বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
জাতির জনক ও আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা প্রধান মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (সোমবার) বাংলাদেশ গণ-পরিষদের প্রথম ঐতিহাসিক অধিবেশনে জাতিকে শীঘ্রই একটি গণমুখী শাসনতন্ত্র দানের আশ্বাস প্রদান করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে জনগণের মৌলিক অধিকার, জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দেওয়া হবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদ বীরদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে পরিষদে শোক প্রস্তাব পেশকালে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল, ধর্ম ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের উপযোগী করে প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্র রচিত হবে। এতে সকল শ্রেণির মতামত গ্রহণ করা হবে। গণ-পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমাদের কর্তব্য সময় নষ্ট না করে সংবিধান রচনা করা, যার মধ্য দিয়ে দেশে স্থিতিশীলতা ও শান্তি ফিরে আসতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, আমাদের আদর্শ ও নীতি হলো গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। উক্ত চারটি স্তম্ভ ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রে সন্নিবেশিত হবে। বঙ্গবন্ধু জানান এর ফল ভবিষ্যত বংশধরগণ ভোগ করবে। বঙ্গবন্ধু আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলেন, বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর বুকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ গণ-পরিষদের সদস্য হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। তিনি বলেন, জনসাধারণ রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে। ৩০ লক্ষ ভাই-বোনের রক্ত ও লক্ষ লক্ষ নারীর ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা এই স্বাধীনতা পেয়েছি। তিনি আরও বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, যাদের রক্তে এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, তা যেন বৃথা না যায়। বঙ্গবন্ধু বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে রক্ত দিয়েছে এই দেশের মেহনতি শ্রমিক, কৃষক, মজুর, ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, বেঙ্গল রেজিনেন্ট, সাবেক ই, পি, আর, পুলিশ ও আনসারবাহিনীর লোক এবং সরকারি কর্মচারীরা। পরিষদের ১৭ মিনিটকাল বক্তৃতাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস উল্লেখ করে বলেন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বড় করুণ ইতিহাস। ২৫ মার্চের রাত্রের ঘটনা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, জল্লাদ ইয়াহিয়া বাহিনী রাতের অন্ধকারে নিরীহ জনসাধারণের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরা অত্যন্ত অমানসিকভাবে নিরীহ জনগণকে হত্যা করে। দুধের শিশুরাও তাদের হাত থেকে রক্ষা পায় নাই। পরিষদ সদস্যরা ঘৃণায় তখন ‘শেম’ ‘শেম’ ধ্বণি করে বর্বর পাকিস্তানবাহিনীর প্রতি ধিক্কার দিচ্ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান জানান, পাকিস্তানবাহিনীর বর্বতার মতো এমন ঘৃণ্য নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে নাই। শেষ নির্দেশ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিষদে জানান, বর্বর পাকিস্তানবাহিনী যখন শহরে হামলা করে তখন তিনি চট্টগাম টেলিফোনে সংগ্রামের জন্য সর্বশেষ নির্দেশ দিয়ে যান। তার সেই সর্বশেষ নির্দেশ অনুযায়ী একই সঙ্গে সর্বত্র দস্যুদের বিরুদ্ধে এই দেশের সংগ্রামী বীর যোদ্ধারা রুখে দাঁড়ায়। বক্তৃতা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, তার জনগণ ও সরকার, রাশিয়া,জাপান, জার্মান, ইংল্যান্ড ও অন্যান্য সাহায্যকারী দেশের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। শাহ আবদুল হালিম স্পীকার ও মোহাম্মদউল্লাহ ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত গণমুখী শাসনতন্ত্র। মৌলিক অধিকার ও জানমালের নিশ্চয়তা থাকবে- মুক্ত বাংলার প্রথম গণপরিষদ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা । বাঙালি জাতির স্বপ্ন ও সাধনার সফল উত্তরণে স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌম গণপরিষদের প্রথম ঐতিহাসিক অধিবেশন শুরু হয়। মুক্ত বাংলার গণপ্রতিনিধিদের এই প্রথম নিয়মতান্ত্রিক সমাবেশ বিপ্লবী বাংলার চিরায়ত সংগ্রামী চেতনার নবতর উজ্জীবনে মুখরিত হয়ে ওঠে। পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা রূপে দেশের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রের রূপরেখা নির্দেশ করে পরিষদে বঙ্গবন্ধু প্রথম ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলার । আপামর গণমানুষের কষ্ঠ প্রতিধ্বম্বিত হয়, জনগণের প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে জনগণের নীরব ভাষা সোচ্চার হয়ে ওঠে। নতুন রাষ্ট্রের নতুন পার্লামেন্টের প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, দলমত সম্প্রদায়। নিশ্চয়তা থাকবে। অধিবেশনে পরিষদের স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার নির্বাচন, রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা। ও ধর্মনির্বিশেষে শাসনতন্ত্রে সকলের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে, প্রতিটি নাগরিকের জানমালের। সংগ্রামের শহীদানের প্রতি শ্রদ্ধা ও বীর জনতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রস্তাব পাশ, পরিষদের। কার্যবিধি প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে গণপরিষদে কার্যপ্রণালী বিধি গ্রহণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। প্রথম গণপরিষদের অধিবেশন ২ ঘন্টা ৪৫ মিনিট কাল স্থায়ী হয়। অতঃপর অধিবেশন আজ (মঙ্গলবার) সকাল ১০টা পর্যন্ত মুলতবী ঘোষণা করা হয়। গণপরিষদ অধিবেশনে রংপুরের জনাব শাহ আবদুল হালিম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিষদের স্পীকার এবং নোয়াখালির জনাব মোহাম্মদউল্লাহ ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত হয়েছেন। স্পীকারের পদের জন্য পরিষদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনাব শাহ আবদুল হালিমের নাম প্রস্তাব করেন। এবং সহকারী নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম উক্ত প্রস্তাব সমর্থন করেন। অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ডেপুটি স্পীকার পদের জন্য জনাব মোহাম্মদউল্লাহর নাম প্রস্তাব করেন। যোগাযোগমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী উক্ত প্রস্তাব সমর্থন করেন। পরিষদের একমাত্র বিরোধী দলের সদস্য ছিলেন মোজাফফর ন্যাপের সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। ১৭০ আসন বিশিষ্ট সাবেক পূর্ব পাকিস্তান পরিষদ কক্ষকে ৪৭০ জন সদস্যের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরিষদে ৪৩৯ জন সদস্যের জন্য মাত্র ১৫০টি মাইক আছে। এর মধ্যে যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য আবার অনেক গুলি কাজ করে নাই। গতকাল গণপরিষদের অধিবেশনের কার্যক্রম দেখার জন্য দর্শকের গেলারিতে তিল ধারণের ঠাই ছিল না। ঢাকাস্থ বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রতিনিধিসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অতিথিদের গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন সদস্য এই দিনে সংক্ষিপ্ত অধিবেশনের আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। দৈনিক ইত্তেফাকের সাবেক চীফ রিপোর্টার ব্রাহ্মণবাড়িয়া হতে নির্বাচিত সদস্য জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুর এক বৈধতা প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন যে, পরিষদে ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ বলে সম্বােধনের পরিবর্তে “মাননীয় সদস্য বা সদস্যা” বলে সম্ভাষিত করা উচিত। কার্যবিধি সংক্রান্ত প্রস্তাব :
এরপর আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন পরিষদ কর্তৃক কার্যপ্রণালী বিধি প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত এ কার্যপ্রণালী, যা প্রত্যেক সদস্যের সম্মুখে দেয়া হয়েছে সেই কার্য প্রণালী বিধি গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাব উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে যশোরের জনাব ইকবাল আনোয়ারুল ইসলাম আপত্তি তোলেন যে, এই মর্মে ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপতির এক আদেশ জারি রয়েছে। ড. কামাল হোসেন সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে, যদি পরিষদ এই বিধি অনুমোদন করেন, তা হলে পরিষদের কার্য নির্বাহের জন্য রাষ্ট্রপতির আদেশ জারির প্রশ্ন ওঠে না। পরিষদ সদস্য জনাব আসাদুজ্জামান আইন মন্ত্রীর বক্তব্য মতবৈধতা প্রকাশ করে বলেন যে, পরিষদের কার্যক্রম রাষ্ট্রপতির আদেশ অনুযায়ী পরিচিত হওয়া উচিত। কুষ্টিয়ার জনাব আমিরুল ইসলাম জনাব আসাদুজ্জামানের বক্তব্যের বিরোধীতা করেন। এবং রাষ্ট্রপতির আদেশে ১৫(১) ধারার উল্লেখ করে বলেন যে, পরিষদ কার্যক্রম পরিষদের কার্যবিধির দ্বারাই পরিচালিত হবে। জনাব আসাদুজ্জামান পুনরায় বৈধতার প্রশ্ন উথাপন করে বলেন যে,
পরিষদের সামনে প্রদত্ত কার্যবিধি যদি গৃহীত হয় তা হলে পরিষদের। সদস্যদের অধিকার ও সুযোগ-হাস করা হবে। জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুর এক বৈধতার প্রশ্ন উথাপন। প্রস্তাব বিবেচনা করার অধিকার পরিষদের রয়েছে। তিনি বলেন যে, পরিষদ কার্যবিধি গ্রহণ করতে করে বলেন যে, যেহেতু সদস্যগণ জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছে, সেজন্য আইনমন্ত্রী কর্তৃক উত্থাপিত। পারে। পাবনার জনাব আবদুল মোমিন তালুকদার আইন মন্ত্রীকে সমর্থন করে বলেন, যেহেতু পরিষদ। সার্বভৌম, সেহেতু তা নিজের বিধি গঠন ও গ্রহণ করতে পারে। সমস্ত বক্তব্যের পর্যালোচনা করে। পরিষদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, বিতর্ক মূলক ধরনের কোনো বিষয় আলোচনা। হয়েছে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি বলেন যে, সাময়িক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতির পক্ষ হতে আইন মন্ত্রীর কার্যবিধি প্রণালী পরিষদে পেশ করেছেন। পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। সাময়িকভাবে এই বিধি গৃহীত হওয়া উচিত এবং তা সংশোধন করা যেতে পারে অথবা পরে কোনো। উপযুক্ত সময়ে সদস্যগণ বিধি প্রণয়ন করতে পারেন বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, এই ধরনের আলোচনায় সময় অপচয় করা উচিত নয়। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের পর কার্যপ্রণালী বিধি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার নির্বাচন :
এরপর পরিষদের সভাপতি মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ঘোষণা করেন যে, পরিষদের স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই সম্পর্কে প্রস্তাব পেশের জন্য চেয়ারম্যান ১৫ মিনিট সময় প্রদান করেন। নির্ধারিত সময়ের পর সভাপতি ঘোষণা করেন যে, স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার পদে প্রত্যেকটির জন্যে তিনি একটি করে প্রস্তাব পেয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, পরিষদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্পীকার পদের জন্য রংপুরের শাহ আবদুল হালিমের নাম প্রস্তাব করেছেন ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রস্তাব সমর্থন করেছেন। স্পীকারের নাম ঘোষণার পূর্বে পরিষদে পাস’ ধ্বনি শোনা যায়। স্পীকার পদের জন্যে পাল্টা কোনো প্রস্তাব না থাকায় শাহ আবদুল হালিম স্পীকার নির্বাচিত হন। পরে সভাপতি জনাব তাজউদ্দিন আহমদের প্রস্তাব ও জনাব মনসুর আলীর সমর্থনক্রমে নোয়াখালির জনাব মোহাম্মদ উল্লাহকে ডেপুটি স্পীকার হিসেবে নির্বাচিত করেন। পরিষদের স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকারের নির্বাচনের পরে মওলানা আব্দুল রশিদ তর্কবাগীশ আসন ত্যাগ করেন ও নবনির্বাচিত স্পীকার শাহ আবদুল হালিম স্পীকারের আসন গ্রহণ করেন।
নয়া স্পীকারের বক্তৃতা প্রকাশ :
নবনির্বাচিত স্পীকার আবদুল হামিদ তার উর্ধ্ব ধ্বনির ভাষণে পরিষদের স্পীকার পদে তাকে নির্বাচিত করায় তিনি সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, সদস্যবৃন্দের সহযোগিতা লাভ করলে তিনি নিরপেক্ষভাবে তাহার দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবেন। শাহ আব্দুল হালিম পরিষদকে নিশ্চয়তা প্রদান করেন যে, সদস্যদের অধিকার ও পরিষদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মোজাফফর গ্রুপ) একমাত্র নির্বাচিত সদস্য সিলেটের শ্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত নবনির্বাচিত স্পীকার শাহ আব্দুল হামিদ ও ডেপুটি স্পীকার মোহাম্মদ উল্লাহকে অভিনন্দন জানান। তিনি পার্লামেন্টের ইতিহাসে স্পীকারের ভূমিকা উল্লেখ করে বলেন যে, পরিষদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখাই স্পীকারের প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আশা প্রকাশ করেন যে, নব নির্বাচিত মাননীয় স্পীকার এই ঐতিহ্য বজায় রাখবেন। ২০ মিনিট মুলতবী থাকার পর ১১টা ৫৫ মিনিটে পুনরায় অধিবেশন শুরু হয়।
তাহের উদ্দিন ঠাকুর : গণপরিষদ সদস্য জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুর বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন যে, পরিষদ কক্ষে স্পীকার প্রবেশ করলে যাতে সদস্যবৃন্দ ও অন্যান্য দর্শক দাঁড়িয়ে তার প্রতি সম্মান পরিদর্শন করতে পারে, সেজন্য স্পীকারের আগমন পূর্বাহ্নে ঘোষণা করা উচিত। পরিষদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুরের বক্তব্য সমর্থন করে বলেন যে, ভবিষ্যতে পরিষদ কক্ষে স্পীকার আগমনের কথা পূর্বাহ্নেই ঘোষণা করতে হবে। শোক প্রস্তাব : এরপর পরিষদের নেতা পরিষদ সদস্যের মৃত্যুতে একটি শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পরিষদের পরলোকগত দশ জন সদস্যদের মধ্যে আট জন পাকিস্তানবাহিনীর হাতে নিহত ও দুইজন স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এই প্রস্তাব বঙ্গবন্ধু পরলোকগত সদস্যদের পরিবার বর্গের প্রতি পরিষদে সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় পরিষদের এক মিনিট নীরবতা পালন করতে হয়। সৈয়দ নজরুলঃ শোক প্রস্তাব পেশকালে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন যে, আজ জাতি অতি শ্রদ্ধার সাথে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, কর্মী, ছাত্র যুবক, সাবেক ইপিআর, পুলিশ, মুক্তিযোদ্ধাদের মহান আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করছি। তিনি বলেন যে, ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন এবং ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে গৃহীত ও সমর্থিত হয়েছিল তা গণপরিষদ মহল কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। তিনি বলেন যে, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে আমরা একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছি। শোক প্রস্তাবের সংশোধনী : সৈয়দ নজরুল ইসলামের এই প্রস্তাবের পর বেশ কতিপয় সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করা হয়। দিনাজপুরের জনাব আজিজুর রহমান এক সংশোধনী প্রস্তাবে বলেন যে, প্রস্ত বে “বুদ্ধিজীবী’ কথাটা রাখতে হবে। কুষ্টিয়ার গণ-পরিষদ সদস্য ড. আসহাবুল হক অপর একটি সংশোধনীয় প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেন যে, প্রস্তাবে আনসার এবং মুজাহিদ কথাটি সংযোজন করতে হবে। জেনারেল এম, এ, জি ওসমানী অপর এক সংশোধনী উত্থাপন করে বলেন যে, প্রস্তাবে “ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট” কথাটি রাখতে হবে। সকল সংশোধনী প্রস্তাবই গৃহীত হয়। এই পর্যায়ে পরিষদ সদস্য বেগম নুরজাহান মুর্শেদ জানতে চান কীভাবে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। পরিষদের নেতা বঙ্গবন্ধু বলেন যে, যেহেতু পরিষদে তখন শোক প্রস্তাব হচ্ছে সেহেতু তখন অন্য বিষয়ে আলোচনা করা সঠিক হবে না। বঙ্গবন্ধু বলেন, তবে মাননীয় সদস্য যদি স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে কিছু জানাতে চান তা হলে এই আলোচনা করা যেতে পারে, কিন্তু এই সময় নয়। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, প্রত্যেক সদস্যের অনুধাবন করা উচিত যে, কার্য প্রণালী বিধির দ্বারা আমাদের পরিচালিত হতে হবে। পরিষদের অধিবেশন দুপুর ১২টা ৫২ মিনিটে মুলতবী ঘোষণা করা হয়। অদ্য (মঙ্গলবার) সকাল ১০ টায় পুনরায় অধিবেশন বসবে।
রেফারেন্স: ১০ এপ্রিল ১৯৭২, ইত্তেফাক
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ