You dont have javascript enabled! Please enable it!

রণাঙ্গণ থেকে লিখছি

কেওয়াটখালী। ময়মনসিংহের একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। শহর থেকে একে বেঁকে বেরিয়েছে একটি কাঁচা রাস্তা। কেওয়াটখালীর মাঝখান দিয়ে সে রাস্তা চলে গেছে। পাক দস্যুদের একটি ইউনিট আস্তানা গেড়েছে এই গ্রামে। গ্রামের তীরেই জনসাধারণ অত্যাচারিত হতে শুরু হলাে। গ্রামের বাড়ী ঘরগুলাে জ্বালাতে শুরু করলাে পাক হায়েনার দল। সােনার বাংলার সবুজ শ্যামল গ্রাম শ্মশানে পরিণত হতে লাগলাে। সেদিনের ঘটনা আজো আমি ভুলতে পারবাে না। বীর বঙ্গশার্দুলদের দুঃসাহসিক অভিযানের কথা। জল্লাদের নখের আঘাতে জর্জরিত গ্রামবাসীদের আর্তচিকার মুক্তিবাহিনীর কানে গেল। এগিয়ে এলেন তারা।  সবে রাতের অন্ধকার নেমেছে গ্রাম বাংলার বুকে। আকাশে লক্ষ তারার মিছিল। মুক্তিবাহিনীর একটি ইউনিট এগিয়ে চললাে। নীরব সাক্ষী আকাশের লক্ষ-কোটি তারা। গ্রাম বাসী সন্ত্রস্ত প্রহর গুনছে। একটু আগে পাক-হায়েনার দল গ্রাম থেকে লুটতরাজ করে ফিরেছে আস্তানায়। গ্রামের ক’টি যুবতীকেও ধরে নিয়ে এসেছে। তাদের করুণ রােদন কানে ভেসে আসছে।

 এক-পা দু’পা করে এগুচ্ছে মুক্তি যােদ্ধার দলটি। কমাণ্ডারের নির্দেশে কটি উপদলে ভাগ হলেন সবাই। বুকে অদ্ভুত চঞ্চলতা। শরীরে আশ্চর্য শিহরণ সামনে মানবতার শত্রু পাক-হায়েনার দল। মুক্তি নয়ত মৃত্যু—শপথে প্রদীপ্ত প্রতিটি মুক্তি যােদ্ধা। বজ্রমুষ্ঠিতে রাইফেল ষ্টেনগান আর এস, এস, আর । হাল্কা মেনিগানও প্রস্তুত। নির্দিষ্ট সময় এলাে। কমান্ডার নির্দেশ দিলেন। মুহূর্ত মাত্র রাতের গভীর নিস্তব্ধতাকে খান খান করে গর্জন করে ওঠলাে মুক্তিযােদ্ধাদের আগ্নেয়াস্ত্রগুলাে। কররূর করর। কান ফাটানাে আওয়াজ। প্রমােদরত খান হায়েনার দল এর জন্যে প্রস্তুত ছিল না। তাদের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব পড়ে গেছে। পাল্টা আক্রমণের জো ছিল না। আতঙ্কে বিহ্বল, ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে জীবন রক্ষার জন্যে ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে তারা। এরই মধ্যে আর্ত গােঙ্গানী শােনা যাচ্ছে। যাওয়ার সব রাস্তাই বন্ধ । বেশী সময় লাগলাে না। মাত্র তিরিশ মিনিট। সব খতম। তাবু, অস্ত্র নিজেদের রক্তেই রঞ্জিত হলাে। কোন সাড়া শব্দ নেই। কমাণ্ডারের নির্দেশে গােলাগুলি বন্ধ করে অস্ত্র হাতেই পায়ে পায়ে এগুতে শুরু করলেন প্রতিটি মুক্তিযােদ্ধা। লাশের পর লাশ পড়ে রইল যত্র তত্র। বাকীগুলাে কমান্ডারের নির্দেশে হাত উড়িয়ে দাঁড়ালাে সারিবদ্ধ ভাবে। উনিশটি পাক-হায়েনা খতম হলাে। ছাব্বিশ জন গ্রেপ্তার হলাে । গ্রামের কটি যুবতী উদ্ধার পেল।  এই হামলায় মুক্তিবাহিনীর হাতে এলাে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র । এর মধ্যে ছিল মেশিনগান, মর্টার, হাল্কা মেসিনগান, রাইফেল ইত্যাদি।

একই রাত। তখন পূবের আকাশে ভােরের আভাস। নিঃঝুম নিস্তব্ধ গ্রাম। ব্রহ্মপুত্র এখান থেকে খানিকটা দূরে। তারই পাশে হানাদার শত্রু ছাউনী। অকস্মাৎ ডিনামাইটের প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। পুলটা ছাই কুটোর মতে উড়ে গেল। আতঙ্কে কেঁপে ওঠলাে হানাদার দস্যুরা। দিশেহারা হয়ে ওঠলাে তারা। এলাে পাথাড়ি গােলাগুলি শুরু করলাে চারিদিকে। দূর পাল্লার কামান আর মর্টারের গুলি দূরের গ্রামগুলিকে ক্ষতবিক্ষত করে তুললাে। এর জন্যে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন। পূর্ব থেকেই এমবুশ করা ছিল তাদের। একই সাথে তিনদিক থেকে আক্রমণ চালালেন তারা। হাল্কা মেসিনগান আর রাইফেলের অব্যর্থ গুলি। প্রায় দু’ঘণ্টা চললাে এই আক্রমণ। তখন সােনালী সকাল। শত্রু খতম হয়েছে। অনেক। তাদের রক্তে ভরতে সুরু করেছে ব্রহ্মপুত্র। বিপর্যস্ত অবস্থায় ছাউনী ফেলে রওয়ানা হলাে মুক্তিযােদ্ধারা। দিনের আলাে নিভলে আবার শুরু করা যাবে। ব্রহ্মপুত্রের বুক বেয়ে ছলাত ছলাত করে এগিয়ে চললাে বঙ্গশার্দুলদের দল।

বাংলার মুখ : ১০

২৬ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!