You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.28 | রংপুরে মুক্তিসেনাদের সাফল্য - সংগ্রামের নোটবুক

রংপুরে মুক্তিসেনাদের সাফল্য

[নিজস্ব প্রতিনিধি। সম্প্রতি রংপুর রণাঙ্গনের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনীর বীর যােদ্ধারা শত্রু সৈন্যের উপর হামলা চালাইয়া বিশেষ সাফল্য অর্জন করে। ২৭শে অক্টোবর লালমণিরহাটের নিকটস্থ রইসবার্গ স্টেশনের পূর্বদিকে মাইন বিস্ফোরণ ঘটাইয়া রেললাইন উড়াইয়া দেওয়া হয়। সংবাদ পাইয়া লালমণিরহাট হইতে ট্রেন বােঝাই পাক সৈন্য রইসৰাগ স্টেশন সংলগ্ন পাকা বাঙ্কারে আসিয়া উপস্থিত হয়। তাহাদের ১৭/১৮ জনের একটি দল রইসবাগ ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসের নিকট বাঙ্কারে ঢুকিয়া গােলাগুলি বর্ষণ করিতে থাকিলে মুক্তি বাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালায়। সংঘর্ষে দুই জন রাজাকার নিহত হয়। পাক দস্যুরা পশ্চাদপসরণ কালে নামুড়ী গ্রামটি জ্বালাইয়া দেয়। ২১শে অক্টোবর মুক্তিফৌজের পুঁতিয়া রাখা মাইন বিস্ফোরণে রইসবাগ স্টেশনের নিকট ৭ জন। রাজাকার ও ১ জন পাক-সৈন্য খতম হয়। পাক-সৈন্যদের একটি দল মুক্তি বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালাইলে মুক্তিবাহিনী বীরত্বের সহিত মােকাবিলা করে। মুক্তি বাহিনীর একজন অসম সাহসী যােদ্ধা একাই একটি স্টেনগান সহ পাকবাহিনীর একটি দলের পিছু ধাওয়া করিতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত এই বীরযােদ্ধার স্টেনগানের গুলি শেষ হইয়া যাওয়ায় পাকদস্যুরা তাঁহাকে ধরিয়া ফেলিয়া বেয়নেটের দ্বারা নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাঁহার মরদেহ মুক্তিবাহিনীর সংগ্রামী সালীরা সংগ্রহ করিয়া আনিয়া যথাযােগ্য মর্যাদার সহিত সমাহিত করে। ৪ঠা নভেম্বর দুইজন রাজাকার ও দুই জন পাকসেনা আদিতমারী স্টেশনের নিকট নামুরীর বিলে  পাখী শিকার করিতে নামে। মুক্তি বাহিনীর গেরিলারা ধান ক্ষেতের আড়াল হইতে গুলি বর্ষণ করিয়া তাদেরই শিকার করে।

অপূর্ব আত্মত্যাগ ৩রা নভেম্বর কালিগঞ্জ থানার মহিষখােচা গ্রামে মুক্তি বাহিনীর ৪ জনের একটি দলকে মুসলিম লীগের কুখ্যাত দালাল চেয়ারম্যান গােপন অবস্থায় ধরাইয়া দেয়। সৌভাগ্যক্রমে তাঁহাদের অস্ত্রাদি নিকটবর্তী স্থানে লুক্কায়িত ছিল। পাক বাহিনী তাঁহাদের গ্রেপ্তার করিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করা কালে মুক্তি বাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন অপূর্ব বুদ্ধিমত্তার প্রয়ােগ নিজেকে মুক্তিফৌজ বলিয়া পরিচয় দেন ও তাঁহার সঙ্গীদের গ্রামবাসী। ও তাহাদের ভয় দেখাইয়া পথ দেখাইতে আনিয়াছেন বলেন। তাহার সঙ্গীরাও গ্রামবাসীর ভান করিয়া মুক্ত হন। পাক বাহিনী খােরশেদ আলমকে গ্রেপ্তার করিয়া রওনা হয়। অকস্মাৎ কৌশলে মুক্ত অপর তিন জন মুক্তিফৌজ লুক্কায়িত স্থান হইতে অস্ত্র সংগ্রহ করিয়া পাক বাহিনীকে আক্রমণ করে। দুই জন। পাক সেনা ও ৪ জন রাজাকার খতম হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে খােরশেদ আলম ও শাহাদৎ বরণ করেন। | রংপুর শহরে পাঞ্জাবী পুলিশ বাহিনী দোকানদারদের নিকট হইতে জবরদস্তিমূলকভাবে জিনিসপত্র ছিনাইয়া লইতেছে। শহরে নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যের আমদানী নাই বলিলেই চলে। ফলে ডিম প্রতি হালি পাঁচসিকা হইতে দেড় টাকা, গােশত প্রতি সের ৮ টাকা, দুধ প্রতিসের তিন টাকা হিসাবে বিক্রয় হইতেছে। উহারা গেরিলাদের খুঁজিয়া বাহির করিবার অজুহাতে প্রতিটি গৃহেই ব্যাপক তল্লাসীর নামে। নাগরিকদের হয়রানি করিতেছে। দস্যুদের সন্দেহ হওয়া মাত্রই যে-কোন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করিয়া লইয়া গিয়া নিয়া গুম করিয়া ফেলিতেছে।  নাগেশ্বরী থানা এলাকার অধিকৃত অঞ্চলের ক্ষেতের ধানে বিষাক্ত ঔষধ ছড়াইয়া বর্বররা ফসল নষ্ট করিয়া দিতেছে।

জনতার প্রতিরােধ হাতিবান্ধা থানার মুক্তাঞ্চল হইতে আমাদের প্রতিনিধি জানাইতেছেন, গ্রাম-বাঙলার শােষিত মানুষ শক্রর হামলার বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরােধ গড়িয়া তুলিতেছেন। হাতিবান্ধা থানার নওদাবাশ ইউনিয়নের কেতকীবাড়ি, পূর্ব নওদাবাশ, ধলাই, পূর্ব বেঙ্গগ্রাম মৌজাগুলিতে তিনটি ভ্যান ভর্তি পাক হানাদার ও রাজাকার বাহিনীর তিন শত দস্যু ৩০শে অক্টোবর হানা দেয় ও লুঠতরাজ, অগ্নিকান্ড ও নারী নির্যাতন শুরু করে। দস্যুদল প্রতিটি বাসগৃহই তছনছ করিতে থাকে ও বেপরােয়াভাবে গােলাগুলি বর্ষণ করিতে থাকে। এই সময় মুক্তিবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র দল তাহাদের বাধা দিতে থাকিলে পাক বাহিনী ভারী অস্ত্রের সাহায্যে মুক্তিবাহিনীকে হঠাইয়া দিয়া লুঠতরাজ অব্যাহত রাখে। যথা সর্বস্ব লুঠ করার পর রাজাকার বাহিনী কৃষকের গরু মহিষ লুঠ করা শুরু করিলে পলায়মান জনতা গুলিবৃষ্টির মুখেও ফিরিয়া দাঁড়ান ও মরণপণ প্রতিরােধ দেন। এই পর্যায়ে পাক বাহিনীর গুলি বর্ষণে ১ জন নিহত ও ৪ জন আহত হন।

মুক্তিযুদ্ধ। ১: ২১]

২৮ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯