ন্যাপের জাতীয় সম্মেলন শুরু
ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ দেশে মানুষের সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধের জন্য এই মুহূর্তে ন্যাপ, আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ পার্টির ৩ দিন ব্যাপী জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে পার্টির প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এ আহ্বান জানিয়ে বলেন, অন্যথায় সমাজতন্ত্র কায়েম তো দূরের কথা যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ এক চরম অনিশ্চয়তা ও হতাশার মাঝে নিক্ষিপ্ত হবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স) আয়োজিত ন্যাপ জাতীয় সম্মেলনে তিনি সভাপতির ভাষণ দিচ্ছিলেন। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে বক্তৃতা দেন আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সভাপতি মনি সিং, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জনাব সাঈফুদ্দিন আহমদ মানিক, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে মোহাম্মদ ইলিয়াস, ভারতের নিরক্ষরতা দূরীকরণ। সমিতির পক্ষ থেকে অধ্যাপক শ্যামল চক্রবর্তী ও ডাকসুর সহ-সভাপতি জনাব আ স ম আবদুর রব। এর আগে সকলকে স্বাগত জানিয়ে বক্তৃতা দেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হোসেন। অধিবেশনের পূর্বে সম্মেলন উদ্ধোধনী পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এতে জাতীয় ও পার্টির পতাকা উত্তোলন করেন যথাক্রমে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও সৈয়দ আলতাফ হোসেন। এছাড়া জেলা ন্যাপ শাখা ও যুক্তরাজ্য শাখা ন্যাপের পক্ষ থেকে মোট ২০টি পার্টি পতাকা উত্তোলিত হয়। তোপধ্বনি, স্লোগান ও শান্তির কপোত উড়িয়ে এবং জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে অনুষ্ঠান শেষ হয়। এরপর অধিবেশনে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ তার ভাষণে বলেন, ঘুষ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি আগের চেয়ে বেড়ে গেছে এবং জনগণ এর জবাব চায়। বাংলাদেশের মানুষ এই অরাজকতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার হাত থেকে মুক্তি চায়। তিনি বলেন, কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি মনে করে যে, সব সমস্যার সমাধান একমাত্র বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে নিহীত রয়েছে। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতন্ত্র কায়েমের জরুরি বিষয় হচ্ছে- স্বাধীনতাকে সংহত করা। চীন-মার্কিন চক্রান্ত আজ আবার স্বাধীনতাকে বিপন্ন করার ষড়যন্ত্র করছে। সে সম্পর্কে এই মুহূর্তে আমাদের হুঁশিয়ার হতে হবে ও এ ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অভিজ্ঞতার আলোকেই মনে রাখা প্রয়োজনএক বার স্থান দখল করে নিতে পারলে সহজে আমেরিকা এ দেশ ছেড়ে যাবে না। ২৯টি সাহায্য সংস্থার নামে সি আই এ গ্রামে গ্রামে গোপন তৎপরতা চালাচ্ছে। ন্যাপ প্রধান বলেন, মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বলে কার্যতঃ ভিন্ন পথ অনুসরণ করলে ন্যাপ তাতে সমর্থন দেবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের দূর্বলতা ঢাকবার জন্য ন্যাপ কোনো দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। সমাজতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সরকারের প্রগতিশীল পদক্ষেপগুলোকে আমরা সক্রিয়ভাবে সমর্থন করি। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ জাতীয় সমস্যা সমাধান ও সমাজতন্ত্রের সংগ্রামে আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশ ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে দলের সংহতি ঘোষণা করেন।
মওলানা ভাসানী প্রসঙ্গে : ন্যাপ প্রধান সম্মেলনে বলেন, মহান ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বিরোধী স্লোগান ও হিন্দু বিরোধী উস্কানীতে অতি ডান ও অতি বামপন্থীদের কণ্ঠস্বর এক। শ্রদ্ধার সঙ্গেই মওলানা ভাসানী সম্পর্কে বলতে হচ্ছে যে, অতি বাম ও দক্ষিণপন্থীরাই এখন তাকে ব্যবহার করছে। তারা মওলানা ভাসানীর আশ্রয় পাবার চেষ্টা করছেন। সম্ভবতঃ সে আশ্রয় পেয়েছেও। তিনি বলেন স্বাধীনতা বিরোধী দেশী শত্রু জামাতে ইসলাম, মুসলিম লীগ, রাজাকার, আল-বদর ইত্যাদি সমাজ থেকে নির্মূল হয়নি। এরা সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। এরা সাম্প্রদায়ীকতার বীজ ছড়ানোর চেষ্টা করছে। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেন, পার্টির এখন তিন লাখ সদস্য রয়েছে। দুর্নীতি, মজুতদারী, চোরাকারবারী, দুষ্কৃতকারী, অরাজকতার বিরুদ্ধে লাঠি ধরার জন্য আওয়ামী লীগের সাথে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু কাউকে যুক্তিহীন ও অনর্থক বিশ্বাস করতে চাইনা।
জিল্লুর রহমান : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান বলেন যে, মহান বন্ধু দেশ রাশিয়ার বিপ্লবের পর সেখানে যে জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলাদেশেও আজ সেই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কারণ কোনো নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। তিনি বলেন, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বিদেশের অর্থ গ্রহণ করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী দালাল হিসেবেই তারা এখন চিহ্নিত হচ্ছে। রাজনৈতিক উপায়ে এদেরকে মোকাবিলা করতে হবে। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি সংঘবদ্ধ থাকলে সকল প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে আমরা অবশ্যই নিশ্চিত সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারবো।
মনি সিং : বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সভাপতি কমরেড মনি সিং বলেন, মূলনীতি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সামন্তবাদী ভূমি ব্যবস্থাকে ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে। দেশের কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, ভূমি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও সমবায় ভিত্তিতে ফসল উৎপাদন বাঞ্চনীয়। এর জন্য চাই কৃষকের হাতে জমি।
সৈয়দ আলতাফ হোসেন : ন্যাপ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হোসেন সম্মেলনে আগত সকলকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলেন, ন্যাপ আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টি বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাসী। বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে এশিয়াসহ সারা দুনিয়ার শান্তি সংগ্রামের নতুন দিক উন্মোচিত হবে। সৈয়দ আলতাফ আরো বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে সত্য। কিন্তু সাবধান থাকা প্রয়োজন যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সাহায্য ভান্ডার নিয়ে সদ্য স্বাধীন যে দেশেই উপস্থিত হয়েছে, সেখানেই জাতীয় স্বাধীনতা বিপদগ্রস্থ হয়েছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে দেড় হাজার কাউন্সিলর ও সাড়ে আট হাজার ডেলিগেট যোগদান করেছেন।
মূল অধিবেশন : বেলা সাড়ে তিনটায় মোজাফফর আহমেদের সভাপতিত্বে ন্যাপ সম্মেলনের মূল অধিবেশন আরম্ভ হয়। অধিবেশনে সম্পাদকের রিপোর্ট পেশ করেন সৈয়দ আলতাফ হোসেন। রিপোর্টে পার্টির সংগ্রামী ভূমিকা, স্বাধীনতা পূর্বক সাবেক পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলন, গোল টেবিল, ইয়াহিয়ার প্রতিশ্রুতি, নির্বাচন বিরোধী ষড়যন্ত্র, আইনগত কাঠামো আদেশ, প্রথম সাধারণ নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু, পরামর্শ দাতা কমিটির ভূমিকা, স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল শিক্ষা ও স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের অবস্থার বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে।৬৮
রেফারেন্স: ১৯ মে ১৯৭২, দৈনিক বাংলা
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ