You dont have javascript enabled! Please enable it!

সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের পুলিশের হাতে সোপর্দ করুন- ময়মনসিংহে বঙ্গবন্ধু

ভাইয়েরা আমার, বোনেরা আমার। আপনারা স্বাধীনতা পেয়েছেন। আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক। বাংলাদেশ আজ সার্বভৌম স্বাধীন দেশ। কিন্তু কোনো দেশ, দুনিয়ার কোনো জাতি এত রক্ত দেয় নাই, যা আমার বাঙালিরা দিয়েছে। ৩০ লক্ষ লোক রক্ত দিয়েছে এই বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য। এমন একটা অসভ্য দেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব ছিল, যে পশ্চিম পাকিস্তানকে এখন পাকিস্তান বলা হয়। তাদের সামরিক বাহিনীর লোকেরা প্রচন্ড লুণ্ঠন করেছে, তারা আমার লক্ষ লক্ষ মা-বোন কে হত্যা করেছে। তারা আমার ছেলে-মেয়েকে হত্যা করেছে। তারা আমার সামরিক বাহিনীকে হত্যা করেছে। তারা আমার রক্ষীবাহিনীকে হত্যা করেছে। তারা আমার ইপিআরকে হত্যা করেছে। তারা আমার কৃষকদের হত্যা করেছে। তারা ছাত্রদের হত্যা করেছে। তারা দুধের বাচ্চাদের হত্যা করেছে। হত্যা করেই ক্ষান্ত হয় নাই। তারা আমার রাস্তাঘাট ধ্বংস করেছে। তারা আমার চাউলের গুদাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। তারা আমার সবকিছু ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। তারা আমার পোর্ট বন্ধ করে দিয়ে। গেছে। তারা আমার রেল লাইনকে নষ্ট করেছে। তারা আমার পোষ্ট অফিসকে ধ্বংস করেছে। তারা আমার বৈদেশিক মুদ্রা চুরি করেছে। তারা আমার স্বর্ণ লুট করে নিয়ে গেছে। তারা আমার টাকার নোট জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। এমন একটা দেশ, যে দেশ আমি পেলাম । আমি এসে দেখলাম, আমার ওপর ক্ষমতা দিল। আমি দেখলাম, একটা ধ্বংসের স্তুপ। আমি জানি না এদের কি করে আমি বাচাব। আমি জানি না কি করে আমি এদের ভাত দেব? আমি জানি না কি করে এদের আমি কাপড় দেব আপনারা জানেন আপনাদের দেশের অবস্থা। আপনারা জানেন কি সর্বনাশ হয়েছে এই বাংলাদেশের। স্বাধীনতা পেয়েছি সত্য। কিন্তু কিছুই পাই নাই, আমি চিন্তা করে কূল পাই না। কেমন করে আমি বাংলাদেশের লোককে বাঁচাব। ৩০ লক্ষ লোক মারা গেছে। মায়ের কোল খালি হয়েছে। বোন বিধবা হয়েছে। সব সর্বশান্ত হয়েছে। আড়াই কোটি লোকের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে পশুর দল। মনে করেছে আর একদল বাঙালি রাজাকার, আলবদর নামে পশ্চিমাদের সঙ্গে যোগদান করে আমার বাংলার গরিব দুঃখীদের হত্যা করেছে। রাজাকাররা মনে করেছে যে তাদের ক্ষমা হবে। নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন রাজাকার, আলবদর যারা খুন করেছে তাদের ক্ষমা হবে না। তাদের বিচার হবে নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন আপনারা। আপনারা দুশ্চিন্তায় ভুগছেন বিচার হবে না, বিচার হবে, ভাল করে বিচার হবে। যে সমস্ত ব্রিগেডিয়ার কর্ণেল আমার বাংলার মা-বোনকে হত্যা করেছে, তাদের এই বাংলায় বিচার হবে। আমি মিথ্যা ওয়াদা করতে পারি নাই। আমি মিথ্যা ওয়াদা জীবনে কোনো দিন করি নাই। আমি আপনাদের ভোট নিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে। আমি বলেছিলাম ৭ মার্চ তারিখে এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ২৫ মার্চ তারিখে আমাকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায় । আমি আপনাদের কাছে অস্ত্র দিবার পারি নাই। আমার যারা সিপাহী ছিল তাদের কাছে থ্রি নট থ্রি গান ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আর যারা জনসাধারণ ছিল তাদের কাছে কিছুই ছিল না। থ্রি নট থ্রি দিয়ে এই সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মোকাবেলা করেছে আমার ছেলেরা, আমার বোনেরা। ফায়ারগুলি আজ দেখেছে, বাঙালিরা কাপুরুষ নয়, বাঙালি যুদ্ধ করতে পারে। বাঙালি যুদ্ধ করতে জানে। বাঙালি মরতে জানে, বাঙালি মারতেও জানে। আপনাদের কাছে আমি কি বলব, আমি আড়াই মাস হলো জেল থেকে এসেছি। আড়াই মাস আমাকে বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীত্ব নিতে হয়েছে। কারণ আমি জানি যে, ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও স্বাধীনতাকে নসাৎ করার চেষ্টা করছে। ৩০ লক্ষ লোক যদি স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য জান দিয়ে থাকে, আমি বিশ্বাস করি এখনো স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জান দিবে বাংলার মানুষ। যদি কেউ বলে আপনাদের এই করব, ওই করব, এই করব। যা সর্বনাশ করেছে জানেন আপনারা চট্টগ্রাম। আল্লাহর মর্জি আমি গিয়েছিলাম, সমস্ত জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে গেছে মুখের মধ্যে, জাহাজ সহসা আসতে পারে না। একটা চ্যানেল আছে যা দিয়া জাহাজ আসে। জাহাজে যদি মাল পাঠাতে না পারি, আর মাল আনতে না পারি, আপনাদের কোথেকে আমি দেবো? আমি কিছুই তিন বছর আপনাদের দেবার পারবো না, রাজি আছেন? ও হবে না, হাত তুলে দেখাতে হবে, রাজি আছেন কি না। হ্যা দেয়া হবে। কোনো মানুষ এদেশে আমার বাংলায় না খেয়ে থাকবে না সে বন্দোবস্ত আমি করেছি। আমার বন্ধু রাষ্ট্র ভারত রাষ্ট্র শ্রীমতি গান্ধী ৫ লক্ষ টন খাবার আগে দেবেন বলে গিয়েছিলেন, পরে আবার আমাকে খবর দিয়েছিলেন, আরো আড়াই লক্ষ টন খাবার দিবেন। আমি বার্মা থেকে চাল কিনেছি। রাশিয়া আমাকে খাবার দেয়ার জন্য বলেছেন। জাপান থেকে কেনার বন্দোবস্ত করছি। জাতিসংঘ আমাকে খাবার দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন। ইনশাল্লাহ, যদি একবার আমার সমস্ত কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়, খাবার অভাব হবে না। তবে চুরি করে যদি কেউ খায় তার নাড়ী কেটে ফেলে দিতে হবে। এক দল লোক জিনিসের দাম বাড়াইয়া দিয়েছে। তেলের দাম, কাপড়ের দাম, সাবানের দাম। আজকে আমি একটা ঘোষণা করতে চাই। আমি আগে করি নাই। আমি আস্তে আস্তে চাবাই। এ বাংলাদেশে যত ডিস্ট্রিবিউটর আছেন, যত হোলসেলার আছেন, যত এজেন্ট আছেন তেলের, নুনের, সাবানের, কাপড়ের যা কিছু হোক, যদি ৭ দিনের মধ্যে দাম না কমে, সমস্ত ডিলার আমি ক্যানসেল করে দেব। সমস্ত ডিষ্ট্রিবিউটর এজেন্টকে আমি ক্যানসেল করে দেব। তোমাদের আমি ব্যবসা করতে দিয়েছিলাম কিন্তু বাংলার মানুষকে আমি লুট করতে দেই নাই। তোমাদের আমি বলে দিচ্ছি যদি জিনিস পাওয়া যায় তবে কেন জিনিসের দাম বেশি হবে? কেরোসিন তেল আছে, অমনি বোতলে কমাইয়া দিয়া দাম বাড়াইয়া দেয়, এ এজেন্সি ক্যানসেল হয়ে যাবে। মুজিবুর রহমান বলে দিচ্ছে, এ এজেন্সি ক্যানসেল । এই বাংলাদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে। বাংলার মানুষ জীবন বাজি রেখে আমাকে ফাঁসির কাষ্ট থেকে নিয়ে এসেছে। আমি প্রধানমন্ত্রী হই নাই প্রধানমন্ত্রীত্ব করার জন্য। ভুলে যান। আমি ভূঁড়িওয়ালাদের পেট কাইটা দিছি। ব্যাংক, ইসুরেন্স কোম্পানি, বড় বড় পাটের কল, সব পাটের কল, সব কাপড়ের কল, সব চিনির কল, আজ প্রায়…। যত বকেয়া খাজনা ছিল সুদসহ সব মাফ কইরা দেয়া হয়েছে। ২৫ বিঘা জমির মালিক আপনারা হবেন। ২৫ বিঘা জমির খাজনা মাফ কইরা দিয়েছি। আমার শতকরা ৬০ জন পুলিশকে গুলি করে হত্যা করেছে। আমার শতকরা ৬০ জন যুবকের ছিল না রাইফেল। এদের ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেল বলা হতো। আমরা বলি বাংলাদেশ বিডিআর, তাদের শতকরা ৬২ জন লোককে হত্যা করেছে। আমার সামরিক বাহিনীর ছেলেরা যারা বাংলাদেশে ছিল তাদের শতকরা ৬৫ জনকে হত্যা করেছে। আইন-শৃঙ্খলা, আমি বলেছি যে তোমরা আমার কাছে অস্ত্র জমা দাও। প্রায় সোয়া লক্ষ লোক আমার কাছে অস্ত্র জমা দিয়েছে। চোর-ডাকাত- গুণ্ডা কিছু অস্ত্র রেখে দিয়েছে সামান্য, তাদের আমি বলছি-সময় থাকতে ভদ্র মানুষের মতো, ভালো মানুষের মতো জমা দিয়ে দাও, না হলে উপায় থাকবে না। আর যদি গ্রামে গ্রামে চুরি ডাকাতি করে বন্দুক নিয়া, আমি তাদের বলে দিয়েছি, পুলিশকেও বলে দিয়েছি, যারা বন্দুক নিয়ে গুলি চালাইয়া ডাকাতি করবার চেষ্টা করবে সোজা গুলি চালাইয়া দিয়া হত্যা করবে আমার আপত্তি নাই। ময়মনসিংহের ভাইয়েরা, পুলিশ দিয়ে হবে না। বদর-ফদরবাহিনী যা পাবে এদের ধইরা এরেস্ট করবা। ওদের আমি বিচার করব। তবে একটা কথা আছে, নিরপরাধ মানুষ যেন নিজের সঙ্গে শত্রুতামি আছে বলে সাজা না পায়। আর যারা অন্যায় করেছে তাদের আপনাদের সাজা দিতে হবে। আমি নিরপরাধ মানুষের সাথে তা করতে চাই না। আমি এখনও মাঝে মাঝে আচ্ছা আপনারা কাসিম দেখছেন, কাসিমের মতো মাথা বার করে, ওরা আপদ-বিপদ দেখলে পেটের মধ্যে মাথা নিয়ে যায় আর যেই দেখে মানুষ নাই অমনি মাথা বাহির করে। তাই আমি আপনাদের অনুরোধ করছি যে, আপনারা গ্রামে গ্রামে আমার ভাইয়েরা পুলিশের ওপর নির্ভর করে আমি সমাজ রক্ষা করতে চাই না। আমি জনগণের সাহায্য চাই। জনগণকে নিয়েই আমি স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করেছিলাম। আজ জনগণকে নিয়েই আমি সংগ্রাম করতে চাই, দেশ গড়ার সংগ্রাম। এভাবে যেন শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকে। আপনারা রাজি আছেন কি না? আর একটা কথা রয়ে গেল। আমি বলে দিয়েছি আপনারা বর্ডারে বর্ডারে গণ কমিটি গঠন করুন। আওয়ামী লীগ এবং ভলান্টিয়ার বাহিনী থাকবে, আমি বাংলাদেশ রাইফেলের লোক পাঠিয়ে দিয়েছি তাদের সাহায্য সহযোগিতা করবেন। মনে রাখবেন, সেদিনের সিপাই নয়। এরাও এদেশের মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য বন্দুক না নিয়ে বিপ্লবীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে অনেক ভাই আমার শহীদ হয়েছে। আমি তাদেরও বলব যে, রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা, এই স্বাধীনতা তোমরা রক্ষা কর, জনগণের সাথে তোমরা শরীক হয়ে যাও। তোমাদের কাছে এটাই আমার দাবি ও আবদার। ভাইয়েরা আমার, সরকারি কর্মচারী ভাইদের আমি বলব, পুরানো মদ পুরানো সঙ্গ ছেড়ে দেন। বিপ্লবিদের মাধ্যমে যেখানে স্বাধীনতা আসে, সেখানে অনেক দেশে অনেকেরই চাকুরি করার সুযোগ থাকে না। আমি আপনাদের অনেকের চাকুরি এখানে রেখে দিয়েছি। আমি চাই, আপনারা এই মায়ের, বাংলা মায়ের সন্তান হিসাবে বাংলা মায়ের সেবা করে যান। আমরা বলব আপনারা শাসক নন। আমি আপনাদের আবেদন করব, এদেশের প্রত্যেকটা মানুষ আপনার ভাই, আপনার মা, আপনার বোন, আপনার বাবা, সরল জ্ঞানে তাদের সেবা করতে হবে। সেবার মানসিকতা নিয়ে আপনাদের কাজ করতে হবে। আমাকে আপনারা সোজা মনে করবেন না। আমি অত সোজা মানুষ নয়। রাগ আমার আছে। দরকার হলে আপনারা জানেন মেশিন গানের সামনে আমি প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। এই আপনারা দেখেছেন এবং অনেক বার দেখেছেন, মৃত্যুভয় আমি করি না, কিন্তু প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ যে ভালোবাসা আমাকে দিয়েছে, যে ভালোবাসা ওদের কাছ থেকে আমি পেয়েছি, দুনিয়ার কোনো দেশে কোনো নেতা তা পায় নাই। প্রধানমন্ত্রীত্ব আমি চাই না, আমি চাই ভালোবাসা। তাই ভলোবাসা নিয়ে আমি মরতে চাই। দেশ আমাকে গড়ে তুলতে হবে। আপনাদের কাজ করতে হবে। কাজ করার টাইম নাই ১০ টা ৫টা ভুলে যান। আমি ১৯ ঘণ্টা কাজ করি। আমি আমার জীবনের যৌবন দিয়ে কাজ করেছি। আমি ১৮ বৎসরে স্কুল ছেড়েছি। কিন্তু আমি ১৯ ঘণ্টা কাজ করছি। আমার সহকারীরাও করছে আপনাদেরও কাজ করতে হবে। আপনারা কাজ করুন। আপনাদের যে পয়সা/বেতন দেয়, এই জনগণই দেয়। আমি যদি খবর পাই, আইন আমার হাতে আছে, আমি আইন ব্যবহার করতে চাই না। আমার লাগবে খালি একটা কলম। আপনার চাকুরি আর দরকার নাই আপনাকে বাড়ি যেতে হবে। মেহেরবাণী করে আপনারা কাজ করেন। জনগণকে বলব আপনাদেরও সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে সহযোগিতার হাত মিলিয়ে আত্মনিয়োগ করতে হবে। সোজাসুজি কথা, এই জনগণের জন্য তাই করা হবে। যদি কেউ এই টাকা আত্মসাত করার চেষ্টা করে, সে আমার দলের লোক হউক তাকে শাস্তি দেয়া হবে এবং তা আপনাদের সামনে। আমি চাই না, আল্লাহর ওয়াস্তে একটা কাজ করবেন, ঘুষ দুর্নীতি মাফ করেন আমারে। মেহেরবাণী করে ঘুষ খাওয়া ছেড়ে দেন। এই জমি পবিত্র জমি। এই জমির এমন কোনো জায়গা নাই যেখানে আমার দেশের মা বোনের রক্ত নাই। এই জমির এমন কোনো মহকুমা নাই যেখানে আমার দেশের মা-বোনের কবর নাই। এই জমির এমন কোনো জমি নাই যেখানে আমার দেশের ছেলেদের আত্মা নাই। তাদের কথা মনে করে, তাদের আত্মার কথা মনে করে, তাদের রক্তের কথা মনে করে আমি আমার জনগণকে, আমি সরকারি কর্মচারীকে, আমি ব্যবসায়িকে, আমি শ্রমিককে, আমি কৃষকদের আবেদন জানাই-দেশ গড়তে আত্মনিয়োগ করুন। নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন। দেশের মানুষ আজ দুঃখী, দেশের মানুষ আজ না খাওয়া। আজ দ্বারে দ্বারে ঘরে ঘরে গৃহহারা সর্বহারার আর্তনাদ। আজ গ্রামে গ্রামে দেখি মানুষের ঘর-বাড়ি নেই। মা মা করে তারা কান্দে বাংলার মানুষ কোথায় থাকবে? এদের কথা চিন্তা করে আমি ঘুমাতে পারি না। আমি আপনাদের কাছে চাই, যার ঘর আছে, তার পাশের বাড়িতে গৃহহারাদের ঘর-বাড়ির ব্যবস্থা করবেন। যার খাবার আছে, তারা অন্যকে খাবার দিয়ে সাহায্য করেন-এটা হলো মনুষত্ত্ব জাগরণের লক্ষণ, খামাখা জয় বাংলা বলে চিৎকার করলে হবে না। বাংলার মানুষ যাতে সব পায়, বাংলার মানুষ যাতে সুখী হয়, বাংলার মানুষ যাতে শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা পায়। সমাজতন্ত্র আমি করব, সমাজতন্ত্র বাংলাদেশে হবে। তার প্রথম পদক্ষেপ আমরা গ্রহণ করেছি এবং আপনাদের সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি জানি বাংলার মানুষ আমাকে ভালোবাসে। আমিও বাংলার মানুষকে ভালোবাসি। আমি বাংলার মাটিকে ভালোবাসি। বাংলার মাটিও আমাকে ভালোবাসে। আমি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসতে পারতাম না। আমার মনে হয় এদেশের কোটি কোটি মানুষের দোয়া আর এই মাটির টানে আমি পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী জেলে, যেখানে আমার জন্য কবর খোড়া হয়েছিল তার কাছ থেকে আমি আসতে পারতাম না। এই মাটিকে আমি ভালোবাসি। আমি চাই, আমার বাংলার মানুষ হাসুক, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক। আমার বাংলার মানুষ শান্তিতে থাকুক, আমার বাংলার মানুষ নির্যাতিত না হউক, আমার বাংলার মানুষ সুখী হউক। আমার বাংলার মানুষ সুখে স্বাচ্ছন্দে বাস করুক। লক্ষ লক্ষ বেকার রয়েছে আমার দেশে। চাকুরির বন্দোবস্ত আমি করতে পারছি না। চাকুরির বন্দোবস্ত করতে হলে কল-কারখানা করতে হবে। সরকারি চাকুরিতে চাকুরি হয় না। আমি তোমাদের বলে দিতে চাই, আমি এমন এক অর্থনীতি গড়ে তুলতে চাই, শোষণের জন্য অর্থনীতি আমি গড়ে তুলতে চাই না। এখানে নিচের থেকে শুরু হবে উন্নয়নের অর্থনীতির ধারা এবং এটা করতে হলে সকলের সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি আজ আপনাদের কাছে, আপনারা জানেন, যে দেশে রক্তক্ষয়ী বিপ্লব হয়েছে, যে দেশে লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আমি, আমার সহযোগিতায় যারা স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়েছেন তারা হত্যাকাণ্ড চালাতে দেন নাই। আমি চাই না নির্দয় অসহায় মানুষ বিপদে পড়ুক, তা আমি চাই না। তার মানে এই নয় যে, আমাদের দুর্বলতা আছে। আমাদের দুর্বলতা নাই। মাফ করেন। মন প্রাণ দিয়ে কাজ করেন। পয়সা খাওয়া ছেড়ে দেন। লোভ ছেড়ে দেন। ব্যবসায়ী ভাইয়েরা আবারও বলে দিচ্ছি-৭দিন সময় ডিষ্ট্রিবিউটর, এজেন্সি, তেলের এজেন্সি, চালের এজেন্সি, দুধের এজেন্সি বিসমিল্লাহ করে ৭ দিনের পর আমি ক্যান্সেল করিয়া দেব। আপনারা তো জানেন আমি মুজিবুর রহমান যা বলি তা করবার চেষ্টা করি। ইয়াহিয়া কত তেলাইছে প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য। প্রধানমন্ত্রী আমি হবার চাইনি, আপনারা জানেন আমি মরতে গিয়েছিলাম কিন্তু বাংলার সাথে বেঈমানি করি নাই। আর এখনো বলছি, আমি মরতে পারি কিন্তু সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে আমি বেঈমানি করতে পারবো না। তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা সংঘবদ্ধ হইয়া থাকেন। এক দল লোক রয়েছে, এটা হলো না, ওঠা হলো না। কিচ্ছু দেবার পারবো না। আমি বলেছি কিছু আমার কাছে নাই। আমি দুনিয়ার কাছে ভিক্ষা করে আনতেছি, ভারতবর্ষ আমাকে সাহায্য না করলে আমি দেশ চালাইতে পারতাম না। একদল লোক আপনাদের প্রভাবিত করতে চেষ্টা করছেন। আমি সাবধান করে দেবার চাই, ভারতের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চুক্তি হয়েছে। আমি একটা স্বাধীন দেশ, ভারতবর্ষ একটা স্বাধীন দেশ। দুই স্বাধীন দেশের সাথে বন্ধুত্ব। এখানে কোনো গোলমাল টোলমাল নাই। আমার স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করবে না, আমিও তোমাদের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করব না। কিন্তু যারা আমার বন্ধুত্বের হরণ করার চেষ্টা করবেন তারা মনে রাখবেন, তারা জানেন না, আমি হাত বাড়াই না, একবার হাত বাড়াইলে আমি কোনো দিনও ফিরাই না, এটা ইয়াহিয়া খানও জানে, আইয়ুব খানও জানে। তাই বন্ধুরা, আপনাদের কাছে আমার আবেদন, আপনারা দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। যাই কিছু করেন। আমি কিছু দেবার পারব না। ৩ বছর পরে, ৩ বছর ধরে যদি যুদ্ধ চলত, আপনারা যুদ্ধ করতেন না? আপনারা না খেয়ে যুদ্ধ করতেন না? ধরেন আরো ৩ বৎসর যুদ্ধ করতে হবে। যা ধ্বংস হয়ে গেছে, তা ঠিক করতে আমার ৫০ বসর সময় লাগত। কিন্তু আমি মনে করি ইনশাল্লাহ ৩ বৎসরের মধ্যে পারব। কিন্তু আপনাদের সহযোগিতা করতে হবে। একলা কেউ কিছুতে চলতে পারে না। তাই আপনারা, আপনাদের আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি। আপনারা দোয়া করবেন। ভালবাসা আপনারা আমাকে দিয়েছেন, আমার জীবনের ওটাই যেন পাথেয় হয়ে থাকে। ইনশাল্লাহ সোনার বাংলা আবার জাগবে, যদি শোষণহীন সমাজ গড়তে পারি। তবে আপনাদের সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন। আপনাদের কাছে আরেকটা অনুরোধ হলো যে, দুর্নীতি ও ঘুষের বিরুদ্ধে আপনারা আন্দোলন করতে রাজি আছেন কি ? দুর্নীতি আর ঘুষ, রাজি আছেন? হ্যা, খোদা হাফেজ- জয় বাংলা।

রেফারেন্স: ৫ এপ্রিল ১৯৭২, ইত্তেফাক
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!