You dont have javascript enabled! Please enable it!

কলাম
দৈনিক ইত্তেফাক
১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
রাজনৈতিক মঞ্চ
মোসাফির

প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠককে ব্যর্থ করিবার জন্য এক সূক্ষ্ম চাল লক্ষ্য করা যাইতেছে। কোন কোন মহল হইতে এক্ষণেই প্রচার শুরু হইয়াছে যে, বিরোধীদলের সহিত আলাপ-আলোচনা সফল হইলে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠনের সম্ভাবনা রহিয়াছে। ইহা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়িয়া দিবার মত এবং ইহাকে আমরা এই মুহূর্তে ক্ষমতার টোপ ফেলান বলিয়া মনে করি। আজ সারাদেশের মানুষ ছাত্র, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, মধ্যবিত্ত শ্রেণী তথা সর্বস্তরের মানুষ যেজন্য সংগ্রাম করিতেছে, রক্ত দিয়াছে, তাহা হইলে রাষ্ট্রের দ্বারা তাহাদের ছিনাইয়া নেওয়ার অধিকার পুন:প্রতিষ্ঠা করা। বিগত দশকের কুশাসন, অনাচার-অত্যাচার ও শোষণের পরিণতি হিসাবে এই গণ-জাগরণ নমিনেশনে মন্ত্রী হওয়ার জন্য কিংবা বর্তমান মন্ত্রীদের বদলে বিরোধীদলীয় লোকদের দ্বারা মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য নয়। জনগণ রাষ্ট্রে তাহাদের অধিকার ফিরিয়া পাইলে, দেশের জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হইলে জনগণের ভোটে ও সমর্থনে যাঁহারা প্রতিনিধি নির্বাচিত হইবেন, গণতন্ত্রের বিধানমতে তাঁহাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল দেশের শাসনভার গ্রহণ করিবেন এবং যে প্রোগ্রামের ওয়াদা দিয়া তাঁহারা নির্বাচিত হইবেন সেই প্রোগ্রাম কার্যকরী করার দায়িত্ব তাঁহাদের উপর বর্তাইবে। আমরা যতদূর বুঝি, ইহাই হইল বর্তমান সংগ্রামের মূল লক্ষ্য। প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠকে জনগণের অধিকার যদি স্বীকৃতি লাভ করে এবং তত্মর্মে শাসনতন্ত্র সংশোধিত কিংবা পরিবর্তিত হয়, একমাত্র তাহা হইলেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে এবং এই একটিমাত্র উদ্দেশ্যে কোন সাময়িক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইতে পারে। জনপ্রতিনিধিত্বহীন জগাখিচুড়ি ধরনের মন্ত্রিসভা গঠনে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা মনে করি, দেশবাসীও তাহা চায় না। আশাকরি, এ-মহল ও-মহল হইতে যত সূক্ষ্ম প্রচার চালান হউক না কেন, তাহার প্রতি কোন গুরুত্ব না দিয়া বাস্তব ক্ষেত্রে বিরোধীদলগুলি কি করে-না-করে, সেদিকেই আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত।
এই প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানী সাহেবের সাম্প্রতিক যে সকল বিবৃতি- বক্তৃতা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা নিয়া কিছুটা আলোচনা করা দরকার। অতীতের বিবৃতি-বক্তৃতার উদ্ধৃতি না দিয়া সম্প্রতি খুলনায় তাঁহার দলীয় কাউন্সিল সভায় তিনি যে দাবি করিয়াছেন, এখানে শুধু তাহারই উল্লেখ করিতে চাই। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর হইতে জানা যায়, তিনি দাবি করিয়াছেন যে তাঁহার দলীয় ১৪ দফা এবং ছাত্রদের ১১ দফা গ্রহণ করার পরই তিনি প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে প্রস্তুত আছেন। প্রথমত কোন রাজনৈতিক দলের প্রোগ্রাম অন্য দল গ্রহণ করিবে, এইরূপ প্রস্তাব অবাস্তব ও গণতন্ত্রের রীতি-নীতি-বিরোধী। প্রোগ্রামের ভিত্তিতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গঠিত হয় এবং একমাত্র জনগণ বিভিন্ন দলের প্রোগ্রাম যাচাই করার মালিক মোক্তার। অন্য কোন দলকে বা বা দলসমূহকে নিজ দলের প্রোগ্রাম মানিয়া নিতে বলার অর্থ হইল, প্রকৃত প্রস্তাবে অপরাপর দলের অস্তিত্ব বিলোপ সাধনের দাবি তোলা। গণতন্ত্রের ইতিহাসে এরূপ প্রস্তাব দেওয়ার নজির আছে কিনা, মওলানা সাহেবের নিকটই আমরা সে প্রশ্ন করিতে চাই। মওলানা সাহেব বয়োবৃদ্ধ, রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও তিনি শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। এদেশের আন্দোলনে যাঁহারা নির্যাতন ও জেল-জুলুম ভোগ করিয়াছেন, তিনি তাঁহাদের অন্যতম। বৃটিশ শাসনের প্রথম দিকে মুসলমানদের উপর নির্যাতন বেশি চলে; কিন্তু পরে স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষদিকে কংগ্রেস নেতারাই সর্বাপেক্ষা নির্যাতন-নিপীড়ন ও জেল-জুলুম ভোগ করিয়াছেন। মওলানা সাহেবের নিশ্চয়ই জানা আছে যে, কংগ্রেস ১৯৩০ সালে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গ্রহণ করে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও বিভিন্ন আন্দোলন চলার পর গান্ধী-আরউইন চুক্তি ইত্যাদি সম্পাদিত হয়। মুসলিম লীগ ১৯৪০ সালে যে লাহোর প্রস্তাব গ্রহণ করে, তাহাতে বাংলা কিংবা পাঞ্জাব অথবা আসামকে বিভক্ত করার প্রস্তাব ছিল না। অপরদিকে কংগ্রেসও ‘অখণ্ড ভারতের’ স্বাধীনতার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম করিয়াছে। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস-উভয় দলের সুস্পষ্ট কর্মসূচী থাকা সত্ত্বেও এবং বৃটিশ শাসকদের হাতে নির্যাতিত হইবার পরেও তাঁহারা কি লর্ডওয়াভেল ও মাউন্টব্যাটেনের সহিত আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন নাই? পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা তো শেষ পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা বৈঠক মারফতই অর্জিত হইয়াছিল। দেশী ও বিদেশী শাসকের পার্থক্য এখানে তুলিলাম না।
অসহযোগ আন্দোলন, বিলাতে দুই-দুইটি গোলটেবিল বৈঠক, ম্যাকডোনাল্ড এওয়ার্ড মাফিক ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন সম্পর্কে মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভূমিকা, কংগ্রেস কর্তৃক ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন, মুসলিম লীগ কর্তৃক ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ ঘোষণা প্রভৃতির কথাও মওলানা সাহেবের মনে থাকার কথা। মওলানা সাহেব প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান সম্পর্কে তাঁহার প্রোগ্রাম সম্পূর্ণভাবে গ্রহণের পূর্বশর্ত আরোপ করিয়াছেন, সে সম্পর্কে তাঁহাকেই আমরা জিজ্ঞাসা করিতে চাই যে, ইহার কোন নজির আছে কিনা, তিনি বিশ্বাসী, তাহা হইলে তাঁহার সহিত আমরা একমত হই কিনা তাঁহার মনোভাব ও নীতি সম্পর্কে আমাদের একটা স্পষ্ট ধারণা জন্মিবে। আমরা তাঁহাকে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করিতে চাই যে, তিনি যখন ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সহিত সাক্ষাত করিয়াছিলেন এবং পিন্ডি হইতে লাহোর গমন করিয়া প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে তদানীন্তন গভর্ণরের সহিতও সাক্ষাত করিয়াছিলেন, এবং তৎপরে আবার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণরের সহিত সাক্ষাত করিয়াছিলেন, তখন তিনি আলোচনার কি কি পূর্বশর্ত দিয়াছিলেন এবং আলোচনার দ্বারা কি কি অধিকার বা তাঁহার দলীয় প্রোগ্রামের কয় দফা আদায় করিয়াছিলেন। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসাবে শুধু আমরাই নই, দেশবাসীও তাঁহার কাছে এর বিস্তারিত তথ্য দাবি করিতে পারে। তাহাকে আমরা স্মরণ করাইয়া দিতে চাই যে, সেই সময় তাঁহার দলীয় লোকজনসহ অন্যান্য দলের বহু কর্মী ও নেতা কারাগারে বিনাবিচারে আটক ছিলেন। শুধু তাই নয়, এদেশের লোকের ভোটের অধিকার ছিল না, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার খর্বিত ছিল, অনেক ট্রেড ইউনিয়নকে সরকার কলমের এক খোঁচায় বাতিল করিয়া দিয়াছিলেন, কৃষকদের উপর কর ভার এবং তহসিলদার ও টাউটদের অত্যাচার আজিকার মত সেদিনও বিরাজমান ছিল।
রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকা সুষ্ঠু গণতন্ত্রেরই লক্ষণ। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সহিত মওলানা সাহেবের মতবিরোধ থাকা স্বাভাবিক দূষণীয় তো নয়ই। কিন্তু আমরা কি তাঁহাকে স্মরণ করাইয়া দিতে পারি যে, মওলানা সাহেব গত কয়েক বছর যাবত দেশের সমস্যাটি নিয়া বিশেষ ভাবেন নাই, শুধু পররাষ্ট্রনীতিই তাঁহার চক্ষের সামনে একমাত্র সমস্যা ছিল। তাঁহার বক্তব্য, পররাষ্ট্রনীতি তাঁহার নির্ধারিত পথে প্রবাহিত হইলে আভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান সহজ হইবে। দেশের রাজনীতিতে পররাষ্ট্রনীতির মূল্য নাই-এ কথা আমরা বলি না; কিন্তু নিজ দেশের মানুষ যখন সর্বপ্রকার অধিকার-বঞ্চিত, শোষিত, লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত, সেই সময় শুধু পররাষ্ট্রনীতিকে কার্যতঃ একমাত্র প্রোগ্রামে পরিণত করা বিধেয় নয়। বরং ইহা গণমনে সন্দেহের সৃষ্টি করিয়া থাকে। মওলানা ভাসানীর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাবের খবর আমরা দেখি যদিও আজ সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞায় অনেকটা রদবদল হইয়াছে। পূর্বে আমরা সাম্রাজ্যবাদ বলিতে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলিকেই বুঝিতাম। সাম্প্রতিককালে কম্যুনিস্ট বিশ্বে বিশেষতঃ চীন ও রাশিয়ার মধ্যে মার্কসবাদের ব্যাখ্যা নিয়া (আমরা মনে করি, এই দুইটি দেশের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়া) মতবিরোধ শুরু হইবার পরে বিশ্বের দুইটি প্রধান কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র একে অপরকে সাম্রাজ্যবাদী চর বলিয়া অভিযোগ করিতেছে। আমরা আজ কম্যুনিস্ট বিশ্বের এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করিতে চাই না। কিন্তু মওলানা সাহেব কি চান তা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করিলেই আমরা এবং দেশবাসী তাঁহার সম্পর্কে স্পষ্ট মতামত গঠন করিতে সক্ষম হইব। সবাই তাঁহার সহিত একমত হইতে পারিবে কিনা, সেটা অবশ্য ভিন্ন কথা।
এখন নিজের দেশের দিকে আসা যাক। তিনি যদি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং পূর্ব বাংলা অধিকার সম্পর্কে আজিকার মত পূর্বেও সচেতন ও দৃঢ় থাকিতেন, তাহা হইলে তিনি এবং তাঁহার দল ৬ দফা এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রচারণা করিয়াছিলেন কেন? তাহাকে আমরা ৬ দফা গ্রহণ করিতে বলি না, জনগণই ৬ দফা, ৮ দফা ও ১৪ দফা সবকিছু যাচাই করিবার অধিকারী। কিন্তু ৬ দফার মধ্যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল সিআইএ’র হস্ত আবিষ্কার করিয়াছিল, বিরোধীদের হইয়াও তাঁহারাই বা কেন একই সুরে তখন কথা বলিতেছিলেন ? ৬ দফাকে তিনি কিংবা যে কেহ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের পরিপূরক বলিয়া গণ্য করিতে না পারেন কিংবা কেহবা অতিরিক্ত দাবি মনে করিতে পারেন, সেটা সম্পূর্ণ আলাদা কথা।
মওলানা সাহেবের সহিত বহুদিন আমরা একত্রে কাজ করিয়াছি, তাঁহার সাথে আমাদের মত-বিরোধও হইয়াছে। আমরা চাই না যে, মওলানা সাহেবের মুখ হইতে এমন কথা বাহির হউক-যাহার দ্বারা তিনি জনসাধারণের সম্মুখে অবান্তর প্রতিপন্ন হন অথবা আমাদিগকে তাঁহার সমালোচনা করিতে হয়। তাঁহার দলীয় প্রোগ্রাম সম্পর্কে আমাদের কোন বক্তব্য নাই। প্রোগ্রামের অর্থ আমরা জানি। ভাল ভাল কথা, সুন্দর ভাষায় প্রোগ্রাম রচনা করা এ যুগে কোন কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়। প্রোগ্রাম বাজারে ছাড়া আর প্রোগ্রামকে কার্যকরী করার সামর্থ্য থাকা না-থাকার মধ্যেই পার্থক্য। তবে একদলের প্রোগ্রাম অন্যদল কখনও গ্রহণ করে না, ইহা ডিক্টেটরী মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। গণতান্ত্রিক বিধি- ব্যবস্থায় প্রোগ্রামের ভাল-মন্দ বিচার করার অধিকার একমাত্র জনগণের রহিয়াছে—অন্য কাহারও নয়। মওলানা সাহেবের নিকট আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ : আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করি—যাতে ছোট-বড় সকল রাজনৈতিক দলের স্ব-স্ব কর্মসূচী দেশের প্রকৃত মালিক-জনসাধারণের কাছে যাচাই করিবার জন্য উত্থাপন করিবার সুযোগ সৃষ্টি হয়। যেকোন দলের পক্ষে নিজের প্রোগ্রাম অন্যের ঘাড়ে চাপাইবার প্রস্তাব হাস্যকর।

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!