গণপরিষদ একটা সুপ্রীম বডি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঃ জনাব স্পীকার সাহেব, আপনার মাধ্যমে অনুরোধ জানাচ্ছি যে, ভবিষ্যতে আমার এই মাইকটি একটু উঁচু করে দেবেন, আমি মানুষ একটু বেশী লম্বা। জনাব স্পীকার সাহেব, আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য হচ্ছি। আমাদের ভুললে চলবে না এবং সদস্য ভাইদের আমি বলি। যে, আমরা গণপরিষদের সদস্য, সদস্যদের একটা বিধি প্রণালী আছে: এর বাইরে প্রশ্ন করবার অধিকার। নই এটা পার্লামেন্টারী কনভেনশন। আমি আপনার মাধ্যমে আমার সহকর্মীদের অনুরোধ করবো, দেখবেন, শেখার চেষ্টা করবেন। আমরা বহুদিন পার্লামেন্টারী কাজ করতে পারি নি, আমাদের অভ্যাস। খারাপ হয়ে গেছে। ১৯৫৮ সালের মার্শাল’ল জারীর পরে পার্লামেন্ট হয়নি। সেই জন্য আমরা সুযোগ। পাইনি পার্লামেন্টারী রাজনীতি কাকে বলে এবং গণপরিষদ কাকে বলে তা শিখবার। সেই জন্য আমাদের। কিছু অসুবিধা হয়। তাই বহুদিন পর সদস্যরা এসে কথা বলতে চায়, যদিও সেটা অনেক সময় বিধি বা। লস এর বাইরে হয়। আমি আপনার মাধ্যমে অনুরোধ করব যখন একজন কথা বলেন, তখন অন্য কারো বাধা দেওয়া উচিত নয়; এরূপ নিয়ম নাই। আমি আপনার মাধ্যমে জানতে চাই যে, গণপরিষদ একটা সুপ্রীম বডি, আমাদের ব্যবহারে বাইরে এমন কিছু প্রকাশ পাওয়া উচিত নয় যাতে জনসাধারণের কাছে আমাদের ইজ্জত নষ্ট হয়। আমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই যে, যেসব রুলস, বেগুলেশন এবং বিধি আছে, তা আপনি অনুসরণ করেন। আমি আপনাকে এই হাউসের পক্ষ থেকে কথা দিচ্ছি, আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করব। মেম্বরদের আর একটা বিষয়ে হুশিয়ার করতে চাই স্পীকার যখন কথা বলে, তখন আর কোন মেম্বরের অধিকার নাই কথা বলার। বললে আপনি মেহেরবানি করে তাকে পরিষদ থেকে বরে করে দিতে পারেন।
পরিষদ কমিটি গঠন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু:
জনাব স্পীকার সাহেব, আমি আপনার মাধ্যমে পরিষদ সদস্যদের আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি আশা করি আপনারা কিছু মনে করবেন না, অনেকদিন পর আমরা এখানে বসার সুযোগ পেয়েছি। তাই অনেক সময় আমরা পরিষদ বিধি না মেনে অনেক কথা বলে ফেলেছি, কিছুদিন আপনাকে এটুকু সহ্য করতে হবে। কারণ সদস্যরা বহুদিন পর এখানে বসবার সুযোগ পেয়েছেন। সকলে এখন পর্যন্ত সব জিনিস দেখবার সময় পান নাই- গণপরিষদ কার্যপ্রণালী বিধিতে কী আছে, তাও দেখবার সময় পান নাই। তাই মাঝে মাঝে দুই একটা কথা কেউ কেউ এদিক ওদিক বলে ফেলেছেন। আমি আপনার মাধ্যমে গণপরিষদ সদস্যদের বলতে চাই যে, আপনারা কটাক্ষ করে কেউ কাউকে কিছু বলবেন না। কারও প্রতি কটাক্ষ করে কথা বলা উচিত নয়। কোন সদস্য অন্য কোন সদস্যকে সম্বােধন করে কথা বলতে পারেন না। সকল মেম্বারকেই জনাব স্পীকারকে সম্বােধন করতে হবে-এটা সকল সদস্যের জানা দরকার। আমি আবার সদস্যদের অনুরোধ করছি আপনারা কারো প্রতি কটাক্ষ করে এই পরিষদে কোন কথা বলবেন না। আমার আর একটি আবেদন এই যে, আপনারা যে গণপরিষদের সদস্য একথা যেন ভুলে না যান। আমি আপনার মাধ্যমে সদস্যদের আরও বলতে চাই যে, পরিষদে একজন বলতে উঠলে সঙ্গে সঙ্গে আর পাঁচজন দাঁড়িয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবেন না। এতে পরিষদের শৃঙ্খলা নষ্ট হবে এবং এর দ্বারা প্রমাণিত হবে যে, আমরা পরিষদ সদস্য হবার যোগ্য নই। আশি আশা করি পরিষদের সকল সদস্য সেদিকে খেয়াল রাখবেন। আপনি যেভাবে দুই দিন পরিষদের কাজ চালিয়েছেন, তার জন্য এই গণপরিষদর পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। পরিষদ সদস্যরা যেভাবে দুই দিন ধৈর্য ধারণ করে পরিষদের কাজ চালাতে সাহায্য করেছেন, তাতে তাদেরকেও আপনার মাধ্যমে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির আজ যে সভা হবে, সেখানে দরজা বন্ধ করে সব বিষয়ে আলোচনা করতে পারবেন। আজ বিকাল ৫টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সভা হবে। সেখানে পার্টির সব বিষয় আলোচনা করা হবে। আপনারা জানেন আমাদের এখানে একজন মাত্র ন্যাপের সদস্য আছেন। তিনি কিছু বেশী সুযোগ পেতে পারেন। সে জন্য আপনারা কিছু মনে করবেন না, তাকে কিছু বেশী সুযোগ দেওয়া উচিত এবং আমি দেখেছি যে, তিনি সুযোগ পেয়েছেন। তিনি ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই আরও সুযোগ পাবেন। এখানে। কথা বলার অধিকার সকলেরই থাকবে। গণপরিষদে বিরোধী দল বলে কোন জিনিস নাই। এটা। আফসোসের বিষয়। গণতন্ত্রে বিরোধী দল থাকা উচিত। নির্বাচন হয়েছে, বিরোধী দলের সদস্যরা। অধিক সংখ্যক নির্বাচিত হতে পারেন নাই। সে জন্য দুঃখ করে লাভ নাই। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই এখানে। বিরোধী দল হবে, আপনারা দেখতে পাবেন। বিরোধী দল হলে আমি তাদের স্বাগতম জানাব। পরিশেষে আমি এখানকার সকল কর্মচারীকে পরিষদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে সদস্যদের ধন্যবাদ দেওয়ার এখানে প্রয়োজন নাই। তবে সদস্যরা যেভাবে সহযোগিতা করেছেন, সে জন্য আমি সদস্যদের ধন্যবাদ দিচ্ছি। আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ: খোদা হাফেজ।
রেফারেন্স: ১১ এপ্রিল ১৯৭২, ইত্তেফাক
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ