You dont have javascript enabled! Please enable it!

তেপ্পান্ন সালের গণমানুষের ভাবনা

বায়ান্নর মে থেকে তেপ্পান্নর জানুয়ারি—এই কয় মাস অসুস্থতার দরুন প্রায় গৃহবন্দি হয়েই ছিলাম। নিয়মিত পত্রিকা পড়া হয়নি, দেশের কোনাে খোঁজখবরও রাখা হয়নি। কিন্তু আট/ নয় মাস পরে, তেপ্পান্নর ফেব্রুয়ারিতেই, লক্ষ করলাম মানুষের কথাবার্তার ধরনধারণ যেনাে বদলে যাচ্ছে। একান্ন সালেও যাদের মুখে হরহামেশা ‘শিশু রাষ্ট্র পাকিস্তানের লালন-পালনের কথা শােনা যেতাে, সরকারের মৃদু সমালােচনার মধ্যেও যারা পাকিস্তানের দুশমনদের চক্রান্ত দেখতাে, তাদের কণ্ঠই এখন কঠোর ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। আওয়ামী মুসলিম লীগ নামক রাজনৈতিক দলটির জন্ম যদিও ঘটেছে বছর চারেক আগেই, তবু আমাদের গ্রামাঞ্চলে তখন এ দলের কোনাে প্রকাশ্য অনুসারীর দেখা পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। অথচ তেপ্পান্ন সালের গােড়াতেই অবস্থা অন্যরকম।
আমাদের রামপুর বাজারটির অবস্থান হচ্ছে চার সড়কের মাথায়। উত্তরে দক্ষিণে প্রলম্বিত কেন্দুয়া-নেত্রকোনা সড়ক ও পূর্ব-পশ্চিমে তেলিগাতি ময়মনসিংহ সড়কের সম্মিলন-স্থলটিতেই রামপুর বাজার। মানুষ দীর্ঘ পথও অতিক্রম করে পায়ে হেঁটে অথবা সাইকেলে। উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম যে দিক থেকেই যে কোনাে পথিকই আসুক, তাকে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও রামপুর বাজারে মথুর নন্দী কিংবা যােগেন্দ্র ঘােষের মুদি দোকানের সামনে বসে বিশ্রাম নিতে হয়। স্থানীয় লােকদেরও অনেকেরই অলস সময় যাপনের স্থান এ মুদি দোকান দুটি। অর্থাৎ এখানে আড্ডা জমে থাকে সারাদিন। সুন্দরী বিড়ি’তে সুখটান দিতে দিতে আর পান চিবােতে চিবােতে কতাে কথাই না বলে যায় আড্ডাধারীরা। নেত্রকোনা বা ময়মনসিংহ থেকে কোনাে লােক এলেই তার কাছে সবাই শহরের খবর জানতে চায়। শহরের খবরে রাজনীতির কথাই থাকে বেশি।
দুপুরে বসে খবরের কাগজ সামনে নিয়ে পােস্ট অফিসের সেই ঐতিহ্যবাহী আড্ডা। রামপুর বাজারের মুদি দোকানের আড্ডা আর পােস্ট অফিসের আড্ডায় পাওয়া খবরগুলাে একত্র হয়ে তৈরি হয় যে তথ্যপ্রবাহ তাই শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে দেয় আশপাশের গ্রামগুলােতে। তখনাে ট্রানজিস্টারের প্রচলন হয়নি, টেলিভিশন তাে কল্পনার বিষয়। খবরের কাগজের প্রচারও গ্রামাঞ্চলে, সে সময়েও, একান্ত সীমিত। তাই আড্ডা থেকে প্রাপ্ত খবরই এক মুখ থেকে আরেক মুখে ছড়িয়ে ছড়িয়ে যেতাে। শুধু খবর নয়, খবরের ভাষ্যও। ভাষ্যই বরং বেশি। এবং সে ভাষ্যে থাকতাে কল্পনার অবাধ বিস্তার, ইচ্ছাপূরণের বিচিত্র উপাদান। এভাবেই
১৯২
তেপ্পান্নর গােড়াতেই দেখলাম, লােকের মুখে মুখে চালু হয়ে গেছে যে, এদেশে এখন দুটো লীগ—একটি আওয়ামী লীগ, আরেকটি পকেট লীগ। কথাটা পঞ্চাশ সাল থেকেই শােনা যাচ্ছিলাে, কিন্তু তখন তার এমন ব্যাপক প্রচার ঘটেনি। কেউ কেউ ফিসফিস করে আড়ালে আবডালে বলতাে, শিশুরাষ্ট্রের গার্জেনদের ভয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস পেতাে না। বায়ান্নর সেই রক্তাক্ত একুশে মানুষের সব ভয় ও আড়াল ঘুচিয়ে দিলাে। একুশে মানুষকে যেমন ক্ষুব্ধ করেছিলাে, তেমনি করে তুলেছিলাে সাহসী ও বেপরােয়া। লােকে প্রকাশ্যেই বলতে লাগলাে : যে মুসলিম লীগ পাকিস্তান এনেছে সে এখন কতিপয়ের পকেটে বন্দি, নিজের স্বার্থ ছাড়া এরা আর কিছু বােঝে না, সারাটা দেশকে লুটেপুটে খাচ্ছে এরা, এদেরকে গদিছাড়া করতে না পারলে দেশের আর কোনাে ভবিষ্যত নেই। কায়েদে আজম’ নেই, কায়েদে মিল্লাত’ নেই, মুসলিম লীগ আর পাকিস্তান চলে গেছে কতকগুলাে বাটপারের দখলে। এই বাটপারদের হাত থেকে দেশটাকে উদ্ধার করতে হলে পকেট লীগের বদলে নতুন লীগ চাই। সেই নতুন লীগেরই নাম আওয়ামী লীগ। আসল নাম যদিও আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং তা থেকে মুসলিম’ শব্দটি খসেছে অনেক পরে, তবু গােড়া থেকেই মানুষের মুখে মুখে সংগঠনটির নাম আওয়ামী লীগই হয়ে গিয়েছিলাে। এই আওয়ামী লীগই, অনেক লােকের বিবেচনায়, পকেট লীগ বা মুসলিম লীগের বিকল্প হয়ে উঠেছিলাে। শিশু রাষ্ট্র পাকিস্তানে বিরােধী দল বলতে ছিলাে দুটো কংগ্রেস ও ক্যুনিস্ট। কংগ্রেসের কাজকর্ম সীমাবদ্ধ ছিলাে পূর্ববঙ্গ আইনসভা আর পাকিস্তান গণপরিষদের অভ্যন্তরে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বসন্তকুমার দাস, রাজকুমার চক্রবর্তী, শ্রীশ চট্টোপাধ্যায়, মনােরঞ্জন ধর এবং এরকম আরাে কয়েকজন কংগ্রেসীর নাম পাওয়া যেতাে খবরের কাগজের পাতায়। এরা সরকারের নানা গণবিরােধী কাজের প্রতিবাদ জানিয়ে গণপরিষদ ও আইনসভায় বক্তৃতা দিতেন। আর সরকারি দলের নেতারা এদেরকে চিহ্নিত করতেন ভারতের দালাল তথা পাকিস্তানের দুশমন রূপে। মূলত হিন্দু অধ্যুষিত ‘পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস’ নামক এ সংগঠনটির পক্ষে কার্যকর বিরােধী দল রূপে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া কোনাে মতেই সম্ভব ছিলাে না। আর কনিষ্ট? ওরা তাে খােদাদ্রোহী, ধর্মদ্রোহী! পাকিস্তানের মতাে পবিত্র ইসলামী রাষ্ট্রে ওদের ঠাই হয় কী করে? পাকিস্তান রাষ্ট্রের সকল নেতা আর পাতিনেতা সর্বক্ষণই কম্যুনিস্টদের মুণ্ডুপাত করে চলেছেন। দেশের জনগণকে সবসময় তারা কম্যুনিস্টদের সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছেন, আশেপাশে ডাইনে-বাঁয়ে সর্বত্র তারা কমুনিস্টের ভূত দেখছেন। আঠারােশাে আটচল্লিশ সালে মার্কস-এঙ্গেলস তাদের রচিত কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টোতাে বলেছিলেন—ইউরােপ ভূত দেখছে, কম্যুনিজমের ভূত। তারই একশাে বছর পরে, উনিশোে আটচল্লিশ সাল থেকে, কমুনিজমের সবগুলাে ভূত যেন পাকিস্তানে এসে জড়াে হয়ে গিয়েছিলাে! তাই পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিরা দিনরাত বিরামহীনভাবে সেই ভূত তাড়ানাের মন্ত্র জপ করে যাচ্ছিলেন!
সকল রকম জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেও কম্যুনিস্টরাই যে পাকিস্তানের জনগণের ন্যায্য অধিকার রক্ষার জন্যে এখানে ওখানে নানা সংগঠন গড়ে তুলছেন, কৃষক-শ্রমিকমধ্যবিত্তদের জন্যে সগ্রাম করে চলছেন, কোথাও কোথাও সে সংগ্রাম রক্তক্ষয়ী রূপ ধারণ করছে—সে সব খবর জনগণের কাছে খুব কমই পৌঁছতে পেরেছিলাে। পৌছলেও তার রূপ হয়ে গিয়েছিলাে একান্ত বিকৃত। আমাদেরই নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুর আর কলমাকান্দা,
১৯৩
জামালপুরের শেরপুর-নালিতাবাড়ি এবং সুনামগঞ্জের কিছু এলাকা জুড়ে যে কম্যুনিস্ট নেতা মনি সিংহের নেতৃত্বে হাজং কৃষকদের বীরত্বপূর্ণ টংক আন্দোলন চলছিলাে, তারও সঠিক খবরটি আমাদের কাছে পৌঁছায়নি। লােকমুখে কেবল শুনেছি যে, কলমাকান্দা ও সুসং দুর্গাপুরের গারাে-হাজংরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তারা আদিস্থান’ কায়েম করতে চায়। এই আদিস্থানের যুদ্ধটি চালাচ্ছে পাকিস্তানের জানী দুশমন কম্যুনিস্টরা। মনি সিংহ হচ্ছে তাদের নেতা। অথচ কথাগুলাে ছিলাে ডাহা মিথ্যা। মনি সিংহের আন্দোলনের সঙ্গে গারােদের ‘আদিস্থানের কোনাে সম্পর্ক ছিলাে না। এমনকি মনি সিংহের নেতৃত্বে পরিচালিত কৃষক আন্দোলনে কোনাে গারােই যােগ দেয়নি। এ এন্দোলনে হাজংরা ছিলাে কুশীলব। আদিস্থানের মতাে কোনাে পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ তাদের ছিলাে না। তারা শুধু টংক নামক একটি জঘন্য সামন্ততান্ত্রিক শােষণের হাত থেকে মুক্তি চেয়েছিলাে। হাজংদের মতােই সাঁওতাল কৃষকদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের খবরও আমরা জানতে পারিনি। কৃষকনেত্রী ইলা মিত্রের ওপর সেই বর্বর নির্যাতন, রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে সাতজন কৃষক ও বামপন্থী নেতার নির্মমভাবে নিহত হওয়া, দেশের বিভিন্ন জেলখানায় কম্যুনিস্ট ও অন্যান্য বামপন্থী বন্দিদের প্রতি অমানবিক আচরণ—এ সব কোনাে খবরই সাধারণ মানুষ পায়নি। রামপুর পােস্ট অফিসে পত্রিকা পাঠের আসরে এ সব প্রসঙ্গে কোনাে কথা কোনাে দিনই শুনিনি। কম্যুনিস্টদের অভ্যন্তরীণ সব খবরাখবর—আটচল্লিশে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস, সে কংগ্রেসের ভেতর থেকেই পাকিস্তানের পৃথক ক্যুনিস্ট পার্টির জন্ম, রণদিভে থিসিস, বামবিচ্যুতি ও সগ্রামের হঠকারী লাইন, বামবিচ্যুতির সংশােধন—কোনাে কিছুর সম্পর্কেই আমাদের তেমন অবহিতি ছিলাে না। কম্যুনিস্ট ও বামপন্থীদের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ উদ্যোগেই যে নানা দমন-পীড়নের মধ্যেও যুবলীগের মতাে সংগঠন গড়ে উঠেছিলাে—মফস্বলের সাধারণ মানুষ তাে দূরের কথা, রাজনীতি-সচেতন মানুষ ও পত্রপত্রিকার নিয়মিত পাঠকদের কাছেও সে খবর খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বামপন্থী চেতনাশ্রয়ী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কেবল ‘গণতন্ত্রী দলটির কথা সে সময় শুনেছি বলে আবছা আবছা মনে পড়ে। এর অনেক পরে কলেজে পড়তে যখন শহরে গিয়েছি, তখনই কেবল পাকিস্তানের প্রাথমিক দিনগুলােতে সকল প্রতিকূলতার মুখেও কম্যুনিস্টরা এদেশে কীভাবে গণসংগ্রামের ভিত গড়ে তুলেছিলাে তার কিছু কিছু খবর জানতে পেরেছি।
তেপ্পান্ন সালে গ্রামাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে মুসলিম লীগের প্রতি যে ক্ষোভের প্রকাশ দেখেছি তা অবশ্যই কমুনিস্টদের প্রত্যক্ষ প্রেরণাজাত নয়। তবে এ-ও লক্ষ করেছি যে, কম্যুনিস্ট জুজুর ভয় দেখিয়ে তখন আর মানুষকে আগের মতাে তাতানাে যাচ্ছে না। সকলের মুখে মুখে আওয়ামী লীগের কথা। আওয়ামী লীগের ভেতরেও কম্যুনিস্টরা ঢুকে গেছে, আওয়ামী লীগের নামে কম্যুনিস্টরাই আমাদের সকলের সাধের স্বাধীন পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে—সরকারি লীগপন্থীদের এ ধরনের কথার জবাব খুবই কড়া ভাষায় দিতে এখন আর অনেকেই পিছপা হয় না। আমার কখনাে কখনাে মনে হয়েছে যে, অদৃশ্য ক্যুনিস্ট ভূতের বিরুদ্ধে গদা ঘুরিয়ে পাকিস্তানের লীগ শাসকরা কম্যুনিস্টদের অপকারের বদলে উপকারই করেছেন। কারণ যারাই জনগণের যে কোনাে ন্যায্য অধিকার বা প্রাপ্য আদায়ের জন্যে দাবি তুলেছে তাদেরই বলা হয়েছে কম্যুনিস্ট। শাসক শ্রেণীর অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে যারা কথা বলেছে তারাই হয়ে গেছে কমুনিস্ট। শাসক দলের এ রকম প্রচারের ফল দাঁড়ালাে এই: যারা
১৯৪
কম্যুনিজম বা কমুনিস্টের মাথামুণ্ডু কিছুই জানতাে না বা বুঝতাে না তাদেরও মনে হতে লাগলাে যে, ক্যুনিজম বিষয়টা খারাপ কিছু নয়, কম্যুনিস্টরাও খারাপ মানুষ নয় ।
তেপ্পান্ন সালে শুরুতেই দেখলাম: বাহাগু গ্রামের আবদুস শাহিদ আমাদের এলাকায় আওয়ামী লীগের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের প্রচারে কোমর বেঁধে লেগে গেছে। শাহিদ ছিলাে বেখৈরহাটি হাইস্কুলে আমার সহপাঠি। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়েই দেখেছি যে, শাহিদ রাজনীতির ব্যাপারে ভীষণ উৎসাহী। সেই রাজনীতি পাকিস্তান ও মুসলিম লীগের। শিশুরাষ্ট্র পাকিস্তান ও তার দুশমনদের সম্পর্কে মুসলিম লীগ নেতাদের কথাগুলােই সে তােতা পাখির মতাে আওড়াতাে। হিন্দুরা পাকিস্তানের দুশমন—এই মহাসত্যটি সে সময়ে অসময়ে উচ্চকণ্ঠে ঘােষণা করতাে। হিন্দুস্থানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে পাকিস্তানের বীর সৈন্যরা কীভাবে চোখের পলকে হিন্দুস্থানের রাজধানী দিল্লী দখল করে নেবে তার নিখুঁত বর্ণনা সে করে যেতে পাকভারতের মানচিত্র সামনে রেখে।
সেই শাহিদের মুখেই এখন শুনলাম যে, বদমাশ মুসলিম লিগাররা পাকিস্তানের সর্বনাশ করে চলেছে, এদের হাত থেকে যে করেই হােক দেশটাকে রক্ষা করতে হবে। সব সময় একটা কৃত্রিম ভারত-বিরােধিতার ভাব এরা জিইয়ে রাখতে চায়। উদ্দেশ্য: আসল সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে নিজেদের গদিকে নিরাপদ রাখা। মুসলমানদের মনে হিন্দু বিদ্বেষকেও এরা স্থায়ী করে রাখতে চায় একই উদ্দেশ্যে। কাজেই, গদি থেকে এদের টেনে নামাতেই হবে।
শাহিদের মুখে এমন ধরনের কথা শুনে, মাত্র চার/পাঁচ বছরের ব্যবধানে তার এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখে, আমি একেবারে অবাক হয়ে গেলাম। শাহিদই আশপাশের গ্রামের যুবকদের নিয়ে এখানে আওয়ামী লীগের সংগঠন দাঁড় করিয়ে ফেললাে। নেত্রকোনা মহকুমার আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে এসে সে বেখৈরহাটি বাজারে, রামপুর বাজারে ও তার পাশের গ্রামগুলােতে ছােট ছােট সভার অনুষ্ঠান করতে লাগলাে। সে সব সভায় বক্তারা মুসলিম লীগ সরকারের সকল দুর্নীতি ও কুকীর্তির খতিয়ান তুলে ধরলেন। পাকিস্তানের জন্মের প্রায় পর থেকেই যে দেশে দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছে, নূরুল আমিন সরকারই যে আমাদের ষােল টাকা সের দরে লবণ কিনতে বাধ্য করেছে, আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছে, মাতৃভাষার অধিকার দাবি করার অপরাধে (?) বন্দুকের গুলিতে ছাত্রদের বুক ঝাঝরা করে দিয়েছে—এ সবই ছিলাে বক্তাদের প্রচণ্ড আবেগপূর্ণ বক্তৃতার বিষয়বস্তু। বক্তৃতার প্রধান অংশ জুড়ে থাকতাে পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন ও অন্যান্য মন্ত্রীদের দুর্নীতি ও লুটপাটের কথা। মুসলিম লীগ-বিরােধী বক্তাদের কথাগুলাে সবচেয়ে বর্ণময় হয়ে উঠতাে মন্ত্রীদের দুর্নীতির বর্ণনায় । নূরুল আমিন একটি শ্বেতপাথরের বাড়ি বানিয়েছে। বাড়ি তাে নয়, সম্রাটের প্রাসাদ! সেই প্রাসাদের বর্ণনা শুনতে শুনতে রূপকথা শুনে অভ্যস্ত গ্রামীণ শ্রোতাদের চোখ চকচক করে উঠতাে। তখনই বক্তারা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠতেন, নূরুল আমিনরা এই রাজপ্রাসাদ এই আমিরি বালাখানা বানিয়েছে আমার-আপনারই গায়ের রক্তজল করা ট্যাক্সের পয়সা চুরি করে। আমাদের প্রত্যেকটি পাই-পয়সার হিসেবে তাদের দিতে হবে। আমরা তাদের এই প্রাসাদের একটি একটি করে পাথর খসিয়ে আনবাে। জনতার আদালতে তাদের বিচার হবে। … ভাইসব, কিছুদিন পরই দেশে ইলেকশন হবে, ভােট হবে। ওরাও আপনাদের কাছে ভােট চাইতে আসবে। তখন আপনারা…।’
১৯৫
ভােটের বক্তৃতা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাদের চোখমুখের রঙ অন্যরকম হয়ে যায় । ভােটের অস্ত্র দিয়েই তারা কীভাবে নূরুল আমিনদের ছারখার করে দেবে, সেই কল্পনায় তারা উত্তেজিত ও উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। কেউ কেউ প্রাকৃত বুলি উচ্চারণ করে নূরুল আমিন আর তার মন্ত্রী মিনিস্টারসহ সকল মুসলিম লিগারের নামে খিস্তি করতে থাকে। ষােল ট্যাহা সেরের লবণ খাওয়াইয়া তারা আবার ভােট চাইতে আইবাে কোন লাজে? …. আমরার পােলাপানরে যারা গুলি কইর্যা মারছে, ভােট দেওনের বদলে তারার কপালে ঝাটা মারবাম।…’
ইলেকশানের সময় যতাে এগিয়ে আসতে থাকে উত্তেজনা তততা বাড়তে থাকে। আট বছর আগে, ছেচল্লিশ সালে, ভোেট হয়েছিলাে। সেই ভােটের ফলেই জন্ম নিয়েছিলাে পাকিস্তান। শাসকদের অনেক টালবাহানার শেষে, পাকিস্তানের জন্মের সাত বছর পরে, চুয়ান্ন সালে, আবার ভােট হতে যাচ্ছে। ছেচল্লিশের ভােটারদের মুখের জিগির ছিলাে—পাকিস্তান জিন্দাবাদ, মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ। সেবারের জিন্দাবাদটা ছিলাে অজাত পাকিস্তানের জন্যে, পাকিস্তানের ধাত্রী শক্তি মুসলিম লীগের জন্যে। আর এবারের ভােটাররা বাস্তবের পাকিস্তানের জন্যে জিন্দাবাদ দেবে বটে, কিন্তু মুসলিম লীগের জিন্দাবাদ দেবে কয়জন?

ভােট দেবেন কিসে? নৌকা মার্কা বাক্সে
চুয়ান্ন সালের শুরুতে, তখনকার পূর্ববঙ্গ আইন সভার (লেজিসলেটিভ এ্যাসেম্বলি) নির্বাচনের দিন যতােই এগিয়ে আসতে লাগলাে ততােই স্পষ্ট হয়ে উঠলাে যে, ভাড়াটিয়া লােক ছাড়া মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ’ বলার মতাে লােকের সংখ্যা একেবারেই কমে এসেছে। মুসলিম লীগের পয়সা খেয়ে যারা বাজারে বাজারে গিয়ে লীগের হারিকেন মার্কায় ভােট দেবার জন্য ক্যানভাস করেছে, তাদেরও অনেককেই দেখা গেছে নিজের পাড়া-পড়শির কাছে যুক্তফ্রন্টের নৌকায় ভােট দেয়ার জন্য আবেদন জানাতে। প্রথম কাজটি করেছে পয়সার খাতিরে, দ্বিতীয়টি মনের তাগিদে। এ ব্যাপারটিতে গাঁয়ের মানুষদের অভিনব রসবােধের পরিচয়ও ধরা পড়েছে। দেখা গেছে: ভােটের দিনেও গাঁয়ের অনেক ভােটার আগে গেছে মুসলিম লীগের ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে বেশ মৌজ করে মুসলিম লিগারদের পান-সিগারেট খেয়েছে। কেউ যদি জিজ্ঞেস করেছে যে, কী ব্যাপার, তােমাকে তাে যুক্তফ্রন্টের সমর্থক বলে জানতাম, তবে তুমি মুসলিম লীগের ক্যাম্প থেকে পান-সিগারেট খাচ্ছ কেন? তাহলে একগাল হেসে সেই ভােটারটি জবাব দিয়েছে, মুসলিম লীগের কিছু ক্ষতি করে গেলাম।
‘মুসলিম লীগের ক্ষতি করা’—বাংলাভাষায় এই কথাগুলাে একটি নতুন ইডিয়ম বা বাগধারা হিসেবে চালু হয়ে গিয়েছিলাে সেই চুয়ান্নর নির্বাচনের সময় থেকেই। এভাবেই নানা সামাজিক বা রাজনৈতিক ঘটনা ভাষায় নানা বাগধারার জন্ম দেয়। কোনাে কোনােটি ভাষার ভেতর চিরস্থায়ী শিকড় গেড়ে বসে, কোনােটির আয়ু হয় স্বল্পস্থায়ী। চুয়ান্নর নির্বাচনের সময়কার এই বাগধারাটি স্বল্পায়ুই হয়েছিলাে। এখন আর কারাে মুখে এটি শুনতে পাই না। আমার সমবয়সীদের মধ্যে কেউ কেউ হঠাৎ এটি ব্যবহার করে ফেললেও অন্যদের কাছে এর তাৎপর্য ধরা পড়ে না। অর্থাৎ সময়ের ব্যবধানে এর ভাবানুষঙ্গটি হারিয়ে গেছে। তবু আমার মনে আছে, চুয়ান্ন সনের পরেও অনেককাল ধরে আমরা নিজেদের মধ্যে এই ইডিয়মটি ব্যবহার করে পুলক অনুভব করেছি।
১৯৬
তবে চুয়ান্ন সনে এদেশের মানুষ মুসলিম লীগের কিছু ক্ষতি নয় শুধু, একেবারে ভরাডুবি ঘটিয়ে ছেড়েছিলাে। পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক আইন সভার নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টেরই হয়েছিলাে জয়জয়কার। দুশাে সাঁইত্রিশটি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট পেয়েছিলাে দু’শাে সাতাশটি।
ভােটের বছর খানেক আগে থেকে আমাদের এলাকার মানুষ মেতেছিলাে আওয়ামী লীগের নামে। ভােটের আগে আগে পরিচিতি পেয়ে গেলাে যুক্তফ্রন্ট’ নামটা। কারণ, আওয়ামী লীগ তখন জোটবদ্ধ হয়েছে মুসলিম লীগ-বিরােধী আরাে কয়েকটি দলের সঙ্গে। কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম, গণতন্ত্রী পার্টি, খিলাফতে রাব্বানী আর আওয়ামী লীগ মিলেই হলাে যুক্তফ্রন্ট। তবে, শতকরা নম্বই ভাগ মানুষের চেতনাতেই আওয়ামী লীগ বা যুক্তফ্রন্ট কোনাে নামই তেমন কোনাে তাৎপর্যবহ ছিলাে না, তারা চিনেছিলাে ‘নৌকা। তখনাে পৃথক নির্বাচন প্রথা বহাল ছিলাে। আমাদের নির্বাচনী এলাকায় (কেন্দুয়া থানায়) আইন সভার মুসলিম আসনের জন্য প্রার্থী ছিলেন তিনজন—মুসলিম লীগের আহছান আলী মােক্তার, আওয়ামী মুসলিম লীগ তথা যুক্তফ্রন্টের ইনসান ভূইয়া উকিল, আর নির্দলীয় শমসের আলী। মুসলিম লীগের হারিকেন, যুক্তফ্রন্টের নৌকা আর নির্দলীয়ের ছাতা ছিলাে নির্বাচনী প্রতীক। ভােটের দিন যতােই এগিয়ে আসে, মানুষ (অন্তত গাঁয়ের মানুষ) ততােই দল বা প্রার্থীর কথা ভুলে যেতে থাকে। প্রতীকটাই তখন তার কাছে প্রধান হয়ে ওঠে। না, ‘প্রতীক’-এর মতাে একটি গম্ভীর তৎসম শব্দও নয়। বাঙালি প্রাকৃতজন এর জন্য বৈদেশিক উৎসজাত একটি শব্দ ব্যবহার করতেই একান্ত স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করে। সেটি হচ্ছে মার্কা। ভােট দেবেন কিসে? অমুক মার্কা বাক্সে। উনিশ শো চুয়ান্ন সন পর্যন্ত এই ছিলাে বাঙালির নির্বাচন যুদ্ধের প্রধান রণধ্বনি। সত্তর সাল থেকে প্রার্থীদের জন্য পৃথক পৃথক মার্কা দেয়া বাক্সের বদলে একই ব্যালট পেপারে সকল প্রার্থীর প্রতীক মুদ্রিত হতে থাকে, প্রত্যেক ভােটার তার নির্বাচিত প্রার্থীর প্রতীকে সিল মেরে একই বাক্সে তা ফেলে দিয়ে আসে। তখন থেকেই অমুক মার্কা বাক্সে’ কথাটা অপ্রচলিত হয়ে পড়ে। তবে ‘প্রতীক’ বা ‘মার্কা’ যে শব্দই ব্যবহার করুক, আসলে প্রাকৃতজন এই প্রতীককে ঘিরেই তার চিন্তা ও কল্পনার জাল বিস্তার করে। কখনাে কখনাে নির্বাচনের কোনাে কোনাে প্রতীক গণমনে দীর্ঘস্থায়ী সংস্কার বা কুসংস্কারেরও জন্ম দিয়ে ফেলে, এবং গণমনের এই সংস্কারটিকে ধূর্ত রাজনীতিকরা নানাভাবে তাদের নিজেদের কাজে লাগায়; জনগণকে প্রয়ােজন মতাে বিভ্রান্ত, উত্তেজিত বা মােহগ্রস্ত করে। চুয়ান্নর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের সমর্থকদের তৈরি একটি ছড়া বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলাে। ছাতা মাথে হারিকেন হাতে, ভােট দিবেন ভাই নৌকাতে। আরেকটি ছড়া-হারিকেনে তেল নাই, মুসলিম লীগের ভােট নাই। যুক্তফ্রন্টের সমর্থকরা গায়ের মানুষজনের কাছে নৌকার মাহাত্ম্য বর্ণনা করতাে নানান কায়দায়। খাল-বিলনদীনালা পরিবেষ্টিত বাংলার মানুষের যে নৌকা ছাড়া গতি নেই, আমাদের মুর্শিদি গানেও যে। আছে মুর্শিদ পার করাে আমারে’-র আকুতি, নৌকা দিয়ে নদী পারাপারের ভাবানুষঙ্গেই যে লৌকিক ধর্মানুসারী গণমানুষ পরলােক যাত্রার কথাও ভাবে—গণমনস্তত্ত্বের এইসব উপাদানকেই নিপুণ কৌশলে ব্যবহার করা হয়েছিলাে নৌকামার্কা বাক্সে ভােট আকর্ষণের জন্যে।
আবার অন্যদিকে, মুসলিম লিগাররা মানুষের মনকে নৌকার প্রতি বিরূপ ও বীতশ্রদ্ধ করে তােলার চেষ্টায় একেবারে মরীয়া হয়ে লেগে গিয়েছিলাে। তারা বারবার ভাঙা নৌকার কথা বলে বলে মানুষকে ভয় দেখাতে লাগলাে ‘আগে জানলে তাের ভাঙা নৌকায় চড়তাম না’
১৯৭
গানের এই কলিটির জুৎসই ব্যবহারের চেষ্টা চালালাে। আমাদের এলাকার জনপ্রিয় বাউল গায়ক মজিদ মিঞাকে দিয়ে নৌকা বিরােধী গান রচনা করালাে ম্যাড়া মান্দার শিমুল কাঠে, বিচিত্র এক নৌকা বটে’-এ-রকম ধূয়াযুক্ত একটি লম্বাগান গেয়ে মজিদ মিয়া বাজারে বাজারে নৌকা-বিরােধী তথা যুক্তফ্রন্ট-বিরােধী প্রচারণা চালালেন। ম্যাড়া, মান্দার আর শিমুল হলাে খুবই পচা কাঠ। এ-সকল কাঠেরই তৈরি যুক্তফ্রন্টের নৌকা। এ-নৌকার মাঝিমাল্লা হচ্ছেন মৌলানা ভাসানী, ফজলুল হক ও সােহরাওয়ার্দী। নৌকা ফুটো হয়ে গেছে, পানিতে ভরে গেছে, এর ডুবুডুবু অবস্থা। এ-নৌকায় যে-ই চড়বে, সে-ই ডুবে মরবে। মজিদ মিঞার পুরাে গানটায় ছিলাে এ-রকমের সব কথাবার্তা।
অথচ মজিদ মিঞা চল্লিশের দশক থেকেই জনপ্রিয় হয়েছিলেন তাঁর গণ-অধিকার সম্পন্ন গানগুলাের জন্যে, তার যেমন ছিলাে অসাধারণ সুরেলা কণ্ঠ, তেমনি তার গানের কথাগুলােতেও এক সময়ে গণমানুষের আশা ও আবেগ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতাে। দেহতত্ত্ব, মারফতি আর মুর্শিদি গানের গতানুগতিক ধারার ভেতরেই সমাজ-চেতনার প্রাণপ্রবাহ সঞ্চার করে দিয়ে তিনি একদিন গ্রামীণ জনগণের হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন, নিবারণ পণ্ডিত আর অখিল ঠাকুরের মতাে বিপ্লবী গণসংগীতকারদের পাশে তিনিও সম্মানজনক ঠাই পেয়েছিলেন, পঁয়তাল্লিশ সালের সারা ভারত কৃষক সম্মেলনে তাঁর গান দিয়ে তিনি বঞ্চিত কৃষকদেরকে অধিকার-চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আর আজ উনিশ শো চুয়ান্ন সালে, সেই মজিদ মিঞা হয়ে গেলেন গণ অধিকার-অপহরণকারী মুসলিম লীগ চক্রের ভাড়াটে গায়ক। হাটেবাজারে গিয়ে গান গেয়ে লােক জড়াে করেন তারপর মুসলিম লীগ নেতাদের শিখিয়ে দেয়া বস্তাপচা কথাগুলাে গেলাতে চেষ্টা করেন। বলেন: নৌকায় ভােট দিলে দেশটা হিন্দুদের দখলে চলে যাবে, যে সব হিন্দু জমিদার তালুকদার মহাজন হিন্দুস্থানে চলে গেছে তারা আবার এদেশে ফিরে আসবে, মুসলমান প্রজাদের সঙ্গে তারা কুকুর বেড়ালের মতাে ব্যবহার করবে, জুতা পায়ে বা ছাতা মাথায় তাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে মুসলমানদের হাঁটতে দেবে না, পাকিস্তান হওয়ার পর গায়ের মুসলমানরা যে জমি জিরাতের মালিক হয়েছে সবই ওই হিন্দুরা কেড়ে নেবে।
মজিদ মিঞার এ-সব কথা অধিকাংশ শ্ৰোতাই বিশ্বাস করেনি, করলে তারা এতাে বিপুল সংখ্যায় নৌকা মার্কা বাক্সে ভােট দিতাে না। কিন্তু আমি ভাবতাম: মজিদ মিঞার এমন পরিণতি কী করে হলাে? একজন গণকবি রাতারাতি গণবিরােধী হয়ে যান কী করে?
মজিদ মিঞাকে আমি সরাসরি কোনােদিন এ প্রশ্ন করিনি। করলে তিনি অবশ্যই ব্ৰিত হতেন। তবে তার সঙ্গে আলাপচারিতার বুঝে নিয়েছি যে অনেক প্রতিভাবান লােককবিই যে প্রক্রিয়ায় এস্টাব্লিশমেন্টের কাছে বিক্রিত হয়ে যান ও নিজের সৃষ্টিকে বিকৃত করে ফেলেন, মজিদ মিঞাও সেই প্রক্রিয়াটির অধীন হয়ে গেছেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশীল মানুষদের অনুগ্রহে তিনি সরকারি অনুষ্ঠানে যােগ দেয়ার সুযােগ পেয়েছেন, পাকিস্তান রেডিওর সংগীতশিল্পী হয়েছেন, দু’টি পয়সার মুখ দেখেছেন। সেই অনুগ্রহের বলয় থেকে বেরিয়ে আসা। তাঁর পক্ষে ছিলাে কঠিন।
কঠিন তাে হয় অনেকের পক্ষেই। ক্ষমতাবানের অনুগ্রহের বলয় ভেঙে বেরিয়ে আসার পথে প্রধান বাধা দু’টো। লােভ আর ভয়। অনুগ্রহকে গ্রহণ করার মধ্যে প্রাপ্তির লােভ যেমন থাকে, তেমনি তাকে প্রত্যাখ্যান করলে থাকে নিগ্রহের ভয়। ক’জন মানুষ পারে লােভ আর
১৯৮
ভয়কে জয় করতে? পারে না বলেই লােককবি তথা গ্রামীণ এলিট মজিদ মিঞার মতাে শহর নগরের অনেক বাঘা বুদ্ধিজীবীও এস্টাব্লিশমেন্টের সেবাদাস হয়ে যায়।
সে যাই হােক, চুয়ান্ন সালে পূর্ববঙ্গের মুসলিম ভােটাররা মজিদ মিঞা কিংবা মুসলিম লীগের কথায় বিশ্বাস করেনি, হিন্দু জুজুর ভয়ে ভীত হয়নি, এবং মুসলিম লীগকে ভােট দেয়নি। তার মানে কিন্তু এ নয় যে সে-সময়েই দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান ঘটে গিয়েছিলাে। যুক্তফ্রন্ট যে একুশ দফা প্রণয়ন করেছিলাে তার কোনাে একটি দফাতেও। অসাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মনিরপেক্ষতার কোনাে কথা ছিল না। বরং ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার লালন ও পােষণেরই নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিলাে। নীতিটি ছিলাে—‘কোরান ও সুন্নার মৌলিক নীতির খেলাফ কোনাে আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবন ধারণের ব্যবস্থা করা হইবে।’
অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের অনুসারী যারা নয়, যুক্তফ্রন্টের মূলনীতিতে তাদের জন্য কিছুই বলা হয়নি। না বলা কথা থেকে বড়াে জোর এ-রকম সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নামে যুক্তফ্রন্টও মুসলিম লীগের মতােই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে পবিত্র আমানত রূপে গ্রহণ করার পক্ষে। যুক্তফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত সবচেয়ে বড়াে দল আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকেও তখনাে মুসলিম’ শব্দটাকে বাদ দেয়া হয়নি। তাই ধরে নেয়া যেতে পারে যে, অনেক প্রগতিশীল কর্মসূচী সত্ত্বেও তখনাে এ-দলটি ছিলাে সাম্প্রদায়িকই। তা ছাড়া যুক্তফ্রন্টে ছিলাে মৌলানা আতহার আলীর ‘নেজামে ইসলাম। এ দলের ঘােষিত লক্ষই তাে ছিলাে পাকিস্তানে ইসলামি হুকুমাত কায়েম করা। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী সভাগুলােতে এমন একটি গান শুনতাম, যে গানের ধ্রুবপদ ছিলাে—‘আল্লা তুমি কায়েম করাে নেজামে ইসলাম/ হায় হায় নেজামে ইসলাম।
এসব কারণেই ইসলাম বিপন্নের ধুয়া তুলে বা কম্যুনিস্ট ও হিন্দু জুজুর ভয় দেখিয়ে মুসলিম লিগাররা চুয়ান্নর নির্বাচনে ভােটারদের ভজাতে পারিনি। যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার সব দফা নিয়ে গাঁয়ের কৃষক জনতার মাথাব্যথা ছিলাে না। তারা পাটের ন্যায্য দাম পাবে, খাজনা ট্যাক্স কমে যাবে, সার্টিফিকেট যােগে খাজনা আদায়ের জুলুম থাকবে না, এখানে সেখানে ঘুষ দিতে হবে না, লবণের দাম শস্তা হবে, শস্তায় কাপড় কেনা যাবে, ছেলে-মেয়েদের বিনা খরচে লেখাপড়া শেখাতে পারবে, লেখাপড়া শেখানাের জন্য ছেলেদের শহরে পাঠালে সেখানে গুলি খেয়ে মরতে হবে না—নৌকা মার্কা বাক্সে ভােট দেয়ার পক্ষে এ-সবই ছিলাে তাদের বিবেচনা। শিক্ষিত প্রগতি-চেতন মানুষদের দৃষ্টিতে অবিশ্যি একুশ দফার আরাে গভীরতর তাৎপর্য ধরা পড়েছিলাে। যদিও একুশ দফায় অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগঠনের প্রত্যয় ব্যক্ত হওয়ার বদলে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রনীতির কথাই বলা হয়েছে, তবু তাঁরা এতে গণতন্ত্রের চর্চা, বাংলাভাষার অধিকার আর পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন অর্জনের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁরা এ-ও বুঝে নিয়েছিলেন যে, বাংলা ভাষার অধিকার আর পূর্ববঙ্গে স্বায়ত্তশাসন মানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা। মানে আখেরে পাকিস্তানের মৃত্যুঘণ্টা বেজে যাওয়া। যারা সুদূর প্রসারী চিন্তা করতে পারেন তাঁরা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে, নীতি হিসেবে একুশ দফার শীর্ষে যতাে বড়াে করেই ধর্মের কথা লেখা থাকুক না কেন, একুশ দফার বিজয় মানে আস্তে আস্তে সেকুলারিজমের পথ খুলে যাওয়া, পাকিস্তানের মৃত্যুর বীজতলা তৈরি হওয়া। তাই নিরক্ষর কৃষক-মজুরের সঙ্গে সাক্ষর মধ্যবিত্ত সমান জোরের সঙ্গেই স্লোগান তুলেছিলাে- ‘ভােট দেবেন কিসে? নৌকা মার্কা বাক্সে।
১৯৯
গাঁয়ের কৃষকদের এই নৌকা মার্কা বাক্সের প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণের আরাে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিলাে। সেটি হচ্ছে যুক্তফ্রন্টের অন্যতম নেতা রূপে হক সাহেবের অবস্থান। শেরে বাংলা ফজলুল হক ছেচল্লিশের নির্বাচনে পাকিস্তানি জোয়ারের মুখে মুসলিম লীগের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। কৃষকরা সে সময়ে তাকে শুধু প্রত্যাখ্যানই করেনি, নেত্রকোনায় এসে তিনি লাঞ্ছিতও হয়েছিলেন। অথচ এর আগে তিনিই তাে ছিলেন বাংলার কৃষকের নয়নমণি। তাঁকে নিয়ে রচিত হয়েছিলাে অনেক গল্পগাথা আর কিংবদন্তী। সাতচল্লিশের পরে বেশ কয়েক বছর ধরে তার অবস্থান একান্ত গুরুত্বহীন হয়ে গেলেও, সে সময়েও, তাঁর কথা নিয়ে কিছু কিছু সত্যমিথ্যা গল্প এখানে ওখানে শােনা গেছে। এরকমই একটি গল্প ভােজনরসিক শেরে বাংলা নাকি একদিন বাজারে খাঁটি দুধ পাওয়া যায় না বলে খুব দুঃখ করছিলেন। তখন তাঁর একজন ভক্ত বললেন, “হুজুর, আপনার বাসায় তাে অনেক জায়গা আছে, কাজের লােকজনও আছে। আপনি অনায়াসে গােরু পােষার ব্যবস্থা করতে পারেন। তা হলে আর বাজারের দুধের ওপর নির্ভর করতে হবে না।’
শেরে বাংলা চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘গরু। গরু কোথায় পাবাে। দেশের সব গরুইতাে পাকিস্তান হওয়ার পর মন্ত্রী হয়ে গেছে?’
পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী সম্পর্ক এ রকম ব্যঙ্গপ্রবণ শেরে বাংলা যখন তাঁর কৃষক শ্রমিক পার্টি নিয়ে যুক্তফ্রন্টে এসে যােগ দিলেন, তখন বাংলার কৃষক তাঁর প্রতি পুরনাে দিনের সেই আবেগ ও আকর্ষণ নতুন করে অনুভব করলাে। তখন শেরে বাংলা যেখানেই সভা করতে যেতেন সেখানেই জনসমুদ্রের সৃষ্টি হতাে। তিনি যখন নৌকা মার্কায় ভােট দেয়ার কথা বলছেন, তখন বাংলার কোন্ কৃষক সে-কথা অমান্য করবে?
সম্প্রদায়-ভিত্তিক পৃথক নির্বাচনে মুসলিম লীগ বা যুক্তফ্রন্টের কোনাে প্রার্থীকেই ভােট দেয়ার অধিকার হিন্দুদের ছিলাে না। হারিকেন মার্কা বা নৌকা মার্কা কোনাে বাক্সই তাদের নয়। তবু যুক্তফ্রন্টের সভাগুলােতে হিন্দুরা দলে দলে যােগ দিতাে। হিন্দুদের সমস্যা বা সংকট সম্পর্কে এ-সব সভায় যদিও টু শব্দটিও উচ্চারণ করা হতাে না, তবু হিন্দুরা যুক্তফ্রন্টকে তাদের একান্ত আপন বলে ভাবতে লাগলাে। সভার শেষে যখন স্লোগান উঠতাে ‘ভােট দেবেন কিসে? নৌকা মার্কা বাক্সে’ তখন অন্য সবার সঙ্গে আমার বন্ধু সুশীল, গােপাল, দীনবন্ধু, ক্ষিতীশ, প্রাণেশরাও প্রবল উৎসাহে গলা মিলাতে।।

সাদা আর সবুজ নিশান, বংশদণ্ড ও পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস
পাকিস্তান আমলের পূর্ববঙ্গের দুই মাতালের গল্প শুনেছিলাম। একজন হিন্দু মাতাল, অপরজন ‘মুসলমান।
কিছু পরিমাণ লাল পানি পেটে যাওয়ার পরই মুসলমান’ মাতাল একেবারে দিল দরিয়া । সে তখন প্রাণ খুলে গাইছে, চাঁদতারা সাদা আর সবুজ নিশান/ আমাদের কওমি নিশান’। গান গাইছে আর গানের ফাঁকে ফাঁকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে হাঁক ছাড়ছে।
কিন্তু হিন্দু মাতাল কিছুতেই তার মুসলমান ইয়ারের সঙ্গে গলা মেলাতে পারছে না। এক পর্যায়ে হঠাৎ সে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতেই বলে, তােদের জন্য পাকিস্তান হয়েছে। তােরা চাঁদতারা কওমি নিশান পেয়েছিস। কিন্তু আমরা? আমি হিন্দু। আমি কি পেয়েছি? পাকিস্তান তােদের, নিশান তােদের। আমার তাে কিছুই নেই।”
২০০
বলতে বলতে তার কান্নার বেগ আরাে বেড়ে যায়।
তার ইয়ার তাকে সান্ত্বনা দেয়। আহা-হা। এতাে দুঃখ করছিস কেন? তাের জন্যেও তাে পাকিস্তানের নিশানে ভাগ আছে। দেখছিস না ওই সাদা অংশটা? নিশানের একেবারে পয়লাই তাে সাদা। এই সাদাটাই তাে তােরা——হিন্দুরা।
এবার কান্না থামিয়ে হিন্দু মাতাল চিৎকার করে বলে, হুঃ এই সাদাটাই আমরা, হিন্দুরা। ওটা তাে রেখেছিস বাঁশ দেয়ার জন্যে। ওই সাদাটার ভেতর দিয়েই তাে আমাদের বাঁশ দেয়া হয়। ওই বাঁশের আগাতেই তাে পাকিস্তানের নিশান ওড়ে।’
মাতালের কথাকে অবশ্যই বিবেচনায় নেয়ার কথা ছিলাে না। কিন্তু ওই বিজ্ঞ মাতালটির অন্তদৃষ্টির প্রশংসা না-করার কোনাে উপায় নেই।
আসলে পাকিস্তান যে যথার্থই একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, সে কথাটি এ রাষ্ট্রের নীতি ও শাসকদের আচরণের মধ্যে দিয়ে সব সময় স্মরণ করিয়ে দেয়া হতাে। পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র, এখানে ইসলামি হুকুমাত কায়েম হবে, মুসলমানের তাহজিব-তমদ্দুন রক্ষা করাই হচ্ছে এ রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব। এ-সব কথারই বিরামহীন পুনরাবৃত্তি চলতাে শাসকগােষ্ঠীর কণ্ঠে ও প্রচারমাধ্যমে। সে সঙ্গে ‘পবিত্র আমানত’ অমুসলমানদের জন্য কিছু করুণাও বর্ষিত হতাে বৈকি! ওরা সংখ্যালঘু, কাজেই রাষ্ট্রীয় সুযােগ সুবিধার লঘু অংশ তারা অবশ্যই পাবে। চাকরি বাকরিতে একটা কোটা নিশ্চয়ই থাকবে তাদের জন্য! তাই বলে তারা সংখ্যাগুরুর সমান ভাগ সমান মর্যাদা পাবে? অসম্ভব। কওমি নিশানে যে-রকম সাদা একটা অংশ রাখা হয়েছে, সে রকমই হবে তাদের অংশীদারিত্ব!
এ-রকম ঘােষিত নীতির অন্তরালে অঘােষিত ছিলাে সংখ্যালঘুদের বংশদণ্ড প্রদানের যে পাকিস্তানি নীতিটি, ‘হিন্দু মাতালের কথায় সেটিরই খােলাখুলি প্রকাশ ঘটেছিলাে। মাতালেরা বােধ হয় মিথ্যা কথা বলতে পারে না।
তবে মদের মাতালরা যা-ই বলুক, দেশপ্রেমের মাতালরা এ-অবস্থাটি মেনে নিতে পারেননি। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ নামক দলটিতে যে সব যথার্থ দেশপ্রেমিক ছিলেন তাঁদের অনেকেই দেশ মাতৃকার অঙ্গচ্ছেদে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠেছিলেন। এদের মধ্যে যাদের জন্মস্থান পড়ে গিয়েছিলাে পাকিস্তানের এলাকায়, তারা পাকিস্তানে অবস্থান করেই দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব পালনে ব্রতী হওয়ার সংকল্প ঘােষণা করলেন, মায়ের অঙ্গচ্ছেদ জনিত যন্ত্রণায় নিরসনের পথ খুঁজলেন। এ-রকমই একজন দেশপ্রেমিক কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত—তার সে সময়কার মনােভাব ব্যক্ত করে লিখেছিলেন, ‘সংকল্প করিলাম, আমি বাক্যে ও কর্মে নিজেকে পাকিস্তানি মনে করিয়া, পাকিস্তানের সর্বপ্রকার উন্নয়নের চেষ্টা করিব, আর যদি জনগণের সেবা করিতে পারি, তাহাই হইবে আমার জীবনের বিশ্বমানবের সেবা। যদিও ভারত বিভাগ আমরা চাই নাই।’
ভারত বিভাগ তারা না-চাইলেও ভারত বিভক্ত হয়ে বাস্তবে যে দেশটির প্রতিষ্ঠা ঘটেছে সে-দেশটি তাে তাদেরও। সে-দেশেরই জল হাওয়ায় তারা মানুষ হয়েছেন, সে-দেশেরই প্রতি তাদের আবেগঘন ভালােবাসা। এই ভালােবাসার টানেই তারা শত লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের মুখেও দেশ ছেড়ে চলে যাননি, নবজাত পাকিস্তান রাষ্ট্রের কল্যাণ ও স্থিতিশীলতা কামনা করেছেন মনে প্রাণে। পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস’ নাম ধারণ করে তাঁরা কেন্দ্রে (অর্থাৎ গণপরিষদে) ও পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক আইনসভায় বিরােধী দলের আসনে বসলেন। পরিষদীয় বিরােধী দল রূপে
২০১
কংগ্রেস ছাড়া সে সময়কার পাকিস্তানে আর কেউ ছিলাে না। কাজেই, বিরােধী দলের সদস্য হিসেবে কংগ্রেসীরাই দেশের জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার কথা গণপরিষদে ও প্রাদেশিক আইন সভায় তুলে ধরতে লাগলেন। তাঁদের সকল প্রস্তাব ও পরামর্শই ছিলাে অত্যন্ত গঠনমূলক, তাঁদের লক্ষ্য ছিলাে পাকিস্তানকে একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র রূপে গড়ে তােলা। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকদল মুসলিম লীগ ছিলাে মধ্যযুগীয় চিন্তাচেতনার ধারক, সব ধরনের প্রগতিশীলতার শত্রু। তাই স্বাভাবিক ভাবেই, তারা সব সময়ই বিরােধী দলভুক্ত কংগ্রেসীদের দেশপ্রেম সম্পর্কে কটাক্ষ করতাে, হিন্দুস্থানের দালাল আখ্যা দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে নানা অবমাননাকর বক্তব্য রাখতাে। তবু, সব অপবাদ আর অবমাননা সয়ে, যথার্থ দেশপ্রেমিকের ভূমিকা পালনে তারা অটল থেকেছিলেন। একদা ভারত বিভাগের বিরােধী ছিলেন বলেই বােধ হয় তাঁদের বিরুদ্ধে যখন-তখন ভারতের দালালির অভিযােগ আনা মুসলিম লিগারদের জন্য অনেক সহজ হয়েছিলাে। কিন্তু তাঁরা প্রতিবেশী ভারতের অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির প্রতি যেমন প্রকাশ্য সমর্থন জানাতেন, তেমনি সে-দেশের প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তির দুরাচার ও মিথ্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ জানাতেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবােধ করতেন না। এ-বিষয়ে বিশিষ্ট বামপন্থী তাত্ত্বিক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর অত্যন্ত মূল্যবান সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন,
“কংগ্রেস সদস্যেরা পূর্ববাংলার জনগণের বিরুদ্ধে ভারতীয় প্রচারণার জোর প্রতিবাদ করেন। সেটা ছিলাে ১৯৫০-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়।
“কলকাতার পত্রিকাগুলােতে পূর্ববাংলার পরিস্থিতির ওপর মিথ্যা সংবাদ প্রচার করার ফলে এখানে দৈনিক আজাদ’ ও ‘মর্নিং নিউজ’-এর মতাে পত্রিকা সেই মিথ্যা সংবাদকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে থাকে। পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বিরােধী দলের নেতা বসন্তকুমার দাস তখন তদন্ত কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেন, পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা পূর্ববঙ্গে হাঙ্গামা বাধার অন্যতম কারণ। তিনি আরও বলেন যে, পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রের বিভিন্ন সংবাদ ও মন্তব্য দাঙ্গা বাধার অন্যতম কারণ।
“কিন্তু সংবাদপত্র ছাড়াও বেতারের মতাে পুরােপুরি সরকার-নিয়ন্ত্রিত ভারতীয় প্রচার মাধ্যমে চরম মিথ্যা এবং তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টিকারী সংবাদ সে-সময় প্রচারিত হয়। এ-প্রচারণার একটি উদাহরণ ছিলাে কুমিল্লায় বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিকৃতি অপসারণকে কেন্দ্র করে অল ইন্ডিয়া রেডিও’র অপপ্রচার। এই অপপ্রচার চালাতে গিয়ে বলা হয় যে, চারশাে মুসলমান হল আক্রমণ করে এবং মুসলমানরা দুশাে হিন্দু পরিবারের বাড়িঘর লুটপাট ও ধ্বংস করে। এই মিথ্যা সংবাদের প্রতিবাদ করে কুমিল্লার দুই বিখ্যাত উকিল কংগ্রেস নেতা ও গণপরিষদের সদস্য কামিনী কুমার দত্ত ও ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বিবৃতি প্রদান করেন। ১৯৫০ সালের পশ্চিম ও পূর্ববাংলায় ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। সারা বাংলাদেশ অর্থাৎ উভয় বাংলা জুড়ে একই সময়ে এতাে বড়াে দাঙ্গা ইতিপূর্বে অথবা ১৯৫০ এর পর আর সংঘটিত হয়নি।” (ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ’, ঢাকা- ১৯৯৪, পৃষ্ঠা- ১৩৩)
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ পূর্ববঙ্গের সকল কংগ্রেস নেতাই সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে স্বচ্ছ ও বাস্তব দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। পাকিস্তান ও ভারত উভয় রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের বিরুদ্ধেই তাঁদের ছিলাে তীব্র ঘৃণা। স্বদেশভূমি পাকিস্তানকে সাম্প্রদায়িকতা-মুক্ত করার লক্ষ্যে তাঁরা। নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ যেমন অনায়াসে ত্যাগ করেছেন, তেমনি ত্যাগ করেছেন সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক সুবিধাবাদও।
২০২
এ-বিষয়টি একান্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে পৃথক নির্বাচনের বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের মধ্যে।
তখনকার প্রচলিত পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা অমুসলমানদের জন্য নিশ্চয়ই বিশেষ সুবিধাজনক ছিলাে। কারণ, তখন জনসংখ্যার হিসেব অনুসারে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের তিন শাে নয়টি আসেনের মধ্যে অমুসলমানদের জন্য নির্ধারিত ছিলাে বাহাত্তরটি। (বর্ণ হিন্দু৩১, তফসিলী হিন্দু-৩৭, খ্রিষ্টান-১, বৌদ্ধ-২ সর্বমােট-৭২)। অর্থাৎ এই বাহাত্তরটি আসনে বিভিন্ন গােষ্ঠীর অমুসলমানদের ছিলাে নিরঙ্কুশ অধিকার, এগুলােতে মুসলমানদের সঙ্গে তাদের কোনাে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে না। তাই, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলতেই হবে যে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত নেতাদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাই ছিলাে লাভজনক। অথচ, নিজেদের জন্য একান্ত লাভজনক এই ব্যবস্থাটিকে বাতিল করার জন্যই তারা সংগ্রাম করেছিলেন।
অন্যদিকে মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামের মতাে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দলগুলাে এই পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাই বহাল রাখতে চেয়েছিলাে। তারা যুক্ত নির্বাচনকে ইসলাম বিরােধী আখ্যা দিয়ে এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে লেগে গিয়েছিলাে। তারা বলতাে: মুসলমানরা ব্রিটিশ ভারতে পৃথক নির্বাচনের অধিকার আদায় করতে পেরেছিলাে বলেই তাদের পক্ষে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান কায়েম করা সম্ভব হয়েছিলাে। হিন্দু কংগ্রেসীরা বরাবরই পাকিস্তানের দুশমন। পাকিস্তানকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই তারা পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থাটিকে বাতিল করতে চাইছে। এদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের হুঁশিয়ার থাকতে হবে।
শুধু কট্টর ইসলামপন্থীরাই নয়, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দির মতাে পাশ্চাত্য পন্থী নেতাও প্রথমে পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে ছিলেন। পরে অবিশ্যি তিনি তাঁর মত বদল করে যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতির অনুকূলে জোরালাে যুক্তি উত্থাপন করেছিলেন। তিনি এমনও বলেছিলেন যে, পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা পাকিস্তানকে বিভক্ত করে ফেলবে। অবিভক্ত ভারতের মুসলমানরা পৃথক নির্বাচনের অধিকার প্রয়ােগেই ভারত বিভক্ত করে আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তান কায়েম করতে পেরেছিল। পাকিস্তানেও যদি হিন্দুদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা বহাল থাকে, তবে তারাও পাকিস্তানের ভেতরেই আলাদা হিন্দুস্থানের দাবি ওঠাতে পারে। অতএব, পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তন করা প্রয়ােজন।
পাকিস্তান কংগ্রেসের নেতারা কিন্তু এ-রকম কোনাে কূট যুক্তিজালের আশ্রয় নেননি। গােড়া থেকেই তারা সব রকম সাম্প্রদায়িক মতলববাজি থেকে দেশকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন, ব্যক্তিগত সুবিধা ও সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠেই বলিষ্ঠভাবে পৃথক নির্বাচনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। কারণ, সাম্প্রদায়িক স্বার্থের বদলে জাতীয় স্বার্থই ছিলাে তাদের একমাত্র অন্বিষ্ট। পৃথক নির্বাচন প্রথাকে তারা প্রকৃত জাতীয় চেতনা গড়ে ওঠার পক্ষে প্রতিবন্ধক বলে মনে করেছিলেন। মুসলমান অমুসলমানের রাজনৈতিক বিভাগ ও বিভেদ যেমন তাঁরা সমর্থন করতেন না, তেমনি অমুসলমানদের জন্য বর্ণ হিন্দু, তফসিলি হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধের রাজনৈতিক বিভাজনও তাদের দৃষ্টিতে ছিলাে একান্ত অবাঞ্ছিত। তাঁরা চেয়েছিলেন: দেশের রাজনীতি থেকে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু কথা দুটো মুছে যাক, ধর্ম হােক মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণের ব্যাপার, রাষ্ট্র হােক ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক।
২০৩
বলা নিষ্প্রয়ােজন যে, তাদের চাওয়াকে পাকিস্তান রাষ্ট্রে পাওয়ায় পরিণত করা সম্ভব হয়নি। তাই উনিশ শ চুয়ান্নতেও পৃথক নির্বাচন পদ্ধতির অধীনেই নির্বাচনে যােগ দিতে হয়েছিলাে তাদের।
পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে নীতি ও আদর্শগত ব্যাপারে কোনাে বিরােধ ছিলাে বলে মনে হয় না। তবে রণকৌশললের ব্যাপারে কিছু মতভেদ সে সময়ে দেখা দিয়েছিলাে। মনােরঞ্জন ধর, নেলি সেনগুপ্তা, বসন্তকুমার দাস প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ছিলেন কংগ্রেস দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পক্ষে। অন্যদিকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রভাস লাহিড়ি, ত্রৈলােক্যনাথ চক্রবর্তী (মহারাজ) এবং এ-রকম আরাে কয়েকজন নেতা দল হিসেবে কংগ্রেসের বিলুপ্তি চেয়েছিলেন। তাঁদের মতে : পাকিস্তানের কংগ্রেস যেহেতু বাস্তবে হিন্দুদের একটি সংগঠনে পর্যবসিত হয়ে গেছে, তাই এটিকে দিয়ে বৃহত্তর জাতীয় লক্ষ্য সাধন করা যাবে না। এই যুক্তিতেই তারা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু তখনাে এদেশে ক্যুনিস্ট পার্টি ছাড়া অন্য কোনাে সেকুলার পার্টির অস্তিত্ব ছিলােই না বলতে গেলে। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে যেমন মুসলিম’ বাদ পড়েনি, শেরে বাংলার কৃষক শ্রমিক পার্টি তেমনি নামে সাম্প্রদায়িক না হলেও সুস্পষ্ট সেকুলার আদর্শ ধারণ করতে পারেনি। গণতন্ত্রী দল’ নামক রাজনৈতিক দলটিরও তেমন কোনাে সাংগঠনিক ভিত্তি ছিলাে না। তাই কংগ্রেস থেকে-বেরিয়ে-আসা হিন্দু নেতৃবৃন্দ নিজেদেরকে যুক্ত করার মতাে কোনাে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন খুঁজে পেলেন না। নিজেরাও এ-রকম কোনাে সংগঠন গড়ে তুলতে পারলেন না। তা ছাড়া তখনকার পৃথক নির্বাচন পদ্ধতির কারণেই, কংগ্রেসের মতােই, তাদেরও কেবলমাত্র অমুসলমান আসনেই নির্বাচন প্রার্থী হতে হলাে। সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্ট’ নামে যে নির্বাচনী জোটের ঘােষণা তারা দিয়েছিলেন সেটি ছিলাে নিতান্তই নাম সর্বস্ব ও কাগুজে-কার্যকর অস্তিত্বহীন। তবু সে জোটের নামেই আমাদের এলাকায় (নেত্রকোনার দশটি ও কিশােরগঞ্জের আটটি থানা) নির্বাচন-প্রার্থী হলেন মহারাজ’ নামে পরিচিত বিপ্লবী নেতা ত্রৈলােক্যনাথ চক্রবর্তী।
চুয়ান্ন সনের এপ্রিলে ছিলাে আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা। সাধারণ নির্বাচন মার্চে। এ-সময়ে আমার নাকমুখ গুঁজে পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করার কথা। অথচ, তখনই আমি নির্বাচনের প্রচার কাজে মেতে উঠলাম ত্রৈলােক্য মাহারাজের পক্ষে। পরীক্ষার পড়া আপাতত শিকেয় উঠলাে।

Reference: পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন – যতীন সরকার

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!