সম্পাদকীয়
দৈনিক আজাদ
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
সমঝোতার মুহূর্ত্তে করণীয়
দেশব্যাপী ব্যাপক ও দুর্ব্বার গণ-আন্দোলনের মুখে সরকারী কর্তৃপক্ষ বাস্তবকে ধীরে ধীরে স্বীকার করিয়া লইতেছেন। জনসাধারণের দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে একটি সমঝোতা স্থাপনের জন্য ইতিমধ্যে উদ্যোগ আয়োজনও শুরু হইয়াছে। সমঝোতার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কিছু কিছু ব্যবস্থাও অবলম্বন করা হইয়াছে। জনসাধারণের মৌলিক ও ন্যায়ানুগ দাবীগুলির স্বীকৃতির মাধ্যমে দেশে পুনরায় শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়া আসুক, এইরূপ কামনা আজ প্রত্যেকের মনেই প্রবল হইয়া উঠিয়াছে। এই পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময় যে সব অবাঞ্ছিত ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটিয়াছে তাহারও একটা প্রতিকার হওয়া বাঞ্ছনীয়।
একথা কর্তৃপক্ষও প্রকারান্তরে স্বীকার করিতেছেন যে, সাম্প্রতিক আন্দোলন কোন বিশৃংখলা ও বিভেদ সৃষ্টিকারী আন্দোলন নয়। জনসাধারণ ও ছাত্র সমাজ দেশ ও দশের স্বার্থ এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই এই আন্দোলনে ঝাপাইয়া পড়ে। সে জন্যই এইসব স্বার্থ ও অধিকার পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমানে সরকার ও বিরোধী দলগুলির মধ্যে গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলিতেছে। কাজেই দেশ ও দশের স্বার্থে পরিচালিত এই আন্দোলনে যেসব অবাঞ্ছিত ও দুঃখজনক ঘটনা ঘটিয়াছে তাহার প্রতিবিধানের কথা কিছুতেই বিস্মৃত হওয়া যায় না। আমরা মনে করি যে, সমঝোতার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য এইসব ব্যাপারেও প্রতিবিধান অপরিহার্য্য। সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময় যেসব অমূল্য জীবনের অবসান ঘটিয়াছে, যাহারা আহত বা পঙ্গু হইয়াছেন এবং যাহারা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইয়াছেন তাঁহাদের এই ত্যাগ ও ক্ষতি নিঃসন্দেহে দেশ ও দশের জন্যই সাধিত হইয়াছে। তেমনি এই উপলক্ষে দমননীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও যথাযথ সীমা লংঘনের অভিযোগ উঠিয়াছে। এই সীমা লংঘনের ব্যাপারে বিশেষত: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে পুলিশের অনধিকার প্রবেশ ও বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছেন। কাজেই বর্তমান পরিস্থিতিতে যাহারা দেশ ও দশের জন্য আত্মত্যাগ ও ক্ষতি স্বীকার করিয়াছেন, তাঁহাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দানের বিষয়টি যেমন গভীরভাবে বিবেচনা করা দরকার, তেমনি আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেখানে সীমা লংঘন করা হইয়াছে যথাযথ তদন্তের ভিত্তিতে তাহারও প্রতিবিধান করা উচিত।
এই প্রসঙ্গে আমরা অত্যন্ত আগ্রহের সাথে লক্ষ্য করিয়াছি যে, পশ্চিম পাকিস্তান সরকার সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময় নিহত দুইজন ছাত্রের পরিবারবর্গকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ দান করিয়াছেন। পশ্চিম পাকিস্তান সরকার যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অঙ্গনে পুলিশের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করিয়াছেন। সর্বশেষ খবরে জানা গিয়াছে যে, সেখানকার প্রাদেশিক সরকার সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময় আইন প্রয়োগকারী মহলগুলি পশ্চিম পাকিস্তানের কোথাও অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করিয়াছে কি না, তাহা তদন্ত করার জন্য একজন প্রাক্তন বিচারপতি সমবায়ে একটি স্থায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠন করিয়াছেন। পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাগুলি আর যাহাই হউক শুভেচ্ছার প্রতীক। পূর্ব্ব পাকিস্তানেও অনুরূপ ব্যবস্থা গৃহীত হওয়া উচিত। দেশব্যাপী গণ-আন্দোলনের মোকাবেলায় এসব অবাঞ্ছিত ও দুঃখজনক ঘটনা দেশের উভয় অঞ্চলেই ঘটিয়াছে। কাজেই উভয় অঞ্চলেই ইহার প্রতিবিধান হওয়া আবশ্যক।
আমরা মনে করি যে, সমঝোতার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য এই ব্যাপারে অচিরেই তাহাদের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এই যথাযথ ব্যবস্থা সম্পর্কেও আমাদের বক্তব্য রহিয়াছে। প্রতিটি গুলী বর্ষণের ঘটনাসহ সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময় যেসব দমনমূলক নীতি গ্রহণ করা হইয়াছে, উহার সামগ্রিক তদন্ত হওয়া উচিত। তদন্তকাৰ্য্য যাহাতে নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয় সেজন্য একটি পূর্ণাঙ্গ বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠন করিতে হইবে। কমিটি প্রতিটি বিষয়রই পুংখানুপুংখরূপে তদন্ত করিবেন এবং যেখানেই আইন-শৃংখলা রক্ষার নামে সীমা লংঘন ও অনধিকার চর্চ্চা করা হইয়াছে, সেখানে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নির্দ্দেশ করিবেন। সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময় যাহারা হতাহত, ক্ষতিগ্রস্ত ও গ্রেফতার হইয়াছে, তাহাদের সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করিয়া প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত লোক ও পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দানের ব্যবস্থা করিতে হইবে। ক্ষতিপূরণের অর্থ কাহাকে কি পরিমাণে দেওয়া উচিত, তাহা সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সহিত আলোচনাক্রমেই নির্দ্ধারিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। আজ সমঝোতার মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ কল্যাণ প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে যাহারা দেশের জন্য অমূল্য ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন তাহাদের অবদানের কথা কিছুতেই বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯