You dont have javascript enabled! Please enable it!

ছাত্র ইউনিয়নের ত্রয়োদশ কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

ভদ্র মহোদয় ও মহিলাগণ, আপনারা আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। আপনারা আমাকে প্রধান অতিথি করেছেন, আমার ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। মতের যেখানে মিল আছে , মনের যেখানে মিল আছে। আপনাদের কাছে আমি দু’চারটা কথা বলতে চাই, আপনাদের কাছে ইতিহাস বলে লাভ নাই। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন যেমন মুক্তির শর্ত, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যায় যদি এদেশের দুঃখী মানুষের জন্য কিছু না করা যায়। এদেশে শোষণহীন সমাজ যদি প্রতিষ্ঠিত না হয় এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি একমাত্র পথ বলে আমরা বিশ্বাস। করি। স্বাধীনতা সংগ্রাম অনেক দিন থেকে শুরু হয় এবং ধাপে ধাপে এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হয়
কারন শোষণ এবং শোষক শ্রেণি হুশিয়ার ছিল। কিন্তু সে স্বাধীনতা যে এই স্বাধীনতা হবে ১৯৪৭ সালে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম এ স্বাধীনতা মিথ্যা, এ স্বাধীনতা বাংলাদেশকে লুট করার ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশের মানুষ চিরদিনের মতো গোলাম করার ষড়যন্ত্র কেন্দ্রে বসে নেতারা স্বাধীনতা ভোগ করেন। বাংলাদেশকে ভাগ করেন। বাংলাদেশকে শাসন করার চেষ্টা করেন। তারা শোষণ করতে চেয়েছিলেন। আমার সংস্কৃতির ওপর আঘাত করে। আমার ভাষার ওপর আঘাত করে। আমার শিক্ষার ওপর আঘাত করে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যেমন একটা কলোনীকে তার নিজস্ব স্বাধীকার থেকে বঞ্চিত করে শোষণ করার ষড়যন্ত্র করে ঠিক একইভাবে আমাদের এই পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক শ্রেণিরা এই বাংলার মানুষকে শোষণ করার ষড়যন্ত্র করেছিল এবং তারা কলোনিতে পরিণত করেছিল। আমার ছোট ছোট ভাই ও বোনেরা, এই স্বাধীনতার আন্দোলন গোড়াপত্তন হয় ১৯৪৭ সালের জুন মাসে, যখন ঘোষণা হয় তারপর থেকে। আমাদের অনেক এদিক দিয়ে, ওদিক দিয়ে, এ পাশ দিয়ে, ওপাশ দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো মেনুয়াল করে চলতে হয়েছে এবং সেজন্য আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছে। জাতীয়তাবাদ আন্দোলন শুরু না করতে পারলে দেশের বিপ্লব করা কষ্টকর হয়ে যায়। এ জন্যই সে সময় আমাদের অনেক বন্ধু-বান্ধবরা অনেক সময় আমাদের এই প্রোগ্রামকে মানতেন না বা সমালোচনা করতেন। তারা ভুল বুঝতেন। তারা আমাদের উদ্দেশ্যের ওপর কটাক্ষ করতেন কিন্তু আমরা জানতাম যে জাতীয়তাবাদের আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির আন্দোলনও আমরা সাথে সাথে চালিয়ে দিয়েছিলাম। তখন এই যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, এর পরে সমাজে অর্থনীতির উন্নয়ণ করতে আমাদের কোনোদিন দ্বিধা বা কষ্ট হতে পারে না। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বড় কষ্টকর ছিল। আমাদের দেশের মানুষ ছিল ধর্মভীরু মানুষ। ধর্মভীরু মানুষকে ধর্মের নামে স্লোগান দিয়ে এগিয়ে নেয়া বড় সোজা। তাদের প্রধান অস্ত্র ছিল এই ধর্ম। নিজেরা কিন্তু কোনোদিনও ধর্ম পালন করতেন না কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করতেন। এমনভাবে ব্যবহার করতেন, যেটা ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি, তাদের যে উদ্দেশ্য ছিল সেটাকেই ফলো করতে চেষ্টা করতেন। আপনারা ইতিহাস জানেন, ইতিহাস বলতে চাই না, আপনারা জানেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ইতিহাস, আপনারা জানেন ৫২ সালের ইতিহাস, আপনারা জানেন ৬৪ সালের ইতিহাস, আপনারা জানেন ৬৯ সালের ইতিহাস। আপনারা জানেন এই সরকারকে। স্বাধীনতা পেয়েছেন, আপনারা ত্রিশ লক্ষ জীবন দিয়েছেন। ত্রিশ লক্ষ লোক শুধু রক্ত দেয় নাই, প্রায় দুই কোটি আড়াই কোটি লোকের ঘর বাড়ি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই করে নাই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। বড় বড় সরকারি কর্মচারীকে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানের আক্রমণে বাংলাদেশের পুলিশ বাংলাদেশের ইপিআর, (তখনকার ইপিআর, বর্তমানের বিডিআর, বাংলাদেশ রাইফেলস) সামরিক বাহিনীর লোকদের হত্যা করা হয়েছে। তারা প্লান করেছিল, সে প্লান অনুযায়ী যা চলেছিল, এদেশে যারা কথা বলার মতো মাথা তুলে দাঁড়াবার মতো ছিল তাদের সবাইকে হত্যা করে শেষ করে দাও। আমরাও জানতাম, আমরাও বুঝতাম। তারাও সময় নিচ্ছিল, আমরাও সময় নিচ্ছিলাম। আমার অনেক বন্ধু বান্ধব বলতেন নির্বাচন কর না, আমরা নির্বাচন বয়কট করলাম। আমি বললাম না নির্বাচন করব। দুনিয়াকে দেখাতে হবে যে আমার এই প্রােগ্রামের পক্ষে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনসাধারণ এবং সেটা পরিষ্কারভাবে দেখা গেছে যে সেটা আমাদের যে একটা শক্তি ছিল। যদি বেঈমানী করতাম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লোভে। তাহলে ইলেকশনের রেজাল্ট ফেজাল্ট নষ্ট হয়ে যেতে। কিন্তু নির্বাচন শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়। আমি ইলেকশনের পূর্বে ঘোষণা করেছিলাম এটা আমার গণভোট, স্বাধীকারের গণভোট, যদিও সাথে সাথে এই স্লোগানও ছিল- এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমাকে বন্ধু-বান্ধবরা বলতেন ঘোষণা করে দাও। আমি বলি ঘোষণা করে আমি নিশ্চয়ই দিয়েছি কিন্তু ঘোষণা করার কায়দা আছে। শত্রুকে বেকায়দায় ফেলতে হয়, শত্রুকে নিয়ে বেকায়দায় পড়তে নাই। ওটা একটা যুদ্ধ। ওটী একটা আন্দোলন, আন্দোলন না করলে আন্দোলন শিখা যায় না, বই পড়ে আন্দোলন হয় না, থিয়োরিশিয়ান হয়ে যায়, চৌকস হয়ে যার নেতৃত্বে থাকে তারাই জানে আন্দোলন কি জিনিস। আন্দোলন কীভাবে করতে হয়। বই পড়া থিয়োরিশিয়ানরা জীবন ভরে বই পড়েই খালি খবরের কাগজে লিখেন কিন্ত প্র্যাকটিকাল জিনিস কীভাবে আন্দোলন পরিচালিত করতে হয় সে শিক্ষা তাদের হয় নাই। মাঝে মাঝে সেজন্য ফাউল প্রিন্ট করে ফেলে। আন্দোলনের একটা ধারা আছে যেটার মাধ্যমে আস্তে আস্তে এগিয়ে নিতে হয় মানুষকে। মানুষকে এমন কিছু বলতে নাই, যেটা দেখলে মানুষ চমকে উঠে। এমন কিছুতে মানুষকে এগিয়ে নিতে হয় যেখান থেকে মানুষ ফেরত আসতে পারে না এবং শক্রকে খেলতে দিতে হয় না। ভাইয়েরা আমার, স্বাধীনতা আপনারা পেয়েছেন, স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। দসুর দল বাংলা থেকে বিতাড়িত হয়েছে। দস্যুর পাল বিতাড়িত হয়েছে সত্য কিন্তু ২৪ বছর যে বন্ধু ছিল সে বন্ধুকে বিতাড়িত করতে পেরেছেন আপনারা ? পারেন নাই। তালের বন্ধুত্ব রয়েছে, তালের বন্ধু রয়েছে, তাদের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক তারা রয়েছে, তাদের সঙ্গে যারা পয়সা লুটত তারা রয়েছে। তাদের সঙ্গে আঁতাত করে যারা প্রমোশন পেয়েছে তারা রয়েছে। স্বাধীনতা পেলেও এদের হাত থেকে এখনও আমরা রক্ষা পাই নাই। তারা আমার কাছে, আমার এক ছোট ভাই সেদিন বলল, যে এত তাড়াতাড়ি না করলেও হতো। এতো তাড়াতাড়ি ব্যাংক, ইসুরেন্স ন্যাশনালাইজ করলেন কেন? এখন পর্যন্ত ভস্মিভূত একটা দেশ) পয়সা অর্থনীতি ভেঙে চুরে চুরমার হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে কেমন করে আপনারা এ জিনিসটা করতে যাচ্ছেন। কি হবে? সর্বনাশ হতে পারে এ দেশের। আরে সর্বনাশের কিছুই বাকি নাই । সর্বনাশের ওপরে আরেকটু সর্বনাশ করে ভবিষৎ বংশধরদের উপরে একটা পথ দেখিয়ে যান। তাই যদি হয়, কারণ তারাও চেষ্টা করেছিল যে দেরি হয়ে গেলে দুর্বলতায় আসলে তারাও নড়ে উঠলে, দাড়ালে এবং সমাজতন্ত্র অর্থনীতি পিছনে আঘাত করতে পারে। আমার সহকর্মীরা এবং আমি এ সম্বন্ধে খুবই হুঁশিয়ার প্রায় সাড়ে সাত কোটি লোক ৭৪ হাজার বর্গমাইল । এতো অল্প জায়গায় এতো বেশি লোক কোথাও বাস করে না দুনিয়ায়। জমি আমাদের নাই বলতে গেলে। যা আছে তাতে কয় পার্সেন্ট লোকের জায়গা হয়। শিল্প- কারখানা যা আছে তার মধ্যে আমাদের কত লোকের বেকার সমস্যা দূর হয়। অর্থনীতি এমনভাবে ২০০ বছর ইংরেজ, ২৪ বছর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক শ্রেণি বাংলার অর্থনীতিকে ভেঙে চুরে চুরমার করে দিয়ে গেছে। আমিতো কোনোদিন আপনাদের কাছে মিথ্যা ওয়াদা করি নাই। আমি তো একথা বলি নাই আপনাদের যে স্বাধীনতা পেয়েছেন এখন এই পাবেন, সেই পাবেন, এটা পাবেন, ওটা পাবেন, এটা দেয়া হবে, ওটা দেয়া হবে, চাকুরি দেয়া হবে। আমিতো পরিষ্কার বলি, ৩ বৎসরের মধ্যে কিছু দিরার পারিব না। যদি বলেন পারিব-আমি বিদায় নিতে রাজি আছি যদি কেউ বলেন, এগিয়ে আসেন, আমার আপত্তি নাই। আমি ছেড়ে দিতে রাজি আছি ক্ষমতা। কিন্তু যারা সত্যিকারের প্রগতিশীল, যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, যারা পড়ে পড়ে সমাজতন্ত্রের কথা বলে না তারা নিশ্চয়ই আমাকে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে- এ সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ আমার নাই। কিন্তু যারা সমাজতন্ত্রের বই পড়ে কথা বলেন, যারা অতি বিপ্লবের কথা বলে বেড়ান এবং অতি বিপ্লবের সমর্থনে কথা বলেন, যারা আমার দেশের লক্ষ লক্ষ ভাই বোন যখন স্বাধীনতার সংগ্রাম করতেছিলেন, তখন যারা পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন, তারা আবার প্রগতিশীল বলে দাবি করেন। তারা আবার বক্তৃতা করেন। এই আমি বক্তৃতা করতে দিচ্ছি বলে তারা মনে না করেন, তাদের আমি সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছি। দরকার হলে আবার সংগ্রাম শুরু হতে পারে। আমি কারো বিরুদ্ধে বলতে চাই না। কোনো জনগণের বিরুদ্ধে আমি নই। আমি আমেরিকার বিরুদ্ধে নই। আমি দুনিয়ার কোনো মানুষের বিরুদ্ধে নই। আমি তাদের সমাজ ব্যবস্থা এবং তাদের শাসনের বিরুদ্ধে। এশিয়ার শ্রেষ্ঠ দেশ, বহু দেশ। দুনিয়ার, চায়না আমাকে এখনো স্বাধীনতা স্বীকৃতি দেন নাই। তিনি বন্ধুত্ব করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের
সমারিক বাহিনীর শাসকদের সাথে এবং যেখানে স্যোসালিজমের নামগন্ধ পর্যন্ত নাই। তারা সোশ্যালিস্ট কান্ট্রি নিশ্চয়ই একথা তারাও বলেন আমরাও বলি। তারাও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা পেয়েছিল। বাংলাদেশের জনসাধারণ আশা করেছিল আমরা যেহেতু রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা এনেহি নিশ্চয়ই তারা আমাদের সমর্থন করবেন। সমর্থন যদি নাও করেন আমাদের বিরোধীতা করবেন না। কিন্তু দুঃখের বিষয় তারা অত্র দিয়েছেন টিক্কা খান, ইয়াহিয়া খানের কাছে যখন বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রাম করতে ছিল, মরতে ছিল তাদের মেশিনগানের সামনে এবং আমার ছেলেরা আমার মুক্তিযোদ্ধারা যে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে তার মধ্যে শতকরা ৬০ টি অস্ত্র চায়নার, শতকরা ৪০ টি অস্ত্র আমেরিকার। বলেনতো আপনারা স্যোসালিষ্ট কান্ট্রি হয়ে আপনারা মানুষের জন্য যুদ্ধবিরোধী কথা বলেন, আপনারা কেমন করে তাদের অস্ত্র দিলেন রাতের অন্ধকারে। আমি চায়না সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করি- আপনারা অনেকে বোধ হয়, সেকথা জানেন এবং জানেন না। তাই আন্দোলন যখন শুরু হয়, আমরা যখন জয়লাভ করি এই রেসকোর্স ময়দানে, আওয়ামী লীগের সদস্যরা শপথ নিলাম। তাদের ঘুম গেল। তারা মনে করেছিল আমরা আপোষ করব ক্ষমতার জন্য। নীতির সঙ্গে আপোষ হয় না। সেটা আমি বার বার তাদের বলে দিয়েছিলাম। সেই দিন যখন আমরা নীতির সঙ্গে কোনো আপোষ করবো না। তারপরই এক জাহাজ অস্ত্র সোয়াত নামে চট্টগ্রামে বন্দরে চায়না থেকে আসে এবং ১ তারিখের পূর্বেই অস্ত্র আইসা পৌছে এবং সে অস্ত্র নামতে দেয় নাই আমার প্রেমিক ভাইরা, কর্মীরা, ছাত্ররা। সামরিকবাহিনীর লোকেরা এরোপ্লেনে যেয়ে বাঙালি সৈন্যদের কাছে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তখন তারা মাল নামানোর চেষ্টা করে। আমি জানতাম, আমি পারতাম সে জাহাজকে ধ্বংস করতে এবং সে সামর্থ আমাদের ছিল কিন্তু করি নাই, তাহলে চট্টগ্রাম পোর্ট আমার উড়ে যায় এবং চট্টগ্রাম শহর আমার জ্বলে যায়। এতো বিষাক্ত অস্ত্র তারা আমাদের বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল তখন বলেন কি করে তাদের আমি ধন্যবাদ জানাব? তবে জনাব এখন জানাতে পারলাম না। ভবিষ্যতে যদি বাংলার জনসাধারণের পাশে তারা দাঁড়ান তা নিশ্চয়ই তারা দাঁড়ান-প্রাণ খুলে জানাব, মন ভরে জানাব, দু-হাত তুলে জানাব। এখন পারলাম না, দুঃখিত। যাই হোক আমেরিকা অস্ত্রপাতি দিয়েছেন, বিশেষ কারণে ধন্যবাদ দেই নাই। রিকোগনেশন দিয়েছেন-ভাল, সুখী হলাম, তাহলে ধন্যবাদ দিচ্ছি। মেহেরবাণী করে আপনাদের প্রতি অনুরোধ রইল যে আর দামাবাজির খেলা খেইলেন । বাংলার মাটিতে তা হবে না। আমরা সকলে সংঘাত ছাড়া বন্ধুত্ব কামনা করতে চাই। আমরা ছোট দেশ, অস্ত্র দিয়ে কারও সাথে যুদ্ধ কামনা করতে চাই না। শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা যুদ্ধে বিশ্বাস করি না। আমাদের দেশে অস্ত্রপাতি নাই। আমরা আনপ্রােডাক্ট এক্সপেনডেসার করতে চাই না। আপনাদের মতো শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষমতা আমাদের নাই। মেহের বাণী করে আপনারা রিকোগনেশন দিয়েছেন, আপনাদের জনগণের সঙ্গে আপনাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব আমিও কামনা করি। আমার ভিতরের ব্যাপাটা হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করবেন না। তাহলে বুঝতেই পারছেন, অবস্থা আবার খারাপ হয়ে যাবে। যারা আমাদের রিকোগনেশন দিয়েছেন-তাদের আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। বিশেষ করে ভারত ও রাশিয়াকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ভারতবর্ষ যদি আমার এক কোটি লোককে খাওয়া না দিত, ভারতরে সৈন্যরা যদি আমার মুক্তিবাহিনীর সৈন্যদের পাশাপাশি যুদ্ধ না করত, ভারতের অধিবাসিরা তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়ে আমাদের নাগরিকদের না খাওয়াত, তাহলে আমাদের এই সংগ্রাম অনেক দিন চলত। স্বাধীনতা নিশ্চয়ই আসত। কিন্তু আমাদের কি হত বলা যায় না। এজন্য আমি নিশ্চয়ই শ্রীমতি গান্ধী, ভারতের জনসাধারণ বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসামের জনসাধারণকে ধন্যবাদ জানাই এবং তিনি আসছিলেন, আমিও ভারতে গিয়েছিলাম আপনারা জানেন, আপনাদের পক্ষ থেকে কোলকাতায় আমি লেখা পড়া করেছি। কেহ আপনারা জানেন কোলকাতার রাস্তা আমি সবই চিনি। কোলকাতায় আমি রাজনীতি কর্মী ছিলাম সাইকেল নিয়ে পথে ঘাটে ঘুরতাম। এর আগে ১৯৩৮ সালেও আমি একবার জেলে গিয়েছিলাম । যাক সে কথী। তারপর আমরা মৈত্রি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি ভারতের সঙ্গে। কারণ ভিতরের ব্যাপারে কেউ হস্তক্ষেপ করবে না। বহু রাষ্ট্রের সাথে আমরা পাশাপাশি বাস করব। আমি সোভিয়েত গিয়েছিলাম। সোভিয়েতের জনসাধারণ এবং সরকার, শুধু যে আমাদের সাহায্য করেছিলেন তাই নয় । যখন সংগ্রাম করছিল বাংলাদেশের জনসাধারণ। যখন আমাকে এখান থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় মেশিন গান দিয়ে, তখন প্রথম দেশ, প্রথম দেশের প্রথম নেতা হিসেবে গ্রেফতারের প্রতিবাদ করে ইয়াহিয়া খানের কাছে অনেকে চিঠি পাঠান এবং মানুষ খুন বন্ধ করার আবেদনও করেন। সোভিয়েত রাশিয়াকে বিশেষ করে ধন্যবাদ দিব এবং যে বিশেষ সম্মান ও ভালবাসা আমাকে দেখিয়েছেন আমি মস্কোতে যাবার পরে। সেজন্য আমি তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। যে সমস্ত দেশ আমাদের ফলোআপ। দিচ্ছেন তাদেরও আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। তবে আমার আমাদের বৈদেশিক নীতি পরিষ্কার আয়নার মতো। কোনো কিন্তু এর মধ্যে নাই। ইংরেজিতে বলি ইন্ডিপেন্ডেন্ট নিউট্রয়াল ফরেন পলিসি । পূর্ণ সহঅবস্থানে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা যে সমস্ত দেশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন করবে। বাংলাদেশের জনসাধারণ তাদের সমর্থন জানাবে। আমরা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিরুদ্ধে এটা পরিষ্কার যে কারো বিরুদ্ধে আমাদের শত্রুতা নেই। আমরা শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানে বিশ্বাস করি। আমার নতুন দেশ, আমার ভস্মিভূত অর্থনীতি, ধ্বংসস্তুপের মধ্যে আমার দেশ হয়েছে। লঞ্চ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ না খাওয়া, গ্রামে গ্রামে হাহাকার গৃহহারার আর্তনাদ। বেকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পয়সা নাই, ট্যাক্স ধরতে পারি না, সরকার চালানো কষ্টকর, মানুষকে খুশি করতে পারি না নানা অসুবিধার মধ্যে আমরা চলছি। এই সুযোগ নিয়ে একদল ষড়যন্ত্রকারী যারা কোনো দিন আমাদের সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেয় নি, যারা আমাদের গণআন্দোলন বানচাল করার চেষ্টা করছিল, তারা সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে। আমার ভাই ও বোনেরা, আপনাদের কাছে আমার আবেদন-ছাত্র-ছাত্রী ভাই ও বোনেরা, আমি আশা করব যে কথা আপনাদের সভাপতি বলছেন। তার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। যারা আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তারা হাতে হাত মিলিয়ে গলায় গলা মিলিয়ে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে এগিয়ে যেতে হবে। এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই। আমি সকলের কোঅপারেশন ও সহযোগিতা চাই। সকলের কাছে যদি দরকার হয় বুদ্ধি হাওলাত নিব-তাতে আমি রাজি আছি। যদি কেও গোপনে গোপনে আমাকে এডভাইস দিতে চান, তাতেও আমি রাজি আছি। যারা তলে তলে গুজগুজ খুচখুচ করেন, তাদের সাথে পারব না। সেটা আমার দ্বারা হবে না, আমি একঘেয়ো মানুষ, ফট করে নেমে যাব ময়দানে, আবার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শুরু হয়ে যাবে, কেউ ঠেকাতে পারবে না। আজ সুযোগ পেয়ে গেছেন, আশ্চর্য হয়ে যাই। এক বিপ্লবীদের নামে রাজাকার আর আলবদর যোগ হয়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। বিপ্লবীদের আগে রেখে আলবদর, রাজাকার পেছনে লাইন দিচ্ছে। এটা হলোনা, ওটা হলোনা- তোমার বাবার মাথা হবে, আরে এখন ও যে বাংলাদেশ বাইচ্যা রইছে এত্ত ভাগ্য ভালো। তোমাদের যে এখন পর্যন্ত আমরা যে ৭১ সালে স্বাধীনতা নিয়ে এসেছি, তারপরেও যে গুলি করে মারি নাই-এটা আমার দুর্বলতা নয়। দরকার হলে হতে পারে জনগণ করবে। আমি ঠেকাতে পারব না। মনে কর না যে সমাজতন্ত্র করতে যাচ্ছি, সেজন্য সমাজতন্ত্র করতে যদি যে কোনো পথ আমাদের অবলম্বন করতে হয়, করবই। কেউ ঠেকাতে পারবে । এটা আমার এবং আমার দলের বিশ্বাস এবং জনগণের বিশ্বাস। ছাত্র ভাইদের ও বোনেরা, এক ভাই বলেছে যে শিক্ষা তিন মাসের শিক্ষা দিয়ে কি করব? স্কুল নাই,কলেজ নাই, ল্যাবরেটরি ভেঙে দিছে, টিচার মেরে ফেলে দিছে, কিছু নেই। তিন মাসের মধ্যে যে আপনারা এখানে বসে সভা করছেন। আল্লাহর কাছে ধন্যবাদ দেন। কারণ যে অস্ত্র আপনারা নিয়ে যুদ্ধ করেছেন, আমার কাছে কাগজ আছে, সেই কাগজ এখন বাহির করব না, ভবিষ্যতে করব। জেনারেল ফরমান আলী খানের হাতের লেখা এ অস্ত্র আমি অমুকের কাছে দিয়ে দিচ্ছি। একটা গ্রুপ, তারা সম্মানে এখন পর্যন্ত দেশের মধ্যে আছে এবং তিনিও বলছেন, তার হাতের লেখা পেয়েছি। তাহলে বুঝতেই পারছেন, ষড়যন্ত্র কিভাবে হচ্ছে। শিক্ষা কমিশন গঠন করা হবে। শিক্ষা হবে গণমুখি শিক্ষা এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সঙ্গে মিল রেখেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য শ্রীঘ্রই একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হবে এবং সেখানে আপনাদের প্রত্যেকেরই অধিকার থাকবে। আপনাদের মতামত দেয়ার। অনেকে বলেন যে, শিক্ষা কমিশনের এই প্রতিনিধি দিতে হবে। শিক্ষক প্রতিনিধি দিতে হবে, এই প্রতিনিধি নিতে হবে, তথ্য প্রতিনিধি নিতে হবে। শিক্ষক প্রতিনিধি নিতে হবে। সব নিলেতো আর কমিশন হয় না আবার এসেম্বলি হয়ে যায়। কমিশন থাকবে, যদি আপনারা যে দল, যে মত, যে ছাত্র প্রতিষ্ঠান যা আছেন, আপনাদের মতামত দিয়ে আপনারা লেখেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন-কমিশনকে সময় দেয়া হবে। আপনাদেরকে সময় দেয়া হবে। আপনাদের মতো দেয়া হবে। আপনাদের সব সুবিধা। দেয়া হবে। আপনারা বলেন, তারপরে কমিশন যখন রিপোর্ট সাবমিট করবে জনগণের কাছে পেশ করব। আমরাও এর মধ্যে ইন্টারফেয়ার করব না। আমরা চাই গণমুখি শিক্ষা। আমরা আর ভবিষ্যতে আল্লাহর ওয়াস্তে কেরানী সাহেব পয়দা করার শিক্ষা আর চাই না। আমাদের শিখাতে হবে গণমুখি শিক্ষা এবং আমাদের নিচের তলার লোক যারা গ্রামে গ্রামে বাস করে তারা যেন শিক্ষার সুযোগ পায়- সেদিকে নজর রাখতে হবে। আমি আশা করি আমার বন্ধুরা তা স্বীকার করবে, যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সম্পাদক সাহেব, আশা করি তিনি তা গ্রহণ করবেন এবং গ্রহণ করা উচিৎ হবে। তার পরে আমাদের বক্তব্যে আমরা বৈদেশিক নীতি বলেছি, অর্থনীতি বলেছি। গণতন্ত্র ? হা গণতন্ত্রও বলেছি। গণতন্ত্র না হলে কেমন করে হয়। আমরা যে বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষের মৈত্রী করেছি দু’একটা পত্রিকা এত গণতন্ত্র হয়ে গেছে! সার্বক্ষণিক কটাক্ষ লেখা শুরু হয়ে গেছে এবং তারা এখানে বসে ইন্টারকন্টিনেন্টালে বসে একটু কিছু গরম পানি খান আর বাহিরের কাছে বাংলাদেশ সম্বন্ধে অনেক কথা বলে দেন। তার মানে গণতন্ত্র নয়। যে গণতন্ত্র হ্যা…নিশ্চয়ই…। কিন্তু আমরা নতুন না যে মাত্র তিন মাস অনধিক আমরা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে স্বাধীনতা পেয়েছি। এথন বন্দুক নিয়ে ঘুরবেন, বন্দুক নিয়ে গুন্ডামি করবেন, লুট করবেন-তারে পুলিশ মারতে পারবে না, জনগণ মারতে পারবে না। এই যদি গণতন্ত্র হয়, সেই গণতন্ত্র নিশ্চয়ই আপনারা চান না। কেউ চায় না। এটা গণতন্ত্র না। তাদের দমন করার জন্য নিশ্চয়ই আপনারা সাহায্য করবেন। এই সমাজ প্রতিরোধে এবং সেটা পুলিশের চেয়েও জনগণের বিশেষ করে ছাত্র সমাজ, সুধী সমাজ এবং কৃষক সমাজের এগিয়ে আসতে হবে। যাতে শান্তি দেশের মধ্যে বজায় থাকে। শান্তি বজায় না থাকলে কোনো কাজই দুনিয়ায় করা যায় না। ভাইয়েরা বোনেরা আমার, আমি আপনাদের আর মূল্যবান সময় নষ্ট করতে চাই না। আমাকে আপনারা যে সমর্থন দিচ্ছেন এবং আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও দিবেন, এই সম্বন্ধে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস আছে। এই জন্য বিশ্বাস আছে, এটা আগেও বলেছি-আপনাদের সঙ্গে যে আদর্শ নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি, তাতে আপনারা বিশ্বাস করেন এবং নিশ্চয়ই সমর্থন করবেন এই সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ নাই। তবে আপনাদের হুঁশিয়ার করে দিতে চাই যে, যারা এই দেশকে নষ্ট করতে চায়, বাচাল করতে চায়, দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, যারা এদেশে মাঝে মাঝে গোপনে গোপনে পোষ্টার ছাপিয়ে, লিফলেট ছাপিয়ে এবং বিদেশি দালাল হিসাবে কাজ করে তাদের কাছে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করেন-আমিতো আপনাদের সাথে আছি। নিশ্চয়ই তাদের দমন করতে হবে- এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই। আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা, যে চারটি স্তম্ভের ওপর বাংলাদেশ স্বাধীন আন্দোলন হয়েছে। এই চারটি স্তম্ভের ওপর স্বাধীনতা চলবে। আপনারা জানেন জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এটা আমি বিশ্বাস করি, আমার দল বিশ্বাস করে, জনগণ বিশ্বাস করে, আশা করি আপনারাও বিশ্বাস করেন। আমি আপনাদের আবারও ধন্যবাদ দিচ্ছি, তবে আমার এক ভাই প্রস্তাব দিয়েছেন যে দুই ছাত্র প্রতিষ্ঠান নিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে নিয়ে কাজ করব কেমন করে। আমি নিশ্চয়ই আশা করব যে, ছাত্র ইউনিয়ন বা ছাত্রলীগ ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান এবং আমি জানি ছাত্র লীগের সঙ্গে আগে জড়িত ছিলাম, হ্যা প্রতিষ্ঠাতাও ছিলাম। আমি আশা করি নীতি০র সঙ্গে যেহেতু আপনাদের আছে। আদর্শের যেহেতু মিল আছে। আপনারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশে সমাজতন্ত্র গঠন করার জন্য দুস্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে এবং দেশের মানুষকে নিয়ে দেশে শোষণহীন সমাজ গঠন করার জন্য কাধে কাধ মিলিয়ে, গলায় গলা মলিয়ে, অগ্রসর হবেন- এটাই আমি আশা করি। আপনাদের মধ্যে সামান্য বিষয় নিয়ে যেন ভুল বোঝাবুঝি না হয়, সেটাই আমি আশা করি।

রেফারেন্স: ৯ এপ্রিল ১৯৭২, ইত্তেফাক
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!