You dont have javascript enabled! Please enable it! গণহন্তার চিঠি | মোহাম্মদ আবু জাফর | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৯ ডিসেম্বর ১৯৮০ - সংগ্রামের নোটবুক

গণহন্তার চিঠি

মোহাম্মদ আবু জাফর

মুক্তিযুদ্ধ কালে চিঠিটি হাতে আসে৷ যশোর থেকে এটি সংগ্রহ করা হয়। চিঠির বিষয় ও বক্তব্য একই সঙ্গে আমাদের মনে তীব্র বেদনা ও বিক্ষোভের সৃষ্টি করে। সে সময় প্রতিটি বাঙালী দেশ- প্রেমিকই জানতেন যে, পাকিস্তানের গনবিরোধী শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের মানুষকে গণ হত্যার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করতে ছিল বদ্ধপরিকর। চিঠিটি আমাদের সেই যথার্থ ধারণাকেই সমর্থন করে। গণহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাভাবিক ঘৃণা সেদিন আরো গভীর হয়েছিল। রক্ত এবং ঘামের মধ্যে দিয়ে কাটছিল আমাদের সময়, দিন কাটছিল অনাহার ও উদ্যেগের মধ্যে। সেই সময় এই চিঠিটি পেয়ে আমরা নতুন করে উপলব্ধি করেছিলাম, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আমাদের চরম শত্রু এবং তাদের বিনাশ ব্যতীত আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার কোন উপায় নেই।

এই চিঠির কিছু অংশ সেই সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়। চিঠির পুরো বক্তব্য জানলে স্পষ্টতই বোঝা যাবে যে, পাকিস্তান সরকার গণহত্যার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল, তার বাস্তবায়নের পেছনে ছিল সে দেশের সমাজের অন্তত একটি অংশের পূর্ণ সমর্থন। তারা মনে প্রাণে বাঙালী জাতির নিশ্চিহ্নকরণ যুক্তিযুক্ত বলে বিশ্বাস ও সমর্থন করতো৷ এই নিষ্ঠুর, মমতাহীন ও অকল্পনীয় চিঠিটি বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট হবে যে, আমাদের জাতিসত্বার পুরো বিলোপ সাধন ছিল তাদের নিত্য কামনা।

এই চিঠিটি ১৯৭১ সালের ২১ আগস্ট পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদ থেকে লেখেন জনৈক মেজর এম, আফজাল খান সাকিব। প্রাপকঃ যশোর সেনানিবাসের (?) ২০০ সংখ্যক সার্ভে সেক্টর অথবা সেকশনের ভারপ্রাপ্ত অফিসার জনৈক মেজর মুহাম্মেদ ইকরাম খান। বিমান ডাকে আসা নীল রঙের খামের পেছনে যশোর ডাক বাক্সের ২৫ আগস্টের সিল পড়েছিল। মেজর আফজালের ইংরেজীতে লেখা পত্রের বাংলা – অনুবাদ নীচে দেয়া গেল।

আমার প্রিয় ইকরাম,

আশা করি এই চিঠি তোমাকে ‘খুবই স্বাস্থ্যবান ‘ দেখবে। তোমার কাছ থেকে দুটি পত্র পেয়েছি। তোমার প্রথম পত্র এবং আমার পত্র পথে পরস্পরকে অতিক্রম করেছে সম্ভবত। পাপুকে টনসিলের অস্ত্রোপচার করার জন্য হাসপাতালে ভর্তির কারণে তোমার প্রথম পত্রের উত্তর দিতে দেরী হয়েছে। অস্ত্রোপচার হয়ে গেছে। পুনরায় মেডিকেল বোর্ডের সম্মুখীন হওয়ার জন্য সে আজ কোহাট যাচ্ছে। মালির অথবা হায়দ্রাবাদে মেডিকেল বোর্ড করার জন্য আমাদের অনুরোধ হেড কোয়ার্টারের হারামজাদারা রাখেনি। মেজর বার্কি এ্যাবোটাবাদে। পাপুকে দেখতে ও মেডিকেল বোর্ডের পরীক্ষার জন্য কোহাটে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সে আজ পিন্ডি আসছে। আশা করি পরীক্ষাটা সে উৎরে যাবে। বার্কি আমাকে বলেছে যে, তুমি ওখানে খুব সুখে নেই। কারণটি আমি বুঝি।

কিন্তু প্রিয়বর, ওখানকার অস্বাভাবিক পরিবেশের সঙ্গে তোমাকে কোন মতে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। এটা খুব ভালো কথা যে, দুঃখজনক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে তোমাদের দুজনের কিছুটা বিকল্প চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা করার জন্য রশিদ ওখানে আছে। আমি এখন অসম্ভব ব্যস্ত। হাসপাতাল থেকে বাচ্চারা সব ফিরে এসেছে। আল্লাহকে শুকরিয়া। কর্ণেল রিয়াজের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। আমি আজ তাকে লিখছি। যখনই সে তোমাকে দেখতে আসবে, তখনই তুমি তার সঙ্গে আলাপ করতে পারো। সে বেশ আমুদে লোক এবং দেশে ফেরার ব্যাপারে সে নিশ্চয়ই তোমাকে সাহায্য করবে।

ইদানীং জমিজমা গুলো আমি বিশেষভাবে দেখাশোনা করছি। কারণ এ – কাজের জন্য আর কেউ নেই, আহদুল্লাহকে সামরিক বাহিনীতে ফেরত নিয়ে গেছে। এখন আগস্টের শেষ এবং এখনও আমার খামারের বেতগুলো খাড়া দাড়িয়ে – কি সৌভাগ্য! আমি একটি চিনি তৈরীর কল ও একটি বিদ্যুৎ – চালিত যাঁতাকল ধার নিয়েছি এবং বর্তমানে আমরা সাদা চিনি তৈরী করছি।

রশিদ যে বাঙ্গালী বাঘিনীদের পোষ মানাচ্ছে তা শুনে আমি মোটেও বিস্মিত হই নি। তাদের পরবর্তী বংশধরদের অবশ্যই বদলে দিতে হবে। করাচীর কুত্তিকে দেখার সুযোগ আমার হয় নি এবং আমি তাকে দেখতেও চাই না। ওদের ছোটটি আবার ডাক্তার খালিদের পেছনে লেগেছে। তার ভাইয়ের লাহোর যাওয়ার অপেক্ষা করছে সে, তারপর সে সেই ‘মিটার ছাড়া ট্যাক্সিটাকে’ একটি পিআইএ – টিকেট পাঠাবার আশা করে। আমার সঙ্গে খালিদের আবার মিল হয়ে গেছে। আসলে সে- ই এসে আমার কাছে মাফ চায়। সে জানায় যে, ঐ দিন সে সত্যিই অসুস্থ ছিল। ওয়ালীর পোস্টিং হয়েছে রাওয়ালকোটে। কি জায়গা।

চৌধুরী ফজল একটি মাল- জাহাজ কিনেছে। সেটি এখন চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা। যদি এটি উড়িয়ে না দেয়া হয়ে থাকে, তা হলে জাহাজটি এত দিনে চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করেছে বলে সে আশা করে। তার চলচ্চিত্র প্রকল্পের কাজ ভালোই এগুচ্ছে। গত রাতে সে আমার সঙ্গে ছিল এবং তোমার কথা সে বলেছে। সে এক চমৎকার লোক।

আমার অনুরোধ, মন খারাপ করো না। আল্লাহ নিশ্চয়ই অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবেন। আমি পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার ইচ্ছে ত্যাগ করিনি। কাজের ঝামেলার জন্যই যেতে পারছি না। যে কোন দিন আমি এবং ফজল ওখানে পৌছে যেতে পারি। ইতিমধ্যে তুমিও কিছু বাঙালী কুত্তিকে পোষ বানানোর পরিকল্পনা করে ফেলো। ‘ছারপোকা ‘ আছে কিনা দেখার জন্য প্রতিদিন কি তুমি তোমার বিছানা, চাদর, টেবিলের ড্রয়ার প্রভৃতি পরীক্ষা করে দেখো। ওই দেশের চাকর-বাকরদের থেকে সাবধান। খাওয়ার আগে তোমার খাবার বিড়ালকে খাইয়ে পরীক্ষা করে দেখো। হোটেল- টোটেলে গেলে সবসময়ই সন্দেহ প্রবণ থাকবে। আমি তোমাকে নিরুৎসাহিত করছি না। শুধু মনে করিয়ে দিলাম।

তোমার খালাম্মার আদর ও দোয়া জেনো। চান্দ ও অন্যান্যদের সময় দিও। রশিদকে চিঠি লিখতে বলো।

তোমার স্নেহময়
সাকিব

মেজর মুহাম্মদ ইকরাম খান
ভারপ্রাপ্ত অফিসার, সার্ভে সেকটর (বা সেকশন)
যশোর, পূর্ব পাকিস্তান।

বাঙালী হত্যা ও যুদ্ধ শুরু হওয়ার পাঁচ মাসের মাথায় লেখা এই চিঠির যে সব বিষ্ময়কর দিক চোখে পড়ে তা হচ্ছেঃ

ক। বাঙালীরাও যে মানুষ এবং মানুষকে যে নির্বিচারে হত্যা ও নির্যাতন করা হচ্ছে তা পত্রলেখক মেজনের মনে সামান্যতম আন্দোলন সৃষ্টি করে নি৷ সে জন্য নির্যাতিতের জন্য কোন সমবেদনা নেই৷ বরং তাদের সরকার ও সেনা বাহিনী যথার্থ আইনী ও ন্যায় কাজ করছে – সেই বদ্ধমূল ধারণাই মেজর আফজাল খান সাকিবের মধ্যে ক্রিয়াশীল। একই সঙ্গে সে বিজয় সম্পর্কেও নিশ্চিত। উল্লেখ্য, ততদিনে বিদেশী রেডিও, টিভি, সংবাদপত্র ও অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যমে পাকিস্তানবাসীরা এখানকার ঘটনা সম্পর্কে অবহিত।

খ। একজন মানসিকভাবে শান্ত মানুষ সংসারের খুঁটিনাটি লিখেছেন তার প্রিয়জনকে। সন্তানদের জন্য সে পিতা হিসেবে উদ্বিগ্ন, হাসপাতাল থেকে বাচ্চারা সুস্থ হয়ে ফিরে আসায় আফজাল আল্লাহকে পর্যন্ত ধন্যবাদ দিয়েছে। আদরের পাপুর সেনাবাহিনীতে কমিশন প্রাপ্তির ব্যাপারে আফজাল খুবই উদ্বিগ্ন, এতখানি উদ্বিগ্ন যে, সামরিক হেড কোয়ার্টারের জেনারেল স্থানীয় কর্মকর্তা দের পর্যন্ত সে হারামজাদা সম্মোধনে ভূষিত করতে পিছপা হয়নি। চিঠির এই অংশটি প্রমাণ করে যে, মেজর ইকরাম মেজর আফজালের পরম আত্মীয়, মেজর আফজাল বয়সে জ্যেষ্ঠ। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলেই চিঠিতে এ ধরণের শব্দ প্রয়োগ করতে তার দ্বিধা হয় নি। ইকরামের জন্য আফজাল উদ্বিগ্ন, তাই সে ব্যাপারে কর্ণেল রিয়াজকে ফোন করার চেষ্টা করেছে। ইকরামকে সে এখানকার পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বলেছে।

গ। সেনাবাহিনীতে মাত্র চতুর্থ ধাপের অফিসার হয়েও স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ সংগ্রহে রীতিমতো কামিয়াব হয়েছে আফজাল. জমির ফসল ও ব্যবসার মুনাফা – দুটোই তার ভাগ্যে জুটেছে। পাকিস্তানের সামন্ত – বেসামরিক ও সামরিক আমলা বুর্জোয়াদের শোষণের দোসর এই মেজর। যুদ্ধ কালেও দাঁও মারার সুযোগ ওরা হাত ছাড়া করে নি। লুন্ঠনের পাশাপাশি পানির দরে কিনেছে সব কিছু। ফজলের মাল বাহী জাহাজ কেনা তারই একটি দৃষ্টান্ত। ফজলকে নাইস গাই বলে সম্মোধন করা হয়েছে, এতে বোঝা যাচ্ছে সে কোন পর্যায়ের, সে সামরিক অফিসার হিসেবে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে যে বহু সম্পদের মালিক হয়েছে তা বোঝা যায়। ব্যবসাতে সে অর্থ বিনিয়োগ করেছে এবং সম্পত্তিও কিনেছে। কৃষি জমির উৎপাদন ও ব্যবসার আয় সম্পর্কে সে খুবই উদ্বিগ্ন। ওরা সবাই একই পদের।

ঘ। পাকিস্তান সরকার সে – সময় এ – দেশে যে জঘন্যতম গণহত্যা চালিয়েছিল সে সম্পর্কে সামান্যতম বিরূপ মন্তব্য এই চিঠিতে নেই। সাকিব আশা করেছিল বরং যে, আল্লাহ পরিস্থিতি অনুকূল করবেনই। সুতরাং ইকরাম যেন হতাশ না হয়। আগস্ট সেপ্টেম্বরেও অবস্থা ওদের জন্য ভালোই ছিল বলে সাকিব মনে করতো। কারণ নানা কাজের চাপেই কেবল, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ আসতে পারছিল না।

ঙ। রশিদ নামের জনৈক সামরিক অফিসার (!) বেশ কিছু ‘বাঙালী বাঘিনী’ দের যে ‘পোষ মানাচ্ছিল’ সে সময় সাকিব তাতে মোটেই বিষ্মিত হয় নি৷ কারণ সেটাই তার কাছে স্বাভাবিক ও পরম কাম্য বলে মনে হয়েছিল৷ এ – ক্ষেত্রে তার মনে কোন নৈতিক প্রশ্নও ওঠে নি। স্ত্রী ছাড়া অন্য নারীর সঙ্গে দৈহিক সংসর্গ ধর্মবিরোধী বলে তার কোনক্রমেই মনে হয় নি। অথচ বার বার সে আল্লাহকে স্মরণ করেছে। তার মনে এটা বদ্ধমূল হয়ে ছিল যে, বাঙালী নারীদের জোর করে সতীত্ব হরণ একটি পবিত্র ও পুণ্য কর্তব্য এবং তার দ্বারা দোজখে শাস্তিভোগের কোন সম্ভাবনাই নেই। বরং ‘মালে গণিমত’ হিসেবে তাদের উপর অত্যাচার করলেই সওয়াবের অধিক সম্ভাবনা। সম্ভবত এ কারণেই মেজর এম, আফজাল খান সাকিব পবিত্র, শিক্ষণীয় ও অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হিসেবে তারই পরম স্নেহভাজন আত্মীয় মেজর ইকরামকে পরামর্শ দেয়, রশীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কিছু বুনো কুত্তীকে (বাঙালী নারী) পোষ মানাতে। কাফেরের সব কিছুই মালে গণিমত – সে সময় অনেকেই এ ফতোয়া দেয়, ‘মালে গণিমত ভোগ করলে পুণ্য হয়, পাপ হয় না৷ বাঙালী নারীদের আফজাল আসলে মালে গণিমতই মনে করেছে – এতে সন্দেহ নেই।

এ ছাড়া সে নীতিগত ভাবেই বিশ্বাস করতো যে, বাঙালীদের পরবর্তী বংশধরদের পরিচয় বদলে ফেলা অবশ্য কর্তব্য। সুতরাং প্রতিটি বাঙালী নারীর গর্ভে খান সেনাদের সন্তান উৎপাদন করা উচিত বলে মনে করতো সে। সে সময় ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ উপস্থিত ছিল না বলে নিজে এই ‘মহান কর্মে’ অংশগ্রহণ করতে পারে নি। সে জন্য সে তার এবং তাদের সবার পক্ষ থেকে ক্রিয়াশীল হওয়ার জন্য মেজর ইকরামকে পরামর্শ দিয়েছেন। এই পরামর্শ দান কালে তার বিকৃত আনন্দ লাভের ভাবটি শব্দ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে।

চ। ইকরাম যাতে বিছানাপত্র, চেয়ার, টেবিল, দেরাজ প্রভৃতি প্রতিদিন পরীক্ষা করে সে জন্য আফজাল পরামর্শ দিয়েছে। বাঙালী চাকরদের অবিশ্বাস করতে, হোটেলে সাবধানে খেতে এবং বাসায় খাওয়ার আগে বিড়ালকে খাইয়ে পরীক্ষা করতেও পরামর্শ দিয়েছে। উক্ত আফজাল বোমা বা বিষ দিয়ে যাতে তাকে মেরে না ফেলে বাঙালীরা, এ জন্যেই এই পরামর্শ। এতে বোঝা যায় যে, কোন বাঙালীকেই তারা বিশ্বাস করতো না এবং তাদের এখানে জীবন যাপন ততদিনে বেশ সঙ্গীনই হয়ে উঠেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বেশ কিছু বাঙালী তখনও বিশ্বাস করতো যে খান সেনারা তাদের পরম মিত্র ও পুরোপুরি বিশ্বস্ত মনে করে। যে যা চেনে।

বস্তুত, চিঠিটি নিজেই নিজের ব্যাখ্যা। এত কথা বলারও দরকার করে না। সে জন্যে একটি অনিবার্য প্রসঙ্গ টেনেই আমাদের এই টীকা শেষ করবো।

(১) আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী জাতীয়তাগত, জাতিগত, গোত্রগত বা ধর্মগত কোন গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণরূপে বা আংশিকরূপে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে নিম্নের যে কোন আচরণ গণহত্যার সামিলঃ

ক। কোন গোষ্ঠীর সদস্যদের সাংঘাতিক দৈহিক বা মানসিক ক্ষতিসাধন করা।

খ। ইচ্ছাকৃতভাবে কোন গোষ্ঠীর উপর এমন পরিকল্পিত জীবযাত্রা – ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া যাতে তাদের দৈহিক অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে বা আংশিক ভাবে ধ্বংস হয়ে যায়।

গ। জীবন ও দেহের প্রতি আক্রমণ, বিশেষ করে সকল রকমের হত্যা, বিকলাঙ্গকরণ, নিষ্ঠুর আচরণ ও নির্যাতন।

ঘ। ব্যক্তিগত মর্যাদাহানি, বিশেষ করে অবমাননাকর ও নীতিবহির্ভূত আচরণ।

গণহত্যার নানাবিধ শর্তের মধ্যে উপরের গুলোও অন্তর্ভুক্ত। ঐ সব আচরণ করলে শাসন্তন্ত্রানুসারে দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক, সরকারী কর্মচারী বা সাধারণ ব্যক্তিও অবশ্যই শাস্তিযোগ্য।
(দ্রষ্টব্যঃ বাংলাদেশে গণহত্যাঃ জাফর সাদেক (মুহাম্মদ আবু জাফর), রক্তাক্ত বাংলা, মুক্তধারা, ১৯৭১ (কলিকাতা), পৃঃ ৩৮৬-৩৮৯)

সে জন্যে সরাসরি হত্যার সঙ্গে বাঙালী নারীর দৈহিক মর্যাদা বিনাশ ও বাঙালী নারীদের গর্ভে খান সেনাদের বংশধর সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙালী জাতীয়তাগত, জাতিগত ও গোত্রগত পরিচয় বিনষ্ট ও পরিবর্তন করার চেষ্টা গণহত্যার মধ্যে পড়ে। এবং এর জন্য দায়ী গোষ্ঠী বা ব্যক্তি গণহত্যাকারী ও শাস্তিযোগ্য।

জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত ‘গণহত্যা চুক্তিসভাপত্রে’ র অন্যতম স্বাক্ষর দানকারী ছিল পাকিস্তান সরকার এবং সেই গনবিরোধী সরকার প্রথম সুযোগ আসা মাত্রই বাংলাদেশে সর্ব প্রকারে গণহত্যায় লিপ্ত হয়।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল সেই গণহত্যা বন্ধ করা সম্ভব হয়।