You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.28 | দিগ্বিদিকে উঠেছে আওয়াজ রক্তে আনাে লাল - সংগ্রামের নোটবুক

দিগ্বিদিকে উঠেছে আওয়াজ রক্তে আনাে লাল

রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে ছিড়ে আনাে ফুটন্ত সকাল ময়মনসিংহ কিশােরগঞ্জের ৭টি থানা মুক্তিযােদ্ধারা দখল করে নিতে সমর্থ হয়েছেন এ ছাড়া বীর মুক্তিযােদ্ধারা আরাে ৬টি পুলিস ঘাটি অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। তাজাস এলাকায় মুক্তি বাহিনীর প্রবল আক্রমণে এক প্লাটুন পাকসেনা খতম হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ২ জন অফিসার আছে। মুক্তিবাহিনী এখানে একটি ভারী মেশিনগান ১টি ১৬ মিলিমিটার ও কয়েকটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল দখল করে নিয়েছেন। অফিসারসহ ২৫ জন বন্দী। শ্রীহট : ২৬ নভেম্বর। হাকিমগঞ্জে মুক্তিবাহিনী দুই কোম্পানী পাকসেনাকে অপসারিত করে দিয়েছেন। একজন ক্যাপ্টেন, একজন জি-সি-ও সহ ২৫ জন পাক হানাদারকে মুক্তিফৌজ আটক করেছে। উত্তর শ্রীহট্টের জয়ন্তীয়াপুরে এক তীব্র লড়াইয়ে ৩০ জন দখলদারী হানাদার নিহত হয়েছে। কয়েকটি সামরিক ট্রাক ভর্তি করে পাকবাহিনী হতাহত হানাদারদের নিয়ে যায়। এখন ডিগ্রাউ পূর্ণ শত্রুকবল মুক্ত। পচাগড়ের পতন ঠাকুরগাঁও মুক্তির পথে। দিনাজপুর : ২৬ নভেম্বর। সফলতার পর সফলতা অর্জন করে মুক্তিসেনারা পূর্ব দিনাজপুর জেলার মহকুমা শহর পচাগড়ের পাক দুষমনদের শক্ত ঘাঁটি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দখল করে নিয়েছে। হানাদাররা মার। খেয়ে ঠাকুর গাঁওর দিকে পালাতে শুরু করেছে। মুক্তিফৌজ ওদের পিছু ধাওয়া করে এগিয়ে চলছে। ঠাকুরগাঁও সড়কে ময়দান দিঘিতে পাক হানাদাররা ঘাটি স্থাপন করেছে। মুক্তিফৌজ চতুর্দিক দিয়ে প্রবলভাবে আক্রমণ করে আজ ভােরে পচাগড় মুক্ত করে নিয়েছেন। পাকসৈন্যের কাছ থেকে মুক্তি বাহিনী। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নিয়েছেন। সরকারী ও বেসরকারী ভবনে এখন স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে। রংপুর জেলায় মুক্তিবাহিনীর দুর্নিবার গতির সামনে পাক হানাদাররা বে-সামাল হয়ে পড়েছে। হানাদারদের ঘাটি পারুলিয়া ধ্বংস করে মুক্তিফৌজ হাতী বাধা থানাটি সম্পূর্ণভাবে দখল করে নিয়েছেন। পাকবাহিনীর সিনমােরা ঘাঁটিটিও মুক্তিফৌজ ধ্বংস করে দিয়েছে। রংপুরের রৌমারি পাটরাম, নাগেশ্বরী, ভুরঙ্গমােরী ও আরাে অনেক মুক্ত এলাকায় স্বাধীন বাংলার পতাকা পতপত করে উড়ছে। পাবনা ঈশ্বরদির টেলিফোন এক্সচেঞ্জ মুক্তিযােদ্ধারা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছেন। থানা আক্রমণ করে অনেক অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধারা দখল করে নিয়েছেন। রেল লাইনের ক্ষতিগ্রস্ত করায় ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। যশোর শহরের পতন আসন্ন। 

যশাের : মুজিবনগর, ২৬ নভেম্বর-খুলনা, কুষ্টিয়া, রংপুর প্রভৃতি রণাঙ্গনে পাকবাহিনী যেরূপ মুক্তিফৌজের হাতে নাজেহাল হয়ে পড়েছে ঠিক একই ভাবে যশােরের উপকণ্ঠেও তারা বেসামাল। চারদিন ধরে প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর মুক্তিফৌজ পটাশ নদীর তীরবর্তী চৌগাছা দখল করে নিয়েছে। যশাের ক্যান্টনমেন্টমুখি মুক্তিবাহিনীর দুর্বার গতি ক্রমান্বয় সাফল্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। আজকের জােরে বীর মুক্তিযােদ্ধারা যশাের ক্যান্টনমেন্টের অদূরবর্তী সিংহজুলি দখল করে নিয়েছেন। মুক্তিবাহিনীর বিশেষ বুলেটিনের এক খবরে প্রকাশ, যশাের শহরের উপকণ্ঠে মারমুখী লড়াই চলেছে। প্রতিটি আক্রমণে মুক্তিফৌজের বীর সেনানীরা সফলতা অর্জন করে চলেছে। মুক্তিফৌজ যশােরের বাঘচরা দখল করে নিয়েছেন এবং নাভারণ ও সাতক্ষীরার মধ্যকার সড়ক যােগাযােগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিতে সমর্থ হয়েছেন। শহরের দক্ষিণ দিকের মামুদপুর এখন মুক্তিফৌজের দখলে। যশাের ক্যান্টনমেন্টের চতুর্দিক এখন মুক্তিফৌজের দ্বারা অবরুদ্ধ। ভীত সন্ত্রস্ত পাক হানাদারদের আর্তনাদ সর্বনিয়ত শােনা যাচ্ছে। যে ভাবে মুক্তিবাহিনী এগিয়ে চলছে তাতে যশাের ক্যান্টনমেন্টের পতন আর বেশি দূরে নয়। স্বাধীন বাংলার পতাকা অতি শীঘ্রই সেখানে উড়বে। বহু চীনা কামান মুক্তিফৌজের দখলে নােয়াখালী : নােয়াখালি জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবল সংঘর্ষের পর মুক্তিবাহিনী কতকগুলাে এলাকা। দখল করে নিতে সমর্থ হয়েছেন। বকশিরহাট অঞ্চলে এক মারমুখি সংঘর্ষে ১৫০ জন পাক হানাদার হতাহত হয়েছে। | ২৭ নভেম্বর-মুক্তিবাহিনীর অপরাজেয় সেনানীরা শ্রীহট্ট অঞ্চলের রহিমপুরের ৬০০ বর্গমাইল জায়গা পুরােপুরি মুক্ত করেছেন। পাক হানাদারবাহিনীর ২ জন পদস্থ অফিসার সহ ২৩ জন সেনা এবং প্রায় ২০০ রাজাকার বন্দী হয়েছে। মুক্তিবাহিনী এখান থেকে ২৬০টি চীনা রাইফেল ও ৯২টি রকেট নিক্ষেপ করে অস্ত্র দখল করে নিয়েছে। ফেনি শহর দখলের জন্য মুক্তিবাহিনী তিন দিক দিয়ে প্রবলভাবে আক্রমণ চালাচ্ছে। স্থল যুদ্ধে। মুক্তিবাহিনীর সামনে দাড়াতে না পেরে পাক আক্রমণকারীরা বিমান থেকে বােমাবর্ষণ করছে। ফেনির বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযােদ্ধারা অনেকগুলাে চীনা কামান ও ভারী ম্যাশিনগান দখল করে নিয়েছেন। এ অঞ্চল থেকে বিমান ভর্তি পাকসেনাদের মৃতদেহ সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

কুষ্টিয়া জেলার সর্বত্র প্রবল আক্রমণ কুষ্টিয়া : মুক্তিযােদ্ধারা কুষ্টিয়া জেলার সব পাক দখলিকৃত এলাকায় প্রবলভাবে আক্রমণ পরিচালনা করেছেন। মেহেরপুর শহর কার্যত মুক্তিবাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ। নতুন তেতুলিয়ায় এক মারমুখী সংঘর্ষে বারােজন পাকসেনা খতম এবং দুটি সামরিক ট্রাক হানাদার সহ ধ্বংস হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্ত অপর এক খবরে জানা যায়, জীবননীয় থানার অন্তর্গত পকা নামক স্থানে পাকবাহিনীর এক প্লাটুন সৈন্য মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে আছে। সব রকমের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন এবং অবরুদ্ধ এই হানাদার বাহিনী মুক্তিফৌজের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়েছে। পুষ্পঘাটি দখল করার জন্য মুক্তিফৌজ প্রবল ভাবে গােলা বর্ষণ করে চলছেন। রাজশাহী নবাবগঞ্জ থেকে তিন মাইল দূরে ইসলামপুর ও চাটইডুবিতে অবস্থিত পাকফৌজের শক্ত ঘাঁটির উপর মুক্তিবাহিনীর বীর সেনানীরা মর্টার ও মেশিনগান নিয়ে প্রবলভাবে আক্রমণ পরিচালনা করেন। নবাবগঞ্জের উপকণ্ঠে এই ঘাটিটির পতন হলে রাজশাহী নবাবগঞ্জ সড়ক যােগাযােগ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন 

হয়ে যাবে। এই অঞ্চলে আক্রমণের প্রথম পর্যায়ে হানাদার বাহিনী রাজাকার দালালদের প্রথম এগিয়ে দেয় কিন্তু মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে প্রায় সবগুলি দালাল খতম হয়। তারপর শুরু হয় পাকআক্রমণকারীদের সাথে মুখােমুখী সংগ্রাম। হানাদারবাহিনী এই সংঘর্ষে ভারী মেশিনগান’ ‘৮১ এম এম মর্টারের গােলা এবং ২৫ পাউন্ড ওজনের কামানের গোেলা ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মতেই মুক্তিবাহিনীর সাথে লড়াইয়ে দাড়াতে পারছে না। এখন পর্যন্ত ১২৫ জন পাকসেনা ও ২৫০ জন। রাজাকার মুক্তিবাহিনীর হাতে খতম এবং ১৫টি বাংকার সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। মুক্তিফৌজের নায়েককাসেম, মােহর আলী এই যুদ্ধে অভূতপূর্ব পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন, মুক্তিবাহিনী এখানে ১৪ জন। রাজাকার ও দুজন পাকসেনাকে আটক করেছেন এবং ২০টি রাইফেল ও অনেক গােলাগুলি দখল করেছেন। রাজশাহীর ১০০০ বর্গ মাইল এখন মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ দখলে এবং সেখানে স্বাধীন বাংলার প্রশাসন ব্যবস্থা চলছে। মারমুখী লড়াই এখনাে চলছে। নবাবগঞ্জ শহরটি তিন দিক দিয়ে অবরুদ্ধ। পতন প্রায় আসন্ন।

অস্ত্রভর্তি তিনটি লঞ্চ ক্ষতিগ্রস্ত বরিশাল : বরিশালের বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ এখন বিশেষ ভাবে তৎপর। আমাদের পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধির এক খবরে প্রকাশ দাড়িয়াল, চরামুদ্দি, চরাদি ইউনিয়নে বিভিন্ন সময়ে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ৫ জন পাকসেনা, ৩ জন পাকগুপ্তচর, ১২ জন রাজাকার এবং ১১ জন কুখ্যাত ডাকাত খতম হয়েছে। অপর এক আক্রমণে দুর্জয় মুক্তিবাহিনী বরিশাল থেকে পটুয়াখালিগামী অস্ত্র-শস্ত্র ভর্তি সহ। পাকসেনা ও রাজাকার ভর্তি তিনখানা লঞ্চ ঝটিকা আক্রমণে বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেন। বহু সংখ্যক পাকসেনা ও রাজাকার এখানে খতম হয়েছে। হিলিতে প্রচণ্ড যুদ্ধ পাক ট্যাংক ধ্বংস হিলি রক্ষার মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েও পাকবাহিনীকে আরও ট্যাঙ্ক হারাতে হয়েছে বলে আজ এক বিশ্বস্ত সূত্রের খবরে জানা গেছে। হিলি পাকসেনাদের গুরুত্বপূর্ণ ঘাটি। হিলির পতন হলে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট | থেকে উত্তর বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে তাই পাকসেনারা এখানে মরিয়া হয়ে উঠেছে। মুক্তিসেনারা হিলিকে তিন দিক থেকে আক্রমণ করেছে। এতে বেসামাল পাকসেনারা ভারতের | বালুরঘাটের দিকে অগ্রসর হলে ভারতীয় বীর সেনারা পাল্টা আক্রমণ করে। কয়েকখানা ট্যাঙ্ক এবং ৮০ জন পাকসেনা খতম হয়েছে। | জানা গেছে হিলিতে ৮ হাজার সৈন্য ট্যাঙ্ক ও দূর পাল্লার ভারী কামান নিয়েও মুক্তিবাহিনীর অগ্রসরকে প্রতিহত করতে পারছে না।

বিপ্লবী বাংলাদেশ । ১: ১৫

২৮ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯