You dont have javascript enabled! Please enable it!

কলাম
দৈনিক ইত্তেফাক
১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
রাজনৈতিক মঞ্চ
মোসাফির

প্রায় তিন বছর পর আপনাদের প্রিয় ‘ইত্তেফাক’ আপনাদের হাতে পৌছিল। আজিকার এই মুহূর্ত একদিকে যেমন আনন্দ ও বিজয়ের মুহূর্ত, অপর দিকে ইহা এক বেদনাদায়ক ইতিহাসও বটে। যে সময় ‘ইত্তেফাক’ দেশরক্ষা আইনবলে বন্ধ করা হইয়াছিল, সে সময় এই দেশে ৬ দফা আন্দোলন গণমুখী আন্দোলনে পরিণত হইয়াছিল। আজ ‘ইত্তেফাক’ যখন আত্মপ্রকাশের সুযোগ লাভ করিল, তখন দেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলন এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টির পথে। আমাদের সন্তানদের রক্তের বিনিময়ে যে গণ- আন্দোলন আজ দানা বাঁধিয়াছে, সেই আন্দোলনে পটভূমিকাতেই ‘ইত্তেফাক’ পুনরুজ্জীবন লাভ করিল। ‘ইত্তেফাকের’ পুন:প্রকাশের সংবাদে সমাজের সমস্ত স্তরে যে আশা-আকাঙ্ক্ষা সঞ্চার ও উল্লাসের সৃষ্টি হইয়াছে, চারিদিক হইতে আমি যে প্রেরণা ও উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পাইতেছি, তাহাতে আমি অত্যন্ত অভিভূত হইয়া পড়িয়াছি। তাঁহাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ‘ইত্তেফাক’ কতটুকু পূর্ণ করিতে পারিবে, তাহা আমি জানি না। তবে ‘ইত্তেফাকে’র তরফ হইতে দেশবাসীকে শুধু এই নিশ্চয়তাই দিতে পারি যে, ‘ইত্তেফাক’ তার পূর্বানুসৃত নীতি ও ঐতিহ্য হইতে বিচ্যুত হইবে না এবং জ্ঞান ও বিশ্বাস মতে, এদেশের ছাত্র, শ্রমিক ও শোষিত এবং নিপীড়িত মানুষের দাবি-দাওয়া ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিবে না।
আমি ভগ্নস্বাস্থ্য তথাপি যারা বাংলার ইতিহাসকে কলঙ্কিত করিতে, বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের ভীরু, কাপুরুষ জাতি হিসাবে চিত্রিত করিয়া এই দেশের ইতিহাসকে মসীলিপ্ত করিতে প্রয়াস পাইয়াছিল, আমাদের দেশের যুবশক্তি সে দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করিয়া সংগ্রামের যে নূতন ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছে তাহাতে নিন্দুকের মুখে শুধু ছাই পড়ে নাই, আমার দেশবাসীর মুখও উজ্জ্বল করিয়াছে তাহারা এমন এক গৌরবদীপ্ত ইতিহাস রচনা করিয়াছে যাহা বাংলার পুরোনো বৈপ্লবিক ইতিহাসকেও ছাড়াইয়া গিয়াছে। এদেশের একজন নাগরিক হিসাবে আমি আজ গর্বিত, তরুণদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত। স্বাস্থ্যের দিক দিয়া দুর্বল হইলেও আজ আমার মনোবল আমি ফিরিয়া পাইয়াছি। দেশবাসীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হইতে দেখিলে, দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসিলে আমি মানসিক প্রেরণা ও উৎসাহ লাভ করিব, তাতে হয়ত আমি আমার স্বাস্থ্য পুনরায় ফিরিয়া পাইব। আমার কিংবা আমার সহকর্মীদের ভাগ্যে যা কিছু ঘটিয়াছে, সে প্রশ্নের অবতারণা আজ আমি করিব না; কেননা অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অগণিত রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র ও শ্রমিক বহু লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, জেল-জুলুম ভোগ করিয়াছে ও করিতেছে। আমরা বরং তাহাদের সাথী হইতে পারিয়া গর্ব অনুভব করিতেছি। আমার বহু কথা বলার আছে, একদিনেই সব কথা বলা যায় না। আমাদের ছাত্রসমাজ যে গৌরবজনক ভূমিকা পালন করিয়াছে, যে নূতন ইতিহাস সৃষ্টির পথে পা বাড়াইয়াছে, তাদের আমি যেমনি অভিনন্দিত করিতেছি, তেমনি তাদের প্রতি আমি এতটুকু সতর্কবাণী উচ্চারণ করিব যে, বিজয়ের মুহূর্তে তাদের প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হইবে। আমি জানি, এ ব্যাপারে ছাত্রসমাজ আমাদেরকে নিরাশ করিবে না। কিন্তু তথাপি সাবধানের মার নাই৷
আমরা জানি, ছাত্রসমাজও এ সম্পর্কে সচেতন যে, এক শ্রেণীর মতলববাজ ছাত্র-জনতা ও রাজনীতিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির সর্বপ্রকার হীন কলাকৌশল প্রয়োগে লিপ্ত রহিয়াছে। আমি সবসময়ই বিশ্বাস করিয়া আসিয়াছি যে, ছাত্র, শ্রমিক, চাষী, মজদুর, রাজনীতিক তথা সর্বশ্রেণীর মানুষ এবং তরুণ ও প্রবীণদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনেই আমরা বাঞ্ছিত লক্ষ্যে পৌঁছিতে সক্ষম হইব। আমাদের দেশের সংগ্রামী তরুণরাই রাষ্ট্রভাষা হইতে শুরু করিয়া যে কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রধান শক্তি হিসাবে কাজ করিয়াছে। তারা নানাবিধ নির্যাতন ভোগ করিয়াছে, যেমনি করিয়াছে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, শ্রমিক শ্রেণী এবং অন্যরা। এ নির্যাতন ভোগের মধ্য দিয়াই আজ দেশে ছাত্র-জনতার দুর্বার ঐক্য গড়িয়া উঠিয়াছে। এই ঐক্যে যাহারা ফাটল ধরাইতে চায় তাহাদের শ্লোগান যতই সোচ্চার হোক না কেন, তারা প্রকৃত প্রস্তাবে গণ-আন্দোলন এবং গণ-অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টার সংগ্রামকে বানচাল করিতে চায়। অবশ্য পূর্ণ গণতন্ত্র এবং মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কোন আপোস ও নতি স্বীকারের প্রশ্ন নাই। আজ এই কয়েকটি কথা বলিয়াই আমি আমার বক্তব্য শেষ করিতে চাই৷ সংগ্ৰামী ছাত্র- জনতার প্রতি পুনরায় আমার সশ্রদ্ধ অভিনন্দন রহিল। তাহাদের সংগ্রাম পূর্ণ সাফল্যমণ্ডিত হোক, সারা অন্তর দিয়া আজ ইহাই আমি কামনা করিতেছি।

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!