You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.28 | দিকে দিকে মুক্তি বাহিনীর অগ্রাভিযান - সংগ্রামের নোটবুক

দিকে দিকে মুক্তি বাহিনীর অগ্রাভিযান

যশাের ক্যান্টনমেন্ট বিপন্ন ইয়াহিয়ার নাভিশ্বাস  পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘােষণা

(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক) বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম নুতন পর্যায়ে প্রবেশ করিতেছে। সকল রণাঙ্গনে অপরাজেয় মুক্তিবাহিনী শত্রুর উপর দুর্বার আঘাত হানিতেছেন। শুরু হইয়াছে হানাদার দুশমনদের বিরুদ্ধে প্রবল আক্রমণাত্মক অভিযান। পাক সেনারা সর্বত্রই মুক্তিবাহিনীর হাতে মার খাইয়া পিছু হটিতেছে। একের পর এক এলাকা শত্রুমুক্ত করিয়া স্বাধীনতার বিজয় কেতন উড়াইয়া বীর মুক্তিবাহিনী আগাইয়া চলিয়াছে। যশাের ক্যান্টনমেন্ট মুক্তিবাহিনীর আঘাতে বিপন্ন, বিমান বন্দর ক্ষতিগ্রস্ত। রংপুর, কুষ্টিয়া, যশাের, খুলনা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্ত হইয়াছে। খুলনা ও সিলেট শহরের দিকে মুক্তিবাহিনী অগ্রসর হইতেছে। গত কয়েকদিনে মুক্তিযােদ্ধারা উত্তরে রংপুর হইতে দক্ষিণে খুলনার সাতক্ষিরা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগে শত্রুর অনেকগুলি ঘাটি আক্রমন করিয়া বিশেষ সাফল্য অর্জন করে। খুলনা জেলার সাতক্ষিরা মহকুমার অংশ, কালিগঞ্জ, ভােমা, কলারােয়ার অংশ, যশাের জেলার মান্দ্রা, চৌগাছা, বরশি, মণিরামপুর, রংপুর জেলার রায়গঞ্জ, হাতিবান্ধা ও বড়খাতা, দিনাজপুর জেলার জগদ্দল, অমলখানা এবং কুষ্টিয়া জেলার আলমডাঙ্গা থানা ও মেহেরপুর মহকুমার অনেক অঞ্চল মুক্ত হইয়াছে।

ক্যান্টনমেন্ট অভিমুখে মুক্তিবাহিনী এই রিপাের্ট লেখার সময় পর্যন্ত যশাের ক্যান্টনমেন্টের সন্নিকটে তুমুল লড়াই চলিতেছে। গত রবিবার মুক্তিযােদ্ধারা যশাের ক্যান্টনমেন্ট হইতে সাত মাইল দূরবর্তী চৌগাছা দখল করিয়া নিলে পাক বাহিনী বেসামাল হইয়া পড়ে। চৌগাছা ঘাটি হইতে পিছু হটিয়া পাক সেনারা যশাের ক্যান্টনমেন্টের ভিতর আশ্রয় লয় এবং পরে ক্যান্টনমেন্ট হইতে চৌঘাছায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থানসমূহের উপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনী ইহার সমুচিত জবাব দেয় এবং চৌগাছা, মণিরামপুর ও বরণি তিন দিক হইতে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে। এই সাঁড়াশী আক্রমণের মুখে যশাের ক্যান্টনমেন্টের পাক সেনাদের অবস্থা সংকটজনক হইয়া পড়িয়াছে। সর্বশেষ খবরে জানা গিয়াছে যে, পাক সেনারা যশাের ক্যান্টমেন্ট হইতে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক দলিল পত্র ও সংরক্ষিত অস্ত্রপাতি বিশেষ বিমানে করিয়া ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সরাইয়া লইয়া যাইতেছে। পাক বাহিনীও বুঝিতেছে যে, যশাের ক্যান্টনমেন্ট হাতছাড়া হইয়া যাইতে পারে। তাই তাহারা ঝিনাইদহ ও মাগুরায় দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা লাইন গড়িয়া তুলিয়াছে। বেগতিক দেখিলে ক্যান্টনমেন্ট ছাড়িয়া পশ্চাদপসরণ করিয়া সেখানে আশ্রয় লইবে। এবং সেখান হইতে ঢাকার দিকে সরিয়া আসিবে। বিমান বন্দর ক্ষতিগ্রস্ত মুক্তিবাহিনীর গােলার আঘাতে যশাের বিমান বন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। মঙ্গলবার হইতেই দখলীকৃত বাঙলাদেশে অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচলের সকল ফ্লাইট বন্ধ হইয়া গিয়াছে। কতিপয় ট্রেন ওবাস সার্ভিসও বাতিল ঘােষিত হয় যশাের ছাড়া কুষ্টিয়ার মেহেরপুরও খুলনার সাতক্ষিরা মহকুমার মুক্তিবাহিনী প্রবল আঘাত হানিতেছে। সাতক্ষিরায় পাক সেনাদের ঘাটিগুলির পতন হইলে খুলনা দখল সহজ হইবে। 

কুষ্টিয়ায় মুক্তিসেনারা জীবন নগর ও দর্শনার সড়ক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করিয়া শক্ত ঘাটি গাড়িয়া  বসিয়া আছে। জেলার উত্তর ভাগে মহেশকান্দিতে অবস্থিত পাকসেনাদের শক্ত ঘাটি মুক্তিযােদ্ধারা দখল করিয়া নিলে পাক সেনারা গেনিয়ার দিকে সরিয়া পড়ে।। পূর্ব রণাঙ্গন। শক্রকবলিত বাঙলাদেশের পূর্ব রণাঙ্গনেও মুক্তিসেনাদের জয়যাত্রা অব্যাহত রহিয়াছে। গত কয়েকদিনে সিলেট জেলায় জাকিগঞ্জে ও আটগ্রামে শত্রুঘাটিগুলির পতন হইয়াছে। জয়ন্তিয়াপুরে এক কঠিন সম্মুখ লড়াইয়ের পর বুধবার ডিগ্ৰাও ঘাটিকে মুক্তিসেনারা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করে। হটিয়া যাওয়ার পরও কয়েকবার পাকসেনারা ভারী কামান লইয়া আক্রমণ চালায়। কিন্তু মুক্তিবাহিনী সাফল্যের সহিত এই সব হামলা প্রতিহত করিতেছে।  ময়মনসিংহের কিশােরগঞ্জ মহকুমার প্রায় সবটাই এখন মুক্তাঞ্চল। মহকুমার ৭টি থানায় মুক্তিবাহিনীর দৃঢ় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে এবং অন্য পাঁচটি ঘাটি মুক্তিবাহিনী ঘিরিয়া আছে। সিলেট ও চট্টগ্রামে তীব্র সংঘর্ষ ও ক্ষয়ক্ষতির কথা রেডিও পাকিস্তান হইতে স্বীকার করা হইয়াছে।  ঢাকার সন্নিকটে মুন্সিগঞ্জে মুক্তিযােদ্ধারা উল্লেখযােগ্য সাফল্য অর্জন করিয়াছে। মুন্সিগঞ্জ থানা হইতে দখলদার শত্রুদের হটাইয়া দিয়া মঙ্গলবার মুক্তিসেনারা স্বাধীন বাঙলার পতাকা উত্তোলন করে ও শহরে কুচকাওয়াজ করে। জনগণ মুক্তিযােদ্ধাদের অভিনন্দিত করে। পিছু হটিয়া পাক বাহিনী এখন দূর হইতে মুন্সিগঞ্জের উপর গােলা নিক্ষেপ করিতেছে। সর্বত্রই পিছু হটার সময় পাকিস্তানী সেনারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ফেলিয়া যাইতেছে। সেগুলি মুক্তিবাহিনী দখল করিয়া লইতেছে । এই সব সংঘর্ষে অনেক মুক্তিযােদ্ধা বীরের মত লড়িয়া শাহদাৎ বরণ করিতেছেন। মুক্তি সেনাদের অগ্রগতি রােধ করার জন্য দখলদার পাক বাহিনী বিমান ও ট্যাঙ্ক বহর লইয়া আক্রমণ চালায়। যশােরের চৌগাছা ও কেশবপুরে পাক জঙ্গী বিমানগুলি বােমা ও খুব নিচু হইতে গুলি বর্ষণ করিয়া নির্বিচারে অনেক গ্রামবাসীকে হত্যা করে। পাকিস্তানী বিমান বাহিনী যশোের মুক্তাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর ঘাটিগুলির উপর বেপরােয়াভাবে গুলিবর্ষণ করিতে করিতে এক সময় ভারতের আকাশসীমা লক্ষ্মন করিয়া যায়। আকাশবাণীর খবরে প্রকাশ, এই সময় ভারতীয় বিমানবাহিনী। অনুপ্রবেশকারী পাকিস্তানী স্যার জেট বিমানগুলিকে ধাওয়া করে এবং ৩টি বিমানকেই গুলি করিয়া ভূপাতিত ও ২ জন পাকিস্তানী বৈমানিককে গ্রেফতার করে। মুক্তিসেনারা পাক বাহিনীর ৫টি মাঝারি আকারের মার্কিন ট্যাঙ্ক ঘায়েল করে।

ইয়াহিয়ার বেসামাল অবস্থা মুক্তিসেনাদের হাতে পরাজয়ের গ্লানি ঢাকিবার জন্য এবং বিমান ও ট্যাঙ্ক ব্যবহারের অজুহাত হিসাবে পাকিস্তান প্রচার করিতেছে যে, ভারতীয় সৈন্যরা ট্যাঙ্ক, বিমান ও ভারী অস্ত্র লইয়া যশাের আক্রমণ করিয়াছে। দেশে বিদেশে পাকসামরিক জান্তার মুখপাত্ররা এবং রেডিও পাকিস্তান অনবরত প্রচার চালাইতেছে যে, ভারত অঘােষিত যুদ্ধ শুরু করিয়াছে। প্রকৃতপক্ষে মুক্তি বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে টিকিতে না পারিয়া পাকসেনারা এখন বিমান ও ট্রাঙ্কসহ সকল যুদ্ধাস্ত্র লইয়া মুক্তিবাহিনীর মােকাবেলায় নামিয়াছে। ইহা হইতে মুক্তিযােদ্ধাদের শক্তি ও আক্রমণের তীব্রতা এবং পাক বাহিনীর নাজেহাল অবস্থাটি বুঝা যায়।  মুক্তি বাহিনীর সাফল্যে দিশাহারা ইয়াহিয়া সারা পাকিস্তানে ও দখলীকৃত বাঙলাদেশে জরুরী অবস্থা ঘােষণা করিয়াছে। মঙ্গলবার বিকালে রেডিও পাকিস্তান হইতে প্রচারিত এক ঘােষণায় বলা হয় যে, বৈদেশিক আক্রমণের আশঙ্কায় এই জরুরী অবস্থা ঘােষণা করা হইল। এইভাবে মুক্তিবাহিনী সাফল্যকে ভারতীয় আক্রমণ বলিয়া প্রচার ও সেই অজুহাতে। জরুরী অবস্থা ঘােষণা করিয়া ইয়াহিয়া গােষ্ঠী সমগ্র বিষয়টিকেই ভারত পাকিস্তান বিরােধ হিসাবে আন্তর্জাতিক দরবারে উপস্থিত করার ও ভারতের সহিত যুদ্ধ বাধাইয়া উহার সাম্রাজ্যবাদী মােড়লদের হস্তক্ষেপ ডাকিয়া আনার শয়তানি চেষ্টা করিতেছে।  কিন্তু মুক্তি বাহিনী আবার বাহুবলে লড়িয়া বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতাকে এক দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্টিত করিয়াছে এইসব অপপ্রচারে বিশ্ববাসী আর বিভ্রান্ত করা যাইতেছে না। তবু ইহাতে মুক্তিযােদ্ধাদের আত্মসন্তুষ্টির অবকাশ নাই। সামনে আরও কঠিন রহিয়াছে।

মুক্তিযুদ্ধ। ১: ২১

২৮ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯