You dont have javascript enabled! Please enable it!

উৎপাদন বৃদ্ধি ও শিল্পে শান্তি রক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধুর আহ্বান

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে উৎপাদন বাড়ানো এবং শিয়ে শান্তি রক্ষার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সমাজতন্ত্র কায়েমে শ্রমিকদের দায়িত্ব বেশি। শনিবার ঢাকা কটন মিল প্রাঙ্গণে জাতীয় শ্রমিক লীগের দু’দিন ব্যাপী দ্বি-বার্ষিক মহাসম্মেলনে তাদের দ্যর্থহীন সমর্থন জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, সমাজতান্ত্রীক অর্থনীতির জন্য চরম কষ্ট স্বীকার করতে হয়। স্বাধীনতার পর সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ ৫ বছর এক টানা কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তারা স্বেচ্ছায় উৎপাদন বৃদ্ধির কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউরোপের পুনর্গঠনেও সেখানকার শ্রমিকরা দ্বিগুণ পরিশ্রম করে দেশকে গড়ে তুলেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৪০ মিনিট ধরে বক্তৃতা করেন। সম্মেলনের প্রতিনিধিগণ বার বার গগণ বিদারী স্লোগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের দ্যর্থহীন সমর্থন জানান। বিদেশি শক্তির দালালদের সম্পর্কে শ্রমিকদের সতর্ক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, বিদেশের অর্থপুষ্ট দালালরা দেশের সমাজতন্ত্র কায়েমের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। তারা আমাদের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র করছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। কিন্তু আমাদের জনগণ ঐক্যবদ্ধ আছে। শত্রুদের ষড়যন্ত্র সফল হবে না। আইয়ুব, মোনেম, ইয়াহিয়া ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলীদের বড় বড় ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে গেছে। তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, অতীতে যখনই তিনি আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন তখনই বাংলাদেশের শ্রমিকরা সাড়া দিয়েছে। প্রয়োজন হলে ভবিষ্যতেও তিনি তাদেরকে ডাক দিবেন এবং শ্রমিকরা তার পাশে এসে দাঁড়াবেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, আমি বাংলার মাটিকে চিনি বাংলার মানুষকে জানি। তাদেরকে আমি ভালোবাসি। তাদের জন্যই আমি প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ গ্রহণ করেছি। কিন্তু আমি যখন বুঝবো আমার প্রতি তাদের ভালোবাসা আর নেই। প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ ছেড়ে আমি আবার জনতার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে দ্বিধা করবো না। স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ৩০ লক্ষ মানুষের জীবনের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি না হলে সে স্বাধীনতা হবে অর্থহীন। তিনি বলেন, স্বাধীনতা একদিনে আসে নাই। স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল অনেক আগে, ধাপে ধাপে এই সংগ্রাম এগিয়ে এসেছে। স্বাধীনতার জন্যে জনগণকে প্রস্তুত করে নিতে হবে। সময়োপযোগী স্লোগান তুলে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হয়। তা না হলে জনগণ বিভ্রান্ত হয় এবং তারা পিছনে পড়ে থাকে। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, সাবেক পাকিস্তানি শাসকরা বাংলাদেশকে তাদের কলোনী ও বাজারে পরিণত করেছিল। এ দেশে তারা এক শ্রেণির দালাল সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু অশেষ ত্যাগ স্বীকার করে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। তিনি বলেন, দেশে সমস্যা আজ অনন্ত। গ্রামে গ্রামে খাদ্য সমস্যা, আমাদের মা বোনেদের পরনে আজ বস্ত্র নেই। লক্ষ লক্ষ লোকের জন্য আশ্রয়ের দরকার। বৃটিশরা ২শ বছর আমাদের শোষণ করেছে। পাকিস্তানি উপনিবেশবাদীরা বাংলার সম্পদ লুট করেছে ২৪ বছর ধরে। তারা দেশকে শ্মশান করে গেছে। পাকিস্তান সেনাদের অত্যাচারে এক কোটি লোক দেশ ত্যাগ করে। তারা কলকারখানা, পুল, রেল, যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে গেছে। ব্যাংক লুট করেছে। টাকা পুড়িয়ে দিয়েছে। তারা চেয়েছিল আমাদের অর্থনীতিকে চিরতরে পঙ্গু করে দিতে। কিন্তু তারা জানে না, যে জাতি রক্ত দিতে শিখেছে, তারা যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে জানে।
চারটি মূলনীতি : বঙ্গবন্ধু সরকারের চারটি মূলনীতি, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, আদর্শের ভিত্তিতেই গড়ে উঠে জাতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে। আদর্শবিহীন জাতি সারেং বিহীন জাহাজের মতো। বঙ্গবন্ধু বলেন, আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই বাঙালি জাতি স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছে। আমার আদর্শ বাঙ্গলার মাটির আদর্শ। এই আদর্শ বাংলার নিজস্ব। অন্যদেশের কিছু ভালো হলে আমরা তা গ্রহণ করবো, খারাপ জিনিস বর্জন করবো। কিন্তু কিছুতেই আমরা জাতির আদর্শ বিসর্জন দেব না।
শোষণহীন সমাজ : সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, সমাজতন্ত্র হলো শোষণহীন সমাজ। আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করি কৃষক-শ্রমিক রাজ প্রতিষ্ঠায়, আমরা শোষণহীন সমাজ কায়েম করবো। তাই শুরুতেই আমরা সমাজতন্ত্র কায়েমের পদক্ষেপ নিয়েছি। বাংলাদেশে শোষকের কোনো স্থান হবে না। কারণ দেশে শোষণহীন সমাজ কায়েমের জন্যে ৩০ লক্ষ লোক প্রাণ দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কাজ শুরু করে দিয়েছি। কিন্তু দেশের কাজ চালানোর জন্য পর্যাপ্ত যোগ্য লোক আমাদের নেই। তবুও আমরা সমাজতন্ত্রের পদক্ষেপ নিয়েছি। কারণ জনগণের রায়ে সমাজতন্ত্র, সততা ও আন্তরিকতা থাকলে কোনো কাজই দুঃসাধ্য নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি ব্যাংক, বীমা ও শিল্প জাতীয়করণের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সমাজতন্ত্র রাতারাতি কায়েম করা যায় না। গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমাদের জনগণ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে এসেছে। কেউ কেউ নির্বাচন বয়কটের স্লোগান দিয়েছিল। কিন্তু আমরা নির্বাচন বর্জন করি নি। আমাদের জনগণ কি চায় বিশ্বকে তা দেখানোর জন্য আমরা নির্বাচন করছি। তিনি বলেন, হটকারিতা কোনো অবস্থাতেই ভালো নয়। জনগণকে এমন প্রোগ্রাম দিতে হবে যা তারা বুঝতে পারে এবং যাতে জনগণকে সঙ্গে নেয়া যায়। হটকারি স্লোগান দিয়ে অনেক নেতাই ধ্বংস হয়ে গেছেন। জনগণের সমর্থন তারা আদায় করতে পারেন নি। তিনি বলেন, গণতন্ত্র যারা মানেন না তারা জনগণকে ভয় করে। কিন্তু গণতন্ত্রের অর্থ স্বেচ্ছাচার বা সাম্রাজ্যবাদের দালালী নয়। গণতন্ত্রের নীতিমালা আছে। গণতন্ত্রের কথা বলবে কিন্তু গণতন্ত্রের নীতিমালা মানবেন না তা হয় না।
ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয় : ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। সবাই নিজ নিজ ধর্মকর্ম করবেন। কেউ তাতে বাধা দিতে পারবেন না। কিন্তু ধর্মের নামে শোষণ, লুট ও নির্যাতন করা চলবে না। ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করতে দেয় হবেনা। এছাড়া সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়িয়ে দিয়ে দেশকে ধ্বংস করতেও দেয়া হবেনা। বঙ্গবন্ধু বলেন, সমাজতন্ত্র কায়েম করতে হলে শ্রমিকদের দায়িত্ব বেশি। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দিকে না গিয়ে আমি যদি ধনতন্ত্রের পথ ধরতাম তবে অনেক অর্থ দেশে আসতো। তাতে ভবিষ্যত বংশধররা গোলাম হবে। আমি কিছুতেই তা হতে দেব না। তিনি বলেন, যারা সমাজতন্ত্র বিশ্বাস করে না তারাই গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তারা অতি বিপ্লবি ও হটকারি।
রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সম্পর্কে : রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, জাতীয়করণ করা শিল্পের মালিক দেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ। দেশের কৃষক-শ্রমিক সকলেই তার মালিক। শিল্পের শ্রমিকরা জনসংখ্যায় মাত্র শতকরা ২ জন। কাজেই সকলেই এই শিল্পের মুনাফার সুফল ভোগ করবেন। তবে শিল্পের শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি পূরণ করা হবে। সাড়ে ৭ কোটি লোকের সম্পত্তি নষ্ট হতে দেয়া হবেনা বলে তিনি মন্তব্য করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে বার্গেনিং এজেন্ট নেই। শ্রমিকরা মিল কারখানার পরিচালনা বোর্ডে থাকবেন। তারাই পরিচালনার প্রধান দায়িত্বে থাকছেন। কাজেই বার্গেনিং এজেন্টের দাবি অমূলক। মজুরী বৃদ্ধি প্রসঙ্গে : মজুরী বৃদ্ধির প্রসঙ্গে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শ্রমিকদের বেতন গড়ে ২৫ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ বছরে ৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে। কিন্তু সরকার কোনো ট্যাক্স ধার্য করেননি। এছাড়া ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরতরে মওকুফ করা হয়েছে। লবণ ট্যাক্স বিলোপ করা হয়েছে। সার্টিফিকেট প্রথা তুলে দেয়া হয়েছে। জনগণকে কষ্ট দিয়ে আমি সরকার চালাতে চাইনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পুলিশ দিয়ে আমি সরকার চালাতে চাই না। তবে চোর, গুন্ডা, বদমায়েশদের দমন করার জন্য পুলিশ থাকবে। তিনি চোরাকারবারি, মজুতদার, শোষক ও গরীবের ওপর জুলুমকারীদের বিরুদ্ধে দাড়ানোর জন্যে শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি ন্যায্য মূল্যের দোকান খোলা এবং এজেন্সি ও পরিবেশন প্রথা বাতিলের কথা উল্লেখ করেন। এছাড়া নিজ নিজ এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করে সুস্থ্য ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য শ্রমিকদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।৭১

রেফারেন্স: ২০ মে ১৯৭২, দৈনিক বাংলা
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!