You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.04.09 | পার্লামেন্টারী পার্টির সর্বসম্মত প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু নেতা নির্বাচিত | ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

পার্লামেন্টারী পার্টির সর্বসম্মত প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু নেতা নির্বাচিত

বাংলাদেশ গণপরিষদ ভবনের কমিটি রুমে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা নির্বাচিত। হয়েছেন। সভায় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে পার্লামেন্টারী সহকারী নেতা নির্বাচন করা হয়েছে। শাহ মোয়জ্জেম হোসেন পার্টির নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নাম প্রস্তাব করেছিলেন। জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রস্তাব করেছিলেন সহকারী নেতা হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলামের নাম। পার্লামেন্ট পার্টির চিফ হুইপ ও হুইপ নির্বাচনের জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। পার্লামেন্টারী পার্টির সভা প্রারম্ভে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে লক্ষ লক্ষ বীর যোদ্ধা অত্মাহুতি দিয়েছেন, তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও আত্মার মাগফিরাত কামনা করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় এক বিশেষ প্রস্তাবে শহীদ পরিষদ সদস্যদের প্রতিও গভীর শ্রদ্ধা ও তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়। পার্লামেন্টারী পার্টির সভায় পরিষদের কার্যবিধির, স্পিকার ও ডেপুটি- স্পিকার নির্বাচনের বিষয়ে আলোচিত হয়। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসীরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে এগিয়ে আসুন- বঙ্গবন্ধু
মতের যেখানে মিল আছে, সেখানে মনের মিল হয়। কাজেই যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে বাংলাদেশে শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলুন।” বাংলাদেশের ছাত্র ইউনিয়নের ২০ বৎসর পূর্তি উৎসব ও ত্রয়োদশ সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই অহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ বলে আমি মনে করি। তিনি সমাজতন্ত্র বানচালের ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং ভুল বুঝাবুঝি পরিহার করে আদর্শগত মিলের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নকে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান। অধ্যাপক মোজাফফরের বাংলাদেশ ন্যাপ ও মণি সিংয়ের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে বলে তিনি জানান। বঙ্গবন্ধু কতিপয় অতি বিপ্লবী কার্যকলাপের তীব্র সমলোচনা করে বলেন যে, গণতন্ত্রের দেশে তাদের কথা বলার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে সত্য, কিন্তু হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গরম পানি খেয়ে বাংলাদেশি সাংবাদিকদের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে নানান কথা বলার জন্য, বাংলাদেশিদের দালালী করার জন্য বা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য নয়। তিনি বলেন, কোনো রূপ বাড়াবাড়ি সহ্য করা হবে না। বই পড়া সমাজতন্ত্রীদের অশুভ উদ্দেশ্য সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, বই পড়ে কোনো আন্দোলন হয় না। আন্দোলনের নিজস্ব ধারা আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন যে, জেনারেল রাও ফরমান আলীর হাতে লিখিত একটি চিঠি তার নিকট আছে। চিঠিতে সবুজ বাংলাকে লাল করে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে একটি গ্রুপের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছিল। তিনি এসব দুষ্কৃতকারীকে দমন করার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান। চীন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, বাংলার মানুষকে হত্যা করার জন্য চীন পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বর শাসকদের অস্ত্র দিয়েছিল। যুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্ত্রের শতকরা ৬০ ভাগ চীনা ও ৪০ ভাগ মার্কিন বলে তিনি জনান। মার্কিন স্বীকৃতির জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান আর পুরাতন সাম্রাজ্যবাদী খেলা শুরু না করার জন্য নিক্সন প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার আহ্বান জানিয়ে বলেন যে, আমরা শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানে বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত ও অন্যান্য দেশ, যারা খাদ্য সাহায্য করছে তাদেরকে ধন্যবাদ জানান। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়ের জনগণকে তিনি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন।যে, বাংলাদেশ স্বাধীন নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবে এবং বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণের পাশে দাড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে। বঙ্গবন্ধু শিক্ষা প্রসঙ্গে বলেন যে, কেরানী সৃষ্টিকারী শিক্ষা ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন করে শিক্ষাকে গণমুখী করতে হবে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, সাত দিনের মধ্যে জিনিসপত্রের দাম না কমলে হোলসেলার ও ডিস্ট্রিবিউটরদের লাইসেন্স বাতিল করে দেয়া হবে। তিনি বলেন যে, বিভিন্ন কলকারখানার প্রশাসকরা কারখানার মালপত্র বিক্রি করে দিচ্ছে। শীঘ্রই এই সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শ্রমিকদের প্রতি বঙ্গবন্ধু বলেন যে, ঘেরাও করে বেতন বাড়ালে সমাজতন্ত্র আসবে না। মুখে মুখে সমাজতন্ত্র আসবে না, এর জন্য কষ্ট করতে হবে। তিনি ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশের সম্পদ সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্পদ। ভাষণের সমাপ্তিতে বঙ্গবন্ধু আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলেন যে, দেশের মানুষ পেট ভরে খেতে না পারলে, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত না হলে আমি শান্তি পাবো না। আপনারাও পাবেন না, তাই বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করুন। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি জনাব নুরুল ইসলাম অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সভার প্রারম্ভে স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের স্মরণে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালনের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান জনাব শফিউল হাসান সোভিয়েত ইউনিয়ন, গণপ্রজাতান্ত্রিক জার্মানি ও ভারত হতে আগত যুবক প্রতিনিধি ও উপস্থিত বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীবৃন্দ, অন্যান্য ছাত্র রাজনৈতিক দলের নেতাদের অভিনন্দন জানান। ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জনাব মুজাহিদুল ইসলাম (সেলিম) একটি কর্মসূচির ভিত্তিতে সমগ্র ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। ছাত্রলীগের প্রতি ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন যে, নিজেদের মধ্যে বিভেদ থাকলে সমাজতন্ত্র আসবে না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নতুন দেশ, নতুন সমাজ, নতুন সভ্যতা গড়ে তোলার শপথ গ্রহণ করে তিনি সুষ্ঠুনীতির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। জনাব মুজাহিদুল ইসলাম মার্কিন ও চীন সাম্রাজ্যবাদের তীব্র নিন্দা করেন এবং স্বাধীনতার নতুন শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার আহ্বান জানান। তিনি শিক্ষার ক্ষেত্রে মৌলিক বিপ্লবী নীতি গ্রহণের আহ্বান জানান এবং মুনাফাখোর, চোরাকারবারী ও সমাজ বিরোধীদের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজের পক্ষ হতে সর্বশক্তি নিয়োগের সংকল্প ঘোষণা করেন।
নূরে আলম সিদ্দিকী :
বাংলাদেশ ছাত্র লীগের সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের আমন্ত্রণে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। তিনি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজ বিরোধী ঠেকানোর সংকল্প ঘোষণা করে তিনি বলেন যে, স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষ হয়েছে। কিন্তু বাংলার যুবসমাজ মুক্তি সংগ্রাম শুরু করেছে। সুযোগ সন্ধানী ফাঁদ পেতে বসে আছে, কিন্তু ছাত্র সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে। শশাষণের পথ বন্ধ করবে এবং সমাজতন্ত্র কায়েম করবে। সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি নতুন দিকের সূচনা করেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন যে, নেতৃত্বের ঐক্য নয়, সর্ব পর্যায়ের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন যে, তার প্রতিষ্ঠান ঐক্যের বিরোধী নয়, তবে কিছুটা বন্ধুত্বসুলভ প্রতিযোগিতা থাকা ভালো। জনাব নূরে আলম কামনা করেন যে, শহুরে নেতৃত্বের বদলে গ্রাম হতে নেতৃত্ব আসুক। দুর্নীতি অনাচার ও দুস্কৃতির বিরুদ্ধে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, মেহনতী মানুষের জন্য দেশকে গড়ে তুলতে হবে- বাঙালি আদমজীদের জন্য নয়।
অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ :
বাংলাদেশ ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ বলেন,যে আশা-আকাক্ষা নিয়ে মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মাহুতি দিয়েছে তাদের সেই স্বপ্নকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাস্তবায়িত করতে হবে। তিনি বলেন যে, জামাত, পি, ডি, পি, আলবদর রাজাকাররা আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের সাথে অতি বিপ্লবীরা ষড়যন্ত্রে মেতেছে। ওদিকে আন্তজাতিক পর্যায়ে মার্কিন-চীন চক্রান্ত চালাচ্ছে। সি, আই, এ-র এজেন্টদের মাধ্যমে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধিয়ে সাম্প্রদায়িকতা ও জেলায় জেলায় বিদ্বেষ প্রচার, বিভেদ সৃষ্টি করছে এবং ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচার করছে।

রেফারেন্স: ৯ এপ্রিল ১৯৭২, ইত্তেফাক
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ