You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে এখন চতুর্দিকে যুদ্ধ চলছে

(শামসুল আরেফিন প্রদত্ত) সিলেট ২৬শে নভেম্বর বাংলার জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে এখন মাতৃভূমির শৃঙ্খল মােচনের দৃঢ় শপথ নিয়ে অপরাজেয় মুক্তিবাহিনী হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। গত এক সপ্তাহের সর্বাত্মক যুদ্ধে শক্রদের তিনটি স্যাব জেট জঙ্গী বিমান ও ১৪টি ট্যাঙ্ক ধ্বংশ হয়েছে। বিভিন্ন রণাঙ্গনে প্রায় ৪ ব্যাটেলিয়ান পাক সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়েছে বলে প্রাথমিক সংবাদে জানা যায়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহম্মদ দেশবাসীকে মতভেদ ভুলে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য তার সরকারের নির্দেশের  অপেক্ষায় প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশিক জঙ্গীচক্র বাংলাদেশের বীর জোয়ানদের সঙ্গে তার ভাড়াটিয়া বাহিনীর চলতি যুদ্ধকে আমাদের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে পর্যবসিত করে বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস পাচ্ছে। পাক তস্করদের সব চক্রান্ত ও দূরভিসন্ধি নস্যাৎ করে দিয়ে মুক্তিবাহিনী পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম, সিলেট ও কুমিল্লা, পশ্চিমে যশাের ও কুষ্টিয়া এবং উত্তরাঞ্চলে রাজশাহী রংপুর ও দিনাজপুর রণাঙ্গনে শত্রুদের ধ্বংস করে বীর বিক্রমে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ এলাকায় এখন বস্তুতঃ মুক্তিবাহিনীর কাৰ্য্যকরী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আট হাজার বর্গমাইল এলাকা সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়েছে। শতকরা ২৫টী থানা অঞ্চলে বাংলাদেশ সরকার বেসামরিক শাসন চালু করতে সক্ষম হয়েছেন।

অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরাচারী জঙ্গী সরকার বাংলাদেশের উপর ঔপনিবেশিক শােষণ কায়েম রাখার দূরভিসন্ধি নিয়ে বাংলার বীর জনগণের মুক্তি সংগ্রাম থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। সামরিক আইন বলবৎ থাকা সত্বেও হার্মাদ ইয়াহিয়া সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশে অধিকৃত অঞ্চলে নতুন করে জরুরী অবস্থা ঘােষণা করেছে। ইতিমধ্যে যশাের রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর সাঁড়াশী আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী দস্যুরা ভারতীয় এলাকায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর ৪টী স্যারজেট বিমান মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হানাদার তস্করদের সমর্থন দিতে গিয়ে ভারত সীমান্তে ঢুকে পড়ে এবং তিনটি অনুপ্রবেশকারী বিমান আকাশ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ভূপাতিত হয় পর্যুদস্ত বিমান তিনটির দুটি থেকে চালক দ্বয় ‘বেল আউট করে এবং জীবন্ত বন্দী হয়। একই রণাঙ্গনে বাংলার অপরাজেয় মুক্তি সেনাদের দুর্বার অগ্রাভিযানের মুখে টিকতে না পেরে হানাদারদের একটী ট্যাঙ্ক বহর মরিয়া হয়ে ভারতীয় সীমান্তে আক্রমণ চালায়। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী পাক তস্করদের ট্যাঙ্ক হামলা সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত করেন এবং আক্রমণকারীদের ১৩টি ট্যাঙ্ক সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেন।

শত্রুরা জনপদ ধ্বংস করে দিচ্ছে। হানাদার দস্যুরা বিভিন্ন রণাঙ্গনে প্রচন্ড মার খেয়ে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ও অসংখ্য মৃতদেহ পিছনে ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে। পিছু হটার সময় নরঘাতক কাপুরুষেরা বিমান থেকে বােমা বর্ষণ করে জনপদ ধ্বংস করে দিচ্ছে। নিরস্ত্র ও বেসামরিক জনসাধারণকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। বাংলার মা-বােনদের ইজ্জত হরণ করেছে। সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। হানাদার বাহিনী অগ্রবর্তী ঘাটি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। শত্রুরা এখন অগ্রবর্তী ঘাটি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সমবেত হচ্ছে। অপেক্ষা করছে শক্তি বৃদ্ধির । পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবে ১৮ থেকে ৪৫ বৎসর পর্যন্ত সকল সক্ষম পুরুষকে বাধ্যমূলকভাবে বেসামরিক দেশরক্ষা বাহিনীতে’ যােগাদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এদের স্বল্প মেয়াদী প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশে গণহত্যা নিযুক্ত করার চক্রান্ত চলছে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর নৌ-সেনারা সর্বতােভাবে প্রস্তুত হয়ে জল পথে হানাদারদের শক্তি বৃদ্ধির সকল প্রচেষ্টা বানচাল করে দেওয়ার জন্য অতন্দ্র প্রহরায় নিযুক্ত রয়েছেন। সিংহল সরকার তার দেশের উপর দিয়ে সামরিক বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করেছেন। বাংলাদেশের বিমান বন্দরগুলাের অধিকাংশ মুক্তিবাহিনীর শক্তিশালী দূরপাল্লার কামানের গােলার আঘাতে হয় বিধ্বস্ত হয়েছে নতুবা মুক্তিসেনাদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছে। এমতাবস্থায় হানাদার  বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধির আশা ও সুদূর পরাহত হয়ে উঠেছে। | পৰ্যবেক্ষক মহল তাই দৃঢ় আশা প্রকাশ করেছেন যে, শীত মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই ৫৬ হাজার বর্গমাইল ব্যাপী গােটা বাংলা দেশ সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হবে।

মুক্তবাংলা ॥ ১; ১০

২৭ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!