায় যে ক্ষতিগ্রস্ত সে-ই কেবল পারে অপরাধীকে ক্ষমা করে নৈতিক অধিকার প্রয়োগ করতে। অন্য কারও সে অধিকার থাকার কথা নয়। কিন্তু কোন প্রমাণিত হত্যাকারীকে ক্ষমা করার অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত আত্মীয়দেরও নেই। কারণ হত্যাকারী মাত্রই আইনের চোখে দন্ডনীয়। যে সমাজে হত্যাকারীর বিচার হয় না সে সমাজে আর যাই থাক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা থাকতে পারে না।
বিচিত্রার গত ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৮০ ও ২৬শে মার্চ ১৯৮১ সংখ্যা দুটিতে বলা হয়েছে যে ১৯৭৫ পূর্ব সরকার গণহন্তাকারীদের বিচার করার কোন চেষ্টা করেনি। এর ফলে সারা দেশে অপরাধ প্রবণতাকেই উৎসাহিত করা হয়েছে। এবং তারই ফলে সারা দেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাকে আর শান্তিপূর্ণ বলা যায় না। বিচিত্রার গত ২৬শে মার্চ সংখ্যায় কিভাবে একের সাফল্য অন্যে ব্যবহার করে সে সম্পর্কে আমরা কিছুটা আলোকপাত করেছি। অর্থাৎ কিভাবে নেপোয় দই মেরে আসছে আসছে তা দেখিয়েছি। তার কয়েক দিন পরেই সংবাদপত্রে আমরা সবাই বিস্মিত হয়ে জেনেছি যে যারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল তারাই এখন নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবী করছে। পাকিস্তানীদের এদেশী সহযোগী দালালদের স্বরূপ উদঘাটন করে ইতিপূর্বে দু-একটি দলিল আমরা পেশ করেছি। এবার আমরা আর একটি দলিল পেশ করে আমাদের এই নিবন্ধের ইতি টানবো। লাকসামের কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি ৬-৫-৭১ তারিখে অনুষ্ঠিত সভায় যে-সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেগুলো হচ্ছেঃ

১। শান্তি কমিটির সভাপতি ও সহ-সভাপতির অনুপস্থিতিতে জনৈক চৌধুরীকে ঐ তারিখের সভায় সভাপতি করা হয়। (আমরা এই দলিলে ছাপানো নামগুলো এখানে প্রকাশ করলাম না।)

২। জনৈক চৌধুরীর পদত্যাগপত্র পরবর্তী সভায় পেশ করার জন্য রেখে দেয়া হোল।

৩। (ক) তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর বিবরণ ও তথ্যাদি তহবিল গঠন ও মুক্তিবাহিনীতে নতুন সদস্য গ্রহণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাদের গোপন তৎপরতার সংবাদাদি এবং যারা ইতিমধ্যে মুক্তিবাহিনীর সদস্য হয়েছে তাদের বিবরণাদি অবিলম্বে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটিকে জানানো হোক। যারা মুক্তিবাহিনীর জন্যে চাঁদা আদায় করছে এবং যারা চাঁদা দিচ্ছে তাদের একটি তালিকা কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কাছে পেশ করা হোক।

খ। লাইসেন্স ছাড়া সমস্ত বন্দুক, রাইফেল ও অন্যান্য সাজসরঞ্জামের খবর জানানো হোক।

গ। ইউনিয়ন শান্তি কমিটিদের পুনরায় অনুরোধ করা হোল (অস্পষ্ট) মেথর, ধোপী, জেলে, নাপিত ছাড়া সকল হিন্দুকে উৎখাত করার জন্যে এধরনের লোকদের একটি তালিকা বিবরণসহ পেশ করা হোক।

ঘ। পাকিস্তানের আশংকামুক্ত হয়ে ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সকল বৌদ্ধ যাতে বাস করতে পারে সেজন্য তাদের সকল সুযোগ-সুবিধা দেয়া হোক। কয়েকটি ইউনিয়ন কাউন্সিলে বসবাসকারী বৌদ্ধদের তালিকা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন শান্তি কমিটির কাছে পেশ করা হোক।

৪। অধুনালুপ্ত ঘোষিত আওয়ামী লীগের যেসব সদস্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে তাদের নিম্নলিখিত কারণে একটি প্রথমত সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিতে বলা হোকঃ

ক। অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের বিভক্তির জন্যে এবং ভারতের সঙ্গে একপ্রকার সংযুক্ত হয়ে যাওয়ার জন্যে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার জন্যে কাজ করে।

খ। উক্ত রাজনৈতিক দল পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে শ্রেণীভিত্তিক ঘৃণা ছড়ায়, তাদের মধ্যে জাতিসত্তাগত ও প্রদেশগত সংঘর্ষ উৎসাহিত করে এবং পাকিস্তানের মারাত্মক ক্ষতি করার জন্য আঞ্চলিকতাকে উৎসাহিত করে।

৫। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নসমূহের সমূহের সামরিক লোকদের ও প্রাক্তন সামরিক ব্যক্তিদের তালিকা পেশ করা হোক।

৬। সরকারী ও আধা সরকারী প্রতিষ্ঠানের অফিসারবৃন্দ ও কারখানার শ্রমিকদের স্ব স্ব কাজে যোগদানের জন্য উৎসাহিত করা হোক।

৭। ১৬ নং ইউনিয়ন কাউন্সিলের মোহাম্মদপুর ও ইছাপুরে বা তার আশেপাশে লুণ্ঠন ও সমাজ বিরোধী তৎপরতা সম্পর্কে তদন্ত করার জন্যে নিম্নলিখিত ভদ্রলোকদের নিয়ে একটি অনুসন্ধান কমিশন গঠন করা হোল। এই কমিটি ৯-৫-১৯৭১ তারিখে যা তার পূর্বে রিপোর্ট পেশ করবেন।

উল্লেখ্য যে উক্ত অনুসন্ধান কমিটিতে যে চারজন সদস্য নিযুক্ত হন তাদের নাম দেয়া আছে এই সিদ্ধান্ত-পত্রে। এরকম আর একটি সিদ্ধান্ত গুছে গ্রহণ করে পাকিস্তানী হানাদারদের সহযোগী ঢাকার মোহাম্মদপুরের পাকিস্তান ইনটেগুটি এ্যান্ড সলিডারিটি প্রিজারভেশন এ্যাকশন- কমিটি (পাকিস্তান সংহতি ও অখন্ডতা সংরক্ষণ সংগ্রাম কমিটি) ১৯৭১ সালের ৯ই আগস্ট। ইংরেজিতে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহে বলা হয়।

১। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা এবং বিদ্যালয়ের বাধ্যতামূলক বিষয় করতে হবে। বাংলায় লিখিত সাইনবোর্ড, নম্বর, ফলক ও নাম-ফলক অপসারণ করতে হবে, সংস্কৃতানুসারী বাংলা অক্ষরের পরিবর্তে রোমান অক্ষর ব্যবহার করতে হবে।

২। যে কাফের কবি নজরুল ইসলামের ছেলেদের হিন্দু/বাংলা নাম রয়েছে তার রচনাসহ বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির হিন্দু প্রভাবিত অংশসমূহ বর্জন করতে হবে।

৩। পূর্ব পাকিস্তানের রেডিও টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের কমপক্ষে শতকরা ৫০ ভাগ ব্যয় করতে হবে উর্দু অনুষ্ঠানের জন্যে।

৪। আমাদের পবিত্র ভূমিতে পাকিস্তান বিরোধী বিদেশীদের আসতে দেয়া হবে না (যেমন, ইহুদীবাদী দুশ্চরিত্র ইসলামের শত্রু এডওয়ার্ড কেনেডী)।

৫। বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল বাঙ্গালী সরকারী কর্মচারী, বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীদের ওপর চব্বিশ ঘন্টা নজর রাখতে হবে, (পরে তাদের সামরিক বিচার করে হত্যা করতে হবে)।

৬। জাতীয় স্বার্থে উচ্চপদ থেকে বাঙ্গালী সরকারী অফিসারদের দু’বছরের জন্যে অপসারণ করতে হবে।

৭। রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটির বেতন দেয়ার জন্যে হিন্দুদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে।

৮। কড়া প্রতিবাদে (অস্পষ্ট) রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য শত্রুরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে।

৯। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্যে বাস্তুহারাদের সাহায্য দ্রব্য এবং উর্দু ভাষী/খাঁটি পাকিস্তানীদের মধ্যে বিতরণের জন্যে বাত্য বিধ্বস্তদের সাহায্য তহবিল ব্যবহার করতে হবে।
(বাংলাদেশ গণহত্যা ফজলুর রহমান পৃঃ ৫৬-৫৮)
পাকিস্তানী গণহন্তাদের দালাল আল-বদর বাহিনী বহু বুদ্ধিজীবীর কাছে নীচের চিঠিটি পাঠায়ঃ

শয়তান নির্মূল অভিযান

শয়তান,
ব্রাহ্মণবাদী হিন্দুদের যে সব পা-চাটা কুকুর আর ভারতীয় ইন্দিরাবাদের দালাল নানা ছুতানাতায় মুসলমানদের বৃহত্তম আবাসভূমি পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে তুমি তাদের অন্যতম। তোমার মনোভাব চালচলন ও কাজকর্ম কোনটাই আমাদের অজানা নেই। অবিলম্বে হুশিয়ার হও এবং ভারতের পদলেহন থেকে বিরত হও, না হয় তোমার নিস্তার নেই। এই চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে নির্মূল হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।

—- শনি

সাইক্লোলাস্টাইল করা এই চিঠির ছবি ১৯৭১ সালের ২১শে ডিসেম্বর দৈনিক অবজারভার পত্রিকায় ও জনাব ফজলুর রহমানের ‘বাংলাদেশে গণহত্যা’ বইতে ছাপানো হয়েছে। এই চিঠি যাদের পাঠানো হয় তারা প্রায় সবাই আলবদরের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।

১৩৭৮ সালের ২৭শে পৌষ দৈনিক পূর্বাদেশে প্রকাশিত আলবদর কমান্ডার আশরাফুজ্জামান খানের ডায়েতীতে ১৯ জন বিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, শিক্ষিকা ও চিকিৎসকের তালিকা পাওয়া যায়। ঐ কমান্ডার নিজের হাতে সাতজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে হত্যা করে বলে অভিযোগ করা হয়। ঠিকানাসহ যাদের নাম ঐ তালিকায় ছিল তারা হলেনঃ মোহাম্মদ শহীদুর রহমান, হাইড্রোগ্রাফিক সেকশন, আইডব্লিউটিএ, ঢাকা; ওয়াকিল আহমদ বাংলা; ডক্টর ফজলুল মহি, আইইআর; ডক্টির লতিফ, আইইআর; মুনীর চৌধুরী, বাংলা; কবীর চৌধুরী; ডক্টর মনিরুজ্জামান, পরিসংখ্যান, সা’দউদ্দিন, সমাজ বিজ্ঞান; এ এম এম শহীদুল্লাহ, অংক; ডক্টর সিরাজুল ইসলাম, ইসলামের ইতিহাস; ডক্টর মোর্তজা; ডক্টর আখতার আরমদ, আইইআর, ডক্টর আবুল খায়ের, ইতিহাস, গিয়াসউদ্দিন ইতিহাস; জহিরুল হক, দর্শন; আহসানুল হক, ইংরেজি; সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইংরেজী; মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, বাংলা; আনোয়ার পাশা, বাংলা; রশিদুল হাসান, ইংরেজী; নীলিমা ইব্রাহিম, বাংলা।
এই তালিকাভুক্ত ব্যক্তিবর্গের আট জনই আল-বদরের হাতে নিহত হনঃ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ডক্টর আবুল খায়ের, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক রশিদুল হাসান, ডক্টর ফজলুল মহী, ডক্টর মোর্তজা (চিকিৎসক)। এই তালিকার বাইরেও বহু শিক্ষক, চিকিৎসক ও অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত বুদ্ধিজীবী এদের হাতে নিহত হন। ( ফজলুর রহমান ঐ, পৃঃ ৬২-৬৪)
জামালপুরের ইসলামী ছাত্রসংঘের নরপিশাচ মোঃ আবদুল বারীর যে ডায়েরী পাওয়া গেছে তাতে স্বহস্তে লেখা হয়ঃ

১। টাঙ্গাইলে সাকসেসফুল অপারেশন হয়েছে। হাজার দেড়েকের মত মুক্তিফৌজ মারা পড়েছে আল-বদর ও আর্মিদের হাতে।

২। আরও লেখা ছিলঃ
(১) হায়দার আলী, (২) নজমুল হক টাকা ২৫০০/-। তিতপল্লার শিমকুড়া গ্রাম জব্বারের কাছ থেকে ২৯-১০-৭১ (তারিখে) আর তিন হাজার নেওয়ার পরিকল্পনা আছে।

৩। ডায়েরীর অন্যান্য স্থানে ডায়েরী লেখকের ব্যক্তিগত চরিত্রের ছবিও আছেঃ

২৬-১০-৭১ প্রোসটিটিউশন কোয়ার্টার
২৯-১০-৭১ র‍্যাপিং কেস হিন্দু গার্ল

ইসলামের নাম ভাঙিয়ে চলতো যে জামাতের ছাত্রকর্মী আবদুল বারী সে নরহত্যা, বেশ্যালয়গমন ও নারীধর্ষণের মাধ্যমিক ইসলামের কি বিশেষ সেবা করেছিল? ডায়েরীর ঐ পৃষ্ঠায় দেয়া সিলে আছে যে, ঐ রিপোর্টটি ছিলঃ দি ডেলী প্রগ্রেস অব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘ, জামালপুর ইউনিট। তারিখ ১৬-১-৭১ শুক্রবার। বলা বাহুল্য মুষ্টিমেয় এই নরঘাতক, ইসলামের অবমাননাকারী, ধর্মের লেবাস গায়ে দিয়ে ধর্মেরই শত্রুতাকারী ও গণমানুষের শত্রুরা একবারও ভাবেনি যে হাজার চেষ্টা করেও সকল বাঙালীকে কোনদিনই নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। অন্যায় করলে সে অন্যায়ের ছুরি তাদেরই দিকে ফিরে যাবে। ইসলামের নামে বুলি আউড়িয়ে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও দেশদ্রোহিতা করে এরাই ইসলামের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে, ইসলামকে বিশ্ববাসীর কাছে হেয় ও কলঙ্কিত করেছে, ইসলামের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা অনেকখানি নষ্ট করেছে, ইসলামকে মানুষের কাছে ভয়ংকর এক ভীতিরূপে উপস্থিত করেছে। এরাই যদি ইসলামের সত্যিকার শত্রু ও ধ্বংসকারী না হয় তাহলে আর কারা শত্রু হবে? মুখে কলেমা পড়তে পড়তে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নিরীহ, ধর্মভীরু ও সত্যিকার মুসলমান নর-নারী এদেরই হাতে নিহত ও ধর্ষিত হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে কখনও ইসলামের এত বড় জঘন্য ও ভয়ংকর আর শত্রু আবির্ভূত হয়নি।
এমন কি নির্মম এজিদও যুদ্ধকালীন সময়ে ছাড়া কোন মুসলমানকে এভাবে কুকুরের মতো সম্ভবত হত্যা করেনি। কোন নারীর অবমাননা কারবালা ময়দানে করা হয় বলেও শোনা যায় না। এজিদ যদি ঘৃণ্য হয়, হয় ইসলামের শত্রু, তাহলে এরা কি নয় মুসলমানের শত্রু, ইসলামের শত্রু? এরা কি সর্বকালের সবচেয়ে জঘন্য ও বড় শত্রু নয় ইসলামের। এই প্রশ্ন আজ বাংলাদেশের সকল মুসলমান নর-নারীর মনে সবসময়ই জাগে। তারা ভয় পায় না। কিন্তু তারা ভয় পায় তারা বেইজ্জতির, তারা চায় না ইসলাম নিয়ে কেউ পাপ কার্যে ব্যবহার করুক, ব্যবহার করুক হত্যার কাজে, ব্যবহার করুক নারীধর্ষণে, ব্যবহার করুক একটা বিরাট বাঙালী জাতি ধ্বংসের কাজে যাতে এই এলাকা থেকে ইসলাম চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ জানে, পাকিস্তানী হানাদারদের দালালরা, এই ধর্মের নামে ব্যবসায়ীরা শুধু বাঙালী জাতি বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শত্রু নয়, তারা মনে প্রাণে ইসলামের শত্রু, মুসলমানের জানের ও ইজ্জতের শত্রু। এই শত্রুরা চিরকাল ধ্বংস হয়েছে, চিরকাল ধ্বংস হবে। এরা মুখে যত বড় কথাই বলুক, এরা আসলে মানুষকে ভালোবাসে না। তাহলে, যে প্রাণ এরা সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে না, সেই প্রাণ এরা ধ্বংস করতো না, যে সতীত্ব এরা ফিরিয়ে দিতে পারে না, সেই সতীত্ব এরা কেড়ে নিত না, যে কলেমার অবমাননা করার অধিকার এদের নেই সেই কলেমা পাঠকারী নামাজে পাঠরত মানুষকে এরা কুকুরের মতো হত্যা করতে পারতো না। এমন কি এরা তাদের নিজেদেরও ভালোবাসা না, এরা আত্মধ্বংসী। সে জন্যে এরা সব সময়েই অন্যায় করে, মানুষের ক্ষতি করে। তারা ফলেই মানুষ তাদের বিরুদ্ধে যায়, প্রকৃতি তাদের বিরুদ্ধে যায়।

এরা তাই সব সময় গোপনে কাজ করে, মানুষকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে। পরিণামে তাদের সকল পরিকল্পনা ভেঙে পড়ে তাড়াতাড়ি মাথার ওপর। এরা মানুষের শত্রু বলেই মানুষ থেকে এরা দূরে থাকে এবং সব সময় ষড়যন্ত্রের মধ্যে থাকে। জাতিকে বলে এক কথা, করে আর এক রকম গোপনে। জাতি তাই কোনকালেই এদের বিশ্বাস করেনি, কোনকালেই বিশ্বাস করবে না। এই জাতি দাঁড়িয়ে আছে মহা পর্বতের মতো। হিমালয়ের মতো। ওদের নতুন শিং গজিয়েছে। মাঝে মাঝেই গজায়। তারা তখন হিমালয় উল্টিয়ে দেয়ার জন্যে গুঁতো মারতে থাকে। পরিণামে তাদেরই শিং ভাঙে। সব সময়ই তাদের শিং ভেঙেছে, সব সময়ই তাদের শিং ভাঙবে। জাতির জন্যে, হিমালয়ের জন্যে, তাই কোন চিন্তা নেই।
এদেশের মানুষ মৃত্যুঞ্জয়ী। বার বার এখানে হানা দেয় মৃত্যু। কিন্তু অবশেষে তাকেই ফিরে যেতে হয়। মরণ আমাদের চিরতরে ছুঁতে পারে না। কারণ আমরা মরনে বিশ্বাস করি না আমরা আছি জীবনের পক্ষে। আমরা অন্ধকারে বিশ্বাস করি না, আমরা আছি আলোর পক্ষে। আমরা পরাজয়ে বিশ্বাস করি না, আমরা আছি জয়ের পক্ষে। ওরা অন্ধকার, ওরা ঘৃণা, ওরা মৃত্যু, ওরা মিথ্যা, ওদের চিরকালের ঠিকানা তাই নর্দমায়। আর আমাদের ঠিকানা জনপথ— আলোকিত জনপথ।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!