You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.05.14 | এবিসির সাথে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার | দৈনিক বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

এবিসির সাথে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঢাকার মাটিতেই অনুষ্ঠিত হবে। এতে সংশয়ের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তিনি বলেন, ৯ মাস ধরে বাংলাদেশে যে পাকিস্ত নি হানাদারবাহিনী ব্যাপক গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নারী ধর্ষণ চালিয়েছে এবং যারা ৩০ লাখ নিরীহ লোককে হত্যা করেছে, বিশ্বের কোনো দেশই তাদের বিচার না করে ছেড়ে দিতে পারে না। বাসস জানাচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমেরিকান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে উপোরক্ত মন্তব্য করেন। বঙ্গবন্ধু পুনরায় ঘোষণা করেন যে, দু’দেশের মধ্যে কোনো আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে অবশ্যই বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি দিতে হবে। তিনি বলেন, জনাব ভুট্টো যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তাহলে অবশ্য বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার সমস্যাবলী সম্পর্কে তার সাথে আলোচনা করতে আমার কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। বঙ্গবন্ধু বলেন, ভুট্টোর এখন বাস্ত বতাকে স্বীকার করে নেওয়া উচিত। বর্তমানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাবলী সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, অনেকগুলো সমস্যা আছে। তিনি বলেন, পাকিস্ত নিরা আমার চার লাখ নিরাপরাধ লোককে আটকে রেখেছে তাদের বন্দি শিবিরে আটক করেছে এবং তাদের পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। এ ছাড়াও আরও সমস্যা রয়েছে। পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের সাথে যুদ্ধবন্দিদের বিনিময়ের কোনো সম্ভবনা আছে কি না এই সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী পুনরুল্লেখ করেন যে, যুদ্ধবন্দিরা মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে। কাজেই পাকিস্তানে আটক পড়া বেসামরিক বাঙ্গলীদের সাথে তাদের সমান করা চলে না। তিনি বলেন, এখানেও তাদের (পাকিস্তান) লোকজন আছে বাংলাদেশে কেবল অবাঙালি এবং বিহারীরাই নেই। পশ্চিম পাকিস্তানের বাসিন্দারাও রয়েছে। পাকিস্তান যদি তাদের নিয়ে যেতে চায় তবে তাদের স্বাগত জানানো হবে। এতে তার কোনো আপত্তি নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিস্তারিত তথ্য জানতে চাওয়া হলে বঙ্গবন্ধু বলেন, যারা সত্যিকারভাবে অপরাধ করেছে তাদের বিচার হবে। আমি ৯৩ হাজার পাকিস্তান সৈন্যের বিচার করব না। আমি নিরাপরাধ সৈন্যের বিচার কেন করব? যেসব ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নিরাপরাধ ব্যক্তিদের হত্যা, সবকিছু তছনছ ও আমাদের মেয়েদের ইজ্জত নষ্ট করেছে, তাদেরই শধু বিচার করা হবে। আমি ২ লাখ মেয়েকে উদ্ধার করেছি যাদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকেরা ধর্ষণ করেছে। এ ধরনের জঘন্য অপরাধে অপরাধীদের বিনাবিচারে ছাড়া হবে না। কি সংখ্যক যুদ্ধাপরাধী হতে পারে সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এখন তদন্ত চলছে। এর সংখ্যা হয়তো ১৪ শত, হয়ত বা ১ হাজার, এমনকি ২’শও হতে পারে। সবই নির্ভর করছে তদন্তের ওপর। ভুট্টো এবং আপনার মধ্যে কোনো বোঝাপড়া হওয়া সম্ভব কি না, কেননা ভুট্টো নিজেই বলেছেন যে, কিছু যুদ্ধাপরাধী বিচার হওয়া উচিত, বিদেশি সাংবাদিক এ প্রশ্ন করলে বঙ্গবন্ধু বলেন তা কিভাবে সম্ভব? বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার মতো সৌজন্যটুকুও দ্রলোকের নেই। তিনি নিজেকে কি ভাবেন? বিশ্বের প্রায় সব বৃহৎ দেশগুলিই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিষয়ে শেখ মুজিবের সাথে আলাপ করতে চাই বলে ভুট্টো যে খেলা খেলতে চাইছেন সে প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি বুঝতে পারিনা ভুট্টো বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নটি বলতে কি বোঝাতে চাইছেন। পাকিস্তানকে আমি স্বীকার করি কিনা সেটাই হলো প্রশ্ন। কেননা ভুট্টো আর পাকিস্তান নামের দাবি করতে পারেন না।
খাদ্যদাঙ্গার খবর ভিত্তিহীন : প্রশ্নকারী বাংলাদেশের কোনো কোনো এলাকায় খাদ্যের জন্য দাঙ্গা হয়েছে ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে বঙ্গবন্ধু বলেন, আপনারা রাত ১২ টা বা ২ টার সময়ে যেখানে খুশি হেঁটে বেড়ান, দেখবেন কোনো বিপদ আপদ নেই। তিনি বলেন, নিউইয়র্কের চেয়ে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো।
দালালদের বিচার : প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, দালালদের মামলাগুলো একটি তদন্ত কমিশন পরীক্ষা করে দেখবেন। সত্যি কথা বলতে, আমরা তদন্ত করছি এবং নির্দোষীদের মুক্তি দিচ্ছি। তিনি অবশ্য উল্লেখ করেন, বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদেরই শুধুমাত্র বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। শুধুমাত্র ঢাকাতেই ১০ হাজার বন্দিসহ বাংলাদেশের প্রায় ৫০ হাজার দালাল বন্দি রয়েছে বলে বিদেশি সাংবাদিক উল্লেখ করলে বঙ্গবন্ধু তার সত্যতা অস্বীকার করে বলেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সব মিলিয়ে ৭ হাজার বন্দি রয়েছে। দেশের বেকার সমস্যার সমাধানের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমার আড়াই কোটি বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। এক কোটি লোক গৃহহারা হয়ে ভারতে চলে গিয়েছিল, তারাও ফিরে এসেছে। আমাকে তাদের বাসস্থান ও খাদ্য সরবরাহ করতে হচ্ছে। স্বভাবতঃই তাদের জন্য সব কিছু করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু অত্যন্ত খুশির কথা এই যে গ্রাম পর্যায়ে সাহায্য সংস্থা গঠন করা হয়েছে। তারা দরিদ্র জনগণকে সাহায্য বিতরণ করছেন। আমার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে, রেলযোগাযোগ নষ্ট করা হয়েছে এবং ট্রাক ও বাস উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবু আমার জনগণ কাজ করে চলেছে। অবশ্য সমস্যা রয়েছে ও থাকবে। আমার জনগণ অত্যন্ত বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন ও অত্যন্ত ভালো। অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, সবাই অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ করেছে। অবশ্য অল্পসংখ্যক লোক রয়েছে যারা অস্ত্রশস্ত্র জমা না দিয়ে কোথাও কোথাও চুরি ডাকাতি করছে। এর সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশে বিহারীদের ভাগ্য সম্বন্ধে জানতে চাওয়া হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, বিহারীদের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। সবাই, এমন কি জাতিসংঘের প্রতিনিধিরাও তাদের অবস্থা দেখেছেন। তিনি বলেন, সৈয়দপুর এলাকায় গেলেই দেখা যাবে সেখানে অবাঙালিরা মিল ফ্যাক্টেরিতে কাজ করছে। মিরপুর ও মোহাম্মদপুরেও তারা শান্তিতে বসবাস করছে। তিনি বলেন, কেও কেও ইচ্ছাকৃতভাবে বিহারীদের বিষয়টিকে জোরালো করে তুলছেন, কিন্তু ৪ লাখ বাঙালি সম্বন্ধে কিছুই বলছেন না।৫১

রেফারেন্স: ১৪ মে ১৯৭২, দৈনিক বাংলা
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ