সাঈদী সমাচার | একজন ধর্মব্যবসায়ীর উত্থান
আসিফ নজরুল | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯
পি ডি এফ ফাইল পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী-বিরোধী সাম্প্রতিক গণবিক্ষোভের মধ্য দিয়ে এদেশে মওদুদীবাদ ও ধর্ম ব্যবসার রাজনীতির অগ্রহণযোগ্য আবারো প্রমাণিত হয়েছে। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর জামাতের মজলিসে শুরায় সাঈদীর অন্তর্ভূক্তির পর পরই দেশের আলেম সমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সাঈদীর ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠেন। সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জামাতের মঞ্চনায়ক সাঈদীর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত জনমত গড়ে ওঠে। দলমত নির্বিশেষে সকল মহলের বিরোধিতার মুখে সিলেট থেকে সাঈদীকে বিতাড়িত করা হয়, দেশের বিভিন্ন স্থান তার মাহফিলের অনুমতি প্রত্যাহার করা হয়। নাছোরবান্দা সাঈদী তারপরও গোপনে রাতের অন্ধকারে কিছু স্থানে প্রবেশ করেন। কড়া পুলিশ প্রহরায়, জামাতের সশস্ত্র ক্যাডারদের উপস্থিতিতে তার বক্তব্য রাখেন। এসব ম্রিয়মান মাহফিলের চরিত্র এবং ক্ষীণত্ব সাঈদীর ধর্মব্যবসায়ী স্বরূপকে আরো প্রকাশ্য, খোলামেলা করে তোলে। সমালোচনায়, আন্দোলনে, হরতালে সাঈদী একনিমিষে উঠে আসেন গোলাম আজমের মতো গণধিকৃত পরিচিতিতে।
সাঈদীর উত্থান পর্ব
রাজধানী ঢাকার সাঈদী পরিচিতির সূচনা ঘটে ১৯৭৫ সনের দিকে। সে সময় পুরনো ঢাকার আরমানীটোলার একটি মাহফিলে তিনি তফসীর করেন। সেই মাহফিলের অন্যতম উদ্যোক্তা চকবাজার শাহী মসজিদের খতিব মওলানা কারী ওবায়েদুল্লাহর দেয়া তথ্যানুযায়ী সে সময় প্রতি বছরই আরমানীটোলা মাঠে তফসীরুল কোরআন মাহফিলের আয়োজন করা হত। ৭৫ কিংবা ৭৬ সনের এরকম একটি মাহফিল আয়োজনের পর্যায়ে কিছু মুসুল্লী (মওলানা ওবায়েদুল্লাহ বলেন পরে শুনেছি, তারা জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল।) সাঈদী আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তাব করেন। সাঈদী সে সময় খুলনায় মোটামুটি পরিচিত হলেও ঢাকায় তাকে সেভাবে কেউ চিনতেন না।
আরমানীটোলা মাহফিলে আমন্ত্রিত হবার পর সাঈদী প্রথম ঢাকায় তফসীর করার সুযোগ পান। অত্যন্ত দীনবেশে সাদামাটা পোশাকে মাহফিলে আগত সাঈদীর থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা মাহফিল কমিটির পক্ষ হতেই করা হয়। আরমানীটোলার পর সাঈদী লালবাগ ও চকবাজারে আরো দুটো মাহফিলে তফসীর করেন। এসব মাহফিলে সর্বপ্রথম তিনি গানের সুরে কোরআনের তফসীর করা শুরু করেন। ইসলামসম্মত নয় বলে স্থানীয় আলেম উলামাগণ এর সমালোচনা করেন এবং পরবর্তীতে সেই মাহফিল কমিটি বিতর্কিত সাঈদীকে আর কখনও আমন্ত্রণ জানানো হতে বিরত থাকে।
পিরোজপুরের এই মওলানার জীবনে বিতর্কের সূচনা আরো আগে থেকেই। শর্ষীনা মাদ্রাসায় পঞ্চম ক্লাসের ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় জামাত রাজনীতি সংশ্লিষ্ট থাকার সন্দেহে তাকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেয়া হয় বলে তারই এক সময়ের সহকর্মী মওলানা ইসহাক ওবায়েদী জানান। শর্ষীনা মাদ্রাসার পর তিনি খুলনার আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সে মাদ্রাসা থেকে তিনি কামেল (দাওরায়ে হাদীস) ডিগ্রী আদৌ লাভ করেছেন কি না এ নিয়ে দেশের আলেম সমাজেই প্রচুর সন্দেহ রয়েছে। দেশের শতাধিক আলেম এ বিষয়ের সত্যতা প্রমাণের জন্য সাঈদীর প্রতি একাধিকবার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেও সাঈদী কখনই সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেননি। সাঈদীর ইসলাম শিক্ষার পরিপূর্ণতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তার কন্ঠ চটুলতা এবং শ্রোতা আকর্ষণ ক্ষমতা বরাবরই দ্বিধাহীনভাবে স্বীকৃত। বিভিন্ন সূত্রের দেয়া তথ্যানুযায়ী স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে এই কন্ঠসম্পদকে অবলম্বন করে সাঈদী পিরোজপুরের গড়ের হাটে সুর করে আতর, তসবীহ ধর্মীয় পুস্তক বিক্রি করে জীবিক নির্বাহ করতেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তার বিরুদ্ধে লুটপাট ও ডাকাতির অভিযোগ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মাসিক নিপুণ পত্রিকার জুলাই’৮৭ সংখ্যায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পাড়েরহাট ইউনিনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়…..‘সাঈদী স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাক-হানাদারবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় লিপ্ত ছিলেন। তিনি ধর্মের দোহাই দিয়ে গণিমতের মাল হিসেবে পাড়েরহাট বন্দরের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর লুট করেছেন। এবং মদন নামের এক হিন্দু ব্যবসায়ীর দোকানঘর ভেঙে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর সাঈদী দীর্ঘ সময় পালিয়ে থাকেন এবং দশ বছর পর নিজ গ্রামে আসেন।’
স্বাধীনতার পর সাঈদীকে প্রকাশ্যে প্রথম চট্টগ্রামে দেখা যায় বলে স্থানীয় একজন আলেম জানান। এ সময় নির্মীয়মান একটি মসজিদের জন্য মাইক দিয়ে ভ্রাম্যমান অবস্থায় তিনি চাঁদা সংগ্রহ করতেন। তার সুরেলা কন্ঠস্বর ও বাচনভঙ্গি জামাত সংশ্লিষ্ট অরাজনৈতিক সংগঠন ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদকে আকৃষ্ট করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী সে সময়ে জামাতের সকল তৎপরতা অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে পরিচালনা করা হত। সমাজকল্যাণ পরিষদের ছদ্মাবরণে জামাত তাফসীর মাহফিলের আয়োজনের মাঝেই তাদের তৎপরতা সীমিত রাখতো। সমাজকল্যাণ পরিষদ আর্থিক সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে সাঈদীকে তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধিতে ব্যবহার শুরু করে। আর এভাবেই জামাতের মাউথপিস হিসেবে সাঈদী এক পর্যায়ে জামাত বলছে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েন।
সাঈদী পরিচয় গোপন করেছিলেন
জামাতে ইসলামের সাংগঠনিক বিন্যাসের একটি পর্যায় হচ্ছে মজলিসে সুরায় অন্তর্ভূক্তি। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সহযোগী সদস্যকর্মী-রোকন পর্যায় পার হয়েই কেবল একজন মজলিসের সদস্য হতে পারে। সেক্ষেত্রে সাঈদীর মজলিসে সুরায় অন্তর্ভূক্তি জামাত রাজনীতির সঙ্গে তার দীর্ঘকালের সম্পর্কের কথাই প্রমাণ করে।
দুদিন আগে জামাতের একজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন সাঈদী অনেকদিন ধরেই জামাতের রাজনীতি করতেন। খিলগাঁও ইসলামী পাঠাগার সভাপতি আবুল কাসেম জানান, হাঁ ১০ বৎসর ধরেই জামাত করতেন।
অথচ এ প্রসঙ্গে সাঈদীর বক্তব্য এক জঘন্য মিথ্যাচারের পরিচায়ক। পাক্ষিক তারকালোকের ৪ বর্ষ ১৮ সংখ্যায় দেয়া সাক্ষাৎকারে সাঈদী স্পষ্টভাবে বলেন—‘আমি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত নই। যারা এ অভিযোগ করেন তাদের আরো মনোযোগ দিয়ে আমার বক্তব্য শুনতে অনুরোধ করব।’
সাঈদীর এই মিথ্যাচার ‘ইত্তেহাদুল উম্মাহ’ নামক একটি ধর্মীয় সংগঠন গড়াকালীন সময়েও দেখা যায়। ৮১ সনের শেষ দিকে বায়তুশ শরফের পীর সাহেবের খানকাতে এক গোপন বৈঠকের সঙ্গে সংগঠনটি গঠনের পরিকল্পনা করা হয়। সেই বৈঠকে বায়তুশ শরফের পীর, শর্ষীনার মেজহুজুর, যশোরের খাজা সাঈদী পীর মওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী এবং জামাতের গোলাম আজম উপস্থিত ছিলেন।
সাঈদী কখনই একথা স্বীকার করেননি। এ সময় বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের প্রধান মওলানা হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে তার একটি কথোপকথনের বর্ণনা দিয়েছেন খেলাফত আন্দোলনেরই একটি সূত্র–
সাঈদী : ইত্তেহাদুল উম্মাহর মধ্যে হুজুর আপনার জন্য চেয়ার খালি আছে।
হাফেজ্জী : এই কথাটি কালামে পাকের মধ্যে নেই। এসব রাজনীতি থেকে আপনি তওবা করুন।
সাঈদী : হুজুর আমি তো এসব করি না, আমি কেন তওবা করবো।
ইত্তেহাদুল উম্মাহ যে জামাতেরই একটি ছদ্মসংগঠন এটি বুঝতে পেরে হাফেজ্জী হুজুর এতে যোগ দেয়া হতে বিরত থাকেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে জামাত দেশের বরেণ্য ধর্মবেত্তাদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে। জামাতের এই গোপন অভিলাষ এক সময় পরিষ্কার হয়ে উঠলে ইত্তেহাদুল উম্মাহর ভাঙন অনিবার্য হয়ে ওঠে। মোহমুক্ত মওলানারা সরে আসলে এক পর্যায়ে ইত্তেহাদুল উম্মাহ একটি নিষ্ক্রিয় সংগঠনে পরিণত হয়।
বিচ্ছিন্ন মওলানারা পরবর্তীতে একত্রিত হয়ে ১৯৮৬ সনে ইসলামী শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।
চরমোনাইয়ের পীর বায়তুশ শরফের পীর ও মওলানা আবদুর রহিমের এই দলটিতে খেলাফতের মওলানা আজিজুল হকের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী অংশ ও জামাত থেকে বেরিয়ে আসা যুব শিবিরের বাচ্চু গ্রুপও প্রথম থেকেই অন্তর্ভূক্ত ছিল।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই দলটি গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে সাঈদী নিজেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। মানিক মিয়া এভিনিউতে জামাতের একটি সম্মেলনে আব্বাস আলী খানের ইমামতি করার ঘটনায় মওলানা সাঈদী ও কামালউদ্দিন জাফরীর সঙ্গে এ সময়ে জামাতের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। আলেমদের উপস্থিতিতে একজন গায়েরে আলেমের ইমামতি সহজভাবে নেয়নি সাঈদীরা। এছাড়াও এ সময় বিভিন্ন ঘটনায় সাঈদীরা বুঝতে পারেন জামাত নেতৃত্বে ধর্মের চেয়ে রাজনীতির প্রশ্নটিই মুখ্য। ইসলামী শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত একজন আলেম জানান, এসব কারণেই সাঈদী সম্ভবতঃ জামাতী তৎপরতার বলয় থেকে সরে আসার চেষ্টা করেন। ইসলামী শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতাদের কাছে সাঈদী এ সময়ও বার বার জামাতের সঙ্গে তার কোনরকম সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেন। সাঈদীর এই মিথ্যাচারে আবারো বিভ্রান্ত হয় কিছু আলেম। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন সাঈদী। আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে চাঁদা আদায়ের কূপনে মওলানা ফজলুল, মওলানা মাদানী, মওলানা আবদুল জব্বারদের সঙ্গে সাঈদীরও দস্তখত ছিল। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রথম সম্মেলনে আহ্বায়ক কমিটিতেও সাঈদীর নাম ছিল। কিন্তু সম্মেলন আরম্ভ হওয়ার কিছুদিন আগে সাঈদী হঠাৎ করে লাপাত্তা হয়ে যান। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সাঈদীর বিশ্বাসঘাতকতায় রাষ্ট্র জামাত এ সময় সাঈদীকে শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের জন্য চাপ দিতে থাকে। এক পর্যায়ে সাঈদীকে বেশ কিছুদিন অজ্ঞাতস্থানে বন্দী করেও রাখা হয় বলে একটি সূত্র জানায়।
অবশেষে সম্মেলন শুরুর ঠিক আগে সাঈদীকে ওমরাহ হজ পালনের নামে সৌদি আরবে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সৌদি আরব থেকে ফিরেই সাঈদী পত্রিকায় বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সঙ্গে তার পূর্বাপর কোন সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেন। সাঈদীর এই অভাবিত বিশ্বাসঘাতকতা এবং মিথ্যাচারে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন শাসনতন্ত্র আন্দোলনের নেতারা। আন্দোলনের বাইরের আলেম সমাজও সাঈদীর এই ভূমিকাকে মেনে নিতে পারেননি। এ সম্পর্কে খেলাফত আন্দোলনের মওলানা জাফরুল্লাহ খান বলেন—খেলাফতের একটি অংশ বিচ্যূত হয়ে ইসলামিক শাসনতন্ত্র আন্দোলনে যোগ দেয়ার ঘটনাটি হাফেজ্জীর জন্যে আঘাতস্বরূপ ছিল। তারপরও সাঈদীর এই আচরণ আমরা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য বা প্রশংসাযোগ্য মনে করি না। এটি একটি জঘন্য গাদ্দারী বা বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
সাঈদীর ধর্মব্যবসা
এই মিথ্যাচার আর বিশ্বাসঘাতকতার স্বল্পোচ্চারিত অধ্যায় সাঈদীর ধর্মব্যবসার সুনিপূণ কৌশলে এক সময় ম্লান হয়ে আসতে থাকে। কথার মারপ্যাঁচ, কোরআন হাদিসের যথেচ্ছ ব্যাখ্যা, আর চটুল উপস্থাপনার মাধ্যমে তফসীর মাহফিলে সাঈদী নিজেকে ইসলামের সাচ্চা ধারক-বাহক রূপে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পান। এরই পাশাপাশি তফসীরের বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থে ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে তার বিত্তের পাহাড়। যে সাঈদীকে ৭৬ সনের দিকে সহায় সম্বলহীন, দীন বেশে ঢাকায় প্রথম দেখেছিলেন কারী ওবায়েদুল্লাহরা, সেই সাঈদী একযুগের ব্যবধানে হয়ে ওঠেন প্রাসাদোপম এক অট্টালিকার মালিক। সব ধরনের আধুনিক ব্যবস্থাদিতে সুসজ্জিত সাঈদীর ৯১৪ নং শহীদবাগের চারতলা বাড়ির ভাড়াবাবদ আয়ই বর্তমানে ২০ হাজার টাকার মত।
এ সম্পর্কে মওলানা জালালাবাদী, মওলানা ইসহাক ওবায়েদী, মওলানা জাফরুল্লাহ খান, মওলানা ওবায়েদুল্লাহ সকলেই বলেন—‘কোরআনের তফসীর করার বিনিময়ে অর্থগ্রহণ কোনক্রমেই ইসলামসম্মত নয়। নিতান্ত অভাবগ্রস্ত কোন আলেমকে তফসীরের লোকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে থাকা খাওয়া বা যাতায়াত খরচ বাবদ কিছু সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে দরকষাকষি করে অর্থগ্রহণের বিনিময়ে কোরআনের তফসীর সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। এটি এক ধরনের হারাম বাণিজ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।’
০০০
‘আমার রাহাখরচ বাবদ যা দেয়া হয় তা শরিয়ত সম্মত’ — মওলানা সাঈদী
সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রতিনিধিকে মওলানা সাঈদী সরাসরি সাক্ষাৎকার প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়ে লিখিত প্রশ্ন দাবী করেন। নিম্নে লিখিত প্রশ্নমালার জবাব পত্রস্থ হলো :-
প্রশ্ন : আপনি কখন হতে জামায়াতে ইসলামের রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হন। আপনি কি কখনো জামায়াতের সহযোগী সদস্য কর্মী বা রোকন পর্যায়ে ছিলেন। না থাকলে একবারে মসলিসে শুরার সদস্য হলেন কিভাবে?
উত্তর : আমি জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে শুরার সদস্য হয়েছি। প্রয়োজনে সে গঠনতন্ত্র অধ্যয়ন করে দেখতে পারেন।
প্রশ্ন : ‘৭১র স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আপনি কি করতেন? সে সময়ের জামায়াত রাজনীতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি? আপনি কি তা সমর্থন করেন?
উত্তর : ঐ সময়টা ছিল আমরা জ্ঞানপিপাসু মনের খোরাক হিসাবে ব্যাপক গবেষণা ও অধ্যয়নকাল। কুরআন হাদীস, তাফছীর ও আকায়েদ ছাড়াও অন্যান্য ধর্মের বহু ধর্মগ্রন্থ এবং বিশ্বের বিভিন্ন মতপথ ও মতবাদের তুলনামূলক পর্যালোচনা ও গবেষণায় তখন আমি ব্যস্ত থাকি। যার কারণে কোন দলের ও পক্ষের কার্যক্রমে আমার বাস্তব অংশগ্রহণ তখন আর আমার হয়ে উঠেনি। তবে বাংলাদেশে যে শোষণ চলছিল সব সময় আমি তার বিরুদ্ধে ছিলাম। ঐ সময়কার জামায়াতে ইসলামীর কার্যক্রমের ব্যাখ্যা জামায়াতে ইসলামী ইতিমধ্যে বিভিন্ন সাংবাদিক সম্মেলন ও পুস্তিকায় প্রকাশ করেছে। আমি তা অযৌক্তিক মনে করি না।
প্রশ্ন : পিরোজপুরের একজন মুক্তিযোদ্ধা আপনার বিরুদ্ধে মাসিক নিপুন পত্রিকায় ’৭১ সনে কিছু হিন্দু পরিবারের সম্পত্তি লুটের অভিযোগ করেছিলেন। সেই অভিযোগ মিথ্যে হলে আপনি পত্রিকায় প্রতিবাদলিপি পাঠান নি কেন?
উত্তর : ঐ সব অভিযোগ সর্সৈব মিথ্যা। তার জবাব সে সময় ও পরবর্তীকালে বিভিন্ন মাহফিলে আমি দিয়েছি।
প্রশ্ন : উপমহাদেশের বিভিন্ন আলেমগণ ইসলাম সম্পর্কে মওলানা মওদুদীর ব্যাখ্যাকে বিকৃত এবং অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। জামাতের রাজনীতি এই মওদুদীবাদকে ধারণ করেই অগ্রসর হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে মওদুদীবাদ ও জামাতের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
উত্তর : কতিপয় আলেম মওলানা মওদুদীর কিছু অংশকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করলেও বিশ্বের অধিকাংশ বরেণ্য ও হক্কানী আলেম তার ব্যাখ্যাকে যথার্থ বলে গ্রহণ করে থাকেন। আমি তার মতামতকে ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক পেয়েছি। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক। এই দল বাংলাদেশে দেশের সংবিধান অনুযায়ী রাজনীতি করে থাকে। উল্লেখ্য যে, মওদুদীবাদ বলতে কোন মতবাদ নেই। মওলানা মওদুদী ছিলেন এ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ ও খাদেম।
প্রশ্ন : আপনি কত সনে কোন মাদ্রাসা হতে কামেল ডিগ্রী লাভ করেন? আপনার পেশাগত জীবন সম্পর্কে বলুন। বর্তমানে আপনার আয়ের উৎস কি?
উত্তর : আমি শর্ষিনা মাদ্রাসা হতে ১৯৬২ সনে ডিগ্রী লাভ করি তবে কোন ডিগ্রী লাভকে আমি জ্ঞানের চূড়ান্ত বলে মনে করি না। আমি এখনো আমার সময়ে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পড়াশুনা ও অধ্যয়নের কাজে ব্যয় করে থাকি। আল্লাহ আমাকে যা, কিছু জ্ঞান দান করেছেন আমার ঐ অধ্যয়ন অধ্যবসায়ের ফল বলে মনে করি।
আমার পেশা বলতে জ্ঞান পেশা সাহিত্য চর্চা ধরে নিতে পারেন। এ পর্যন্ত আমার অনেকগুলো বই পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। আর ঐ বই বিক্রয়লব্ধ মুনাফা আমার আয়ের উৎস।
প্রশ্ন : শহীদবাগের আপনার বর্তমান বাড়িটি কত সনে কোন অর্থ উৎস হতে নির্মাণ করেন?
উত্তর : বর্ণিত বাড়িটি আমার নিজস্ব। আজীবন সঞ্চিত আয় এবং বিশিষ্ট বন্ধুবান্ধবদের থেকে পাওয়া ঋণের অর্থে তৈরি হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক এ বাড়ির নীচতলার অগ্রীম ভাড়া বাবদ কিছু অর্থ পরিশোধ করায় এর তৈরি কাজ ত্বরান্বিত হয়েছে। এইসব ঋণ আমার এখনো রয়ে গেছে।
০০০
উল্লেখ্য বছর দুয়েক আগে একটি পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে সাঈদী নিজেই বলেছিলেন—‘আমি বাণিজ্যিক পীরদের ঘৃণা করি।’ ইসলাম নিয়ে নিজের বাণিজ্যচর্চার ব্যাপারে অবশ্য সাঈদী কিছু বলেননি। তবে তফসীরের পূর্বে তফসীর আয়োজনকারীদের সঙ্গে তার আর্থিক সমঝোতার শর্তটিতেই সাঈদী নিজের জালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। অর্থগ্রহণের এই প্রক্রিয়ার লিখিত প্রমাণ না থাকলেও তফসীর আয়োজনকারীদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বিষয়টি আর গোপন থাকে না। এ সম্পর্কে ১৯৮৬ সালে মীরপুরের মফিদইয়াম হাইস্কুলের ময়দানে তফসীর মাহফিল আয়োজনকারীদের একজন মোঃ নূর হোসেন জানান—হুজুরের সঙ্গে প্রাথমিক আলাপের পর হুজুর ৪ হাজার টাকাতে জলসাতে আসতে সম্মত হন। কিন্তু জলসায় এসে মাত্র ঘন্টাখানেক বক্তব্য রেখে তিনি চলে গেলে মাহফিলে শোরগোল শুরু হয়। অনেকেই বলতে থাকেন এত টাকা দিয়ে আনা হল, হুজুর কেন এত তাড়াতাড়ি চলে গেলেন!’ ময়মনসিংহের একটি মাহফিলে সভাপতি হিসেবে গিয়েছিলেন খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমীর মওলানা ফয়জুর রহমান। সেই মাহফিলে কোরআন তফসীর করার জন্য সাঈদীকেও আনা হয়েছিল। ফয়জুর রহমান বলেন,‘সেই মাহফিলে আমি শুনেছি ওয়াজ করার জন্য সাঈদীকে ১০,০০১ টাকা দেয়া হয়।’ আহলে সুন্নাত ওয়লি জামাতের সেক্রেটারী জেনারেল মওলানা হাবীবুর রহমান বলেন…..সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলের পূর্বে বিভিন্ন সংগঠনের ছদ্মনামে চাঁদার কূপন ছাপানো হয় এবং যাকাতসহ বিভিন্ন খাতের টাকা চাঁদা হিসেবে আদায় করা হয়। জনগণের জিজ্ঞাসা একজন ব্যক্তির ওয়াজ মাহফিলের জন্য অজস্র অর্থের দরকারটা কি? সাঈদী সাহেব উক্ত অর্থের সিংহভাগ মালিকানা পেয়ে থাকেন।
ওয়াজের বিনিময়ে সাঈদীর অর্থগ্রহণের কথা এমনকি ইসলামী ছাত্র শিবির সূত্রেই জানা যায়। ২ ফেব্রুয়ারী দুপুরে জামাতে ইসলামীর মহানগর অফিসে শিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শেখ বেলালউদ্দীনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। ক্যাসেট প্লেয়ারে ধারণকৃত এই আলাপচারিতার একপর্যায়ে বেলালউদ্দীন বলেন……‘কারো পারপাস সার্ভ করলে সে খুশী হয়ে টাকা দিলে তা গ্রহণ করা শরিয়তবিরোধী নয়। দরকষাকষি না করলেই হয়।’ কোন টাকা পয়সা না দিলে সাঈদী ওয়াজে যান কি না এ প্রশ্নের উত্তরে শিবির নেতা বলেন….‘এমনিতেই উনি যাবেন….তবে টাইমিং ঠিক হতে হবে। আপনি আগামী বৎসর প্রোগ্রাম করতে চাইলে এ বছরই কনট্রাক্ট করতে হবে।’ সাঈদী প্রতি ওয়াজে কত টাকা নেন জিজ্ঞেস করা হলে বেলালউদ্দীন বলেন, ‘খুলনায় একবার ওয়াজ করে তিনি টাকা নিতে ভুলে যান। পরে সেই টাকা তাকে দেয়া হলে তিনি তা গুণেও দেখেননি। উদ্যোক্তারা আমাকে বলেছিলো—তিন হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। গ্রাম্য এলাকা তাই টাকা পয়সা বেশী দেয়া হয়নি।….ঢাকা সিটিতে মাহফিল হলে বিরাট এ্যারেঞ্জমেন্ট থাকে—কালেকশন বেশী হয়….তাই বেশী দেয়া হয়।’
সাঈদীর এই অর্থ লালসার আরেক চিত্র হচ্ছে ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের ঘটনা। এ সম্পর্কে ১ জানুয়ারী ৮৮ সংখ্যা সাপ্তাহিক ‘একতা’ পত্রিকায় ‘দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর এক কীর্তি’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয় ‘ইসলামী বক্তৃতা বাগীশ হিসাবে দেশব্যাপী খ্যাত—মওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীও ব্যাংকের ঋণ নিয়ে শোধ না করে লুটেরা ধনীক গোষ্ঠীর কাতার যুক্ত হয়ে চলেছেন। ব্যাংকের ভাষায় তাঁকে খারাপ দেনাদার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৯৮৭-র জুন পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী তাঁর কাছে ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ ১৬ লাখ টাকা। তাঁর মালিকানাধীন হিজবুল্লাহ ট্রেডিং সিন্ডিকেট নামক সুতা ব্যবসার প্রতিষ্ঠান ১৯৮৫ সালের নবেম্বর মাসে ইসলামী ব্যাংক নারায়ণগঞ্জ শাখা থেকে ১৫ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করে। ১৯৮৬ সালের নবেম্বর মাসের মধ্যে ঐ টাকা পরিশোধের কথা থাকলেও কোন টাকা (১৯৮৮-র জানুয়ারী পর্যন্ত) শোধ করা হয়নি। হিজবুল্লাহ ট্রেডিং সিন্ডিকেটের অপর মালিকের নাম আলহাজ মজিবর রহমান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংক ক্রোক করবে এমন কোন মালামাল ঐ প্রতিষ্ঠানে নেই।
সাঈদী পরবর্তীতে এই প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করে নিজেকে হিজবুল্লাহ ট্রেডিং সিন্ডিকেটের স্লিপিং পার্টনার হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেয়ার ঘটনাটি অস্বীকার করেননি। বরং ‘মাত্র ১৬ লাখ’ টাকার জন্য তাকে লুটেরা ধনীক গোষ্ঠীর কাতারযুক্ত করাতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
০০০০
প্রশ্ন : হিজবুল্লাহ ট্রেডিং কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করা সংক্রান্ত সাপ্তাহিক একতায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টের ব্যাপারে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সেই টাকা কি আদৌ পরিশোধ করা হয়েছে আজ পর্যন্ত?
উত্তর : হেজবুল্লাহ ট্রেডিং করপোরেশনের সঙ্গে বর্তমানে আমার কোন সম্পর্ক নেই। হেজবুল্লাহ ট্রেডিং করপোরেশন ও ইসলামী ব্যাংকের পারস্পরিক ব্যাপার ওরাই ফয়সালা করবেন। আমার দ্বারা কখনো ইসলামী ব্যাংকের কোন আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয়নি।
প্রশ্ন : কোরআন তফসীর করার বিনিময়ে আপনি অর্থ গ্রহণ করে থাকেন। এটি ইসলামের দৃষ্টিতে কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
উত্তর : আমার ও আমার সংগী সাথীদের হা খরচ বাবদ যা দেয়া হয় তা শরীয়ত সম্মত।
প্রশ্ন : সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে আপনি তফসীর করতে গিয়ে তীব্র বাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন। অথচ জামাতের মসলিসে সুরার সদস্য হবার আগে এ ক্ষেত্রে আপনি কোনরূপ বাঁধা পাননি। অর্থাৎ বলা যায় জামাতের অগ্রহণযোগ্যতা আপনার ইমেজকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ ব্যাপারে আপনার কোন দ্বিমত আছে কি?
উত্তর : ইতিপূর্বে বাঁধার সম্মুখীন হইনি এই কথা ঠিক নয়। তবে ইদানিং তার তীব্রতা শতগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামের কাজ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেই কোন কোন মহল এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। দ্বীন কায়েম ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যারাই করবে কায়েমী স্বার্থবাদী মহল তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবেই। তাই এর জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম এবং থাকবো ইনশাল্লাহ।
জামায়াতে ইসলামীর মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি বিপ্লবী আন্দোলনে যোগদানে আল্লাহর মেহেরবানীতে ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পেয়েছে বলেই আমি মনে করি।
প্রশ্ন : আপনি বিভিন্ন ওয়াজে বামপন্থী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী, পীর আউলিয়াদের বিভিন্ন অশ্লীল ও বিদ্রূপাত্মক ভাষায় আক্রমণ করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আপনার বক্তব্য কি?
উত্তর : এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমার বক্তৃতায় ক্যাসেটসমূহ আগাগোড়া শুনলে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে।
প্রশ্ন : দেশের বিভিন্ন আলেমগুণ আপনার ওয়াজের সমালোচনা করেছেন। তাঁরা আপনাকে বাহাসে অংশ নেয়ারও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আপনি এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন?
উত্তর : যাঁরা সমালোচনা করেছেন তাঁদের উদ্দেশ্য মহৎ বলে আমি মনে করি না। তাঁদের বাহাসের আহ্বানও সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আমার মনে হয় না। কেননা সদিচ্ছা প্রণোদিত হলে তাঁরা সরাসরি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আলোচনায় বসতে পারতেন। তা না করে পত্রপত্রিকায় বিবৃতি প্রদান করে তারা কাদের মনে রঞ্জনের চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার শ্রোতাদের মধ্যে সর্বত্র হাজার হাজার দেশ বরেণ্য হক্কানী আলেমের উপস্থিতি এর প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।
প্রশ্ন : আপনি এত বিতর্কিত কেন? আপনার নিজের মূল্যায়ন কি?
উত্তর : ৯ নং প্রশ্নের উত্তরে আমি এর জবাব ব্যাখ্যা করেছি।
প্রশ্ন : এরশাদ, হাসিনা ও খালেদা জিয়া সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
উত্তর : শাসক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মূল্যায়নের দায়িত্ব জনগণের। এ সম্পর্কে আমি কোন মন্তব্য করতে চাই না।
০০০০
সাঈদীর তফসীর ইসলামসম্মত নয়
কোরআন তফসীরে সাঈদীর বক্তব্যের সিংহভাগ জুড়ে থাকে জামাত রাজনীতির পক্ষে ওকালতি, বামপন্থী এবং প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে অশ্লীল ও বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য। মসলিসে শুরার সদস্য হওয়ার আগেও সাঈদী তার বিভিন্ন মাহফিলে জামাত-শিবির পক্ষে প্রচারণা চালাতেন। ৮৬-র সংসদ নির্বাচনের পূর্বে একটি ইসলামী জলসায় সাঈদী বলেন,‘যে কোন নির্বাচনের পূর্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মত ইসলাম দলের মোর্চাও গঠিত হয়। হুজুররা ইসলামের নামে ভোট চান। ফলে বিভিন্ন লোকজন আমার কাছে জানতে চায় যে তারা কোন ইসলামী দলকে সমর্থন করবে।….সেই দলকে সমর্থন করতে হবে যাদের কর্মীবাহিনী এবং সাংগঠনিক তৎপরতা রাজধানী থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে।’ এ পর্যায়ে সাঈদী জোরগলায় উপস্থিত জনতার কাছে জানতে চান এরপরও তাকে দলটির নাম নিজমুখে প্রকাশ করতে হবে কি না? উত্তরে তিনি নিজেই আবার বলেন,‘আমার বিশ্বাস দলটির ছাত্র সংগঠনের তৎপরতা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। সুতরাং এই দলটিকেই সমর্থন করতে হবে।’
পৃষ্ঠপোষক গোষ্ঠীর স্বার্থ এবং নিজ ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার জন্য সাঈদী সে ইসলামের কতদূর স্বকল্পিত ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন তার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় গত বছর ২৩ নবেম্বর খুলনা প্লাটিনাম জুট মিলস এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের নির্বাচনে। এ নির্বাচনে শ্রমিকদের ধর্মীয়ভাবে প্রতিহত করার জন্য মালিক ও প্রশাসনিক মহল হতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। মালিকপক্ষ সাঈদীকে দিয়ে একটি ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করেন। সেই মাহফিলে নির্দ্বিধায় সাঈদী শ্রমিকদের কম্যুনিস্ট আখ্যা দিয়ে মোনাজাত করেন….হে আল্লাহ কম্যুনিস্টরা যেন জয়লাভ না করে…..। দেড় লক্ষ টাকার এই জাঁকজমকপূর্ণ ওয়াজ উৎসবে সাঈদীর মোনাজাত মালিকপক্ষের ভরাডুবি রোধ করতে পারেনি। সাঈদী যেসব ‘কম্যুনিস্ট নেতাদের’ বিরুদ্ধে দোয়া করেন তাদের সকলেই মিলের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানদের দেয়া ভোটে জিতে যান।
সাঈদী তার ধর্মীয়—ওয়াজে সমাজতন্ত্রকে ছয়মাসতন্ত্র, কম্যুনিজমকে কমিনালিজম, প্রগতিশীলদের দুর্গতিশীল আখ্যায়িত করে থাকেন। সাঈদীর অভিমত অনুযায়ী সমাজবাদীরা এবং মার্কস, এল্গেলস, লেনিন, ডারউইন, রুশো, ভলতেয়ারের মতো দার্শনিকরা মানবতার উন্নতির জন্য নতুন কোন মতবাদ দিতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের সম্পর্কে সাঈদী বলেন, মস্কো, পেন্টাগন ও শান্তি নিকেতনে শিক্ষিত এ সমস্ত শিক্ষকরা এদেশের কলংক। এরা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্রছাত্রীদের বিপথগামী করছেন। এসব শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এদেশের সোনার ছেলেরা সবাইকে কম্যুনিস্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রগতিশীল নারী আন্দোলন সম্পর্কে সাঈদী বলেন : ‘কম্যুনিস্টরা বলে ধর্ম কিছুই নয়, ধর্মের নামে, পর্দার নামে তোমাদের (মেয়েদের) ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখা হয়েছে। তোমরা বাইরে এসে বাংলার আলো বাতাস গায়ে-লাগাও, শরীর তরতাজা কর।’ বামপন্থীদের সম্পর্কে তিনি বলেন, তোমরা কি স্বাধীনতা দিবে? তোমাদের দার্শনিকরা তো নারীদের সম্ভোগ করেছে….এরা গার্মেন্টস থেকে মেয়েদের ভাড়া করে মিটিং মিছিলে হাজির করায়। কিন্তু আসল কথা হলো মেয়েরা না থাকলে তারা মিছিলে জোশ পায় না।
পবিত্র কোরআনের তফসীরের নামে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ সম্পর্কে সাঈদীর এই মিথ্যাচার বিদ্রুপাত্মক এবং বিদ্বেষমূলক বক্তব্য কোরআনের শিক্ষারই সুস্পষ্ট পরিপন্থী। কোরআন শরীফে আছে—‘একদল লোক যেন অন্য দল লোকের বিদ্রুপ না করে, কারণ ইহারা তাহাদের অপেক্ষা উত্তম হইতে পারে।’ ইমাম বায়হাকীর বর্ণনায় রয়েছে—‘হযরত (সঃ) বলিয়াছেন যাহারা বিস্তর কথা বলে, লোকের প্রতি বিদ্রুপ ও অহংকার করে তাহারা অসচ্চরিত্র।’
এই ধর্ম ব্যবসায়ীকে রুখতে হবে
নিজ পরিচয় গোপন করে ধর্মের নামে মওদুদীবাদের উপর অভিজাত জামাত রাজনীতির সাফাই গেয়ে, ইসলামের যথেচ্ছ ব্যাখ্যা দিয়ে সাঈদী এদেশের লক্ষ কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতারিত করেছেন বলে এদেশের আলেম সমাজ রায় দিয়েছেন।
সাঈদীর বিরুদ্ধে ইসলামী শিক্ষার অপূর্ণতা, কোরআনের বিকৃত ব্যাখ্যা ও তেলাওয়াতেরও সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। মওলানা জাফরুল্লাহ খান প্রসঙ্গত বলেন, সাঈদীর ভুল হাদীস তেলাওয়াত শুনেই তার বিদ্যার বহর বোঝা যায়। মওলানা হাবীবুর রহমান বলেন, সাঈদীর তেলাওয়াত শুনলেই বোঝা যায় তিনি কোন সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত আলেম নন। তার তেলাওয়াতে যথেষ্ঠ ভুল-ক্রুটি রয়েছে যা কোন মওলানার পক্ষে শোভন নয়। শহীদ পার্ক কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম মওলানা আ ন ম জাকির হোসাইন বলেন, আমি সাঈদীর প্রতি চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করছি যে, তফসীর তো দূরের কথা বঙ্গানুবাদ করার মত ন্যূনতম যোগ্যতা মৌলভী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর নেই।
এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সাঈদীকে কোরআন হাদীসের অপব্যাখ্যাকারী আখ্যায়িত করে দেশের শতাধিক বরেণ্য আলেম সাঈদীকে সম্মুখ বিতর্কে অবতীর্ণ হওয়ার চ্যালেঞ্জ প্রদান করেন। ইসলামের ভ্রান্ত ব্যাখ্যাদানকারী সাঈদীর তফসীর করার সুযোগ বন্ধ করার দাবীও জানানো হয় এসব আলেমদের বক্তব্যে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে সাঈদী এক্ষেত্রেও তার বিরুদ্ধবাদীদের কম্যুনিস্ট, ইবলিশ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেননি। চট্টগ্রাম প্যারেড মাঠের এবারের মাহফিলে সাঈদীর বক্তব্য ছিল ‘রাসুলুল্লাহ’র সময় ইবলিশ শক্তি ছিল এখন আছে। এই শয়তান চক্রই তার বিরুদ্ধে লেগেছে। ৪ জানুয়ারী ঢাকার খিলগাঁও চৌরাস্তায় এক সমাবেশে সাঈদী বলেন,‘এদেশের কম্যুনিস্টরা কোরআনের বাণী প্রচার করতে দেবে না। তাই দেশে কোরআনের তফসীর বন্ধ করার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র তৌহিদী জনতা বরদাস্ত করবে না।’
দেশের আলেমসমাজ, ছাত্র-ছাত্রী, রাজনৈতিক কর্মী নির্বিশেষে সকল বিরুদ্ধবাদীদের সাঈদী কোরআন তফসীর বন্ধের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে আবিষ্কার করতে সমর্থ হলেও সাঈদীর এই আবিস্কারে এদেশের ধর্মপ্রাণরা আর বিভ্রান্ত হচ্ছেন না। প্রসঙ্গত কোরআন প্রচার সংস্থার একটি বিবৃতির উল্লেখ করা যেতে পারে, ৪ খিলগাঁও চৌধুরীপাড়াস্থ কোরআন প্রচার সংস্থার এই বিবৃতিতে বলা হয়—‘কোরআন প্রচার সংস্থা শহর বন্দর, এমনকি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে পবিত্র কোরআনের তফসীর মাহফিল করে আসছে। এই সংস্থা মনে করে এদেশের মুসলিম সন্তান মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুসলিম সন্তান ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং ৫ দল ৮ দলসহ সর্বস্তরের জনগণ কোনদিনই পবিত্র কোরআন তফসীরের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে না। এদেশে এমন বহু তফসীর আগেও অনুষ্ঠিত হয়েছে যার বিরুদ্ধে তারা কোনদিনও কথা বলেননি। এ থেকে আমরা সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ, ৮ দল, ৫ দল দেশের ৯০ ভাগ মুসলমানের প্রাণের সঙ্গে জড়িত পবিত্র কোরআন বা তার সত্যিকারের তফসীরের বিরুদ্ধে বিরোধিতা করছেন না বরং তফসীরের নামে পবিত্র কোরআনের অপব্যাখ্যা ও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির অবমূল্যায়ন যিনি করছেন—সেই সাঈদীরই কেবল বিরোধিতা করছেন।’
০০০
ইউনিকোড সংগ্রামের নোটবুক