You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.05.06 | এদেশে সাম্রাজ্যবাদী দাবা খেলা চলবে না- বঙ্গবন্ধু | দৈনিক বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

এদেশে সাম্রাজ্যবাদী দাবা খেলা চলবে না- বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন যে, বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদীর শক্তি দ্বন্দের দাবার গুটিতে পরিণত হতে দেয়া হবে না। এক শ্রেণির লোকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, এরা বিদেশি শক্তির টাকায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারত ও রাশিয়ার সাথে আমাদের সম্পর্কে ভাঙ্গন ধরাবার এবং দেশে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। এদের সম্পর্কে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, একাত্তরের মার্চে তিনি যেমন স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন তেমনি আবার চক্রান্তকারীদের উৎখাতের জন্যেও আন্দোলন শুরুর ডাক দিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের আজীবন সদস্য হিসেবে বরণ করা হয়। এ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা চলাকালে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। দীর্ঘ নয় মাস ধরে ভারত তাদের খাবার দিয়েছে, সর্বাত্মক সহায়তা করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদে তিন তিন বার ভেটো দিয়েছে। তারা এই ভেটো না দিলে বাংলাদেশের মানুষের দুর্দশা আজও শেষ হতো না। বঙ্গবন্ধু দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এইসব দেশের বন্ধুত্বকে সন্দেহের চোখে দেখা কারো কারো ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, কিছু সংখ্যক সরকারি কর্মচারীও এসব লোকের পেছনে রয়েছে। যেসব বিদেশি শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে এখানে এখন ‘কৃষক শ্রমিক রাজ’ কায়েমের স্লোগান বন্ধ করা হয়েছে সেইসব বিদেশি শক্তির স্বরূপ উদঘাটন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করে দেবার জন্যে এরা বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল। তিনি বলেন, সোয়াত জাহাজে চট্টগ্রামে যে বিপুল পরিমাণ মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র এসে পৌছেছিল সে সবই ছিল। চীনের দেওয়া। বঙ্গবন্ধু বলেন, এই জাহাজটিকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম শহর বিপদাপন্ন হয়ে পড়তো বলে এই পরিকল্পনা কার্যকরী করা হয়নি। তিনি বলেন, স্বাধীনতার সংগ্রামে যারা সাহায্য সহযোগিতা করেছিল বাংলাদেশ সবসময় তাদের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে। কিন্তু তাদের কিছুতেই বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে না যারা এই মুক্তি সংগ্রামের বিরোধীতা করেছিল। তবে তারা যদি কোনোদিন নিজেদের ভুল বুঝতে পারে তবে আমরা অবশ্যই তাদের প্রতি বন্ধুত্তের হাত বাড়িয়ে দেব। যে সব দেশের জনসাধারণ আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল বঙ্গবন্ধু তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, ভারত বিরোধী প্রচারণার সাথে সাথে বাংলাদেশে নতুন পতাকা ওড়াবারও হুমকি দেয়া হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি প্রদান করে তিনি বলেন, এর ফলে জনসাধারণের মনে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি করা হবে। তিনি বলেন, এদেশের মানুষ এতো ত্যাগ ও ক্ষতি স্বীকার করেছে বাংলাদেশের পতাকার জন্যই। এর কোনো পরিবর্তন তারা চায় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, এই সব ব্যক্তি একদিকে ধর্মান্ধতা ছড়াচ্ছে সাথে সাথে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথাও বলছে। একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে তারা দুই বিপরীতধর্মী আদর্শ প্রচার করছে। দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চরম দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও রাজাকাররা চরম বামপন্থীদের সাথে হাত মিলিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, শুধু বক্তৃতা বিবৃতি বা সংবাদপত্রে দায়িত্ব জ্ঞানহীন নিবন্ধন লিখে সমাজতন্ত্র কায়েম করা যায় না। এগুলোতে আসলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এদেশের সমাজতন্ত্র কায়েম হবেই। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সরকার এরই মধ্যে মিল, কল-কারখানা, বীমা ও ব্যাংক জাতীয়করণ করেছে। এদেশে কোনোভাবেই আর পুঁজিবাদী মনোভাব গড়ে উঠতে দেয়া হবে না বলে তিনি ঘোষণা করেন। ছাত্র সমাজের প্রতি : বঙ্গবন্ধু ছাত্রসমাজের প্রতি পড়াশোনায় মনোনিবেশের আহ্বান জানান। দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এবার আপনারা পড়াশোনা করুন। স্লোগান আর নয়। শৃঙ্খলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, শৃঙ্খলা ছাড়া যোগ্য নেতৃত্ব কখনও গড়ে ওঠে না। তিনি বলেন, সমাজের সকল ক্ষেত্রেই যোগ্য ব্যক্তিত্বের এখন খুবই প্রয়োজন। গ্রামে মা-বাবার কাছে গিয়ে ছুটি কাটাবার আহ্বান জানিয়ে তিনি ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন, তাদের উচিত মানুষের দুঃখ দুর্দশা নিজের চোখে দেখা এবং তা দূর করার উদ্যোগ নেয়া। শিক্ষা কমিশন : কয়েক দিনের মধ্যেই প্রস্তাবিত শিক্ষা কমিশন ঘোষিত হবে বলে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন। চারটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, এগুলো স্লোগান মাত্র নয়, এগুলোতে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী। তিনি বলেন, সমাজতন্ত্র রাতারাতি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এর জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি ও পস্থা রয়েছে। শোষণের মাধ্যমগুলো যথা- ব্যাংক, বীমা, বৃহৎ শিল্প প্রভৃতিকে এরই মধ্যে জনগণের কর্তৃত্বে আনা হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নকে শ্রেষ্ঠ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে তিনি উল্লেখ করে বলেন, বিপ্লবের ফলকে টিকিয়ে রাখার জন্যে সেখানে বিপ্লবের পর পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়েছে। বিপ্লব সাধিত হয়েছে এমন সব দেশে এ ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তিন মাসের মধ্যেই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন রাত দশটার পরেও শহরের রাস্তায় আপনারা অনায়াশে চলাফেরা করতে পারবেন। গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, গণতন্ত্র মানে বিশৃঙ্খলা বা ভিন্ন পতাকা উড়াবার স্বাধীনতা নয়। গণতন্ত্র মানে আইনের শাসন। তিনি বলেন, জনগণের ওপর যাদের আস্থা নেই তারা শুধু জনগণের বিরুদ্ধে কথা বলে থাকে। বঙ্গবন্ধু বলেন, জাতীয়তাবাদ একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গে তিনি ধর্মের নামে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের বর্বরতার কথা উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় স্বাধীনতার সংগ্রামে শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য ও ডাকসুর সভাপতি ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে এর আগে ডাকসুর সহসভাপতি জনাব আ স ম আব্দুর রব, সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুল কুদ্দুস মাখন বক্তৃতা করেন। জনাব রব বঙ্গবন্ধুকে স্বাগতম জানিয়ে একটি মানপত্র পাঠ করেন। জনাব রব তার বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, দেশ গঠনের কাজে ছাত্র সমাজ সব সময় তার পাশে থাকবে। তিনি বলেন, ছাত্র সমাজ বঙ্গবন্ধুকে শুধু বাংলাদেশেই নয় সারা বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের নেতা বলে তিনি মনে করেন। ডঃ মুজাফফর আহমদ চৌধুরী তার সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, জাতির পিতাকে ডাকসুর আজীবন সদস্য পদ দান করতে পেরে বিশ্ববিদ্যালয় আজ গর্বিত। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সমস্যার কথাও উল্লেখ করেন। সবশেষে এক মনোজ্ঞ সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

রেফারেন্স: ৬ মে ১৯৭২, দৈনিক বাংলা
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ